ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। গোরানসাহেব শিক্ষিত, পণ্ডিত মানুষ, তিনি বলেছেন এখানে ড্রাকুলা এসেছিল। গোরক্ষনাথ অশিক্ষিত, সংস্কারাচ্ছন্ন, তার কথায় কান দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই, সে ওই কথা বলতেই পারে। কিন্তু বেড়াল কাক শকুন এমন অদ্ভুত আচরণ করবে কেন? অতদূরে বুকে হাঁটা সাপটাকে কানা কাক দেখে ভয় পেয়ে চিৎকার করবে, এটাও তো ভাবা যায় না।
হঠাৎ হাওয়া বইতে লাগল। ওরা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে দেখল সেটা যেন ঝড়ের চেহারা নিল। ঝড় হচ্ছে অথচ আকাশে একফোঁটাও মেঘ নেই। পাশে এসে দাঁড়িয়ে মেজর বললেন, হচ্ছেটা কী?
সামনের জঙ্গলটা এখন অস্থির। গাছগুলো প্রবলবেগে ডালপালা নেড়ে চলেছে। কয়েক সেকেন্ড এইরকম চলার পর আচমকা প্রকৃতি শান্ত হয়ে গেল। হঠাৎ গোরানসাহেব চিৎকার করলেন, লুক।
অর্জুন দেখল একঝাঁক বাদুড়জাতীয় প্রাণী গাছগুলো থেকে উড়ে আসছে। ওদের উড়ে আসার ভঙ্গিটা খুব হিংস্র। গোরানসাহেব টর্চের আলো ফেলতে চাইলেন ওদের ওপরে। গোরক্ষনাথ তৎক্ষণাৎ লাঠিসুদ্ধ খাঁচাগুলোকে ওপরে তুলে নিল। নিতেই কাক বেড়াল এমনকী শকুনটাও চিৎকার শুরু করে দিল। নীচের দিকে শোঁ শোঁ করে নেমে আসা বাদুড়গুলো ঢেউয়ের মতো ওপরে উঠে গিয়ে পাহাড়ের দিকে চলে যেতেই গোরক্ষনাথের পোষ্যরা শান্তু হল। মেজর তাকিয়ে ছিলেন পাহাড়ের দিকে, বললেন, চশমাটা পালটাতে হবে। মনে হচ্ছে পাওয়ার বেড়েছে।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেন?
বাদুড়গুলো আচমকা ঝাপসা হয়ে গেল, দেখতে পেলাম না।
চাঁদ ড়ুবে যাচ্ছে পাহাড়ের ওপাশে। হঠাৎ জ্যোৎস্না চলে যাওয়ায় অন্ধকার ঘন। হয়ে গেছে বেশ। গোরানসাহেব বললেন, এবার ফিরে যাওয়া যাক। প্রথমদিনের পক্ষে যথেষ্ট হয়েছে।
মেজর খুব খুশি হলেন। পকেট থেকে একটা নি বের করে খানিকটা তরল পদার্থ গলায় ঢেলে বললেন, ফেরা যাক। এখনই ভোর হবে। তোমরা নিশ্চয়ই বাংলোয় ফিরে গিয়ে বিছানায় উঠে বসবে কিন্তু আমি এই জঙ্গলের ভোরটাকে লনে বসে এনজয় করব। আন্ডারস্ট্যান্ড?
কেউ জবাব দিল না। গোরানসাহেবের টর্চের আলো ওদের পথ দেখাচ্ছিল। একটু একটু করে অন্ধকার পাতলা হয়ে আসছে। এবার বাংলোর পেছনটাকে দেখতে পেল ওরা। ছায়া ছায়া, অস্পষ্ট। হঠাৎ অর্জুন দাঁড়িয়ে গেল। সে কি ঠিক দেখছে? কোনও মানুষের ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কথা নয়। কিন্তু লম্বা গাউন পরা কেউ কি ওখানে দাঁড়িয়ে! সে মেজরের হাত ধরে দাঁড় করালো, দেখুন তো, বাংলোর পেছনে কাউকে চোখে পড়ে কিনা?
মেজর দেখলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, উঁহু, না। অবশ্য আমার এই চশমাটাকে পালটাতে হবে। তবু বলছি, না। ওখানে এখন কে যেতে পারে? আমাদের ড্রাইভারটা? ব্যাটার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ওখানে যাবে কেন? সাপের খবরটা কি জানে না বুন্ধুটা?
গোরানসাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন, কী হয়েছে?
মেজর আবার হাঁটা শুরু করে তাঁর কাছে পৌঁছে অর্জুনের কল্পনার কথা বললেন। গোরানসাহেব অর্জুনের দিকে তাকালেন, তুমি কি কোনও লম্বা ফিগার দেখেছ, যার পোশাক কালো? একটু বেঁকে দাঁড়ানো?
অর্জুন বলল, হ্যাঁ, যদিও আমি ঠিক নিশ্চিত নই!
আমিও দেখেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝলাম ওটা একটা সরু গাছ। প্রচুর পাতা থাকায় এতদূর থেকে কালো পোশাক পরা মানুষের মূর্তি বলে মনে হচ্ছে। চলো।
বাংলোয় পৌঁছবার আগেই ভোর হয়ে গেল। রোদ ওঠেনি, সূর্যের দেখা পাওয়া যায়নি কিন্তু তিনি আসছেন জানিয়ে চমৎকার এক আলোয় পৃথিবী আলোকিত হল। এখন অন্ধকার যা আছে তা গাছের পাতার আড়ালে।
বারান্দায় উঠে এসে দেখা গেল বসার ঘরের দরজাটা খোলা। মেজর বললেন, সর্বনাশা দরজা খোলা কেন? কেউ কি ঢুকেছিল?
অর্জুন হেসে বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা চোর এতদূরে জঙ্গলের মধ্যে চুরি করতে অন্তত রাত্রে আসবে না। হাওয়ায় খুলে গেছে। তখন ঝড় উঠেছিল।
মেজর বললেন, আমি চোরের কথা বলছি না। যার সন্ধানে আমরা এখানে এসেছি তিনি যদি ঘুমন্ত ড্রাইভারকে একা পেয়ে চলে আসেন?
অর্জুন বসার ঘরে ঢুকল। ঘরের ভেতরে এখনও আলো ঢোকেনি। সে দ্রুত চলে গেল চার নম্বর ঘরের দরজায়। দেখল বটা উপুড় হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। ওর শোয়ার ভঙ্গি দেখে ঘাবড়ে গেল অর্জুন। ধীরে ধীরে বিছানার পাশে এসে সে ডাকল, বটা, বটা!
বটা কোনও সাড়া দিল না।
ইতিমধ্যে গোরক্ষনাথ এবং মেজর এসে দাঁড়িয়েছেন পাশে। মেজর চাপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ডেড?
অর্জুন জবাব দিল না। মেজর বললেন, গলার পাশে দাঁতের দাগ আছে কিনা ভাল করে দ্যাখো তো?
কিন্তু সেটা দেখার আগেই গোরক্ষনাথ বটার পায়ের আঙুল ধরে ঝাঁকুনি দিল। বটাবাবু! ও বটাবাবু?
সঙ্গে-সঙ্গে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল বটা। প্রথমে বুঝতে না পারলেও খুব তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বলল, আপনারা ফিরে এসেছেন? যাক বাবা। খুব চিন্তা হচ্ছিল আপনাদের নিয়ে। কারও কোনও বিপদ হয়নি তো?
হঠাৎ হো হো করে হাসতে লাগলেন মেজর, দুহাতে ভুড়ি চেপে। হাসতে হাসতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বটা অবাক হল, কী ব্যাপার বাবু?
কিছু না। চা খাওয়াতে পারো? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে করে দিচ্ছি। বটা বিছানা থেকে নেমে দাঁড়াল।
বাইরের বারান্দায় তখন মেজর গোরানসাহেবকে প্রবলবেগে হাত নেড়ে বোঝাচ্ছিলেন এই তল্লাটে দু-এক পিস ভূত থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু ড্রাকুলা নেই। তাঁর বক্তব্য, ড্রাকুলা থাকলে বটার ঘুম এ জীবনে ভাঙবে না। এতবড় খালি বাংলোয় ঘুমন্ত বটাকে পেয়েও যখন ড্রাকুলা তার রক্ত খেতে আসেনি তখন প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে তিনি এই অঞ্চলে নেই।
অর্জুন এসে কথাগুলো শুনল। গোরানসাহেব কোনও জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন। মেজর অর্জুনকে বললেন, একবার মাছ ধরতে গিয়েছিলাম কঙ্গোতে, ওখানে ব্ল্যাক লেক বলে বিশাল হ্রদ আছে। শুনেছিলাম, আমাদের কাতলা মাছের তিন ডবল সাইজের একটা মাছ, যাকে ওরা কুত্তা বলে, ওখানে পাওয়া যায়। ব্ল্যাক লেক লম্বায় মাইল পাঁচেক, চওড়ায় আধ মাইল। তিনদিন ধরে বোট নিয়ে ছিপ ফেলেছি কিন্তু কুত্তার দর্শন পাইনি। ওরা নাকি দল বেঁধে থাকে। পাঁচ মাইল লম্বা লেকের কোথায় তাঁরা থাকতেন জানি না। হাতে তিনদিনের বেশি সময় ছিল না বলে চলে আসতে হয়েছিল। এও দেখছি সেরকম। গোরান শুনেছে ড়ুয়ার্সের এইদিকে ড্রাকুলা আছে। আরে এইদিক বলতে কোনদিক? আমরা এখানে বসে আছি আর ড্রাকুলা হয়তো কোচবিহারে ঘুমোচ্ছে।
গোরানসাহেব ফিরে এসে অর্জুনের পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। ওঁর হাতে একটা মোটা ডায়েরি। তার পাতা ওলটাতে-ওলটাতে একটা জায়গায় থেমে মুখ তুললেন, নাইনটিন ফর্টিওয়ানে ছয়মাসের মধ্যে লেখা হয়েছিল চিঠি তিনটে। আমি এখানে কপি করে রেখেছি। চিঠি লিখেছিলেন জন লিঙ্কন। প্রথম চিঠি, ডিয়ার বব, আশা করি ভাল আছ। আমি এখন ইন্ডিয়ার বেঙ্গল প্রভিন্সের নর্থে বিনাহাট চাবাগানের ম্যানেজার। সুন্দর বাংলো, প্রচুর কাজের লোক, যা ইচ্ছে তাই করার ক্ষমতা আমার আছে। ইন্ডিয়া স্বাধীন হতে চাইছে কিন্তু আমার এখানে কোনও গোলমাল নেই। আমি এই চিঠি লিখছি সম্পূর্ণ অন্য কারণে। আমার আগে এই বাগানের ম্যানেজার ছিলেন উইলিয়াম রাইট। তাঁকে একদিন একটি জঙ্গলের মধ্যে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর গলায় দাঁতের চিহ্ন ছিল। সেই চিহ্ন কোনও পশু করেনি। আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বলছেন তিনি নাকি জঙ্গলের গভীরে একটি বাংলোয় একা রাত কাটাতে গিয়েছিলেন। ওই বাংলোটি করেছিলেন একজন ব্রিটিশ টি-প্ল্যান্টার, যিনি কয়েক বছর আগে মারা গিয়েছেন। এই ব্যাপারটা আমাকে খুব ভাবাচ্ছে। ভাল থেকো। শুভেচ্ছা নিও।–জন লিঙ্কন।
দ্বিতীয় চিঠি, ডিয়ার বব, তোমার চিঠি পাওয়ার আগেই আবার লিখছি। মিস্টার রবার্টকে কোনও মানুষ খুন করেনি। যে ব্রিটিশ প্ল্যান্টারের বাংলোয় গিয়ে মিস্টার রাইট খুন হন, তাঁর মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ভদ্রলোক বিয়ে করেননি। ওঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে ওঁর দুভাই লন্ডন থেকে এসেছিলেন। ওই বাংলোয় রাত কাটাতে গিয়েছিলেন তাঁরা। পরের দিন দুজনের মৃতদেহ রক্তশূন্য অবস্থায় পাওয়া যায়। তোমার কাছে অনুরোধ, লন্ডনের যেসব সংস্থা পরলোক নিয়ে গবেষণা করেন তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ঘটনাগুলো জানাও। তাঁরা কী বলেন তা জানতে আমি খুব আগ্রহী। শুভেচ্ছা নিও।–জন।
তৃতীয় চিঠি, ডিয়ার বব, তোমার চিঠি পেয়েছি। মনে হচ্ছে তুমি আমার দ্বিতীয় চিঠিটি পাওয়ার আগেই এই চিঠি লিখেছ। যাহোক, আমি খুব চিন্তায় আছি। আমার চা-বাগান হাসিমারা নামক মোটামুটি পরিচিত ব্যবসাকেন্দ্রের কাছে। এখানকার চার্চের ফাদার আমাকে সাবধান করে দিয়েছেন। ওই জঙ্গলের মধ্যে যে বাংলাটা আছে তার ধারেকাছে আমাকে যেতে নিষেধ করেছেন। বাংলোটা আমার বাগান থেকে অন্তত কুড়ি মাইল দূরে জঙ্গলের শেষে। অথচ সন্ধে হলেই মনে হয়, যাই গাড়ি নিয়ে ঘুরে আসি। গতরাত্রে একটা ঘটনা ঘটল। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল কোনও একটা শব্দে। দেখলাম আমার জানলার তারে একটা বাদুড় ঝুলছে। পোকামাকড় যাতে ঘরে না ঢুকতে পারে তাই তার লাগানো ছিল। এতবড় বাদুড় আমি কখনও দেখিনি। সঙ্গে-সঙ্গে বালিশের নীচ থেকে রিভলভার বের করে গুলি করলাম। বাদুড়টা নীচে পড়ে গেল। গুলির শব্দে কাজের লোকজন ছুটে এল। আলো জ্বেলে বাংলোর পাশে জানলার নীচটা খোঁজা হল। কিন্তু কোথাও বাদুড়টাকে পাওয়া গেল না। অথচ আমি নিজের চোখে দেখেছি ওর পেটে গুলি লেগেছিল। তুমি অবাক হবে শুনে, জানলার তারে একফোঁটাও রক্ত ছিল না। বুঝতেই পারছ, এসব কারণে আমি একটুও ভাল নেই। ছুটির দরখাস্ত করেছি। পেলেই দেশে চলে যাব কিছুদিনের জন্যে। শুভেচ্ছা নিও–জন।
চিঠি পড়া শেষ করে গোরানসাহেব বললেন, এই বাংলোটির কথাই জন লিঙ্কন তাঁর চিঠিতে লিখেছেন।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, জন নিশ্চয়ই ফিরে গিয়েছিলেন?
না। ওঁর বন্ধু চিঠিগুলো পরলোকচর্চার একটি সংস্থার কাছে জমা দিয়ে জানিয়েছিলেন যে, তাঁর বন্ধু ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।
ম্যালেরিয়া?
হ্যাঁ। গোরানসাহেব উঠে দাঁড়ালেন, অর্জুন, চলো, একটু ঘুরে আসি।
লনে পায়চারি করতে করতে গোরানসাহেব আচমকা দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর চোখ স্থির। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কী হল?
তুমি প্যাঁচাটাকে উড়ে যেতে দেখলে?
না তো! এখন তো আলো ফুটে গেছে। এসময় প্যাঁচা উড়বে কেন?
গোরানসাহেব দ্রুত বাড়ির পেছনদিকে চলে যেতে অর্জুন অনুসরণ করল। না, কোথাও কোনও প্যাঁচা নেই, কিন্তু স্টিভেনসনের কবরে ঢোকার গর্তটা কেউ সযত্নে বন্ধ করে দিয়েছে।