১৫. ফ্রেডরিকার আশ্চর্য ব্যবহার

১৫. ফ্রেডরিকার আশ্চর্য ব্যবহার

চিফ কনস্টেবল কর্ণেল ওয়েস্টন আমাদের দুপুরের খাবারটা তার সঙ্গে খেতে ডেকেছেন, হোটেলে ফিরেই খবর পেলাম। আমরা যথাসময়ে গিয়ে হাজির হলাম। লম্বা, সুদর্শন পুলিশ কর্মীটি দেখা গেল পোয়ারোর বিরাট ভক্ত। তার বিষয়ে প্রায় সব খবরই রাখে সে। সাদর অভ্যর্থনা জানানোর পর তিনি বললেন (এবং কথাটা অনেকবারই বললেন)। আমাদের পরম সৌভাগ্য, যে আপনাকে এখানে পেয়েছি। তবে তিনি দ্রুত অপরাধের সমাধান করে আসল অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে চান। তার আশঙ্কা না হলে হয়ত তদন্তের ভার স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের হাতে চলে যাবে। নিশ্চিতভাবেই নার্সিংহোমে মহিলাটি সুরক্ষিত আছেন। কিন্তু সেটা কোন সমাধান নয়। কতদিন ওনাকে সেখানে রাখা যাবে? কর্নেল ওয়েস্টনের কথায় পোয়ারো উত্তর দেয়, এই সমস্যার তো একটাই সমাধান। কর্নেল আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করেন, সেটা কি?অপরাধীকে তাড়াতাড়ি কজা করা। হুমম। কিন্তু সেটা খুব সহজ কাজ হবে না, কর্নেল ওয়েস্টন হতাশ গলায় বলেন। অবশ্যই। এই ধরনের মামলাগুলো সবসময়েই ভীষণরকম জটিল। আহ, যদি পিস্তলটাও, যেটা খুনে ব্যবহৃত হয়েছিল, সেটা হাতে পাওয়া যেত। চিফ কনস্টেবল হতাশ গলায় আবারও বললেন। সেটা ঠিক। তবে ঘাঘু অপরাধীরাও মাঝে মাঝেই এমন ছোট্ট, ছোট্ট বোকার মত ভুল করে বসে। পোয়ারো সমর্থনের ভঙ্গি করে মাথা নাড়ে।

আগামীকাল সকালে ময়না তদন্ত করা হবে। তবে তার ফলাফল আপাতত আমরা কাউকে জানাব না।

সেটাই ভাল। পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়। আমরা এবার বিদায় নেব। আমরা দরজার দিকে কয়েক পা মাত্র এগিয়েছি, হঠাৎ উনি বললেন, ওহ, একটা কথাতত বলতে ভুলেই গেছি। কথাটা বোধহয় আপনার মতামতও চাই। পকেট থেকে একটা প্রায় দোমড়ানো মোচড়ানো কাগজের টুকরো বের করে পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দেন চিফ কনস্টেবল। আমার পুলিশকর্মীরা যে মাঠে বাজি পোড়ানো হচ্ছিল সেখানে তল্লাশি করতে গিয়ে এটা পেয়েছে।

পোয়ারো কাগজটাকে সোজা করে দুহাত দিয়ে চেপে, তারপর চোখের সামনে তুলে ধরে। বেশ বড় বড় অক্ষরে লেখা।

……. টাকার জোগাড় তাড়াতাড়ি কর…… তা না হলে, তুমি জান কি ঘটবে……… ভালই জানো……. আমি তোমাকে শেষবার সতর্ক করছি……….

পোয়ারোর চোখে বেশ তীব্র আগ্রহ ফুটে ওঠে। ইন্টারেস্টিং। আমি কি এটা রাখতে পারি? অবশ্যই। চিঠিটায় কোন আঙুলের ছাপ নেই। আপনি যদি এটার থেকে আর কোন তথ্য বার করতে পারেন আমি খুশিই হব। এরপর আমরা বের হয়ে এলাম। তার আগে অবশ্য চিফ ইন্সপেক্টর আমাদের জানিয়ে দিলেন ম্যাগির মা-বাবা আজ বিকেলেই ইয়র্কশায়ার থেকে এসে পৌঁছেছেন। আগামীকাল ময়না তদন্তের পরই তারা মেয়ের মৃতদেহ নিয়ে ফিরে যাবে ইংলন্ডে।

বাড়িতে ফিরে পোয়ারো খুব মনোযোগ দিয়ে চিঠিটাকে পরীক্ষা করছি, কোন প্রয়োজনীয় তথ্য? কোন সূত্র? আমার প্রশ্নে পোয়ারো কাঁধ ঝাঁকায়। কি করে বলা যেতে পারে? শুধু এটুকু বলা যেতে পারে চিঠিটার মধ্যে ব্ল্যাকমেলের দুর্গন্ধ আছে। সেই বাজি পোড়ানোর অনুষ্ঠানের রাতেই এই চিঠিটা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কে দিয়েছিল? কাকে? এবার সে খুব মনোযোগ দিয়ে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস দিয়ে চিঠিটাকে পরীক্ষা করতে থাকে। হাতের লেখাটাকে বিশেষ করে। তারপর আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসে। তোমার কি হাতের লেখাটা চেনা মনে হচ্ছে হেস্টিংস? আমি আরও একবার বেশ কিছু সময় নিয়ে চিঠির হাতের লেখাটাকে গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করি আমার কি যেন একটা মনে পড়ছে। কি যেন……. আহ মনে পড়েছে। মিসেস রাইস।

একেবারে ঠিক ধরেছ। পোয়ারো সপ্রশংসক গলায় বলে।

নিঃসন্দেহে। যথেষ্ট মিল আছে। যথেষ্টই মিল। বেশ কৌতূহলজনক ব্যাপার। যদিও, আমার মনে হয় না, যথেষ্ট সন্দেহ আছে এটা মাদাম রাইসের লেখা বলে। উত্তরে আমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনি দরজায় করাঘাতের শব্দ হল। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার ঘরে ঢুকলেন অসময়ে আপনাদের বিরক্ত করলাম হয়তো। আসলে আমি এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম, ভাবলাম একবার ঢু মেরে যাই। তদন্তের আর কোন অগ্রগতি হল কি না খোঁজ নিয়ে যাই।

Probleui, অগ্রগতি কি বলছেন মশাই? এ এক জব্বর মামলা। আমার তো মনে হচ্ছে দিনে দিনে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছি আমি।

সেটা হলে খুবই বিশ্রী একটা ব্যাপার ঠিকই, কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করছি না। আপনার অনেক কীর্তি কাহিনি আমি শুনেছি। আমি জানি আপনি একজন অসধারণ ক্ষমতাবান মানুষ।

না-না, সেরকম কিছুই নয়। পোয়ারো বিনীত গলায় বলে।

আপনি কখনও ব্যর্থ হতে পারেন না। আপনি এই অপরাধের রহস্যও ভেদ করে ফেলেছেন। ঠিক কিনা?

পোয়ারো একটু ইতস্তত করে, দ্বিধার গলায় বলে, ঠিক সেরকম কিছু নয়। তবে হ্যাঁ অবশ্যই দুজনকে সন্দেহ করছি, বলা ভাল অপরাধী হিসাবে চিহ্নিত করে ফেলেছি।

আমি তাদের নাম জিজ্ঞাসা করলেও আপনি নিশ্চয়ই সেটা বলবেন না আমাকে?

পোয়ারো বিনীত ভঙ্গিতে হাসে। আমার সেটা বলা উচিত নয়। বুঝতেই পারছেন, আমার হয়তো ভুল হতে পারে। তারপর কয়েকমুহূর্ত স্থির পলকহীন চোখে কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার-এর দিকে তাকিয়ে থাকে পোয়ারো, তারপর হঠাৎ বলে, আপনি সে রাতে ৪.৩০-এর একটু পরে ডাভেনপোর্ট থেকে রওনা হয়েছিলেন। কিন্তু, আপনি এখানে এসে পৌঁছেছিলেন ১০টার ৫ মিনিট পর। ৩০ মাইল আসতে আপনার পৌনে দু ঘণ্টা সময় লাগল কেন? নাহ, আপনার অ্যালিবাইটাও কিন্তু একেবারেই পাকাপোক্ত নয়।

উ-ম-ম, আসলে…… কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার স্পষ্টতই আমতা আমতা করতে থাকেন।

অ্যালিবাই-এর প্রসঙ্গ যদিও বাদও দিই……… পোয়ারো মাখন মাখানো হাসে। আমি সব বিষয়েই খোঁজখবর নিয়েছি। আপনি মাদাম জোয়েল নিক-কে বিয়ে করতে চান। তাই তো?

কম্যান্ডারের মুখ রক্তবর্ণ হল। আমি সবসময়েই ওকে বিয়ে করতে চেয়েছি। মৃদুগলায় বলেন তিনি।

হুম। অথচ তিনি অন্য একজন পুরুষের বাগদত্তা সেক্ষেত্রে………..’

নিক তাহলে সত্যি মাইকেল সেটনের বাগদত্তা ছিল? আমি ব্যাপারটা গুজবই ভাবতাম।

আপনি কিছু সন্দেহ করেননি কখনও?

না, ওকে সন্দেহ করার কথা আমি ভাবতেই পারি না। দিন দুয়েক আগেই নিক আমাকে প্রথমবার সরাসরি জানিয়েছিল যে সে কারও বাগদত্তা। কবে থেকে স্পষ্ট করে জানায়নি সে সময়।

হ্যাঁ, তিনি নিঃসন্দেহেই মাইকেল সেটনই। তবে একটা কথা আমি জোর দিয়েই বলতে পারি মাদাম জোয়েল নিক আপনাকে যথেষ্টই পছন্দ করেন।

শ্যালিঙ্গার কথাগুলো শোনেন। কয়েক মুহূর্ত নীরবে কি যেন ভাবেন। তারপর প্রায় স্বগতোক্তি করার মত বিড়বিড় করেন, যদি তাই হয়………. ঠিক সেই সময়েই দরজায় টোকা পড়ে। এবার স্বয়ং ফ্রেডরিকা রাইস হাজির হলেন।

আমি তোমাকেই খুঁজছি। শ্যালিঙ্গারের দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি, আমার হাতঘড়িটা কি দোকান থেকে এনেছ?

ওহ, হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। শ্যালিঙ্গার তার প্যান্টের পকেটে হাত ঢোকালেন। ঘড়ি বের করে মিসেস রাইসের হাতে তুলে দিলেন।

মাদাম জোয়েল রাইস মৃদু হাসেন, বলেন–আমি আপনাদের কোন জরুরি আলোচনায় বিঘ্ন ঘটালাম নাতো?

না-না মাদাম, আমরা নিছকই গল্পগুজব করছিলাম একটু। আপনি বসুন না। আসলে আমি ওনাকে বলছিলাম কি দ্রুত এসব খবর ছড়িয়ে পড়ে। ফ্রেডরিকা একটা চেয়ারে বসেন তারপর ঠাণ্ডা চোখে পোয়ারোর দিকে তাকান,  কোন খবরের কথা হচ্ছে?

এই যে মাদাম জোয়েল নিক যে মাইকেল সেটনের বাগদত্তা ছিলেন। নিমেষে ফ্রেডরিকার দুচোখে তীক্ষ্ণ একটা ঝিলিক খেলে যায়। যেন নিজেকে আপ্রাণ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন, তাহলে নিক সত্যিই মাইকেল সেটনের সঙ্গে বাগদত্ত হয়েছিল? বেশ বিস্ময়ের রেশ ওনার গলায়।

আপনি অবাক হচ্ছেন মাদাম জোয়েল? পোয়ারো বিনীত গলায় প্রশ্ন করে।

হ্যাঁ, তা একটু হয়েছি বইকি। গত শরতে ওরা মেলামেশা করেছিল কিছুটা। কিন্তু তারপর, বড়দিনের সময় থেকে ওদের আর দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল বলে জানতাম না।

ব্যাপারটা ওরা নিখুঁতভাবে গোপন রাখতে পেরেছিলেন।

সেটা স্যার ম্যাথুর জন্যে। উনি ব্যাপারটার প্রবল বিরোধ করতেন জানতে পারা মাত্র।

ফ্রেডরিকার কথাটা শুনে পোয়ারো আগ্রহী গলায় বলে, আপনি তো ওনার প্রিয়তম বন্ধু ছিলেন। সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। আপনি কিছু সন্দেহ করেননি কখনও?

নিক খুব চাপা স্বভাবের মেয়ে ছিল। তবে এখন আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেন ইদানিং ও এত উদ্বিগ্ন থাকত। কয়েক মুহূর্ত পরই ফ্রেডরিকা পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকায় প্রবলরকম আগ্রহভরা চোখে, মিঃ পোয়ারো আমাকে একটা কথা……… আচমকাই সে থেমে যায়। তার দীর্ঘ দোহারা চেহারাটা মৃদু কেঁপে ওঠে, মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে। মাঝের টেবিলটার দিকে ওর দুচোখ স্থির হয়ে আটকে থাকে।

মাদাম, আপনি কি, অসুস্থ বোধ করছেন? পোয়ারো ফ্রেডরিকার কাঁধে হাত রাখে। সামান্য নড়ে মাথাটা, বিড়বিড় করে উনি বলেন, আমি ঠিক আছি। দুহাতের পাতায় মুখটা ঢেকে উনি সামনে ঝুঁকে পড়েন। আমরা সবাই অবাক হয়ে মিসেস রাইসের এই অদ্ভুত আচরণটা লক্ষ্য করতে থাকি। কয়েক মিনিট মাত্র। তারপরই উনি আবার সোজা হয়ে বসেন। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করতে বলে ওঠেন, আরে এত দুশ্চিন্তা করতে হবে না, আমি সুস্থ আছি। এখন কিছু উত্তেজক কথাবার্তা হোক। যেমন, খুন। মিঃ পোয়ারো আপনি আমাকে বলুন, কতটা এগোলেন আপনি?

না মাদাম, সেরকম করে বলবার মত কিছু এখনও ঘটেনি। পোয়ারো প্রতিশ্রুতিহীন জবাব দেয়।

কিন্তু আপনি নিশ্চিতভাবেই একটা ধারণা নিশ্চয়ই করতে পেরেছেন তাই না?

 হ্যাঁ, সেটা করেছি ঠিকই। তবে এখনও প্রচুর প্রমাণ জোগাড় করতে বাকি রয়েছে।

এবার ওনাকে যেন কিছুটা অনিশ্চিত দেখায়। তারপর উনি উঠে দাঁড়ালেন, এবার আমি চলি। উনি ঘর ছেড়ে হঠাৎ করেই দ্রুত বের হয়ে যান।

শ্যালিঙ্গার সেদিকে তাকিয়ে ফোঁস করে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়েন, নারী, এরা যে কখন কি চায় হয়ত ভগবানও জানে না। নিক হয়ত ওই মহিলাকে খুবই পছন্দ করে। কিন্তু এই মহিলাটি যে নিককে সত্যি সত্যি কতটা পছন্দ করেন তাতে আমার সন্দেহ আছে গভীর ভাবে। একটু থেমে তিনি আবার বলে উঠলেন, যাকে প্রিয়তম….প্রিয়তম…….সম্বোধন করছে এক মুহূর্ত পরই তাকে হয়ত নিকুচি করেছে বলে ছুঁড়ে ফেলবে। এইসব মেয়েদের মতিগতি বোঝা সত্যিই ভার। তারপরই ওনার নজর পড়ে পোয়ারোর দিকে, আপনি কি কোথাও

পোয়ারো ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। সযত্নে টুপিটাকে ঝাড়ছে। কম্যান্ডার-এর মুখের দিকে তাকিয়ে সে বিনয়ী হাসে। হ্যাঁ, আমি একটু শহরে যাব।

কম্যান্ডার একঝলক কি যেন ভাবলেন, আমার হাতে এখন কোন কাজ নেই। আমি কি আপনার সঙ্গে আসতে পারি?

অবশ্যই, অবশ্যই। আমি খুশিই হব তাহলে। অতএব অবশেষে কম্যান্ডার আমাদের সঙ্গী হলেন।

পোয়ারো শহরে পৌঁছে প্রথমে একটা ফুলের দোকানে ঢুকল। আমরা নিশ্চিতভাবেই কিছু আরোগ্য কামনাময় শুভেচ্ছাসহ ফুল পাঠান উচিত মাদাম জোয়েল নিককে আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করে সে। তবে পোয়ারোর ফুল পছন্দ করাটা এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়াল। কোনটা তার পছন্দ করা উচিত কিছুতেই বুঝে উঠতে পারল না সে। অবশেষে, বেশ বড়সড় একটা সোনালী বাক্স, অলঙ্করণ করা, তাতে একগুচ্ছ কমলালেবু রঙ উজ্জ্বল করোনেশন পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয় সে। আমি সকালেই ফুল পাঠিয়েছি। আমি বরং কিছু ফল পাঠাই। কম্যান্ডার বললেন। পোয়ারো দোকান থেকে দেওয়া কার্ডটাকে যত্ন করে, শুভেচ্ছাসহ, এরককুল পোয়ারো লিখে দোকানী মহিলার হাতে ফেরত দিতে দিতে বলে Inutile।

কি? শ্যালিঙ্গার ভুরু কুঁচকে তাকায় আমি বললাম অর্থহীন। বাইরে থেকে পাঠান কিছু খাওয়া মাদামের নিষেধ আছে।

কে বলল?

আমি বলছি। আমি নিয়মটা চালু করেছি। মাদাম তার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে মেনেও নিয়েছেন।

হে ভগবান। শ্যালিঙ্গার স্পষ্ট চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায়। তার কপালে চিন্তার কুঞ্চন ভেসে ওঠে, তার মানে, এই ব্যাপার?…… বিপদ এখনও কাটেনি……।

.

১৬.

মিঃ হোয়াইটফিল্ডের সঙ্গে সাক্ষাতকার

ময়নাতদন্তটা নেহাতই বিরস ধরনের অনুত্তেজক হল। ময়না তদন্তের পর আমি পোয়ারোর সঙ্গে যোগ দিলাম। আমরা দুজনে গেলাম রেভারেন্ড গাইলস বার্কলি এবং তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। নিহত ম্যাগি বার্কলির মা বাবা দুজনেই সহজ সরল মানুষ। শহুরে সফিস্টিকেশনের ধার ধারেন না। মিসেস বার্কলি বেশ লম্বা। তুলনায় তার স্বামী বেশ ছোটখাটো চেহারার। ধূসর রঙা চুল। মেয়ের বেঘোরে মৃত্যুর শোকাচ্ছন্ন-তার বাইরে এখনও তারা স্বামী-স্ত্রী কেউই আসতে পারেন নি। আমাদের ম্যাগি বারবার দুঃখে ভারাক্রান্ত গলায় বলছিলেন তাঁরা আমার মেয়ে ছিল নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগী, সবসময় অন্যদের কথা ভাবত। তাকে কে খুন করতে পারে? ঠিক তখনি মিসেস বার্কলি বললেন, একটাই সান্ত্বনা, আপনার মত একজন মহান গোয়েন্দা যখন এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন, তখন খুব শিগগিরই এই অপরাধের কিনারা হবেই হবে।

অপরাধী শাস্তি পাবেই। এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি মাদাম। তবে কখনও সেই শাস্তি খুব গোপনে ঘটে।

এর দ্বারা আপনি কি বোঝাতে চাইছেন মিঃ পোয়ারো? এবার প্রশ্নটা করেন মিঃ বার্কলি। পোয়ারো কথাটার কোন উত্তর দেয়না। শুধু ঘনঘন কয়েকবার মাথা নাড়ে। যার বহুরকম অর্থ হতে পারে।

পোয়ারো সান্ত্বনা দেয়, আচ্ছা, আর আপনাদের বিরক্ত করব না। যা ঘটে গেছে তার জন্যে আন্তরিক দুঃখবোধ জানানো ছাড়া, আপনাদের সহানুভূতি জানাবার ভাষা আমাদের নেই। সন্তানকে অকালে হারাবার যন্ত্রণা অন্য কারও পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়।

আপনি সত্যিই অত্যন্ত সহৃদয় মিঃ পোয়ারো। আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

আমরা বাড়ির বাইরে বের হয়ে আসবার পর পোয়ারো বিষণ্ণ গলায় বলে, নিজেকেই ভীষণরকম অপরাধী মনে হচ্ছে জানো হেস্টিংস। আমিই মাদাম জোয়েল বার্কলিকে পরামর্শ দিয়েছিলাম কাউকে তার কাছে এনে রাখতে, অথচ, আমি এরকুল পোয়ারো ঘটনার জায়গায় হাজির থাকা সত্ত্বেও ব্যাপারটাকে আটকাতে পারলাম না।

নিয়তি কে ঠেকাতে পারে কে বন্ধু? আমি নরম গলায় বলি।

না হেস্টিংস, তোমার বক্তব্যে ঘটনার যথার্থ প্রতিফলন হচ্ছে না। এখানে কোন সাধারণ মানুষের কথা হচ্ছে না। আমি এরকুল পোয়ারো তাহলে আমার অসাধারণত্ব কোথায় যদি এরকম একটা পাতি অপরাধ ঠেকাতে না পারলাম? বিশেষ করে যেখানে নিক ও ম্যাগিকে পূর্ণ নিরাপত্তা দেবার নৈতিক দায়িত্ব ছিল আমার, এরকুল পোয়ারোর ওপর।

তা অবশ্য ঠিক। ব্যাপারটাকে তুমি যদি এভাবে ভাব তাহলে ব্যাপারটা সেইরকম দাঁড়াচ্ছে বটে।

বাস্তবিক। আমি সেইহেতু ভীষণরকম মর্মাহত, হৃদয়বিদারক অবস্থার মধ্যে রয়েছি।

আমি জানি পোয়ারোর মানসিক গঠন অন্য অনেকের মত নয়। একেবারে আলাদা। তাই কোন মন্তব্য করলাম না। চুপ করে থাকাই শ্রেয় মনে করলাম। এবং এখন, ইংল্যান্ড। পোয়ারোর কথাটা শুনে আমি আঁতকে উঠলাম। ইংল্যান্ড? Mai Gui পোয়ারো গভীর মনোযোগে হাতঘড়ির দিকে তাকায়। এখনও চেষ্টা করলে দুপুরের ট্রেনটা ধরা যাবে। চল হে আর দেরি করা যাবে না। মাদাম জোয়েল নিক আপাতত নার্সিংহোমে যখন নিরাপদে আছেন, থাকবেন, আমরা দু চারদিন ছুটি নিতেই পারি। তার চেয়ে জরুরি কিছু তথ্য, সূত্র সেই সুযোগে জোগাড় করে ফেলতে হবে।

লন্ডনে নেমেই আমাদের প্রথম কাজ হল মৃত ক্যাপটেন সেটনের সলিসিটার মহাশয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা। মেসার্স হোয়াইটফিল্ড, প্রাগরিটার অ্যান্ড হোয়াইটফিল্ড। পোয়ারো আগে থেকেই সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সন্ধে ৬.০০ টায় আমরা সংস্থার মালিক মিঃ হোয়াইটফিল্ডের মুখোমুখি হলাম। পোয়ারো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড থেকে আনা বিশেষ অনুমতির চিঠিটা ওনার হাতে তুলে দিল। সেটাকে ভাল করে খুঁটিয়ে পড়ে চশমার কঁচ রুমালে মুছতে মুছতে তিনি আমাদের দিকে তাকালেন, খুবই দুঃখজনক ঘটনা।

পোয়ারো ততক্ষণে ওনাকে গুছিয়ে আমাদের আসবার কারণটা জানায়, সত্যিই খুব দুঃখজনক। তবে তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে খুনটা খুবই অন্যধরনের, বেশ অসাধারণ ধরনের।

কিন্তু, আমি বুঝতে পারছি না, এই খুনটার সঙ্গে আমার সদ্য প্রয়াত ক্লায়েন্ট-এর যোগাযোগটা ঠিক কোথায়?

আমি সেটা খুঁজতেই আপনার কাছে এসেছি।

মিঃ হোয়াইটফিল্ড এবার একটা গভীর শ্বাস টানেন, বুঝলাম। বেশ আপনার কি জানবার আছে বলুন। আমি আপনাকে সাহায্য করতে প্রস্তুত।

ধন্যবাদ। আপনি স্বর্গত মাইকেল সেটনের জন্যে কোন উইল করেছিলেন সম্প্রতি?

অবশ্যই। সেটন পরিবারের সবার উইল আমরাই করে আসছি।

পোয়ারো এবার স্পষ্ট চোখে মিঃ হোয়াইটফিল্ডের দিকে তাকায়, প্রয়াত ম্যাথু সেটন? তার উইলের ভাগটা কিরকমভাবে হয়েছিল?

কিছুটা ভাগ গেছে ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামে। তবে তার বিশাল, আমার বলা উচিত সুবিশাল সম্পত্তির প্রায় পুরো অংশটাই গেছে মাইকেল সেটনের কাছে। ওনার আর কোনও কাছের আত্মীয় নেই।

খুব বিরাট সম্পত্তির অংশ বলছেন?

স্যার ম্যাথু সেটন ছিলেন ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় সর্বাপেক্ষা ধনী ব্যক্তি। একথা ভুলে যাবেন না।

মাথা হেলিয়ে মিঃ হোয়াইটফিল্ডের বক্তব্যর প্রতি পুরোপুরি সমর্থন জানিয়ে পোয়ারো এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা প্রসঙ্গে চলে যায়, স্যার ম্যাথুর মৃত্যুটা কি অনাকাঙ্খিত বা হঠাৎ ঘটে যাওয়া বলে আপনি মনে করেন?

নিশ্চয়ই। একেবারেই অপ্রত্যাশিত বলতে পারেন। ওনার স্বাস্থ্য খুবই ভাল ছিল। অসুস্থতার কোনরকম লক্ষণই ছিল না। হঠাৎ এভাবে মৃত্যু তো অনেক দূরের ব্যাপার।

পোয়ারো গম্ভীর মুখে কি যেন চিন্তা করে কয়েক মুহূর্ত। তারপর বলে, তাহলে ক্যাপটেন মাইকেল সেটনের উইল অনুযায়ী সম্পত্তির মালিকানা এখন কে পাচ্ছেন?

নিশ্চিভাবেই ওনার স্ত্রী। বা বলা ভাল বাগদত্তা। মিসম্যাগদালেনা বার্কলি।

পোয়ারো এবার উঠে দাঁড়াল। ধন্যবাদ মিঃ হোয়াইটফিল্ড। আমার প্রয়োজনীয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যটা আমি পেয়ে গেছি।

মিঃ হোয়াইলফিল্ডের সঙ্গে করমর্দন করে আমরা ওর অফিসের বাইরে বের হয়ে এলাম।

তুমি যেভাবে ভেবেছিলে ব্যাপারটা ঠিক সেইরকমই ঘটেছে পোয়ারো। বাইরে বের হয়ে এসে আমি বললাম।

সেটা তো হতে বাধ্য। অন্যরকম কিছু ঘটবার সম্ভাবনা কোথায়? পোয়ারো বিড়বিড় করে আত্মমগ্ন ভঙ্গিতে বলে।

এরপর আমরা গেলাম সুবিখ্যাত রেস্তোরাঁয় চেশয়ার চিজসে। ইন্সপেক্টর জেপ সেখানে আমাদের জন্যে পূর্বনির্ধারিত ভাবে অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের দেখামাত্র তিনি সাদর উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন।

বহুদিন পর আপনার সঙ্গে দেখা হল মঁসিয়ে পোয়ারো। জেপ বললেন।

 পোয়ারো হাসে, কেমন আছেন বলুন?

ভাল। আপনি? আবারও খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছেন?

পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে, কথায় আছে না তেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। অপরাধ তেমন আমার পিছু ছাড়ে না।

জেপ এবার সরাসরি প্রসঙ্গে আসেন, যাইহোক, আপনি যে ফিঙ্গার প্রিন্টগুলো আমাকে পাঠিয়ে ছিলেন তাতে কিছুই উল্লেখযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় নি। উনি যেই হন, আমাদের খপ্পরে আগে কোনদিন পড়েননি। তাছাড়া, আমি মেলবোর্নেও খোঁজ নিয়েছিলাম। আপনার দেওয়া নাম বা চেহারার বর্ণনার কারো খোঁজ পাওয়া যায়নি সেখানে।

তাই, পোয়ারো একটা ছোট্ট মন্তব্য করে। ওর মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটে ওঠে। আর অন্য ব্যাপারটায় আপনার কথামত আমি লাজারুম আর ওনার ছেলের বিষয় খোঁজ নিয়েছিলাম। ওরা ব্যক্তিগতভাবে এবং পেশাদার জীবনেও যথেষ্ট সুনামের অধিকারী। কোন বদনাম নেই তাদের বাজারে। তবে, সম্প্রতি তারা বেশ আর্থিক টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন।

তুই বুঝি?

হ্যাঁ, পুরনো ছবি বা জিনিসপত্রের বাজার এখন সেরকম ভাল নয়। সবার নজর এখন হাল ফ্যাশানের জিনিসপত্রের ওপর। তাছাড়া গত বছর একটা নতুন বাড়ি তৈরি করতে শুরু করেছেন ওরা। সবমিলিয়ে..

ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ জেপ। আপনি আমার অনেক উপকার করলেন।

আরে না, না, পুরনো বন্ধুর জন্যে এটুকু তো করতেই হবে।

পোয়ারো সমর্থনের ভঙ্গিতে মৃদু বিনীত হাসে। তারপর বলে আর ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার, ওনার ব্যাপারে কিছু জানতে পারলেন?

আহ, নিশ্চয়ই। উনি মেয়েদের ডাক্তার। না, না গায়নোকলজিস্ট নয়, একজন হাতুড়ে ধরনের। সাধারণভাবে মহিলাদের যৌন ইচ্ছে সংক্রান্ত সমস্যার চিকিৎসাই করেন। সেসব ব্যাপারে ওনার চিকিৎসা নাকি খুবই ফলদায়ক।

এই ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার কে? আমি বেশ অবাক ভাবে প্রশ্ন করি। আচমকা এই নামটা কোথা থেকে উড়ে এল?

ডাঃ ম্যাক অ্যালিস্টার হলেন কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গারের কাকা। মনে আছে উনি একবার উল্লেখ করেছিলেন, ওনার এক কাকা চিকিৎসক?

আমার মনে পড়ল, কিন্তু এই ঘটনার সঙ্গে তার যোগাযোগ কোথায়?

আমার প্রশ্নে পোয়ারোর কপালে ভাঁজ পড়ে, হয়ত কিছুই নেই। কিন্তু এরকুল পোয়ারো কোন গন্ধ না খুঁকে ছেড়ে দেয় না। হয়ত এইভাবেই খুলে যাবে কোন দরজা। আর হেস্টিংস দরজা যে সত্যিই খোলে, তার প্রমাণ তো অতীতে পেয়েছি আমরা। বহু……বহুবার। তাই না?

এরপর সন্ধ্যেটা বেশ ভালই কাটল। ইন্সপেক্টর জেপের অনুরোধে আমরা তিনজনেই কয়েক পাত্র পোর্ট পান করলাম। পোয়ারো এবং জেপ পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থনে ডুবে গেল। বেশ লাগছিল শুনতে। কিন্তু কখন যেন আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, মন ডুবে গিয়েছিল বর্তমান মামলার ঘটনায়। পোয়ারো এখনও যেভাবে কোন তথ্য বা সূত্র খুঁজে পায়নি। অথচ মামলাটা হাতে নেবার পর দিন কম গেল না। আমার কেমন শীত শীত করে উঠল হঠাৎ তাহলে….. তাহলে কি এরকুল পোয়ারোকে প্রথমবার পরাজয় স্বীকার করে নিতে হবে? পোয়ারোর চোখের সামনে ম্যাগি বার্কলির মৃত্যুটা কি তাহলে সেই অনিবার্যতার নিষ্ঠুর ইঙ্গিত? হঠাৎ পিঠে হাতের চাপে আমার ঘোর কাটল। সম্বিত ফিরে পেলাম। পোয়ারো আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কি ভাবছ বন্ধু?

নাহ, কিছু না, কিছু না। নিজের অপ্রস্তুত ভাবটাকে আড়াল করার চেষ্টা করতে করতে বলে উঠি।

সাহস রাখ, প্রিয় বন্ধু সাহস রাখ। পোয়ারো আমার পিঠে হালকা চাপড় মারে, সব কিছু এখনও শেষ হয়ে যায় নি।

আমি হেসে উঠি। পোয়ারো আমার মনের অবস্থাটা নির্ভুল বুঝতে পেরেছে। আমার। হাসির সঙ্গে তাল মিলিয়ে পোয়ারোও হাসে। আমাদের হাসতে দেখে ইন্সপেক্টর জেপও সশব্দে হেসে ওঠেন।

এরপর আমরা হাসিখুশি মনে বিদায় নিই ইন্সপেক্টর জেপের কাছ থেকে। পরের সকালে আমরা আবার সেন্ট লু ফিরে আসি। হোটেলে পৌঁছে পোয়ারো নার্সিংহোমে ফোন করে এবং নিকের সঙ্গে কথা বলতে চায়। হঠাৎ করেই আমি ওর মুখের ভাব বদলে যেতে দেখি। প্রবল হতাশা, চিন্তা, উদ্বেগ ফুটে ওঠে যুগপৎ ওর মুখে। হা, হা, আমি এখনি আসছি। ফোনটা ছেড়ে দিয়ে পোয়ারো প্রবল রাগ মেশা হতাশায় মাথা ঝাঁকায়, কি কান্ড। চল হেস্টিংস। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে এক চরম আশঙ্কা ভেসে ওঠে। আতঙ্কিত গলায় আমি বলি কি হয়েছে পোয়ারো?

মাদাম জোয়েল নিক ভয়ঙ্কর অসুস্থ। কোকেন বিষক্রিয়াতে আক্রান্ত। Mon Dieu, Mon Dieu, কেন যে আমি ওনাকে এখানে রেখে চলে গিয়েছিলাম? কেন?

.

১৭.

 এক বাক্স চকোলেট

নার্সিংহোমে যাবার পুরো রাস্তাটা পোয়ারো নিজের মনে বিড়বিড় করে চলল। নিজের অতি আত্মবিশ্বাসকে অভিশাপ দিচ্ছিল। আমার বোঝা উচিত ছিল। স্বগতোক্তি করে পোয়ারো বলে ওঠে আমার বোঝা উচিত ছিল। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে রুষ্ট গলায় বলে, কিন্তু আমি থাকলেই বা কি হত? আমি যা ব্যবস্থা করেছিলাম মাদাম নিকের কাছে পৌঁছন অসম্ভব। হ্যাঁ, পুরোপুরি অসম্ভব। কেউ নিশ্চয়ই আমার নির্দেশ অমান্য করেছে–কে?

আমরা নার্সিংহোমে পৌঁছবার পর একতলায় একটা ছোট্ট ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ডাঃ গ্রাহাম একটু পরই এলেন। তাকে রীতিমত বিধ্বস্ত, ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। চিন্তা করবেন না। উনি ঠিক আছেন। সমস্যাটা হচ্ছিল উনি কতটা বিষ শরীরে নিয়েছেন বুঝতে না পারায়। এখন পরিস্থিতি সামলে নেওয়া গেছে।

কিন্তু কি ভাবে এটা ঘটল? পোয়ারো ডাক্তারের কথা শুনে প্রথমে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে, এরপর তীক্ষ্ণ গলায় প্রশ্নটা করে। ভেতরে যেতে কাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল?

না না কাউকে ভেতরে যেতে দেওয়া হয়নি।

 অসম্ভব পোয়ারো দৃঢ় গলায় বলে।

 না না, আমি সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন।

কিন্তু, তাহলে………… পোয়ারোর গলায় তীব্র সংশয় ভেসে ওঠে।

এক বাক্স চকোলেট।

ওহ-হ। আমি ওনাকে বলেছিলাম, হে ভগবান, বার বার বুঝিয়েছিলাম বাইরে থেকে আসা কিছু খাওয়া তো দূরের কথা, স্পর্শও না করতে।

আমি সেটা জানতাম না। বোঝেনই তো কোন মেয়েকে চকোলেট থেকে দুরে রাখা কত কঠিন। তবে ভগবানকে অজস্র ধন্যবাদ, উনি মাত্র একটাই খেয়েছিলেন।

চকোলেটের ভেতর কি ভাবে কোকেন পোরা হয়েছে?

 খুব শক্ত কাজ মশায়। মাঝখান থেকে অর্ধেক করে ভেতরটা বার করে দিয়ে কোকেন পুরে দিয়ে আবার চকোলেটটা জোড়া দেওয়া হয়েছে। একেবারে অপেশাদার কাঁচা হাতের কাজ।

পোয়ারো মৃদু একটা খড়খড় শব্দ করে।

আমি ক্ৰমে ব্যাপারটা বুঝতে পারছি। যাই হোক, একবার কি মাদাম জোয়েলের সঙ্গে দেখা করা যাবে?

আমার মনে হয় ঘণ্টাখানেক পর যদি আপনি আসেন তবে ওনার সঙ্গে দেখা করতে পারবেন।

আমরা ঘণ্টাখানেক সেন্ট লু-র রাস্তায় অলসভাবে হেঁটে বেড়ালাম। পোয়ারো এক মনে কি যেন চিন্তা করে চলেছে হাঁটতে হাঁটতে। আমি কথা বলে ওর মনোসংযোগে বিঘ্ন ঘটালাম না। মাঝে মাঝেই পোয়ারো মাথা নাড়ছিল আমার ভয় করছে হেস্টিংস। ভয় করছে। বেশ ভয় করছে। এমন অদ্ভুত, শরীর শিরশির করে ওঠা ভঙ্গিতে কথাগুলো বলছিল যে আমিও রীতিমত আতঙ্কিত বোধ করতে শুরু করলাম। একসময় ও হঠাৎ আমার কবজির কাছটা খামচে ধরল, আমি ভুল করেছি। শোন বন্ধু, আমি প্রথম থেকেই ভুল করছি।

তার মানে তুমি বলতে চাও এটা টাকার জন্যে নয়?

না, না, অবশ্যই নয়। ওই ব্যাপারটায় আমি একশো শতাংশ ঠিক। ওহ হ্যাঁ। কিন্তু ওই দুটো……. খুবই সহজ………. অত্যন্তই সহজ। তবে হ্যাঁ একটা নাটকীয় মোড় অবশ্যই অপেক্ষা করছে, হ্যাঁ, অবশ্যই কিছু একটা। তারপর হঠাৎ ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে আচমকা। আমি ওনাকে বলেছিলাম। বলেছিলাম কিনা? Ettee petite, বাইরে থেকে আসা কোন কিছু স্পর্শ করবেন না। আমায় অমান্য করেছেন উনি। এরকুল পোয়ারোকে অমান্য করেছেন। চার-চারটে মৃত্যুর ছোবলও কি ওনার জন্যে যথেষ্ট নয়? পঞ্চম সুযোগটাও নিতেই হবে?

আমি কোন কথা বলিনা। বলতে পারিনা। নিশব্দে ওর উত্তেজনার পারদটাকে ছুঁতে চেষ্টা করে চলি। তারপর একসময় আমরা ফিরে চলি। সামান্য অপেক্ষার পর আমাদের ডাক পড়ে। বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া নিক। অস্থিরভাবে হাত দুটো নড়ে চলেছে, এপাশ ওপাশ করছে। মুখে চোখে জ্বরের ভাব। আবার। বিড়বিড় করে বলে সে।

পোয়ারো নিককে দেখা মাত্র বেশ আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। ওর হাতটাকে নিজের হাতের মধ্যে চেপে ধরে।

তাহলে আপনার এই নার্সিংহোমও আটকাতে পারল না। তীক্ষ্ণ গলায় বলে নিক।

 আপনি যদি আমার নির্দেশ মানতেন তাহলে অবশ্যই সব ঠিকঠাকই চলত।

 নিক বিস্ময়ভরা চোখে তাকায়, কিন্তু আমি তো তাই করেছি।

পোয়ারো অস্থিরভাবে মাথা নাড়ে মাদাম জোয়েল আমি আপনাকে বলেছিলাম বাইরের কোন খাবার খাওয়া তো দূরের কথা, স্পর্শও না করতে। কোন কিছু নয়।

কিন্তু, আমি তো সেরকম কিছু করিনি।

কিন্তু ওই চকোলেটগুলো?

ওহ, ওগুলো তো আপনি পাঠিয়েছিলেন।

 মানে?

ওগুলো তো আপনার পাঠান। ওগুলো কেন খাব না?

পোয়ারো এবার তড়িতাহতের মত চমকে ওঠে, কিন্তু আমি তো সেরকম কিছু পাঠাইনি।

তা কি করে হতে পারে? বাক্সের ভেতর আপনার স্বহস্তে লেখা কার্ড ছিল।

কি? পোয়ারো বিমূঢ় মুখে তাকিয়ে থাকে।

নিক হতবাক ভঙ্গিতে পোয়ারোকে লক্ষ্য করে। তারপর নার্স মেয়েটিকে ইঙ্গিতে কাছে ডাকে। সে এলে তাকে চকোলেটের বাক্সের ভেতর যে কার্ডটা ছিল সেটা আনতে বলে। যুবতীটি কাঁচের জানালাটার পাশে টেবিলটার দিকে এগিয়ে যায়। কার্ডটা হাতে নিয়ে এগিয়ে আসে। নিক কার্ডটা পোয়ারোর দিকে এগিয়ে দেয়। পোয়ারো কার্ডটা হাতে নিয়ে কে গেলে। আমি বিস্ফারিত চোখে দেখি, ফুলের দোকানের কার্ডটাতে পোয়ারো যে কথাগুলো লিখেছিল, এই কার্ডটাতেও স্পষ্ট স্বচ্ছন্দ হাতের লেখায় হুবহু সেই কথাগুলোই লেখা।

Sacritonnere’ পোয়ারোর হতবাক মুখ দিয়ে শব্দদুটো ছিটকে বের হয়।

 দেখলেন তো? নিক অভিযোগের গলায় বলে।

 আমি এটা লিখিনি।

 কি? নিক তীব্র চোখে তাকিয়ে থাকে।

যদিও এটা হুবহু আমার হাতের লেখার মতই।

পোয়ারোর কথাটা শুনে নিক সায় দেবার মত করে বলে হ্যাঁ। কমলা রঙের কারনেশান ফুলগুলোতে তো একই রকম হাতের লেখা ছিল।

পোয়ারো তীব্র চোখে কার্ডটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে থাকে।

আর তাই ওই চকোলেটের বাক্সটা পেয়ে আমি কোনরকম সন্দেহ করিনি।

কি করে বা সন্দেহ করবেন? কি করে সন্দেহ করা সম্ভব। ওহ্, জিনিয়াস, এক জিনিয়াস শয়তানের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। অসাধারণ।

নিক অস্থিরভাবে নড়েচড়ে বসে।

নিজেকে দোষী ভাববেন না মাদাম জোয়েল। দোষ যদি কেউ করে থাকে, সে আমি। হ্যাঁ আমি। এই সম্ভাবনায় কথাটা আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল। অবশ্যই ভাবা উচিত ছিল। না ম্যাডাম না। চিন্তা করবেন না। সাহস আনুন মনে। সাহস। এরপর থেকে এরকুল পোয়ারো আর এরকম কোন কিছু হতে দেবে না। দিব্যি দিচ্ছি। এটাই ছিল আমার শেষ ভুল।

এরপর এরকুল পোয়ারো ঘর থেকে বের হয়ে এল। আমরা গিয়ে মেট্রনের ঘরে ঢুকলাম। গোটা ব্যাপারটায় মহিলা বেশ বিব্রত এবং হতচকিত, বিমর্ষও।

পোয়ারো তাকে যথাসম্ভব সান্ত্বনা দেবার পর বলল, কাল পাহারাদার যে ছিল আমি একটু তার সঙ্গে কথা বলতে চাই।

মেট্রন সঙ্গে সঙ্গে তাকে ডেকে পাঠালেন। রোগাটে চেহারার, সরল মুখশ্রীর এক যুবক। চকোলেটের বাক্সটা কাল কখন এসেছিল প্রশ্ন করায় সে অসহায় মুখে উত্তর দেয়, সারাদিন কত মানুষ কত কিছুর জন্যে আসছে যাচ্ছে, সবার কথা, সবকিছুর কথা মনে রাখা মুশকিল।

পোয়ারো তাকে বলে নার্স মেয়েটি বলেছে এটা সবার শেষে এসেছিল। সন্ধ্যে ছটা নাগাদ।

সঙ্গে সঙ্গে যুবকটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, হা, হা ঠিক। এক ভদ্রলোক বাক্সটা নিয়ে এসেছিলেন।

রোগা চেহারা, পাতলা চুল? পোয়ারো আগ্রহী গলায় প্রশ্ন করে।

চুল পাতলা খেয়াল আছে। চেহারাটা রোগাটে, কিনা মনে করতে পারছি না।

 তোমার কি মনে হয় চার্লস ভ্যাইস নিজেই বাক্সটা নিয়ে এসেছিলেন? বিড়বিড় করে পোয়ারোকে বলি। আমার খেয়াল ছিল না স্থানীয় মানুষ হিসাবে ওকে অনেকেই চেনে।

না, না, যিনি এসেছিলেন তিনি মিঃ ভ্যাইস নন। পাহারাদার যুবকটি বলে উনি লম্বায় বেশ কিছুটা বেশি ছিলেন। অনেক বেশি সুপুরুষও। একটু ভেবে নিয়ে সে যোগ করে।

লাজারুম। আমার মুখ থেকে শব্দটা বের হওয়া মাত্র পোয়ারো তীব্র ভৎর্সনার চোখে। আমার দিকে তাকায়। আমি মাথা হেলিয়ে ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গি করি।

তারপর? পোয়ারো পাহারাদারটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।

আমি ভদ্রলোকের হাত থেকে পার্সেলের বাক্সটা নিয়ে ভেতরের ঘরের টেবিলে রাখি। যত জিনিস আসে সব ওখানে জমা করাটাই নিয়ম। তারপর যে রোগীর জিনিস সেই ঘরের নার্স এসে সেটা নিয়ে যায়।

পোয়ারো এবার মাথা নাড়ে, ঠিক আছে, ধন্যবাদ। তুমি এখন আসতে পার।

পাহারাদারটি বের হয়ে যাবার পর পোয়ারো মেট্রনের দিকে তাকিয়ে বলে, এবার একটু নার্সটির সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি।

নার্স মেয়েটি খুব সহজেই সন্ধ্যে নাগাদ পার্সেলটা নিয়ে যাবার কথা মনে করতে পারল।

পোয়ারো বিড়বিড় করে বলে, তার মানে পার্সেলটা নীচের টেবিলে বেশ কিছু সময় পড়েছিল নজরবিহীন অবস্থায়।

এই বাক্সটা ছাড়াও আরও দুটো বাক্স ছিল। একটা ফুলের। অন্যটা ডাক মারফত এসেছিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, সেটাও এক বাক্স চকোলেট।

কথাটা শোনামাত্র পোয়ারো কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করে, আরও একটা অন্য বাক্স? কে পাঠিয়ে ছিল সেটা?

না, ওই বাক্সটার ভেতর কোন কার্ড বা প্রেরকের নাম ছিল না। মিস বার্কলি দুটো বাক্সই খুলেছিলেন। তারপর আক্ষেপের ভঙ্গিতে বলেছিলেন–কি দুর্ভাগ্য, এত লোভনীয় চকোলেট অথচ আমার খাওয়া বারণ। তারপর তিনি ওই বাক্সটা আমাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বলে অন্য বাক্সটা থেকে তুলে একটা চকোলেট খেয়েছিলেন।

হাসপাতালের বাইরে বের হয়ে এসে পোয়ারো প্রবল চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে বলে। সংশয়ের ওপর আবার নতুন সংশয় যোগ হচ্ছে। ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে অন্তত একটা ব্যাপার তো বুঝতে বা জানতে পারা গেল, বাক্সটা লাজারুম এনেছিলেন।

ব্যাপারটা আমার কাছে খুব আশ্চর্যের লাগছে।

তুমি কি ওনাকে এব্যাপারে কিছু বলবে?

অবশ্যই। নিশ্চিতভাবেই। মাদামজোয়েলের শারীরিক অবস্থা এখন কেমন সেটা ওনাকে জানানো আমাদের কর্তব্য। মাদাম মৃত্যুর দোরগোড়ায় রয়েছেন, হয়ত বাঁচাবেন না, শুনলে ওনার মানসিক অবস্থাটা ঠিক কি রকম হয় জানতে খুব ইচ্ছে করছে। তুমি খুব খুঁটিয়ে এই কথাটা শোনামাত্র ওনার মুখের অভিব্যক্তিটা ঠিক ঠিক নজর করবে। অবশ্যই বুঝে নেবে।

লাজারুসকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হল না। সৌভাগ্যবশত হোটেলের বাইরে গাড়ির গেট খুলে ঝুঁকে পড়ে তিনি কি যেন পরীক্ষা করছিলেন।

পোয়ারো বিনা কালক্ষেপে সোজা ওর কাছে চলে গেল, মঁসিয়ে লাজারুম, কাল সন্ধ্যেবেলা আপনি মাদাম জোয়েল নিকের জন্য একটা চকোলেটের বাক্স রেখে এসেছিলেন।

দৃঢ় গলায় বলে হ্যা। বেশ একটু অবাক হয়েই পোয়ারোর দিকে তাকায় সে। এরকম একটা সামান্য ব্যাপারে পোয়ারোকে মাথা ঘামাতে দেখে যেন কিছুটা বিরক্ত গলাতেই এরপর সে বলে, আসলে ওটা পাঠিয়েছিলেন ফ্রেডি, মানে, মিসেস রাইস। উনিই আমাকে বলেছিলেন, অনুরোধ করেছিলেন ওটা পৌঁছে দিয়ে আসতে।

ওহ, তাই বুঝি? কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে তারপর পোয়ারো প্রশ্ন করে, মিসেস রাইস এখন কোথায়?

একতলার লাউঞ্জে পেয়ে যাবেন।

আমরা ভেতরে ঢুকে দেখলাম তিনি এক কাপ চা নিয়ে বসে আছেন। আমাদের দেখামাত্র উদ্বিগ্ন, দুশ্চিন্তাগ্রস্থ মুখে তিনি প্রশ্ন করলেন, নিক নাকি আবার অসুস্থ হয়ে পড়েছে?

হ্যাঁ। খুব রহস্যজনক ব্যাপার মাদাম জোয়েল, আচ্ছা, আপনি কাল বিকেলে মাদাম নিককে একবাক্স চকোলেট পাঠিয়েছিলেন তো?

হ্যাঁ, নিকই আমাকে বলেছিল সেগুলো পাঠাতে।

মাদাম জোয়েল নিক আপনাকে চলোলেট পাঠাতে অনুরোধ করেছিল? পোয়ায়োর ভঙ্গিতে বিস্ময় চাপা থাকে না।

অবশ্যই, ফ্রেডরিকা দৃঢ় গলায় বলেন।

কিন্তু ওনার সঙ্গে আপনার দেখা হল কি ভাবে? কারও সঙ্গে ওনার দেখা করা তো বারণ।

না দেখা হয়নি। নিক আমাকে টেলিফোন করেছিল।

কথাটা শুনে পোয়ারোকে কিছুটা চমকিত দেখায়, আচ্ছা কথাগুলো বলার সময় ওনার গলা বা কথা বলার ভঙ্গি কি দুর্বল ক্লান্ত মনে হয়েছিল?

না, একেবারে না। বরং বেশ দৃঢ় গলায় কথা বলছিল। বেশ কিছুটা অন্যরকমই লেগেছিল ওর গলা এবং কথা বলার ভঙ্গিটা। প্রথমটা আমি তো বুঝতেই পারিনি নিকই যে কথা বলছে।

তবু আপনি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে এটা আপনার বান্ধবীই বলছেন।

ফ্রেডরিকা এবার কিছুটা চমকিত চোখে তাকায়। পোয়ারোর কথার অর্থটা যেন সঠিকভাবে ওর বোধগম্য হয় না।

তার মানে? নিক না হলে কে হবে?

পোয়ারো মৃদু হাসে, অথচ গম্ভীর মুখে বলে, খুব কৌতূহল-উদ্দীপক প্রশ্ন। একটু থেমে কি যেন ভেবে নেয় পোয়ারো, আপনি দিব্যি করে বলতে পারবেন ওটা আপনার বান্ধবীরই কণ্ঠস্বর ছিল?

না। ধীর কণ্ঠে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলে ফ্রেডরিকা। নিকের কণ্ঠ ওটা, আমি নিশ্চিত বলতে পারব না, ওর কণ্ঠ ভিন্নরকম। তবে সেই সময় আমার মনে হয়েছিল হয়ত ফোনে শুনতে ওইরকম লাগছে। অথবা অসুস্থতার কারণে………..

পোয়ারো মাথা হেলিয়ে ফ্রেডরিকার বক্তব্যে সায় দেয়।

 প্রায় হতভম্ব গলায় ফ্রেডি এবার বলে, কে? তাহলে ওটা কে ফোন করেছিল?

আমি সেটাই তো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি মাদাম। পোয়ারোর গলার গাম্ভীর্যে এবার ফ্রেডির মুখে ধীরে ধীরে তীব্র আতঙ্ক ফুটে ওঠে। কি যেন একটা বুঝে নেবার ভঙ্গিতে সে বলে, নিক কেমন আছে মিঃ পোয়ারো? ওর কিছু হয়েছে কি?

পোয়ারো সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা দোলায়, আপনার বান্ধবী ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আপনার পাঠান চকোলেটগুলোর মধ্যে তীব্র বিষ মেশান ছিল। পোয়ারোর কথাগুলো শুনতে শুনতে ফ্রেডি শিউরে ওঠে। ভয়ঙ্কর আতঙ্কে দুহাতে মুখ ঢাকে, না, না, তা হতে পারে না। বিষ? হে ভগবান তা কি করে সম্ভব? আমি আর জিম ছাড়া চকোলেটগুলোর বাক্সটা কেউ স্পর্শ করেনি। আপনাদের নিশ্চয়ই কোথাও ভুল হচ্ছে মিঃ পোয়ারো। ভুল হচ্ছে। এ হতে পারে না।

আমার কোন ভুল হচ্ছে না মাদাম। ভুল হবার কোন সুযোগই নেই। পোয়ারো ঘুরে দাঁড়ায়। সিঁড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। আমি ওকে অনুসরণ করি।

আমাদের ঘরে এসে পোয়ারো ক্ষিপ্তভঙ্গিতে টুপিটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। পুরোপুরি অন্ধকারে রয়েছি। মাদাম জোয়েল নিকের মৃত্যুতে কে লাভবান হবে? মাদাম রাইস চকোলেট বাক্স কিনেছেন স্বীকার করছেন। তারপরেও উনি……… না, সেটা অত্যন্ত মূখের মত কাজ হবে। আর উনি মোটেই বোকা নন। একেবারেই না। সেক্ষেত্রে….।

কিন্তু উনি কোকেন নেন। হেস্টিংস ব্যাপারটা মাথায় রাখ। এতে কোন ভুল নেই। আর চকোলেটের ভেতর কোকেন পোরা ছিল তাতেও কোন ভুল নেই। আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছ? উনি বললেন অন্যটায়, এটায় নয়। এটার ব্যাখ্যাও পাওয়া যাচ্ছে না। অন্য চকোলেটের বাক্সটার কথাতো ওনার জানবারই কথা নয়। তাহলে? পোয়ারো একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ে। ওর কপালে চিন্তার গভীর খাঁজ। মাদাম রাইস নিশ্চিতভাবেই কিছু জানেন। কিন্তু মুখ খুলছেন না। আর উনি সেরকম মহিলা নন কথার চাপে ঘাবড়ে গিয়ে কিছু বলবেন। কিন্তু কি জানেন উনি? সেটা বলছেন না? ওনার টেলিফোনের কথা কি সত্যি? না উনি বানিয়ে বলছেন? যদি সত্যি হয় তাহলে ওটা কার গলার স্বর ছিল?

সব পুরো অন্ধকার।

 হতাশার বহিঃপ্রকাশ শুনে আমি বললাম অন্ধকারের পরই কিন্তু সূর্যোদয় হয়।

পোয়ারো সমর্থনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে, তাহলে, দ্বিতীয় আরেকটা বাক্স ছিল। সেটা এসেছিল ডাকযোগে।

আমি আবার কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। পোয়ারো দ্রুত আমাকে বাধা দেয়, না, না, আবার একটা প্রবচন নয়। আমি আর নিতে পারব না। তুমি কি সত্যি আমার একজন শুভাকাঙ্খি বন্ধু?

আমি বেশ অবাক চোখে তাকাই অবশ্যই।

 তাহলে যাও হেস্টিংস, এক বাক্স তাস কিনে আন।

আমি তীব্র চোখে ওর দিকে তাকালাম। আবার ঠাণ্ডা গলায় বললাম, বেশ।

আমি পরিষ্কার বুঝতে পারলাম এই তাস কিনে আনবার অজুহাতে পোয়ারো এখনকার মতো ব্যাপারটা আমার কাছে এড়িয়ে যেতে চাইছে।

এখানেই আমি ওকে ভুল বুঝেছিলাম। সেই রাতে খাবার পর প্রায় ১০-১৫ মিনিট নাগাদ বসবার ঘরে এলাম দুজনে। দেখলাম আমার আনা তাসগুলো একটার ওপর একটা বসিয়ে সাজিয়ে ঘর বানাচ্ছে। আমি জানি এটা ওর পুরনো পদ্ধতি। যখন স্নায়ুর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়, পোয়ারো এইভাবেই স্নায়ুকে শান্ত করে, বলা ভাল নিজের স্নায়ুকে বশে আনে। এইসব দেখতে দেখতে চেয়ারে হেলান দিয়ে কখন যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেই জানি না। হঠাৎ পোয়ারোর ঝাঁকুনিতে আমার ঘুম ভাঙল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম, সোয়া পাঁচটা। সকাল হয়ে গেছে। চোখ কচলাতে কচলাতে পোয়ারোর দিকে তাকালাম, আমাকে দুহাত নাড়াতে নাড়াতে উচ্ছ্বাসভরা গলায় সে আমাকে বলে চলেছে, তুমি ঠিক বলেছ বন্ধু, একদম ঠিক বলেছিলে।

আমি আধো ঘুমের গলায় বলি–কি ব্যাপার?

 মাদাম জোয়েল মারা গিয়েছেন।

 কি-ই-ই-ই? আমি আঁতকে উঠি, চেয়ারে সটান উঠে বসি।

আরে না, না। সত্যি সত্যি ব্যাপারটা ঘটেনি।

আমি একটা স্বস্তির শ্বাস ফেলি। উত্তেজনার চোখে পোয়ারোর দিকে তাকাই। এ আবার কি ধরনের রসিকতা?

তবে ব্যাপারটার যদি ব্যবস্থা করা যায় আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে।

পোয়ারো হাশিখুশি ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকায়–খুনটা সম্পূর্ণ হল, চারবার, চারবার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়ে অবশেষে খুনী সফল হল। আমি দেখতে চাই তারপর কি ঘটে?

খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হবে এটা। আমারও তাই মনে হচ্ছে না। আমার দিকে। তাকিয়ে কথাটা বললেও, আসলে নিজের মনে স্বগোতোক্তির মতো করে বলে।

.

১৮.

 জানালায় একটি মুখ

পরের দিনের ঘটনাগুলো আমার স্মৃতিতে যথাযথ নেই। সকাল থেকেই প্রচণ্ড বেগে জ্বর এল। জ্বরের ঘোরে প্রায় অচেতন হয়ে শুয়ে রইলাম। এরপর কি ঘটনা ঘটল কিছুই জানতে পারলাম না। শুধু শুয়ে শুয়ে জ্বরের ঘোরে বুঝতে পারছিলাম পোয়ারো একবার করে ঘরে আসছে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে।

পরে জানতে পারলাম পোয়ারো ডাঃ গ্রাহামের সঙ্গে কথা বলে নিজের পরিকল্পনাটায় তাকে রাজি করায়।

ডাঃ গ্রাহামের বিশ্বস্ত কয়েকজন হাসপাতাল কর্মচারীকেও নিজের পরিকল্পনায় সামিল করে। অবশ্যই ডাঃ গ্রাহামের হাসপাতাল কর্মচারীদের প্রভাবেই এটা সম্ভব হয়। তারপর পুলিশ। কর্নেল ওয়েস্টন প্রথমে পোয়ারোর প্রস্তাবকে খুব একটা বাস্তবতার বা বুদ্ধিমানের কাজ বলে মানতে পারছিলেন না। পোয়ারোর বোঝানোর পর তিনিও অনেকটা নিমরাজি হয়েই সম্মতি দিলেন। যদিও তিনি বেশ পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন ব্যাপারটাতে তার কোন দায়িত্ব থাকছে না। মিথ্যাচারের দায়িত্ব পুরোটাই পোয়ারোকে নিতে হবে। এবং তারপরের দায়িত্বও। পোয়ারো এককথায় রাজি হয়ে যায়।

সারাটা দিন কম্বল মুড়ে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম। মাঝে মাঝেই পোয়ারো এসে ঘটনার সাম্প্রতিকতম অগ্রগতি সম্পর্কে আমাকে ওয়াকিবহাল করে যাচ্ছিল। বিকেলের দিকে ঘরে এসে চোখ টিপে মুচকি হেসে বলল, এক প্রস্থ লিলি পাঠাবার ব্যবস্থা করতে হবে বুঝলে? গভীর সমবেদনার সঙ্গে কথাটা বলে পোয়ারো।

একটু হেসে ও আবার যোগ করে কি ভয়ঙ্কর মজার ব্যাপার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও আবার বেরিয়ে যায়। রাতের দিকে আবার ঘরে আসে।একটু আগে মাদাম রাইসের সঙ্গে কথা হল। উনি প্রিয় বন্ধুর আকস্মিক মৃত্যুতে ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। নিক নেই বিশ্বাসই করতে পারছেন না। বারবার বলছিলেন, ওরকম একজন ছটফটে, প্রাণচঞ্চল মেয়ে……… এ ভাবে অকালে……আমিও সর্বান্তকরণে ওর কথায় সায় দিলাম। ওহ কি মজার সব কাণ্ডটা যে ঘটবে এবার।

তুমি কি করে ব্যাপারটাকে উপভোগ করছ? ক্ষীণ গলায় আমি বলি।

আঃ হেস্টিংস, বোকার মত কথা বল না। এটা আমার পরিকল্পনার একটা অঙ্গ। মজাটাকে সফল ভাবে সফল করা। যাইহোক, কথা প্রসঙ্গে উনি বারবার বলছিলেন চকোলেটের ব্যাপারটা উনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। ব্যাপারটা অসম্ভব। আমি তখন ওকে বলি, ময়না তদন্তের রিপোর্টেই সব জানা যাবে। তখন আপনি নিশ্চিত হবেন। আমার মুখে চকোলেটে কোকেন মেশানো ছিল শুনে, মাদাম জোয়েল নিকের তাতেই মৃত্যু হয়েছে জানতে পেরে উনি ভীষণ ঘাবড়ে গেলেন।

তুমি ঠিকই বলেছ হেস্টিংস। সম্ভাবনা প্রবলভাবে সেদিকেই ইঙ্গিত করেছে। কিন্তু অপরাধের অতি সরলীকরণ ব্যাপারটাই আমার বেশ ধাঁধায় ফেলেছে হে।

পোয়ারো আমার সামনের চেয়ারটায় বসে। এস, আর একবার সম্ভাবনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাক। দেখা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে তিনটে সম্ভাবনা ঘটতে পারে। প্রথম সম্ভাবনা, মাদাম রাইস চকোলেট এনেছিলেন। মিঃ লাজারুম সেটা দিয়ে আসেন। এক্ষেত্রে ওদের দুজনের কেউ একজন, অথবা, দুজনই অপরাধী হতে পারেন আর ওই তথাকথিত মাদাম জোয়েলের ফোন? নির্ভেজাল বানানো।

পোয়ারো থামে। তারপর একটু ভেবে নিয়ে আবার বলতে শুরু করে সম্ভাবনা দুই, দ্বিতীয় চকোলেট বাক্সটা। যে কেউ সেটা পাঠাতে পারে। আমাদের সন্দেহের তালিকায় ক থেকে জ’-র মধ্যে যে কেউ। কিন্তু, সেক্ষেত্রে ফোনটা করা হল কেন? ব্যাপারটা এভাবে জটিল করা হল কেন? তোমার কি মনে হয় হেস্টিংস?

আমি মাথা নাড়লাম। একশ দুই ডিগ্রি জ্বরের ঘোের ধরা মস্তিষ্ক নিয়ে আমার পক্ষে এরকম জটিল বিষয়ে মন্তব্য করা অসম্ভব।

পোয়ারো চেয়ার থেকে একবার উঠে দাঁড়ায়, তারপর আবার বসে পড়ে। এবার সম্ভাবনা তিন, মাদাম রাইসের আনা নির্দোষ সাধারণ বাক্সটাকে বদলে দেওয়া হয়েছিল বিষভরা চকোলেটের বাক্স দিয়ে। সেক্ষেত্রে টেলিফোনটার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ পাওয়া যায়। মাদাম রাইসের পক্ষে মাদাম জোয়েল বার্কলিকে খুন করার যুক্তিসঙ্গত বেশ কিছু কারণও বের করা অসম্ভব হবে না। সুতরাং, সম্ভাবনা তিন-কেই সবচেয়ে বেশি যুক্তিগ্রাহ্য কারণ বলে মনে হচ্ছে। তাই নয় কি?

অবশ্যই। পোয়ারো আমার কথায় নির্বিবাদে সায় দেয়। এতকিছু পরেও পোয়ারো কিন্তু নিশ্চিন্ত হতে পারে না। দু হাতে মুখ ঢেকে চেয়ারে হেলান দিয়ে একমনে কি যেন ভাবতে থাকে। নানা কথা চিন্তা করতে করতে একসময় কখন যেন দুর্বলতাজনিত কারণে ঘুমিয়ে পড়ি।

আমার আবার যখন ঘুম ভাঙল তখন বেশ গভীর রাত। টেবিলের সামনের চেয়ারটায় বসে রয়েছে পোয়ারো। ওর সামনে একটা খোলা বড় কাগজ। আমি দেখেই চিনতে পারলাম। ওটা সেই কাগজ যেটার মধ্যে পোয়ারো ক’ থেকে জ’ পর্যন্ত সন্দেহজনকদের একটা তালিকা তৈরি করেছিল। পোয়ারো যেন আমার মনের অনুচ্চারিত প্রশ্নটা পড়তে পারে, হ্যাঁ বন্ধু, পুরো ব্যাপারটাকে আবার নতুন করে বানাচ্ছি আমি। একেবারে সম্পূর্ণ অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখছি আবার। আবার, নতুন কিছু প্রশ্ন যার উত্তর খুঁজে পাওয়াটা এই নতুন এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খুব জরুরি।

কতদুর এগিয়েছ তুমি? আমার প্রশ্নে পোয়ারো উত্তর দেয়, প্রায় শেষ করে ফেলেছি। তুমি শুনতে চাও?

নিশ্চয়ই।

 বেশ। আমি তাহলে তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি পুরোটা।

পোয়ারো সামান্য কেশে নিয়ে গলা পরিষ্কার করে নিয়ে পড়তে শুরু করে।

(ক) এলিন–কেন সে রাতে বাজি পোড়ানো দেখতে না গিয়ে বাড়ির ভেতর ছিল। মাদামজোয়েলের অবাক হওয়া এবং দেওয়া প্রমাণ (প্রতি বছরই ও বাজি পোড়ানো দেখতে বের হয়) বলে দিচ্ছে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক। ও কি সন্দেহ করেছিল কিছু ঘটবে? ও কি কাউকে বাড়িতে (জ?) ঢুকতে দেখেছিল? গোপন প্যানেল আছে ঘরে, এ ব্যাপারে কি ও সত্যি কথা বলছে? যদি সত্যি সেরকম কিছু থাকে, কোথায় আছে কেন মনে করতে পারছে না? ও জোর দিয়ে আছে বলছে? যদি সত্যি সেরকম কিছু থাকে, কোথায় আছে কেন মনে করতে পারছে না? ও জোর দিয়ে আছে বলছে, অথচ, মাদামজোয়েল অস্বীকার করছেন। ব্যাপারটা বানানো হলে, এলিন কেন বানিয়ে বলছে? নিককে লেখা মাইকেল সেটনের প্রেমপত্রগুলো কি ও পড়েছে? নাকি মাদামজোয়েলের এনগেজমেন্টের খবর শুনে ওর বিস্ময় সত্যি?

 (খ) এলিনের স্বামী যতটা দেখায় সত্যি কি ততটাই নির্বোধ বা সরল, ভাল মানুষ? ওকি সেসব জানে (যাই হোক সেটা) যা এলিন জানে?

(গ) এলিনের সন্তান–রক্ত, হিংসা দেখে ওর আনন্দ পাওয়া কি ওর বয়সী ছেলের পক্ষে স্বাভাবিক, নাকি সে মানসিক অসুস্থ? এই মানসিক অসুস্থতা কি সে বাবা-মা কারও কাছ থেকে পেয়েছে? ও কি খেলনা পিস্তল থেকে কখনও গুলি ছুঁড়েছে?

(ঘ) মিঃ ক্রফট কে ইনি? কোথা থেকে এসেছেন? তিনি যেটা দিব্যি করে বলছেন, সেটা কি সত্যি! উইলটা সত্যি উনি পাঠিয়েছিলেন? যদি না পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে তার পেছনে উদ্দেশ্য কি?

(ঙ) মিসেস ক্রফট (মিঃ ক্রফটের মত একই) কে, কোথা থেকে এসেছেন, ওরা স্বামী-স্ত্রী কি কোন কারণে আত্মগোপন করে আছেন? তাই যদি হবে, কারণ কি সেই আত্মগোপনের? বার্কলি পরিবারের সঙ্গে ওদের কি কোন সম্পর্ক, যোগাযোগ আছে?

(চ) মিসেস রাইস–উনি কি নিক-এর বাগদানের ব্যাপারে জানতেন? নিছক অনুমান? না কি উনি বান্ধবীর প্রেমপত্রগুলো পড়েছিলেন? সে ক্ষেত্রে উনি জানতেন বা অনুমান করা ওর পক্ষে কঠিন ছিল না যে নিক এবার সেটনের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী? মাদাম জোয়েলের সম্পত্তি থেকে উনি কি পাবেন, তা উনি জানতেন কি? (সম্ভবত জানতেন। নিক ওনাকে নিশ্চয়ই বলেছিলেন) নিজের মাদক সরবরাহের সেই নোটে। বয়ফ্রেন্ড’ বলে কাকে উল্লেখ করেছিলেন মিসেস রাইস? সে কি জ’? ফোন করে নিকের তাকে চকোলেট কিনতে বলার কথাটা কি সত্যি? নাকি ইচ্ছাকৃত মিথ্যে?

একটা ব্যাপার দেখেছ? পোয়ারো হঠাৎ পড়া বন্ধ করে আমার দিকে তাকায়। মাদাম রাইস সম্পর্কিত প্রশ্নগুলো পুরোপুরি অস্পষ্ট, এক একটি প্রহেলিকা যেন। যে কারণে, নিশ্চিতভাবেই, উনি সব কিছু জানেন। কথাগুলো বলে পোয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর আবার ওর লেখা পাতাটায় চোখ রাখে, পড়তে শুরু করে।

(ছ) মিঃ লাজারুম ওনাকে এই অপরাধে যুক্ত করার মতো সেরকম কোন প্রশ্ন নেই। শুধুমাত্র উনি বিষাক্ত চকোলেটের বাক্সটা বদলে দিয়েছিলেন। তাছাড়া, আর একটাই মাত্র ছোট্ট খটকা। উনি একটা প্রায় মূল্যহীন ছবি কেনবার জন্যে কেন এত চড়া দাম দিয়েছিলেন?

উনি হয়তো নিক-কে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। আমার উত্তরটা শুনে পোয়ারো মাথা নাড়ে। নাহ, ভুলে যেওনা বন্ধু, উনি ব্যবসায়ী। কোন জিনিস ক্ষতিতে কিনে বিক্রি করতে চাইবেন না। বন্ধুকে সাহায্য করার ইচ্ছে থাকলে গোপনে কোনভাবে টাকা ধার দিয়েও সাহায্য করতেন।

কিন্তু এই অপরাধের সঙ্গে ওই ঘটনার কোন যোগ নেই। পোয়ারো কথাটা শুনে সায় দেবার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।সেটা সত্যি, তবে এই খটকাটার উত্তর আমি অবশ্যই জানতে চাইব। নিশ্চিতভাবেই জানতে চাইব।

পোয়ারো এক মুহূর্ত থামে, তারপর বলে–এবার, জ’।

(জ) এখানে একটা প্রশ্ন চিহ্ন ছাড়া আপাতত আমার হাতে কিছু নেই। সত্যিই কি কেউ আছে এই জ’ চরিত্রে? যদি থাকে…..

তখনি পোয়ারোর নজর পড়ে আমার ওপর, কি ব্যাপার? কি হয়েছে হেস্টিংস? আমি এতক্ষণে পোয়ারোর নজর ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছি। আমার গলা চিরে একটা তীক্ষ্ণ আর্তচিৎকার বের হসে আসে। আমার কাঁপা কাঁপা হাতের আঙুল নির্দেশ অনুসরণ করে পোয়ারো জানালার দিকে তাকায়।

একটা মুখ পোয়ারো, ভয়ঙ্কর একটা মুখ, জানালার কাঁচের ওপর………

যদিও এ মুহূর্তে সেখানে কিছু নেই। পোয়ারো জানালাটার কাছে গিয়ে সেটাকে ঠেলে দেয়, ঝুঁকে বাইরেটা দেখে।

কেউ নেই এখন। পোয়ারো চিন্তিত গলায় বলে, তুমি নিশ্চিত হেস্টিংস যে তুমি কাউকে সত্যি দেখেছ? মনের ভুল নয়তো?

না, আমি নিশ্চিত, বীভৎস একটা মুখ।

হুম, ওপাশে একটা ব্যালকনি আছে। আমাদের কথা শুনবে ঠিক করে থাকলে অবশ্যই ওখানে উঠে কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারে। বীভৎস মুখ বলতে তুমি কি বোঝাতে চাইছ হেস্টিংস?

ফ্যাকাশে, কঠিন চোখে নির্মমভাবে তাকিয়েছিল। প্রায় ভৌতিক একটা মুখ।

হুম। পোয়ারো কাগজগুলো গুছোতে-গুছোতে চিন্তিত মুখে বলে এটাই আশার কথা, এই বীভৎস মুখের মালিক যদি আমাদের কথা শুনেও থাকে, মাদাম জোয়েল নিক যে বেঁচে আছেন সেই বিষয়ে আমরা কোন কথা আলোচনা করছিলাম না, শোনেনি।

কিন্তু পোয়ারো, নিককে মৃত বানিয়ে তোমার কি লাভ হল? তোমার পরিকল্পনা মত সেরকম কিছু নাটকীয় ব্যাপার তো ঘটল না।

নাহ্, এত তাড়াতাড়ি সেরকম কিছু ঘটবে আশা করছি না। ২৪ ঘণ্টা অন্তত কাটুক। আগামীকাল, আমার গোয়েন্দাগিরি যদি ভুল না হয় তাহলে আগামীকাল অবশ্যই কিছু একটা ঘটবে। পোয়ারো একটু থামে, তারপর উদাস গলায় বলে, আর তা যদি না ঘটে, ধরে নিতে হবে আমার প্রথম থেকে এ পর্যন্ত সম্পূর্ণ থিয়োরিটাই ভুল।

পরদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গল বেশ বেলাতে। সামান্য দুর্বল লাগছিল। জ্বরটা কমে গেছে অবশ্য পুরোপুরি। আমরা প্রাতরাশ খাবার পর পোয়ারো সেদিনের ডাকে আসা চিঠিগুলো নিয়ে বাছতে বসল। আহ, এই যে।

পোয়ারোর ছোট্ট মন্তব্য শুনে আমি আমার চিঠির দঙ্গল থেকে মুখ তুলে বললাম কি ব্যাপার হে?।

এই চিঠিটা পড় পোয়ারো আমার দিকে একটা চিঠি এগিয়ে দেয়। আমি হাতে নিয়ে চিঠিটার দিকে তাকাই। ম্যাগি বার্কলির মা, মিসেস বার্কলির লেখা চিঠিটার বয়ান এই রকম

প্রিয় মঁসিয়ে পোয়োনরা,
বাড়ি ফিরে এসে আমার হতভাগ্য মেয়ের একটা চিঠি পেলাম। সেন্ট লু-তে পৌঁছানোর পর সে চিঠিটা পাঠিয়েছিল। চিঠিটা পড়বার পর কেন জানি না মনে হচ্ছে আপনার কাজে হয়ত সাহায্য করতে পারে চিঠিটা। অন্তত একবার পড়ে দেখতে চাইতে পারেন। তাই চিঠিটা পাঠালাম।

আপনার সহৃদয় সাহায্যের জন্যে অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভেচ্ছা জানবেন।
—মিসেস জিন বার্কলি

পোয়ারো ততক্ষণে ম্যাগির চিঠিটা পড়া শেষ করেছে। এবার সে চিঠিটা আমার দিকে এগিয়ে দেয়।

প্রিয় মা,
আমি নিরাপদেই পৌঁছেছি। বেশ আরামদায়ক সফর ছিল। এখানকার আবহাওয়াও এখন খুব ভাল। নিক ভালই আছে। তবে মাঝে মাঝে ওকে দেখে একটু অস্থির মনে হচ্ছে। তবে, আমি এখনও বুঝতে পারছি না ও কেন এত তাড়াহুড়ো করে আমাকে টেলিগ্রাম করে এখানে ডেকে পাঠাল।

আজ আর লিখছি না। আমি আর নিক এখন প্রতিবেশীর বাড়িতে চা খেতে যাব। ওরা অস্ট্রেলিয়ান দম্পতি। নিকের ভাড়াটে। নিক বলেছে ওরা এমনিতে দয়ালু হলেও, মানুষ হিসাবে খুব বিশ্রী, ভয়ানক।
—তোমার ম্যাগি।
পুঃ–নিক বলেছে ওর দুর্ভাবনা, উদ্বেগের কারণ আছে। পরে আমাকে সব বলবে। এই বাড়ি থেকে চায়ের নিমন্ত্রণ থেকে ফিরে ওর কথা শুনব।

মৃতের কণ্ঠস্বর পোয়ারো শান্তভাবে বলে এবং যা আমাদের কিছুই জানাল না পোয়ারোর কথাটা শুনে আমি প্রশ্ন করি তোমার অন্য চিঠিগুলো, ওগুলো থেকেও কিছু জানতে পারলে না?

না হেস্টিংস, আমি খুবই হতাশ। যে তিমিরে ছিলাম সেখানেই থেকে গেলাম। প্রাপ্তিযোগের ঘর শূন্য।

পোয়ারোর কথা শেষ হওয়া মাত্র ফোনটা বেজে উঠল। পোয়ারো ফোনটা ধরা মাত্র দেখলাম নিমেষে পোয়ারোর মুখের ভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে। আমার চোখ থেকে নিজের উত্তেজনা আড়াল করতে পারে না ও। ফোনালাপে পোয়ারোর অবদান কিছুই ছিল না বলতে গেলে। মনোযোগ দিয়ে অন্য পক্ষের কথা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে শুধু সাড়াবোধক শব্দ করছিল সে। ফলে বার্তার কিছুই আমার কানে পৌঁছল না, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, কি বিষয়ে ওই চমকদার ফোনটা।

শেষ পর্যন্ত একসময় বাক্যালাপ শেষ হল। Tnes bien, Jeaouses remerei বলে ফোনটা নামিয়ে রেখে পোয়ারো, আমি যেখানে বসেছিলাম, সেখানে ফিরে আসে। ওর দুচোখে উত্তেজনা চকচক করছিল।

Mon ami পোয়ারো অস্ফুটে বলতে বলতে আমার সামনের চেয়ারটায় বসে, তোমায় কি বলেছিলাম? এবার ঘটনা ঘটতে শুরু করবে।

কি হয়েছে?

মিঃ চার্লস ভ্যাইস ফোন করেছিলেন। তিনি জানালেন আজ সকালে ডাক মারফত তিনি তার বোনের করা একটি উইল পেয়েছেন। যেটা গত ফেব্রুয়ারি মাসের বানানো।

কি?

একেবারে নিখুঁত সময় ওটা পৌঁছেছে। কি বল?।

আমি ভুরু কুঁচকে তাকাই তোমার কি মনে হয়? উনি সত্যি বলছেন?

পোয়ারো হাসে এই তো সবে শুরু বন্ধু। মাদাম জোয়েল নিক মারা গেছেন। এখন নতুন নতুন এরকম অবাক করা কত কাণ্ডকারখানা ঘটবে। শুধু দেখে যাও।

সত্যিই তাই। তা নতুন উইলের বিষয়বস্তু কি?

মিঃ ভ্যাইস সেসব কিছু বললেন না বিস্তারিতভাবে। সেটাই উচিত। তবে এটা যে নিজের বলা উইলটাই, সে ব্যাপারে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ এটার সাক্ষী হিসাবে শ্রীমতী এলিন উইলসন এবং তার স্বামীর সই ছিল।

পোয়ারো একঝলক কি যেন ভেবে নিয়েই দ্রুত পায়ে টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়। আমি মাদাম জোয়েল ম্যাগির চিঠিটা আর একবার পড়তে চাই। আমার কি একটা ব্যাপার যেন নজর এড়িয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। কৌতূহল উদ্দীপক কিছু একটা। চিঠিটা তুলে নিয়ে পোয়ারো আরও একবার পড়তে থাকে।

আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াতে থাকা ইয়টগুলোর পাল্লাবাজি দেখতে থাকি। হঠাৎ পোয়ারোর মুখ থেকে বের হয়ে আসা প্রবল বিস্ময়তাড়িত একটা শব্দে আমি মুখ ফিরিয়ে তাকাই। পোয়ারো দু হাতে তার মাথাটা চেপে ধরে আছে। ওহ আমি কি অন্ধ হয়ে গেছি? পোয়ারো চাপা আর্তনাদ করে ওঠে।

কি হয়েছে?

কি হয়নি হেস্টিংস? কি হয়নি? এরকম একটা সরল ব্যাপার কি করে নজর এড়িয়ে গেল? কিচ্ছু দেখতে পেলাম না আমি? কিছু না?

ভগবানের দোহাই পোয়ারো, বল কি হয়েছে?

দাঁড়াও, দাঁড়াও। আবার ব্যাপারগুলোকে, নতুন করে সাজাতে হবে। পোয়ারো টেবিল থেকে তার সম্ভাব্য অপরাধীদের তালিকাটা তুলে নেয়। দ্রুত সেটার ওপর নজর বুলিয়ে চলে। ওর ঠোঁট দুটো নড়তে থাকে। আর তালে তালে সায়ব্যঞ্জক ভঙ্গিতে ওর মাথাটা নড়তে থাকে।

পড়া শেষ হলে পোয়ারো আরাম কেদারাটায় হেলান দিয়ে বসে। ওর দুচোখ বন্ধ হয়ে যায়। গভীর চিন্তায় ডুবে যায় সে।

একসময় একটা গভীর শ্বাস ফেলে উঠে বসে, সোজা হয় সে। আমার দিকে সোজাসুজি তাকায়। প্রিয় মুদ্রাভঙ্গিতে হাত দুটোকে বুকের কাছে জড়ো করে বলে ব্যাস, সব মিলে যাচ্ছে যা-যা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল, জট পাকাচ্ছিল, সব খাপে খাপে বসে যাচ্ছে।

তার মানে, তুমি রহস্যের সমাধান করে ফেলেছ? উত্তেজিত গলায় বলি আমি।

হ্যাঁ, প্রায় সবগুলো জট খুলে গেছে। আমার থিয়োরি মোটামুটি ঠিকই ছিল। আর সেই জন্যেই আসল সত্যিটাকে আশ্চর্যভাবে ধোঁয়াটে মনে হচ্ছিল। তবে এখন সবকিছুই জলের মত স্পষ্ট, স্বচ্ছ। একটু থেমে ও আবার বলতে থাকে আমাকে এখন দুটো টেলিগ্রাম পাঠাতে হবে দুটো প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়ে। যদিও, তার উত্তরগুলো ইতিমধ্যে আমি জেনে ফেলেছি। এখানে তা জমা আছে। আঙুল দিয়ে নিজের মস্তিষ্কটা দেখায় সে।

আর সেই প্রশ্ন দুটোর উত্তর কখন পাবে তুমি? কৌতূহলী গলায় প্রশ্ন করি। হঠাৎ পোয়ারো উঠে দাঁড়ায়।

হেস্টিংস, তোমার মনে আছে। মাদাম জোয়েল নিক এন্ড হাউসে একটা নাটক করতে চেয়েছিলেন? আজ রাতে আমরা ওখানে সেইরকমই একটা নাটক করব। কিন্তু সেই নাটকের পরিচালক হবে এরকুল পোয়ারো। মাদাম জোয়েল তাতে একটা বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করবেন। পোয়ারো মুচকি হাসে। তুমি তো জান হেস্টিংস, অনেকের মুখেই শুনেছ এন্ড হাউসে নাকি কিছু আছে। সবার কেমন শরীর ছমছম করে। কিন্তু সেই কিছু মানে ভূত-প্রেতাত্মাটাকে কেউ দেখেনি এন্ড হাউসে, আজ দেখবে।

আমি একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু পোয়ারো শুরুতেই থামিয়ে দেয় আমাকে, না, না, আমি আর একটা কিছুও বলব না। আজ রাতেই নিজের চোখে কানে তোমার সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাবে। তখনই সব জেনে নিও।

দ্রুতপায়, আচমকা ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় সে।

.

১৯.

পোয়ারোর পরিচালনায় নাটক

এক কৌতূহল-উদ্দীপক জমায়েত। আজ সারাদিনে পোয়ারোর দেখা প্রায় পাইনি বলতে গেলে। এমনকি রাতের খাবারও খেতে আসেনি। ফোনে বলে রাত ন’টায় আমি যেন সরাসরি এন্ড হাউসে চলে যাই। এন্ড হাউসের বাইরের ঘরে পোয়ারোকে ঘিরে সবাই বসেছিল। আমি দেখলাম পোয়ারোর তালিকার ক’ থেকে ছ’ পর্যন্ত সবাই হাজির রয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই, তালিকার জ’ ব্যক্তিটি (থাকতেও পারে, কে জানা নেই) এই জমায়েতে হাজির নেই। এমনকি হুইল চেয়ারে চেপে মিসেস ক্রফটও হাজির হয়েছেন, আমার দিকে তাকিয়ে উনি মৃদু হাসলেন তাও এই সুযোগে আমার একটু বাড়ির বাইরে বের হওয়া হল।

আমি ঘরের চারপাশটা ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে নিলাম (আমার দুচার মিনিট দেরি হয়েছিল আসতে) পোয়ারো বসে আছে মিঃ ভ্যাইসের ডান পাশে। নীচু গলায় কি যেন বলছে পোয়ারো ওকে। এলিন দরজার পাশেই একটা টুলে বসেছে। ওর পাশে ওর স্বামী। ভদ্রলোক বড়বড় শ্বাস নিচ্ছেন। বেশ নার্ভাস। ফ্রেডরিকা, লাজারুম, কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার বাকিরা সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুরো ঘরটা জুড়ে বসেছিল। ওদের সবার থেকে কিছুটা দূরে বসেছিলাম আমি।

দেখা গেল, পরিচালক হলেও পোয়ারো সক্রিয়ভাবে নাটকের পরিচালনায় অংশ নিচ্ছেন না। সেই দায়িত্বটা ও দিয়েছে চার্লস ভ্যাইসকে। এতক্ষণ ধরে বোধ হয় সে সবই বোঝাচ্ছিল ওনাকে। পোয়ারো যে তার আস্তিনের তলায় আমাদের জন্যে কি অবাক করা কাণ্ড লুকিয়ে রেখেছিল কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

যুবক আইনজীবীটি সামান্য কেশে, গলা সাফ করে নিয়ে বলতে শুরু করে এই জমায়েতটা একটু অন্য ধরনের। পরিস্থিতিটা সত্যিই ভীষম রকমের অদ্ভুত। বলা উচিত চমকপ্রদ। আমার তুতো বোন নিকের মৃত্যু ঘিরে এক আশ্চর্য পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তার মৃত্যুর পর ময়না তদন্ত চলছে, মৃত্যু হয়েছে খুনের উদ্দেশ্যে। বিষ প্রয়োগে, কে, কিভাবে বিষ প্রয়োগ করেছে সেটা পুলিশই তদন্ত করে খুঁজে বার করবে। আমি সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। আমার যেটা বলবার কথা, যা বলতে এখানে এসেছি সেই কথাই বলি। যে কোন মৃত ব্যক্তির শেষ ইচ্ছাপত্র তার অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার পরই পড়তে হয়। কিন্তু মিঃ পোয়ারোর সনির্বন্ধ অনুরোধে এবং বিশেষ কারণে আমি নিকের অন্ত্যেষ্টি কাজ সম্পন্ন হবার আগেই তার শেষ ইচ্ছাপত্রটি খুলে পড়ছি। যার যা প্রাপ্য এই সম্পত্তি থেকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। সেকারণেই আজ রাতে সবাইকে এখানে জমায়েত হতে বলেছি। আর এই উইলটাও ভারী অদ্ভুত ভাবে আমার কাছে পৌঁছেছে। এটার তারিখ লেখা আছে, ফ্রেব্রুয়ারী মাসের। অথচ, আশ্চর্য দেখুন, এটা মাত্র আজ সকালেই আমার কাছে পৌঁছেছে। যদিও, কোন সন্দেহই নেই যে উইলটা আমার বোনের হাতেই লেখা। এবং আইনিভাবে তৈরি। ভ্যাইস একটু থামে।

আরও একবার গলা সাফ করে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে। ঘরের প্রতিটি মানুষের চোখ তখন ওর ওপর নিবদ্ধ এটা খুবই ছোট্ট’। হাতের হলুদ রঙের মোটা খামটা থেকে একটা কাগজের পাতা বের করে, সামান্য বিরতির পর সে পড়তে শুরু করে এটা ম্যাগডেলা বার্কলির সম্পত্তির বাটোয়ারা বিষয়ে শেষ ইচ্ছাপত্র। আমি নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি আমার সম্পত্তির সঠিক ভাগ-বাটোয়ারা দায়িত্বে থাকবেন আমার তুতো ভাই চার্লস ভ্যাইস।

আমার শেষ ইচ্ছানুসারে আমার স্থাবর অস্থাবর যাবতীয় সম্পত্তির মালিক হবেন আমার মৃত্যুর পর মিসেস মিলডেরড ক্রফট। আমার বাবাকে দারুণভাবে সঙ্গদান ও সেবা করার জন্যে, বন্ধুত্বর সামান্য নিদর্শন হিসাবে তার প্রতি আমার প্রতিদান। আমার বাবা ফিলিপ বার্কলির হয়ে আমি মিসেস ক্রফটকে তার সার্ভিসের অতুলনীয় উপকারের বিনিময়ে সামান্য কিছুটা ফিরিয়ে দিতে চাই।

সই– ম্যাগডেল বার্কলি।

সাক্ষী– এলিন উইলসন, উইলিয়াম উইলসন’ ভ্যাইস থামলেন।

আমি স্তব্ধ, নির্বাক হয়ে গেলাম। ঘরের প্রতিটি মানুষেরই অবস্থা আমারই মত। শুধুমাত্র মিসেস ক্রফট বারকয়েক সমর্থনসূচক ভঙ্গিতে মাথাটা নাড়ালেন। এটা সত্যি। শান্ত গলায় বললেন তিনি। ফিলিপ বার্কলি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন। এবং সেটা মনে হয় আমারই জন্যে। যাইহোক, সেই বিষয়ে আমি কিছু বলব না। এতদিন যখন কাউকে কিছু বলিনি, আজও কিছু বলব না। গোপন বিষয় গোপনই থাকুক। যদিও, এখন দেখছি নিক ব্যাপারটা জানত। খুব সম্ভবত ওর বাবা ওকে জানিয়েছিলেন। আমরা যে বারবার এখানে আসতাম সেটা এই এন্ড হাউসকে দেখতে কাছ থেকে, ফিলিপ বার্কলির মুখে সব সময় যেটার কথা বহুবার শুনেছিলাম। নিক সব জানত তাই বারবার আমরা এখানে আসি ও চাইত। লজটায় আমাদের থাকতে দিত। ভাড়া নিতে চাইতনা এক পয়সাও। আমরা প্রায় জোর করেই ভাড়াটা দিতাম। কিন্তু ও নানাভাবে সেটা আমাদের ফেরত দিয়ে দিত। আর শেষ পর্যন্ত, এই পৃথিবীতে নাকি কৃতজ্ঞতাবোধ বলে কিছু নেই। ভুল, ভুল। এই ঘটনাটাই তো জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ, নিকের মত মানুষদের মধ্যে, তা বেঁচে আছে, থাকবে।

সারা ঘরে তখনও তারপরও এক বিস্ময় বিজড়িত নৈঃশব্দ। পোয়ারো ভ্যাইসের দিকে তাকায় আপনার এই ব্যাপারে কোন ধারণা ছিল?

ফিলিপ বার্কলি অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন আমি জানতাম। কিন্তু সেখানে কোনরকম স্ক্যান্ডাল ঘটেছিল বলে শুনিনি কখনও।

পোয়ারো সপ্রশ্ন চোখে মিসেস ক্রফটের দিকে তাকায়। তিনি দৃঢ়ভঙ্গিতে মাথা নাড়েন নাহ আমার থেকে আপনি কিছু জানতে পারবেন না। সেই গোপনতা আমার সঙ্গেই কবরে যাবে। আগেই বলেছি, অতীতেও এ ব্যাপারে কখনও কারও কাছে মুখ খুলিনি। আজ বা পরেও কোনদিন খুলব না।

ভ্যাইস শান্তভাবে বসে হাঁটুতে পেন ঠুকতে থাকে সেক্ষেত্রে আমার মনে হয়……

পোয়ারো ভ্যাইসের দিকে ঝুঁকে পড়ে এই উইলটাকে মাদাম জোয়েলের সবচেয়ে কাছের আত্মীয় হিসাবে আপনার আদালতে চ্যালেঞ্জ জানান উচিত। যখন এই উইল তৈরি করা হয়েছিল তখন একরকম ব্যাপার ছিল। কিন্তু এখন এটা বিশাল এক সম্পত্তির উত্তরাধিকারের ব্যাপার।

ভ্যাইস ঠাণ্ডা চোখে পোয়ারোর দিকে তাকায় উইলটা পুরোপুরিভাবে আইনসঙ্গত। আমার বোনের করা তার সম্পত্তির বাটোয়ারাকে আইনি পথে বিরোধীতা করার কোন ইচ্ছে, আগ্রহই আমার নেই।

আপনি খুবই সৎ মানুষ। মিঃ ক্রফট সমর্থনের ভঙ্গিতে বলেন। আশ্চর্য করে দিল মেয়েটা। একবারের জন্যেও কখনও বুঝতে দেয়নি এই কাণ্ডটা করতে চলেছে।

স্বামীর কথায় মিসেস ক্রফট মাথা নাড়েন মিষ্টি মেয়েটা আমাদের অবাক করে দিতে চেয়েছিল।

ও হয়ত ওপর থেকে আমাদের দেখছে। আর ও যা চেয়েছিল, সেটাই ঘটতে দেখে হয়ত খুব খুশি হচ্ছে। পোয়ারো বলে। তারপর এক মুহূর্তের মধ্যে, যেন কি মনে পড়ে গেল, এভাবে বলে, যেন হঠাৎ কোন পরিকল্পনা মাথায় এল, আচ্ছা, আমরা আজ এখনি একটা প্রেতচক্রে বসলে হয় না? সবাই টেবিল ঘিরে বসে পড়ুন।

প্ল্যানচেট? মিসেস ক্রফট আঁতকে ওঠা গলায় বলেন, কিন্তু……… তার গলায় এখন একধরনের বিপন্নতা।

হ্যাঁ, ব্যাপারটা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। হেস্টিংস, আমার প্রিয় বন্ধু এখানে আছে। ওর মধ্যে মাধ্যমশক্তি প্রচণ্ড (আবার আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন? আমি মনে মনে বলি), অন্য জগৎ থেকে বার্তা নিয়ে আসতে পারব আমরা। এ তো এক দারুণ সুযোগ। আমাদের এই সুযোগটাকে অবশ্যই কাজে লাগান উচিত। একটু থেমে পোয়ারো হাতে তালি বাজায়। ঘরের সবার দিকে ইঙ্গিত করে, তাড়াতাড়ি, টেবিলটার কাছে চেয়ার টেনে নিয়ে ঘিরে বসুন সবাই। আলো, আলোগুলো নিভিয়ে দেওয়া হোক।

অনেকেই যে খুব প্রসন্ন মনে বা সাহসের সঙ্গে পোয়ারোর নির্দেশ মানল তা বলা যাবে না। তবে পোয়ারোর ইচ্ছের কেউ বিরোধিতাও করল না। আসলে হয়ত ঘটনাচক্রের দ্রুততা, আকস্মিকতায় তারা এতটাই হতচকিত হয়ে পড়েছিলেন যে প্রতিবাদ করা বা বিরোধিতা করার কথা ভাববারও সময় পাননি।

অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে সবকিছু করা হল। ঘর এখন ঘন অন্ধকার। টেবিল ঘিরে অজানা-অচেনা শঙ্কায় দুরু দুরু বক্ষ কয়েকটি মানুষ। যেহেতু গরমের রাত, জানালাগুলো খোলা থাকলেও পর্দাগুলো সব টেনে দেওয়া হয়েছে। যার ফলে আবছা মৃদু একটা আলো ঘরে এসে পড়েছে। প্রায় ভুতুড়ে, রহস্যময়, আবছায়া পরিবেশ। নিস্তব্ধ ঘরে সবাই প্রায় মিনিট তিন শ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। তারপর ধীরে, খুব ধীরে টেবিলটা কাঁপতে শুরু করে (আমি মনে মনে পোয়ারোকে অভিসম্পাত দিই আমাকে এসব করতে হবে, ওর পুরো পরিকল্পনাটা, কেন আগে থাকতে আমাকে জানায়নি কিছু) আমার শ্বাস ভারী হয়ে ওঠে (সবাই সেটা শুনতে পায়, শুনতে পেতে বাধ্য করি নাটকীয়তা ব্যবহারে) ইতিমধ্যে অন্ধকারের সুযোগে পোয়ারো নিশব্দ পায়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমার কানে মুখ ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বলে চালিয়ে যাও। উনি বাইরে, টেরেসে চলে এসেছেন। খুব শিগগির নাটকের ওপর নাটক ঘটতে শুরু করবে।

আমি অন্য সবার মনের অবস্থানটা স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম। অন্ধকারে, ঘরের কোথাও কিছু একটা, কিছু এসেছে, অপেক্ষায় আছে। কিছু একটা অভুতপূর্ব ঘটতে চলেছে। প্রতি মুহূর্তে শ্বাসরোধ করে তারই অপেক্ষা করে চলেছিল ঘরের প্রতিটি মানুষ। আমি নিজেও যথেষ্ট নার্ভাস বোধ করছিলাম। আমার তো তবু একটা ধারণা রয়েছে কি ঘটতে পারে, ঘটতে চলেছে। তবুও, আমার হৃৎপিন্ডটা মুখের কাছে এসে আটকে আছে মনে হচ্ছে। বাকিদের তাহলে কি অবস্থা? ঠিক এই সময়েই, ঘরের দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। প্রায় নিঃশব্দে (আগে থেকেই তেল দিয়ে বোধহয় তৈরি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু প্রভাবটা হল মারাত্মক) দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে যেন একটা দমকা হাওয়া ঘরে ঢুকে এল। বাগান থেকে বয়ে আসা সাধারণ হাওয়া। অথচ, মনে হল সবার শরীরে যেন একটা হিমশীতল মৃত্যুর স্পর্শ লাগল।

এবং তারপরই আমরা সবাই দেখতে পেলাম দরজার সামনে, আবছা ছায়ার মত প্রায় অবয়বহীন একটা আদল। নিক বার্কলি। এক ভৌতিক, অলৌকিকতার ভঙ্গিতে, নিঃশব্দে, ধীরে, প্রায় ভেসে আসবার মত, এগিয়ে আসতে থাকে সে। অমানুষিক এক দৃশ্য। যার প্রভাব স্বাভাবিক, নিশ্চিত, এবং প্রগাঢ়ভাবে ঘরে উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মনের ওপর পড়ে। আমি মনে মনে তারিফ না করে পারি না। কি অসাধারণ একজন অভিনেত্রীকে পায়নি সিনেমা, হলিউড। নিশ্চিতভাবেই নিক তার এই নতুন চরিত্রে অভিনয় উপভোগ করছে। নিখুঁতভাবে তার প্রতিফলনও ঘটাচ্ছে। এন্ড হাউসে নিক একটা নাটক করতে চেয়েছিল। কি নাটক, তা আমি জানি না। তবে সেই নাটকের চেয়ে এই চরিত্রটা যে বেশ কয়েকগুণ বেশি ভাল, নাটকীয়তা ভরা তা আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি।

প্রায় ভাসতে ভাসতে (সেটা কি করে, এখনও আমি জানি না) ঘরের মাঝখানে চলে এল। আর তখনি ঘরের থমথমে নৈঃশব্দ ভেঙ্গেচুরে খানখান হয়ে গেল। আমার পাশেই, হুইল চেয়ারটা থেকে কেমন একটা দম আটকে আসা কান্না জাতীয় শব্দ ভেসে এল। মিসেস ক্রফট। ঘড়ঘড়ে গলা আটকে আসা শব্দ। মিঃ ক্রফট। তীব্র চমকিত, আতঙ্কিত, ভগবানের নাম স্মরণ। কম্যান্ডার শ্যালিঙ্গার ও লাজারুম সামনে ঝুঁকে পড়ে বিড়বিড় করতে থাকে। চালর্স ভ্যাইস দম দেওয়া পুতুলের মত চেয়ারে হেলান দিয়ে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকেন। শুধুমাত্র ফ্রেডরিকা রাইস, কোনরকম নড়াচড়া বা শব্দ করলেন না। এবং তারপরই তীক্ষ্ণ গলার একটা চিৎকার উঠল ফিরে এসেছে, সে ফিরে এসেছে। হাঁটছে, হাঁটছে। যাদের খুন করা হয়, তারা হাঁটে। তারা হাঁটে। আহ হে ভগবান…….

তারপরই, একসাথে ঘরের সবগুলো আলো জ্বলে উঠল। পোয়ারোর মুখে দেখলাম একটা বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছে। যেন এক রিং মাস্টারের হাসি। সাদা ধবধবে ওড়না জাতীয় একটা গাউন পরে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে নিক। এক এক করে সবার মুখগুলো দেখছে।

সবার আগে ফ্রেডরিকাই কথা বলে। অবিশ্বাসের তীব্রতর ভঙ্গিতে হাত বাড়ায় সে, বন্ধুকে স্পর্শ করে নিক, নিক, তুমি সত্যি আসল।

নিক হাসে, এগিয়ে যায় হ্যাঁ, আমি সত্যি, যথেষ্ট আসল। তারপর সে মুখ ফেরায় আপনি আমার বাবার জন্যে যা করেছিলেন তার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ মিসেস ক্রফট। কিন্তু আমি দুঃখিত, তার লাভটা এক্ষুনি আপনি পাচ্ছেন না।

হে ভগবান, ওহ হে ভগবান। মিসেস ক্রফট প্রায় খাবি খেতে থাকেন, চেয়ার থেকে পড়ে যাবার উপক্রম হয়, আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল বার্ট নিয়ে চল। আমি রসিকতা করেছি মাত্র। শুধু রসিকতা, বিশ্বাস কর। খুবই সন্দেহজনক রসিকতা বাস্তবিক।

আবার দরজা খুলে যায় আর প্রায় নিঃশব্দে একজন মানুষ ঘরে ঢোকেন। আমি অবাক হয়ে যাই। ইন্সপেক্টর জেপ। পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে তিনি মাথা নাড়েন কোন প্রশ্নের উত্তর মিলে যাবার তৃপ্ত ভঙ্গিতে। আর তারপরই তার মুখ নিমেষে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হুইল চেয়ারে বসা ভেঙ্গে পড়া, হতচকিত, প্রবল বিব্রত পঙ্গু মহিলাটির চেহারার দিকে নজর পড়তেই। দ্রুত ক্ষিপ্র পায়ে তিনি এগিয়ে যান। আরে আরে আরে, কি আশ্চর্য, এক পুরনো বন্ধু যে। মিলি মেরটন। আপনি তাহলে এখানে আপনার পুরনো খেলা শুরু করেছেন মাননীয়া?

মিসেস ক্রফট বিড়বিড় করে কি একটা কথা বলতে থাকেন। বড়ই ক্ষীণ দুর্বল সেই প্রতিবাদ। জেপ ধমকে ওঠেন, থামুন। আপনার জারিজুরি সব শেষ। তারপর পোয়ারোর দিকে ফিরে জেপ বলেন মাননীয়াটিকে চিনে রাখুন মঁসিয়ে পোয়ারো। এই সময়ের সবচেয়ে ধূর্ততম প্রতারক মিলি মেরটন। আমাদের কাছে খবর ছিল এক গাড়ি দুর্ঘটনায় উনি মারাত্মক আহত। কিন্তু উনি কোথায় আছেন জানতে পারা যাচ্ছিল না। পঙ্গু, আহত, হুইল চেয়ারে বসা অবস্থাতেও উনি প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এখানে। বাস্তবিক, জোচ্চুরির ক্ষেত্রে উনি একজন বিরাট মাপের শিল্পী মানতেই হবে।

তার মানে উইলটা জাল? একটা প্রতারণা? প্রবল বিস্ময়ের গলায় ভ্যাইস প্রশ্ন করেন।

অবশ্যই জাল। তুমি ভাবলে কি করে ওরকম বোকা বোকা, চরম অসঙ্গতিপূর্ণ একটা উইল আমি করব, করতে পারি। আমি এন্ড হাউস তোমাকে দিয়ে গিয়েছি চার্লস। বাকি সবকিছু ফ্রেডরিকাকে।

আর ঠিক তখনি ঘটল ব্যাপারটা। আচমকা।

জানালার বাইরে যেন একটা আগুনের ঝলক ঝলসে উঠল। তীব্র, কান ফাটানো একটা শিসের মত শব্দ। তারপর আরও একটা। জানালার বাইরে একটা মর্মভেদী আর্তচিৎকার আর কিছু একটা পড়ে যাবার শব্দ। এদিকে ফ্রেডরিকা তখন পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। ওর কবজির কাছ থেকে রক্তের সরু ধারা নেমেছে।