১৫. ফেরা
ছোট খালা আমাকে দেখে সরু চোখে তাকিয়ে বললেন, কোথা থেকে আসা হয়েছে লাটসাহেবের?
আমি কিছু বললাম না। ছোট খালা চিৎকার করে উঠলেন এবারে, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি?
আমি এবারেও কিছু বললাম না। কী বলব ছোট খালাকে? বব কার্লোসের দল ধরে নিয়ে গিয়েছিল? টুকুনজিল আমাকে বাঁচিয়ে এনেছে? ছোট খালাকে এটা বিশ্বাস করানো থেকে মনে হয় মাথাটা কেটে হাতে নিয়ে নেয়া সোজা। আমি তাই সে চেষ্টা করলাম না, চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম।
কি হল, কথা বলছিস না কেন?
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।
অনেক শিক্ষা হয়েছে আমার। ভেবেছিলাম বুকুর জন্যে একটা কাজ করব, তোকে মানুষ করে দেব। লাভের মাঝে লাত হল কি? গ্রামের ছেলে শহরে এসে গুণ্ডা হয়ে গেলি। গুণ্ডা। একেবারে পরিষ্কার গুণ্ডা। সুযোগ পেলেই রাস্তায় গিয়ে মারপিট করে আসিস।
ছোট খালা একটু দম নিয়ে আবার শুরু করলেন, কাল সারা রাত কোথায় ছিলি? কোথায়? মদ-গাঞ্জাও কি খাওয়া শুরু করেছিস এই বয়সে? সারা রাত যে তোর ছোট খালু হাসপাতাল আর থানায় দৌড়াদৌড়ি করেছে, সেই খবর কি আছে? এখন ড্যাংভ্যাং করে লাটসাহেব বাড়ি ফিরে এলেন। বাপের বাড়ির বান্দী পেয়েছিস আমাকে যে তোর জন্যে রান্না করে বসে থাকব সারা রাত।
হঠাৎ টুকুনজিলের কথা শুনতে পেলাম, দেব থামিয়ে?
কেমন করে?
মস্তিষ্কের যে অংশে কথা বলার কন্ট্রোল, সেটা একটু পাল্টে দিলেই হবে। দেব?
না, থাক। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোট খালার বকুনি শুনতে থাকি।
ঘন্টাখানেক পর বল্টু আমাকে একটা চিঠি দিয়ে গেল। বাড়ি থেকে এসেছে। চিঠিটা নিশ্চয়ই খুলে পড়ে আবার আঠা দিয়ে লাগানো হয়েছে। আঠাটা এখনো শুকায় নি। আমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামালাম না। ভিতরে রাঙাবুবুর একটা চিঠি। রাঙাবুবু লিখেছেঃ
বিলু
ভেবেছিলাম তোকে লিখব না। কিন্তু না লিখেই থাকি কেমন করে? বাবার খুব শরীর খারাপ, গত এক সপ্তাহ থেকে বিছানায়। তোক দেখার জন্যে খুব ব্যস্ত হয়েছেন। মাঝরাতে উঠে বসে থাকেন, বলেন, দরজা খোল, বিলু এসেছে।
তুই চলে আয়, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে বাবা আর বাঁচবেন না। বাড়িতে তুই ছাড়া পুরুষমানুষ নাই। মনে হয় এখন তোকে দায়িত্ব নিতে হবে। বাবার পাগলামিটাও খুব বেড়েছে। বড় কষ্ট হয় দেখলে।
রাঙাবুবু।
আমি চিঠিটা পড়ে অনেকক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। মনটা বড় খারাপ হয়ে গেল, সবকিছু অর্থহীন হয়ে গেল হঠাৎ। বাবা মারা যাবেন? তাহলে আমার আর থাকবে কে? বিছানায় মাথাওঁজে আমি ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেললাম।
টুকুনজিল আমাকে ডাকল, বিলু।
কি?
তোমার কী হয়েছে, বিলু?
মন-খারাপ?
হ্যাঁ। অনেক মন-খারাপ?
হ্যাঁ টুকুনজিল, আমার অনেক মন-খারাপ। আমার বাবার নাকি অনেক শরীর খারাপ। রাঙাবুবু লিখেছে, বাবা নাকি মরে যাবেন।
আমি আবার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। টুকুনজিল বলল, তুমি কেঁদো না বিলু, তুমি যখন অনেক মন-খারাপ করে কাঁদতে শুরু কর, তখন তোমার মস্তিষ্কের কম্পনে চতুর্থ মাত্রার একটা অপবর্তন শুরু হয়; সেটা ভালো না। নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় তখন।
আমি চোখ মুছে বললাম, ঠিক আছে, আমি আর কাঁদব না।
এখন তুমি কী করবে?
আমি বাড়ি যাব এক্ষুণি। ট্রেন ছাড়বে কখন কে জানে। ট্রেন না থাকলে বাসে যাব।
তোমাকে আমি তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাব?
পারবে নিতে? পারবে?
কেন পারব না।
কেমন করে নেবে?
আকাশে উড়িয়ে নিয়ে যাব।
সত্যি? কতক্ষণ লাগবে যেতে?
দেখতে দেখতে পৌঁছে যাবে তুমি।
চল তাহলে যাই। চল। চল এক্ষুণি চল।
যাওয়ার আগে ছোট খালাকে বলে যেতে হবে। রান্নাঘরে কী কাজ করছিলেন, গিয়ে বললাম, ছোট খালা, আমার বাবার খুব অসুখ। আমি বাড়ি যাব।
ছোট খালা অবাক হওয়ার ভান করলেন, বললেন, কি অসুখ?
জানি না।
ঠিক আছে, বাড়ি যেতে চাইলে যাবি। তোর খালু আসুক।
আমি এখনই বাড়ি যাব।
এখন কেমন করে যাবি? ট্রেনের সময় দেখতে হবে না? ছোট খালা আমাকে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়ে আবার নিজের কাজে মন দিলেন। ছোট খালার সাথে আর কথা বলার চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি আমার ঘরে এসে একটা কাগজে একটা ছোট চিঠি লিখলাম।
ছোট খালা ও খালু :
রাঙাবুবু লিখেছে, বাবার খুব শরীর খারাপ। আমি তাই বাড়ি চলে গেলাম। আমার জন্যে আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না। আমি ঠিকভাবে বাড়ি পৌঁছে যাব।
ইতি বিলু।
একটু ভেবে নিচে লিখলাম,
পুনঃ আমি এখন থেকে বাড়ি থেকেই পড়াশোনা করব। আমার জন্যে আপনাদের অনেক ঝামেলা হল।
চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে আমি চুপি চুপি ছাদে চলে এলাম।
ভরা-দুপুর এখন। রাস্তায় রিকশা যাচ্ছে, মানুষজন হাঁটাহাঁটি করছে। পাশের ছাদে এক জন কাপড় নেড়ে দিচ্ছে। কার্নিশে দুটো শালিখ প্রচও ঝগড়া করছে কী-একটা নিয়ে। আমি তার মাঝে টুকুনজিলকে বললাম, টুকুনজিল।
বল।
চল যাই। কোথায় যেতে হবে তোমাকে বলে দিই।
আমি জানি।
জান! আমি অবাক হয়ে বললাম, কেমন করে জান?
তুমি যা জান আমি তাই জানি। আমি তোমার মস্তিষ্কের মাঝে দু’বেলা ঘুরে বেড়াই। হা হা হা।
তুমি আমার বাড়ি গিয়েছ?
হ্যাঁ।
বাবাকে দেখেছ?
কেমন আছে বাবা? কেমন আছে?
টুকুনজিল রহস্য করে বলল, চল, গেলেই দেখবে।
বল না, এখন বল।
উঁহু। তুমি প্রস্তুত?
হ্যাঁ।
চল আমরা আকাশে উড়ে যাই!
পরমুহূর্তে আমি বাতাসে ভেসে উপরে উঠে গেলাম। আমার সমস্ত শরীর যেন পাখির পালকের মতো হালকা। প্রথম কয়েক মুহূর্ত ভয়ের চোটে আমি প্রায় নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেলাম, মনে হতে থাকল এই বুঝি পড়ে গেলাম আকাশ থেকে, হাড়গোড় ভেঙে ছাতু হয়ে গেলাম জনের মতো।
কিন্তু আমি পড়ে গেলাম না, বাতাসে ভেসে আরো উপরে উঠে গেলাম। ভেবেছিলাম নিচে থেকে একটা রৈরৈ রব উঠবে, লোকজন চিৎকার করে কেলেঙ্কারি শুরু করে দেবে, কিন্তু কী আশ্চর্য, একটি মানুষও লক্ষ করল না। কেউ যেটা কখনো আশা করে না, সেটা দেখার চেষ্টাও করে না, তাই খোলা আকাশে আমি নির্বিঘ্নে পাখির মতো উড়ে গেলাম।
আমার মিনিটখানেক লাগল ব্যাপারটায় অভ্যস্ত হতে। তখন আমি আস্তে আস্তে একটু একটু হাত-পা নাড়তে শুরু করলাম। পানিতে মানুষ যেরকম করে সাঁতার কাটে অনেকটা সেভাবে। আমার মনে হতে লাগল আমি নীল গাঙে সাঁতার কেটে যাচ্ছি। একটু অভ্যাস হবার পর আমি একটা ডিগবাজি দিলাম বাতাসে, ঘুরপাক খেলাম কয়েকবার, তারপর চিলের মতো দু’হাত মেলে উড়ে যেতে থাকলাম আকাশে।
কী মজা উড়তে, টুকুনজিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, তুমি তো জান। তুমি তো উড়ে বেড়াও।
হ্যাঁ, আমি নিজে তো উড়তে পারি না, আমার মহাকাশযানে করে আমি উড়ে বেড়াই।
প্লেনের মতন?
অনেকটা সেরকম, কিন্তু তার থেকে অনেক সাবলীল। প্লেনের আকাশে ওড়ার জন্যে রানওয়ে লাগে, নামার জন্যেও রানওয়ে লাগে। তা ছাড়া যখন যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে যেতে পারে না, এক জায়গায় দাঁড়িয়েও থাকতে পারে না। আমার মহাকাশযান তা পারে। তা ছাড়া আমি অসম্ভব দ্রুত যেতে পারি। এত দ্রুত যে ভূমি চিন্তাও করতে পারবে না।
হ্যাঁ। কার্লোস তোমাকে এভাবে ধরতে চেয়েছিল। ধরে বুঝতে চেয়েছিল তুমি কী ভাবে সেটা কর।
হ্যাঁ। কিন্তু জ্ঞানের মাঝে কোনো শর্টকাট নেই! আমি যদি পৃথিবীর মানুষকে তাদের অজানা কিছু বলে দিই, তাহলে সেটা তো আর জ্ঞান হল না, সেটা হল ম্যাজিক। সেই ম্যাজিক পৃথিবীর মানুষ নিয়ন্ত্রণ করবে কেমন করে? অনেকটা হবে তোমাদের গল্পের দৈত্যকে বশ করার মতো। একটু যদি ভুল হয়, তাহলে উল্টো সেই দৈত্য তোমাকে ধ্বংস করে ফলবে।
তা ঠিক।
আমি একটা মেঘের মাঝে ঢুকে যাচ্ছিলাম, ভিজে কুয়াশার মতো মেঘ। মেঘ থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা টুকুনজিল, আমি এইভাবে উড়ছি কেমন করে? তুমি ঠিক কী ভাবে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছ?
তোমার ভাষায় বলা যায় আমি তোমাকে ঘাড়ে করে নিয়ে উড়ে যাচ্ছি। কিন্তু যেহেতু আমি খুব ছোট, তাই তোমার শরীরের এক জায়গায় ধরে না রেখে শরীরের তিন হাজার দু’ শ’ নয়টি ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুতে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। আমি খুব দ্রুত যেতে পারি, কাজেই সেটা কোনো সমস্যা নয়। নিচে থেকে তোমাকে উপরে ধরে রেখেছি, তুমি টের পাচ্ছ না, কারণ এক-একটা বিন্দুতে আমি এক আউন্স থেকেও কম চাপ দিচ্ছি।
টুকুনজিল একটু থেমে বলল, একটা প্লেন আসছে।
আমি ভয় পেয়ে বললাম, আমাকে ধরতে?
না। যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে। দেখতে চাও?
কোনো ভয় নেই?
না। অনেক নিচে দিয়ে যাচ্ছে, তোমার নিঃশ্বাস নিতেও কোনো অসুবিধে হবে না। গতিবেগ একটু বেশি, তাই তোমাকে ঘিরে কোনো ধরনের একটা বলয় তৈরি করে দিতে হবে।
পারবে করতে?
পারব। হ্যাঁ, চল যাই।
আমি হাত দুটি উঁচু করলাম, মানুষ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যেভাবে। সোজা উপরে উঠে ডান দিকে ঘুরে গেলাম পাখির মতো।
প্লেনটা বেশি বড় না। পাখার দু’পাশে দুটি প্রপেলার প্রচণ্ড শব্দ করে ঘুরছে। প্লেন যে এত শব্দ করে আমি জানতাম না, প্রথমে খানিকক্ষণ কানে হাত দিয়ে থাকতে হল, একটু পর অবশ্যি শব্দটা অভ্যেস হয়ে গেল, হতে পারে টুকুনজিল কিছু-একটা করে দিল যেন শব্দটা শুনতে না হয়। টুকুনজিলের অসাধ্য কিছু নেই। আমি প্লেনের পাশে পাশে উড়তে উড়তে সাবধানে একটা পাখার উপর দাঁড়ালাম। বাতাসে আমার চুল উড়ছে, মেঘের মাঝে উড়ে যাচ্ছি আমি, কী যে চমৎকার লাগছে তা আর বলার নয়।
প্লেনের গোল গোল জানালা দিয়ে মানুষজন অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, কেউ নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না, চোখ বিস্ফারিত, মুখ হাঁ করে খুলে আছে। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়লাম, সবাই এত হতবাক হয়ে গেছে যে, কেউ হাত নেড়ে আমাকে উত্তর দিল না। শুধু একটা ছোট বাচ্চা খুশিতে। হেসে আমার দিকে হাত নাড়তে শুরু করল। আমি বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে হাসলাম, তারপর আবার হাত নাড়লাম, বাচ্চাটা আরো জোরে হাত নেড়ে লাফাতে শুরু করল। এবারে বাচ্চাটার দেখাদেখি আরো কয়েকজন হাত নাড়ল আমার দিকে।
টুকুনজিল বলল, চল ফিরে যাই!
চল।
আমি দুই হাত উপরে তুলে একটা ডিগবাজি দিলাম বাতাসে। তারপর দু হাত দু পাশে ছড়িয়ে প্লেনের মতো উড়ে গেলাম ডানদিকে। ঘুরে একবার পিছনে তাকালাম আমি, প্লেনের সব মানুষ এবারে পাগলের মতো হাত নাড়ছে আমার দিকে তাকিয়ে। আমি শেষবারের মতো হাত নেড়ে নিচে নামতে শুরু করলাম। অনেক দিন মনে রাখবে সবাই পুরো ব্যাপারটা।
নিচে নামাতে নামাতে টুকুনজিল আমাকে একেবারে মাটির কাছাকাছি নামিয়ে আনল। ধানক্ষেত, নদী, নৌকা, ছোট ঘোট বন-জঙ্গল, কী চমৎকার দেখায় উপর থেকে। আমি পাখির মতো উড়ে যাচ্ছি বাতাসে, আর নিচে মাঝিরা নৌকা বেয়ে যাচ্ছে, চাষীরা কাজ করছে মাঠে, বৌ-ঝিরা কলসি নিয়ে পানি আনছে পুকুর থেকে, মাঠে খেলছে বাচ্চারা।
মজার ব্যাপার হল, কেউ আমাকে খেয়াল করে দেখছে না। মানুষের মনে হয় দরকার না হলে উপরের দিকে তাকায় না। কেন তাকাবে, যা কিছু দরকার সবই তা নিচে মাটির সাথে। আমি এবারে আরো নিচে নেমে এলাম।
মাঠে গোল্লাছুট খেলছে বাচ্চারা, আমি একেবারে নিচে নেমে তাদের মাথার কাছ দিয়ে উড়ে আবার আকাশে উঠে গেলাম। বাচ্চাগুলো একেবারে হতবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি হাত নাড়লাম, সবাই হাত নাড়ল আমার দিকে। ছোট একটা বাচ্চা শুধু পিছনে পিছনে দুই হাত উপরে তুলে ছুটে আসতে থাকে, আমি উড়ব—আমি উড়ব–
আমার কী মনে হল জানি না, নিচে নেমে এসে বাচ্চাটার দুই হাত ধরে তাকে উপরে নিয়ে আসি। সেও ভাসতে থাকে আমার মতো, তখন সাবধানে ছেড়ে দিই তাকে। বাচ্চাটি ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে যায়, আমি উড়ে যাই সামনে। টুকুনজিলের অসাধ্য কোনো কাজ নেই।
এবারে সব বাচ্চা হাত তুলে পিছনে পিছনে ছুটতে থাকে, আমি উড়ব আমি উড়ব আমি উড়ব।
কিন্তু আমার সময় নেই, দেরি হয়ে যাচ্ছে বাড়ি পৌঁছাতে। হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় নিয়ে উড়ে উড়ে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গেলাম।
টুকুনজিল বলল, আমরা প্রায় এসে গেছি।
সত্যি? হ্যাঁ, চিনতে পারছ না?
আমি নিচে তাকালাম, ঐ তো নীল গাঙ, ঐ তো নীল গাঙের পাশে স্কুলঘর, নীলাঞ্জনা হাই স্কুল। ঐ তত বড় সড়ক। ঐ তো দূরে আমাদের বাড়ি। বাড়ির পিছনে “জঙ্গল। ঐ তো জঙ্গলের পিছনে জোড়া নারকেল গাছ। কখনো উপর থেকে দেখি নি, তাই প্রথমে চিনতে পারি নি।
আমি বললাম, টুকুনজিল, বাবাকে দেখতে পাও?
হ্যাঁ।
কোথায়?
একটা মাদারগাছের সামনে চুপ করে বসে আছেন।
কেউ কি আছে বাবার আশেপাশে?
না, নেই।
তাহলে আমাকে বাবার কাছে নামাও। ঠিক আছে।
আমি এবারে শোঁ শোঁ করে নিচে নেমে আসি। স্কুলঘরের পাশে দিয়ে উড়ে নারকেলগাছের পাশে মাদারগাছের কাছাকাছি নেমে হঠাৎ বাবাকে দেখতে পেলাম। গালে হাত দিয়ে মাদারগাছের সামনে উবু হয়ে বসে আছেন। আমি কাছাকাছি আসতেই বাবা হঠাৎ কী মনে করে ঘুরে তাকিয়ে আমাকে দেখতে পেলেন। আমি উড়ে এসে খুব ধীরে ধীরে বাবার সামনে নামলাম।
বাবা একটু হেসে বললেন, বিলু, বাবা তুই এসেছিস?
আমি যে আকাশে উড়ে এসেছি, সেটা দেখে বাবা একটুও অবাক হলেন না, মনে হল ধরেই নিয়েছেন আমি উড়ে আসব।
আমি বাবার হাত ধরে বললাম, বাবা, তোমার শরীরটা নাকি ভালো না?
কে বলেছে?
রাঙাবুবু।
রাণু? রাণুটা একেবারে বোকা। আমি একটা হাঁচি দিলেই মনে করে অনেক অসুখ!
বাবা মাদারগাছটার দিকে তাকিয়ে বললেন, যেতে হয় এখন, জনাব। ছেলেটা এসেছে এতদিন পরে, মায়ের কাছে নিয়ে যাই। বড় খুশি হবে।
আমি বাবার হাত ধরে বাড়ির ভেতরে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, রাঙাবুবু লিখেছিল তুমি একেবারে বিছানায়, তুমি তো বেশ হাঁটছ, বাবা।
আমি একেবারে বিছানাতেই ছিলাম। মনে হচ্ছিল আর বুঝি বাঁচবই না। এই ঘন্টাখানেক আগে কী হল, হঠাৎ শুনি ঝিঁঝিপোকার ডাক, মনে হল যেন বুকের মাঝে কে জানি চিমটি কাটল। তারপর তুই বিশ্বাস করবি না, হঠাৎ মনে হল শরীরটা অনেক ঝরঝরে হয়ে গেছে। তুই আসবি বলেই মনে হয়!
টুকুনজিল। আমি বুঝে গেলাম বাবা কেমন করে হঠাৎ ভালো হয়ে গেছেন। টুকুনজিল বাবাকে ভালো করে দিয়েছে। নিশ্চয়ই তাই। সে জন্যে আমার সাথে রহস্য করছিল, বাবার কথা বলছিল না। আমি টুকুনজিলকে ডাকলাম কয়েকবার, নেই ধারেকাছে। কে জানে আবার চট করে মঙ্গল গ্রহটা দেখতে গেছে কি না?
বাড়ির উঠানে আসতেই লাবু আমাদের দেখে ফেলল, তারপর চিৎকার করতে করতে বাড়ির ভেতরে ঢুকে গেল। এক সেকেন্ডের মাঝে বাড়ির ভেতর থেকে সবাই বের হয়ে এল, মা, রাঙাবৰ, বড়, বড়বুবুর ছোট ছেলেটা সবাই। মা ছুটে এসে আমাকে একেবারে বুকে চেপে ধরলেন, বললেন, ইস, শরীরটা একেবারে শুকিয়ে গেছে।
রাঙাবুবু বলল, বিলু, তুই এখন কেমন করে এলি? ট্রেন তো আসবে সন্ধ্যেবেলা! বাবা বললেন, উড়ে এসেছে। রাঙাবুবু চোখ পাকিয়ে বলল, উড়ে এসেছে?
হ্যাঁ। কী সুন্দর উড়তে শিখেছে বিলু! একেবারে পাখির মতো দেখলে অবাক হয়ে যাবি।
পাখির মতো?
হ্যাঁ, একেবারে পাখির মতো উড়তে পারে। বাবা ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বিলু, একটু উড়ে দেখাবি এখন?
মা ধমক দিলেন বাবাকে, চুপ করেন তো আপনি।
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হেসে বললেন, দেখলি বিলু, আমার কথা কেউ বিশ্বাস করে না। তুই চলে যাবার পর আমার আর কথা বলার মানুষ নেই।
মা বললেন, বিলু বাবা যা, হাত-পা ধুয়ে আয়, খাবি।
আমি একটা গামছা নিয়ে বের হয়ে গেলাম, কে জানে কলতলায় দুলালকে পেয়ে যাব কি না, আমাকে দেখে কী অবাক হয়ে যাবে! হঠাৎ টুকুনজিলের কথা শুনতে পেলাম, বিলু? তুমি এখান থেকে চলে গিয়েছিলে কেন? এরা সবাই তোমাকে কী অসম্ভব ভালবাসে। তরঙ্গ কম্পন চার দশমিক সাতের মাঝে–
ভালবাসবে না কেন? আমার মা-বাবা ভাই-বোন—
তাহলে তুমি চলে গেলে কেন?
এই তো ফিরে এসেছি, আর যাব না।
হ্যাঁ, যেও না।
টুকুনজিল, আমি একটু আগে তোমাকে ডেকে পাই নি।
আমার মহাকাশযানটার কিছু জিনিস ঠিক করতে হল।
ঠিক হয়েছে?
হ্যাঁ।
টুকুনজিল, তুমি বাবার শরীর ঠিক করে দিয়েছ, তাই না?
পুরোপুরি ঠিক করি নি, হৃৎপিণ্ডের একটা ধমনীতে কিছু সমস্যা ছিল, সেটা ঠিক করে দিয়েছি। তুমি কি চাও অনা সমস্যাগুলোও সারিয়ে দিই?
হ্যাঁ হ্যাঁ হ্যাঁ, পারবে তুমি? মাথা-খারাপটা সারিয়ে দিতে পারবে?
মাথা-খারাপ? তোমার বাবার মাথা খারাপ?
হ্যাঁ। দেখ না, গাছপালা, পশুপাখির সাথে কথা বলেন?
সেটা কি মাথা-খারাপ? পশুপাখিরা তো খুব নিম্ন বুদ্ধিবৃত্তির প্রাণী, কিন্তু তারাও তো চিন্তা করে, নিজেদের নিম্ন বুদ্ধিবৃত্তির চিন্তা। তোমার বাবা সেটা হয়তো অনুভব করতে পারেন। আমি যেরকম করি। এটা একটা ক্ষমতা–
কচু ক্ষমতা। দরকার নেই এই ক্ষমতার। তুমি বাবাকে ভালো করে দাও।
ঠিক আছে, যাবার আগে তোমার বাবাকে ভালো করে দেব।
যাবার আগে? কোথায় যাবার আগে?
আজকে আমার ফিরে যেতে হবে, মনে নেই?
তাই তো! টুকুনজিল, তুমি চলে যাবে?
হ্যাঁ, বিলু।
আমার মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল।