১৫শ অধ্যায়
মুনিমানরক্ষার্থ অর্জুনের ব্রহ্মাস্ত্রোপসংহার
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তখন মহাবীর ধনঞ্জয় সেই হুতাশনসদৃশ তেজঃপুঞ্জকলেবর তাপসদ্বয়কে দর্শন করিবামাত্র অতিমাত্র ব্যগ্রচিত্তে স্বীয় দিব্যাস্ত্র প্রতিসংহার করিবার মানসে কৃতাঞ্জলিপুটে তঁহাদিগকে কহিলেন, “আমি অশ্বত্থামার অস্ত্রবেগ নিবারণ করিবার মানসেই দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করিয়াছি। এক্ষণে উহার প্রতিসংহার করিলে নিশ্চয়ই পাপাত্মা অশ্বত্থামা স্বীয় অস্ত্রপ্রভাবে আমাদিগের সকলকে ভস্মাবশেষ করিবে। অতএব যাহাতে আমাদিগের ও লোকের মঙ্গল হয় আপনারা তাহার মন্ত্রণা করুন।” মহাত্মা ধনঞ্জয় এই বলিয়া স্বীয় অস্ত্র প্রতিসংহৃত করিলেন। ঐ অস্ত্র প্রতিসংহার করা দেবগণেরও অসাধ্য। অন্যের কথা দূরে থাকুক, দেবরাজ ইন্দ্রও উহার প্রতিসংহারে সমর্থ নহেন। ঐ দিব্যাস্ত্র ব্রহ্মতেজোদ্বারা বিনির্মিত। ব্রহ্মচারী ভিন্ন অন্য ব্যক্তি উহা প্রয়োগ করিলে আর প্রতিসংহার করিতে সমর্থ হয় না। ব্রহ্মচর্য্যবিহীন অশিক্ষিত ব্যক্তি ঐ অস্ত্রের প্রতিসংহারে চেষ্টা করিলে উহা উৎক্ষণাৎ তাহারই মস্তক ছেদন করে। মহাবীর ধনঞ্জয় সত্যব্রতপরায়ণ, ব্রহ্মচারী ও গুরুশুশ্রুষাপরতন্ত্র ছিলেন বলিয়াই সেই অস্ত্রের প্রতিসংহারে সমর্থ হইলেন। তিনি ইতিপূর্বে ঘোরতর বিপদগ্রস্ত হইয়াও কখন ঐ অস্ত্র প্রয়োগ করেন নাই।
হে মহারাজ! ঐ সময়ে দ্রোণতনয় মহাবীর অশ্বত্থামা সেই ঋষিদ্বয়কে পুরোবৰ্ত্তী অবলোকন করিয়া কোনক্রমেই স্বীয় ঘোরতর অস্ত্রের প্রতিসংহারে সমর্থ হইলেন না। তখন তিনি অতি দীনমনে দ্বৈপায়নকে কহিলেন, “মুনিসত্তম! আমি ভীমসেনের ভয়ে ভীত ও নিতান্ত বিপন্ন হইয়াই প্রাণরক্ষার্থে এই অস্ত্র প্রয়োগ করিয়াছি। ভীমসেন সমরাঙ্গনে দুৰ্য্যোধনের বিনাশার্থ কপট ব্যবহার দ্বারা অতি অধর্ম্মকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছে। আমি সেই কারণে পৃথিবী পাণ্ডবশূন্য করিব বলিয়া এই দুরাসদ দিব্যাস্ত্রে ব্ৰহ্মতেজ নিহত করিয়া ইহা প্রয়োগ করিয়াছি; কিন্তু এক্ষণে ইহার প্রতিসংহারে সমর্থ হইতেছি না। হে ব্রহ্মন! আমি রাগোন্মত্ত হইয়া পাণ্ডবদিগের বিনাশার্থ অস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া অতি কুকৰ্ম্ম করিয়াছি, সন্দেহ নাই। এক্ষণে এই অস্ত্র নিশ্চয়ই পাণ্ডবগণকে বিনাশ করিবে।”
অশ্বত্থামার পরাজয়স্বীকার-মস্তকমণিপ্রদান
তখন বেদব্যাস কহিলেন, “বৎস! মহাত্মা অৰ্জ্জুন ব্রহ্মশির অস্ত্র বিদিত থাকিয়াও কদাচ তোমার বিনাশের নিমিত্ত রোষভরে উহা পরিত্যাগ করেন নাই। এক্ষণে কেবল তোমার অস্ত্র-নিবারণের নিমিত্তই ঐ অস্ত্র প্রয়োগ করিয়াছেন; অচিরাৎ উহার প্রতিসংহারও করিয়াছেন। ঐ মহাত্মা তোমার পিতার নিকট ব্রহ্মাস্ত্র প্রাপ্ত হইয়াও কদাচ ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম হইতে বিচলিত হয়েন নাই। মহাবীর অর্জুন ধৈৰ্যশালী সাধু ও সৰ্বাস্ত্রবিশারদ; তুমি কি নিমিত্ত তাহাকে তাহার ভ্রাতা ও বন্ধুগণের সহিত বিনাশ করিতে বাসনা করিয়াছ? যে রাজ্যে দিব্যাস্ত্র দ্বারা ব্রহ্মাস্ত্র নিরাকৃত হয়, সে রাজ্যে দ্বাদশ বৎসর অনাবৃষ্টি হইয়া থাকে। এই জন্য মহাবীর অর্জুন ক্ষমতাপন্ন হইয়াও প্রজাগণের হিতার্থ তোমার অস্ত্র বিনষ্ট করিলেন না। হে দ্রোণতনয়! এক্ষণে আপনাকে, পাণ্ডবগণকে ও তাঁহাদের রাজ্য রক্ষা করা তোমার অবশ্য কর্ত্তব্য। অতএব তুমি অবিলম্বে দিব্যাস্ত্র প্রতিসংহারপূর্ব্বক ক্রোধশূন্য হও; পাণ্ডবগণও নিরাপদ হউক। রাজর্ষি যুধিষ্ঠির কখনই অধর্ম্মানুসারে বিজয় বাসনা করেন না। এক্ষণে তুমি পাণ্ডবগণকে স্বীয় মস্তকস্থিত মণি প্রদান কর। উঁহারা সেই মণি গ্রহণ করিয়া তোমার প্রাণ দান করিবেন।”
তখন অশ্বত্থামা কহিলেন, “মহর্ষে! পাণ্ডব ও কৌরবগণের যে সকল ধনরত্ন আছে, তৎসমুদয় অপেক্ষা আমার এই মণি শ্রেষ্ঠ। ইহা ধারণ করিলে অস্ত্রভয়, ব্যাধিভয় ও ক্ষুধা এককালে তিরোহিত হইয়া যায় এবং দেব, দানব, পন্নগ, রাক্ষস ও তস্কর হইতে শঙ্কার লেশমাত্র থাকে না। অতএব এই মণি কোনরূপেই পরিত্যাগ করিবার উপযুক্ত নহে, কিন্তু আপনি যাহা কহিতেছেন, তাহাও আমার সর্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। এক্ষণে এই মণি বিদ্যমান আছে, আমিও উপস্থিত রহিয়াছি, আপনার যাহা ইচ্ছা হয় করুন, কিন্তু এই অমোঘ ঈষীকাস্ত্র পাণ্ডবতনয়দিগের মহিলাগণের গর্ভস্থ সন্তানসন্ততির উপর নিপতিত হইবে। আমি কোনক্রমেই এই অস্ত্র প্রতিসংহার করিতে সমর্থ হইতেছি না।”
তখন বেদব্যাস কহিলেন, “হে দ্রোণপুত্র। এক্ষণে পাণ্ডবতনয়দিগের কামিনীগণের গর্ভে অস্ত্র নিক্ষেপ করাই তোমার কৰ্ত্তব্য; আর অন্য ইচ্ছা করিও না।” মহাত্মা বেদব্যাস এই কথা কহিলে দ্রোণতনয় পাণ্ডবতনয়দিগের মহিলাগণের গর্ভ উদ্দেশ করিয়া সেই দিব্যাস্ত্র পরিত্যাগ করিলেন।