গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

১৫. মায়াজাল

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ – মায়াজাল

নগর পত্তনের ঘাটে বাটে পরিভ্রমণ কালে বজ্র কুহুকে কয়েকবার দেখিয়াছিল। কুহুকে সে রানীর দাসী বলিয়া চিনিত না; কারণ কুহু যখন রানীর দোলার সহিত যাইতেছিল তখন বজ্রের দৃষ্টি তাহার উপর পড়ে নাই, রানীর উগ্রোজ্জ্বল রূপশিখা তাহার চক্ষু আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল। কুহুকে সে ভাল করিয়া দেখিল একদিন দ্বিপ্রহরে। বজ্র মৌরীর এক ঘাটের পাশে বাঁধের উপর বসিয়া ছিল, ঘাটে আর কেহ ছিল না। সহসা একটি কিশলয়-শ্যামাঙ্গী যুবতী নৃত্যচটুল ছন্দে নূপুর বাজাইয়া নদীর কিনারায় নামিয়া আসিল এবং বজ্রের দিকে একটি ক্ষিপ্র গোপন কটাক্ষপাত করিয়া বেশবাস বর্জন করিতে প্রবৃত্ত হইল। প্রথমে উত্তরীয়টি খসিয়া সোপান পটের উপর পড়িল, তারপর পড়িল কটির ধটি; তারপর যুবতী যখন কাঁচুলির গ্রন্থি খুলিতে উদ্যত হইল তখন বজ্র উঠিয়া রণে ভঙ্গ দিল। নগর-বিলাসিনীদের নিরংশুকা হইয়া স্নান করাই হয়তো বিধি, কিন্তু বজ্র তাহা বসিয়া দেখিতে লজা বোধ করিল।

ইহার পর আরও কয়েকবার কুহুর সহিত বজ্রের সাক্ষাৎ হইল। কখনও নির্জন প্রাকারের উপর, কখনও জনবহুল রাজপথে। কুহু স্মিত-ভঙ্গুর নেত্রপাতে বজ্রকে নিরীক্ষণ করিত, চোখের সঙ্কেতে তাহাকে ডাকিত। কথা বলিত না, রিমঝিম মঞ্জীর বাজাইয়া চলিয়া যাইত, যাইতে যাইতে পিছু ফিরিয়া আবার চোখের ইঙ্গিতে ডাকিত। কিন্তু বজ্র নাগরিক নয়, সে হয়তো কুহুর চোখের আহ্বান বুঝিতে পারিত না, কিম্বা বুঝিতে পারিলেও আহ্বান উপেক্ষা করিত।

একদিন বৈকালে কালবৈশাখীর প্রবল ঝড় বৃষ্টি হইয়া যাইবার পর আকাশ পরিষ্কার হইয়া গিয়াছিল। সন্ধ্যার প্রাক্কালে বজ্র তাহার অভ্যস্থ স্থানে না বসিয়া একটি গোলাকৃতি উচ্চ চত্বরের উপর গিয়া বসিল। সমুদ্রগ্রামী বহিত্রগুলি যেখানে ভিড় করিয়া গুণবৃক্ষের অরণ্য রচনা করিয়াছে সেখানে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা যায়; ঝড়ের দাপটে দুই চারিটি তরণীর আড়কাঠ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে, রজ্জু ছিঁড়িয়া জট পাকাইয়া গিয়াছে। একটি তরণী কাত হইয়া পড়িয়া অন্য তরণীর গুণবৃক্ষের সহিত আপন গুণবৃক্ষ আশ্লিষ্ট করিয়া বিপজ্জনক সংস্থার সৃষ্টি করিয়াছে।

এতদিন নৌকাগুলিতে নাবিক বা দিশারু কাহাকেও দেখা যাইত না। আজ দেখা গেল কয়েকটি নৌকার পট্টপত্তনের উপর নাবিকেরা কাজ করিতেছে, সম্ভবত শোধনসংস্কারের চেষ্টা করিতেছে। বজ্র আগ্রহের সহিত দেখিতে লাগিল।

বজ্র যে চত্বরে উপবিষ্ট ছিল সেই চত্বরে আর একজন লোক বসিয়া ব্যাকুল চক্ষে নৌকাগুলির পানে চাহিয়া আছে, বজ্র তাহা লক্ষ্য করে নাই। লোকটির বয়স অনুমান চল্লিশ বৎসর; দেহ এককালে স্থূল ছিল, এখন শীর্ণ ও লোলচর্ম হইয়া গিয়াছে। মুখে আভিজাত্যের চিহ্ন বর্তমান, কিন্তু বেশভূষার পরিপাট্য নাই; স্কন্ধের উত্তরীয়টি মলিন। দেখিলে মনে হয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, কিন্তু সম্প্রতি দুর্দশায় পড়িয়াছে।

লোকটি সহসা ‘হায় হায়’ করিয়া উঠিল।

বজ্র চমকিয়া তাহার দিকে ফিরিতেই লোকটি যেন চেতনা ফিরিয়া পাইল এবং অত্যন্ত লজ্জিত কণ্ঠে বলিল— ‘ক্ষমা করুন, আমি আত্মসংবরণ করতে পারি নি।’

বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘কি হয়েছে?’

লোকটি কাতর স্বরে বলিল— ‘এ বছরও আমার বুহিত্ত সমুদ্রে যেতে পারবে না। বর্ষা এসে পড়ল, আর কবে যাবে?’

বজ্র বুঝিল, এ ব্যক্তি কোনও সমুদ্রগামী তরণীর স্বামী। সে তাহার কাছে আসিয়া বসিল। বলিল— ‘আপনার নৌকা সমুদ্রে যেতে পারবে না কেন?’

লোকটি বোধহয় নিজের দুঃখের কথা কাহাকেও বলিবার সুযোগ পায় না, সে অতিশয় আপ্যায়িত হইয়া বলিল— ‘আপনি দেখছি মরমী সৎপুরুষ। কানসোনায় কি নূতন এসেছেন?’

‘হাঁ। আপনি বুঝি নৌ-বণিক?’

‘হাঁ। আমার নাম বরুণ দত্ত। কিন্তু কানসোনার লোক আমাকে চারু দত্ত বলে ডাকে।’ বলিয়া বরুণ দত্ত করুণ হাসিল।

বজ্র নাটকীয় শ্লেষ বুঝিল না, বলিল— ‘আপনার ডিঙা আছে?’

বরুণ দত্ত অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল— ‘ঐ যে ঘাটের বাঁয়ে দুটি হংসমুখী ডিঙা, ও দুটি আমার ডিঙা।’

বজ্র আবার প্রশ্ন করিল— ‘কিন্তু ওদের সমুদ্রে যেতে বাধা কি?’

তখন বরুণ দত্ত তাহার দুঃখের কাহিনী বজ্রকে শুনাইল।

বরুণ দত্ত পুরুষানুক্রমে সমুদ্রগামী ব্যবসায়ী, পূর্বকালে তাহাদের অনেকগুলি বহিত্র ছিল, গৌড়বঙ্গের পণ্য লইয়া বহুদূর পর্যন্ত যাত্রা করিত। দক্ষিণে সিংহল অতিক্রম করিয়া ভরুকচ্ছ যাইত, কখনও পারসীকদের দেশে যাইত। পূর্বদিকে মলয় যবদ্বীপ সুবর্ণভূমিতে যাইত। শতাব্দীর পর শতাব্দী এইভাবে চলিয়াছে, গৌড়বঙ্গ পুণ্ড্রমগধের পণ্যসম্ভার দেশ দেশান্তরে সঞ্চারিত হইয়া স্বর্ণ রৌপ্যের আকারে প্রত্যাবর্তন করিয়াছে।

প্রায় বিশ বছর পূর্বে হঠাৎ এক নিদারুণ বাধা উপস্থিত হইল, সমুদ্রে হিংস্রিকা দেখা দিল। এতকাল সমুদ্রে জলদস্যুর উৎপাত ছিল না, সকল দেশের বাণিজ্য-তরী স্বচ্ছন্দে সাগরবক্ষে বিচরণ করিত; এখন বনায়ু দেশের দস্যুরা সমুদ্রের পথ বিপদ-সঙ্কুল করিয়া তুলিল। নিরীহ নিরস্ত্র পণ্যবাহী জাহাজ লুঠ করিয়া ডুবাইয়া ছারখার করিয়া দিতে লাগিল। তাহাদের দৌরাত্ম্যে গৌড়বঙ্গের সাগরসম্ভবা লক্ষ্মী আবার সাগরে ডুবিতে বসিলেন।

গত বিশ বছরে গৌড়ের নৌ-বাণিজ্য ক্রমশ সঙ্কুচিত হইয়া দক্ষিণে সিংহল ও পূর্বে সুবর্ণভূমি পর্যন্ত দাঁড়াইয়াছিল, কিন্তু তাহাও বুঝি আর থাকে না। আরব জলদস্যুদের দুর্নিবার অভিযান বঙ্গোপসাগরের জল তোলপাড় করিয়া তুলিয়াছে।

বরুণ দত্তের সপ্তদশ ডিঙা ছিল, এখন মাত্র দুইটি অবশিষ্ট আছে, বাকিগুলি ভরাডুবি হইয়াছে। নাবিকেরা সমুদ্রে যাইতে চায় না; নৃশংস জলদস্যুর হাতে প্রাণ দিবার জন্য কে সমুদ্রে যাইবে? বণিকেরা বেতন দিয়া সৈন্য সংগ্রহ করিতে চায়, কিন্তু বাঙ্গালী সৈন্য সমুদ্রে যুদ্ধ করিতে অভ্যস্ত নয়,* বেতনের লোভেও তাহারা নৌ-যুদ্ধে যাইতে অসম্মত। রাজশক্তি নিশ্চেষ্ট উদাসীন, রাজা থাকিয়াও নাই। বাংলার বন্দরে বন্দরে বাঙ্গালীর নৌ-বাহিনী পঙ্কবদ্ধ হস্তিযূথের ন্যায় নিশ্চল; নদীর মোহানা পার হইয়া সাগরের নীল জলে ভাসিবার সাহস কাহারও নাই।

বরুণ দত্ত গত দুই বৎসর তাহার তরণী দুটিকে সমুদ্রে পাঠাইতে পারে নাই। এবার কয়েকজন বণিক মিলিয়া কিছু নাবিক ও সৈন্য সংগ্রহ করিয়াছিল, স্থির করিয়াছিল তাহাদের তরণীগুলিকে রণসাজে সজ্জিত করিয়া একসঙ্গে সমুদ্রে পাঠাইবে; তাহাতে জলদস্যুর হাত হইতে নিস্তার পাইবার সম্ভাবনা আছে। বরুণ দত্ত অতি কষ্টে কয়েকটি যোদ্ধা সংগ্রহ করিয়াছিল; কিন্তু কালবৈশাখীর ঝড়ে তাহার তরণী দুটি আহত হইয়াছে, শোধনসংস্কার করিতে সময় লাগিবে। এদিকে বর্ষা আসন্ন, অন্য তরণীগুলি অপেক্ষা করিতে পারিবে না। সুতরাং এবারও বরুণ দত্তের নৌকা সমুদ্রে যাইতে পারিবে না।

বরুণ দত্ত যখন তাহার কাহিনী শেষ করিল, তখন সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইয়া আকাশে তারা ফুটিয়াছে। গভীর নিশ্বাস ফেলিয়া বরুণ দত্ত বলিল— ‘আমার মন্দ দশা যাচ্ছে। ধন সম্পত্তি প্রায় সবই গিয়েছে; শেষ পর্যন্ত বোধহয় কিছুই থাকবে না।’

বরুণ দত্ত নিজের সম্বন্ধে যাহা বলিল তাহা যে সমগ্র দেশের পক্ষে সত্য তাহা সে জানিত না।

বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘অন্য নৌকাগুলি কবে যাত্রা করবে?’

বরুণ দত্ত বলিল— ‘পরশু ঊষাকালে। মঙ্গলের ঊষা বুধে পা— সেদিন ত্রয়োদশী তিথিও আছে।’

‘এই সময়ের মধ্যে আপনার ডিঙা প্রস্তুত হবে না?’

‘হয়তো হতে পারে। কিন্তু আর এক বিপদ ঘটেছে। যে-সব যোদ্ধা নৌকায় যেতে সম্মত হয়েছিল তারা এখন পশ্চাৎপদ হয়েছে। তারা বলছে, ভাঙা নৌকা, বর্ষাকাল এসে পড়েছে— এখন তারা যাবে না। এ বিপদ কেবল আমার নয়, অন্য নৌকায় যে-সব যোদ্ধা যাচ্ছিল তারাও গণ্ডগোল করছে।’

অতঃপর কৃষ্ণপক্ষের রাত্রি গাঢ় হইতেছে দেখিয়া বজ্র উঠিল। হতাশ বরুণ দত্ত ঘাটেই বসিয়া রহিল।

রাত্রে কর্ণসুবর্ণের পথে আলোক নাই, কদাচিৎ কোনও গৃহস্থের মুক্ত দ্বার বা গবাক্ষপথে একটু আলোর প্রভা আসিয়া রাজপথে পড়িয়াছে। রাত্রে কোনও নাগরিককে কোথাও যাইতে হইলে উল্কা জ্বালিয়া পথ চলিতে হয়। বজ্র নক্ষত্রের আলোকে অতি যত্নে পথ চিনিয়া বাসস্থানে ফিরিয়া আসিল।

বটেশ্বরের মদিরাগৃহে অতিথির ভিড় কমিয়াছে, মাত্র দুই চারিজন ঝুনা খেলোয়াড় প্রদীপের মিটিমিটি আলোতে অক্ষবাট ঘিরিয়া বসিয়া খেলিতেছে এবং ভর্জিত সহযোগে মদ্যপান করিতেছে। আলো বেশি নয়, ঘরের কোণে কোণে ছায়া জমিয়াছে, কিন্তু সেজন্য কাহারও অসুবিধা নাই; এইরূপ আলোতেই তাহারা অভ্যস্ত।

ঘরের একটি কোণ হইতে নিম্নস্বর বাক্যালাপের গুঞ্জন আসিতেছিল, বজ্র ঘরে প্রবেশ করিতেই তাহা বন্ধ হইল। বজ্র নিজ প্রকোষ্ঠের দিকে যাইতে যাইতে একবার সেই দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল। দেখিল কোণের ছায়ান্ধকারে তিনজন লোক বসিয়া আছে, যেন ঘনিষ্ঠভাবে বসিয়া কোনও গুপ্তকথার আলোচনা করিতেছে। তাহাদের মধ্যে একজন অপরিচিত, বাকি দুইজন বটেশ্বর ও বিম্বাধর। তিনজনেই বজ্রকে দেখিয়া একদৃষ্টে তাহার পানে চাহিয়া রহিল। তাহাদের নিষ্পলক দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যে বজ্র থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।

তিনজনের মধ্যে বিম্বাধরই প্রথম আত্মসংবরণ করিল; ত্বরিতে উঠিয়া আসিয়া কৌতুকের ভঙ্গিতে বলিল— ‘কি বন্ধু মধুমথন, তুমি যে দেখি নিশাচর হয়ে উঠলে! কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’

বজ্র বলিল— ‘হাতিঘাটে বসেছিলাম।’

‘ভাল ভাল। তা এস না, দু’ পাত্র মধু পান করা যাক। বটেশ্বর অনুযোগ করছিল তুমি কিছুই পান কর না। এতে যে ওর মদিরা-ভবনের নিন্দা হবে।’

‘আমার পক্ষে ভোজনই যথেষ্ট।’

‘তা কি হয়? মধুপান না করলে নাগর হওয়া যায় না। এস এস।’

‘না, আজ নয়।’

বিম্বাধর একবার বটেশ্বর ও অপরিচিত ব্যক্তির সহিত দৃষ্টি বিনিময় করিল, তারপর বলিল— ‘তবে থাক। কাল কিন্তু আমি আবার আসব। একটু আসব-সেবা করে একসঙ্গে ভ্রমণে বাহির হব। কেমন?’

বজ্র কিছু বলিল না। বিম্বাধর প্রস্থান করিলে সেও নিজ কক্ষে প্রবেশ করিল। বটেশ্বর ও অপরিচিত ব্যক্তি তখন আবার নিম্নস্বরে আলাপ আরম্ভ করিল। তাহাদের ভাবগতিক দেখিয়া মনে হয় তাহারা বজ্র সম্বন্ধেই গূঢ় আলোচনা করিতেছে।

দুই দণ্ড মধ্যে বজ্র আহারাদি সম্পন্ন করিয়া শয়ন করিল। ক্রমে বটেশ্বরের মদিরাগৃহ নিঃশব্দ হইল, অতিথিরা প্রস্থান করিয়াছে। বজ্রের একটু তন্দ্রাবেশ হইয়াছে এমন সময় দ্বারে খুট্‌খুট্‌ শব্দ শুনিয়া তাহার তন্দ্রা ছুটিয়া গেল, সে চকিতে শয্যায় উঠিয়া বসিল।

কিছুক্ষণ শব্দ নাই। বজ্র উৎকর্ণ হইয়া রহিল। তারপর আবার বাহিরের দিকের দ্বারে মৃদু করাঘাত হইল। যে দ্বার দিয়া একেবারে পথে পড়া যায় সেই দ্বারে কেহ টোকা দিতেছে।

ঘরের কোণে দীপ স্তিমিত হইয়াছিল। বজ্র উঠিয়া দীপ উস্কাইয়া দিল, তারপর সন্তর্পণে দ্বারের হুড়ুক্ক খুলিল।

দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া আছে একটি যুবতী। রাত্রির মতই গাঢ় নীল তার বসন; এক হস্তে প্রদীপ, অন্য হস্তে অঞ্চল দিয়া প্রদীপের শিখাটিকে আড়াল করিয়া রাখিয়াছে। প্রদীপের নিরুদ্ধ প্রভা যুবতীর বক্ষে কণ্ঠে পড়িয়াছে, মুখের নিম্নার্ধ আলোকিত করিয়াছে। বাহিরে ছায়া, ভিতরে আলো।

বজ্র কুহুকে দেখিয়াই চিনিয়াছিল, সে ক্ষণকাল বিস্ময়-বিমূঢ় রহিল। সেই ফাঁকে কুহু ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।

বজ্র চমকিয়া বলিয়া উঠিল— ‘এ কি! কে আপনি?’

কুহু মাথার গুণ্ঠন সরাইয়া বিলোল চক্ষে বজ্রের পানে চাহিল, ওষ্ঠাধর মুকুলিত করিয়া অধরে অঙ্গুলি রাখিল। তারপর ক্ষিপ্রদৃষ্টিতে একবার ঘরের চারিদিক দেখিয়া লইয়া মৃদুকণ্ঠে বলিল— ‘আমাকে চিনতে পারছেন না?’

বজ্র দৃঢ়ভাবে নিজেকে আত্মস্থ করিল, সাবধানে বলিল— ‘বোধহয় দু’ একবার দেখেছি। আপনি কে তা জানি না।’

কুহু হাসিল। নিঃশব্দ হাসির তরল তরঙ্গে তাহার সমস্ত দেহ যেন হিল্লোলিত হইয়া উঠিল। সে কুহক-কলিত স্বরে বলিল— ‘আমার নাম কুহু। কিন্তু আমাকে অত সম্মান করে কথা বলবেন না। আমি সামান্যা নারী।’

কুহু প্রদীপটি মাটিতে নামাইয়া রাখিল, বজ্রের কাছে আসিয়া প্রগল্‌ভ হাসিয়া বলিল— ‘আমার পরিচয় নিলেন, কৈ নিজের পরিচয় তো দিলেন না।’

বজ্র এক পা পিছু হটিয়া বলিল— ‘আমার নাম— মধুমথন। কর্ণসুবর্ণে নূতন এসেছি।’

কুহু ওষ্ঠাধর বিভক্ত করিয়া হর্ষোৎফুল্ল চোখে চাহিয়া রহিল, অর্ধস্ফুট স্বরে যেন নিজ মনেই বলিল— ‘মধুমথন— কি মিষ্টি নাম। আপনি যে নগরে নূতন এসেছেন তা অনেক আগেই বুঝেছি। নগরে যারা নাগর আছে আপনি তাদের মত নন।’

কুহু পরিতৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিল। এদিক ওদিক চাহিয়া ঘরের কোণে জলের কুম্ভ দেখিয়া সেইদিকে গেল, ঘটিতে জল ঢালিয়া জল পান করিল। তারপর বজ্রের শয্যার এক পাশে গিয়া বসিল। কোনও সঙ্কোচ নাই, এ যেন তাহার নিজেরই ঘর।

বজ্র নির্বাক হইয়া দেখিতে লাগিল। গভীর রাত্রে নিভৃত শয়নকক্ষে এই প্রগল্‌ভা অভিসারিকার আকস্মিক অভিযান, এরূপ সংস্থা তাহার কল্পনাতীত। যুবতীর অভিপ্রায় সম্বন্ধেও বিশেষ সংশয়ের অবকাশ নাই। বজ্রের কর্ণদ্বয় উত্তপ্ত হইয়া উঠিল, বুকের রক্ত তোলপাড় করিতে লাগিল।

সে সহসা বলিয়া উঠিল— ‘আমার কাছে কি চাও?’ তাহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ ঘরের মধ্যে উচ্চ শুনাইল।

কুহু অমনি ঠোঁটের উপর অঙ্গুলি রাখিয়া তাহাকে সতর্ক করিয়া দিল, চাপা গলায় বলিল— ‘ছি, ছি, অত জোর গলায় কি রহস্যালাপ করতে আছে? এখনি কে শুনতে পাবে। আসুন, কাছে এসে বসুন।’ বলিয়া নিজের পাশে শয্যা নির্দেশ করিল।

বজ্র একটু ইতস্তত করিয়া শয্যার অন্য প্রান্তে গিয়া বসিল। কুহু তাহা দেখিয়া মিষ্ট-দুষ্ট হাসিল, বজ্রের দিকে সরিয়া আসিয়া ঈষৎ গাঢ় স্বরে বলিল— ‘আমি কী চাই তা কি এখনও বুঝতে পারেন নি?’

বজ্র কিছুক্ষণ বুকে ঘাড় গুঁজিয়া রহিল, তারপর রুদ্ধ কণ্ঠে বলিল— ‘নগরে নাগরের অভাব নেই।’

কুহু বজ্রের আরও কাছে সরিয়া আসিল, চক্ষু দিয়া তাহার সর্বাঙ্গ লেহন করিয়া বলিল— ‘নগরে কুকুরেরও অভাব নেই, কিন্তু বনের বাঘ কটা আছে? আপনি আমার মধু-নাগর। আমার লজ্জা নেই। আপনি আমার প্রতি সদয় হোন।’

বজ্র পূর্ববৎ বুকে ঘাড় গুঁজিয়া বলিল— ‘না।’

কুহুর মুখ একটু মলিন হইল। সে ক্ষণকাল পরে জিজ্ঞাসা করিল— ‘আমাকে কি আপনার ভাল লাগে না?’

বজ্র চকিতে একবার চক্ষু তুলিয়া আবার চক্ষু নামাইল, কথা কহিল না। কুহুর মুখে তখন আবার হাসি ফুটিল। বজ্রের পানে চাহিয়া চাহিয়া তাহার মুখের ভাব পরিবর্তিত হইল; সে অঙ্গুলি দিয়া বজ্রের বাহুর উপর মৃদু স্পর্শে হাত বুলাইয়া স্নেহ-বিগলিত স্বরে বলিল— ‘বুঝেছি। তুমি বড় কাঁচা, এখনও মনে রঙ ধরেনি— তোমার বয়স কত?’

বজ্রের মনের মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলিয়া গেল, সে উৎফুল্ল মুখ তুলিল। নগরে আসিয়া অবধি সে যে বস্তুটির জন্য মনে মনে বুভুক্ষু হইয়া উঠিয়াছিল তাহা রমণীর স্নেহস্পর্শ : এতক্ষণে তাহাই সে কুহুর কণ্ঠে শুনিতে পাইল। সে এক মুখ হাসিয়া বলিল— ‘আমার বয়স কুড়ি।’

কুহু বলিল— ‘আমার উনিশ। কিন্তু তবু আমি তোমার চেয়ে অনেক বড়, অনেক কিছু শেখাতে পারি।’

হাসিতে হাসিতে সে উঠিয়া দাঁড়াইল, হাসিটি কিন্তু নৈরাশ্য-বিদ্ধ।

‘আজ আমি ফিরে চললাম। কিন্তু আবার আসব।’ বলিয়া কুহু সসঙ্কেত অঙ্গুলি তুলিল।

বজ্র উঠিল। কুহু দ্বারের কাছে গিয়া বাহিরে উঁকি মারিল, তারপর উদ্বিগ্নমুখে ফিরিয়া আসিয়া বলিল— ‘নগর নিশুতি, পথ বড় নির্জন। আমার ভয় করছে।’

‘কিসের ভয়?’

‘দুষ্ট লোকের ভয়। তুমি আমাকে ঘরে পৌঁছে দেবে?’

‘কোথায় তোমার ঘর?’

‘অনেক দূরে, নগরের দক্ষিণে।’

বজ্র দ্বিধায় পড়িল, ইতস্তত করিয়া বলিল— ‘তুমি— তোমার স্বামী—’

কুহু ফিক করিয়া হাসিল— ‘তোমার কি ভয় করছে নাকি?’

‘না। চল।’

কুহু সানন্দে বজের হাত ধরিয়া দ্বারের দিকে লইয়া চলিল। বজ্র বলিল— ‘পিদিম নিলে না?’

‘না, আমি অন্ধকারে পথ চিনে যেতে পারব।’

দুইজনে বাহির হইল। মসীবর্ণ রাত্রি, কেবল স্পর্শানুভূতির দ্বারা সঙ্গ পাওয়া যায়। কুহু বজ্রের হাত ধরিয়া রহিল; ক্রমে তাহার বাহু বজ্রের সহিত জড়াইয়া গেল। বজ্র আপত্তি করিল না।

পথ চলিতে চলিতে দুই চারিটি কথা হইল।

বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘তুমি রাত্রে পথে পথে ঘুরে বেড়াও, তোমার স্বামী কিছু বলে না?’

কুহু বলিল— ‘আমার স্বামী নেই।’

অনেকক্ষণ কথা হইল না। পথ দীর্ঘ, উপরন্তু কুহু যেন ইচ্ছা করিয়াই মন্থর পদে হাঁটিতেছে।

এক সময় কুহু সহসা প্রশ্ন করিল— ‘তোমার ঘরে কে কে আছে?’

‘মা আছেন।’

‘আর—’

বজ্র উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিয়া কুহু মৃদুকণ্ঠে হাসিল। বলিল— ‘থাক। ও সব জেনে আমার লাভ কি?’

অবশেষে তাহারা নগরের দক্ষিণ প্রান্তে পৌঁছিল। রাজপ্রাসাদের সম্মুখ দিয়া যে পথ গিয়াছে সেই পথে আসিয়া কুহু প্রাসাদ-প্রাকারের পাশ দিয়া চলিতে লাগিল। রুদ্ধ তোরণদ্বার পিছনে রাখিয়া আরও দক্ষিণে চলিল।

বজ্র বলিল— ‘এ কি! এ যে রাজপ্রাসাদ!’

কুহু অন্ধকারে মুখ টিপিয়া হাসিল, বলিল— ‘হ্যাঁ।’

প্রাকারের গায়ে একটি ক্ষুদ্র গুপ্তদ্বার ছিল। কুহু তাহাতে মৃদু করাঘাত করিল, বজ্রকে হ্রস্বকণ্ঠে বলিল— ‘তুমি ভিতরে আসবে না?’

বজ্র বলিল— ‘তুমি কে?’

কুহু বলিল— ‘আমি রাজপুরীর দাসী, অবরোধেই থাকি। আমার আলাদা ঘর আছে। একবার আসবে আমার ঘরে?’

বজ্র শক্ত হইয়া বলিল— ‘না।’

ইতিমধ্যে গুপ্তদ্বার খুলিয়াছিল। কুহু বজ্রের হাত ছাড়িয়া তাহার কণ্ঠ জড়াইয়া লইল, কানে কানে বলিল— ‘তুমি কেমন মধুনাগর? এত মিষ্টি আবার এত শক্ত!— বেশ, আজ থাক। কাল আমি আবার যাব— তুমি ঘরে থেকো।’

বজ্রকে ছাড়িয়া দিয়া কুহু অন্ধকার গুপ্তদ্বার পথে নিঃশব্দে অদৃশ্য হইয়া গেল। গুপ্তদ্বার আবার বন্ধ হইল।