বেশি দূর দৌড়তে হল না। হাউ-মাউ করে খানিকটা ছুটেই একটা গাছের শেকড়ে পা লেগে হাবুল ধপাস্! সঙ্গে সঙ্গে আমিও তার পিঠের ওপর কুমড়োর মতো গড়িয়ে পড়লুম।
খাইছে–খাইছে!–হাবলা হাহাকার করে উঠল।
তারপর দুজনে মিলে জড়াজড়ি। ভাবছি পেছন থেকে এবার সেই অট্টহাসির ভূতটা এসে আমাদের দুজনকে বুঝি ক্যাঁক করে গিলে ফেলল।
কিন্তু মিনিট পাঁচেক গড়াগড়ি করেও যখন কিছুই হল না–আর মনে হল আমরা তো এখন কলেজে পড়ছি–ছেলেমানুষ আর নই, অমনি তড়াক করে উঠে পড়েছি। দুত্তোর ভূত! বাঘের গর্তে পড়েই উঠে এলুম–ভূতকে কিসের ভয়।
হাবুল সেন তো বিধ্বস্তভাবে পড়ে আছে, আর চোখ বুজে সমানে রাম রাম বলছে। বোধহয় ভাবছে ভূত ওর ঘাড়ের ওপর এসে চেপে বসেছে। থাক পড়ে। আমি উঠে জুল-জুল চোখে চারিদিকে চেয়ে দেখলুম।
অমনি আবার সেই হাসির আওয়াজ; হ্যাঁ-হ্যাঃ—হ্যাঃ।
শুনেই আমি চিংড়িমাছের মতো তিড়িং করে লাফ মেরেছি। হাবুল আবার বললে, খাইছে–খাইছে!
কিন্তু কথাটা হল, হাসছে কে! আর আমাদের মতো অখাদ্য জীবকে খেতেই বা চাচ্ছে কে!
আরে ছ্যা ছা! মিথ্যেই দৌড় করালে! কাণ্ডটা দেখেছ একবার! ওই তো বকের মতো একটা পাখি, তার চাইতে গলাটা একটু লম্বা, কদমছাঁট চুলের মতো কেমন একটা মাথা কালচে রং, কুতকুতে চোখ। আবার দুটো বড়বড় ঠোঁট ফাঁক করে ডেকে উঠল : হ্যঃ–হ্যাঃ—
—ওরে হাবলা, উঠে পড়! একটা পাখি!
হাবুল সেন কি সহজে ওঠে? ঠিক একটা জগদ্দল পাথরের মতো পড়ে আছে। চোখ বুজে, তিনটে কুইনাইন একসঙ্গে খাচ্ছে এইরকম ব্যাজার মুখ করে বললে, রামনাম কর প্যালা–রামনাম কর। এইদিকে ভূতে ফ্যাকর ফ্যাকর কইর্যা হাসতাছে আর অর অখন পাখি দেখনের শখ হইল!
কী জ্বালা! আমি কটাং করে হাবুলের কানে একটা চিমটি কেটে দিলুম। হাবুল চ্যাঁ করে উঠল। আমি বললুম, আরে হতচ্ছাড়া, একবার উঠেই দ্যাখ না! ভূত-টুত কোথাও নেই–একটা লম্বা-গলার পাখি অমনি আওয়াজ করে হাসছে।
–কী, পাখিতে ডাকতাছে!–বলেই বীরের মতো লাফিয়ে উঠল হাবুল। আর তক্ষুনি সেই বিচ্ছিরি চেহারার পাখিটা হাবুলের দিকে তাকিয়ে, গলাটা একটু বাঁকিয়ে, চোখ পিটপিট করে, ঠিক ভেংচি কাটার ভঙ্গিতে হ্যা-হ্যা করে ডেকে উঠল।
হাবুল বললে, অ্যাঁ–মস্করা করতে আছস আমাগো সঙ্গে? আরে আমার রসিক পাখি রে! অখনি তবে ধইর্যা রোস্ট বানাইয়া খামু।
আমার পেটের ভেতরে সেই খিদেটা আবার তিং পাং তিং পাং করে লাফিয়ে উঠল। আমি বললুম, রোস্ট বানাবি? তবে এক্ষুনি বানিয়ে ফ্যাল না ভাই। সত্যি বলছি, দারুণ খিদে পেয়েছে।
কিন্তু কোথায় রোস্ট–কোথায় কী! হাবলাটা এক নম্বরের জোচ্চোর! তখুনি দু-তিনটে মাটির চাঙড় তুলে নিয়ে ছুড়ে দিয়েছে পাখিটার দিকে। আর পাখিটা অমনি ক্যাঁক্যাঁ আওয়াজ করে পাখা ঝাপটে বনের মধ্যে ভ্যানিশ।
–গেল-গেল—রোস্ট পালিয়ে গেল–বলে আমি পাখিটাকে ধরতে গেলুম। কিন্তু ও কি আর ধরা যায়।
ভীষণ ব্যাজার হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলুম। পাখিদের ওই এক দোষ। হয় দুটো ঠ্যাং থাকে–সেই ঠ্যাং ফেলে পাঁই-পাঁই করে পালিয়ে যায়, নয় দুটো ডানা থাকে–সাঁই সাঁই করে উড়ে যায়। মানে, দেখতে পেলেই ওদের রোস্ট করা যায় না। খুব খারাপ-পাখিদের এসব ভারি অন্যায়।
আমি বললুম, এখন কী করা যায় হাবুল?
হাবুল যেন আকাশজোড়া হাঁ করে হাই তুলল। বললে, কিছুই করন যায় না বইস্যা থাক।
-কোথায় বসে থাকব?
-যেখানে খুশি। এইটা তো আর কইলকাতার রাস্তা না যে ঘাড়ের উপর অ্যাঁকটা মটরগাড়ি আইস্যা পোড়।
-কিন্তু বাঘ তো এসে পড়তে পারে।
—আসুক না।–বেশ জুত করে বসে পড়ে হাবলা আর-একটা হাই তুল; বাঘে আমারে খাইব না। তোরে ধইরা খাইতে পারে। কিন্তু তোরে খাইয়া বাঘটা নিজেই ফ্যাচাঙে পইড়া যাইব, গা। বাঘের পেটের মধ্যে পালাজ্বরের পিলা হইব।–বলেই মুখ-ভর্তি শাঁকালুর মতো দাঁত বের করে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসল।
ভিজে ভূত হয়ে আছি সারা গা-ভর্তি এখনও পাঁক। ওদিকে পেটের ভিতর খিদেটা সমানে তেরে-কেটে-তাক বাজাচ্ছে। এদিকে এই হনলুলু–না মাদাগাস্কার না-না সুন্দরবন—দুত্তোর, ড়ুয়ার্সের এই যাচ্ছেতাই জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ভ্যাবাচ্যাকা হয়ে রয়েছি। তার ওপর একটু পরেই রাত নামবে–তখন হাতি, গণ্ডার, বাঘ, ভালুক সবাই মোকাবিলা করতে আসবে আমাদের সঙ্গে। এখন এইসব ফাজলামি ভালো লাগে? ইচ্ছে হল, হালার কান পেঁচিয়ে একটা পেল্লায় থাপ্পড় লাগিয়ে দিই।
কিন্তু হাবলাটা আবার বক্সিং শিখেছে। ওকে ঘাঁটিয়ে সুবিধে করতে পারব না। কাজেই মনের রাগ মুনেই মেরে জিজ্ঞেস করলুম, তোকে বাঘে খাবে না কী করে জানলি?
হাবুল গম্ভীর হয়ে বললে, আমার কুষ্ঠীতে লেখা আছে ব্যাঘ্রে আমারে ভোজন করব না।
আমি রেগে বললুম, দুট্টোর কুষ্ঠীর নিকুচি করেছে। আমাদের পাড়ার যাদবদার কুষ্ঠীতে তো লেখা ছিল সে অতি উচ্চাসনে আরোহণ করবে। এখন যাদবদা রাইটার্স বিল্ডিংয়ের দশতলার ঘরগুলো ঝাঁট দেয়।
হাবুল বললে তা উচ্চাসনই তো হইল।
আমি ভেংচে বললুম, তা তো হইল। কিন্তু ব্যাঘ্ৰে না-হয় ভোজন করবে না ভালুক এসে যদি ভক্ষণ করে কিংবা হাতি এসে পায়ের তলায় চেপটে দেয়, তখন কী করবি?
এইবার হাবুল গম্ভীর হল।
—হ, এই কথাটা চিন্তা করন দরকার। ক্যাপ্টেন টেনিদা হাতির পিঠে উইঠ্যা কোথায় যে গেল—সব গোলমাল কইরা দিছে। অ্যাঁক্টা বুদ্ধি দে প্যালা। কোন্ দিকে যাওয়া যায়ক দেখি?
–যাওয়ার কথা পরে হবে। সত্যি বলছি হাবুল, এখুনি কিছু খেতে না পেলে আমি বাঁচব। কী খাওয়া যায় বল তো?
–হাতি-ফাতি ধইর্যা খা—আর কী খাবি?
ওর সঙ্গে কথা কওয়াই ধাষ্টামো। এদিকে এত ভূতের ভয়–ওদিকে দিব্যি আবার লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল। যেন নিজের মোলায়েম বিছানাটিতে নবাবি কেতায় গা এলিয়ে দিয়েছে। একটু পরেই হয়তো ঘুরঘুর করে খাসা নাক ডাকাতে শুরু করবে। ও-হতচ্ছাড়াকে বিশ্বাস নেই—ও সব পারে।
কিন্তু আমায় কিছু খেতেই হবে। আমি খাবই।
চারদিকে ঘুরঘুর করছি। নাঃ—কোথাও একটা ফল নেই–খালি পাতা আর পাতা। বনে নাকি হরেক রকমের ফল থাকে আর মুনি-ঋষিরা তাই তরিবত করে খান। স্রেফ গুলপট্টি!
এমন সময় : ক্যুঁক-ক্যুঁর-কোঁর্-র্—
যেই একটা ঝোপের কাছাকাছি গেছি, অমনি একজোড়া বনমুরগি বেরিয়ে ভোঁ-দৌড়। আমার আবার দীর্ঘশ্বাস পড়ল। ইস্-পাখিদের কেন ঠ্যাং থাকে। বিশেষ করে মুরগিদের? কেন ওরা কারি কিংবা রোস্ট হয়ে জন্মায় না?
কিন্তু জয় গুরু! ঝোপের মধ্যে চারটে সাদা রঙের ও কী? অ্যাঁ—ডিম! মুরগির ডিম!
খপ করে দুহাতে দুটো করে ডিম তুলে নিলুম। হাবুলের দিকে তাকিয়ে দেখি ঘুমুচ্ছে। ঘুমুক হতভাগা! ওকে আর ভাগ দিচ্ছি না। এ চারটে ডিম আমিই খাব। কাঁচাই খাব।
একটা ভেঙে যেই মুখে দিয়েছি–ব্যস! আমার চোয়াল সেইখানেই আটকে গেল। আমার সামনে কোত্থেকে এসে দাঁড়িয়েছে এক বিকট কালো মূর্তি—ঝোপের ভেতর মনে হল নির্ঘাত একটা মস্ত ভালুক!
এমনিতে গেছি অমনিতেও গেছি! আমি একটা বিকট চিৎকার করে ডাকলুম : হাবুল। তারপর হাতের একটা ডিম সোজা ছুড়ে দিলুম ভালুকটার দিকে।
আর ভালুক তক্ষুনি ডিমটা লুফে নিয়ে স্পষ্ট মানুষের গলায় বললে, দে না। আর আছে?