১৫. মাছ-ধরা পর্ব
ক্লান্ত ও হতাশ হয়ে আমার ব্যর্থতার যে ক্ষেত্রটা ছেড়ে ১৯২৫ সালের শরৎকালে চলে এসেছিলাম, ১৯২৬-এর বসন্তকালে আবার ফিরে গেলাম সেখানে নবোদ্যমে, পূর্ণ আশা নিয়ে।
গাড়োয়ালের নরখাদকের সন্ধানে, আমার এই দ্বিতীয় যাত্রায় কৌটদোয়ারা পর্যন্ত গেলাম ট্রেনে এবং সেখান থেকে পাউরি পর্যন্ত হেঁটে–তাতে আটটা দিন সময় বাঁচল। পাউরি থেকে রুদ্রপ্রয়াগ পর্যন্ত ইবটসন এল আমার সঙ্গে।
গাড়োয়ালে আমার তিন মাসের অনুপস্থিতির মধ্যে নরখাদকটি দশটা মানুষ মেরেছে, এবং এই তিন মাসে আতঙ্কগ্রস্ত অধিবাসীরা চিতাটাকে মারার কোনো চেষ্টা করে নি।
এই দশটার মধ্যে শেষ শিকার হয়েছে একটি ছোট ছেলে। আমরা রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছনোর দু-দিন আগে অলকানন্দার বাঁ পাড়ে ঘটনাটা ঘটেছে। পাউরিতে টেলিগ্রামে এ হত্যার সংবাদ পেয়েছিলাম, কিন্তু যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে পথ চলে এসেও ইন্সপেক্শন বাংলোয় অপেক্ষারত পাটোয়ারীর কাছে হতাশ হয়ে শুনলাম যে চিতাটা আগের রাতে মড়িটা সম্পূর্ণ শেষ করে ফেলেছে। ছোট ছেলেটির মড়ির এমন কিছুই আর অবশিষ্ট রাখে নি যার ওপর আমরা বসতে পারি।
রুদ্রপ্রয়াগ থেকে চার মাইল দূরের একটা গ্রামে ছেলেটি মাঝরাত্রিতে মারা পড়েছে এবং নির্বিঘ্নে খাওয়া সারার পর চিতাটা যে নদী পার হয়ে যাবে সে সম্ভাবনা খুব কম। কাজেই আমরা পৌঁছনোর পর অবিলম্বে পুলদুটো বন্ধ করার ব্যবস্থা করলাম।
শীতের সময়টায় ইবটসন নরখাদক উপদ্রুত সারা এলাকাটায় এক অতীব সুদক্ষ সংবাদ-সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই এলাকায় কোনো কুকুর, ছাগল, গরু বা মানুষ মারা পড়লে অথবা কোনো দরজা ভাঙার চেষ্টা হলে সেই ব্যবস্থা অনুযায়ী সংবাদ এসে পৌঁছত এবং এই উপায়ে আমরা নিয়মিতভাবে নরখাদকটার খবর পেয়ে চললাম।
নরখাদকের আক্রমণের শত-শত মিথ্যা গুজব আমাদের কাছে আনা হতে লাগল, তাতে ফল হল শুধু মাইলের পর মাইল হাঁটা। কিন্তু এটা অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। কারণ যে-যে এলাকায় একটা সুপ্রতিষ্ঠিত নরখাদক উপদ্রব করে বেড়াচ্ছে যেখানে, সেখানে প্রত্যেকে তার নিজের ছায়াকেই সন্দেহ করে, আর রাতের বেলায় যে-কোনো শব্দ শুনলেই সেটা নরখাদকের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়।
গালটু নামে একটা লোককে নিয়ে এরকম একটা গুজব উঠেছিল। লোকটা রুদ্রপ্রয়াগ থেকে সাত মাইল দূরে অলকানন্দার ডান-পাড়ের কুন্দা গ্রামের বাসিন্দা। গালটু একদিন বিকেলে গ্রাম থেকে মাইলখানেক দূরে তার গরুর খাটালে রাত কাটাতে চলে যায়। পরদিন সকালে তার ছেলে সেখানে গিয়ে দেখে যে তার বাপের কম্বলটা পড়ে রয়েছে, দরজার ভিতরে অর্ধেক আর বাইরে অর্ধেক। নিকটে নরম জমির উপর সে যা দেখতে পায়, তার ধারণা সেটা একটা টেনে নেওয়ার দাগ এবং তার কাছেই নরখাদকের থাবার ছাপ।
গ্রামে ফিরে গিয়ে সে একটা শোর তুলল, ষাট জন লোক বেরুল দেহটা খুঁজতে আর চারজন লোককে পাঠানো হল রুদ্রপ্রয়াগে আমাদের খবর দিতে। যখন লোক চারটে এল তখন আমি আর ইবটসন নদীর বাঁ-পাড়ের একটা পাহাড়ে নরখাদকের খোঁজে ঝাঁপান চালাচ্ছি। আমি নিশ্চিত জানতাম যে চিতাটা নদীর এপারেই আছে এবং গালটু মারা যাওয়ার সত্যতা নেই। সুতরাং ইবটসন একজন পাটোয়ারীকে ঐ চারজনের কুন্দায় পাঠিয়ে তদন্ত করে রিপোর্ট আনতে বলল।
পরদিন বিকেলে রিপোর্ট পাওয়া গেল, আর সেই নরম জমির উপরে থাবার ছাপের একটা নকশাও। রিপোর্টটায় বলা হয়েছে যে দুশো নোক নিয়ে সারা দিনে চারদিকে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে কিন্তু গাটুর দেহাবশেষ পাওয়া যায় নি, এবং অনুসন্ধান চালিয়ে যাওয়া হবে। নকশাটায় ছয়টা বৃত্ত আঁকা ছিল। মাঝেরটা ডিশের সাইজের, তাকে ঘিরে পাঁচটা সমান সাইজের বৃত্ত, এক একটা চায়ের পেয়ালার মত। সব বৃত্তগুলোই আঁকা হয়েছে কম্পাস দিয়ে। পাঁচদিন পরে আমি আর ইবটসন টাওয়ারে বসার জন্যে রওনা হয়েছি, এমন সময় একটা শোভাযাত্রা এসে হাজির হল বাংলোর সামনে। তার আগে-আগে একটা মহা খাপ্পা লোক জোর গলায় প্রতিবাদ জানাচ্ছে যে সে এমন কোনো অপরাধ করে নি, যার জন্যে তাকে গ্রেপ্তার করে রুদ্রপ্রয়াগে আনা যেতে পারে। খাপ্পা লোকটি হচ্ছে গালটু। আমরা তাকে শান্ত করার পর সে তার কাহিনী বলল।
জানা গেল, সেদিন সে যখন বাড়ি থেকে বের হচ্ছে তখন তার ছেলে এসে তাকে জানায় যে একজোড়া বলদের দাম সে একশো টাকা দিয়ে এসেছে, কিন্তু গালটুর দৃঢ় অভিমত, সে-জোড়ার দাম সত্তর টাকার বেশি হওয়া উচিত নয়। টাকার এই অপব্যয়ে সে এতটা ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে যে রাতটা খাটালে কাটিয়ে ভোরে উঠেই সে চলে যায় দশ মাইল দূরে তার মেয়ের বাড়িতে। আজ তার নিজের গাঁয়ে ফিরে আসতেই পাটোয়ারী তাকে গ্রেপ্তার করে। এখন সে জানতে চায় তার গ্রেপ্তারের কারণটা কী। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে পরিস্থিতিটার মজার দিকটা বুঝতে পারে, এবং বুঝতে পারার পর সমবেত জনতার সঙ্গে সেও এই কথা ভেবে প্রাণ খুলে হাসতে থাকে যে, পাটোয়ারীর মত একজন মাতব্বর ব্যক্তি যে সময় দুশো বন্ধুবান্ধব নিয়ে পাঁচদিন ধরে তার দেহাবশেষ খুঁজে বেড়িয়েছিল, সে তখন দশ মাইল দূরের এক গ্রামে বসে মাথা ঠাণ্ডা করছে।
রুদ্রপ্রয়াগ পুলের বাত্যাক্ষুব্ধ মুক্ত টাওয়ারের উপর শুয়ে সারারাত্রি কাটাতে ইবটসনের প্রবল আপত্তি। কাজেই কাঠ ও মিস্ত্রি যোগাড় করে টাওয়ারের উপর সে একটা মঞ্চ তৈরি করিয়ে ফেলল। ইবটসন যে পাঁচদিন রুদ্রপ্রয়াগে থাকতে পারল, সে কদিন আমরা সেই মঞ্চের উপরই রাত কাটালাম।
ইবটসন চলে যাওয়ার পর চিতাটা একটা কুকুর, চারটে ছাগল আর দুটো গরু মারল। কুকুর আর ছাগলগুলোকে সে রাতেই খেয়ে শেষ করেছিল, কিন্তু গরুদুটোর মড়ির উপর দুদিন করে বসলাম। প্রথম গরুটার মড়ির উপর আমি বসে থাকার দ্বিতীয় রাতে চিতাটা এসেছিল। রাইফেলটা তুলে টর্চটা জ্বালাতে যাচ্ছি, এমন সময় দুর্ভাগ্যক্রমে কাছেই একটা বাড়িতে একটি স্ত্রীলোকের দরজায় ঘা মারার শব্দে চিতাটা ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল।
এর মধ্যে কোনো মানুষ মারা পড়ে নি, তবে, একটি স্ত্রীলোক ও তার শিশু সন্তান সাংঘাতিকভাবে জখম হয়েছিল। যে ঘরে তারা শুয়ে ছিল তার দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে চিতাটা স্ত্রীলোকের হাত কামড়ে ধরে তাকে ঘরের বাইরে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে স্ত্রীলোকটির সাহস ছিল, এবং সে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে নি বা বুদ্ধিও হারায় নি। চিতাটা তাকে টেনে পিছুতে পিছুতে দরজার বাইরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে দরজাটা তার উপর বন্ধ করে দেয় এবং হাতে আর বুকে জখম নিয়ে বেঁচে যায়,–শিশুটার মাথায় কিছুটা চোট লেগেছিল। পরের দু-রাত্রি আমি এই ঘরে কাটাই, কিন্তু চিতাটা আর ফিরে আসে নি।
মার্চের শেষভাগে একদিন কেদারনাথ তীর্থপথের ধারে একটা গ্রাম থেকে আমি ফিরে আসছি, একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম যেখানে রাস্তাটা মন্দাকিনী নদীর খুব ধার ঘেঁষে চলেছে। সেখানে দশ-বারো ফুট উঁচু একটা জলপ্রপাতও রয়েছে। এখানে নদীর উপরে জলপ্রপাতটার পাথরের উপরে দেখলাম লম্বা বাঁশের আগায় বাঁধা তিনকোণা একটা জাল নিয়ে কয়েকটা লোক বসে আছে। জলের গর্জনে কথাবার্তা সম্ভব নয় বলে আমি একটু ধূমপান ও একটু বিশ্রামের জন্যে এপাশে একটা পাথরের। উপর বসলাম, কেননা সেদিন হাঁটাও হয়েছিল অনেক, আর লোকগুলো কী করছে তাও দেখার ইচ্ছা ছিল প্রবল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটি লোক উঠে দাঁড়িয়ে উত্তেজিতভাবে আঙুল দিয়ে জলপ্রপাতের নিচে সাদা ফেনিল জলের দিকে দেখাতে লাগল আর দু-জন লোক বাঁশটা বাড়িয়ে ত্রিভুজাকৃতি জালটা জলপ্রপাতের খুব কাছে পেতে ধরল। পাঁচ থেকে পঞ্চাশ পাউণ্ড পর্যন্ত বিভিন্ন সাইজের মহাশোল মাছ জলপ্রপাতটার উপর লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। এর মধ্যে একটা পাউণ্ড-দশেক ওজনের মাছ জলপ্রপাতের বাইরে লাফিয়ে পড়ল। ফিরে জলে পড়বার সময় সেটাকে বেশ কায়দা করে জালে ধরে ফেলা হল এবং জাল টেনে নিয়ে মাছটা বের করে নেওয়ার পর আবার পাতা হল জলপ্রপাতের কাছে। ঘণ্টাখানেক ধরে আমি ওদের মাছ ধরা দেখলাম,-এর মধ্যে লোকগুলো চারটে মাছ ধরল, প্রত্যেকটি দশ পাউণ্ড ওজনের।
আগের বার রুদ্রপ্রয়াগে থাকার সময় ইনসপেকশন বাংলোর চৌকিদারের মুখে শুনেছিলাম যে বসন্তকালে, বরফগলা জল নামার আগে, অলকানন্দা আর মন্দাকিনীতে প্রচুর মাছ পাওয়া যায়। সেজন্যে এবার আমি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম চোদ্দ ফুট লম্বা বেতের তৈরি একটি স্যামন-মাছ-ধরা ছিপ, ২৫০ গজ সুতো-সমেত একটা রীল, কয়েকটা শক্ত বঁড়শি, আর এক থেকে দুই ইঞ্চি মাপের কতকগুলো ঘরে-তৈরি পিতলের টোপ।
নরখাদকটার কোনো সংবাদ না পাওয়ায় পরের দিন সকালে আমি আমার ছিপ আর সরঞ্জাম নিয়ে জলপ্রপাতটার দিকে গেলাম।
জলপ্রপাতটায় আর আগের দিনের মত মাছ লাফাচ্ছিল না। উপরে লোকগুলো একটা ছোট আগুনের চারদিকে ঘিরে বসে হুঁকোটা এ-হাত ও-হাত ঘোরাচ্ছিল আর খুব আগ্রহে আমাকে নজর করে দেখছিল।
জলপ্রপাতটার নিচে ত্রিশ চল্লিশগজ চওড়া একটা জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছে, দু-পাশে পাথরের দেওয়াল প্রায় দুশো গজ লম্বা। জলপ্রপাতের মাথায় যেখানে আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম সেখান থেকে একশো গজ পর্যন্ত দেখা যায়। এই মনোরম সুন্দর জলাশয়ের জলটা স্ফটিক-স্বচ্ছ।
জলাশয়ের মাথায় জল থেকে সোজা দশ-বারো ফুট উঁচু হয়ে খাড়া পাহাড়ের গা উঠেছে। এইভাবে খাড়া হয়ে গজ-কুড়ি যাওয়ার পর ঢালটা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে উঠে গিয়েছে একশো ফুট পর্যন্ত। আমার এদিক থেকে জল পর্যন্ত নামা কোনোমতেই সম্ভব নয়। বঁড়শিতে একটা মাছ যদি আমি বিধিয়েও ফেলি তবু পাড় ধরে সেটাকে অনুসরণ করা সম্ভব হবে না, লাভও নেই; কারণ উপর দিকটায় ঝোপ-জঙ্গল আর গাছপালা, আর নিচের দিকে নদীটা বিপুল কলোচ্ছাসে অলকানন্দার সঙ্গে গিয়ে মিশেছে। এখানে মাছ ধরে ডাঙায় ওঠানো কঠিন ও বিপজ্জনক কাজ। অবশ্য একটা মাছ না বিধানো পর্যন্ত সে বাধা পার হওয়ার কথা চিন্তা না করাই ভাল। তা ছাড়া এখনো তো ছিপই জুড়ি নি।
আমার এপাশে জলাশয়টার জল গভীর। অসংখ্য বুদবুদ উড়িয়ে ছুটে চলেছে জল। আধাআধি ওপাশে নুড়িপাথর বিছানো জলের তলাটা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। তার ওপর চার থেকে ছ-ফুট জল। জলের তলের প্রত্যেকটা নুড়ি আর পাথর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। তার উপর দিয়ে তিন থেকে দশ পাউণ্ড ওজনের কতকগুলো মাছ ধীরে ধীরে উজানের দিকে এগিয়ে চলেছিল।
বার ফুট উপরে দাঁড়িয়ে আমি মাছগুলো দেখছি, হাতে রয়েছে দু-ইঞ্চি একটা টোপে লাগানো একটা তিনমুখো বঁড়শি,হঠাৎ দেখি গভীর জল থেকে একঝাক স্যামন মাছের পোনা ছুটে বেরিয়ে এসে নুড়ি-বিছানো নদীর তলা দিয়ে ছুটে চলেছে–পিছনে তাড়া করছে তিনটে বড়-বড় মহাশোল।
উৎকৃষ্ট স্যামন ধরার ছিপটা ধরে আমি টোপটি সজোরে দুরে ছুঁড়ে মারলাম। ছিপটা এভাবে ব্যবহার হয়, আমার বন্ধু হার্ডি তা কোনদিনও চায় নি, এবং আগে, বহুবার ওটি ওই ভাবেই ব্যবহার হয়েছে। উৎসাহের বশে দূরত্ব আন্দাজ সঠিক হয় নি। ফলে জলের দু-ফুট আন্দাজ উপরে জলাশয়টির অনেক ওদিকে, পাথরের গায়ে বাজল টোপটা। ওটা জলে পড়ল, স্যামনের পোনাগুলোও পাথরের কাছে পৌঁছল। টোপটা ছুঁতে-না-ছুঁতে সামনের মহাশোলটি ওটি গিলে ফেলল।
উঁচু জায়গা থেকে লম্বা সুতোয় মাছ তুলতে টান পড়ে প্রচণ্ড, কিন্তু আমার ছিপটা বেশ মজবুত, আর শক্ত তিনমুখো বঁড়শিটা বেশ ভাল-মত গেঁথে গেছে মাছটার মুখে। একটি কি দুটি মুহূর্ত, মনে হল মাছটা বুঝতে পারে নি কি ব্যাপার ঘটে গেছে। পেটটা আমার দিকে, মুখটা উঁচু করে জলের ভেতর সোজা হয়ে উঠে এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়তে লাগল। তারপর সম্ভবত ঝুলন্ত টোপটা মাথায় লাগায় ভয় পেয়ে সে একটা প্রচণ্ড ঝাঁপটা মেরে ছুট লাগাল ভাটির দিকে, আর নুড়ির বুকে ছোট মাছগুলো ছিটকে যেতে লাগল দুদিকে।
প্রথম দৌড়ে মাছটা টেনে বের করে নিয়ে গেল একশো গজ সুতো, তারপর এক মুহূর্ত থেমে আবার গজ-পঞ্চাশেক। রীলে আরো সুতো ছিল, কিন্তু মাছটা ততক্ষণে বাঁকটা পার হয়ে বিপজ্জনকভাবে জলাশয়টার শেষ প্রান্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। সুতোর টানে একবার শক্ত করে একবার ঢিল দিয়ে অবশেষে মাছটার মুখ উজানের দিকে ফেরাতে পারলাম, এবং তারপর খুব আস্তে-আস্তে সেটাকে বাঁক ঘুরিয়ে জলের যে একশো গজ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল তার মধ্যে নিয়ে এলাম।
আমার ঠিক নিচে পাহাড়ের খানিকটা বেরিয়ে এসেছে। সেখানে বাধা পেয়ে জল স্থির, স্রোতহীন। আধঘণ্টা বীরের মত যুঝে তবে মাছাটা সেই বদ্ধজলে আসতে বাধ্য হল।
এতক্ষণে আমি আমার শেষ বাধার সম্মুখীন হয়েছি। এবার এটা পার হওয়ার কোনো উপায়ই যখন নেই তখন ভাবছি সুতো কেটে মাছটাকে ছেড়েই দিতে হবে। বেশ দুঃখিত মনেই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এমন সময় একটা ছায়া এসে পড়ল পাশের পাথরের ওপর। পাথরে ধারে ঝুঁকে পড়ে নবাগতটি মন্তব্য করল যে মাছটা মস্ত বড়, এবং একই নিশ্বাসে আমাকে প্রশ্ন করল এখন আমি কী করব ঠিক করেছি। যখন বললাম যে মাছটাকে ভোলা সম্ভব নয়, একমাত্র পথ হচ্ছে তাকে ছেড়ে দেওয়া, তখন সে বলল, দাঁড়াও সাহেব, আমার ভাইকে ডেকে আনি। তার ভাই হল লম্বা রোগা; সে যখন এল, স্পষ্টই বোঝা গেল যে তখন সে গোয়াল-ঘর সাফ করছিল। তাকে ওপারে গিয়ে হাত পা ধুয়ে নিতে বললাম যাতে সে পাথর থেকে পিছলে না পড়ে, যায়। তারপর বড় ভাইটির সঙ্গে পরামর্শ করলাম।
যেখানে আমরা দাঁড়িয়েছিলাম সেখান থেকে জলের এক ফুট উপর পর্যন্ত কয়েক ইঞ্চি চওড়া একটা ফাটল এঁকে-বেঁকে নিচে নেমে গেছে। ঠিক সেখানেই দু-ইঞ্চি চওড়া একটা পাথরের ফলক। আমাদের পরিকল্পনা শেষ পর্যন্ত এই দাঁড়াল যে, ছেলেটা হাত পা ধুয়ে ফিরে এসেই ফাটল বেয়ে ঐ ফাটলটার উপর চলে যাবে, বড় ভাই ফাটল দিয়ে কিছুটা নেমে ছোট ভাইয়ের হাত ধরে থাকবে, আর আমি পাড়ের উপর শুয়ে পড়ে বড় ভাইয়ের হাত ধরে থাকব। কাজে নামার আগে আমি ওদের জিগ্যেস করলাম মাছ তোলার কায়দা-কানুন তাদের জানা আছে কি না এবং তারা সাঁতার জানে কি না। এতে তারা একগাল হেসে জানাল যে ছোটবেলা থেকেই তারা মাছ ধরছে আর নদীতে সাঁতার দিয়ে আসছে।
আমাদের পরিকল্পনাটার মধ্যে অসুবিধার ব্যাপার এইটুকু যে, একই সঙ্গে বড় ভাইয়ের হাত ধরে থাকা ও ছিপ সামলানো আমার একার পক্ষে সম্ভব নয়। যাই হক কিছুটা ঝুঁকি নিতেই হবে। কাজেই আমি ছিপ নামিয়ে রেখে সুতোটা হাত দিয়ে ধরলাম, এবং দু-ভাই যখন নেমে গেল তখন পাথরের উপরে উপুড় হয়ে পড়ে বড় ভাইয়ের একটা হাত ধরলাম। তারপর খুব আস্তে আস্তে একবার বাঁ-হাতে, একবার দাঁতে কামড়ে সুতোটা গুটিয়ে এনে মাছটাকে পাথরের কাছে টেনে আনলাম।
বাচ্চা ছেলেটা মাছ ধরতে জানে কি না সে সম্বন্ধে আর কোনো প্রশ্নই রইল না, কারণ মাছটা পাথরের গায়ে এসে লাগার আগেই সে তার তর্জনী আর বুড়ো আঙুল মাছটার দু-পাশের কানকোর মধ্যে চালিয়ে দিয়ে শক্ত করে গলাটা চেপে ধরল। এ পর্যন্ত মাছটা বেশ শান্তই ছিল, কিন্তু গলায় হাত পড়ার সঙ্গে-সঙ্গেই মারল প্রচণ্ড এক ঝাঁপট। কিছুক্ষণ পর্যন্ত মনে হতে লাগল যে আমরা তিনজনেই উল্টে গিয়ে পড়ব জলের ভিতর।
দুই ভায়েরই খালি পা। সুতো ধরে থাকার প্রায়োজন শেষ হতে দু-হাত দিয়েই তাদের সাহায্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হল। উপর থেকে প্রাণপণে আমি টানতে লাগলাম, আর পাথরের দিকে মুখ করে পায়ের পাতায় ভর দিয়ে তারা উঠে এল উপরে।
মাছটাকে নিরাপদে ডাঙায় তেলার পর তাদের আমি জিগ্যেস করলাম তারা মাছ খায় কি না। সাগ্রহ উত্তর পেলাম যে পেলেই তারা খায়। তখন তাদের বললাম যে তারা যদি আমার লোকজনের জন্যে আর একটা মাছ ওঠাতে সাহায্য করে তবে এই চমৎকার মহাশোল মাছটা তাদের আমি দিয়ে দেব-মাছটার ওজন ছিল ত্রিশ পাউণ্ডেরও একটু উপরে। এ প্রস্তাবে তারা তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেল।
মাছটার নিচের নরম ঠোঁটে বঁড়শিটা গভীরভাবে বসে গিয়েছিল। কেটে যখন সেটা বার করছি, দু-ভাই সাগ্রহে তা লক্ষ করতে লাগল। বঁড়শিটা বের হলে তারা জানতে চাইল সেটা তারা একটু দেখতে পরে কি না। তিনটে বঁড়শি একসঙ্গে, এমন জিনিস তাদের গাঁয়ে আগে কখনো দেখে যায় নি। বাঁকানো পিতলের টুকরোটা অবশ্য। ভারের কাজ করে–কিন্তু বঁড়শিতে টোপ ছিল কিসের? মাছ পিতল খেতে চাইবে কেন, এবং সেটা কি সত্যিই পিতল, না কোনো রকমের শক্ত টোপ?
টোপ, এবং তিনমুখো বঁড়শিটা সম্বন্ধে বিস্ময় প্রকাশ ও মন্তব্যটি হয়ে গেলে পর আমি তাদের বসে বসে আমার দ্বিতীয় মাছ ধরাটা দেখতে বললাম।
জলাশয়ের সবচেয়ে বড় মাছগুলো ছিল জলপ্রপাতটার ঠিক নিচেই। ওখানকার ফেনায়িত সাদা জলের মধ্যে মহাশোল ছাড়াও খুব বড়-বড় কয়েকটা গুঞ্চ মাছও ছিল। ওরা শুন বা টোপ খুব চট করে ধরে এবং ওরাই আমাদের পাহাড়ী নদীগুলিতে শতকরা নব্বইটা বঁড়শি হারানোর জন্যে দায়ী। কারণ এগুলোর একটা ভারি বদ অভ্যাস, যে বঁড়শি ধরার সঙ্গে-সঙ্গেই জলের তলায় ডুব দেয়, আর মাথাটা ঢুকিয়ে দেয় কোনো পাথরের তলায় : সেখান থেকে তাদের নড়ানো সব সময়েই কঠিন এবং প্রায়ই অসম্ভব হয়ে ওঠে।
প্রথম মাছটা যেখানে ধরেছি সেখানকার মত সুবিধেজনক জায়গা নেই দেখে আমি সেখানেই ছিপ নিয়ে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম।
মাছটাকে খেলিয়ে তোলার সময় নুড়ির উপরকার মাছগুলো ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। অচিরেই ভাইদুটি বিস্ময়সূচক আওয়াজ করে আঙুল দিয়ে খানিকটা ভাটির দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। যেখানে নুড়ি-বিছানো তলটা শেষ হয়ে গভীর জল আরম্ভ হয়েছে, সেখানে একটা মস্ত বড় মাছ। আমি বঁড়শি ফেলার আগেই মাছটা ঘুরে গিয়ে গভীর জলে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিন্তু একটু পরেই আবার ফিরে এল সেটা। সেটা অগভীর জলে আসার পর আমি বঁড়শি ফেললাম, কিন্তু সুতো ভিজে থাকায় সেটা ঠিক জায়গায় গিয়ে পড়ল না।
দ্বিতীয়বার টোপটা জলের যেখানে ফেলতে চেয়েছিলাম ঠিক সেই জায়গায় এবং ঠিক সময়মত গিয়ে পড়ল। টোপটা ডোবার জন্যে এক সেকেণ্ড অপেক্ষা করে, প্রয়োজনমত ঘোরানোর জন্যে একটু-একটু করে সুতো গোটাতে লাগলাম। ছোট-ছোট টান দিয়ে সেটা এগিয়ে আনছি, এমন সময় মহাশোলটা বিদ্যুৎবেগে এগিয়ে এল এবং পরমুহূর্তেই মুখে বঁড়শি গেঁথে জলের উপর পরিষ্কার লাফিয়ে উঠল, উল্টে পড়ল অনেক জল ছিটকিয়ে, তারপর উন্মত্তের মত ছুট লাগানো ভাটির দিকে। উত্তেজিত হয়ে উঠল দর্শকরা–কারণ ওপারের লোকগুলোও ভাই-দুটির মতই একাগ্র মনে সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ করে যাচ্ছিল।
রীল ঘুরে চলেছে, চলেছে, সুতো চলে যাচ্ছে, ইতিমধ্যে দু-ভাই আমার দু-পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা আমাকে বার-বার বলতে লাগল যেন মাছটাকে আমি জলাশয়ের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত চলে যেতে না-দিই। এটা করার চেয়ে বলা সহজ, কারণ যে-কোনো মাপের মহাশোলেরই প্রথম মরিয়া ছুটটা থামানো সম্ভব নয়। তাতে সুতো ছিঁড়ে যাওয়ার বা বঁড়শি ভেঙে যাওয়ার নিশ্চিত সম্ভাবনা থাকে। আমাদের ভাগ্যটা ভাল, কারণ রীলে যখন আর পঞ্চাশ গজেরও কম সুতো বাকি, তখন সে থামল। যদিও সে বেশ ভালভাবেই লড়াই চালিয়ে গেল তবু তাকে বাঁকটা ঘুরিয়ে টেনে আনা গেল, এবং শেষ পর্যন্ত পাথরের নিচের সেই স্থির জলের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব হল।
দ্বিতীয় মাছটা ডাঙায় ওঠাতে প্রথম মাছটার মত তত বেশি বেগ পেতে হল না, কেননা পাথরের উপর আমাদের প্রত্যেকের জায়গাগুলো, এবং ঠিক কি-কি করতে হবে, তা ঠিকমত জানা হয়ে গিয়েছিল।
দৈর্ঘ্যে দুটো মাছই সমান, কিন্তু দ্বিতীয়টা একটু বেশি ভারি। বড় ভাইটি একটা ঘাসের দড়ি পাকিয়ে নিয়ে তা দিয়ে নিজেদের মাছটা ঘাড়ে ঝুলিয়ে বিজয়গর্বে গাঁয়ের দিকে রওনা হল। ছোট ভাইটি প্রার্থনা জানাল যে সে আমার ছিপটা আর মাছটা বয়ে নিয়ে ইনসপেকশন বাংলো পর্যন্ত দিয়ে আসবে। অনেকদিন আগে আমি নিজেও বালক ছিলাম এবং আমার এক ভাইয়ের ছিল মাছ ধরার বাতিক, কাজেই ছেলেটির আর আমাকে অনুরোধ করে একথা বলার দরকার ছিল না : ‘সাহেব, তুমি যদি তোমার মাছটা আর ছিপটা আমাকে বয়ে নিয়ে যেতে দাও আর নিজে একটু দূরে-দূরে পিছন-পিছন আসো, তবে রাস্তায় বা বাজারে যারা দেখবে তারা ভাববে যে আমিই এই মস্ত মাছটা ধরেছি, যার সমান মাছ তারা চোখেও কখনো দেখে নি!
.
১৬. একটি ছাগলের মৃত্যু
মার্চের শেষ তারিখে ইবটসন পাউরি থেকে ফিরে এল। পরের দিন সকালে আমরা প্রাতরাশ খেতে-খেতে শুনলাম, রুদ্রপ্রয়াগের উত্তর-দক্ষিণে একটা গ্রামের কাছে একটা চিতা সারারাত ধরে ডেকেছে। যেখানে জাঁতিকলে আটকানো চিতাটাকে আমরা মেরেছিলাম তার মাইলখানেক দূরে জায়গাটা।
গ্রামের আধ মাইল উত্তরে, পাহাড়টার উঁচু শিখরে বেশ খানিকটা জায়গা খুব এবড়ো-খেবড়ো ও দুর্গম। সেখানে বিরাট-বিরাট পাথর আর গুহা আর গভীর গর্ত। স্থানীয় লোকেরা বলে ওখান থেকে তাদের পূর্বপুরুষরা তামা খুঁড়ে বের করত। সারা এলাকাটায় ঝোঁপ জঙ্গল। কোথাও গভীর কোথাও পাতলা, পাহাড়ের ঢাল দিয়ে গ্রামের উপরের স্তর-কাটা জমিগুলোর আধ মাইল দূর পর্যন্ত নেমে এসেছে।
আমার বহুদিন ধরে সন্দেহ হচ্ছিল, নরখাদকটা রুদ্রপ্রয়াগের ধারে-কাছে এলে এই এলাকাটাতেই আস্তানা হিসাবে ব্যবহার করে। আমি বহুবার এবড়ো খেবড়ো জমিটার উপরের পাহাড়ে উঠেছি। আশা করছি চিতাটাকে ভোরের সূর্যে পাথরের উপর রোদ পোহাতে দেখব। ঠাণ্ডার সময়ে এ-ভাবে রোদ পোহাতে চিতারা খুব ভালবাসে। এই অবস্থায় ওদের গুলি করা খুব সহজ। শুধু ধৈর্য আর নির্ভুল নিশানা দরকার।
আমি এবং ইবটসন সকাল সকাল লাঞ্চ সেরে আমাদের .২৭৫ রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সঙ্গে ইটসনের একটি লোফ। তার কাছে একগাছা ছোট দড়ি। গ্রাম থেকে একটা জোয়ান মদ্দা ছাগল কিনলাম। আমি আগে আগে যে ছাগলগুলো কিনেছি, সবগুলোই চিতাটার হাতে নিহত হয়েছে।
গ্রাম থেকে একটি উঁচু-নিচু পথ পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা উঠে, এবড়ো খেবড়ো জমিটার কিনারে গিয়ে বাঁ-দিকে মোড় নিয়েছে। তারপর পাহাড়ের গা দিয়ে আরো একশো গজ গিয়ে পাহাড়ের চূড়া ঘিরে দুরে চলে গেছে। যেখানে পথটা পাহাড়ের গা দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে উপরের দিকে পথের দু-পাশে দূরে-দূরে ঝোঁপ। নিচের দিকে খাড়া জায়গাটায় দু-পাশে ছোট-ছোট ঘাস।
যেখানে পথটা মোড় ঘুরেছে, সেখানে, ঝোপ-জঙ্গলের দশ গজ নিচে ছাগলটাকে শক্ত খুঁটিতে বাঁধলাম। পাহাড় বেয়ে দেড়শো গজ নেমে আমরা কতকগুলো বড় পাথরের আড়ালে লুকোলাম। ছাগলটার গলায় জোর আছে। যতক্ষণ ওর চড়া, তীক্ষ্ণ ডাক শোনা যাচ্ছে, ততক্ষণ ওকে দেখার কোনো দরকার নেই। কেননা ওকে খুব শক্ত করে বাঁধা হয়েছে। চিতাটার ওকে তুলে নিয়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই।
সূর্য যখন লাল আগুনের গোলার মত কেদারনাথের উপরের তুষারচূড়ার এক হাতের মধ্যে, তখন আমরা পাথরের পিছনে লুকোই। তার খানিকটা বাদে ছাগলটা হঠাৎ ডাক থামাল। তখন কয়েক মিনিট মাত্র ছায়া পেয়েছি আমরা।
আমি হামাগুড়ি দিয়ে, পাথরের পাশে গিয়ে ঘাসের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, ছাগলটা কান খাড়া করে ঝোপগুলোর দিকে চেয়ে আছে। আরো দেখলাম, ছাগল মাথা বাঁকিয়ে দড়িটা পুরো টেনে পিছিয়ে গেল।
চিতাটা নিশ্চয় ছাগলের ডাক শুনেই এসেছে। চিতার উপস্থিতি টের পাওয়ার আগে অবধি ছাগলটা লাফায় নি। এই দেখেই বোঝা গেল ছাগলটা সন্দিগ্ধ। ইবটসনের লক্ষ আমার চেয়ে নির্ভুল হবে। কেননা ওর রাইফেলে টেলিকোপিক সাইট লাগানো আছে। তাই আমি ওকে জায়গা করে দিলাম।
শুয়ে ও যখন রাইফেল তুলল, আমি ফিসফিস করে বললাম, ছাগলটা যে ঝোপগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে, ও যেন সেই ঝোপগুলো ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে। আমার মনে হল, ছাগলটা যদি চিতাটাকে দেখতে পেয়ে থাকে লক্ষণ দেখে তাই মনেই হচ্ছে, তা হলে ইবটসনও নিশ্চয় ওর শক্তিশালী টেলিকোপ দিয়ে চিতাটাকে দেখতে পাবে। ইবটসন কয়েক মিনিট টেলিকোপ চোখে লাগিয়ে রাখল, মাথা নাড়ল, রাইফেল নামিয়ে আমাকে জায়গা করে দিল।
শেষ যে-অবস্থায় ওকে দেখেছি, ছাগলটা সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আমি সেই একই ঝোপের ওপর টেলিসকোপ নিশানা করলাম। চোখের পলক-ফেলা, কম-সে-কম কান কিংবা গোঁফের নড়াচড়া, টেলিকোপ দিয়ে দেখা যাবেই। কিন্তু কয়েক মিনিট লক্ষ করেও আমি কিছুই দেখতে পেলাম না।
টেলিসকোপ থেকে চোখ সরিয়ে দেখি আলো দ্রুত মিলিয়ে আসছে। ছাগলটাকে পাহাড়ের গায়ে একটা লাল-সাদা ছোপ বলে মনে হচ্ছে। আমাদের অনেকটা পথ যেতে হবে। আর অপেক্ষা করা অহেতুক, বিপজ্জনকও বটে। আমি উঠে ইবটসনকে বললাম, এবার যাওয়া উচিত।
সেই ডাক বন্ধ করা থেকে ছাগলটা আর কোনো শব্দ করে নি। ওটাকে খুঁটি থেকে খুলে নিয়ে আমরা গ্রামের দিকে চললাম। ইবটসনের লোকটার হাতে ছাগলটার দড়ি। বোঝা গেল, যে ছাগলটার গলায় কোনোদিন দড়ি পড়ে নি। এইভাবে নিয়ে যাওয়াতে সে তীব্র আপত্তি জানাতে লাগল। আমি লোকটাকে দড়ি খুলে দিতে বললাম। পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি, কোনো ছাগলকে জঙ্গলে বেঁধে রাখার পর ছেড়ে দিলে সে, হয় ভয়ে, নয় সাহচর্য চেয়ে কুকুরের মত পায়ে-পায়ে হাঁটে। এ ছাগলটার কিন্তু অন্য মতলব ছিল। লোকটা দড়ি খুলে দিতেই ও পথ দিয়ে উলটো দিকে ছুটল।
ছাগলটার ডাকের দাম আছে। তাই ওটাকে ফেলে রেখে আসতে চাইলাম না। ডেকে ও একবার চিতাটাকে টেনে এনেছে। হয়তো আবারও আনতে পারে। তাছাড়া, মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ভাল দামে কেনা হয়েছে ওটাকে। তাই আমরা ওর পিছু ধাওয়া করলাম। ছাগলটা বাঁ-দিকে ঘুরল। আমাদের চোখের আড়ালে চলে গেল। আমরাও ছাগলটার পথ ধরেই চললাম।
পাহাড়ের চূড়ায় উঠলাম। সেখান থেকে পাহাড়ের নিচে ঘাসে-ঢাকা ছোট এলাকাটার অনেকটা দেখা যায়। ছাগলটাকে কোথাও না দেখে আমরা ভাবলাম যে ও নিশ্চয় কোনো ছোট পথ ধরে গ্রামে ফিরে গেছে। আমরাও ফিরে যাবার পথ ধরলাম। আমি আগে-আগে হাঁটছিলাম। যে একশো গজ লক্ষ পথের উপরের দিকে ছড়ানো ঝোপ, খাড়া নিচের দিকে ছোট-ছোট ঘাস, তার মাঝামাঝি এসেছি–আমাদের সামনের পথের উপর কি একটা সাদা জিনিস দেখতে পেলাম।
আলো প্রায় নেই বললেও হয়। সন্তর্পণে এগিয়ে এসে দেখি সাদা জিনিসটা হল সেই ছাগলটা। সরু পথের উপর লম্বা করে শোয়ানো, ফলে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে যায়, সে-ভয় নেই। ছাগলটার গলা থেকে রক্ত পড়ছে। আমি গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম মংসপেশীগুলি তখনো কাঁপছে।
ওই চিতাটা ছাড়া আর কেউ ছাগলটাকে মেরে পথের উপর শুইয়ে রেখে যায় নি। মনে হল, নরখাদকটা বলছে, “ছাগলটাকে খুব চেয়েছিলে তো? এই নাও। এখন অন্ধকার। তোমাদের অনেকখানি পথ যেতে হবে। দেখা যাক, তোমাদের মধ্যে কে গ্রামে জ্যান্ত পৌঁছয়!”
আমার দেশলাইয়ের একটি আস্ত বাক্স না থাকলে, সেদিন আমরা তিনজন গ্রামে বেঁচে ফিরতে পারতাম বলে মনে হয় না আমার। (ইবটসন তখন ধূমপান করত না)। একটি-একটি করে দেশলাই জ্বালাচ্ছি, চারদিকে উৎকণ্ঠায় চাইছি, কয়েক পা হাঁটছি। যতক্ষণ না গ্রামটা হাঁকের মধ্যে এল, ততক্ষণ এইভাবেই আমরা সেই উঁচু-নিচু পথ বেয়ে কোনো মতে নামলাম। আমাদের উদ্বিগ্ন চেঁচামেচিতে, লোকজন লণ্ঠন এবং পাইন কাঠের মশাল হাতে আমাদের দিকে এগিয়ে এল।
যেখানে চিতাটা ছাগলটাকে শুইয়ে রেখেছিল, পরদিন সকালে সেখানে ফিরে গিয়ে দেখি, চিতাটার খাবার ছাপ আমাদের অনুসরণ করে গ্রাম পর্যন্ত এসেছিল।
আমরা যে অবস্থায় ছাগলটাকে রেখে এসেছিলাম, ওটা ঠিক তেমনি পড়ে আছে। কেউ ছোঁয় নি।
.
১৭. সায়ানাইড প্রয়োগ
গত রাতের নিহত ছাগলটাকে দেখে আমি যখন ইন্সপেকশন বাংলোয় ফিরলাম, গ্রামে এসে খবর পেলাম, আমার রুদ্রপ্রয়াগে উপস্থিতি জরুরী দরকার। খবর এসেছে, নরখাদকটা গত রাতে ওখানে একজনকে মেরেছে। আমাকে সংবাদবাহকরা সঠিক বলতে পারল না, কোথায় লোকটাকে মারা হয়েছে। তবে নরখাদকটার থাবার ছাপ দেখে বোঝা গেল, যে ও গ্রাম পর্যন্ত আমাদের অনুসরণ করে এসে আবার ফিরতি-পথে ফিরে যায়। তারপর পথের মোড়ে এসে ডান দিকে ঘুরে যায়। পরে জেনেছিলাম, আমার অনুমান সঠিক। আমাদের কাউকে না পেয়ে ওটা পাহাড়ের আরো উঁচুতে উঠে অন্য শিকার ধরে। এ
বাংলোয় এসে দেখি, ইবটসন নন্দরাম নামে একজন লোকের সঙ্গে কথা বলছে। আমরা গত সন্ধ্যায় যেখানে বসেছিলাম, নন্দরামের গ্রাম সেখান থেকে মাইল চারেক দূরে। এই গ্রাম থেকে আধ মাইল উঁচুতে, এক গভীর খাদের অন্য ধারে, গাওইয়া। নামে অনুন্নত সম্প্রদায়ের একটি লোক, জঙ্গলের একটু ছোট জায়গা সাফ করে বাড়ি করেছিল। ওর সঙ্গে থাকত ওর, স্ত্রী আর তিনটি বাচ্চা।
সকালে নন্দরাম গাওইয়ার বাড়ির দিক থেকে নারীকণ্ঠের কান্না শুনতে পায়। ও চেঁচিয়ে জানতে চায়, কি হয়েছে। উত্তর পায়, “বাড়ির মরদকে” আধঘণ্টা আগে নরখাদকটা তুলে নিয়ে গেছে। সেই খবর নিয়ে নন্দরাম ইনসপেকশন বাংলোয় দৌড়ে এসেছে।
আরবী ও ইংব্লেজ, ঘোড়া দুটোকে জিন পরাতে বলল ইবটসন। ভাল করে খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। নন্দরাম আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। পাহাড়ে কোনো রাই নেই। শুধু ছাগল ও গরুর চলার পথ। বিরাটায় ইংরেজ ঘোড়াটি পথের অসম্ভব আঁকাবাকা মোড়গুলি ঘুরতে পারছিল না। তাই দেখে আমরা ঘোড়াগুলো ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। বন্ধুর ও চড়াই, বাকি পথটুকু উঠলাম পায়ে হেঁটে।
জঙ্গলের সেই সাফ করা নির্জন জায়গায় পৌঁছলাম আমরা। দুটি উদ্বিগ্ন রমণী আমাদের দেখাল, দরজার কাছে কোথায় গাওইয়া বলছিল, কোথায় নরখাদকটা ওকে ধরে। ওদের তখনো আশা আছে, বাড়ির মরদ বেঁচে আছে।
চিতাটা বেচারাকে গলায় কামড়ে ধরে। সেই জন্যেই ও কোনো আওয়াজ করতে পারে নি। একশো গজ টেনে নিয়ে গিয়ে তবে ওকে মারে। মারবার পর গাওইয়াকে চিতাটা, ঘন ঝোপে ঢাকা খাতে টেনে নিয়ে যায় আরো চারশো গজ দুরে। মেয়েদের কান্নাকাটি আর নন্দরামের চিৎকারে নিশ্চয় চিটার খাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটে। কেননা, ও গাওইয়ার গলা, চিবুক, একটা কাঁধ আর উরুর কিছুটা অংশ মাত্র খেয়েছে।
আমরা বসতে পারি, এমন কোনো গাছ শিকারটার কাছাকাছি ছিল না। তাই, মড়িটার যে তিন জায়গা থেকে চিতাটা খেয়েছে, সেই তিন জায়গায় সায়ানাইড বিষ প্রয়োগ করলাম। এর মধ্যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছিল। আমরা কয়েকশো গজ দূরে পাহাড়ে এক জায়গায় বসলাম। চিতাটা নিশ্চয় ঘন ঝোপের মধ্যেই কোথাও ছিল। কিন্তু যদিও আমরা লুকিয়ে দু-ঘণ্টা নজর রাখলাম, কিছুই দেখতে পেলাম না। সন্ধ্যা হতে, সঙ্গে-আনা লণ্ঠন জ্বালিয়ে আমরা বাংলোয় ফিরে গেলাম।
পরদিন উঠলাম খুব ভোরে। যখন খাদের উপরের পাহাড়ে গিয়ে বসেছি, তখন সবে আলো হচ্ছে। কিছু দেখা গেল না, কিছু শোনা গোল না? সূর্যোদয়ের ঘণ্টাখানেক বাদে আমরা মড়ির কাছে গেলাম। যে-তিন জায়গায় বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল, সেগুলো চিতা ছোঁয় নি। খেয়েছে অন্য কঁধ আর পা থেকে। লাশটাকে আরো কিছুদূর টেনে নিয়ে গিয়ে ঝোপের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছে।
এখানেও বসার মতো কোনো গাছ নেই, এবং দীর্ঘ পরামর্শের পর ঠিক হল ইটসন মাইলখানে নিচে একটা গ্রামে গিয়ে একটা বড় আম গাছে মাচান বেঁধে রাত কাটাবে, আর আমি মড়িটা থেকে চারশো গজ দূরে একটা গাছের উপর বসব। সেখানেই আগের দিন নরখাদকটার থাবার ছাপ দেখেছি।
যে গাছটায় আমি কসব ঠিক করলাম সেটা একটা রডোডনড্রন গাছ, অনেক বছর আগে মাটি থেকে ফুট পনেরো উপরে গাছটা কাটা হয়েছিল চারপাশের ডালপালার জন্য, যেখানে কাটা হয়েছিল তার চারপাশে শক্ত-শক্ত ডাল বেরিয়েছে, ফলে ওই ডাল-ঘেরা কাণ্ডটার উপর বেশ চমৎকার লুকিয়ে থাকার ও আরাম করে বসার জায়গা হল।
আমার সামনের দিকে একটা খাড়া পাহাড়। ঘন ব্র্যাকেন এবং ছোট-ছোট বাঁশ-ঝোপে ঢাকা। পাহাড়ের গায়ে পুব থেকে পশ্চিমে একটা পায়ে-চলা পথ। পথটা বহু-ব্যবহৃত এবং তার ফুট-দশেক নিচে আমার রডোডেনড্রন গাছটা।
গাছের উপর থেকে দশ গজ পরিমাণ রাস্তা আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। পথটা আমার বাঁয়ে একটা খাদ পার হয়ে সমান হয়ে চলে গিয়ে ঘুরে এসেছে। তারপর আমার ডাইনে তিনশো গজ দূরে একটা ঝোপের সামান্য নিচ দিয়ে গিয়েছে। ওই ঝোপটার নিচেই মড়িটা পড়ে আছে। খাদটার যেখানে পথটা গিয়ে নেমেছে সেখানে জল ছিল না, কিন্তু ত্রিশ গজ নিচের দিকে, ঠিক আমার গাছটার নিচেই, গাছ থেকে তিন-চার গজ দূরে কয়েকটা ছোট-ছোট জলাশয় ছিল। ওগুলো একটা ছোট ঝরনার উৎসস্থল। ঝরনাটা নিচে নেমে একটি ছোট নদীতে পরিণত হয়ে গিয়ে গ্রামের লোকের পানীয় আর সেচের জল যোগায়।
রাস্তার যে দশ গজ আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম, সেখানে তিনশো গজ উপরের পাহাড়ে গাওইয়ার ঘর থেকে একটা সরু পথ সোজা নেমে এসে সমকোণ করে মিশেছে। বাড়িটা আমার থেকে তিনশো গজ উপরে। এই পথটার ত্রিশ গজ উপরে একটা বাঁক এবং সেখান থেকে একটা ছোট খাদ শুরু হয়ে নিচের পথটায় এসে মিশেছে। উপরের পথে যেখানটায় খাদটা শুরু হয়েছে আর নিচের পথে সেটা যেখানে এসে মিশেছে, সে দুটো জায়গাই আমার দৃষ্টির আড়ালে।
টর্চের কোনো দরকার ছিল না কারণ চাঁদের উজ্জ্বল আলো ছিল। এবং চিতাটা যদি সমতল পথটা দিয়ে অথবা ওই উপরের পথটা দিয়ে আসে–আর থাবার ছাপে তো বোঝাই গেছে আগের দিন তাই করেছে–আমি তাহলে খুব সহজেই ত্রিশ চল্লিশ ফুট পাল্লার ভিতরে থেকে গুলি করার সুযোগ পাব।
ইবটসনের সঙ্গে পাহাড় দিয়ে খানিকটা নেমে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে সূর্যাস্তের কিছুটা আগে গাছের উপর উঠে বসলাম। কয়েক মিনিট পরে তিনটে কালিগি ফেজেন্ট, একটি মোরগ, দুটি মুরগি, পাহাড় দিয়ে নেমে এসে ঝরনায় গিয়ে জল খেল, তারপর যে পথ ধরে এসেছে সেই পথ ধরে ফিরে গেল। দুবারই ওরা আমার গাছটার ঠিক নিচ দিয়েই গেল, এবং আমাকে তারা দেখতে না পাওয়ায় প্রমাণ হল যে আমার লুকোনোর জায়গাটা ভালই।
রাতের প্রথম দিকটা সব চুপচাপ ছিল। কিন্তু আটটার সময় মড়িটার দিক থেকে একটা কাকার ডাকতে শুরু করল। চিতাটা এসেছে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস হল যে, যে দুটো রাস্তা আমি পাহারা দিচ্ছি তার কোনোটা দিয়েই সে আসে নি। কাকারাট কয়েক মিনিট ঢেকে থামল। রাত দশটা পর্যন্ত সব চুপচাপ কাটল। তখন কাকারটা আবার ডাক শুরু করল। ঘণ্টা-দুই চিতাটা মড়ির কাছে ছিল। বেশ ভাল করে খাওয়ার পক্ষে ঐ সময় যথেষ্ট। এর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ বিষও নিশ্চয়ই খেয়ে ফেলেছে, কেননা এই দ্বিতীয় রাত্রিতে মড়িটাতে প্রচুর পরিমাণে বিষ দেওয়া হয়েছে। লাশের গভীরে ভাল করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল সায়নাইড।
আমি নিষ্পলক দৃষ্টিতে সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। চাঁদের আলো এত উজ্জ্বল যে প্রতিটি ঘাসের ডগা পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল। রাত দুটোর সময়ে শুনতে পেলাম চিতাটা বাড়ির রাস্তা ধরে আসছে। আমি এই পথে কিছু শুকনো পাতা ছড়িয়ে রেখেছিলাম, উদ্দেশ্য ছিল যে চিতার আগমনের আভাস পাওয়া। ও যে এই পাতাগুলির উপর দিয়ে অসাবধানে হাঁটছে, নিঃশব্দে আসার কোনো চেষ্টা করছে না দেখে আমি আশান্বিত হলাম যে ওর অবস্থা ভাল নয়। আমার অবশ্য আশা ছিল যে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে আমি ওকে গুলিবিদ্ধ করতে পারব।
রাস্তার বাঁকে চিতাটা একটু দাঁড়াল, তারপর রাস্তা ছেড়ে ছোট খাদটায় ঢুকল, সেটা ধরে নিচের রাস্তায় নেমে আবার দাঁড়াল।
আমার হাঁটুর উপর রাইফেল। তার উপর হাত রেখে বহু ঘণ্টা নড়াচড়া না করে বসেছিলাম। আমার ধারণা ছিল যে চিতাটা রাস্তা ধরে আসবে। আমি ঠিক করেছিলাম যে ওকে আমার সামনে দিয়ে যেতে দেব। ও যখন আমার নড়াচড়া আর দেখতে পাবে না, আমি রাইফেল তুলে যেখানে খুশি সেখানে গুলি করব।
বেশ কয়েক সেকেণ্ড আমি পথটার উপর নজর রাখলাম, ডালপালার আড়াল থেকে ওর মাথাটা বেরুবে আশা করলাম। যখন এ উত্তেজনা অসহ্য লাগছিল তখন শুনতে পেলাম যে ওটা রাস্তা থেকে লাফিয়ে নামল এবং কোনাকুনিভাবে আমার গাছের দিকে আসতে লাগল। আমার একবার মনে হল যে ও কোনো রহস্যময় উপায়ে গাছের উপর আমার উপস্থিতির কথা জেনে গেছে; এবং ওর আগের শিকারের স্বাদ আর ভাল না লাগায় নতুন মানুষ-শিকার খুঁজছে; ওর পথ ছাড়ার উদ্দেশ্যে আমাকে ধরা নয়। ও ঝরনার কাছে পৌঁছবার জন্য রাস্তা ধরল, কেননা সে-গাছের নিচে দাঁড়াল না। পরের মুহূর্তে শুনতে পেলাম ওর জল খাওয়ার আগ্রহ, জোর শব্দ।
চিতাটার পাহাড়ের উপর চলাফেরা এবং জল খাওয়ার ধরণ দেখে মনে হল যে ওকে বিষে ধরেছে। কিন্তু সায়ানাইডের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। আমি জানতাম না বিষটা কাজ করতে কত সময় নেবে। চিতাটা জল খাওয়া বন্ধ করার দশ মিনিট পরে মনে হল যে ও হয়তো ঝরনার কাছে মরে গেছে। সেই সময় আমি শুনতে পেলাম ও খাদের ওপারের পাহাড় ধরে উঠে যাচ্ছে। ও যখন পাহাড়ের চূড়া ঘেরা রাস্তাটায় পৌঁছল আবার সব নিস্তব্দ হয়ে গেল।
যখন চিতাটা রাস্তা ধরে নামল, খাদ ধরে এল, পাহাড় বেয়ে আমার গাছের নিচে– এল, যখন জল খেল, খাদের ওপারের পাহাড়ে উঠে গেল–কোনো সময়ে আমি ওকে দেখতে পেলাম না। কি দৈবঘটনায়, কিংবা স্বেচ্ছায় ও এমন জায়গায় লুকিয়ে থাকল যেখানে চাঁদের একটু রশ্মিও ঢোকে নি। আমার গুলি চালাবার আশা আর ছিল না। তবে নৈনিতালের ডাক্তারের কথা মত বিষটা যদি সত্যিই শক্তিশালী হয়ে থাকে তাহলে গুলি চালাবার আর প্রয়োজন ছিল না।
বাকি রাতটা বসে কাটালাম, নজর রাস্তার উপর, কান আওয়াজ শুনবার জন্য সজাগ। দিনের আলো হতে ইবটসন ফিরল। এই সময়ে চা বস্তুটি খুবই আদরের। তাই বানাতে বানাতে ইবটসনকে রাত্রের ঘটনাগুলি বললাম।
মড়ির কাছে গিয়ে দেখলাম যে চিতাটা একটা পা খেয়েছে, যেখানে থেকে দু-রাত আগে অল্প একটু অংশ খেয়েছিল, সেখানে আমরা প্রচুর পরিমাণে বিষ প্রয়োগ করেছিলাম। তাছাড়া আরো দু জায়গায় থেকে বিষ খেয়েছে, বাঁ কাধ এবং পিঠ থেকে।
এখন চিতাটার অনুসন্ধান করা দরকার। গ্রামের পাটোয়ারী ইবটসনের সঙ্গে ফিরেছিল। তাকে লোক সংগ্রহ করতে পাঠানো হল। বেলা বারটা নাগাদ সে দুটো লোক নিয়ে হাজির হল। তাদের সারি-সারি সাজিয়ে আমা চিতাটা যেদিকে গেছে সেদিকের পাহাড়টায় ঝাঁপান করলাম।
যেখানে চিতাটা তৃষ্ণা নিবারণ করেছিল, তার থেকে আধমাইল দূরে কতকগুলি বড় বড় পাথর ছিল। চিতাটা এদিকেই গিয়েছিল। পাথরগুলির তলায় একটি গুহা ছিল। সেটা পাহাড়ের অনেকটা ভিতরে ঢুকে গেছে। ওটার মুখটা চিতার পক্ষে যথেষ্ট বড়। এই গুহার মুখে চিতাটা জমি আঁচড়েছে এবং মড়ির পায়ের আঙুলগুলি বমি করে বার করেছে। এগুলিকে ও আস্ত গিলেছিল।
বহু আগ্রহী হাত পাহাড়ের গা থেকে পাথর টেনে নিয়ে এল। আমরা চলে আসার আগে গুহার মুখ এমনভাবে বন্ধ করে এলাম যে ভিতরে যদিও বা কোনো চিতা থাকে, তার পালাবার আর কোনো সম্ভাবনা থাকল না।
পর দিন সকালে আমি এক ইঞ্চি চওড়া তারের জাল এবং কিছু তাবু খাটাবার লোহার খুঁটি নিয়ে এলাম। পাথর সরিয়ে গুহার মুখটা জাল দিয়ে বন্ধ করলাম। তার পর-পর দশ দিন সকালে এবং সন্ধ্যায় গুহাটায় আসতাম। এই সময়ে অলকানন্দার বাঁ-পারের কোনো গ্রাম থেকে নরখাদকটার কোনো খবর আসছিল না দেখে আমার আশা রোজ ক্রমাগত বাড়তে লাগল যে হয়তো পরের দিনই এসে কোনো নিশানা পাব যে চিতাটা গুহার ভিতরে মরে গেছে।
দশম সকালে যখন গুহা থেকে ফিরলাম–জালটাকে দেখলাম কেউ মাড়ায় নি। ইবটসন আমাকে খবর দিল যে গত রাত্রে পাঁচ মাইল দূরের একটা গ্রামে একজন মহিলা নিহত হয়েছে। রুদ্রপ্রয়াগ-বদ্রীনাথ যাওয়ার তীর্থপথের এক মাইল উপরে।
যে জন্তু আর্সেনিক এবং স্ট্রীকনিন খেয়ে বেঁচে থাকে এবং যার শরীরে এই সব দ্রব্য উত্তেজক-পদার্থের কাজ করে, বোঝাই গেল, তারপক্ষে সায়ানাইড সঠিক বিষ নয়। চিতাটা যে সায়ানাইড খেয়েছিল সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। আরো সন্দেহ নেই, যে ও গুহাটায় ঢুকেছিল। কেননা গুহাতে ঢুকবার সময় একটা পাথরে ওর পিঠের লোম লেগেছিল।
হয়তো বিষের পরিমাণ বেশি হয়েছিল বলে কোনো প্রতিক্রিয়া হয় নি, এবং হয়তো পাহাড়ের গায়ে গুহায় কোনো দ্বিতীয় রন্ধ্র ছিল বলে ও পালাতে পেরেছে। আমার চিতাটার সঙ্গে পরিচয় মাত্র কয়েক মাস। তবুও আমি আর অবাক হলাম না যে গাড়োয়ালের লোকরা–যারা চিতাটার সঙ্গে দীর্ঘ আট বছর ধরে নিবিড় এবং অন্তরঙ্গভাবে বসবাস করেছে–ওকে-জন্তু বা প্রেতাত্মা-অলৌকিক ক্ষমতার মালিক, বলে বিশেষিত করেছে। তাদের বদ্ধ ধারণা ছিল যে আগুন ছাড়া এই দুষ্ট আত্মাকে তাড়ানো যাবে না।
.
১৮. অল্পের জন্য
যে খবর প্রতিটি জনসাধারণের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ, সেটা খুব দ্রুত ছড়ায়। গত দশ দিন ধরে গাড়োয়ালের সবাই শুনেছিল যে নরখাদকটার উপর বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে এবং আমাদের আশা যে তাকে গুহায় বন্দী করা হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক যে সবাই ঝুঁকি নিতে শুরু করেছিল। প্রত্যক্ষরূপে বোঝাই গেল যে চিতাটা বিষের প্রতিক্রিয়া থেকে সেরে উঠে গুহা থেকে পালাবার রাস্তা খুঁজে নেয়, এবং প্রথম যে-জন ঝুঁকি নিচ্ছিল তাকে ধরে।
আমি সকাল থাকতেই গুহা থেকে ফিরেছিলাম। সারা দিনটা পড়ে ছিল। প্রাতরাশ খেয়ে ইটসনের নির্ভরযোগ্য ঘোড়ার পিঠে চড়ে রাইফেল হাতে নিয়ে সেই গ্রামের দিকে চললাম। যেখান থেকে মহিলাটির নিহত হওয়ার খবর এসেছে।
তীর্থপথ ধরে জোরে ঘোড়া ছোটালাম। পাহাড়ের উপর দিয়ে একটা কোণাকুনি রাস্তা ধরলাম। সেটা এক মাইল দূরে গিয়ে–গ্রামের রাস্তার সঙ্গে মিশেছে। সে সন্ধিস্থলে ধস্তাধস্তির চিহ্ন এবং অনেকখানি জমাট রক্ত।
গ্রামপ্রধান এবং নিহত মহিলাটির আত্মীয়রা আমাদের জন্য গ্রামে অপেক্ষা করছিল। যেখানে বাড়ির দরজা বন্ধ করে বেরোবার সময় চিতাটা মহিলাটিকে ধরে, তারা আমাদের সে জায়গাটা দেখাল। এখান থেকে চিতাটা মহিলাটিকে চিত অবস্থায় একশো গজ টেনে দুই রাস্তার মোড় পর্যন্ত টেনে নিয়ে যায়। সেখানে ও মহিলাটিকে ছেড়ে দেয়। তারপর খুব ধস্তাধস্তির পর তাকে মেরে ফেলে।
যখন মহিলাটিকে মাটিতে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, এবং যখন সে চিতাটার বিরুদ্ধে প্রাণ বাঁচাবার জন্য লড়াই করছিল, তখন গ্রামের লোকেরা ওর চিৎকার শুনতে পায়, কিন্তু ভয়ে কোনো সাহায্য করে নি।
মহিলাটি মারা যাওয়ার পরে চিতাটা তাকে তুলে একটা পতিত জমি পার হয়। সেটার পর একটা একশো গজ চওড়া খাদ ছিল। সেটা পার হয়ে লাশটাকে নিয়ে যায় আরো দুশো গজ পাহাড়ের উপরে। মাটিতে কোনো টেনে নিয়ে যাওয়ার দাগ পড়ে নি, কিন্তু রক্তের দাগ অনুসরণ করা সহজই ছিল। সেই দাগ আমাদের নিয়ে যায় একটি সমতল জমিতে। জমিটা চারফুট চওড়া এবং কুড়ি ফুট লম্বা। এই সরু জমিটার উপর দিকে লম্বাভাবে অবস্থিত আট ফুট উঁচু ঢিপি ছিল। তার উপরে একটা খর্বকায় মেডলার গাছ।
নিচের দিকে যেখানে পাহাড়টা হঠাৎ উৎরাই হয়ে যায়, একটি বুনো গোলাপের ঝোপ, ঝোপটা উপরদিকে বেড়ে মেডলার গাছটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়েছে। ওই ঢিপি এবং গোলাপের ঝোপটার মাঝখানে, ঢিপির উপরে মাথা রেখে পড়ে আছে। শিকারটা। গায়ে একটুকু আবরণ নেই। নগ্ন দেহের উপরে ঝরে পড়েছে সাদা গোলাপের পাপড়ি–একজন পাকা চুল বৃদ্ধা, বয়স সত্তর।
এই মর্মান্তিক হত্যার জন্য চিতাটাকে জীবন দিতে হবে। আমরা যুদ্ধের পরামর্শ করার পর ইবটসন বাড়তি ঘোড়াটাকে নিয়ে রুদ্রপ্রয়াগে ফিরে গেল আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস আনতে। আমি রাইফেল নিয়ে বেরোলাম। দিনের আলোয় নরখাদকের মুখোমুখি হওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টায়।
অঞ্চলের এই এলাকাটা আমার কাছে নতুন। আমার প্রথম কাজ হবে জায়গাটা পরিদর্শন করা। আমি গ্রাম থেকেই লক্ষ করেছি যে পাহাড়টা খাদ থেকে চড়াইয়ে চার-পাঁচ হাজার ফুট উঠে গেছে। পাহাড়ের দু’হাজার ফুট উপরে ওক এবং পাইনের ঘন জঙ্গল, তার নিচে আধ মাইল চওড়া ছোট ঘাস ভর্তি খোলা জমি। ঘাস-জমির নিচে ঝোপ-জঙ্গল।
ঘাস এবং ঝোপ-জঙ্গলের পাশ দিয়ে আমি পাহাড়ের অন্য দিকে চলে গেলাম। আমার সামনে দেখলাম একটা খাদ। আধ মাইল নিচে গিয়ে তীর্থপথে মিশেছে। বহুদিন আগে মাটি ধসে খাদটা সৃষ্টি হয়েছিল। খাদটার উপর দিকটা একশো গজ চওড়া, এবং নিচের দিকটা যেখানে তীর্থপথে মিশেছে, তিনশো গজ চওড়া। তার পরে ফাঁকা মাঠ।
খাদের মাটি ভেজা। ভেজা মাটির উপর গজিয়েছে কিছু বড় বড় গাছ, গাছের নিচে ঘন ঝোপ-জঙ্গল। খাদের উপর দিয়ে ঝুলে পড়া পাথরের উত্রাই উচ্চতায় কুড়ি থেকে চল্লিশ ফুট বাড়ছে ও কমছে-দৈর্ঘ্য একশো গজ; এই উত্রাইয়ের মাঝামাঝি কয়েক ফুট চওড়া ফাটল, সেখান দিয়ে ছোট একটি জলধারা কুলকুল করে নামছে। পাথরগুলির উপর ঝোপ-জঙ্গলের সরু ফালি। তার উপরে আবার খোলা ঘাসের মাঠ।
আমি খুব সাবধানে জায়গাটা পরিদর্শন করলাম। চিতাটা নিশ্চয় খাদের কোথাও লুকিয়ে ছিল। অমি চাই নি যে ও আগে থেকে আমার উপস্থিতি টের পায়। তাতে আমার সুবিধা হবে না। এবার আমার জানা দরকার মোটামুটি কোন্ জায়গায় চিতাটা লুকিয়ে আছে। তার জন্যে আমাকে মড়ির কাছে ফিরে যেতে হল।
গ্রামেই আমাদের বলা হয়েছিল যে, মহিলাটি নিহত হওয়ার কিছু পরে আলো হয়। তাকে মেরে, চারশো গজ টেনে নিয়ে, কিছুটা অংশ খেতে চিতাটার নিশ্চয় কিছুটা সময় লেগেছে। এর থেকে অনুমান করা যায় যে যেখানে মড়িটাকে লুকনো হয়েছে সেই জায়গাটা ছাড়তে সকাল হয়ে গিয়েছিল। যে পাহাড়ে মড়িটা পড়ে ছিল, সেটা গ্রামটার পুরো দৃষ্টিসীমার মধ্যে। এই সময়ে গ্রামে নিশ্চয় লোক-চলাচল শুরু হয়েছিল। চিতাটা তাহলে মড়ি ছেড়ে নিশ্চয় গা-ঢাকা দিয়ে পালিয়েছিল। মাটি খুব শক্ত থাকাতে ওর থাবার ছাপ দেখা যাচ্ছিল না। এই দুটি অনুমানের উপর ভিত্তি করে আমি ওকে অনুমানিত পথ ধরে অনুসরণ করতে লাগলাম।
আমি আধ মাইল দূরে গ্রামের দৃষ্টির বাইরে খাদের কাছাকাছি এসে পড়লাম। দেখে তৃপ্ত হলাম যে আমি চিতাটার পায়ে-পায়ে চলে এসেছি। একটা ঝোপের, বাতাসের উল্টো দিকে আলগা মাটি ছিল। তার উপরে ওর থাবার ছাপ দেখে বোঝ গেল যে এই জায়গাটা ছেড়ে সে পাথরে উবাই-এর পঞ্চাশ গজ নিচ থেকে খাদটায় ঢুকেছে।
যেখানে চিতাটা লুকিয়েছিল, আমি সেখানে আধ ঘণ্টা শুয়ে আমার সামনের গাছ এবং ঝোপ-জঙ্গল ভর্তি ছোট এলাকাটা লক্ষ করলাম। আশা করছিলাম যে চিতাটা একটু নড়েচড়ে ও কোথায় আছে, নিশানা দেখাবে।
কয়েক মিনিট নিরীক্ষণ করার পর ঝরা পাতার উপর শব্দ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। একটু পরে দুটি সিমিটার ব্যাবলার পাখিকে দেখা গেল, খুব অধ্যবসায় সহকারে পাতা উলটে পোকা খুঁজছে। মাংসাশী জীব সম্বন্ধে এই পাখিরা জঙ্গলের ভিতরে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংবাদবাহক। আমার আশা হল যে পরে এই দুজনকে দিয়ে চিতাটার অবস্থানের খোঁজ বার করব।
কোনো নড়াচড়া দেখা যাচ্ছিল না, এবং কেননা শব্দ থেকে বোঝা যাচ্ছিল না যে চিতাটা খাদের মধ্যে আছে কি না। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ও আছে, এবং এক উপায়ে যখন গুলি করা সম্ভব হল না, আমি অন্য উপায় অবলম্বন করলাম।
চিতাটা খোলা জায়গায় না এলে দুটি রাস্তা ধরে পালাতে পারে। একটি হল উত্রাই ধরে তীর্থপথের দিকে, এবং অন্যটা চড়াই ধরে উপরে। ওকে পাহাড় বেয়ে নামালে আমার সুবিধা হবে না। কিন্তু যদি ওকে পাহাড়ের উপর দিকে ধাইয়ে নেওয়া যায়, ও নিশ্চয় সেই পাথরের ফাটলটার দিকে গিয়ে উত্রাই-এর উপরের ঝোঁপগুলিতে আশ্রয় নেবে। এই সময়ে ওকে গুলি করার পর্যাপ্ত সুযোগ পাওয়া যাবে।
যেখানে চিতাটা থাকতে পারে তার একটু নিচ দিয়ে আমি খাদটায় ঢুকলাম। আমি আঁকা-বাঁকাভাবে খুব আস্তে হাঁটতে লাগলাম। অল্প-অল্প করে কয়েক ফুট উঠতে লাগলাম। এখানে ফাটলটার উপর চোখ রাখার কোনো প্রয়োজন ছিল না, কেননা ব্যাবলার দুটি ঠিক তার কয়েক ফুট নিচে ছিল, এবং চিতাটা নড়লে ওরাই আমাকে সতর্ক করবে।
আমি আঁকাবাঁকাভাবে খাদ দিয়ে হেঁটে প্রায় চল্লিশ গজ উঠেছি। তখন আমি ফাটল থেকে দশ গজ নিচে একটু বাঁয়ে। হঠাৎ ব্যাবলার দুটি ভয় পেয়ে ডানা মেলল। ছোট একটা ওক গাছের ডালে বসে উত্তেজিত হয়ে লাফাতে লাগল এবং ওদের স্পষ্ট এবং জোরাল ডাক ডাকতে লাগল, যে ডাক পাহাড়ী অঞ্চলে আধ মাইল দূর থেকে শোনা যায়। আমি দ্রুত গুলি চালাবার জন্য রাইফেলটা ধরলাম। এক মিনিট নিশ্চলভাবে দাঁড়িয়ে আবার আস্তে-আস্তে সামনে এগোলাম।
এখানে জমিটা ভেজা এবং পিচ্ছিল। আমি ফাটলের উপর চোখ নিবদ্ধ করে দু-পা এগোতেই আমার রবার-সোলের জুতো ভেজা-মাটিতে পিছলে গেল। আমি টাল সামলাতে-সামলাতে চিতাটা এক লাফে ফাটলে উঠে গেল। উপরের ঝোঁপ থেকে এক রাশ কালিগি ফেজেন্ট আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল।
আমার দ্বিতীয় উদ্যমও নিষ্ফল হল। আমার পক্ষে চিতাটাকে আবার তার আদি অবস্থানে তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সহজ। কিন্তু তাতে আমার কোনো লাভ হবে না। কেননা, উপর থেকে দেখতে গেলে, পাথরের ফাটলটা একদম কাছে না–আসলে দেখা যায় না, এবং সেই জায়গায় আমি পৌঁছবার আগেই চিতাটা খাদ দিয়ে অনেক দূর নেমে যাবে।
আমার এবং ইবটসনের, খাদের ভোলা জায়গায় দেখা হওয়ার কথা দুপুর দুটোয়। ও তার একটু আগে রুদ্রপ্রয়াগ থেকে ফিরল–সঙ্গে বেশ কিছু লোক, ও যা আনতে গিয়েছিল বহন করে আনছে। এর মধ্যে ছিল খাবার, পানীয় —তার মানে চা–আমাদের পুরনো সঙ্গী পেট্রোম্যাক্স। যদি দরকার পরে এবার ওটাকে আমি বয়ে বেড়াব। দুটো অতিরিক্ত রাইফেল, গুলি-বারুদ, আমার মাছ ধরার ছিপ, বেশি পরিমাণে সায়ানাইড, এবং জাঁতিকল।
খাদের মধ্যে একটা স্বচ্ছ নদীর ধারে বসে আমরা দিনের আহার খেলাম। চা পর্ব। শেষ করে আবার মড়িটার কাছে ফিরে গেলাম।
এবার আমি মড়িটার অবস্থান সম্বন্ধে বলব। আপনারা তাহলে আমাদের গতিবিধি এবং পরবর্তী ঘটনাগুলি বুঝতে পারবেন।
চার ফুট চওড়া ও কুড়ি ফুট লম্বা সমতল ভূমিটার খাদের দিকের পাঁচ ফুটের কাছাকাছি মড়িটা পড়ে ছিল। এই ভূমিখণ্ডটার উপর দিকটা উঁচু ঢিপিদ্বারা সুরক্ষিত। নিচের দিকে ছিল ভীষণ উত্রাই এবং ছড়ানো গোলাপের ঝোঁপ। ঢিপির উপরের খর্বকার মেডলার গাছটা মাচানের ভার বইবার পক্ষে উপযুক্ত ছিল না। সেই কারণে আমরা ঠিক করলাম যে বন্দুক, বিষ ও জাঁতিকলের উপর নির্ভর করব। এই সিদ্ধান্তে আসার পর আমরা যোগাড়যন্ত্র করতে লাগলাম।
প্রথমে মড়িটায় বিষ প্রয়োগ করলাম। সময়ের অভাবে চিতাটা এর অল্প অংশ খেয়েছিল। আশা ছিল যে এবার ও যথেষ্ট পরিমাণে আহার করে নিজেকে বিষিয়ে তুলবে। চিতাটা যে-জায়গায় যে-ভাবে দাঁড়িয়ে খেতে পারে, আমি সেভাবে সেই জায়গায় দাঁড়ালাম। আমার ওপর চোখ রেখে, ইবটসন ওর .২৬৫ ম্যানলিকার যেটার ঘোড়া খুব হালকা এবং আমার ৪৫০ হাই-ভেলসিটি রাইফেল দুটোকে দুটো ডালের সঙ্গে বাঁধল। আমরা যে-দিক দিয়ে মুড়ির কাছে যাব, ডাল দুটো সে দিকে।
চিতাটা যে-কোনো দিক দিয়ে মুড়ির দিকে আসতে পারে। কোথাও কোনো অনতিক্রম্য বাধা ছিল না। অবশ্য আমি ওকে যেখানে-দেখেছিলাম, সেখান থেকে ওর আসার স্বাভাবিক রাস্তা হল পনের ফুট মত সমতল জমি ধরে। আমরা এই সমতল জমিটাতেই বড় জাঁতিকলটা পুতলাম। পোঁতার আগে জমি থেকে প্রতিটি শুকনো পাতা, হোট-ছোট কাঠ-কুটো, ঘাস তুলে ফেললাম।
আমরা–এরপর পর্যাপ্ত মাপের এক গর্ত খুঁড়লাম-লম্বা, চওড়া এবং গভীর। খুঁড়ে-তোলা মাটি দূরে নিয়ে গেলাম। গর্তে কলটা বসিয়ে স্প্রিং-এ চাপ দিয়ে কুলের চোয়াল দুটি ফাঁক করলাম। কলে, একটা প্লেট আছে যেটা ট্রিগারের কাজ করে। সেটাকে যতটা সম্ভব খুব সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রণ করলাম।
কলটাকে এবার সবুজ পাতা দিয়ে ঢাকা হল, তার উপর দেওয়া হল মাটি শুকনো পাতা, কাঠ-কুটো, ঘাস-ঠিক যেভাবে আগে ছিল। কলটা এত ভালভাবে পোঁতা হল যে আমরা, যারা কলটা পেতেছিলাম, ওটার সঠিক অবস্থান খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
এবার আমার মাছ ধরার সুতোর কাঠিম বার করা হল। শক্ত রেশমের সুতোর একদিকটা বাঁধা হল একটা রাইফেলের ঘোড়ার বাঁটে জড়িয়ে মড়িটার দশ ফুটের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হল। সেখান থেকে ঘুরিয়ে এনে দ্বিতীয় রাইফেলটার বাঁটে জড়িয়ে ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা হল। এবার সুতোটাকে কাটা হল–আমার বেশ দুঃখ হল। সুতোটা নতুন এবং ভাল ছিল–একটা দিক বাঁধা হল মহিলাটির কোমরে। তার ভিতর দিয়ে সুতোটা চালিয়ে ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা সুতোগুলিকে টেনে শক্ত গিট দেওয়া হল। দ্বিতীয় বারের জন্য, সুতোটাকে আবারও কাটা হল।
আমরা শেষ বারের মত নিজেদের হাতের কাজটা দেখলাম–বেশ ভালই মনে হল। এবার খেয়াল হল যে চিতাটা যদি ঘুরে এসে আমাদের দিক থেকে মড়িটার দিকে যায়, তাহলে ও সম্ভবত বন্দুক এবং ফাঁদ এড়িয়ে যেতে পারে। সেটা বন্ধ করার জন্য আমরা গ্রাম থেকে একটা শাবল আনতে বললাম।
ইতিমধ্যে আমরা কিছুদূর থেকে পাঁচটা কাঁটাঝোপ কেটে নিলাম। সমতল জমিতে আমাদের দিকটা শাবল দিয়ে এক ফুট গভীর পাঁচটা গর্ত খুঁড়ে দিলাম, যাতে ঝোঁপগুলি শক্ত এবং স্বাভাবিক দেখায়, যেন ওগুলি পাহাড়ের গায়েই গজিয়েছে। এবার আমাদের প্রত্যয় হল যে ইঁদুরের চেয়ে বড় কোন জন্তু কোনো না-কোনো রূপে মৃত্যুকে এড়িয়ে মড়িটার কাছে এসে কোনো অংশ খেতে পারবে না। রাইফেল দুটির সেটি-ক্যাচ খুলে দিয়ে গ্রামে ফিরে এলাম।
গ্রাম থেকে পঞ্চাশ গজ দূরে যেখানে আমরা এসে জমাট রক্ত দেখেছিলাম তার কাছে, একটা ডালপালা ছড়ানো আমগাছ ছিল। গ্রাম থেকে পাটাতন এনে এই গাছে মাচান বানালাম। তার উপরে দিলাম সুগন্ধি খড়। ওর উপরে রাত কাটানোই আমাদের উদ্দেশ্য। আমাদের প্রত্যাশা ছিল যে চিতাটা একবার ফাঁদে পড়লে ওকে শেষ করতে হবে।
আমরা যখন মাচানে উঠলাম তখন প্রায় সূর্যাস্ত। মাচানটা বেশ লম্বা এবং চওড়া ছিল যাতে আমরা পাশাপাশি লম্বা হয়ে শুতে পারি। মাচান থেকে খাদের ওপাশের মড়িটার দূরত্ব দুশো গজ, এবং মাচান থেকে মভিটা একশো ফুট উঁচু জমিতে।
ইবটসনের ভয় ছিল যে ওর রাইফেলে লাগান টেলিসকোপিক-সাইট দিয়ে ওর লক্ষ নির্ভুল হবে না। সেই কারণে ও খাপ থেকে একজোড়া শক্তিশালী ফিল্ড— গ্লাস বার করল আর আমি আমার .২৭৫ রাইফেলে গুলি ভরলাম। আমরা ঠিক করলাম যে চিতাটার যে রাস্তা দিয়ে আসার কথা, সেই জায়গাটার উপর ইটসন লক্ষ রাখবে আর আমি পুরো পাহাড়টার উপরই ব্যাপকভাবে নজর রাখব। যদি চিতাটাকে দেখা যায় আমি গুলি করবার ঝুঁকি নেব। যদিও গুলি করতে হবে আমার রাইফেলের শেষ পাল্লায়, এবং সেটা হল তিনশো গজ।
ইবটসন ঝিমোচ্ছিল। আমি ধূমপান করতে-করতে দেখলাম পশ্চিমের পাহাড়ের ছায়া আমাদের সামনের পাহাড়ে গুটিগুটি উঠছে। যখন অস্তমান সূর্যের রশ্মিতে পাহাড়ের চূড়া রক্তিম হয়ে উঠল, ইবটসন জাগল। তুলে নিল ফিল্ড-গ্লাস, আমি তুললাম রাইফেল। কেননা, যে-সময়ে চিতাটা দেখা দেবে বলে আমরা আশায় আছি, সে-সময় এসে গেছে। দিনের আলোর তখনও পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি ছিল এবং সেই সময়টুকু আমাদের মাচান থেকে পাহাড়ের যে বিস্তীর্ণ এলাকা দেখা যায়, তার প্রতিটি ফুট ভাল করে নিরীক্ষণ করলাম–আমি এক জোড়া চোখ দিয়ে যেমন চোখ মাত্র কয়েকজন ভাগ্যক্রমে পায়, আর ইবটসন দেখল ওর ফিল্ড-গ্লাস দিয়ে। কোনো জন্তু বা পাখির সাড়াশব্দ পেলাম না।
যখন আর গুলি চালাবার মত যথেষ্ট আলো ছিল না, আমি রাইফেল নামালাম। একটু পরে ইবটসন ফিল্ড-গ্লাস খাপে ভরে ফেলল। চিতাটাকে মারার একটা সুযোগ নষ্ট হল, কিন্তু তখনও তিনটি সুযোগ বাকি, কাজেই আমরা অযথা নিরুদ্যম হলাম না।
অন্ধকার হওয়ার একটু পরে বৃষ্টি শুরু হল। আমি ইবটসনকে ফিসফিস করে বললাম যে এতে আমাদের কাজ পণ্ড হতে পারে, কেননা বৃষ্টির জলের বাড়তি ওজনে সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রিত কলের চোয়াল বন্ধ হয়ে যেতে পারে, কিংবা মাছ ধরার সুতো জলে ভিজে কুঁকড়ে গিয়ে রাইফেলের হাল্কা ঘোড়ায় টান মেরে গুলি চালিয়ে দেবে।
একটু পরে ইবটসন আমার কাছে সময় জানতে চাইল। তখনও বৃষ্টি পড়ে চলেছে। আমার কব্জিতে লুমনাস ঘড়ি ছিল। আমি ওকে বললাম যে সময় হয়েছে পৌনে আটটা, তখন মড়িটার দিক থেকে পরপর হিংস্র এবং ক্রুদ্ধ গর্জন শোনা গেল–চিতাটা, রুদ্রপ্রয়াগের সুপ্রসিদ্ধ নরখাদক চিতাটা অবশেষে ফাঁদে পড়েছে।
ইবটসন এক লাফে মাচান থেকে নামল, আমি ডাল ধরে নামলাম। নামতে গিয়ে যে কারুর হাত-পা ভাঙে নি সেটা আমাদের সৌভাগ্য। পেট্রেমাটা কাছের একটা মিষ্টি আলুর খেতে লুকানো ছিল। ইবটসন ওটা ধরাতে ধরাতে আমি আমার ভয় এবং অনিশ্চয়তা সম্বন্ধে উক্তি করলাম। ইবটসন তার যোগ্য পাল্টা জবাব দিল।
“তুমি একটা বাজে দুঃখবাদী। প্রথমে বলে যে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জন্য ফাঁদটা বন্ধ হয়ে যাবে, আমার রাইফেল থেকে গুলি ছুটে যাবে। এখন ভাবছ যে চিতাটা কোনো আওয়াজ করছে না মানে ওটা ফাঁদ থেকে পালিয়েছে।”
আমি ঠিক তাই ভাবছিলাম এবং ভয় পাচ্ছিলাম। আরেকবার যখন একটা চিতাকে ফাঁদে ফেলেছিলাম, সেটা ক্রমাগত গর্জন, এবং চিৎকার করেছিল। কিন্তু এই চিতাটা, ওই প্রথম ক্রোধপূর্ণ গর্জনের পর, যে-গর্জন শুনে আমরা মাচান থেকে হুড়মুড় করে নামলাম, নিস্তব্ধ হয়ে আছে। অতি অমঙ্গুলে এই স্তব্ধতা।
ইবটসন সব রকমের লণ্ঠন জ্বালাতে দক্ষ। খুব অল্প সময়ের মধ্যে সে পেট্রোম্যাক্সটাকে জ্বালিয়ে পাম্প করে ফেলল। আমাদের সব দ্বিধা দূরে সরিয়ে শক্ত জমির উপর দিয়ে ছুটলাম। ইবটসনও এখন এই দীর্ঘ নৈঃশব্দে সন্দিহান হয়ে পড়েছে। আমরা কিছুটা ঘুরে উপর থেকে মড়িটার দিকে গেলাম, উদ্দেশ্য হল সুতোগুলি এবং সম্ভবত জুব্ধ চিতাকে এড়িয়ে যাওয়া।
উঁচু ঢিপি থেকে নিচের জমির গর্তটা দেখলাম, কিন্তু কলটার কেননা, চিহ্ন নেই। আমাদের আশা আবার চড়ে উঠল, কিন্তু পেট্রোম্যাক্সের উজ্জ্বল আলোয় এবার কলটা দেখা গেল–চোয়াল বন্ধ এবং শূন্য। পাহাড়ের ঢালে দশ গজ নিচে পড়ে আছে। মড়িটা আর ঢিপিতে মাথা দিয়ে পড়ে নেই। ক্ষণিক দৃষ্টিপাতে দেখা গেল যে ওটার বেশ কিছুটা অংশ খাওয়া হয়েছে।
আমরা আমগাছে ফিরে গিয়ে মাচানে উঠলাম–আমাদের মন এত তিক্ত-বিরক্ত, যে ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। আর আমাদের জেগে থাকার প্রয়োজন ছিল না। কাজেই নিজেদের উপর খড় চাপা দিয়ে আমাদের বিছানা ছিল না, এবং রাত্রিটা খুব ঠাণ্ডা ছিল–আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম।
পর দিন ভোরের প্রথম আলো ফুটতেই আমগাছের কাছে আগুন জ্বেলে জল গরম করা হল। আমরা বেশ কয়েক কাপ চা খেয়ে আগুন পোয়ালাম। তারপর পাটোয়ারী, ইবটসন, আমার এবং গ্রামের কিছু লোক নিয়ে মড়িটার দিকে গেলাম।
আমি বলছি যে আমরা দুজন ছাড়া আমাদের সঙ্গে পাটোয়ারী এবং আরো কয়েকজন লোক ছিল। কেননা আমি যদি একলা থাকতাম তাহলে এবারে আপনাদের যা বলব সেটা বলতে ইতস্তত করতাম।
পিশাচ কি পশু, বৃদ্ধার হত্যাকারী যদি উপস্থিত থেকে আমাদের রাতের যোগাড়যন্ত্র দেখত তাহলেও এটা বোঝা মুশকিল, যে ও কি করে এক অন্ধকার, বর্ষণমুখর রাতে কোনো-না-কোনো উপায়ে ধরা-পড়ে মৃত্যু থেকে বাঁচল? যদিও হাল্কা বৃষ্টিই পড়েছিল, তাতেই মাটি নরম হয়েছিল এবং ওর গত রাত্রের প্রতিটি গতিবিধি মনে-মনে পুনর্গঠন করে বুঝতে পারলাম।
যেদিক থেকে আশা করেছিলাম, সেদিক থেকেই চিতাটা এসেছিল। সমতল জমিটার কাছে এসে ও ওটার নিচে দিয়ে ঘুরে আসে। তারপর যেদিকে আমরা শক্ত করে কাঁটাঝোঁপ পুঁতেছিলাম, সেদিক থেকে মড়িটার কাছে আসে। ও তিনটি ঝোঁপ টেনে তুলে নিজের যাওয়ার মত জায়গা করে নেয়। তারপর মড়িটাকে ধরে ফুটখানেক রাইফেলগুলির দিকে টেনে নেয়।
তাতে সুতোগুলি ঢিলা হয়ে যায়। তারপর সে খেতে শুরু করে। খাওয়ার সময় সে মহিলাটি কোমরে জড়ানো সুতোটাকে ছোঁয়নি। আমরা মড়ির মাথা এবং ঘাড়ে বিষ দেওয়ার কথা ভাবি নি। এগুলিকে সে প্রথমে খায়, তারপর অতি সাবধানে, বিষ-দেওয়া জায়গাগুলির মাঝখান থেকে বাকি সব অংশটুকু খেয়ে ফেলে।
ক্ষুধা নিবৃত্তির পর চিতাটা মড়ি ছেড়ে বৃষ্টি থেকে আশ্রয় নিতে যায়। এই সময় আমি যে ব্যাপারে ভয়টা করেছিলাম সেটাই হয়। খুব সূক্ষ্মভাবে নিয়ন্ত্রিত কলে বৃষ্টির জল পড়ে বাড়তি ওজন সৃষ্টি করে। তাতে প্লেটটা, মানে ট্রিগারটা, নেমে গিয়ে ম্প্রিংগুলিকে ছেড়ে দেয়। ঠিক এই সময়ে চিতাটা কলটাকে ডিঙিয়ে যাচ্ছিল। বড় চোয়াল দুটি ওর পিছনের পায়ের হাঁটুতে ধরে। এটাই হল সবচেয়ে আফসোসের বিষয়।
যে-লোকরা রুদ্রপ্রয়াগ থেকে কলটা নিয়ে আসছিল অরা ওটাকে মাটিতে ফেলে দিতে একটা তিন ইঞ্চি লম্বা দাঁত ভেঙে যায়। চিতাটার হাঁটু কলের চোয়ালে যে-জায়গায় চেটে যায়, ঠিক সেখানকার দাঁতটাই ভাঙা ছিল। সেই জন্য সেইখানে ফাঁক ছিল, বাকি জায়গায় দাঁতগুলি ঠিক সারি-সারি।
এই দাঁতটা ঠিক থাকলে চিতাটা কল থেকে বেরোতে পারত না। কেননা ওর পায়ে সেটা শক্ত করেই চেপে ধরেছিল, যাতে করে ও আশি পাউন্ড ওজনের কলটাকে গর্ত থেকে তুলতে পারে। যে-গর্তে আমরা কলটা পুঁতেছিলাম, তারপর সেটাকে পাহাড়ের গা দিয়ে দশ গজ নিচে টেনে নিয়ে যায়। এখন চিতাটার বদলে আছে শুধু এক গোছ লোম আর এক টুকরো চামড়া, যেটা পরে অনেক পরে–ঠিক জায়গায় জোড়া লাগাবার তৃপ্তি হয়েছিল।
চিতাটা গতিবিধি যতই অবিশ্বাস্য হোক না কেন, যে পশু আট বছর ধরে নরখাদক হয়েছে, তার কাছ থেকে এই ধরনেরই গতিবিধি আশা করা যায়। খোলা জমি এড়িয়ে চলা, মড়ির কাছে গা-ঢাকা দিয়ে যাওয়া, রক্তের দাগের উপর বসানো কাঁটাঝোপ সরানো, আহারের জন্য সুবিধাজনক জায়গায় মড়ি টেনে নেওয়া, বিষ দেওয়া অংশগুলি বাদ দেওয়া–সায়ানাইডের পূর্ব-অভিজ্ঞতা ওর ছিল, ওটার বড় তীব্র গন্ধ–এগুলি ওর পক্ষে খুবই স্বাভাবিক।
ফাঁদ ভাঙার যে ব্যাখ্যাটা আমি দিলাম, সেটা সঠিক বলেই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বৃষ্টির জলের বাড়তি ওজনের জন্য চোয়াল বন্ধ হওয়ার সময়েই যে চিতাটা ওটা ডিঙিয়ে যাচ্ছিল, সেটা ঘটনার সমাপতন।
আমরা ফাঁদটা খুলে ফেলে অপেক্ষা করলাম যাতে করে আত্মীয়রা ওই বৃদ্ধার দেহাবশেষ শবদাহের জন্য নিয়ে যেতে পারে। তারপর আমরা দুজনে হেঁটে রুদ্রপ্রয়াগের দিকে চললাম, আমাদের লোকরা পরে আসবে এই কথা রইল।
রাত্রে কোনো সময়ে চিতাটা আমগাছের কাছে এসেছিল। যেখানে-জমাট রক্ত পড়েছিল এবং যে রক্ত বৃষ্টিতে ধুয়ে যায়, সেখানে আমরা ওর থাবার ছাপ দেখতে পাই। আমরা থাবার ছাপ অনুসরণ করে দেখলাম; যে সেগুলি তীর্থপথে নেমে গেছে। গেটের একটা থামের তলার মাটি আঁচড়ে চিটা আরো এক মাইল দূরে আমার পুরনো বন্ধু মালবাহকের ক্যাম্পে গিয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে ওর একটা ছাগলকে মারে।
পৃথিবীর যে কোনো অঞ্চলে আপনাদের মধ্যে যাঁরা শিকারার্থে রাইফেল হাতে নিয়েছেন, তাদের বলার প্রয়োজন নেই যে এতগুলি অকৃতকার্যতা এবং নৈরাশ্য আমাকে দমাতে পারে নি, বরং আমার সংকল্প আরো জোরাল হল যে, আমি কাজ চালিয়ে যাব, যতদিন না সেই শুভ দিন কিংবা রাত আসে যেদিন বিষ এবং ফাঁদ পরিত্যাগ করে আমি আমার রাইফেল, যেমনভাবে উচিত, তেমনি করেই ব্যবহার। করার সুযোগ পাব। নরখাদকের দেহ সঠিক এবং অব্যর্থভাবে গুলিবিদ্ধ করব।
.
১৯. সতর্কতার শিক্ষা
কিছু শিকারী ভাবেন, যে তারা অলক্ষুণে বলেই বড় জানোয়ার শিকারে ব্যর্থ হন। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই।
শিকারী নিজে আশাবাদী, নিরাশাবাদী যাই হন না কেন, তিনি যে-জন্তুকে গুলি করবার, কিংবা তার ছবি তুলবার জন্য অপেক্ষা করে আছেন, শিকারীর চিন্তাধারা কোনোমতেই তার গতিবিধিকে প্রভাবিত করতে পারে না।
আমরা ভুলে যাই যে, যে বন্য প্রাণীদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি, বিশেষ যে-প্রাণীরা খাদ্য সংগ্রহ এবং আত্মরক্ষার জন্যে এই ইন্দ্রিয়গুলির উপর নির্ভর করে–সভ্য মানুষের তুলনায় অতি উঁচু স্তরের। এত উঁচু যে আমরা সম্ভাব্য শিকারে কিছু দেখতে বা শুনতে পাচ্ছি না বলে, তারাও আমাদের চলাফেরার আওয়াজ পাচ্ছে না, চলাফেরা দেখতে পাচ্ছে না, এ অনুমানের কোনো ন্যায্য কারণই নেই।
বন্য প্রাণীর বুদ্ধি বিষয়ে ভুল ধারণাপোষণ, এবং কোনো শব্দ, বা নড়াচড়া না করে প্রয়োজনীয় সময়টুকু বসে থাকায় ব্যর্থতাই হল জানোয়ার শিকারে সকল ব্যর্থতার কারণ। মাংসাশী পশুর সঠিক শ্রবণ-ক্ষমতা, এদের সঠিক কারো দেখা হলে কত যে সতর্ক হতে হয়, তার দৃষ্টান্ত হিসাবে আমার একে অধুনা অভিজ্ঞতার কথা বলি।
মার্চ মাসের একটি দিন; মাটিতে শুকনো পাতার গালচের উপর প্রতিটি মরা পাতা ঝরে পড়ার শব্দ পাওয়া যায়, মাটিতে-খুঁটে খাওয়া ছোট-ছোট পাখিদের প্রতিটি নড়াচড়া বুঝতে পারা যায়। অনেক দিন ধরে একটা বাঘের ছবি তোলার চেষ্টা করেছি। সেটা যেদিকে শুয়ে আছে বলে আন্দাজ করেছি সেদিকে একদল হনুমানকে চালিয়ে দিয়ে খুব ঘন ঝোঁপ জঙ্গলের মধ্যে বাঘটার সঠিক অবস্থিতি টের পেয়ে গিয়েছি। বাঘটা থেকে সত্তর গজ দূরে একটা কঁকা জমি। পঞ্চাশ গজ লম্বা ত্রিশ গজ চওড়া জমিটার পাশে, বাঘের বিপরীত দিকে একটা বড় গাছ-ঘন লতায় একেবারে মাথা পর্যন্ত ঢাকা। মাটি থেকে কুড়ি ফুট উপরে গাছটা দুটো ডালে ভাগ হয়ে উঠেছে। আমি জানতাম বেলা শেষ হয়ে এলে বাঘটা জমিটা পার হবে, কারণ জমিটা তার ও তার শিকার-করা সম্বরটার মাঝ-বরাবর। সম্বরটাকে সেদিনই সকালে দেখতে পেয়েছি। মড়ির কাছাকাছি কোথাও দিনের বেলাটা শুয়ে কাটানোর মত উপযুক্ত আড়াল না থাকায় বাঘটা সরে গিয়েছে ঐ ঘন জঙ্গলটার ভেতর, সেখানে হনুমানগুলোই আমাকে তার সন্ধান পাইয়ে দিয়েছে।
পায়ে হেঁটে বাঘ বা চিতা শিকার করা বা তার ছবি তোলার জন্যে জন্তুটার সঠিক অবস্থিতি জানা প্রায়ই প্রয়োজন হয়, তা সেটা কোনো আহত প্রাণীকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্যেই হক অথবা ফোটো তোলার জন্যেই হক। তার প্রকৃষ্টতম উপায় হচ্ছে জীবজন্তু বা পাখিদের সাহায্য নেওয়া। খানিকটা ধৈৰ্য্য এবং তাদের অভ্যাস সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান থাকলে বিশেষ একটা প্রাণী বা পাখিকে ইচ্ছেমত দিকে চালানো কঠিন কাজ নয়। এ কাজে পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে উপযোগী হচ্ছে লাল জংলি মোরগ, ময়ূর এবং সাদা-মাথা ছাতারে পাখি, আর জন্তুদের মধ্যে সবচেয়ে উপযোগী হচ্ছে কাকার ও হনুমান।
যে বাঘটার কথা আমি বলছি সেটা আহতও নয়, এবং ঝোপের ভেতরে ঢুকে সেটাকে আমি নিজেও সহজেই খুঁজে বের করতে পারতাম। কিন্তু তা করতে গেলে তার বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটত এবং ফলে আমার নিজের উদ্দেশ্যই ব্যাহত হত। ঝোপের মধ্যে বাঘটা নজরে পড়লে তাদের প্রতিক্রিয়া কী হবে জানা থাকায় তাদের সাহায্য নিয়ে বাঘটাকে বিরক্ত না করেই যা জানার তা জেনে গেলাম।
খুব সন্তর্পণে ঐ গাছটার কাছে এগোলাম। লতাগাছটার উপরের দিকের পাতাগুলো বাঘটার নজরে আসতে পারে ভেবে গাছের দুই ডালের মাঝখানটায় চড়ে বসলাম–নিখুঁতভাবে লুকিয়ে আরামে বসার মত জায়গা বটে সেটা। ১৬ মিলিমিটার সিনে-ক্যামেরাটা বের করে সামনের পাতাগুলোর মধ্যে ছবি তোলার মতো একটা ফাঁক তৈরি করলাম। নিঃশব্দে এসব শেষ করে আমি বসে থাকলাম চুপচাপ। আমার সামনে দৃশ্যমান রইল ফাঁকা জমি আর তার ঠিক পিছনের জঙ্গলটা।
ঘণ্টাখানেক বসে থাকার পর একজোড়া ব্রোঞ্জ-পাখা ঘুঘু জঙ্গলটা থেকে উঠে নিচু ঝোপগুলোর উপর দিয়ে উড়ে চলে গেল এবং এক কি দু-মিনিট পরে, আমার একটু কাছে, ছোট একঝাক পাহাড়ী পিপিট মাটি ছেড়ে উঠে একটা ন্যাড়া গাছের ডালগুলোর ভিতর দিয়ে একেবারে উপরে উঠে উড়ে চলে গেল।
এই দু-জাতের পাখির কোনোটারই বিপদজ্ঞাপক কোনো ডাক নেই, কিন্তু তাদের আচরণ দেখে আমি বুঝলাম যে বাঘটা উঠে দাঁড়িয়েছে এবং তাদের সন্ত্রস্ত করে দিয়েছে। কয়েক মিনিট ধরে আমি আস্তে-আস্তে বাঁ থেকে ডাইনে আমার নজর ফেরাতে লাগলাম। আমার সামনে যতটা জায়গা দেখা যায়, তার প্রতি ফুট জায়গা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে লাগলাম। এই সময় আমার দৃষ্টি গিয়ে ঠিক আমার সামনের দিকে ফাঁকা জমিটার কিনার থেকে দশ ফুট দূরে এক কি দুই বর্গইঞ্চি মাপের একটা ছোট জিনিসের উপর আবদ্ধ হল।
খানিকক্ষণ ঐ নিশ্চল জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থেকে ডানদিকে দৃষ্টিসীমার মধ্যকার ঝোপগুলো নজর করে গিয়ে আবার সেই সাদা জিনিসটার উপর নজর ফিরিয়ে আনলাম।
এইবার আমি নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারলাম যে, ঐ জিনিসটাকে মিনিটখানেক বা মিনিট-দুয়েক আগে প্রথম যেখানটায় দেখেছি সেখানে সেটা আর নেই এবং সেটা বাঘের মুখের একটা সাদা দাগ ছাড়া আর কিছুই নয়। বোঝা যাচ্ছে যে যদিও আমার পায়ে পাতলা রবারের জুতো ছিল এবং জ্ঞানত কোনো শব্দই আমি করি নি, তবুও আমি যখন গাছটার দিকে এগোচ্ছিলাম বা গাছে উঠেছিলাম তখন বাঘটা সে শব্দ শুনতে পেয়েছে।
যখন তার মড়ির কাছে যাওয়ার সময় হয়েছে তখন সে শুকনো পাতার উপর দিয়ে সত্তর গজ দূরের ঐ সন্দেহজনক শব্দটার উৎপত্তিস্থলের দিকে ভাল করে নজর করে দেখেছে। নড়াচড়া না করে আধ ঘণ্টা ধরে শুয়ে থাকার পর সে উঠে দাঁড়াল, আড়মোড়া ভাঙল, হাই তুলল, তারপর ভয়ের কিছু নেই দেখে বেরিয়ে পড়ল খোলা জমিটার উপর। সেখানে দাঁড়িয়ে সে মাথাটা একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে ঘোরাল। তারপর জমিটা পার হয়ে সোজা আমার গাছটার তলা দিয়ে মুড়ির কাছে চলে গেল।
জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানোর সময় মাংসাশী প্রাণী শিকারের জন্যে তৈরি মাচানগুলো প্রায়ই আমার চোখে পড়ে এবং যখন দেখতে পাই মাচান বানানোর জন্যে কাছে-পিঠে চারাগাছগুলো কাটা হয়েছে, দেখার সুবিধের জন্যে ডালপালা ছাঁটা হয়েছে আর আশে-পাশে পড়ে রয়েছে টুকরো-টাকরা ফালতু জিনিস, তখন চিন্তা করি এসব কাজের সময়ে কী পরিমাণ কথাবার্তা ও হৈ-হল্লা চলত। সেইজন্যে আমি বিস্মিত হই না, যখন কেউ বলে যে চিতা বা বাঘের জন্যে কয়েকশোবার বসে থেকেও তারা কোনোবার একটিরও দেখা পায় নি এবং এই ব্যর্থতার জন্যে দায়ী করে মন্দ ভাগ্যকেই।
এ পর্যন্ত যে নরখাদকটাকে মারতে পারি নি তার কারণ এ নয় যে আমরা এমন কিছু করেছি, যা করা উচিত ছিল না। অথবা এমন কিছু করি নি, যা করা উচিত ছিল। এর জন্যে একমাত্র দোষ দেওয়া যায় ভাগ্যকে। দুর্ভাগ্যটর্চ-লাইটটা সময়মত এসে পোঁছল না। ইটসনের দু-পায়েই টান ধরল। চিতাটা পরিমাণের অতিরিক্ত সায়ানাইড খেয়ে ফেলল। এবং সর্বশেষ, বাহকটা জাঁতিকলটা ফেলে দিয়ে, যে-দাঁতটা সবচেয়ে দরকারী সেটাই ভেঙে ফেলল।
সুতরাং আমরা চিতাটাকে তার সত্তর-বছর-বয়স্ক শিকারের মড়িতে আনতে ব্যর্থ হওয়ার পর ইবটসন যখন পাউরি ফিরে গেল, আমার আশা তখনো পুরোমাত্রায়, কেননা চিতাটাকে গুলি করার সম্ভাবনাটা রুদ্রপ্রয়াগে আসার প্রথম দিনের মতই রয়েছে, বরং এখন আমি প্রাণীটার ক্ষমতা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল হওয়ায় সে সম্ভাবনা আগের চেয়েও বেশিই হয়েছে।
একটা জিনিস আমার খুব অস্বস্তি ও মর্মপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেটা হচ্ছে নরখাদকটাকে নদীর একটা পাড়ে আটকে রাখা। যেভাবেই দেখি না কেন, অলকানন্দার বাঁ-পাড়ের লোকরাই শুধু চিতাটার আক্রমণের আওতাভুক্ত হয়ে থাকবে আর ডান-পাড়ের লোকদের সে-রকম আক্রমণের ঝুঁকি থাকবে না, এটা মোটেই উচিত মনে হচ্ছিল না।
আমরা আসার দু-দিন আগে যে-ছেলেটি মারা পড়েছে তাকে নিয়ে মোট তিনজন ইদানীং বাঁ-পাড়ে প্রাণ হারিয়েছে, এবং আরো অনেকেরই সেই দশা হতে পারে। তবু পুলদুটো খুলে দিয়ে চিতাটাকে নদীর ডান-পাড়ে চলে যেতে দিলে আমার অসুবিধেগুলো শতগুণ বেড়ে যাবে, এবং তাতে সামগ্রিকভাবে গাড়োয়ালেরও কোনো উপকার হবে না। কারণ নদীর ডান-নিকের মানুষগুলোর জীবনও বাঁ-দিকের মানুষদের জীবনের মতই সমান মূল্যবান।
সুতরাং অনিচ্ছাসত্ত্বেও আমি পুলদুটো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তই করলাম। নদীর বাঁ-পাড়ের বহু সহস্র মানুষদের আমি শ্রদ্ধা জানাই এ-জন্যে যে, পুল বন্ধ রাখার অর্থ ভয়ঙ্কর নরখাদকটার কার্যকলাপগুলো তাদের এলাকার ভিতরই গণ্ডীবদ্ধ করে রাখা। একথা জেনেও তবু যে ক-মাস পুলগুলো আমি বন্ধ করে রেখেছিলাম, তার মধ্যে একবারও তারা বাধাগুলো অপসারণের চেষ্টা করে নি, বা আমাকে তা করতে অনুরোধ করে নি। পুলদুটো বন্ধ রাখা সাব্যস্ত করে আমি গ্রামবাসীদের তাদের বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক করে দেওয়ার জন্যে লোক পাঠিয়েছিলাম, নিজেও যতটা সময় পেলাম আর পায়ে হেঁটে যতটা সম্ভব, বিভিন্ন গ্রামে বলে বেড়লাম। গ্রামে বা পথে যত লোকের সঙ্গে কথা বলেছি তাদের একজনকেও চিতাটা তদের এলাকায় গণ্ডীবদ্ধ রাখার জন্যে একটিবারও অসন্তোষ প্রকাশ করে নি, এবং যেখানেই গিয়েছি আতিথ্য আপ্যায়ন পেয়েছি এবং শুভেচ্ছা কুড়িয়েছি। কেউ জানে না কে নরখাদকটার পরবর্তী শিকার হয়ে পড়তে পারে, তবু এমনই সব স্ত্রী ও পুরুষের কাছ থেকেই এই আশ্বাস পেয়ে প্রচুর উৎসাহ বোধ করেছি। চিতাটা গতকাল মারা পড়ে নি তে আফসোসের কিছু নেই, কারণ সেটা নিশ্চয়ই আজ নয় তো আগামী কাল মারা পড়বে।