পরের দিন—সে-দিন শনিবার—যখন বেলুনকে আকাশে তোলা হলো তখন আর মাত্র দু-ঘণ্টা চলাবার মতো শক্তি আছে ভিক্টরিয়ার। এর ভেতরে যদি কোনো জলাশয় নাপাওয়া যায়, তাহলে মরুভূমির মরা ধূলোয় মরে পড়ে থাকা ছাড়া আর-কোনো উপায় নেই। তার সর্বগ্রাসী রিক্ততা নিয়ে পড়ে আছে হলুদ মরুভূমি, এমনকী একটু হাওয়াও সে রাখেনি অভিযাত্রীদের ভরসা দেবার জন্যে। রোদ এত প্রখর যে, সেই সকাল বেলাতেই পারা চড়চড় করে উঠে গেলো একশো তেরো ডিগ্রি পর্যন্ত। ফার্গুসন তাকিয়ে দেখলেন, সঙ্গী দু-জন আচ্ছন্নের মতো চোখ বুঝে পড়ে আছেন। একাই তাঁকে শেষ চেষ্টা করতে হবে বাঁচবার। উদভ্রান্তের মতো তিনি চুল্লির আঁচ বাড়িয়ে চললেন, বেলুন উঠে এলো পাঁচ হাজার ফিট। কিন্তু নিচে যেমন ওপরেও তেমনি, একটুও হাওয়া নেই। সোজা ওপরে চলে এলো বেলুন মস্ত এক লম্বের মতে, একচুলও এদিক-ওদিক নড়লো না, তারপর একসময়ে সব গ্যাস সংকুচিত হয়ে ফের সেই খাঁ-খাঁ বালিতেই নেমে এলো, যেখান থেকে উঠেছিলো ঠিক সেখানেই।
বেলা তখন দুপুর। এখান থেকে পাঁচশো মাইল দূরে চাড় হ্রদ, আর পশ্চিম উপকূলও প্রায় চারশো মাইল দূরে অবস্থিত।
ধীরে-ধীরে বেলা গড়িয়ে গিয়ে রাত এলো : আজ আর কেউ রাতের বেলায় পাহারা দেবার কথা ভাবলেন না, অথচ কারু চোখেই কিন্তু ঘুম নেই।
পরদিন প্রায় আধপাত্র আন্দাজ জল বাকি থাকলো। ঐ শেষ জলবিন্দুটুকু স্পর্শ করা হবে না বলে ঠিক হলো। আকাশ ঝকঝক করছে, তেমনি নিমেঘ আর অগ্নিক্ষরা।
সন্ধের দিকে জো-র ভিতর পাগলামির লক্ষণ দেখা দিলো। মুঠো মুঠো বালি তুলে সে বলতে লাগলো, আঃ কী ঠাণ্ডা জল। তারপর মুখে পুরেই থুঃ থুঃ করে ফেলে। দিতে লাগলো, নাঃ, বড্ড বেশি নোনা জল–কিছুতেই পান করা যায় না। চোখের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে গেছে তার—চারদিকের বিস্তীর্ণ বালুকাকে সে বার-বার ভুল করতে লাগলো নীল সমুদ্র বলে।
ফার্গুসন আর কেনেডি পড়ে আছেন অসাড়। হামাগুড়ি দিয়ে জো দোলনার দিকে এগিয়ে গেলো। বোতলের জলের শেষ তলানিটুকু সে পান করবেই, না-হলে যেন এক্ষুনি পুড়ে ছাই হয়ে যাবে তার হৃৎপিণ্ড! তীব্র ইচ্ছাশক্তির বলে সে অবশ হাত নিয়েই বোতলটাকে কাছে টেনে নিলে, তারপর ঠোঁটের কাছে তুলে ধরতেই কানে শুনলো, আমায় একটু দাও, আমায় একটু!
তাকিয়ে দ্যাখে, কেনেডিও হামাগুড়ি দিয়ে পাশে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। কোনো কথা না-বলে সে তার হাতে তুলে দিলে বোতলটি মূহূর্তে সবটুকু জল নিঃশেষে গলায় ঢেলে দিলেন কেনেডি। ফ্যাল ফ্যাল করে জ্বালাধরা চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো জো। তারপর দু-জনেই জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলেন বালির মধ্যে।
কীভাবে যে সেই ভীষণ রাত কাটলো, কেউ তা জানে না। সকালে মনে হলো সারা শরীর যেন দুমড়ে যাচ্ছে, কে যেন শুষে নিচ্ছে শরীরের সমস্ত রক্ত, সব রক্ত নিংড়ে নিয়ে কেবল খোশার মতো শরীরটা ফেলে দিয়ে যাবে সে। ভীষণ এক প্রেত সে, তীব্র তার চাহিদা, নাম তার পিপাসা—সে-ই সবাইকে ছিবড়ের মতো ফেলে রেখে যাবে, সব রক্ত নিঃশেষে পান করে। জ্ঞান হতেই ওঠবার চেষ্টা করলে জো, কিন্তু কিছুতেই পারলে না। ফার্গুসন গুটিশুটি মেরে অসাড়ে পড়ে আছেন, কপালে উঠে আসতে চাচ্ছে তাঁর চোখের তারা। কেনেডির অবস্থা আরো ভীষণ : অনবরত মাথা ঝাকিয়ে চলেছেন তিনি, চোখের শাদা অংশটা রক্তের চাপে টকটকে লাল হয়ে গেছে। হাঠাৎ তার চোখ পড়লো দোলনার গায়ে রাখা রাইফেলটার দিকে
অমনি এক অদ্ভুত দীপ্তিতে মুহুর্তের জন্যে সারা মুখ ভরে গেলো তার, চকচক করে উঠলো চোখের তারা। অমানুষিক প্রচেষ্টায় তিনি এগিয়ে গিয়ে রাইফেলটাকে তুলে নিয়ে মুখের মধ্যে নলটা ঢুকিয়ে দিলেন। এবার ঘোড়ায় চাপ দিয়ে তিনি তার জীবনের শেষ শিকার সমাধা করবেন। ট্রিগারের উপর তার শিথিল আঙুল এসে পড়লো।
ও কী করছেন, থামুন! থামুন! থামুন! বলে কেনেডির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো জো। রাইফেলটা নিয়ে প্রবল ঝুটোপাটি শুরু হয়ে গেলো দু-জনের।
কেনেডি ভীষণ গলায় রুক্ষভাবে শাসিয়ে উঠলেন, সাবধান, জো, যদি ভালো চাও তো শিগগির ছেড়ে দাও, নয়তো তোমাকেই আমি গুলি করে মারবো।