১৫. পোয়ারোর পরামর্শ
ডঃ রেলি তার আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। সবাই চলে যাবার পর অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন তিনি। তারপর পোয়ারোর দিকে চকিতে একবার তাকালেন, ইশারায় তাদের মধ্যে কি কথা হল কে জানে, তবে পরমুহূর্তে ডঃ রেলিকে কোর্টইয়ার্ডের দিকের জানালাটা বন্ধ করতে দেখা গেল। তারপর তিনি তার আসনে আবার ফিরে এলেন।
চমৎকার! পোয়ারোর কথায় খুশির আমেজ, আমরা এখন এক গোপন আড্ডা গড়ে তুলেছি। কেউ আমাদের বিরক্ত করতে আসবে না এখানে। আমরা এখন স্বাধীন ভাবে কথা বলতে পারি। এক্সপিডিসনের সদস্যরা কে কি বলেছে, তা আমরা ইতিমধ্যে শুনেছি। কিন্তু ও হ্যাঁ, সে যাইহোক, মাদাম বলুন, এ কেসের ব্যাপারে আপনি কী ভাবছেন? আপনার কী চিন্তা ভাবনা দয়া করে আমাদের বলুন!
পোয়ারোর কথায় আমার সারা মুখ লজ্জায় লাল হয়ে উঠল। এখন আর অস্বীকার করবার উপায় নেই, পোয়ারো ছোট-খাটো বেঁটে লোক হলে হবে কি তার চোখ দুটো বড় তীক্ষ্ণ, বড় কৌতূহলোদ্দীপক! মনে হয়, আমি তার চোখে ধরা পড়ে গেছি, আমার ভাবনার কথা তিনি জেনে গেছেন।
ও কিছু নয়, উত্তরে আমি বললাম।
এবার তুমি নির্ভয়ে মুখ খুলতে পার নার্স, ডঃ রেলি তাড়া দেন, বিশেষজ্ঞদের অযথা দাঁড় করিয়ে রেখো না।
সত্যি বলছি, ও কিছু নয়, আমি তাড়াতাড়ি বললাম, এমনি কথাটা আমার মনে হঠাৎ উদয় হল, তাই বলছিলাম। ধরা যাক, কেউ হয়তো জানেন কিংবা সন্দেহ করেন কাউকে মিসেস লিডনারের খুনী হিসাবে, কিন্তু প্রকাশ্যে বিশেষ করে ডঃ লিডনারের সামনে তার পক্ষে কথাটা প্রকাশ করা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। আশ্চর্য, আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো আমার সমর্থনে মাথা নাড়লেন।
কথাটা একেবারে খাঁটি সত্যি। ওঁদের সঙ্গে আলোচনার মাঝেও আপনি এ কথাটাই বলেছিলেন। ভাবছেন হয়তো, তবু কেন আলাদা করে আপনাকে আমাদের ব্যক্তিগত আলোচনার মধ্যে রেখে দিলাম? তবে কী একটু আগের আলোচ্য সভার কোন অর্থ নেই? না, ঠিক তা নয়। একটু আগে যে ছোট খাট জমায়েত এখানে হয়ে গেল, তারও প্রয়োজন ছিল বৈকি, সেটা বর্তমান কেসের ব্যাপারে সুদূরপ্রসারী যে হতে পারে, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। কেন নেই, তার ব্যাখ্যা আমি করছি। আপনার নিশ্চয়ই খেয়াল আছে, ইংলন্ডের রেসের মাঠে ঘোড়দৌড় শুরু হবার আগে প্রতিযোগী ঘোড়াদের একটা প্যারেড হয়ে থাকে। গ্র্যান্ডস্ট্যান্ডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারা, যাতে করে সবার পক্ষে তাদের দেখবার এবং বিচার করবার সুযোগ পাওয়া যায়। এই ছোট খাট জমায়েতের এটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। খেলোয়াড়ী দৃষ্টি নিয়ে আমি সম্ভাব্য স্টার্টারদের নিরীক্ষণ করেছি।
ডঃ লিডনার প্রবলভাবে আপত্তি জানালেন, আমার এই এক্সপিডিসনের কোন সদস্য বা সদস্যা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত আছে বলে আমি আদৌ বিশ্বাস করি না।
তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে আমার সমর্থন লাভের আশায় বললেন, নার্স, তুমি যদি মঁসিয়ে পোয়ারোকে বুঝিয়ে বল আমার স্ত্রীর সঙ্গে গত দুদিন থাকার সময় কি কি তোমার নজরে পড়েছিল, কিংবা তোমাদের দুজনের মধ্যে কী আলোচনা হয়েছিল আমি তাহলে বাধিত হব এই কারণে যে, বুঝতে পারব প্রকৃত তথ্য আমরা তুলে ধরতে পেরেছি ওঁর কাছে।
ডঃ লিডনারের অনুরোধ আমি প্রত্যাখ্যান করতে পারলাম না। তবে আমি যেটুকু জেনেছি তার থেকে বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে বলবার প্রয়োজন মনে করলাম না। এমন কি মিসেস লিডনার যে সব কথাগুলো ব্যবহার করেছিলেন, ঠিক সেই কথাগুলোই আমার বক্তব্যে স্থান দিলাম। আমার মনে হল, এই মুহূর্তে মিসেস লিডনার যেন আমার উপরে ভর করেছেন।
আমার বলা শেষ হতেই মঁসিয়ে পোয়ারো বলে উঠলেন, খুব ভাল, খুব ভাল। দেখছি আপনার সব ঠিক মনে আছে। আমার ধারণা, এখানে আপনি আমার অনেক কাজে লাগতে পারেন।
তারপর তিনি ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে বললেন, চিঠিগুলো আপনার কাছে আছে?
হ্যাঁ। চিঠিগুলো আমি সঙ্গে নিয়েই এসেছি। আমার অনুমানই ঠিক ভেবেছিলাম প্রথমেই আপনি চিঠিগুলো দেখতে চাইবেন।
তাঁর হাত থেকে নিয়ে পোয়ারো পড়তে শুরু করে দিলেন এবং তার অভ্যাস মত খুব সতর্কতার সঙ্গে চিঠিগুলো পড়লেন। কিন্তু তার একটা কাজের ব্যাপারে আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। আমি লক্ষ্য করলাম, চিঠিগুলোর উপরে গুঁড়ো পাউডার ব্যবহার করলেন না তিনি, এমন কি মাইক্রোস্কোপ কিংবা ওই রকম জাতীয় কিছু ব্যবহার করলেন না তিনি চিঠিগুলো পড়তে গিয়ে। সাধারণ যেমন চিঠি পড়ে থাকেন, ঠিক সেই ভাবেই চিঠিগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে গেলেন তিনি এবং চিঠিগুলো টেবিলের উপরে রেখে ডঃ লিডনারের দিকে তাকালেন।
এখন আসুন ব্যাপারটা পরিষ্কার করা যাক। দেখা যাচ্ছে, প্রথম চিঠিটা আপনার স্ত্রী পান আমেরিকায় আপনার সঙ্গে তার বিবাহের কিছু পরেই। তারপরে আরো কিছু চিঠি তিনি পান, তবে সেগুলো তিনি নষ্ট করে ফেলেন। এখানে দ্বিতীয় চিঠির তারিখ দেখে মনে হচ্ছে, এই চিঠিটা পাওয়ার কিছু দিন পরেই আপনারা দুজনেই বিষাক্ত কয়লার গ্যাসে মৃত্যু হওয়া থেকে কোন রকমে রেহাই পেয়ে যান। তারপর আপনারা এখানে এই বিদেশে চলে এলেন, এবং এই দু’বছরে কোন চিঠি আসেনি আপনাদের কাছে। এই বছরের মরশুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার আপনার স্ত্রী চিঠি পেতে থাকেন গত তিন সপ্তাহের মধ্যে। ঠিক কিনা?
হুঁ।
আপনার স্ত্রী হাবভাবে বুঝিয়ে দেন তার মনের আকাশে একটা দারুণ আতঙ্কের মেঘ জমে উঠেছে। স্ত্রীর অমন অবস্থায় ডঃ রেলির পরামর্শ মত নার্স লিথেরানকে নিয়োগ করেন আপনার স্ত্রীকে সঙ্গ দেবার জন্য, যাতে করে তার ভয়টা কেটে যায়। তাই না?
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
ইতিমধ্যে কয়েকটা অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা ঘটে যায়, যেমন মিসেস লিডনারের ঘরের জানালায় নক্ করার শব্দ, ভুতুড়ে মুখের আবির্ভাব, অ্যান্টিকরুম থেকে ভুতুড়ে শব্দ ভেসে আসা। এ সব কী আপনার চোখে পড়েনি?
না।
তাহলে এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে মিসেস লিডনার ছাড়া অন্য আর কেউ বিন্দুবিসর্গ জানেন না।
ঠিক তা নয়, ডঃ লিডনার স্মরণ করিয়ে দেন, ফাদার ল্যাভিগনি অ্যান্টিকরুমে আলো দেখতে পেয়েছিলেন, সে কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
হ্যাঁ, আমি তা ভুলিনি।
পোয়ারো মিনিট দুই কি যেন চিন্তা করলেন, তারপর কি ভেবে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার স্ত্রী কি কোন উইল করে গেছেন?
না, আমার তা মনে হয় না।
কেন! তিনি ধনবতী ছিলেন না?
হ্যাঁ, ছিলেন বৈকি, জীবিত অবস্থায় কেবল। ওর বাবা ওর জন্য একটি ট্রাস্টের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ গচ্ছিত রেখে যান। তবে আসল টাকায় হাত দিতে পারত না ও। ওর মৃত্যুর পর ওর কোন ছেলে-মেয়ে থাকলে সেই ট্রাস্ট্রের টাকা তার প্রাপ্ত হত, আর অপুত্রক হলে পুরো টাকাটাই পিটস্টাউন মিউজিয়ামের অধিকারে চলে যাওয়ার কথা।
টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে পোয়ারো নিজেকে চিন্তায় মনোনিবেশ করলেন।
তাহলে এক্ষেত্রে আমরা একটা মোটিভ সযত্নে দূরে সরিয়ে রাখতে পারি। সেই মোটিভটা যে কি আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। মানে মিসেস লিডনারের মৃত্যুর পর কে লাভবান হচ্ছে? এক্ষেত্রে একটি মিউজিয়াম। অন্য দিকে মিসেস লিডনার যদি প্রচুর অর্থ এবং সম্পত্তি রেখে যেতেন, সেক্ষেত্রে একটি অতি প্রয়োজনীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতে আমাকে। আমাকে প্রমাণ করতে হতো সেই অর্থের অধিকারী কে হতেন? আপনি না মিসেস লিডনারের প্রাক্তন স্বামী? তবে তার প্রাক্তন স্বামীর পক্ষে দাবী প্রতিষ্ঠা করতে যাওয়া একটা বিরাট ঝামেলার ব্যাপার, কারণ সেক্ষেত্রে প্রথমেই তাকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হবে, তিনি একজন স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বলে। তবে এ অনুমান এক্ষেত্রে খাটে না দুটি কারণে; প্রথম কারণ হল মিসেস লিডনার সে রকম কোন অর্থ কিংবা সম্পত্তি রেখে যাননি। অতএব বর্তমান পরিবেশে স্ত্রীর অস্বাভাবিক মৃত্যুতে স্বামীকে সন্দেহ করাটাই স্বাভাবিক নিয়ম। এক্ষেত্রে প্রথমেই আপনি প্রমাণ রেখেছেন, গতকাল সেই দুর্ঘটনার সময় আপনি আপনার স্ত্রীর ঘরের সামনে যাননি কখনো, দ্বিতীয়ত স্ত্রীর মৃত্যুতে লাভের চেয়ে লোকসানই হয়েছে আপনার বেশি, এবং তৃতীয়ত
এখানে একটু সময়ের জন্য থামলেন তিনি।
হ্যাঁ, বলুন তারপর? ডঃ লিডনার তাড়া দিলেন।
আপনার স্বপক্ষে তিন নম্বর যুক্তি হল, পোয়রা তার কথার জের টেনে বলতে থাকেন, কথা-বার্তা শুনে আমার মনে হয়েছে, স্ত্রীকে আপনি অত্যন্ত ভালবাসতেন। এর থেকে ধরে নেওয়া যায় যে, এমন স্ত্রীবৎসল স্বামী তার স্ত্রীকে কখনোই খুন করতে পারে না, এ আমার একান্ত বিশ্বাস ডঃ লিডনার এবং এর জন্য আমি আপনার প্রশংসা না করে থাকতে পারছি না। বলুন, আমার অনুমান ঠিক কিনা?
হ্যাঁ, ডঃ লিডনারের ঠোঁটে বিনয়ের হাসি।
অতএব, পোয়ারো একটু চিন্তা করে বললেন, এই কেসের ব্যাপারে আরো একটু এগুনো যাক।
কেন, এখানে আমরা যা জেনেছি, সেটাই কি যথেষ্ট নয়? ডঃ রেলি বেশ একটু অধৈর্য হয়েই কথাটা বলে ফেললেন যেন।
পোয়ারো চকিতে তার দিকে ফিরে তাকালেন, ধৈর্য ধরুন ডঃ রেলি, এত ব্যস্ত হবেন না। অসম্পূর্ণ তদন্তে আমি বিশ্বাসী নই। শুধু এই কেসের ব্যাপারেই নয়, যে কোন কেসের ব্যাপারে তুরুপের তাস সহ সম্ভাব্য সমস্ত তাসগুলো আমি আমার টেবিলে হাজির দেখতে চাই, সে যত প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয়ই হোক না কেন। আমি চাই না একটা তাসও আমার দৃষ্টির আড়াল করে রাখা হোক।
পোয়ারোর শেষ কথায় ডঃ লিডনারকে একটু বিস্মিত বলে মনে হল।
বিশ্বাস করুন মঁসিয়ে পোয়ারো, কোন কিছুই আমি গোপন করে রাখিনি। যতটুকু জানি, সব আপনাকে বলেছি। আমার বলার আরও কিছুই অবশিষ্ট নেই।
কিন্তু আমি যদি বলি সব কথা আপনি আমাকে বলেননি?
হ্যাঁ, অবশ্যই বলেছি। আমার মনে হয় না, কোন কথা বাদ পড়ে গেছে।
এই মুহূর্তে ডঃ লিডনারকে কেমন অসহায় বলে মনে হয়।
পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে মাথা দুলিয়ে বললেন, না, না সব কথা আপনি আমাকে খুলে বলেননি। যেমন ধরুন নার্স লিথেরানকে কেন আপনি নিয়োগ করলেন, বলেছেন সে কথা?
ডঃ লিডনারকে এখন পুরোপুরি বিধ্বস্ত বলে মনে হল। কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গীতে কোন রকমে তিনি বলেন, তবে তার ব্যাখ্যা আমি করেছি। এটা একান্ত প্রয়োজন ছিল–আমার স্ত্রী স্নায়ুর চাপে ভুগছিল, তাছাড়া ওর ভয় কাটানোর জন্য।
টেবিলের উপরে ঝুঁকে পড়লেন পোয়ারো। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পড়েছিল ডঃ লিডনারের মুখের উপরে। মনে হয় সেই ফাঁকে তিনি নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন কি ভাবে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করবেন। এ যেন প্রাক্ যুদ্ধের প্রস্তুতি।
না, না। এর পরেও এমন একটা ব্যাপার আছে, যেটা এখনো পরিষ্কার নয়। আপনার স্ত্রী বিপদের মধ্যে দিয়ে কাটাচ্ছিলেন, হ্যাঁ, কথাটা মিথ্যে নয়। আর এও সত্যি যে, তাঁকে প্রাণ নাশের ভয় দেখানো হয়েছিল। আর এ সব সত্ত্বেও পুলিশকে আপনি খবর দেন নি, এমন কি আপনি কোন প্রাইভেট ডিটেকটিভের পরামর্শ নেবারও প্রয়োজনবোধ করেননি। কিন্তু নার্সের ব্যবস্থা আপনি কেন যে করতে গেলেন, সেটা আমার বোধগম্য নয়!
আ–আ–আমি, ডঃ লিডনারের কথা জড়িয়ে যায়। তার মুখের রঙ বদলায়। আমি ভেবেছিলাম- এবার তিনি একেবারে থেমে যান।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমরা এখন সেই কথাতেই আসছি, পোয়ারো তাকে উৎসাহিত করেন, কী, কী ভেবেছিলেন আপনি– ডঃ লিডনার কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন।
ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন, আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি, আমি জানি না। আমি জানি না।
ইঁদুর ধরবার জন্য ইঁদুরের গর্তের সামনে বিড়াল যেমন, তেমনি ভাবে স্থির চোখে ডঃ লিডনারের দিকে তাকিয়ে থাকেন পোয়ারো।
তাহলে আপনি আর কী ভাবতে পারেন তখন!
আমি জানি না, বললাম তো, আমি জানি না।
কিন্তু আমি যদি বলি আপনি জানেন, এবং বেশ ভাল করেই জানেন। হয়তো এ ক্ষেত্রেও আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। ডঃ লিডনার, সত্যি করে বলুন তো, চিঠিগুলো যে আপনার স্ত্রীই নিজের হাতে লিখতেন, একথা আপনার মনে কখনো সন্দেহ হয়নি?
এরপর ডঃ লিডনারের উত্তর দেবার আর কোন প্রয়োজন নেই বলেই মনে হয়। পোয়ারোর অনুমানের মধ্যেই প্রকৃত সত্য লুকিয়েছিল বোধহয়। ডঃ লিডনার তার হাত দুটি প্রার্থনার ভঙ্গিতে যে ভাবে তুলেছিলেন, তাঁর সেই ভঙ্গিমা দেখে মনে হচ্ছিল যে, তার নিজের গল্প বলা বোধহয় এখানেই শেষ।
এবার আমি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলাম, এই প্রথম। তাহলে আমার অনুমানই ঠিক, ভাবলাম। এই প্রসঙ্গে ডঃ লিডনারের একটি প্রশ্ন আমার মনে পড়ে গেল, তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, তার স্ত্রীর প্রসঙ্গে আমার কী ধারণা? আপন খেয়ালে আমি আমার মাথাটা আস্তে আস্তে দোলাতে গিয়ে দেখি, পোয়ারোর শ্যেন দৃষ্টি নিবদ্ধ আমার উপরে।
নার্স, আপনিও তো তাই মনে করেন, কেন করেন না?
হ্যাঁ, সত্য কথা স্বীকার করতে আমার কোন দ্বিধা হয় না, কথাটা আমারও মনে হয়েছিল?
কারণ?
মিঃ কোলম্যান মিসেস লিডনারের হাতে লেখা একটা চিঠি আমাকে দেখান, সেই চিঠি এবং মিসেস লিডনারকে হুমকি দিয়ে লেখা চিঠিগুলোর মধ্যে একটা সাদৃশ্যের কথা আমি তাকে ব্যাখ্যা করে বলি।
ডঃ লিডনারের দিকে ফিরলেন পোয়ারো।
সেই সাদৃশ্য আপনি কী লক্ষ্য করেছিলেন ডঃ লিডনার?
ডঃ লিডনার মাথা নিচু করে বললেন, হ্যাঁ, শুধু একটা নয়, অনেক, অনেক সাদৃশ্য আমি লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে এস, ই অক্ষরগুলো দেখলে মনে হয় সেই চিঠিগুলোর হাতের লেখার সঙ্গে আমার স্ত্রীর হাতের লেখার মধ্যে কোন তফাত নেই; হুবহু এক। তবে আমি হস্তরেখা বিশারদ নই যে জোর করে আমার নিজস্ব ধারণা অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে দেব। কিন্তু একটা কথা আমি বলতে পারি যে, সব চিঠিগুলো একই লোকের লেখা। এই
অনিশ্চিত সম্ভাবনার কথা আমাদের মনে অবশ্যই ঠাই দিতে হবে।
তারপর পোয়ারো তার চেয়ারে হেলান দিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথায় চিন্তার ছোঁওয়া স্পষ্ট। এ প্রসঙ্গে আমার তিনটি সম্ভাবনার কথা মনে পড়ে যায়। প্রথমত, হাতের লেখার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়াটা যুক্তিসঙ্গত। দ্বিতীয়ত, এই হুমকি দিয়ে চিঠি লেখার পিছনে মিসেস লিডনারের মধ্যে এক দুর্বোধ্য মানসিকতার কারণ আমরা দেখতে পাই। তৃতীয় সম্ভাবনা হল, চিঠিগুলো কেউ হয়তো উদ্দেশ্যমূলক ভাবে মিসেস লিডনারের হাতের লেখা নকল করে লিখে থাকবে। কিন্তু কেন? এর মধ্যে কোন যুক্তি অবশ্য পাওয়া যায় না। যাইহোক, এই তিনটি সম্ভাবনার মধ্যে একটি অবশ্যই ঠিক এবং নির্ভুল।
পোয়ারো কিছুক্ষণের জন্য আমাদের মুখের উপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। তারপর ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা ডঃ লিডনার, প্রথম যখন আপনার মনে হল, সেই চিঠিগুলোর লেখিকা মিসেস লিডনার নিজেই, তখন আপনার মনে কী রকম প্রতিক্রিয়া হল বলুন?
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেই অনুমানটা আমি আমার মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিই। কারণ আমার মনে হয়েছিল, আমি যা ভাবছি সেটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক।
এর কারণ কি আপনি কখনও খুঁজে দেখেছেন?
হ্যাঁ, দেখেছি বৈকি! ডঃ লিডনার একটু ইতস্ততঃ করে বলেন, ইদানিং আমার স্ত্রীর কথাবার্তা শুনে আমার কেন জানি না মনে হয়েছিল, অত্যাধিক মানসিক চাপে এবং অহেতুক চিন্তা-ভাবনার জন্য হয়তো ও ওর মনের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে থাকবে সাময়িকভাবে এবং আমার ধারণা সেই সময় –হ্যাঁ, সেই সময়ের মধ্যেই তিনি লিখে থাকবেন। তখন তিনি আর তার মধ্যে ছিলেন না। সম্পূর্ণ অবচেতন মনে লেখা সেই চিঠিগুলো। এটাই সম্ভব তাই না? ডঃ রেলির দিকে ফিরলেন তিনি তার সমর্থন আদায় করার জন্য।
মানুষের মন হেন কাজ নেই যে করতে পারে না। ডঃ রেলি স্পষ্ট করে কিছু বলতে চাইলেন না।
চিঠিগুলোর মধ্যে খুবই গুরুত্ব আছে। তবে সামগ্রিক ভাবে কেসটার উপরে আমাদের আরও বেশি করে মনোযোগ দিতে হবে। আমার মনে হয় এক্ষেত্রে তিনটি সমাধানের পথ আছে। পোয়ারো তার সুচিন্তিত মতামত জানালেন।
তিনটি?
হ্যাঁ, প্রথম সমাধান খুবই সহজ। আপনার স্ত্রীর প্রথম স্বামী এখনো জীবিত। প্রথমে তিনি আপনার স্ত্রীকে হুমকি এবং পরে তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়ে চলেন একের পর এক। এই সহজ সরল সমাধানের পথটা বেছে নিলে আমাদের সমস্যা হবে খুঁজে দেখা, কি করে তিনি এখানে প্রবেশ করলেন, আর কি ভাবেই বা বেরিয়ে গেলেন কাউকে দেখা না দিয়ে?
দ্বিতীয় সমাধান হল : মিসেস লিডনার নিজেই, কী কারণে কে জানে (এ ক্ষেত্রে সাধারণ লোকের চেয়ে চিকিৎসাবিদ্ৰা বোধহয় সঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবেন) সেই হুমকি দেওয়া চিঠিগুলো লিখতেন। গ্যাস প্রয়োগের প্রসঙ্গে স্মরণ রাখতে হবে তিনি একাই সেই গ্যাসের ঘ্রাণ পেয়েছিলেন তাঁর কথায় আপনি সায় দিয়েছিলেন মাত্র। কিন্তু মিসেস লিডনার যদি নিজেই চিঠিগুলো লিখে থাকেন, সেক্ষেত্রে তার বিপদের সম্ভাবনা কি করে থাকতে পারে? অতএব খুনীর সন্ধানে আমাদের অন্য পথে উঁকি মারতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, এক্ষেত্রে আপনার স্টাফদের মধ্যে অনুসন্ধান চালাতে হবে। হ্যাঁ, ডঃ লিডনারের চাপা প্রতিবাদকে অস্বীকার করে পোয়ারো বলতে থাকেন, যুক্তি-তর্কের দিক থেকে–সেটাই একমাত্র সমাধানের পথ বলে মনে হয়। যে তাদের মধ্যে কেউ একজন ব্যক্তিগত আক্রোশ চরিতার্থ করার জন্য মিসেস লিডনারকে খুন করে থাকবে। আর সেই ব্যক্তি মনে হয়, চিঠিগুলো সম্বন্ধে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিল এবং সেই চিঠিগুলোর ব্যাপারে মিসেস লিডনারের যে ভয় ছিল, কিম্বা ভয়ের ভান করতেন, সেটা তার জানা ছিল। খুনীর মতে সেই তথ্যটা তার পক্ষে নিরাপদে থাকাটা একটা বিশেষ সহায়ক। সে ভেবেছিল, খুনের দায়টা সে বাইরের পত্র লেখকের ঘাড়ে সহজেই চাপিয়ে দেওয়া যাবে এই ভাবে।
এই সব বিভিন্ন সমাধানের সূত্রগুলো একত্রিত করলে দেখা যায়, প্রকৃতপক্ষে খুনী নিজের ওই চিঠিগুলো লিখেছিল মিসেস লিডনারের অতীত ইতিহাস জেনে। কিন্তু এক্ষেত্রেও ভাববার আছে, অপরাধী কেন মিসেস লিডনারের হাতের লেখা নকল করতে গেল? এই ব্যাপারটা এখনো খুব পরিষ্কার নয়। বাইরের কারোর হাতের লেখা হলে এতো চিন্তার প্রয়োজন থাকতো না এবং সেক্ষেত্রে খুনীর বাড়তি সুবিধাও হত। আমাদের সন্দেহ গিয়ে পড়তো বাইরের লোকের উপরে।
তৃতীয় সমাধানের সূত্র আমার মতে সব চেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। আমার ধারণা চিঠিগুলো নির্ভেজাল এবং সেই চিঠিগুলো লেখা হয় তো মিসেস লিডনারের প্রাক্তন স্বামী (কিম্বা তার ছোট ভাইয়ের), যিনি প্রকৃতপক্ষে এই এক্সপিডিসনের একজন সদস্য।
.
১৬.
রহস্যময়
ডঃ লিডনার কথাটা শোনামাত্র লাফিয়ে উঠলেন।
অসম্ভব! এ একেবারে অবাস্তব ধারণা!
মিঃ পোয়ারো শান্ত চোখে তাকালেন তার দিকে, কিন্তু কিছুই বললেন না।
তার মানে আপনি বিশ্বাস করতে বলছেন, আমার স্ত্রীর প্রাক্তন স্বামী আমাদের এই এক্সপিডিসনের একজন কর্মী এবং আমার স্ত্রী তাকে চিনতে পারেনি?
হ্যাঁ, ঠিক তাই। অতীতের দিকে একবার ফিরে তাকান। বছর পনের আগে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আপনার স্ত্রী কয়েক মাস বসবাস করেছিলেন। আপনি কী মনে করেন দীর্ঘ পনের বছর পরে আপনার স্ত্রী তাকে চিনতে পারবেন? আমার তো তা মনে হয় না। ভদ্রলোকের মুখের আদল বদলে যেতে পারে, চেহারার বদল হতে পারে। আর মনে রাখবেন, মিসেস লিডনার তার প্রাক্তন স্বামীকে খুঁজব মনে করে কখনো চেষ্টা চালান নি। মিসেস লিডনার তাকে আগন্তুক হিসাবেই গ্রহণ করে থাকবেন হয়তো। না, আমার তো মনে হয় না, তিনি তার প্রাক্তন স্বামীকে চিনতে পেরেছিলেন। আর দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল, তার প্রাক্তন স্বামীর ছোট ভাই, ছেলেবেলায় যে তার ভায়ের প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিল। এখন তার বয়স বেড়েছে, এখন সে রীতিমত সাবালক। সেদিনকার দশ বার বছরের বালক আজ তিরিশোর্ধ যুবক, আপনার স্ত্রী কী তাঁকে চিনতে পেরেছিলেন, না পারা সম্ভব? যুবক উইলিয়াম বসনারকে বিশ্বাসঘাতক বলা যায় না বরং তাকে দেশপ্রেমিক বলা যেতে পারে। সে তার দেশ জার্মানির জন্য প্রাণ দিতে পারে। তার চোখে মিসেস লিডনার ছিলেন একজন বিশ্বাসঘাতক, সে জানত তার দাদার মৃত্যুর জন্য মিসেস লিডনারই দায়ী। শিশুদের মনে কারোর সম্বন্ধে একবার বিরূপ প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তা আর থামতে চায় না। তারা তখন মরীয়া হয়ে ওঠে প্রতিহিংসা নেবার জন্য। আহত বাঘের মতো শিকারের খোঁজে তারা তখন সাংঘাতিক বেপরোয়া।
খাঁটি কথা, ডঃ রেলি তার মতামত জানাতে গিয়ে বলেন, সাধারণ মানুষের মতামত হল, শিশুরা খুব তাড়াতাড়ি সব কথা ভুলে যায়, এটা ঠিক নয়। আসলে তাদের সব কিছু ঠিক ঠিক মনে থাকে। প্রতিবাদ করার জন্য তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকে।
তার মনে আপনি বলছেন, এখানে দুটি সম্ভাবনা বর্তমান। ফ্রেডরিক বসনার, এখন যার বয়স পঞ্চাশ, এবং ইউলিয়াম বসনার, তিরিশোর্ধ বয়স যার। সম্ভাব্য এই দুই ব্যক্তির কথা খেয়াল রেখে এবার আপনার কর্মচারীদের মধ্যে অনুসন্ধান করে দেখা যাক।
বিচিত্র! ডঃ লিডনার বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, আপনার কর্মচারী! আমার নিজের এক্সপিডিসনের সদস্যদের সন্দেহ করব?
–নিশ্চয়ই! প্রত্যুত্তরে পোয়ারো বলেন, কে বলতে পারে, তাদের মধ্যে ফ্রেডরিক কিম্বা উইলিয়াম লুকিয়ে নেই?।
তাহলে মহিলারা বাদ?
হ্যাঁ, আপাততঃ ওদের দূরে সরিয়ে রাখা যায়। মিস জনসন এবং মিসেস মারকাডোকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আর কে হতে পারে?
ক্যারি? আমি এবং সে দীর্ঘদিন ধরে এক সঙ্গে কাজ করেছি, এমন কি লুসির সঙ্গে দেখা হওয়ার অনেক আগে থেকে তার সঙ্গে আমার–
তাছাড়া তার বয়সেরও অমিল। আমার মনে হয়, তার বয়স আটত্রিশ কি ঊনত্রিশ, ফ্রেডরিকের থেকে অনেক ছোট, আর উইলিয়ামের থেকে অনেক বেশি বয়স তার। এখন যারা বাকি, তাদের দেখতে হবে। ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিঃ মারকাডো। এঁদের দুজনের মধ্যে যে কেউ একজন নিশ্চয়ই ফেডরিক বসনার।
কিন্তু মঁসিয়ে, ডঃ লিডনার উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠেন, ফাদার ল্যাভিগনি হলেন বিশ্ববিখ্যাত এপিগ্রাফিস্ট এবং নিউ ইয়র্কের একটি বিখ্যাত মিউজিয়ামে বেশ কয়েক বছর কাজ করেছেন মিঃ মারকাডো। আপনার অনুমান মতো তাদের মধ্যে যে কোন একজনকে আমার স্ত্রীর হত্যাকারী ভাবাটা অসম্ভব।
অসম্ভব! অসম্ভব! এ কথা আমি আমার মনের কোথাও স্থান দিতে চাই না। অসম্ভব ব্যাপারের উপরেই আমার ঝোঁক বেশি। সেই অসম্ভব ব্যাপারটা নিয়ে আমার যা কিছু গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অসম্ভবকেই আমি সম্ভবপর করে তুলি। তবে এক্ষেত্রে আমি অবশ্য ওঁদের দুজনের মধ্যেই থেমে থাকতে চাই না। আপনার সদস্যদের মধ্যে আর কে কে আছেন? কার্ল রেইটার বয়সে যুবক, জার্মান নাম, ডেভিড এমাট–
মনে রাখবেন, সে আমার সঙ্গে দুটি সিজন কাজ করছে।
যুবকটির ধৈর্য আছে। যদি সে অপরাধ করে থাকে, ঝটিতি করেনি। ঠাণ্ডা মাথায় অনেক ভেবে চিন্তে খুন করে থাকবে সে।
ডঃ লিডনারের চোখে-মুখে হতাশার ভাব।
আর আমাদের শেষ সন্দেহভাজন ব্যক্তি হলেন উইলিয়াম কোলম্যান। পোয়োররা তার কথার জের টেনে বলেন।
সে একজন ইংলিশম্যান।
জানি। সেই সঙ্গে মিসেস লিডনারের কথাও মনে পড়ে যায়। তিনি বলেছিলেন, ছেলেটি আমেরিকা থেকে পালিয়ে যায় এবং তার কোন হদিশ পাওয়া যায় না। অতএব তাকে অনায়াসে ইংলন্ডে আনা যায়। আর সেই ভাবেই সে-
উত্তর যেন আপনার মুখে লেগেই আছে! ডঃ লিডনার পরিহাস করে বলেন।
হ্যাঁ, শুরু থেকেই আমি মিঃ কোলম্যানের কথা ভাবছিলাম। তার আচরণ কখনই স্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। তার আচরণে কেমন একটা অভিনয়ের ছোঁয়া আমি দেখতে পেয়েছি। সত্যি কি উনি অভিনেতা? নাটক করেন?
ডঃ লিডনার চুপ করে থাকেন।
পোয়ারো সেই ছোট্ট নোটবুকে কলম চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
আসুন এবার সম্ভাব্য খুনীর নাম নিয়ে পর্যালোচনা করা যাক। পোয়ারো বলেন, প্রথম পর্যায়ে আমরা দুটি নাম পেয়েছি, ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিঃ মারকাডো। দ্বিতীয় পর্যায় কোলম্যান, এমাট এবং রেইটার। এর ঠিক বিপরীত চিন্তাও আমাদের করতে হবে, দেখতে হবে এ ধরণের অপরাধ করার সুযোগ কার বেশি? একটু থেমে পোয়ারো আবার বলতে থাকেন, দুর্ঘটনার সময় ক্যারি ছিলেন খনন কার্যে ব্যস্ত, কোলম্যান যান হাসানিয়ায়, আপনি নিজে ছিলেন ছাদে, এখন অবশিষ্ট থাকেন ফাদার ল্যাভিগনি, মিঃ মারকাডো, মিসেস মারকাডো, ডেভিড এমাট, কার্ল রেইটার, মিস জনসন এবং সব শেষে নার্স লিথেরান।
ওঃ! আমি আঁতকে উঠলাম,
মিঃ পোয়ারো আমার দিকে জ্বলজ্বলে চোখে তাকালেন।
হ্যাঁ, আমার আশঙ্কা, আপনার নামটাও যোগ করা উচিত। আপনি হয়তো ভাবছেন, এ আমার অবাস্তব ভাবনা। না ঠিক তা নয়। আমার ধারণা, কোর্ট ইয়ার্ডে খনন জনশূন্য, চারিদিকে নির্জনতা বিরাজ করছিল, তখন আপনি অনায়াসে মিসেস লিডনারের ঘরে প্রবেশ করে তাকে খুন করে আসতে পারেন। আপনি ছিলেন তার নার্স, সন্দেহ করার কিছু নেই। আপনার স্বাস্থ্য ভাল, একটা ঘুষির আঘাতে (বস্তুত যা হয়েছিল মিসেস লিডনারের খুন হওয়ার ক্ষেত্রে) অনায়াসে, তাঁকে খতম করে দিতে পারেন।
মিঃ পোয়ারোর কথায় আমি এমন হতাশ হয়ে পড়ি যে, মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না।
বড় অদ্ভুত ব্যাপার তো। ডঃ রেলি বিড়বিড় করে বলতে থাকেন, একজন নার্স একের পর এক রুগীকে খুন করে যাচ্ছে।
আমার চোখ দুটো হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে উঠল, সেই জ্বলন্ত চোখে আমি তাকালাম ডঃ রেলির দিকে।
ওদিকে ডঃ লিডনারের মনে তখন অন্য চিন্তা, অন্য ভাবনা।
মঁসিয়ে পোয়ারো, এমাট নয়, ডঃ লিডনার বাধা দিয়ে বললেন, আপনার সন্দেহের তালিকা থেকে তার নামটা বাদ দিয়ে দিতে হবে। মনে রাখবেন, সেই অভিশপ্ত দশ মিনিট সময় সে আমার সঙ্গে ছাদে ছিল।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত ডঃ লিডনার, কোন মতেই আমি তাঁর নাম আমার সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিতে পারি না। অনায়াসে তিনি নিচে নেমে এসে মিসেস লিডনারের ঘরে প্রবেশ করতে পারেন এবং নিঃশব্দে তাঁকে খুন করে চলে যেতে পারেন। তারপর বয়কে ডাকতে পারেন। কিংবা এমন হতে পারে যে, বয়কে কাজের অছিলায় আমার কাছে ছাদে পাঠিয়ে, সেই ফাঁকে মিসেস লিডনারকে খুন করে আবার তিনি তার নিজের জায়গায় ফিরে এসেছিলেন।
ডঃ লিডনার সজোরে মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন, আমি কী তবে দুঃস্বপ্ন দেখছি? বিচিত্র অনুমান আপনার।
আমাকে অবাক করে দিয়ে পোয়ারো বললেন, বিচিত্র নয় ডঃ লিডনার, হ্যাঁ, এটা খুবই সত্য। এ এক বিচিত্র খুনই বটে। সাধারণতঃ খুন জিনিসটা অতি জঘন্য, অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। কিন্তু এ যেন এক বিচিত্র খুন। ডঃ লিডনার, আমার সন্দেহ হয়, আপনার স্ত্রী ছিলেন এক অস্বাভাবিক মহিলা।
কথাটা কি ঠিক নার্স? ডঃ লিডনার শান্ত ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, ওঁকে বলে দাও লুসি মানুষ হিসাবে কি রকম ছিল। তোমার কাছ থেকেই আমি নিরপেক্ষ বিচার আশা করি।
খোলাখুলি ভাবেই আমি বললাম, চমৎকার মহিলা ছিলেন উনি। তোষামোদ করে ওঁর মন জয় করা যেত না। ওঁর মতন সুন্দর মহিলা এর আগে আমি কখনো দেখিনি।
ধন্যবাদ, ডঃ লিডনার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন।
বাইরের লোকের কাছ থেকে পাওয়া এ এক মূল্যবান পরিচয় পত্র। মার্জিত সুরে বললেন পোয়ারো, যাইহোক, ধরে নেওয়া যাক, আমার তৃতীয় অনুমানটাই ঠিক। তার মানে খুনী হয় ফ্রেডরিক, না হয় উইলিয়াম বসনার। আর এই ফ্রেডরিক কিম্বা উইলিয়াম আপনার এক্সপিডিসনেরই একজন সদস্য। আমার সন্দেহের তালিকা সংকুচিত করে চারজনের তালিকা তৈরি করতে পারি। এই চারজন হলেন, ফাদার ল্যাভিগনি, মিঃ মারকাডো, কার্ল রেইটার এবং ডেভিড এমাট।
ফাদার ল্যাভিগনি প্রশ্নাতীত, ডঃ লিডনার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন, তিনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি। তিনি এমন জঘন্য কাজ কিছুতেই করতে পারেন না। এবং তাঁর দাড়ি খাঁটি, নকল নয়! তার সমর্থনে আমি বললাম।
প্রথম শ্রেণির খুনীরা কখনো নকল দাড়ি ব্যবহার করে না। পোয়ারো উত্তরটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন।
আপনি কী করে বুঝলেন? সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম, খুনী প্রথম শ্রেণির?
তা না হলে সমস্ত ব্যাপারটাই জোলো হয়ে যেত। কেসটা এত জটিল হয়ে উঠত না।
এ যেন পুরোপুরি বুদ্ধির খেলা, মনে মনে আমি ভাবলাম।
যাইহোক, দাড়ির প্রসঙ্গে ফিরে গিয়ে আমি বললাম, দাড়ি গজাতে বেশ কিছু সময় নিশ্চয়ই লেগেছিল?।
এটা একটা বাস্তব পর্যবেক্ষণ, পোয়ারো মন্তব্য করেন।
ওদিকে ডঃ লিডনারের কথায় উত্তেজনা প্রকাশ পায়, কিন্তু এ অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব। তিনি এবং মারকাডো দুজনেই অতি পরিচিত ব্যক্তি, আর সে পরিচয় দীর্ঘদিনের।
চকিতে ডঃ লিডনারের দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো।
আপনাকে ঠিক বোঝানো যাচ্ছে না। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারকে আপনি আমল দিতে চাইছেন না। ফ্রেডরিক বসনার যদি মৃতই না হয়, তাহলে এতদিন সে কী করছিলেন? নিশ্চয়ই সে নাম ভঁড়িয়েছে?
আমার মতামত যদি জানতে চান, ডঃ রেলি তাদের আলোচনায় বাধা দিয়ে বলেন, এক্ষেত্রে কার্ল রেইটারের নামটাই যথার্থ এবং আইনত ন্যায়সঙ্গতও বলা যেতে পারে। বয়সে তরুণ, উইলিয়াম বসনারের বয়সের সঙ্গে যথেষ্ট মিল আছে তার। তাছাড়া জার্মান নাম তার। এ বছরই সে প্রথম এসেছে এবং মিসেস লিডনারের ঘরের কাছেই তার ঘর, সুযোগটা বেশি তারই ছিল। কোর্টইয়ার্ডে উল্টোদিকে তার ঘর। ফটোগ্রাফার সে। যদি কেউ বলে যে তার ঘরে তাকে দেখা যায় নি দুর্ঘটনার সময়, জবাব তার মুখেই লেগে থাকার কথা,–অনায়াসে সে বলতে পারবে, সে তখন ডার্করুমে ছিল। জানি না এই যুবকটি আপনার সন্দেহের আওতায় আসে কি না, তবে এটুকু বলতে পারি যে, তাকে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে। আপনার সম্ভাব্য অপরাধীদের তালিকায় তার নাম প্রথমেই লিখতে পারেন।
পোয়ারো তেমন আগ্রহ দেখাল না এ ব্যাপারে। মাথা নেড়ে সায় দিল বটে সে, তবে কেমন দায়সারা গোছের যেন।
হ্যাঁ, তিনি বলেন, আপাত দৃষ্টিতে তাকে সন্দেহ করাটা ন্যায় সঙ্গত হলেও প্রমাণ করাটা কিন্তু খুব সহজ ব্যাপার নয়। তারপর তিনি একটু থেমে বলেন, এখন আর কোন কথা বলা বোধহয় ঠিক হবে না। আমি এখন নিহত মিসেস লিডনারের ঘরটা একবার ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে চাই।
নিশ্চয়ই! ডঃ লিডনার পকেটে হাত ঢুকিয়ে ডঃ রেলির দিকে ফিরে তাকালেন, ঘরের চাবি তো ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের কাছে।
মেটল্যান্ড চাবিটা আমাকে দিয়ে গেছেন। ডঃ রেলি বললেন সেই কুরডিশের ব্যাপারে তাকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। অতঃপর চাবিটা এগিয়ে দেন ডঃ রেলি।
পোয়ারোর হাতে চাবিটা তুলে দিতে গেলে ডঃ লিড়নারকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ বলে মনে হয় যেন, কিছু মনে করবেন না, আপনার সঙ্গে আমি যেতে পারছি না, সম্ভবত নার্স
নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, আমি আপনার অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনাকে আমি অযথা বিরক্ত করব না। তারপর তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, আপনি যদি আমাকে একট সঙ্গ দেন-
নিশ্চয়ই! সঙ্গে সঙ্গে আমি জবাব দিলাম।
.
১৭.
ওয়্যাশস্ট্যান্ডে রক্তের দাগ
পোস্টমর্টেমের জন্য মিসেস লিডনারের মৃতদেহ ইতিমধ্যে হাসানিয়েয় চালান করা হয়েছিল। তবে তার ঘরের হেরফের কিছুই হয়নি, যেমনটি আগে ছিল, এখনো ঠিক তেমনি আছে। ঘরটা এতই ছোট যে, ঘুরে দেখার জন্য খুব বেশি সময় লাগেনি পুলিশের।
দরজার ডানদিকে বিছানা। দরজার ঠিক বিপরীত দিকে শহরমুখী গরাদ-বিহীন দুটি জানালা। মাঝ বরাবর ওক কাঠের টেবিল, ড্রেসিংটেবল হিসাবে ব্যবহার করতেন মিসেস লিডনার, সংলগ্ন দুটি ড্রয়ারে তার প্রসাধন সামগ্রী থাকত। পূবদিকের দেওয়ালের বুকে ঝুলছিল সারি সারি পোশাক। দরজার ঠিক বাঁদিকে কাপড় রাখার স্ট্যান্ড। ঘরের ঠিক মাঝখানে ওক কাঠের একটা টেবিল শোভা পাচ্ছিল। টেবিলের উপরে লেখার সরঞ্জাম ও একটি এ্যাটাচি কেস। মিসেস লিডনার সেই অভিশপ্ত চিঠিগুলো ওই এ্যাটাচি কেসের ভিতরে চালান করে দেন। পর্দাগুলো মামুলি ধরনের। পাথরের মেঝের উপরে ছাগলের কার্পেট বিছানো।
ঘরের মধ্যে কাপবোর্ড কিংবা আড়াল করার মত কোন জিনিস বড় একটা চোখে পড়ে না। বিছানায় সস্তা দামের সুতির তোশক। দামী শয্যা সামগ্রী বলতে তেমন কিছুই ছিল না, কেবল দামী তিনটি বালিশ ছাড়া।
মিসেস লিডনারের মৃতদেহ ঠিক কোথায় পাওয়া যায় বোঝাতে গিয়ে অল্প কথায় ডঃ রেলি যেন অনেক কিছুই বলে গেলেন। ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি আমাকে ইশারায় এগিয়ে আসতে বললেন।
দুর্ঘটনার পর আমি যা, দেখেছি তার অনুরূপ বর্ণনা আমি সংক্ষেপে বললাম। ডঃ রেলি আমাকে তার সাধ্য মত সাহায্য করলেন।
ডঃ লিডনার তার স্ত্রীর অমন অবস্থা দেখে মাথাটা তুলে ধরেন, ডঃ রেলি বলেন, তবু আমি তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, মিসেস লিডনারের মৃতদেহ যেখানে যে অবস্থায় তিনি প্রথম দেখতে পান সেখানেই আছে, নাকি সরিয়েছেন? ওঁর কথার হাবভাব এবং পরিবেশ দেখে আমার মনে হয়েছিল, মৃতদেহ উনি সরাননি।
মনে হয় মিসেস লিডনার তখন বিছানায় শুয়েছিলেন, পোয়ারো তাঁর সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করেন, হয়তো তিনি তখন ঘুমুচ্ছিলেন, কিংবা বিশ্রাম নিচ্ছিলেন সেই সময় কেউ দরজা খুলে থাকবে, তাকে দেখে তিনি হয়তো বিছানা ছেড়ে উঠে বসতে যান এবং তখনই আততায়ী নিশ্চয়ই তাঁর মাথায় প্রচণ্ড আঘাত হেনে থাকবেন, পোয়ারো কথাটা শেষ করলেন, সেই একটা ঘুষির আঘাতেই মিসেস লিডনার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে থাকবেন এবং একটু পরেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। দেখুন-
অতঃপর মিসেস লিডনারের আঘাতের বিশদ বিবরণ দিলেন ডঃ রেলি।
তাহলে খুব একটা বেশি রক্ত পড়েনি? পোয়ারো জিজ্ঞাসা করলেন।
বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও মনে হয় ব্রেনের মধ্যে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়ে থাকবে।
তাহলে এর থেকে বোঝা যাচ্ছে, মৃত্যুটা সরাসরিই ঘটে থাকবে, তবে একটা ব্যাপারে কেমন খটকা লাগছে। আততায়ী যদি আগন্তুক, মানে মিসেস লিডনারের অপরিচিতই হয়ে থাকবে, তাহলে তিনি কেন সাহায্যের জন্য চিৎকার করলেন না। চিৎকার করলে নার্স লিথেরান, এমাট এবং পটবয় নিশ্চয়ই শুনতে পেতো।
তা এর উত্তর তো খুবই সহজ, ডঃ রেলি শুকনো গলায় বলেন, কারণ সে আগন্তুক ছিল না।
হু, গভীর ভাবে চিন্তা করে পোয়ারো বলেন, তিনি হয়তো লোকটিকে দেখে একটু অবাক হয়ে থাকবেন, কিন্তু ভয় পাননি। তারপর সে তার মাথায় অতর্কিতে আঘাত করলে তিনি হয়তো অস্ফুটে চিৎকার করে থাকবেন, কিন্তু তখন অনেক, অনেক দেরি হয়ে যায়।
তবু সেই অস্ফুট চিৎকার মিস জনসন শুনতে পায়।
এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। কারণ এমন মোটা দেওয়াল বিশেষ করে বন্ধ জানালা পেরিয়ে মিস জনসন কি করে তার অস্ফুট কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন জানি না?
মিসেস লিডনারের বিছানার দিকে এগিয়ে যান পোয়ারো।
আপনি কী তাকে বিছানায় শোয়া অবস্থায় দেখে যান? পোয়ারো এবার আমার উদ্দেশ্যে তার প্রশ্নটা ছুঁড়ে দেন।
জীবিত অবস্থায় মিসেস লিডনারকে আমি ঠিক কি অবস্থায় দেখে যাই, তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ আমি তাকে দিলাম। তাকে আমি দু খানি বই দিয়ে যাই। মনে হয় বই পড়তে পড়তে ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে আসে। হা, তখন তিনি স্বাভাবিক ছিলেন। অস্বাভাবিক কিছু ঘটে থাকলে আমার নজর এড়াতে না নিশ্চয়ই।
আমার কথাগুলো পোয়ারো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। তারপর তিনি তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করলেন ঘরের চারিদিকে।
আর খুনের পর ঘরে ঢুকে আপনি কী আগের মতোই সব ঠিক ঠিক দেখেছিলেন এখানে?
হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি। ঘরের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলি, আমার মনে হয় না, ঘরের মধ্যে কোন তফাৎ আমার চোখে পড়েনি।
এই ধরুন, যেমন কোন অস্ত্র, যা দিয়ে তাকে আঘাত করা হয়েছিল?
না।
ডঃ রেলির দিকে তাকালেন পোয়ারো। এ ব্যাপারে আপনার কী মতামত ডঃ রেলি?
ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন।
খুব শক্তিশালী কোন একটা বস্তু হতে পারে। তবে খুব একটা ধারালো নয়। এই যেমন, স্ট্যাচুর মতো কিছু একটা বস্তু। মনে রাখবেন, আমার এই অনুমানটা জোর করে চাপিয়ে দিচ্ছি না, কিন্তু এ ধরনের অস্ত্রের কথাই আমি বলতে চাইছি। মনে হয়, সেই বস্তু দিয়ে সজোরে আঘাত করা হয়ে থাকবে।
একজন বলিষ্ঠ মানুষের ঘুষির আঘাত? একজন মানুষের কালো হাত?
হ্যাঁ, তা না হলে—
তা না হলে কী?
ডঃ রেলি ধীরে ধীরে বলতে থাকেন, মনে হয় মিসেস লিডনার নতজানু হয়ে বসেছিলেন, উপর থেকে ঘুষির আঘাতে তেমন প্রচণ্ডতা না থাকলেও এক আঘাতেই তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
নতজানু হয়ে বসেছিলেন, পোয়ারো নিজের মনে বিড়বিড় করতে থাকেন, হ্যাঁ, সেই রকমই মনে হয়
হ্যাঁ, আমার অনুমান ঠিক, ডঃ রেলি নিজেকে সমর্থন করে বলেন, এ ছাড়া অন্য আর কিছু ভাবা যায় না।
হয়তো সম্ভব।
হুঁ, পারিপার্শ্বিক ঘটনাগুলো বিবেচনা করে দেখলে মনে হবে, এটা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। আকস্মিক ঘটনায় ভয়ে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েন, এবং নতজানু হতে বাধ্য হন। তখনো তিনি জানতেন না যে, তিনি খুন হতে যাচ্ছেন। কিন্তু সম্বিৎ যখন ফিরে পেলেন তখন আর ফেরবার পথ ছিল না।
হ্যাঁ, পোয়ারোকে রীতিমত চিন্তান্বিত বলে মনে হল। এটা অনুমেয় বটে।
কিন্তু সেই ধারণাটা বড়ই দুর্বল বলে আমার মনে হল। আমি ভাবতেই পারি না, মিসেস লিডনার কারোর কথায় কিম্বা ভয়ে নতজানু হয়ে বসে থাকতে পারেন।
পোয়ারো জানালা দুটির সামনে গিয়ে লক্ষ্য করলেন, সেই পথে মাথা গলানো যেখানে মুশকিল সেখান দিয়ে আততায়ীর পক্ষে পালানো একরকম অসম্ভব ব্যাপারই বটে। তাছাড়া দুর্ঘটনা ঘটার সময় জানালাগুলো বন্ধ ছিল বলেই তাকে রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে। অতএব দেখা যাচ্ছে, মিসেস লিডনারের ঘরে প্রবেশ এবং প্রস্থানের একটি মাত্রই পথ হল দরজা। আর সেই দরজার সামনে আসা একটি মাত্র পথ হল কোর্টইয়ার্ড এবং সেই কোর্টইয়ার্ডে প্রবেশ করতে হলে খিলান পথ দিয়ে আসতে হবে। সেই খিলান পথের বাহিরে তখন পাঁচজন কর্মচারী আড্ডা দিচ্ছিলেন এবং তারা সবাই একই কাহিনীর পুনরাবৃত্তি করেছে। পোয়ারো মনে করেন, তারা মিথ্যা বলেনি বা তারা কখনোই মিথ্যা কথা বলতে পারে না। কিম্বা ঘুষ দিয়ে তাদের মুখও বন্ধ করা হয়নি। অতএব খুনী এখানে এঁদের মধ্যে গা ঢাকা দিয়ে আছে।
আমি কোন কথা বললাম না। গোল টেবিলের বৈঠকে আমরা যখন আটক হয়ে পড়ি কথাটা তখনি আমার মনে উদয় হয়, কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনি।
পোয়ারো নিঃশব্দে কখন যে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একজন বয়স্ক লোকের ফটো বার করে নিবিষ্ট মনে দেখছিলেন আমরা কেউ খেয়াল করিনি। বয়স্ক লোকটির মুখে ছাগলের মতো সাদা দাড়ি। আমার দিকে সপ্রশ্ন চোখে তাকালেন পোয়ারো।
ফটোটা মিসেস লিডনারের বাবার, প্রত্যুত্তরে আমি বলি, উনি আমাকে সেরকমই বলেছিলেন।
ফটোটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর ছড়ানো প্রসাধন সামগ্রীগুলো এক নজরে দেখে নিলেন পোয়ারো। সাধারণ প্রসাধন, তবে গুণগত বিচারে বেশ ভাল। তারপর বুকসেলে রাখা বইগুলোর নাম জোরে জোরে পড়তে থাকলেন।
হুঁ, ওয়ার দ্যা গ্রীজ? ইনট্রোডকশনস টু রিলেটিভিটি। লাইফ অফ লেডি হেস্টার স্ট্যানহোপ। ফ্রিউ টেন। ব্যাক টু মেথুমেলা। লিন্ডা কনডন। হ্যাঁ, এই বইগুলো যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে, আপনাদের মিসেস লিডনার বোকা ছিলেন না।
ও হ্যাঁ। অত্যন্ত, বুদ্ধিমতী মহিলা ছিলেন তিনি, আমি খুব আগ্রহ নিয়ে বললাম, সাধারণ মহিলা ছিলেন না তিনি।
তার দৃষ্টি আমার দিকে, ঠোঁটে হাসি।
না, সেটা আমি আগেই বুঝেছিলাম।
কথা বলতে বলতে কয়েক মুহূর্তের জন্য ওয়্যাশস্ট্যান্ডের সামনে গিয়ে থামলেন পোয়ারো। সেখানে সারি সারি বোতল সাজানো, সেই সঙ্গে টয়েলেট ক্রীম। তারপর হঠাৎ হাঁটু মুড়ে বসে কম্বলটা পরীক্ষা করতে ব্যস্ত হলেন তিনি।
ডঃ রেলি এবং আমি দ্রুত তার কাছে ছুটে গেলাম। তিনি তখন সেই কম্বলের উপরে গাঢ় বাদামি রঙের দাগটা লক্ষ্য করছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। সেই দাগটার প্রতি ডঃ রেলির দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আপনাদের কী মনে হয়, ওটা রক্তের দাগ?
ডঃ রেলির নতজানু হয়ে বসলেন, হতে পারে, তবে আপনি চাইলে আমি পরীক্ষা করে দেখতে পারি।
আপনি যদি দয়া করে ।
তারপর পোয়ারো জাগ এবং বেসিনটা ভাল করে পরীক্ষা করতে থাকলেন। ওয়্যাশস্ট্যান্ডের পাশে পড়ে ছিল জাগটা। ফাঁকা বেসিন। তবে ওয়্যাসস্ট্যান্ডের পাশে একটা নোংরা জল ভর্তি কেরোসিন টিন পড়ে থাকতে দেখা গেল।
আমার দিকে ফিরে তাকালেন পোয়ারো।
নার্স, আপনার মনে আছে। আপনি যখন মিসেস লিডনারের ঘর ছেড়ে যান তখন এই জাগটা বেসিনের বাইরে না উপরে রাখা ছিল?
ঠিক খেয়াল করতে পারছি না, মিনিট দুই পরে কি ভেবে বললাম, তবে মনে হয়, ওটা বেসিনের উপরেই ছিল। লাঞ্চের পর পরিচারকরা বেসিনের উপরেই ওটা রেখে গিয়ে থাকবে হয়তো। না থাকলে আমার দৃষ্টি এড়াতো না। তবে এ সবই আমার অনুমান মাত্র। বুঝলেন?
হ্যাঁ, বুঝেছি বৈকি। এ সবই আপনার হাসপাতাল থেকে পাওয়া ট্রেনিং-এর ফসল। রুগীদের প্রতিটি ব্যবহৃত জিনিসের উপরে আপনার সজাগ দৃষ্টি থাকে, এদিক ওদিক হবার উপায় নেই। যাইহোক, এবার বলুন খুনের পর কী দেখেছিলেন? এখন যেমনটি দেখছেন ঠিক তেমনি?
সঙ্গে সঙ্গে আমি মাথা দোলাই।
তখন আমি লক্ষ্য করিনি, উত্তরে আমি বলি, তখন আমার লক্ষ্য ছিল আততায়ী পালালো কোথায়? ঘরের মধ্যে একটা জলজ্যান্ত মানুষের লুকানোর মত জায়গা কোথায় থাকতে পারে? আমার আর একটা দেখার ছিল, খুনী তার ব্যবহৃত কোন জিনিস ভুলে ফেলে গেছে কিনা।
হ্যাঁ, এটা রক্তেরই দাগ বটে। ডঃ রেলি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, এটা একটা উল্লেখযোগ্য দিক।
পোয়ারোর পিঙ্গল চোখে ভ্রুকুটি, মেজাজটা হঠাৎ যেন একটু খিটখিটে হয়ে যায়।
আমি বলতে পারি না। কি করেই তা বলব আমি? হয়তো, আদৌ এর কোন সম্পর্ক নেই মিসেস লিডনারের খুনের সঙ্গে। তবে আমি বলতে পারি যে, এ সবই আমার অনুমান। সেই অনুমানের উপরে ভিত করেই বলতে পারি, খুনী হয়তো তাকে স্পর্শ করে থাকতে পারে এবং তার হাতে হয়তো সেই কারণে একটু আধটু রক্ত লেগে থাকবে, তবু রক্ত রক্তই এবং সেই রক্ত মুছে ফেলবার জন্যই এই ওয়্যাশস্ট্যান্ডে তার আসা, হ্যাঁ এ রকমই একটা কিছু ঘটে থাকবে। তবে তাই বলে এই নয় যে, এ ব্যাপারে তাড়াতাড়ি আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলব। এমনও তো হতে পারে, ওই রক্তের দাগের সঙ্গে এই কেসের কোনও সম্পর্কই নেই।
খুব সামান্য রক্ত, ডঃ রেলি মন্তব্য করেন, মনে হয় নিহত মিসেস লিডনারের ক্ষত স্থানের রক্ত সেটা অবশ্য আততায়ী যদি সেই ক্ষত স্থানে হাত দিয়ে থাকে, তবেই রক্তের দাগ এখানে লাগতে পারে।
হঠাৎ আমার শরীরটা কেঁপে উঠল ভয়ে, বিস্ময়ে। একটা বিশ্রী কুৎসিত চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। একটি মুখের ছবি, মনে হয় সেই ফটোগ্রাফারের মুখ, প্রথমে মিসেস লিডনারকে খুন করে সে, তারপর তার ক্ষতস্থানে হাত দিয়ে দেখতে যায় ক্ষতের গভীরতা এবং সম্ভবতঃ সেই বীভৎস দৃশ্য দেখে তার মুখের রঙ বদলে যায়, পাগলের মত ছুটে যায় ওয়্যাশস্ট্যান্ডের দিকে।
ডঃ রেলির চোখে আমার কাপনের ছায়া পড়েছিল বোধহয়।
কী ব্যাপার নার্স জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।
কিছু নয়, হঠাৎ গায়ে কেমন কাঁটা দিয়ে উঠল, এই আর কি!
ডঃ পোয়ারো আমার দিকে তাকায়। তার চোখে কৌতূহল।
আমি জানি আপনার কি প্রয়োজন। পোয়ারো বলতে থাকেন, আমাদের এখানকার কাজ আপাততঃ শেষ। ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে হাসানিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় ভাবছি আপনাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব। তার আগে ডাক্তার, নার্স লিথেরানকে আপনি
আনন্দ মানে একটু সুখ!
না, না ডাক্তার, সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানালাম। ও সব কথা আমি চিন্তাই করতে পারি না।
বন্ধুর মতো আমার পিঠের উপরে আলতো করে একটা টোকা মারলেন পোয়ারো। একেবারে ব্রিটিশ কায়দায়, বিদেশীদের মতো নয়।
ম্যাডাম, আপনি যা বলবেন তাই হবে। পোয়ারো এবার তার কাজের প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। আপনাকে সঙ্গে পেলে আমার খুব উপকার হয়। এমন কতকগুলো কথা আছে, সব জায়গায়, সবার সামনে বলা যায় না। ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে বলতে গেলে একরকম দেবদেবীর চোখে দেখতেন, তাঁকে সময় সময় পুজোও করতেন এবং তিনি নিজে বিশ্বাস করতেন, তাঁর মতো অন্য সবাই তার স্ত্রীকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতেন। কিন্তু আমি তা মনে করি না। মানুষের মন না মতিভ্রম, ভুল-ভ্রান্তি, এই নিয়েই তো মানুষের জীবন। তাই আমি এ ব্যাপারে বিশেষ করে মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে একান্তে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চাই। আপনার মতে ভদ্রমহিলা কেমন ছিলেন, সেটা আমার আগে জানতে হবে। হাসানিয়েয় গিয়ে এ নিয়ে আপনার সঙ্গে বিশদ ভাবে আলোচনা করতে চাই।
আমার মনে হয়, একটু ইতস্ততঃ করে আমি বলি, এই অবস্থায় এখান থেকে চলে গেলে এখানকার সবাই সেটা খুব একটা ভাল চোখে দেখবেন না।
তাতে কি হয়েছে, দু-একদিনে কিছু এসে যায় না, পোয়ারোর হয়ে ডঃ রেলি বলেন, মিসেস লিডনারকে কবর দেবার আগে তো আর আপনি যেতে পারছেন না।
তা অবশ্য ঠিক, আমার পরবর্তী প্রশ্নটা একটু অদ্ভুত ধরনের হল, ধরুন, আমিও যদি খুন হই?
কথাটা আমি বললাম ঠাট্টার ছলে, এবং ডঃ রেলিও হাল্কা ভাবে গ্রহণ করলেন সেটা। কিন্তু পোয়ারো আমাকে অবাক করে দিয়ে হাত মুখ নেড়ে বললেন নাটকীয় ভঙ্গিতে।
আঃ, তাই যদি হয়, অস্ফুট কণ্ঠস্বর, বিপদ, হা, মহা বিপদ, তাই যদি হয় তাতে কার কী করার থাকতে পারে? কতক্ষণ বা একজনকে চোখে চোখে রাখা যায়?
কেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি বললাম, আমি তো ঠাট্টা করেই কথাটা বলেছিলাম, আপনার কথা সত্যি ধরে নিলে স্বভাবতই জানতে ইচ্ছে করে, কে, কে আমাকে খুন করতে পারে?
শুধু আপনি কেন, অন্য কেউও খুন হতে পারেন, পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে গভীর প্রত্যয়ের ছাপ। জানি না, তাঁর এ কথা বলার কি অর্থ থাকতে পারে।
কিন্তু কেন? কেন আমরা যে কেউ খুন হতে পারি? আমার মধ্যে কেমন একটা জিদ চেপে গেল, পোয়ারোর কথার অন্তর্নিহিত অর্থ আমাকে জানতেই হবে।
আমার দিকে সরাসরি তাকালেন পোয়ারো।
আমি ঠাট্টা করছিলাম, পোয়ারো বললেন, কিন্তু এমন এক একটা ব্যাপার আছে, যা নিয়ে ঠাট্টা-ইয়ার্কি চলে না। আমি আমার পেশাদার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, খুন করা মানুষের একটা স্বভাব……..
.
১৮.
ডঃ রেলির বাড়িতে চায়ের আসর
ফিরে যাবার আগে এক্সপিডিসন হাউস এবং তার চারপাশ একবার ঘুরে দেখে নিলেন পোয়ারো। সেই সঙ্গে দ্বিতীয় পর্যায় পরিচারকদের জিজ্ঞাসাবাদ করতে ভুললেন না তিনি। তবে পোয়ারোর প্রশ্নগুলো ইংরিজি থেকে আরবী ভাষায় এবং পরিচারকদের উত্তরগুলো আরবী থেকে ইংরিজিতে অনুবাদ করে দিলেন ডঃ রেলি। প্রশ্নগুলো সেই আগন্তুককে ঘিরে, যাকে মিসেস লিডনার, আমি এবং ফাদার ল্যাভিগনি দেখেছিলাম জানালা পথে।
আপনার কি ধারণা সেই আগন্তুকের কোন প্রয়োজন হতে পারে এই কেসের ব্যাপারে? হাসানিয়ের যাবার পথে ডঃ রেলি জানতে চাইলেন পোয়ারোর কাছ থেকে।
পোয়ারোর উত্তর, সবরকম খবর সংগ্রহ করে রাখাই হল আমার কাজ।
পোয়ারোর এই কাজের পদ্ধতিটা আমার খুব ভাল লাগল। দেখলাম, সত্য ঘটনা থেকে শুরু করে খোশগল্প কথা, কোন কিছুই বাদ দিলেন না, খুব মন দিয়ে তিনি তাঁর নোটবুকে লিপিবদ্ধ করলেন প্রশ্নোত্তরগুলো।
স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, ডঃ রেলির বাড়িতে চা খুব ভাল লাগল, অনেকক্ষণ থেকে এর অভাব বোধ করছিলাম। লক্ষ্য করলাম পোয়ারো যেন একটু বেশি মিষ্টি পছন্দ করেন, এক কাপ চায়ে পাঁচ চামচ চিনি।
চায়ের চামচটা রাখতে গিয়ে পোয়ারো বললেন, এখন আমরা খোলাখুলি ভাবে আলোচনা করতে পারি, কেন পারিনা? আমরা এখন মনস্থির করতে পারি, এই অপরাধ কে বা কারা করতে পারে?
ল্যাভিগনি, মারকাডো, এমাট কিংবা রেইটার? ডঃ রেলি জিজ্ঞাসা করলেন।
না, না, ওটা তো সেই তিন নম্বর থিয়োরি। আমি এখন দু নম্বর থিয়োরির উপরে মনোনিবেশ করতে চাই। মিসেস লিডনারের সেই রহস্যময় স্বামী কিংবা তার দেওরের প্রসঙ্গ এখানে ভোলা থাক। এখন আসুন এই এক্সপিডিসন হাউসে দেখা যাক মিসেস লিডনারকে খুন করার সুযোগ কার সব থেকে বেশি ছিল এবং সম্ভাব্য খুনী কে হতে পারে? আমার মনে হয়, পোয়ারো এখানে একটু থেমে আবার বলতে থাকেন, এই এক্সপিডিসনের সদস্যদের মধ্যে কে তার স্ত্রীকে খুন করতে পারে, এই প্রশ্ন নিয়ে ডঃ লিডনারের সামনে আলোচনা করলে কেমন হয়? মনে হয় তাতে খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। আর একটা কথা বলে রাখি এ প্রসঙ্গে, তার স্ত্রী সবার শ্রদ্ধেয় ছিলেন এবং এখানকার সবাই তাকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করতো, বিতর্কিত প্রশ্নটা আপাতত মুলতুবি রাখতে চাই।
হ্যাঁ, আমরা এখানে ভাবানুবেগের কোনও প্রশ্রয় দেব না। ডঃ রেলি বলেন, আমাদের বিচার হবে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ, অন্য কারোর মতামতকে আমরা কোন পাত্তা দেব না। এ ব্যাপারে আশাকরি নার্স লিথেরান আমাদের সাহায্য করবেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, উনি একজন ভাল পর্যবেক্ষক।
না, না ও ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না, সঙ্গে সঙ্গে আমি আপত্তি জানালাম।
আসুন মাদাম, ডঃ রেলির হয়ে পোয়ারো বলেন, আপনাকে কিছু জানতে হবে না, আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি, এখন বলুন, মিসেস লিডনারের প্রতি এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যদের কার কী রকম মনোভাব ছিল?
কিন্তু মিঃ পোয়ারো, আমি তো মাত্র এক সপ্তাহ হল এখানে এসেছি
আপনি বুদ্ধিমতী, তার ওপর নার্স, রুগীর নাড়ি টিপলেই বুঝতে পারেন, মাত্র এক সপ্তাহ তো সেদিক থেকে অনেক দীর্ঘ সময়। পোয়ারো মৃদু হেসে বলেন, আসুন, এবার প্রথম থেকে শুরু করা যাক। সবার আগে ফাদার ল্যাভিগনির নাম নেওয়া যাক।
ঠিক আছে, তবে সত্যি কথা বলতে কি ওঁর ব্যাপারে আমি তেমন কিছুই জানি না। তাছাড়া ফাদার ল্যাভিগনি এবং মিসেস লিডনার বেশির ভাগ সময়ে ফরাসী ভাষায় কথা বলতেন। আর ফরাসী ভাষা খুব একটা ভাল আমার জানা নেই, ছেলেবেলায় স্কুলে কিছুদিন ক্লাস করেছিলাম। তাতে বুঝতে পারি, তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল বইপত্তর।
তাহলে বলতে পারেন, জুটি হিসাবে ওঁরা মন্দ ছিলেন না।
হ্যাঁ, আপনি তা মনে করতে পারেন, আমি তাকে বললাম, কিন্তু আমার যতদূর ধারণা, ফাদার ল্যাভিগনি মিসেস লিডনারের ব্যাপারে শেষ দিকে বিরক্ত হয়ে উঠেছিলেন, বলা যেতে পারে, ওঁকে নিয়ে তিনি মহা সমস্যায় পড়েছিলেন। আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।
তারপর আমি তাকে ফাদার ল্যাভিগনির সঙ্গে আমার কি কথাবার্তা হয়েছিল সব বললাম সবিস্তারে। আর এও বললাম, ফাদার ল্যাভিগনির মতে মিসেস লিডনার নাকি একজন বিপজ্জনক মহিলা।
বিপজ্জনক মহিলা? পোয়ারো চমকে উঠলেন, ফাদার ল্যাভিগনি বলেছেন এই কথা? দারুণ মজার ব্যাপার তো। পোয়ারো নিজের চেয়ারে নড়েচড়ে বসলেন, তার মুখের ভাব দেখে মনে হল, তিনি যেন কোন সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। আর মিসেস লিডনার তার সম্বন্ধে কিছু কি বলেছিলেন?
সেটা বলা খুবই শক্ত। মিসেস লিডনারের মনের গভীরে প্রবেশ করতে পারিনি আমি। তবে–
তবে কী?
একদিন তার স্বামীকে বলতে শুনেছিলাম, ফাদার ল্যাভিগনির মতো যাজক তিনি নাকি এর আগে কখনো দেখেননি।
দেখছি ফাদার ল্যাভিগনির জন্য একটা বড় মাপের শনের দড়ির ব্যবস্থা করতে হবে, ডঃ রেলি ঠাট্টা করে বললেন।
প্রিয় বন্ধু, পোয়ারো কপট দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আপনার কী ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে? আমি জানি, আপনি একজন চিকিৎসক, তাই খুব বেশি সময় আমি নেব না। তবে একটু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। আমার কতকগুলো জরুরী কথা আছে। এর মধ্যে দ্বিতীয় পর্যায় আর একবার চায়ের ব্যবস্থা হলে খুব ভাল হয়।
এক প্লেট স্যান্ডউইচ আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে পোয়ারো তার স্বভাবসুলভ হাসি হেসে বললেন, এগুলো খেয়ে নিন। খেতে খেতে আলোচনা করব।
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম, পোয়ারো কথার জের টেনে বলতে থাকেন, আপনার কী মনে হয়, মানে কারা কারা মিসেস লিডনারকে পছন্দ করত বলে আপনার মনে হয় নার্স?
বলছি, তবে আগেই বলে রাখছি, এ আমার ব্যক্তিগত অভিমত, বাস্তবের সঙ্গে এর মিল নাও থাকতে পারে। তবু বলছি এই কারণে যে খবরটা আপনার তদন্তের কাজে হয়তো সুবিধা হতে পারে। জানেন মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার যতদূর ধারণা, মিসেস মারকাডো ভীষণ ঘৃণা করতেন মিসেস লিডনারকে।
আর মিঃ মারকাডো?
তার মনোভাব একটু নরম ছিল, আমি তাকে এ কথাও স্মরণ করিয়ে দিলাম, তার স্ত্রী ছাড়া অন্য কোন মহিলা তার প্রতি বড় একটা নজর দেয় না। আর মিসেস লিডনার-এর ওই এক স্বভাব ছিল, যে কোন লোকের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতেন, তার কাছে সবাই সমান আলাদা করে কাউকে বিশেষ ভাবে ভাবতেন না।
আর মিসেস মারকাডো হলেন তার ঠিক বিপরীত চরিত্র, কী বলেন?
তিনি ঠিক কি রকম ছিলেন জানি না, তবে আর পাঁচটা মেয়ের মতো তাঁর স্বামীর বান্ধবী কিংবা স্নেহভাজন মহিলার প্রতি তার হিংসা হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। তাই আপনাকে সাবধান করে দিচ্ছি, মিসেস মারকাডোর সঙ্গে কথা বলার সময় ওঁদের স্বামী-স্ত্রীর প্রসঙ্গটা যথা সম্ভব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। তা না হলে–
আপনি যা বলতে চাইছেন, তাতে আমার কোন সন্দেহ নেই। অতএব ধরে নিতে পারি, মিসেস লিডনারের প্রতি মিসেস মারকাভোর হিংসা ছিল এবং তাকে তিনি ঘৃণা করতেন।
কিন্তু তাই বলে তিনি যে খুন করতে পারেন, ওই কথা স্বপ্নেও আমি কখনো ভাবিনি। ওঃ ঈশ্বর আমাকে ক্ষমা করুন। আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। মিঃ পোয়ারো, ও কথা আমি ভাবিনি, এক মুহূর্তের জন্যও নয়!
না, না আমি বুঝতে পারি সব। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল। পোয়ারো তার বক্তব্য শুধরে নিয়ে বললেন, মিসেস মারকাভোর তখন শত্রুতাচরণের ব্যাপারে আপনার কি মনে হয়, মিসেস লিডনার চিন্তিত ছিলেন?
না, আমার তো মনেই হয় না, আদৌ তিনি চিন্তিত ছিলেন। এমন কি মিসেস মারকাডো যে তার সঙ্গে শত্রুর মতো ব্যবহার করতেন, সে খবরও বোধহয় তার জানা ছিল না। এক এক সময় আমি ভেবেছি, তাকে সব খুলে বলি, সাবধান করে দিই। পরে আবার ভেবেছি, দু দিন পরে সব ঠিক হয়ে যাবে, তাই চুপ করেছিলাম।
এ আপনার বুদ্ধিরই পরিচয় মাদাম। কি যেন চিন্তা করে পোয়ারো বললেন, তাহলে উনিই মিসেস লিডনারের প্রথম বিবাহের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন? আচ্ছা, খবরটা দেবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি আপনার দিকে কী চোখে তাকিয়েছিলেন বলুন তো? মানে, ওঁর বলার আগে আপনি অন্য কারোর কাছ থেকে ঘটনাটা শুনেছিলেন কিনা, সেটা যাচাই করতে
আপনি কী মনে করেন, সত্যিই সেই ব্যাপারটার সত্যতা সম্বন্ধে উনি নিঃসন্দেহে ছিলেন?
অসম্ভব কিছু নয়। হয়তো চিঠিগুলো তিনি নিজের হাতেই লিখে থাকবেন।
আমারও তাই ধারণা। মনে হয় প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্য অমন অপ্রিয় কাজটা তিনি করেছিলেন।
হ্যাঁ, ঠিক তাই। পোয়ারো আমার কথায় সায় দিয়ে বলে ওঠেন, তবে সে কাজ বড় নিষ্ঠুর, বড় অমানুষিক। এক কথায় ঠাণ্ডা মাথায় খুন। বড় নিষ্ঠুর হত্যা, অবশ্যই।
একটু থেমে পোয়ারো তার কথার জের টেনে আবার বলতে থাকেন, তার একটা কথা বড় অদ্ভুত বলে মনে হয়েছে আমার কাছে। আমি জানি তুমি কেন এখানে এসেছ। আপনাকে ওঁর এ কথা বলার কী অর্থ হতে পারে ভেবে দেখেছেন?
না, সহজভাবেই বললাম আমি, আমি ঠিক বুঝতে পারিনি।
আমি আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি মাদাম। আপনার এখানে আসার কারণটা সবাই যা জানে, মিসেস মারকাড়ো সেটা বিশ্বাস করতেন না। তার ধারণা ছিল, আপনার এখানে আসার পিছনে অন্য কোন বিশেষ কারণ ছিল। কী সেই কারণ? যার জন্য আপনার এখানে আসার মুহূর্ত থেকে তিনি আপনার উপরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে গেছেন!
কে জানে, আমি একটু বিরক্ত হয়েই একটা রূঢ় কথা বলে ফেললাম, মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার যতদূর মনে হয়, তাকে ঠিক লেডির পর্যায় ফেলা যায় না।
কিন্তু মাদাম, ওটা ঠিক উত্তর হল না।
পোয়ারোর কথার রহস্যটা আমি ঠিক অনুধাবন করতে পারলাম না। কিছু বোঝবার আগেই তিনি আবার বলতে শুরু করে দিলেন। প্রসঙ্গ এবার অন্য। অন্য মন, অন্য লোক।
আর অন্য সদস্যদের সম্বন্ধে আপনার কী ধারণা নার্স?
মিস জনসনের কথাই ধরা যাক না কেন, আমার তো মনে হয়, মিসেস লিডনারকে তিনি খুব একটা ভাল চোখে দেখতেন না। তবে ডঃ লিডনার-এর প্রতি তিনি খুব অনুরক্ত ছিলেন। খুবই স্বাভাবিক, বহু বছর এক সঙ্গে ওঁরা দুজন কাজ করেছেন, অনুরাগ থাকারই কথা। তবে লিডনারদের বিয়েটাই পরিবর্তন এনে দেয় তাদের মধ্যে, হয়তো সেইজন্যই মিস জনসন মিসেস লিডনারের প্রতি অমন বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন।
হ্যাঁ, পোয়ারো আমার কথায় সায় দিয়ে বলেন, হয়তো মিস জনসনের কাছে ওঁদের বিয়েটা গ্রহণীয় নয়। ওঁর সঙ্গে ডঃ লিডনারের বিয়েটা বোধহয় ঠিক হতো।
হ্যাঁ, যা বলেছেন, আমি স্বীকার করলাম, কিন্তু একশোর মধ্যে বোধহয় একজোড়া বিবাহিত দম্পতি সুখী হয় না। তবে সত্যি কথা বলতে কি এর জন্য ডঃ লিডনারকে কেউ দোষ দিতে পারে না। মিস জনসন, বেচারি দেখতে তেমন আহামরি বলে কিছু নয়। তার তুলনায় মিসেস লিডনার, বয়স হলেও যে কোন যুবতী নারীর চেয়ে বেশি সুন্দরী, রীতিমতো চোখ ধাঁধিয়ে দিতেন পুরুষদের। সত্যি ওই বয়সেও পুরুষদের আকর্ষণ করার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখতেন। মনে পড়ে মিঃ কোলম্যান বলতেন, মিসেস লিডনারের রূপের আগুনে প্রলোভিত পুরুষরা নিজেদের মরণ জেনেও ঝাঁপ দিতে কসুর করতো না। তার রূপ সম্বন্ধে আমার এই উপস্থাপনায় হয়তো আপনি হাসবেন, কিন্তু আমি আবার বলছি, তার মধ্যে একটা অপার্থিব এমন কিছু ছিল, যা দেখে মুগ্ধ না হয়ে থাকা যেত না।
হুঁ! পোয়ারো ছোট্ট করে মাথা নাড়লেন।
তবে আমার মনে হয় না, মিঃ ক্যারির সঙ্গে তার সম্পরটা খুব একটা মধুর ছিল। আমার ধারণা, মিঃ জনসনের মতো মিঃ ক্যারিও ঈর্ষাপরায়ণ ছিলেন। সব সময় মিসেস লিডনারের প্রতি তার মনোভাব ছিল অনমনীয় আর মিসেস লিডনারও তাকে সেই চোখেই দেখতেন। তিনি তাঁর স্বামীর পুরনো বন্ধু ছিলেন অবশ্যই, তবে ওই যে প্রবাদ আছে, কিছু কিছু মহিলা আছেন যাঁরা তাঁদের স্বামীর পুরনো বন্ধুদের কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না।
বুঝতে পারছি, আর সেই তিনজন যুবক? কোলম্যান, আপনার কথা থেকে ধরে নেওয়া যায়, ছেলেটির কাছে মিসেস লিডনার যেন একটি কবিতা ছিলেন। ঠিক তাই না?
আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না।
এ এক হাস্যকর ব্যাপার মঁসিয়ে পোয়ারো, হাসতে হাসতে বললাম, নিতান্ত যুবক সে।
আর অন্য দুজন?
মিঃ এমাটের ব্যাপারে সত্যি আমার বিশেষ কিছু জানা নেই। শান্তশিষ্ট মানুষ কথা বলেন কম। তাঁর কাছে মিসেস লিডনারও ছিলেন অতি চমৎকার মহিলা। আর মিসেস লিডনারও ছিলেন তাঁর প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন, আদর করে তাকে ডেভিড বলে ডাকতেন, মিস রেলির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করতেন। ওঁদের দুজনের সম্পর্কটা ছিল ঠিক এই রকম।
আর মিঃ রেইটার?
তাঁর সঙ্গে মিসেস লিডনারের সম্পর্কটা খুব একটা ভাল ছিল না। ধীরে ধীরে বললাম, প্রায়ই মিসেস লিডনার তার সঙ্গে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ করে কথা বলতেন।
তাতে সে কিছু মনে করত না?
বেচারা! মুখ লাল করে ফিরে যেত।
রেইটারের প্রতি আমার দুঃখবোধ থেকে হঠাৎ কেন জানি না একটা নিষ্ঠুর সত্য কথা আমার মনে উদয় হল। ঠাণ্ডা মাথায় সে খুন করেনি তো? সেই সম্ভাবনার কথাটা মনে হতেই আমি চমকে উঠলাম, তবে আমার মনের কথাটা প্রকাশ করলাম না পোয়ারোর কাছে।
মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি মৃদু চিৎকার করে উঠি, সত্যি কী ঘটেছে বলে আপনার মনে হয়?
চিন্তিত মুখ পোয়ারোর। ধীরে ধীরে মাথা দোলালেন।
তার আগে বলুন, আজ রাতে সেখানে ফিরে যেতে আপনার ভয় হচ্ছে না?
ওহো, না না, আমি বললাম, অবশ্য আপনার কথা আমার মনে আছে। কে, কে আমাকে খুন করতে পারে মঁসিয়ে পোয়ারো?
আমার মনে হয় না কেউ আপনাকে খুন করতে পারে, ধীরে ধীরে বললেন পোয়ারো, আপনাদের কাছ থেকে এমনি আশঙ্কার কথা আমি আশা করছিলাম। কিন্তু আমি নিশ্চিত, আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদ।
কেউ যদি বাগদাদে আমাকে বলত– কথা বলতে গিয়ে মাঝ পথে থামলাম।
মিস রেলি দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলেন, হাতে র্যাকেট, টেনিস খেলে ফিরছে ও।
হাসানিয়েয় পৌঁছেই ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল পোয়ায়োর।
আমার কুশল সংবাদ নিয়ে পোয়ারোর দিকে ফিরল ও, মঁসিয়ে পোয়ারো, হত্যা রহস্যের ব্যাপারে কতদূর এগুলেন বলুন!
খুব বেশি এগুতে পারিনি।
যাইহোক, বিপদের হাত থেকে নার্সকে রক্ষা করতে পেরেছেন দেখতে পাচ্ছি।
নার্স লিথেরানের কাছ থেকে আমি এক্সপিডিসনের সদস্যদের সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগ্রহ করেছি। প্রসঙ্গক্রমে নিহত মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে অনেক অজানা খবর এখন আমার হাতের মুঠোয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, নিহত ব্যক্তিই সেই খুনের কেসে একটা উল্লেখযোগ্য ক্লু হয়ে উঠেছে।
এ আপনার বুদ্ধিরই পরিচয় মঁসিয়ে পোয়ারো, মিস রেলির কথায় আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া, মিসেস লিডনার খুন হওয়ার মতই মহিলা ছিলেন।
মিস রেলি? রাগে, উত্তেজনায় আমি চিৎকার করে উঠলাম, এ আপনি কী বলছেন?
থামল সে, তার হাসিটা কেমন কুৎসিত বলে মনে হল আমার।
নার্স লিথেরান, আপনি হয়তো সত্য ঘটনা জানেন না বলেই এমন আশ্চর্য হচ্ছেন। আর পাঁচজনের মত আমার এই স্পষ্ট কথাগুলো আপনার কানে ঔদ্ধত্যের মত শোনাচ্ছে। পেটে খিদে, মুখে লাজের মত স্বভাব আমার নয়, আমি স্পষ্ট বক্তা। তারপর সে পোয়ারোর দিকে ফিরে বলে, মঁসিয়ে পোয়ারো, এই প্রথম বোধহয় আপনাকে অসাফল্যের মালা ঝোলাতে হবে গলায়। আমি চাই না মিসেস লিডনারের খুনী ধরা পড়ুক।
মেয়েটি ক্রমশঃ আমার বিরক্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। জানি না, পোয়ারো তার কথাগুলো কিভাবে নিচ্ছিলেন।
তাহলে, পোয়ারো এই প্রথম মুখ খুললেন, মনে হচ্ছে, গতকাল অপরাহ্নের ঘটনার ব্যাপারে আপনার এ্যালিবি আছে, আছে না?
মুহূর্তের নীরবতা, হাতের র্যাকেট খসে পড়ে যায় তার মেঝের উপরে। কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। ঢিলে-ঢালা স্ন্যাক্স আঁটো করার খেয়াল নেই এখন তার। তারপর সে এক নিঃশ্বাসে কথা বলে গেল, ও হা, আমি তখন ক্লাবে টেনিস খেয়াল বস্ত ছিলাম। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মিসেস লিডনারকে আপনি ঠিক চেনেন না। চিনলে আপনার ধারণা বদলে যেত নিশ্চয়ই।
আবার সেই অদ্ভুত চোখে তাকালেন পোয়ারো, আপনি আমাকে সব খুলে বলতে পারেন?
একটু ইতস্ততঃ করে সে আবার মুখ খোলে। কিন্তু তার কথার মধ্যে কেমন বোকা বোকা ভাব, সৌন্দর্যের অভাব, সেটা আমাকে ভীষণ পীড়া দিচ্ছিল।
মৃত লোক, সে যতই খারাপ হোক না কেন, তার সমালোচনা করা মানবিক দিক থেকে বাঞ্ছনীয় নয়। আমি মনে করি, এ অন্যায়, এ পাপ। সত্য সব সময়ই সত্য। সত্য কখনো গোপন থাকে না। তবে তাই বলে জীবিত লোকের ব্যাপারে মুখ না খোলাই ভাল। তাতে তার ক্ষতি হতে পারে, মৃত্যু এখন অতীত। শেক্সপীয়রের সেই বিখ্যাত উক্তিটা এক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক নয় বলেই মনে হয়। তেল ইয়ারিমাহর সেই ভয়ঙ্কর আবহাওয়ার কথা কী নার্স আপনাকে বলেছে? এখানে এখন সবাই সবাইকে ঘৃণার চোখে দেখে, শত্রু বলে মনে করে। এর জন্য দায়ী লুসি লিডনার। তিন বছর আগে আমার অল্প বয়সেই অনুভব করতে পারতাম, তখন তারা সবাই বেশ সুখে শান্তিতে ছিল, এমন কি গত বছরেও সেই সুখী পরিবারে ব্যাঘাত ঘটতে দেখেনি। কিন্তু এই বছর তাদের মধ্যে হঠাৎ কেমন রেষারেষি মনোমালিন্য শুরু হয়ে যায়। আমার ধারণা, এর জন্য মিসেস লিডনারই দায়ী ছিল। কাউকে সুখে থাকতে দিতে চাইতেন না, তার মনোভাব ছিল এমনই। আর তার একটা বাজে অভ্যাস ছিল, পুরুষদের মন নিয়ে ছিনিমিনি খেলা খেলতে ভালবাসতেন ভীষণ। উঃ! কি সাংঘাতিক মহিলা তিনি–
মিস রেলি? আমি আর চুপ করে থাকতে পারলাম না। তাকে বাধা দিয়ে বললাম, আমার মনে হয়, এসব সত্য নয়। সত্যি কথা বলতে কি, এ সব সত্যি নয় বলেই আমি এমন জোর দিয়ে বলতে পারছি।
কিন্তু শীলা রেলি আমার কথায় কান দিল না। নিজের কথায় নিজেই ব্যস্ত সে তখন। শুনেছি ডঃ লিডনার নাকি তাঁর স্ত্রীকে দেবীর মত পুজো করতেন। তাতেও খুশি ছিলেন না মিসেস লিডনার। মার্কোডার মত ইডিয়ট, যার ব্যক্তিত্ব বলে কিছু নেই, তাকে তিনি বশ করেছিলেন, বোকা বানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করতেন। তারপর তিনি বিলকেও তার মোহজালে জড়িয়ে ফেলেন ধীরে ধীরে। আর কার্ল রেইটার? মিসেস লিডনার নাকি তাকে কোনদিন সুনজরে দেখেননি। তাকে অত্যাচার করে একটা বিজয়ীর আনন্দ অনুভব করতেন। একধরনের মহিলা আছেন, যারা পুরুষদের উপরে প্রভুত্ব করে সুখ পায়, মিসেস লিডনার ছিলেন সেই ধরনের মহিলা। কিন্তু ডেভিড ছেলেটি খুব বুদ্ধিমান। মিসেস লিডনারের প্রতি সে আকর্ষণ বোধ করলেও নিজের সম্বন্ধে খুব সচেতন ছিল সে। তাছাড়া তাকে খুব একটা পাত্তাও দিত না সে। তিনি যে কি ধরনের মহিলা তার জানা হয়ে গিয়েছিল।
শীলার কথাগুলো আমার গায়ে তীরের মতো বিঁধছিল। মিসেস লিডনারের অমন জঘন্য ব্যবহারের জন্যই শীলা নাকি তাকে ঘৃণা করত। অবুঝ মহিলা। কারোর বন্ধুত্ব তার কাম্য ছিল না, একজনের বিরুদ্ধে অন্য আর একজনকে লড়িয়ে দিয়েই তৃপ্তি পেতেন তিনি। জীবনে কারোর সঙ্গে তিনি ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হননি, কিন্তু তিনি যেখানেই গেছেন ঝগড়ার সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। তার নাটকের প্রয়োজন ছিল, কিন্তু সেই নাটকে তিনি নিজেকে জড়াতে চাইতেন না। ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো।
বুঝলেন মঁসিয়ে পেয়ারো, এর থেকেই বুঝতে পারবেন, কি অদ্ভুত প্রকৃতির মহিলা ছিলেন এই মিসেস লিডনার।
না, আপনি দেখছি আমার থেকে অনেক বেশি ভাল বুঝেছেন পেয়ারের কথায় রাগ ও ঘৃণার সুর ঝঙ্কার তুলছিল তখন।
শীলা রেলি বোধহয় পোয়ারোর মনোভাব আন্দাজ করতে পেরেছিল। তাই সঙ্গে সঙ্গে সে বলে উঠল, আপনি যা ভাল বোঝেন, তাই মনে করুন। কিন্তু তার সম্বন্ধে আমার ধারণা অভ্রান্ত, তাতে কোন ভুলচুক নেই।
আর তার স্বামী? পোয়ারো জিজ্ঞেস করলেন, তার সঙ্গে মিসেস লিডনারের সম্পর্কটা কিরকম ছিল মিস রেলি?
স্বামীকে ঠিক আঘাত দিতে চাননি তিনি, ধীরে ধীরে মিস রেলি বলে, অন্তত সেরকম কিছু আমার চোখে পড়েনি। বরং স্বামীর প্রতি তিনি সদয় ছিলেন। আমার ধারণা, ডঃ লিডনার তার খুব প্রিয় ছিল। আগেই বলেছি, ডঃ লিডনার তার স্ত্রীকে দেবীর মতো পুজো করতেন, শ্রদ্ধা করতেন। মনে হয় তাতে কোন মহিলা ক্রুদ্ধ হয়ে থাকবে। কিন্তু মিসেস লিডনারের তাতে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই। যে কোন জ্ঞানী লোকের চোখে ডঃ লিডনার মুখের স্বর্গে বাস করছেন বলে মনে হবে। কিন্তু তবু ডঃ লিডনারের কাছে মূখের স্বর্গ বলে মনে হয় না, কারণ মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে তার ধারণা ছিল অন্য। যদিও অন্য কারোর পক্ষে সেটা অনুমান করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তার মনে ঠিক কি ছিল–
এখানে এসে শীলা থামল।
থামলেন কেন বলুন তারপর– পোয়ারো তাড়া দিলেন।
শীলা হঠাৎ আমার দিকে ফিরল।
একটু আগে রিচার্ড ক্যারির ব্যাপারে কী যেন মন্তব্য করলে তুমি?
মিঃ ক্যারি সম্বন্ধে? আমি অবাক হলাম।
মিসেস লিডনার এবং ক্যারিকে কেন্দ্র করে।
ঠিক আছে, প্রত্যুত্তরে আমি বললাম, আমি আবার বলছি, মনের দিক থেকে তারা খুব বেশিদূর এগোননি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল শীলা।
খুব বেশিদূর এগোননি তিনি? আপনি বোকা, তাই কিছু বোঝেন না। ক্যারি তাঁর প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন। তাঁর মন বলে কোন পদার্থ ছিল না কারণ ডঃ লিডনারের মত তিনিও তাকে অন্ধ হয়ে পুজো করতেন। ক্যারি তাদের দীর্ঘ দিনের পরিবারের বন্ধু। অবশ্য তাতে তার বাড়তি সুবিধা হয়েছিল। তাদের দুই বন্ধুর মাঝে ধূমকেতুর মত উদয় হন তিনি। তাই আমার মনে হয়েছিল।
কী?
শীলার চোখে ভ্রুকুটি। কি যেন ভাববার চেষ্টা করছিল সে।
আমার মনে হয়েছিল, এ ব্যাপারে তিনি অনেক দূর এগিয়েছিলেন। পুরুষ হিসাবে ক্যারি অত্যন্ত আকর্ষনীয়। মিসেস লিডনার ঠাণ্ডা মাথায় শয়তানি করতেন। কিন্তু আমার মনে হয়, ক্যারির সংস্পর্শে এসে তার সেই স্বভাবের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে থাকবে।
ছিঃ ছিঃ, মিসেস লিডনারের সম্বন্ধে–এসব উক্তি মানহানিকর। রাগে তখন আমার মাথা গরম হয়ে উঠেছিল, এ সব কথার কোন মানে হয় না, এঁদের মধ্যে খুব কমই কথাবার্তা হত।
তাই নাকি? শীলা সঙ্গে সঙ্গে আমার দিকে ফিরে তাকায়, শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে যাবে না নার্স, আপনি জানেন, সব জানেন। মিঃ ক্যারি এবং মিসেস লিডনার বাড়ির বাইরে গিয়ে মিলিত হতেন, বলুন, এ খবর আপনি জানেন কিনা? বলুন, ফুলের বাগানে কিংবা নদীর ধারে তাদের দুজনকে এক সঙ্গে দেখা যায়নি কি না?
একটু থেমে পোয়ারোর দিকে তাকাল শীলা।
মঁসিয়ে পোয়ারো, পোয়ারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমি বললাম, আমি ওঁর একটা কথাও বিশ্বাস করি না। আপনি করেন?
আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন পোয়ারো। (তার চাহনিটা কেমন সন্দেহজনক বলে আমার মনে হল),–এই কেসের উপরে মিস রেলি যে নতুন করে আলোকপাত করলেন, আপনি তা অস্বীকার করতে পারেন না নার্স।
.
১৯.
নতুন করে অবিশ্বাস
সেই মুহূর্তে ডঃ রেলি ঘরে প্রবেশ করার জন্য আমরা আর বেশি আলোচনা করতে পারলাম না। তিনি এবং পোয়ারো মনস্তত্ব এবং মিসেস লিডনারকে লেখা সেই বেনামা চিঠিগুলো নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন হলেন। ডঃ রেলি কতকগুলো জটিল রোগের প্রসঙ্গ তুললেন এবং পোয়ারো তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে কতকগুলো চমকপ্রদ কাহিনীর প্রসঙ্গ তুললেন।
ব্যাপারটা যতটা সহজ বলে মনে হয়, ঠিক তা নয়, প্রসঙ্গের জের টানতে গিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ক্ষমতার লড়াই এবং অত্যন্ত হীনমন্যতার প্রকাশ আমি দেখেছি।
ডঃ রেলি মাথা নাড়লেন।
আর তাই বুঝি আপনার শেষ সন্দেহভাজন ব্যক্তিই হল সেই চিঠিগুলোর বেনামা লেখক?
চিন্তার ফসল ফলালেন পোয়ারো তাঁর কথায়, আপনি কী তাহলে বলতে চান, মিসেস লিডনারের মধ্যে হীনতাভাবের ঝোঁক ছিল?
উঃ রেলি মুখ থেকে পাইপটা সরালেন।
পৃথিবীর শেষতম মহিলা হিসাবে আমি এই ভাবেই বর্ণনা করব। তার সম্বন্ধে সংযত হওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। জীবন, আরও সুখের জীবন, এই ছিল তার কাম্য এবং পেয়েছিলেন তিনি।
মনস্তত্বের দিক থেকে বলতে গেলে, আপনারা কী মনে করেন, সেই চিঠিগুলো তিনি লিখেছিলেন?
হ্যাঁ, আমি তাই মনে করি বৈকি। কিন্তু এর কারণ কী? কেন এই নাটকের অবতারণা? নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে হচ্ছে? আমি খবর নিয়ে জেনেছি, মিসেস লিডনারের জীবনে বহু চিত্রাভিনেতা এসেছে। তিনি চেয়েছিলেন তাদের মধ্যমণি হবেন নিজেকে লাইমলাইটে নিয়ে এসে। ডঃ লিডনারের সঙ্গে তার দ্বিতীয় বিবাহ অসম, তার স্বামী তখন অবসরের বুড়ি প্রায় দুই ছুঁই, তবে স্বামী হিসাবে আদর্শ বলা যেতে পারে। স্ত্রীর আদর-যত্নের ত্রুটি রাখতেন না। বৃদ্ধস্য তরুণী ভার্যা হলে যা হয় তাই আর কি। কিন্তু মিসেস লিডনারের তাতে মন ভরত না। তার চাহিদা ছিল পর্বত প্রমাণ। ছায়াচিত্রের নায়িকা হবার বাসনা তাকে পেয়ে বসেছিল তখন।
সত্যি কথা বলতে, পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন মিসেস লিডনার সেই সব চিঠিগুলো নিজে লিখেছিলেন, কিন্তু পরে সে কথা তার মনে ছিল না, ডঃ লিডনারের এই মতবাদ আপনি সমর্থন করেন না?
না, আমি তা মনে করি না। ডঃ লিডনার যা মনে করেন, তা, সত্যি নয়। কারণ কোন স্বামী তার স্ত্রীর অমন নির্লজ্জ অভিনয় বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করে না। সত্যি কথা বলতে কি কোন স্বামীকে তার স্ত্রীর সম্বন্ধে সত্য কথা না বলাই ভাল, কারণ স্ত্রীর খারাপ দিকটা সে সহ্য করতে পারে না। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, বেশির ভাগ স্ত্রী তার স্বামীকে মাতাল, অবিশ্বাসী জেনেও কেমন আনায়াসে তাকে গ্রহণ করে নেয়। বাস্তবিক নারী জাতির মতো বাস্তববাদী মানুষ বোধহয় কেউ হতে পারে না।
সত্যি করে বলুন তো ডঃ রেলি, মিসেস লিডনারকে আপনার কী রকম মনে হয়?
ডঃ রেলি চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। ধীরে ধীরে পাইপ টানতে টানতে কী যেন ভাবছিলেন, বোধহয় মনে মনে উত্তরটা তৈরি করে নিচ্ছিলেন তিনি। একটু পরে মুখ থেকে পাইপটা নামিয়ে কথা বলতে শুরু করলেন।
সত্যি কথা বলতে কি ওঁর সম্বন্ধে কোন মতামত প্রকাশ করা খুব মুশকিল। তাছাড়া ওঁর সম্বন্ধে আমি কতটুকুই বা জানি। তবে ওঁর সম্বন্ধে যেটুকু জানি বলতে পারি, উনি ছিলেন সুন্দরী, বুদ্ধিমতী, সহানুভূতিশীলা তবে কেন জানি না সব সময় আমার একটা কথা মনে হত (কিন্তু তার প্রমাণ আমার হাতে ছিল না।), তিনি ছিলেন একজন মার্জিত রুচিসম্পন্না মিথ্যাবাদী। কিন্তু যে কথাটা আমি জানতাম না (জানতে খুব ইচ্ছা হয়) তা হল, তার সেই সব মিথ্যাভাষণ কী নিজের কাছে কেবল, না অন্য লোকদের উদ্দেশ্যেও? মেয়েরা জন্ম-অভিনেত্রী, মিথ্যাভাষণে পটু, অস্বীকার করি না। তবে আমি মনে করি না, পুরুষ-শিকারী ছিলেন তিনি। পুরুষদের সঙ্গে মেলামেশা করতেন খেলোয়াড়ী মনোভাব নিয়ে, তার বেশি কিছু নয়। যাইহোক, এ ব্যাপারে আপনি যদি আমার মেয়ের সঙ্গে–
আপনার মেয়ের সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগ আগেই আমরা পেয়েছি, পোয়ারো হাসতে হাসতে বললেন।
তাই নাকি? ডঃ রেলি বলেন, আশাকরি, আপনাদের সময় খুব বেশি নষ্ট করেনি ও। তবে ওর কথাবার্তা একটু চাঁচাছোলা গোছের। আজকের যুবক-যুবতীরা মৃত্যুর ব্যাপারে ভাবপ্রবণতার কোন ধার ধারে না, রুচিবাগীশ হয় সাধারণতঃ। তারা পুরনো সংস্কার সব বাতিল করে দিয়ে নিজেদের নতুন মতবাদ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে থাকে। মিসেস লিডনার-এর কার্যকলাপে ওর হয়তো সমর্থন থাকত। কিন্তু মিসেস লিডনারের নাটুকেপনাটা ও সহ্য করতে পারত না। বিড়াল ইঁদুর দেখলেই তাড়া করবে, এ যে সহজাত প্রবৃত্তি। মিসেস লিডনারের ব্যপারটাও যেন কতকটা তাই। পুরুষরা বাচ্ছা ছেলে নয় যে, তাদের সব সময় চোখে চোখে রাখা যায়। মেয়েদের সঙ্গে তারা মিশবেই, তার উপর মেয়েদের কাছ থেকে প্রশ্রয় পেলে তো আর কথাই নেই। জীবনটা হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র, পিকনিক করার স্থান নয়। লিডনারকে ঘৃণা করার যথেষ্ট কারণ দিল শীলার। মাঝবয়সী ওই ভদ্রমহিলা, বিশেষ করে যাঁর জীবনে দু-দুটির স্বামীর আগমন ঘটেছিল, তার অমন আগুন নিয়ে খেলাটা পছন্দ করত না শীলা। চমৎকার মেয়ে এই শীলা, রীতিমতো সুন্দরী এবং পুরুষদের আকর্ষণ করার মত রূপ আছে ওর। কিন্তু মিসেস লিডনারের ভাবগতিক ছিল অন্য রকম। তাৎক্ষণিক চাতুরির খেলায় নিজেকে ভাসিয়ে দিতে বিশ্বাসী ছিলেন তিনি।
চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলাম আমি–ডঃ রেলির এ কথায় মধ্যে কী কোন অর্থ লুকিয়ে থাকতে পারে?
আপনার মেয়ে, কথাটা অসমীচীন হবে না, সম্ভবতঃ এখানকার কোন একটি যুবককে নিজের আপনজন বলে নির্বাচন করে ফেলেছে। এ কথা কী সত্য?
না না না আমি তা মনে করি না। এমাট এবং কোলম্যান ওর নাচের সঙ্গী। আমার তো মনে হয় না, তাদের কাউকে ও পছন্দ করে। তারা ছাড়া বিমান বাহিনীর কয়েকজন সুপুরুষ যুবকও আছে এখানে। আমার ধারণা, তারা সবাই শীলার জালে ধরা পড়তে পারে মাছের মতো। কিন্তু না, তাদের ধরে রাখার কলাকৌশল বোধহয় তার জানা ছিল না। আমার মনে হয় সেই বয়সে যৌবনের অমন বিপর্যয়টা শীলার বিরক্তির কারণ। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীটাকে আমার থেকে বেশি ভাল বোধহয় শীলা জানতো না। শীলা সুন্দরী মেয়ে হতে পারে, কিন্তু লুসি লিডনার ছিলেন রূপসী, অপরূপা! উজ্জ্বল চোখ দুটি তার কি অপূর্বই না ছিল। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন সত্যি-রূপসী, অপরূপা!
হ্যাঁ, ডঃ রেলি ঠিকই বলেছেন, সে কথা আমিও ভেবেছি অনেকবার। লুসি লিডনারের চোখ ধাঁধানো অমন রূপ দেখে সত্যি হিংসা করতে হয়। তাকে প্রথম দিন দেখেই এ কথা আমার মনে হয়েছিল। সেই রাত্রেই আমার মনে বার বার উঁকি দিতে থাকে, কেমন অস্বস্তিবোধ করতে থাকি। এক সময় শীলার কথাগুলো আমি বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করিনি, আমার তখন মনে হয়েছিল, আর পাঁচটা হিংসুটে মেয়েদের মতো ও বোধহয় মিসেস লিডনারের নামে মিথ্যা কুৎসা রটাচ্ছে।
কিন্তু এখন হঠাৎ আমার একটা দিনের কথা মনে পড়ে গেল। শেষ অপরাহ্নের আলো এসে পড়েছিল কোর্টইয়ার্ডে। মিসেস লিডনারকে কেমন চঞ্চল বলে মনে হচ্ছিল। একটু পরেই জানতে পারলাম, তিনি একা একা ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াতে চান। আমি তাকে বার বার অনুরোধ করলাম, এ সময় আপনার একা একা বাইরে কোথাও যাওয়া উচিৎ নয়, তাই আমি আপনার সঙ্গে যেতে চাই। কিন্তু আমার কথায় তিনি কান দিলেন না, একাই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়লেন। এখন মনে হচ্ছে, সেদিন তিনি গোপনে মিঃ ক্যারির সঙ্গে মিলিত হতে যাননি তো? হ্যাঁ, এখন মনে হচ্ছে তারা দুজনে কি রকম অন্তরঙ্গ সুরে কথা বলতেন যেন। অন্যদের তিনি ক্রিশ্চিয়ান নাম ধরে ডাকতেন, কিন্তু মিঃ ক্যারির বেলায় তা করতেন না, কেন এই পার্থক্য?
মিঃ ক্যারিকে কখনো তার দিকে সরাসরি তাকাতে দেখিনি, হয়তো তিনি মিসেস লিডনারকে ঘৃণা করতেন, কিম্বা এর ঠিক বিপরীতও হতে পারে।
আজ আমি বুঝতে পারছি, শীলার রাগের কারণ। ভিতরে ভিতরে ক্রুদ্ধ না হলে কেউ হঠাৎ অমন করে ফেটে পড়ে না।
অবশ্য এ কথাও ঠিক যে, মিসেস লিডনার ওকে সুনজরে দেখতেন না। মিঃ এসোটের সম্মানার্থে সেদিন মধ্যাহ্নভোজের দিন শীলার প্রতি ওঁর অমন দুর্ব্যবহারটা মোটেই দৃষ্টিনন্দন নয়। আজ বুঝতে পারছি, শীলার কোন অপরাধ ছিল না। হতে পারে এসোট ওর দিকে যে ভাবে তাকিয়ে ছিল, সেটা অনুরাগ ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যায় না। সম্ভবত সে কিছু ভাবছিল। মিঃ এসোটের ভাবনার কথা কেউ হদিশ করতে পারে না। এমনি চাপা স্বভাবের মানুষ সে। তাবে মানুষ হিসাবে চমৎকার সে। সত্যি কথা বলতে কি তার উপরে নির্ভর করা যায়।
কিন্তু মিঃ কোলম্যানের মত অমন বোকা লোক আমি কখনো দেখিনি। আমরা যখন সেখানে পৌঁছলাম, তখন রাত নটা বেজে গেছে। দরজায় তালা লাগানো ছিল। ইব্রাহিম তার চাবির গোছা নিয়ে ছুটে এল আমাকে ভিতরে আহ্বান করার জন্য।
একটু তাড়াতাড়ি আমরা যে যার বিছানায় চলে গেলাম। বসবার ঘর অন্ধকার। ড্রইং-অফিস এবং ডঃ লিডনারের অফিস ঘর থেকে আলো চুঁইয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছিল, তবে অন্য সব জানালাগুলো অন্ধকারে ডুবে ছিল।
আমরা ঘরে যাবার জন্য ড্রইং-অফিসের পাশ দিয়ে দেখলাম, মিঃ ক্যারি তখনো একটা বিরাট প্ল্যানের উপরে ঝুঁকে পড়ে কি যেন নিরীক্ষণ করছেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। আমার মনে হল, তাকে খুব ক্লান্ত বিষণ্ণ দেখাচ্ছিল। তাঁর অমন রূপ আমি তার আগে কখনো দেখিনি। তাঁর দিন যেন সীমিত, আমি কি বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই।
মুখ ঘোরাতেই তিনি দেখতে পেলেন আমাকে। মুখ থেকে পাইপ সরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, হাসানিয়ের থেকে ফিরে এলেন?
হ্যাঁ, মিঃ ক্যারি, কিন্তু আপনি এত রাত পর্যন্ত কাজ করছেন? এখন সবাই প্রায় ঘুমে অচৈতন্য।
আগামীকাল থেকে খনন কার্য আবার শুরু হচ্ছে। তাই করণীয় কাজগুলো দেখে নিচ্ছি।
এত তাড়াতাড়ি? আমি চমকে উঠলাম।
অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকালেন তিনি।
এ অবস্থায় ঘরে বসে এ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে কী লাভ? ব্যাপারটা ডঃ লিডনারের উপর ছেড়ে দিয়েছি। আগামীকাল বেশিরভাগ সময় তিনি হাসানিয়েয় থাকছেন। বাকী আমরা সবাই এখানে থাকছি।
ভুল বলেন নি তিনি। আমি তার বক্তব্য সমর্থনে বললাম, এক হিসাবে আপনি ঠিকই বলেছেন, বাড়িতে চুপচাপ বসে থেকে কোন লাভ নেই। কাজের মধ্যে দিয়ে ভুলে থাকা যাবে।
আমি জানতাম পরের দিনের পরদিন মিসেস লিডনারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা হতে যাচ্ছে।
মিঃ ক্যারি আবার তার প্ল্যানের উপরে ঝুঁকে পড়লেন। কেন, আমি তা জানি না। তবে তার জন্য কেন জানি না আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছিল। আমার মনে হল, আজ রাতে তিনি আর ঘুমাতে যাচ্ছেন না।
মিঃ ক্যারি, আপনার ঘুমের ট্যাবলেট দরকার?
মাথা নাড়লেন তিনি, মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়াটা বদ অভ্যাস। রাতটা আমি কাটিয়ে দিতে পারব।
তাহলে শুভরাত্রি মিঃ ক্যারি, চলে আসবার সময় বললাম, যদি কোন প্রয়োজন হয় তো বলবেন আমাকে
ধন্যবাদ নাস, অমন চিন্তা মনে আনবেন না। শুভ-রাত্রি।
আমি অত্যন্ত দুঃখিত মিঃ ক্যারি, বিশেষ করে আপনার জন্য আমি ভীষণ চিন্তিত।
আমার জন্য? কিন্তু কেন?
কারণ আপনি ওঁদের দুজনেরই বন্ধু ছিলেন বলে।
ডঃ লিডনারের আমি পুরানো বন্ধু হতে পারি, কিন্তু মিসেস লিডনারের নয়।
মিঃ ক্যারি কথাটা এমন ভাবে বললেন, যেন প্রকৃতপক্ষে মিসেস লিডনারকে তিনি দারুণ ভাবে ঘৃণা করেন, তার বন্ধুত্ব তিনি স্বীকার করতে চান না। আমার খুব ইচ্ছা হচ্ছিল, মিস রেলি যেন তার কথাটা শুনে থাকে।
শুভ রাত্রি, বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে দ্রুত পায়ে আমি আমার ঘরে চলে এলাম।
পোশাক বদলে বিছানায় দেহটা এলিয়ে দেবার তোড়জোড় করেছিলাম, ডঃ লিডনারের অফিস ঘরে আলো তখনো জ্বলতে দেখে ভাবলাম, একবার ওকে শুভ-রাত্রি জানিয়ে এলে কেমন হয়! একটু ইতস্ততঃ করলাম, তিনি যদি অসন্তুষ্ট হন, এ সময় তার কাজের মধ্যে তাকে বিরক্ত করলে? কিন্তু পরমুহূর্তেই আমি মনস্থির করে ফেললাম, শুভ রাত্রি জানালে কোন ক্ষতি নেই। স্রেফ একবার শুভ-রাত্রি জানিয়ে তাকে জিজ্ঞসা করে আসব, তার কোনো প্রয়োজনে তিনি যেন আমাকে ডাকেন।
কিন্তু ডঃ লিডনার তাঁর অফিসঘরে ছিলেন না। ঘরের আলো জ্বললেও মিস জনসন ছাড়া সেখানে কেউ ছিলেন না। টেবিলের উপরে মাথা রেখে কাঁদছিল সে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মিস জনসনকে এ ভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখে কেমন অবাক হলাম। তাহলে?
কি হয়েছে মিস জনসন? তার পিঠে সান্ত্বনার হাত বুলোতে গিয়ে শুধালাম, এখন এভাবে ভেঙ্গে পড়লে, চলবে না। ওঠো, কেঁদো না।
মিস জনসন আমার কথার উত্তর দিল না। বরং সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
শোনো এ ভাবে কেঁদো না, শান্ত হও, আমি তোমার জন্য চা তৈরি করে নিয়ে আসছি।
এবার সে মাথা তুলে তাকাল। না, না, আমি ঠিক আছি নার্স। বোকার মত আমি-
তুমি এভাবে ভেঙ্গে পড়লে কেন?
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় না সে, পরে এক সময় সে বলে, সে বড় ভয়ঙ্কর, বড়-
এখন, এসব কথা চিন্তা করো না, আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, যা হবার হয়ে গেছে, ভুল তত আর সংশোধন করা যাবে না।
মিস জনসন এবার সোজা হয়ে বসল। চুলে বিলি কাটতে কাটতে সে বলে, আমি কী বোকা? অফিসঘর পরিষ্কার করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করছিলাম। তারপর হঠাৎ ধূমকেতুর মতো–
হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি জানি বৈকি। আমি তাড়াতাড়ি বলে উঠি, এক কাপ কড়া চা আর গরম জলের বোতল তোমার বিছানার পাশে দেখতে চাও, এই তো?
ধন্যবাদ নার্স, আমি বিছানায় তার পাশে বসলে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সে বলে, তোমার মতো কর্তব্য পরায়ণ মহিলা আমি এর আগে দেখিনি। চমৎকার মেয়ে তুমি। তারপর একটু থেমে সে অদ্ভুত গলায় জিজ্ঞাসা করে, একটু আগে কী যেন বলছিলে তুমি? কথাটা কী সত্যি? যা ঘটে গেছে তা আর সংশোধন করা যায় না–
মিনিট দুই নীরব থেকে সে একটা অদ্ভুত কথা শোনাল, জানো নার্স, তিনি কখনোই ভাল মহিলা ছিলেন না।
আমি তার কথার কোন প্রতিবাদ করলাম না। আমার আশঙ্কা, তবে কি মিস জনসন তার মৃত্যুতে মনে মনে খুশি হয়েছিল? তারপর এখন সেই কথা ভেবে সে লজ্জাবোধ করছে!
প্রসঙ্গ পাল্টাবার জন্য আমি তৎপর হলাম। চেয়ারের উপর থেকে তার পরণের কোর্ট, স্কার্ট হ্যাংগারে রাখতে গিয়ে মেঝের উপরে একটা দলাপাকানো কাগজ পড়ে থাকতে দেখলাম। মনে হয়, তার কোটের পকেট থেকে সেটা পড়ে গিয়ে থাকবে।
কাগজের টুকরোটা কুড়িয়ে নিয়ে জানালা গলিয়ে ফেলতে যাব, মিস জনসন চিৎকার করে উঠল, ওটা আমায় দাও!
আমি তার কথা মতো কাগজের টুকরোটা তাকে ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম, কিন্তু তার আগেই সে একরকম ছিনিয়ে নিল আমার হাত থেকে সেটা এবং সেটা সে জ্বলন্ত মোমবাতির শিখায় মেলে ধরল যতক্ষণ না সেটা পুড়ে ছাই হয়ে গেল। কিন্তু তার আগে দূর থেকে সেই কাগজের হাতের লেখাটা দেখে আমি স্তব্ধ, হতবাক।
বিছানায় শুয়েও প্রসঙ্গটা আমার মনে দারুণ আলোড়িত হতে থাকে। এখন বুঝতে পারছি, ওঁরা কেন আমাকে ওঁদের সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। আমি একজন মহিলা বলেই মিস জনসনের বেডরুমে প্রবেশ করতে পেরেছি। হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, সেই একই হাতের লেখা, বেনামা চিঠিগুলোতে সেই একই রকম হাতের লেখা আমি দেখেছিলাম।
তবে কী এই কারণেই সে তখন অনুতাপ করছিল? সেই বেনামা চিঠিগুলো কী তাহলে মিস জনসন এতদিন লিখে আসছিল?