১৫. রিশানের মনে হল

রিশানের মনে হল সে একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছে। যতদূর চোখ যায় নিচে একটা বিস্তৃত অরণ্য। সবুজ দেবদারু গাছ ঝোঁপঝাড় লতাগুল্ম জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। একটা ছোট নদী কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে। নদীর পানিতে রোদ পড়ে ঝিকমিক করছে। নদীর পানি থেকে হঠাৎ হুস করে ভেসে উঠল একটি মেয়ে দুই হাত উপরে তুলে চিৎকার করে উঠল, বাচাও বাঁচাও আমাকে বাঁচাও

রিশান ছুটে যেতে চাইল নিচে কিন্তু হঠাৎ গাছের লতাগুল্ম তাকে পেঁচিয়ে ধরল সাপের মতো, সে ছুটে যেতে চাইছে কিন্তু যেতে পারছে না। পা বেঁধে পড়ে যাচ্ছে নিচে। মেয়েটি ভেসে যাচ্ছে পানিতে, চিৎকার করে ডাকছে তাকে রিশান–রিশান–রিশান–

রিশান চোখ খুলে তাকাল। চারদিকে চাপা অন্ধকার, তার মাঝে সত্যি সত্যি কেউ ডাকছে তাকে। রিশান তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল, তার উপর ঝুঁকে আছে সানি, ভয়ার্ত গলায় ডাকছে, রিশান রিশান

রিশান শুকনো গলায় বলল, কী হয়েছে সানি?

তুমি বেঁচে আছ? আমি ভেবেছিলাম মরে গেছ।

আমি মরি নি। রিশান উঠে বসার চেষ্টা করে। চোখ তুলে চারদিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছিল আমার?

পড়ে গিয়েছিলে। পুরো পাহাড়টা ভেঙে পড়ে গিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম সবাই মরে যাব আমরা।

রিশান হাতড়ে হাতড়ে যন্ত্রপাতির বাক্সটা বের করে একটা সবুজ মনিটরের দিকে তাকাল, বাইরে তাপমাত্রা কম করে হলেও বিশ ডিগ্রি বেড়ে গেছে। বাইরে নিক্সিরলের পরিমাণ হঠাৎ করে দ্রুত কমতে শুরু করেছে, এভাবে আরো কিছুক্ষণ চলতে থাকলে মনে হয় বিপদ কেটে যাবে। রিশান সানির দিকে তাকিয়ে বলল, সানি, মনে হয় আমরা গ্রুনি কলোনিকে বাঁচিয়ে ফেলেছি।

সত্যি?

হ্যাঁ, এই দেখ নিক্সিরল কত তাড়াতাড়ি কমে আসছে। আর ঘণ্টাখানেকের মাঝে এত কমে যাবে যে কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।

রিশান সানিকে নিজের কাছে টেনে এনে বলল, বাইরে কী অবস্থা অবিশ্যি আমি জানি। আগ্নেয়গিরি থেকে হয়তো গলগল করে লাভা বের হয়ে আমাদের ঢেকে ফেলেছে!

সানি ভয় পাওয়া চোখে রিশানের দিকে তাকাল, সত্যি?

রিশান হাসিমুখে বলল, না সানি। আমি ঠাট্টা করছিলাম।

সানি একটু অবাক হয়ে রিশানের দিকে তাকিয়ে রইল। ঠাট্টা ব্যাপারটি কী সে জানে না। তার সাথে কেউ কখনো ঠাট্টা করে নি।

রিশান আর সানি চুপচাপ দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইল। বাইরে নিশ্চয়ই খুব গরম, তাদের মহাকাশচারীর পোশাকের ভিতরে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। দেয়ালের সাথে লেগে থাকা কিলবিলে জিনিসগুলো ক্রমাগত নড়ছে, হিসহিস এক ধরনের শব্দ হচ্ছে, হঠাৎ হঠাৎ সেটাকে এক ধরনের যন্ত্রণায় কাতর ধ্বনির মতো মনে হয়। ভিতরে এক ধরনের হলুদ রঙের বাষ্পও জমা হচ্ছে, সেটা কী এবং কেন তৈরি হচ্ছে সে সম্পর্কে রিশানের কোনো ধারণা নেই।

রিশান তার যোগাযোগ মডিউলের দিকে তাকাল, মহাকাশযান থেকে হান এবং বিটি, অবাসস্থল থেকে নিডিয়া তার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছে, সে ইচ্ছে করে চ্যানেলটা বন্ধ করে রেখেছে। এখানে গুহার মাঝে বসে তার চ্যানেলটি ভোলার ইচ্ছে করল না। সবকিছু ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে বাইরে গিয়ে সে তাদের সাথে কথা বলবে।

রিশান চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ সময় বসে রইল। সানি সারাদিনের উত্তেজনায় নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে, রিশানের কোলে মাথা রেখে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। রিশান তার মাথায় লাগানো অনুজ্জ্বল আলোটিতে সানির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কৈশোরে সে মহাকাশচারীর কঠোর জীবন বেছে নিয়েছিল, কোনোদিন তাই তার স্ত্রী পুত্র পরিজন হয় নি। সন্তানকে বুকে চেপে ধরে রাখতে কেমন লাগে সে কখনো জানতে পারে নি। কিন্তু নির্বান্ধব জনমানবশূন্য বিষাক্ত একটি গ্রহের বদ্ধ একটি গুহায় বিচিত্র এক ধরনের জীবিত প্রাণীর। কাছাকাছি বসে থেকে দশ বছরের এই শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ তার বুকের ভিতরে এক ধরনের আশ্চর্য অনুভূতির জন্ম হয়

তার ইচ্ছে করতে থাকে গভীর ভালবাসায় শিশুটিকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু সে সেটা করতে পারল না, মহাকাশচারীর পোশাক এত কাছাকাছি এনেও তাদের দুজনকে ধরাছোঁয়ার বাইরে আলাদা করে রেখেছে।

রিশান কতক্ষণ সানির দিকে তাকিয়েছিল সে জানে না, হঠাৎ সামনে তাকিয়ে সে পাথরের মতো জমে গেল। তার কাছাকাছি একটি নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, এত কাছে যে প্রায় হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। রিশান ভালো করে তাকাল, মূর্তিটি অর্ধস্বচ্ছ এবং বর্ণহীন। এই মূর্তিটিকে সে আগে দেখেছে, ছায়ামূর্তিটি সানির মা নারার। রিশান কষ্ট করে নিজেকে শান্ত করে বলল, তুমি কি নারা?

ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ে।

তুমি–তুমি কি কিছু বলতে চাও?

হ্যাঁ, ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ে।

বল।

তোমাকে ধন্যবাদ পৃথিবীর মানুষ। আমাদের বাঁচানোর জন্যে অনেক ধন্যবাদ।

রিশান কী বলবে ঠিক বুঝতে পারল না, হাত নেড়ে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আমি শুধু আমার দায়িত্বটুকু করেছি, তার বেশি কিছু নয়।

ছায়ামূর্তিটি আবার কী একটা বলতে চেষ্টা করে কিন্তু বলতে পারে না। রিশান ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে রইল, ছায়ামূর্তিটি আবার চেষ্টা করল, তবু বলতে পারল না

রিশান নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, তোমার কি কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে?

ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল।

তুমি কি সানিকে কিছু বলতে চাও?

ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল। তারপর খুব কষ্ট করে বলল, হ্যাঁ।

আমি সানিকে ডেকে তুলছি।

রিশান নিজের কোলের উপর শুয়ে থাকা সানির দিকে তাকিয়ে নরম গলায় ডাকল, সানি, দেখ কে এসেছে।

সানি প্রায় সাথে সাথে চোখ খুলে তাকাল, রিশানের দিকে তাকিয়ে ঘুম জড়ানো গলায় বলল, কে এসেছে?

রিশান যত্ন করে সানিকে তুলে বসিয়ে দিয়ে বলল, তোমার মা।

মা! মুহূর্তে সানি পুরোপুরি জেগে উঠে, লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে প্রায় ছুটে যাচ্ছিল, রিশান তাকে ধরে রাখল। সানি চিৎকার করে বলল, তুমি বেঁচে আছ!

নারার ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল। তারপর ফিসফিস করে বলল, সানি, কথা বলতে আমার কষ্ট হচ্ছে, আমি তোমাকে শেষ কথাটি বলে যাই।

কী শেষ কথা?

তুমি যখন পৃথিবীতে যাবে তখন

আমি যাব না। আমি এখানে থাকব।

না সানি। এই গ্রহ মানুষের জন্যে না। তুমি পৃথিবীতে যাবে এবং এই গ্রহের কথা ভুলে যাবে।

না–সানি ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি যাব না।

তুমি যাবে সানি, রিশান তাকে শক্ত করে ধরে রেখে বলল, তুমি অবিশ্যি যাবে।

পৃথিবীতে আমার মা নেই।

এখানেও তোমার মা নেই।

সানি চিৎকার করে ছায়ামূর্তিটিকে দেখিয়ে বলল, এই যে আমার মা।

না, রিশান মাথা নেড়ে বলল, এটা তোমার মা নয়। এটা তোমার মায়ের একটা ছায়ামূর্তি।

ছায়ামূর্তিটি মাথা নেড়ে বলল, সানি। এটা সত্যি কথা। এটা তোমার মায়ের স্মৃতি থেকে তৈরি করা একটা ছায়ামূর্তি। এর মাঝে কোনো প্রাণ নেই

তবু আমি যাব না। সানি ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে।

রিশান সানির হাত ধরে রেখে নরম গলায় বলল, সানি তুমি মানুষ। মানুষকে পৃথিবীতে যেতে হয়, না হয় তার জন্ম অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তুমি যখন যাবে তখন দেখবে পৃথিবীটা কী অপূর্ব। সেখানকার মানুষ কত বিচিত্র আর কী গভীর তাদের ভালবাসা। তুমি মায়ের ভালবাসা হারিয়েছ তাই এখনো গ্রুনি কলোনিতে সেই ভালবাসা খুঁজে বেড়াও। যখন পৃথিবীতে যাবে তখন দেখবে ভালবাসা তোমাকে খুঁজে বেড়াবে–

চাই না চাই না আমি

তুমি চাও সানি। তোমার মাও তাই চায়।

ছায়ামূর্তিটি মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলল, হ্যাঁ সানি, আমিও তাই চাই।

সানি কোনো কথা না বলে তীব্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, তার চোখ আবার পানিতে ভরে আসছে, সবকিছু ঝাঁপসা হয়ে আসছে চোখের পানিতে। তার বুকের ভিতরে এক গভীর শূন্যতা এসে ভর করছে, মনে হচ্ছে কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। কিছু না।

.

রিশান সানিকে নিয়ে সুড়ঙ্গ দিয়ে বের হবার ঠিক আগের মুহূর্তে থমকে দাঁড়াল। গুহাটির মাঝামাঝি এখনো সেই ছায়ামূর্তিটি দাঁড়িয়ে আছে। রিশান একটু ইতস্তত করে বলল, নারা, তোমাদের মাঝে কি লি–রয় আছে?

ছায়ামূর্তিটি মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ রিশান। এই তো আমি।

তুমি? রিশান চমকে উঠে বলল, তুমি তো নারা—

আমি নারা আমি লি–রয় আমি কিশি আমি রন আমি আরো অনেকে

রিশান হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল, বলল তোমরা সবাই এক?

হ্যাঁ। আমরা সবাই এক। আমরা বিশাল একটা মস্তিষ্ক যেখানে সবার নিউরন কাছাকাছি

তোমরা আলাদা আলাদা নও?

না। আমরা এক

তার মানে তার মানে—

তার মানে আমরা মানুষের চাইতেও বুদ্ধিমান হবার ক্ষমতা রাখি রিশান

রিশান হতচকিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। গুহার ভিতরের থলথলে জিনিসটাকে সে চিনতে পেরেছে–এটি দেখতে মানুষের মস্তিষ্কের মতো। বিশাল একটা মস্তিষ্ক মানুষের করোটির মাঝে যেভাবে সাজানো থাকে।

কেন জানি না রিশান হঠাৎ একবার শিউরে ওঠে।