১৫. পরন্তপের শপথ
আগন্তুক আবার প্রশ্ন করল, তোমরা এখানে কি চাও?
পরন্তপ বলল, আমরা পথিক। পর্বত অতিক্রম করে বিপরীত দিকে যেতে চাই।
নীচে দুই পাহাড়ের মাঝখানে পথের দিকে নির্দেশ করে আগন্তুক বলল, বিপরীত দিকে যেতে হলে ওই পথে যাওয়াই সুবিধা। অনর্থক পর্বত পার হওয়ার প্রয়োজন কি?
অসহিষ্ণুস্বরে পরন্তপ বলল, তোমাকে অত কৈফিয়ত দেব না। ধনুর্বাণ নামাও। আমাদের যেতে দাও।
আগন্তুকের মুখে হাসির আভাস দেখা দিল, তোমাদের গতিবিধি সন্তোষজনক নয়। উপরে উঠে তোমরা আমাকে আক্রমণ করতে পারো। বিশেষত আমার এক সঙ্গী অসুস্থ অবস্থায় গুহার ভিতর বিশ্রাম করছে। তার নিরাপত্তার কথাও আমি ভাবছি। অতএব, তোমাদের আমি উপরে উঠতে দেব না।
কর্ণদেব হঠাৎ বলে উঠল, পথিক! পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে তুমি আমাদের উপর অত্যাচার করছ। অতর্কিতে ধনুর্বাণ উদ্যত করায় আমরা অসহায় হয়ে পড়েছি। অসি হস্তে সম্মুখীন হলে তোমাকে উচিত শাস্তি দিতাম।
আগন্তুকের মুখের হাসি বিস্তৃত হল, চারজনের বিরুদ্ধে একাকী যুদ্ধে ব্যাপৃত হলে আমি যে বিপন্ন হব সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সেইজন্যই তো তোমাদের উপরে উঠতে দেব না।
তারপর পরন্তপের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে এই দলের নেতা মনে হচ্ছে। এই বালক দস্যুটিকে কোথা থেকে সংগ্রহ করলে?
শায়ন ও বল্লভ চিৎকার করে উঠল, আমরা দস্যু নই।
কর্ণদেব ক্রুদ্ধস্বরে বলল, তোমাকে বিপন্ন করার জন্য চারজনের প্রয়োজন নেই। ধনুর্বাণ ফেলে অসি গ্রহণ করলে আমি একাকী তোমাকে সমুচিত দণ্ড দিতে পারি। এস। অসি গ্রহণ করো। তোমাকে আমি দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করছি।
আগন্তুক হাসিমুখে বলল, পরিকল্পনাটি ভাল। তোমার সঙ্গে দ্বন্দ্বযুদ্ধে প্রবৃত্ত হলেই তোমার সঙ্গীরা উপরে উঠে আমাকে ঘিরে ফেলতে পারে। বালক! তোমার প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার মতো নির্বোধ আমি নই।
কর্ণদেব বলল, আমি শপথ করছি আমার সঙ্গীরা যুদ্ধে বাধা দেবে না। ধনুর্বাণ সংবরণ করে অসি হাতে নাও।
আগন্তুক বলল, দস্যর শপথে আমি বিশ্বাস করি না।
কর্ণদেব কি যেন বলতে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দিয়ে পরন্তপ বলল, বারংবার আমাদের তুমি দস্যু বলছ কেন? আমরা যে দস্যু তার কোনো প্রমাণ আছে?
-আছে। আমার সঙ্গীর উপর একদল দস্যু অত্যাচার করছিল। আমার সঙ্গী যে এক সময়ে ঐ দস্যুদলেরই দলপতি ছিল, সে কথাও সে আমাকে বলেছে। তার অন্তিমকাল উপস্থিত। তাই তার নাম আর পরিচয় আমাকে জানাতে সে দ্বিধাবোধ করেনি। আমার বিশ্বাস শল্যকে হত্যা করার জন্যই তোমরা এসেছ। যাদের কবল থেকে আমি ওকে উদ্ধার করেছি, তোমরা নিশ্চয়ই সেই দুস্যদলের অন্তর্ভুক্ত। নচেৎ, সমতল ভূমিতে সহজ পথ থাকতেও তোমরা পর্বতে আরোহণ করছ কেন?
চিন্তিতস্বরে পরন্তপ বলল, শল্য তোমাকে তার নাম জানিয়েছে বুঝতে পারছি। সে যে দস্যুদলের অধিপতি ছিল, সেকথাও গোপন করেনি। অন্তিমকাল উপস্থিত দেখে উদ্ধারকর্তাকে তার প্রকৃত পরিচয় দিতে সে ইতস্তত করে নি। কিন্তু সব কথা সে কি তোমায় বলেছে?
–আর কি কথা থাকতে পারে? তার ব্যক্তিগত জীবনের তথ্য জানার আগ্রহ আমার নেই।
পরন্তপ এক মুহূর্ত হেঁটমুণ্ডে চিন্তা করল, তারপর সহস্য মুখ তুলে বলে উঠল, শোনো; আমরা তার সন্ধানেই এসেছি তোমার এই অনুমান সত্য। কিন্তু আমরা তাকে হত্যা করতে আসিনি। তার বিপদের সংবাদ পেয়ে তাকে উদ্ধার করতেই এসেছিলাম। কিন্তু আমরা কিছু করার আগেই তুমি শল্যকে দুস্যদের কবল থেকে মুক্ত করেছ। সে যে আহত হয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে, এই কথা শুনে আমি অতিশয় চিন্তিত। তুমি আমার নাম জানিয়ে শল্যকে জিজ্ঞাসা করো সে আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চায় কি না– যদি সে অসম্মতি জানায়, তাহলে আমরা ফিরে যাব। আশা করি এই প্রস্তাবে তোমার আপত্তি হবে না।
আগন্তুক কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল, তারপর বলল, তোমার প্রস্তাব মেনে নিচ্ছি। যদি সত্যই তোমরা তার মিত্র হও, তাহলে অন্তিমকালে শেষ সাক্ষাঙ্কারে বাধা দেওয়া আমার পক্ষে অনুচিত। বললো, কি তোমার নাম?
– পরন্তপ।
আগন্তুকের ললাট ও ভ্রূ কুঞ্চিত হল, কিন্তু তার কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক তোমরা ক্ষণকাল বিলম্ব করো। আমি শল্যকে জিজ্ঞাসা করে আসছি।
গুহামধ্যে তার দেহ অদৃশ্য হতেই কর্ণদেব বলল, তোমার নাম বলে ভুল করেছে পরন্তপ।
উপায় কি? পরন্তপও বলল, শল্যের অনুমতি ছাড়া ওই ব্যক্তি কিছুতেই আমাদের উপরে উঠতে দেবে না। আরও একটা কথা– এই রাজ্যে পরন্তপ নামে একাধিক ব্যক্তির অস্তিত্ব থাকতে পারে, আমিই যে দস্যু পরন্তপ সে-বিষয়ে সে নিশ্চিত হবে কেমন করে?
কর্ণদেব বলল, ওই ব্যক্তি জানে শল্য দস্যু-দলপতি। দস্যু পরন্তপের নাম এই দেশে কারও অবিদিত নয়। খুব স্বাভাবিক যুক্তি দিয়েই সে ধরে নিতে পারে এক দস্যুর সঙ্গে আর এক দস্যুর পরিচয় বা মিত্রতা ঘটতে পারে। সুতরাং–
কর্ণদেবের কথা শেষ হওয়ার আগেই গুহার মুখে আবির্ভূত হল আগন্তুকের দীর্ঘ দেহ। সে বলল, পরন্তপ! শল্য তোমাকে দেখা করার অনুমতি দিয়েছে। তুমি একাকী নিরস্ত্র ভাবে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারো। তোমার সঙ্গীদের ওখানেই থাকতে হবে।
নিঃশব্দে অস্ত্রত্যাগ করে উপরে উঠে গেল পরন্তপ, তারপর গুহার মধ্যে প্রবেশ করল।
পরন্তপের তিন সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে আগন্তুক বলল, তোমরা যেখানে আছ, সেখানেই থাকো। উপরে ওঠার চেষ্টা করলে বিপদ ঘটবে। আমি গুহার ভিতর থেকে নজর রাখছি।
সে গুহার ভিতর অদৃশ্য হল।
পরন্তপ তখন আহত শল্যের পাশে বসে পড়েছে, তার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা পরিস্ফুট।
শল্যের পিঞ্জরে বিদ্ধ বাণটির দিকে তাকিয়ে সে বলল, ওটাকে ক্ষতমুখ থেকে টেনে ফেলে দিলে হয়তো তুমি স্বস্তি পাবে।
ম্লান হেসে শল্য বলল, এখন আর কোনো চেষ্টা করে লাভ নেই। আমার আয়ু সীমিত। মৃত্যুর পদধ্বনি আমি শুনতে পাচ্ছি।
পাশ থেকে আগন্তুক বলে উঠল, ক্ষতমুখ থেকে বাণ উৎপাটিত করলে প্রবল বেগে রক্তপাত হয়ে এখনই প্রাণসংশয় ঘটতে পারে।
অতিকষ্টে শাসগ্রহণ করতে করতে শল্য বলল, আমার মৃত্যু অনিবার্য। বাণ তুলে ফেলার চেষ্টা করলে দারুণ যন্ত্রণা হবে। অনর্থক কষ্টভোগ করাতে চাই না… পরন্তপ! আমার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। বলল, কি বলতে চাও?
পরন্তপ অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে আগন্তুকের দিকে কটাক্ষ করল। আগন্তুক সেই দৃষ্টির অর্থ বুঝল কি না বলা যায় না, কিন্তু সে যথাস্থানে দাঁড়িয়ে রইল অটল হয়ে।
শল্যের ওষ্ঠাধরে ক্লিষ্ট হাসির রেখা দেখা দিল, পরন্তপ! আমি জানি তুমি গুপ্ত ধনভাণ্ডারের সন্ধানে এসেছ- তাই নয় কি?
পরন্তপ সম্মতিসূচক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সায় দিল।
শল্য বল্ল, তুমি নিশ্চয় আমার বিপদের সংবাদ পেয়ে আমাকে উদ্ধার করতে এসেছিলে? শুনলাম, তোমার সঙ্গে অস্ত্রধারী অনুচর আছে?
পরন্তপ আবার সায় দিল।
শল্য বলল, আমি ওদের গুপ্তধনের সন্ধান দিতে রাজি হইনি, তোমাকে সন্ধান দেব এমন কথা তুমি ভাবছ কেন?
পরন্তপ বলল, ওরা তোমার উপর অত্যাচার করছিল। আমি তোমাকে উদ্ধার করতাম এবং গুপ্তধনের সন্ধান পেলে তোমাকে অর্ধাংশ দিতে সম্মত হতাম। ওদের প্রতিশ্রুতির কোনো মূল্য নেই। গুপ্তধনের সন্ধান পাওয়া মাত্র প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে ওরা তোমাকে হত্যা করত। কিন্তু আমি কখনো প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করি না। আমাদের সাহায্যে তোমার প্রাণরক্ষা হলে, আমার প্রতিশ্রুতিতে আস্থা রেখে তুমি স্বয়ং আমাদের যথাস্থানে নিয়ে যেতে বলেই আমার মনে হয়।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে শল্য বলল, সত্য। পরন্তপ কখনো বিশ্বাসভঙ্গ করে না একথা দস্যুমহলে সবাই জানে। কিন্তু আমি এখন মৃত্যুপথযাত্রী; তোমাকে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়ার আগেই আমার মৃত্যু হবে।
পরন্তপ বলল, তা বটে। তবে যদি গুপ্তধনের সন্ধান দাও, তাহলে আমরা ওই ধন উদ্ধার করতে প্রাণপণ করব। তোমার কোনো আত্মীয়-স্বজন থাকলে তার নাম-ধাম আমাকে জানাও। আমি শপথ করছি তোমার প্রাপ্য অর্ধাংশ–
বাধা দিয়ে শল্য বলল, আমার কোনো আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধব নেই। কিন্তু
একটু থেমে হাত বাড়িয়ে দণ্ডায়মান আগন্তুকের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে শল্য বলল, কিন্তু এই অপরিচিত ব্যক্তিকে আমি পরমাত্মীয় জ্ঞান করি। আমাকে উদ্ধার করার জন্য এই ব্যক্তি নিজের প্রাণ বিপন্ন করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। পরন্তপ! আমি বাঁচব না। যদি আমার অর্ধাংশ ওকে দিতে সম্মত হও, তাহলে আমি তোমাকে গুপ্তধনের সন্ধান দিয়ে যাব। বলল, আমার প্রস্তাবে তুমি সম্মত?
একটু ইতস্তত করে পরন্তপ বলল, হ্যাঁ।
শল্য বলল, প্রতিজ্ঞা করছ?
পরন্তপ একবার পাশেই দণ্ডায়মান আগন্তুকের মুখের উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করল। সেই মুখ পাথরের মতো ভাবলেশহীন নির্বিকার; মনে হল গুপ্তধন সংক্রান্ত কোনো কথাই তার কানে যায় নি, অথবা কানে গেলেও এ বিষয়ে তার কিছুমাত্র আগ্রহ নেই।
শল্য বলল, পরন্তপ! আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। শপথ করো, আমার প্রাপ্য অর্ধাংশ এই ব্যক্তিকে দেবে? শপথ না করলে ধনভাণ্ডারের সন্ধান পাবে না।
পরন্তপ দৃঢ়কণ্ঠে বলল, শপথ করছি, যদি গুপ্তধনের সন্ধান পাই, তাহলে অর্ধাংশ এই ব্যক্তির হাতে সমর্পণ করব। আমার কথার অন্যথা হবে না।
তবে শোন, অতিকষ্টে শ্বাস নিতে নিতে শল্য বলল, উত্তর-পশ্চিম দিক ধরে অগ্রসর হলে শ্রাবস্তী ও কৌশাম্বী রাজ্যের সীমানায় একটি পাহাড়ের গুহায় ওই ধনভাণ্ডার লুকানো রয়েছে। ওই অঞ্চলের পর্বতমালার মধ্যে বিশেষ পর্বতটিকে সনাক্ত করার উপায় আমি বলে দিচ্ছি। পাহাড়টির চেহারা অবিকল মাংসহীন নরমুণ্ডের মতো। কঙ্কাল-করোটির আকার বিশিষ্ট ওই পর্বতের গুহামুখে– অর্থাৎ, নরমুণ্ডের মুখের মধ্যে প্রবেশ করলে গুহার গায়ে আমার নামের আদ্যাক্ষর খোদিত আছে দেখবে। ওইখানে পপ-পশ–ওঃ! পরক্তপ! বড়ো কষ্ট- একটু জল!
জল। পরন্তপ বিব্রত মুখে বলল, জল এখানে কোথায় পাব?
শল্যের সমস্ত দেহ ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেল; অধর প্রান্তে উঠে এল একঝলক রক্ত। তারপর মুখের দুইপাশে চোয়াল বেয়ে ঝরে পড়ল সেই রক্তের ধারা। শল্যের দেহের উপর ঝুঁকে পড়ে পরন্তপ ডাকল, শল্য! শল্য!
আগন্তুক বলল, কাকে ডাকছ? তোমার বন্ধুর মৃত্যু হয়েছে।
ঘুরে দাঁড়িয়ে আগন্তুকের মুখের উপর দুই চোখের দৃষ্টি মেলে পরন্তপ বলল, তুমি সব কথাই শুনেছ। গুপ্তধন পাওয়া গেলে অর্ধাংশ তোমাকে নিশ্চয়ই দেব। পথের আপদ-বিপদ সম্পর্কে তোমাকে সতর্ক করা নিষ্প্রয়োজন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তোমার নির্ভীক চরিত্রের পরিচয় আমরা পেয়েছি। তবে–
-তবে কি?
শ্রাবস্তী ও কোশলের সীমান্ত বহু ক্রোশ ধরে বিস্তৃত। ওই কঙ্কালকররাটির আকার-বিশিষ্ট পর্বতের সন্ধান পেতে বেশ বিলম্ব হবে। চারদিকে অনার্যপ্রহরীর দল সর্বদাই
বাধা দিয়ে আগন্তুক বলল, পাহাড়টি বহু কাল পূর্বেই আমার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। ওই পথে আমি বহুকাল ধরে যাতায়াত করছি। স্থানীয় বনপথে চলাচলের অভিজ্ঞতা আমার আছে। কোন পথে কিভাবে চললে অনার্যসেনার দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া যাবে তা আমি জানি। নিতান্তই যদি ধরা পরি, তাহলে যথাসময়ে যথাকৰ্তব্য করা যাবে। এখন থেকে সম্ভাব্য বিপদের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা করার প্রয়োজন নেই।
স্থির দৃষ্টিতে আগন্তুকের মুখের দিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, তুমি পরন্তপের যোগ্য সঙ্গী বটে। তোমার নাম?
আমার নাম শশক।
আগন্তুকের পেশীবদ্ধ বিপুল বপুর দিকে তাকিয়ে পরন্তপ সবিস্ময়ে বলে উঠল, তোমার নাম শশক? আশ্চর্য!
নিজের দেহের উপর একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বিব্রত মুখে শশক বলল, আমি সার্থকনামা মানুষ নই। শশক নামটিও আমি পছন্দ করি না।
পছন্দ হওয়ার কথা তো নয়, পরন্তপ হেসে বলল, কিন্তু নামকরণের উপর আমাদের তো হাত নেই। জনক-জননী বা আত্মীয়-স্বজনই আমাদের নামকরণ করে থাকেন। তবে তোমার ন্যায় শক্তিশালী পুরুষের নাম শশক হওয়া অনুচিত একথা বলতে পারি।… শশক! যদি অনুমতি দাও, তাহলে আমার সঙ্গীদের আমি উপরে আসতে বলি। আজ থেকে তুমিও যে আমদের সহচর সেকথা তাদের জানানো প্রয়োজন।
আগন্তুক কিছু বলতে গেল, কিন্তু সে কথা বলার আগেই পার্বত্যপথের নীচ থেকে কর্ণদেবের উচ্চকণ্ঠ ভেসে এল, পরন্তপ! পরন্তপ! সতর্ক হও! সামনে সমূহ বিপদ!
পরক্ষণেই তাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল এক ভয়াবহ আতধ্বনি! সেই আর্তনাদের কেশ স্তব্ধ হওয়ার আগেই পাহাত্মে সানুদেশে গুহার নিকটবর্তী স্থান থেকে ভেসে এল রক্তজল করা শব্দের তরঙ্গ!
.
১৬. গিরিপথে মৃত্যুর হানা
শশক তার ধনুর্বাণ পৃষ্ঠদেশে স্থাপন করেছিল, এখন ঝটিতি পিঠ থেকে ধনুক নিয়ে তাতে শর যোজনা করে বলে উঠল, নেকড়ের আর্তনাদ! নেকড়ের চিৎকার!
পরন্তপ বলল, অনেকগুলো নেকড়ের চিৎকার! প্রথম যে নেকড়েটা আর্তনাদ করেছিল, সেটা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গীদের তিরের আঘাতে আহত হয়েছিল।
উত্তর না দিয়ে শশক একলাফে গুহার বাইরে এসে দাঁড়াল। বিনা বাক্যবয়ে তার সঙ্গী হল পরন্তপ। শশকের নির্দেশ অনুসারে সে গুহার মধ্যে নিরস্ত্র অবস্থায় প্রবেশ করতে বাধ্য হয়েছিল, এখন পরিত্যক্ত অস্ত্রে কথা তার মনে হল;- দ্বিধা মুহূর্তের জন্য অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে না জানলে মহারাজ রুদ্রদমনের রাজ্যে এতকাল দুস্যবৃত্তি করতে পারত না পরন্তপ-শশকের সঙ্গ নেওয়ার আগে গুহাতল থেকে একটি প্রস্তর তুলে নিতে তার ভুল হয়নি। প্রস্তরটিকে দৃঢ়মুষ্টিতে ধারণ করে পরন্তপ গুহার বাইরে এসে দাঁড়াল।
গুহার দক্ষিণে যে স্বল্প-পরিসর স্থান বৃত্তাকারে ঘুরে গেছে, সেইদিকে তাকিয়ে তারা দেখতে পেল পাঁচ-ছয়টি নেকড়ে সেখানে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে লোলুপ দৃষ্টিতে! তাদের ক্ষুধিত-দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে পরন্তপের তিন সঙ্গীকে! সামনে জ্যান্ত খাবার দেখেও নেকড়ের দল গিরিপথ ধরে কেন নামছে না এই রহস্যের সমাধান পড়ে আছে গুহার অনতিদূরে- তীরবিদ্ধ একটি নেকড়ের মৃতদেহ থেকে ঝরে পড়ছে রক্তের ধারা!
নীচে গিরিপথের উপর ধনুকে বাণ লাগিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শায়ন ও কর্ণদেব। তাদের পাশেই প্রকাণ্ড কুঠার হস্তে অবস্থান করছে গেরুয়াধারী বল্লভ।
শায়ন ও কর্ণদেব আবার তীর নিক্ষেপ করল। দুটি নেকড়ে চিৎকার করে মৃত্যুশয্যায় শুয়ে পড়ল। অন্যান্য জন্তুগুলি তাড়াতাড়ি পিছিয়ে পাথরের আড়ালে আশ্রয় নিল।
পরন্তপ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করল
গুহার অদুরে দুটি পাহাড়ের মধ্যবর্তী শূন্যস্থানকে পরিপূর্ণ করে সেতুর আকারে বিরাজ করছে দুটি প্রকাণ্ড বৃক্ষকাণ্ড। খুব সম্ভব গিরিপথে যাতায়াত করার জন্য স্থানীয় মানুষ অথবা কোনো শিকারি ওইভাবে গাছ কেটে সেতু প্রস্তুত করেছিল। পরন্তপ ও তার সঙ্গীরা যে পাহাড়টায় রয়েছে, তার পাশের পাহাড়ে ওই গাছের গুঁড়ির পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো নেকড়ে। নেকড়েবাহিনীর অগ্রবর্তী একটা ছোটো দল পার্শ্ববর্তী পর্বত অতিক্রম করার সময়ে সম্ভবত পরন্তপের সঙ্গীদের দেখতে পেয়েছে, আর তার ফলেই এই বিপত্তি। নেকড়েরা শিকার দেখলে চিৎকার করে সঙ্গীদের জানিয়ে দেয়- অগ্রবর্তী দল যখন চিৎকার করে পশ্চাৎবর্তী বাহিনীকে শিকারের সংবাদ জানাচ্ছিল, সেই ভয়ংকর জান্তব উল্লাসের ধ্বনি একটু আগে শুনতে পেয়েছিল পরন্তপ ও শশক। তার আগেই আক্রমণোদ্যত নেকড়েদের দেখে শায়ন অথবা কর্ণদেব তির নিক্ষেপ করে একটি পশুকে হত্যা করেছে শাপদ-কণ্ঠের সেই মৃত্যুকাতর আর্তনাদ শশক ও পরন্তুপের শ্রুতিগোচর হয়েছে প্রথমেই।
হঠাৎ একটি নেকড়ে মুখ তুলে চিৎকার করে উঠল আক্রমণের পূর্ব-সংকেত! সঙ্গে সঙ্গে গাছের গুঁড়ির সেতু বেয়ে ছুটে এল অনেকগুলি জানোয়ার;- এধারে পাথরের আড়ালে যে নেকড়েগুলি দাঁড়িয়েছিল, তারাও সঙ্গীদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ধেয়ে এল নীচে গিরিপথে দণ্ডায়মান তিনটি মানুষের দিকে!
গিরিপথ আর গুহার মাঝখানে সঙ্কীর্ণ চাতালের মতো জায়গাটাতে পৌঁছানোর আগেই তলা থেকে তিরের পর তির ছুটে এসে আক্রমণে উন্মুখ নেকড়েবাহিনীর অধিকাংশকেই মৃত্যুশয্যায় শুইয়ে দিল। দুটি জানোয়ার গিরিপথের মুখে এসে পৌঁছাল বটে, কিন্তু নীচের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগেই শশক অব্যর্থ সন্ধানে শরনিক্ষেপ করে একটি জন্তুকে হত্যা করল। আবার ধনুকে বাণ লাগানোর সুযোগ পেল না শশক- দ্বিতীয় নেকড়েটা হিংস্রভাবে দন্তবিকাশ করে নতুন শত্রুর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। পরন্তপ শক্ত মুঠিতে পাথরটা চেপে ধরে শূন্যে হাত তুলল, কিন্তু উদ্যত মুষ্টি যথাস্থানে আঘাত করার পূর্ব মুহূর্তেই শশকের প্রচণ্ড পদাঘাতে নেকড়েটা ছিটকে পড়ল পাহাড় থেকে নীচে।
হঠাৎ দুইদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে নেকড়ে বাহিনী চমকে গেল। তিরের নাগালের বাইরে ছোটো বড়ো পাথরের আড়াল থেকে তারা মানুষগুলোর উপর নজর রাখতে লাগল।
উপর থেকে হাঁক দিয়ে পরন্তপ বলল, শায়ন! কর্ণদেব! তোমরা উপরে উঠে এসো। আমার সঙ্গী তোমাদের বাধা দেবে না।
শায়ন বলল, তোমার সঙ্গী বাধা না দিলেও আমরা এখন উপরে উঠে গুহার মধ্যে প্রবেশ করব না।
–কেন? ভিতরে এলে তোমরা কিছুটা নিরাপদ হবে।
না। সেই নিরাপত্তা সাময়িক। আমরা গুহায় প্রবেশ করলেই জন্তুগুলো গুহামুখ থেকে শুরু করে গিরিপথের চারধারে ছড়িয়ে পড়বে, আর সকলেই হব গুহার মধ্যে বন্দি। এখন দুদিক থেকে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে ওরা গুহার সামনে এসে চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে পারছে না।
কর্ণদেব বলল, শয়ান! আমরা কতক্ষণ এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকব?
পরন্তপ কিছু বলার আগেই বল্লভের উদাত্তকণ্ঠ ভেসে এল, তোমরা উপরে উঠে যাও। আমি যা করার করছি।
পরন্তপ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল, কি করতে চাও বল্লভ?
কোনো উত্তর না দিয়ে বল্লভ সঙ্কীর্ণ গিরিপথ বেয়ে উপরে উঠে এসে গুহার মুখে দাঁড়াল, একবার শশকের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর দৃঢ়মুষ্টিতে কুঠার ধরে বৃক্ষকাণ্ডে গঠিত সেতুর দিকে অগ্রসর হল।
নেকড়েরা এতক্ষণ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে মানুষগুলোর গতিবিধি লক্ষ করছিল। বল্লভ তাদের কাছাকাছি আসতেই পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে সগর্জনে তেড়ে এল। সেতুর ওপারে যে নেকড়েগুলো দাঁড়িয়েছিল, তারাও দলে দলে সেতু পার হতে শুরু করল।
তির ছুড়লে বল্লভের গায়ে লাগতে পারে তাই, শায়ন ও কর্মদেব ধনুর্বাণ নামিয়ে ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বল্লভের দিকে। শশক একবার বল্লভের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তারপর খাপ থেকে তলোয়ার খুলে পিছন পিছন এগিয়ে গেল।
কিন্তু শশকের তরবারিতে এক ফোঁটা রক্তের দাগও পড়ল না। বল্লভের প্রচণ্ড কুঠার ঘুরতে লাগল বিদ্যুদ্বেগে এবং পাহাড়ের গায়ে রক্তের স্রোত ছুটিয়ে ছিটকে পড়তে লাগল নেকড়েদের ছিন্ন ভিন্ন মৃতদেহ! কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই যুদ্ধ শেষ! হতাবশিষ্ট নেকড়েগুলি গাছের গুঁড়ির সেতু পার হয়ে অপর দিকে পাহাড়ে তিরবেগে পলায়ন করল। বল্লভ তবু থামল না, সেতুর সামনে এসে সে কুঠার তুলল। রক্তাক্ত কুঠার ফলক সবেগে নেমে এল বৃক্ষকাণ্ডে নির্মিত সেতুর উপর। উপরি-উপরি দুবার আঘাত করতেই বিশাল বৃক্ষ দুটি খণ্ডিত হয়ে তলায় ছিটকে পড়ল।
কুঠার নামিয়ে সঙ্গীদের দিকে দৃষ্টিপাত করে বল্লভ বলল, আপদ শান্তি। ওরা এখন আর আমাদের বিরক্ত করবে না।
তারপর পিছন ফিরে তরবারি হাতে শশককে দেখে হেসে বলল, আমাকে সাহায্য করতে এসেছ বলে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তবে এ যাত্রা তোমার তরবারি ব্যবহারের প্রয়োজন হল না।
কর্ণদেব ও শায়ন ততক্ষণে উঠে এসেছে গুহার মুখে। সকলকে ডাক দিয়ে পরন্তপ বলল, বন্ধুগণ! এদিকে এসো।
শশকের সঙ্গে বল্লভ এসে দাঁড়াল পরন্তপের সম্মুখে। তাদের পাশেই দণ্ডায়মান হল শায়ন ও কর্ণদেব।
তোমরা শোন, পরন্তপ বলল, এই ব্যক্তির নাম শশক। আজ থেকে এই অভিযানে শশকও আমাদের সঙ্গী।
এই অভাবিত ঘোষণায় সকলেই চমকে উঠল, কিন্তু কেউ কোনো অভিমত প্রকাশ করল না।
কর্ণদেব জিজ্ঞাসা করল, শল্য কোথায় যাবে?
পরন্তপ বলল, শল্যের মৃত্যু হয়েছে। অন্তিমকালে তার অনুরোধেই আমি শশককে দলভুক্ত করেছি এবং শল্যের প্রাপ্য অর্ধাংশ শশককে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছি।
শশক! সবিস্ময়ে বল্লভ বলল, এই বৃষস্কন্ধ ব্যঢ়োরস্ক প্রকাণ্ড পুরুষের নাম শশক?
শায়ন আর কর্ণদেব শশকের নামকরণ সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করতে উদ্যত হল, কিন্তু তাদের মুখের কথা মুখেই থেকে গেল–
বল্লভ ভ্রূ কুঞ্চিত করে বলল, নেকড়েরা হঠাৎ চিৎকার করছে কেন? ওরা কি তলা থেকে এই পাহাড়ে উঠে আমাদের আক্রমণ করতে চায়?
পরন্তপ বলল, বোধহয় না। একবার আমাদের আক্রমণ করতে এসে ওদের যা অভিজ্ঞতা হয়েছে, তাতে দ্বিতীয়বার ওরা এদিকে আসতে সাহস করবে বলে মনে হয় না।
কর্ণদেব বলল, আমারও তাই মনে হয়। তবে নেকড়ের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নিতান্তই সীমাবদ্ধ।
শায়ন এতক্ষণ স্থির হয়ে বসে নেকড়ের চিৎকার শুনছিল। সে বলল, নেকড়েরা বিভিন্ন ধরনের শব্দে বিভিন্ন প্রকার মনোভাব প্রকাশ করে। এখন ওদের চিৎকারের ধরন শুনে বুঝতে পারছি শিকারের সন্ধান পেয়ে ওরা উল্লাস প্রকাশ করছে।
তা হবে, পরন্তপ বলল, কোন বন্যপশুকে লক্ষ্য করে ওরা যদি উল্লাস জানায় আমার আপত্তি নেই। আমাদের উপর ওদের দৃষ্টি আকৃষ্ট না হলেই মঙ্গল। মাংসাহারী শ্বাপদের ভক্ষ্য হয়ে অনেক জীবই জন্মগ্রহণ করেছে, সেইরকম কোনো
হঠাৎ থেমে গিয়ে উদ্বিগ্ন স্বরে পরন্তপ বলে উঠল, আমাদের চারটি অশ্ব পাহাড়ের নীচে রজ্জবদ্ধ আছে। তাদের লক্ষ্য করে ওরা চিৎকার করছে না তো?
সচমকে পিঠ থেকে ধনুর্বাণ টেনে নিয়ে শায়ন বলল, তাই তো! খুব সম্ভব তোমার আশঙ্কা
একলাফে গুহার বাইরে এসে দ্রুতবেগে গিরিপথ বেয়ে নামতে লাগল শায়ন। বিনা বাক্যব্যয়ে তাকে অনুসরণ করল সবাই। গিরিপথের উপর থেকে পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র তুলে নিয়ে পরন্তপও পাহাড় থেকে নামতে লাগল দ্রুতবেগে।…
আশঙ্কা সত্য। রজ্জবদ্ধ অশ্বদের লক্ষ্য করে ছুটতে ছুটতে হিংস্র উল্লাসে চিৎকার করছে নেকড়ে পাল।
পরন্তপ ও তার সঙ্গীরা পায়ের গতি বাড়িয়ে দিল। প্রাণ বিপন্ন করে বিপজ্জনক সঙ্কীর্ণ পথ বেয়ে তারা ক্ষিপ্রচরণে নীচে নামতে লাগল।…
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে হতাশ কণ্ঠে পরন্তপ বলল, বৃথা চেষ্টা। আমরা কাছাকাছি যাওয়ার আগেই নেকড়ের দল ঘোড়াগুলোর উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
একটি অশ্ব প্রাণপণ চেষ্টায় বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করে ছুটে পালাল। অন্য তিনটি জানোয়ার দারুণ আতঙ্কে হ্রষাধ্বনি করতে লাগল বারংবার।
অধর দংশন করে কর্ণদেব ধনুর্বান তুলল। মুহূর্তে ছুটে গেল তির। একটি নেকড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। নেকড়েরা ফিরেও তাকাল না। আবার ছুটল তির- একবার শায়নের ধনুক থেকে। আরও একটি নেকড়ে তিরবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুযাতনায় ছটফট করতে লাগল। নেকড়েবাহিনীর ভ্রূক্ষেপ নেই। তারা খুব কাছাকাছি এসে পড়েছে। এখনই তীক্ষ্ণ শ্বাপদদন্তে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে তিনটি অশ্বের দেহ।
শায়ন হঠাৎ ধনুর্বাণ তুলে অশ্বতিনটির দিকে লক্ষ্যস্থির করল। পরন্তপ বিস্মিত কণ্ঠে চিৎকার করে বলল, শায়ন! ও কি করছ?
পরক্ষণেই শায়নের ধনুক থেকে জ্যামুক্ত তির ছুটে গিয়ে একটি অশ্বের বন্ধনরঙ্কু ছিন্ন করে দিল! মুক্ত পশু প্রাণপণে ছুটে পলায়ন করতে লাগল। তীব্রতর কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল নেকড়ের দল।
ধনুকে তির লাগিয়ে আবার নিশানা স্থির করতে লাগল শায়ন। অকস্মাৎ তার কানের কাছে। বেজে উঠল ধনুকের টঙ্কার ধ্বনি- বিদ্যুঝলকের মতো একটি বাণ ছুটে গিয়ে আর একটি অশ্বের বন্ধনরঙ্কু কেটে তাকে মুক্তি দিল!
চমকে উঠে সবিস্ময়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে শায়ন দেখল তুণীর থেকে আর একটি তির টেনে নিয়ে ধনুকে যোজনা করছে শশক।
আবার ধনুষ্টঙ্কার! শশকের নিক্ষিপ্ত দ্বিতীয় তীর শেষ অশটিকে রজ্জ্বর বন্ধন থেকে নিষ্কৃতি দিল। ভীষণ চিৎকারে চারদিকে কাঁপয়ে নেকড়ের পাল অশ্বটিকে অনুসরণ করল। কিন্তু বেগবান অশ্ব তখন প্রাণভয়ে ছুটছে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সারিবদ্ধ বৃক্ষ আর উদ্ভিদের অন্তরালে সে আত্মগোপন করল। তার পশ্চাদ্ধাবন করে অরণ্যগর্ভে অদৃশ্য হল নেকড়ের দল।…
শশকের দিকে তাকিয়ে শায়ন বলল, তুমি আশ্চর্য ধনুর্ধর! লক্ষ্যভেদে সিদ্ধহস্ত এমন তিরন্দাজ আগে কখনও দেখিনি।
শশক হেসে বলল, এতখানি বয়সেও তুমি কখনও দর্পণ ব্যবহার করোনি, জেনে বিস্মিত হলাম।
শায়ন লজ্জিতভাবে বলল, দর্পণ ব্যবহার করব না কেন?… গর্ব ছিল আমার তুল্য তিরন্দাজ এই রাজ্যে নেই। তুমি আমার সেই দর্প চূর্ণ করেছ।
পরন্তপ বলল, একথা সত্য। শায়নের ধনুর্বিদ্যার খ্যাতি আমার কানেও এসেছে। তাই আজ তার লক্ষ্যভেদের ক্ষমতা দেখে আশ্চর্য হলেও খুব বেশি বিস্মিত হইনি। তুমি আমাকে স্তম্ভিত করে দিয়েছ। ধনুর্বিদ্যায় তোমার ক্ষমতা শায়নের চাইতে কম নয়।
এই ব্যক্তির নাম শায়ন? শশক শায়নের দিকে দৃষ্টিপাত করল, তিরন্দাজ শায়নের অদ্ভুত ক্ষমতার কথা আমিও শুনেছি। শুধু ধনুর্বিদ্যায় নয়– অসিচালনাতেও শায়নের খ্যাতি শ্রাবস্তী রাজ্যে জনশ্রুতিতে পরিণত হয়েছে। আজ এই আশ্চর্য পুরুষের সাক্ষাৎলাভ করে ধন্য হলাম।
কর্ণদেব বলল, অসিচালনায় শশকও কিছু কম নয়। শল্যকে উদ্ধার করার সময়ে যে দস্যু-দলপতিকে শশক অসির আঘাতে হত্যা করেছিল, তার মৃতদেহ আমি দেখেছি। মৃত দলপতির ব্রহ্মতালু থেকে চিবুকের উপরার্ধ পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। আসুরিক শক্তির সঙ্গে অসামান্য দক্ষতার যোগাযোগ ঘটলেই ওইভাবে আঘাত করা সম্ভব।
শশক চমকে উঠে বলল, তোমরা আমাকে ওই সময়ে দেখেছ?
পরন্তপ বলল, হ্যাঁ। আমরা দুর্বৃত্তদের আক্রমণ করতে উদ্যত হয়েছিলাম; অকস্মাৎ বিনামেঘে বজ্রাঘাতের মতো আবির্ভূত হয়ে তুমি আমাদের সমস্ত পরিকল্পনা পণ্ড করে দিয়েছ। তবে সব ভালো যার, শেষ ভালো তার– তোমার মতো নিপুণ যোদ্ধাকে দলভুক্ত করে আমাদের শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে।
আমিও বীর্যবান পুরুষদের সাহচর্যে এসে নিজেকে ধন্য মনে করছি; কিন্তু পরন্তপ! একটা কাজ তোমার ভালো হয়নি, কর্ণদেবের দিকে দৃষ্টিপাত করে শশক বলল, এই বালককে দলভুক্ত করা অন্যায় হয়েছে।
কর্ণদেবের মুখ ক্রোধে আরক্ত হল। অপাঙ্গে সেইদিকে তাকিয়ে পরন্তপ বলল, শশক! বয়স কম বলে কর্ণদেবকে অবজ্ঞা করো না। অসিচালনায় ওর সমকক্ষ যোদ্ধা খুব কমই আছে।
সায় দিয়ে শায়ন বলল, সত্য কথা। আমি ওকে অসিচালনা করতে দেখেছি। পরন্তপের উক্তি আদৌ অত্যুক্তি নয়।
বল্লভ বলল, কর্ণদেবকে আমি তরবারি ব্যবহার করতে দেখিনি। কিন্তু আমার চোখের সামনে ও বামহস্তে ছুরিকা ধরে তিনটি লৌহদস্তানাধারী দুর্বৃত্তকে পর্যুদস্ত করেছে এবং কিঞ্জল নামে এক অসিধারী দুর্বৃত্তকে বামহস্তের ওই ছুরির সাহায্যেই দ্বন্দ্বযুদ্ধে পরাস্ত করেছে। বামহস্তে ছুরিকা নিয়ে যে এমন অসাধারণ ক্ষমতার পরিচয় দিতে পারে, দক্ষিণহস্তে তরবারি গ্রহণ করলে, সে কি করতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বিস্ময়-বিস্ফারিত দৃষ্টিতে কর্ণদেবকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে শশক বলল, তোমার নাম। কর্ণদেব?… তুমি সার্থকনামা সন্দেহ নেই। যা শুনলাম তা যদি সত্য হয়, তবে তমি মহাভারতে কর্ণের মতোই নিপুণ যোদ্ধা। কিন্তু আমি তোমার ক্ষমতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করিনি। এদের মুখে তোমার বিক্রমের পরিচয় পাওয়ার আগেই আমি ধনুর্বিদ্যায় তোমরা ক্ষমতা স্বচক্ষে দর্শন করেছি- তোমার নিক্ষিপ্ত বাণ নির্ভুল নিশানায় অনেকগুলো নেকড়ের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিয়েছে। কিন্তু এত অল্প বয়সে তোমাকে দস্যুদলে যোগ দিতে দেখে আমি বিরক্ত হয়েছি। তোমার বলবিক্রমে সন্দিগ্ধ হয়ে তোমাকে বালক সম্বোধন করিনি।
কর্ণদেব বলল, ওই সম্বোধনটি আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি। পুনরায় আমাকে বালক সম্বোধনে অভিহিত করলে আমি তোমাকে দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান জানাতে বাধ্য হব শশক! আমি তোমার ক্ষমতা দেখেছি কিন্তু অসিহস্তে তোমার বিরুদ্ধে দ্বন্দ্বযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে আমি ভয় পাই না। আরও একটা কথা তুমি আমাকে দুস্যবৃত্তি করতে দেখনি, শুধু দস্যুর সাহচর্যে আছি বলেই আমাকে দস্যু মনে করলে কেন? তিরন্দাজ শায়ন এবং মহাবলী বল্লভও আজ পরন্তপের সঙ্গী তারাও কি দস্যু?
শাশক বলল, কর্ণদেব! সে সম্বোধন তুমি পছন্দ করো না, সেই সম্বোধন তুমি ভবিষ্যতে কখনো আমার মুখে শুনতে পাবে না। তোমাকে দস্যু মনে করে যদি ভুল করে থাকি, তাহলে বলব দস্যুর সহচরকে সহজ বুদ্ধিতে দস্যু বলেই মনে করা স্বাভাবিক। তবে তোমাদের যোগাযোগ অতি অদ্ভুত- যোদ্ধা, সন্ন্যাসী ও প্রিয়দর্শন এক কিশোরের সঙ্গে দস্যু দলপতির যোগাযোগ চিন্তা করা যায় না।
কর্ণদেব বলল, পৃথিবীতে তোমার অচিন্ত্যনীয় অনেক কিছুই ঘটতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলছি- গেরুয়াধারী বল্লভ গেরুয়া ধারণ করলেও সন্ন্যাসগ্রহণ করেনি।
সবিস্ময়ে শশক বলল, এত অল্প সময়ের মধ্যে বারংবার এমনভাবে চমকিত হওয়ার মতো তথ্য এর আগে কখনো সংগ্রহ করতে পারিনি। বল্লভ! একথা সত্য? তুমি সন্ন্যাসী নও?
বল্লভ হেসে বলল, না। শ্বেতবস্ত্র শীঘ্রই মলিন হয়। বারংবার বস্ত্র ধৌত করার পরিশ্রমে আমি অনিচ্ছুক, তাই গেরুয়াকে অঙ্গে ধারণ করেছি। অন্যান্য রং আমি পছন্দ করি না।
কর্ণদেব বলল, দস্যুবৃত্তির স্বপক্ষে ও বিপক্ষে বিস্তর যুক্তি থাকতে পারে; ব্যক্তিবিশেষের পেশা বা বৃত্তি দেখে তার সঙ্গীর স্বভাব-চরিত্রের বিচার কার অনুচিত। জানো তো–উত্তম নির্ভয়ে চলে অধমের সাথে, তিনিই মধ্যম যিনি থাকেন তফাতে।
শশক ভ্রূকুঞ্চিত করে বলল, একই দিনের মধ্যে এতবার চমকে চমকে উঠলে আমার দুর্বল হৃৎপিণ্ডের গতি হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যেতে পারে। কর্ণদেব! তোমার কথা শুনে বুঝতে পারছি তুমি শুধু অস্ত্রচালনাতেই শিক্ষালাভ করোনি, পুঁথিপত্র নিয়ে দস্তুরমতো বিদ্যাভ্যাসও করেছ।
পরন্তপ বলল, কর্ণদেব আমার প্রিয় সহচর বটে, কিন্তু দস্যু নয়। ও ব্রাহ্মণ-সন্তান। অস্ত্র-অভ্যাস করার আগে দীর্ঘকাল বিদ্যাভ্যাস করেছে। ওর কথা এখন থাক। তোমার কথা বলল। তুমি আমাদের দলের প্রত্যেকটি মানুষেরই পরিচয় পেয়েছ, কিন্তু তোমার নাম ছাড়া আর কিছুই আমরা জানি না। বলো তুমি কোথায় থাকো? কি উপায়ে জীবিকানির্বাহ করো? আত্মীয়-স্বজন কে কোথায় আছে?
দূর আকাশে দৃষ্টি মেলে দাস স্বরে শশক বলল, সমগ্র আর্যাবর্তে আমার বাসস্থান। যত্রতত্র ঘুরে বেড়াই, কোনো নির্দিষ্ট স্থানে স্থায়ীভাবে বাস করি না। জীবিকানির্বাহের জন্য কোনো বিশেষ, বৃত্তি গ্রহণ করি নি। প্রয়োজনে তরবারি ও ধনুর্বাণ ব্যবহার করি বটে। আর আত্মীয়স্বজন? আমি যাদের সাহচর্যে আসি তারাই আত্মার সঙ্গী, আমার আপনার জন অর্থাৎ স্বজন। কেবলমাত্র রক্তের বন্ধনে আমি বিশ্বাসী নই।
পরন্তপ বলল, শশক! তুমি পরিহাস করছ। বুঝলাম, সঠিক পরিচয় দিতে তুমি সম্মত নও। বেশ, আমরা শুধু তোমার নামটি জেনেই খুশি থাকার চেষ্টা করব।
শশক বলল, আমি পরিহাস করি নি। সত্য কথাই বলেছি। কিন্তু শল্যের মৃতদেহ যে পড়ে আছে, সেকথা ভুলে যেও না। মৃতের সকার করতে হবে।
পরন্তপ বলল, অবশ্যই। উপর থেকে মৃতদেহ বহন করে নীচে আনা খুবই কষ্টকর। সেই চেষ্টা করব না। পর্বতশিখরেই মৃতদেহের সৎকার করব। অদূরবর্তী অরণ্যে বৃক্ষের অভাব নেই এবং বন্ধুবর বল্লভও কুঠার হাতে নিকটেই বর্তমান অতএব অরণ্য থেকে কাঠ সংগ্রহ করে উপরে গিয়ে সৎকারকার্য সমাধা করতে বিশেষ অসুবিধা হবে না।
বল্লভ বলল, পরন্তপ! আমার একটি দুর্বলতার কথা তোমার জেনে রাখা ভালো। আমি যুদ্ধ করতে পারি, যে-কোনো বিপদের সম্মুখীন হতে পারি নির্ভয়ে কিন্তু ক্ষুধার যাতনা আদৌ সহ্য করতে পারি না। আমি এখন অত্যন্ত ক্ষুধার্ত। কাল সন্ধ্যা থেকে এখন পর্যন্ত আমি অভুক্ত। কিছু খাদ্য না পেলে আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়।
কর্ণদেব বলল, আমিও অত্যন্ত ক্ষুধার্ত।
শায়ন বলল, আমার অবস্থাও তোমারই মতো।
পরন্তপ বিপন্ন হয়ে বলল, আমারও ক্ষুধার উদ্রেক হয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে খাদ্য কোথায় পাব? কিয়ৎ পরিমাণে শূল্য মেষমাংস এবং আম, কলা প্রভৃতি কিছু ফল আমার ঘোড়ার পিঠে একটি বস্ত্রের ভিতর নিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু পলাতক অশ্বের সঙ্গে সেগুলিও অন্তর্ধান করেছে। এখন নিকটস্থ অরণ্যে কিছু ফলমূল পাওয়া যায় কি না, সেই চেষ্টাই করো।
বল্লভ বলল, আমি ভীষণ ক্ষুধার্ত। ফলের সন্ধানে অরণ্যে ছুটোছুটি করতে পারব না। আর ফলাহারে আমার প্রচণ্ড ক্ষুধা তৃপ্ত হবে বলে মনে হয় না।
শায়ন ও কর্ণদেব কথা বলল না। কিন্তু তাদের মুখ দেখে মনে হল অরণ্যে প্রবেশ করে ফলাহারের প্রস্তাব তাদের মনঃপুত হয় নি।
পরন্তপ বিব্রতভাবে এদিক-ওদিক দৃষ্টিপাত করতে লাগল, যদি ফলভারে সমৃদ্ধ কোনো বৃক্ষ দৈবাৎ চোখে পড়ে এই আশায়।
তোমরা খাদ্যের জন্য বৃথা চিন্তা করছ, খাদ্য তো কাছেই আছে, শশক বলল, বরং পানীয় জলের জন্য একটু কষ্ট হতে পারে। গিরিপথের ধারে একস্থানে বৃষ্টির জল জমে আছে দেখেছি। অবশ্য এতগুলো লোকের ভালোভাবে তৃষ্ণা-নিবারণ করার মতো যথেষ্ট পরিমাণ জল বোধহয় ওখানে হবে না। তবে নিকটবর্তী অরণ্যে নিশ্চয়ই জলের সন্ধান পাওয়া যাবে। আমি জানি, কাছেই একটা নদী আছে।
বল্লভ বলল, জলের সংবাদ শুনে বিশেষ আশ্বস্ত হলাম না। জলপান করে তো ক্ষুধা শান্ত হবে না। আহার্য কোথায়?
শশক বলল, দগ্ধ মাংসেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যাবে। সেজন্য চিন্তা কিসের?
চারটি কণ্ঠ একসঙ্গে বলে উঠল, মাংস পেলে তো দগ্ধ করব। মাংস কোথায়?
শশক বলল, এতগুলো নেকড়ের মৃতদেহ থাকতে মাংসের ভাবনা কি?
কর্ণদেব বিস্মিতস্বরে বলল, নেকড়ের মাংস? তা কি খাওয়া যায়?
পরন্তপ বলল, অনার্যরা নেকড়ের মাংস খায় শুনেছি। কিন্তু কোনো আর্য-সন্তান কখনো নেকড়ের মাংস ভক্ষণ করেছে কি না জানি না। আমার মনে হয় নেকড়ের মাংস আর্যপুরুষের গ্রহণযোগ্য নয়। শায়ন! তুমি কি বলে?
শায়ন স্খলিতস্বরে বলল, আমি নিজে কখনও ওই মাংস ভক্ষণ করি নি। তবে অনার্যরা যে নেকড়ের মাংস খায় সেকথা সত্য।
শশক বলল, আমি একবার বনমধ্যে অত্যন্ত ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছিলাম। হরিণ, বরাহ, প্রভৃতি কোনো পশু তখন আমার চোখে পড়েনি। হঠাৎ একটি নেকড়ে আমার দৃষ্টিগোচর হল। তৎক্ষণাৎ তির নিক্ষেপ করে নেকড়েটাকে বধ করলাম। সেই নেকড়ের মাংস অগ্নিদগ্ধ করে ক্ষুধা নিবারণ করলাম। নিতান্ত মন্দ লাগে নি। অন্তত অখাদ্য বলে তো মনে হয়নি। এই মুহূর্তে আমিও তোমাদের মতোই ক্ষুধার্ত। একটি নেকড়েকে দগ্ধ করে আমি ক্ষুন্নিবৃত্তি করব। তোমাদের রুচি না হয়, অভুক্ত থাকো।
পাহাড়ের তলায় একটি তিরবিদ্ধ নেকড়ের মৃতদেহ লক্ষ্য করে শশক অগ্রসর হল।
উপবিষ্ট অবস্থা থেকে একলম্ফে দণ্ডায়মান হয়ে বল্লভ বলল, আমার রুচি আছে। আমিও নেকড়ের মাংস খাব।
সঙ্গীদের দিকে না তাকিয়ে বল্লভ পাহাড় থেকে নামতে শুরু করল।
শায়ন, কর্ণদেব ও পরন্তপ অর্থপূর্ণভাবে দৃষ্টি বিনিময় করল, তারপর তারাও নিঃশব্দে সঙ্গী দুজনকে অনুসরণ করল…
দগ্ধ মাংস চর্বন করতে করতে পরন্তপ জানাল নেকড়ের মাংসের স্বাদ তার খুব খারাপ লাগছে না!
শশক নীরবে অগ্নিকুণ্ড থেকে একটুকরো মাংস তুলে নিল। শায়ন, কর্ণদেব ও বল্লভ সোৎসাহে জানাল নেকড়ের মাংস সম্পর্কে পরন্তপের সঙ্গে তারা একমত।
.
১৭. অভাবিত বিপত্তি
অতিবাহিত হয়েছে দশটি দিন, দশটি রাত্রি। মাথার উপর অগ্নিবর্ষণ করেছে প্রচণ্ড মধ্যাহ্ন-সূর্য, এসেছে পার্বত্য অঞ্চলের হিমশীতল রাত্রি; পথিমধ্যে একদিন সগর্জনে আবির্ভূত হয়েছে প্রচণ্ড ঝঞ্জাবর্ত; পাঁচটি দুর্ধর্ষ মানুষ তবুও এগিয়ে চলেছে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে অটল চরণে!
অরণ্যও তাদের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে বারংবার। কন্টকময় বনভুমি তাদের পা আর দেহকে করে দিয়েছে রক্তাক্ত। পাহাড় থেকে নামতে গিয়ে কর্ণদেবের পা এমন মচকে গেছে যে, দুদিন সে আর মাটিতে পা ফেলতে পারে নি। কিন্তু অভিযান স্থগিত থাকেনি মুহূর্তের জন্যও। প্রথমে বল্লভ, তারপর শশক কর্ণদেবকে স্কন্ধে বহন করেছে এবং সেই অবস্থায়ই অতিক্রম করেছে। ক্রোশের পর ক্রোশ। দিবাভাগে প্রখর রবিরশ্মি আর রজনীতে বনভূমির শীতার্ত বায়ুর আলিঙ্গনে পরন্তপের অবস্থা বেশ কাহিল- যদিও সেকথা সে কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। বনের ফল অধিকাংশই অখাদ্য, তাই মৃগয়ালব্ধ পশুমাংসই অভিযাত্রীদের একমাত্র আহার্য। সব সময় ভালো শিকার পাওয়া যায় না, তাই বল্লভের উদর প্রায়ই ক্ষুধার্ত থাকে। এমন ভাবে শূন্য উদরে ক্রোশের পর ক্রোশ চলা যে তার স্বাস্থ্যের পক্ষে অত্যন্ত ক্ষতিকর, সেই তথ্য ক্রমাগতই সঙ্গীদের কর্ণকুহরে পরিবেশন করতে করতে অনবরত পা চার্লিয়ে এগিয়ে চলেছে বল্লভ– কারণ, ক্লান্ত হলেও থামলে চলবে না। শুধু দুটি মানুষ কোনো অভিযোগ না করে নিঃশব্দে অক্লান্তপদে অতিক্রম করছে দুর্গম পথ, তাদের মুখে কিংবা দেহে একমুহূর্তের জন্যেও ক্লান্তি বা অবসাদের চিহ্ন দেখা যায় না– শশক ও শায়ন!
বনের পশুরাও পাঁচ বন্ধুর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেনি। একটা বিষাক্ত সাপ অতর্কিতে পরন্তপের পায়ে ছোবল মারতে ফণা তুলেছিল, সদাসতর্ক শায়ন যদি যথাসময়ে সাপটাকে দেখে তলোয়ারের আঘাতে বধ না করত, তাহলে সেইদিনই শেষ হয়ে যেত পরন্তপের ভবলীলা। আর এক রাত্রে অগ্নিকুণ্ডের ধারে অনেকগুলো মানুষকে শুয়ে থাকতে দেখে একটা প্রকাণ্ড বাঘ কৌতূহলী হয়ে ব্যাপারটা কি দেখতে এল। শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে সমবেতভাবে নিদ্রিত হলে সেই নিদ্রা চিরনিদ্রায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা আছে মনে করে প্রহরে প্রহরে পালা করে অভিযাত্রীরা জেগে থাকত। ব্যাঘ্রের আবির্ভাব যখন ঘটল, সেইসময় প্রহরায় ছিল কর্ণদেব। অগ্নিকুণ্ড থেকে একটা জ্বলন্ত কাঠ ছুঁড়ে ব্যাঘ্রকে বিতাড়িত করতে চাইল সে। তুচ্ছ মানুষের এমন স্পর্ধা দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে সগর্জনে কর্ণদেবকে আক্রমণ করল শার্দুল। গর্জন শুনে সকলেরই ঘুম ভেঙে গেল। এতগুলো মানুষের আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে ব্যাঘ্র রণে ভঙ্গ দিল। পাছে সে ফিরে এসে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে সচেষ্ট হয়, সেই ভয়ে রাতটা সকলে জেগেই কাটিয়ে দিল।
আর একদিন একটা পাহাড়ের উপর দিয়ে পথ চলার সময়ে বল্লভের সামনে এগিয়ে এল বিরাট এক ভল্লুক! খুব সম্ভব, বল্লভের বপু দেখে সে তাকে মল্লযোদ্ধা বলে বুঝে নিয়েছিল, আর সেইজন্যেই মল্লযুদ্ধের আহ্বান জানিয়ে পিছনের দুই পায়ে দাঁড়িয়ে বল্লভকে আলিঙ্গন করতে উদ্যত হয়েছিল। কিন্তু ভল্লুকের নখর-ভয়াল থাবার আলিঙ্গন আর ভয়ংকর দাঁতের বিপজ্জনক সান্নিধ্য বল্লভের পছন্দ হল না- সে তার প্রকাণ্ড কুঠার তুলে সজোরে আঘাত হানল। দৈবক্রমে আঘাতটা মাথার উপর সোজাসুজি পড়ে নি, একটা কান উড়িয়ে দিয়ে মাথার চামড়ার কিছু অংশ ছিঁড়ে নিয়ে গেল কুঠার-ফলক। কাপুরুষ মানুষের বর্বর আচরণে ক্ষুণ্ণ হয়ে চিৎকার করতে করতে ভল্লুক স্থান ত্যাগ করল তিরবেগে।
এই ধরনের বিপদ-আপদ আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ মাথায় করে অভিযাত্রীরা যখন দশটা দিন আর দশটা রাত্রি পার করে দিয়েছে, সেইসময় একাদশ দিবসের মধ্যাহ্নে শশক ঘোষণা করল, তারা অভীষ্ট স্থানের খুব কাছেই এসে পড়েছে।
সংবাদ শুনে সকলেই উৎফুল্ল। বল্লভের আনন্দ সবচেয়ে বেশি। কারণ, ঠিক সেই সময়েই তাদের দৃষ্টিগোচর হল তিনটি হরিণ এবং শূল্য মৃগমাংসের কল্পনায় বল্লভের ক্ষুধার্ত জঠর হয়ে উঠল আরও বেশি ক্ষুধার্ত!
অভিযাত্রীরা যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেই জায়গাটা ছিল ঘন লতাগুল্ম আর বৃক্ষের ছায়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। সম্মুখে উন্মুক্ত প্রান্তরের বুকে বিচরণ করতে করতে মহানন্দে তৃণ ভক্ষণ করছিল তিনটি হরিণ। প্রান্তরের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে হরিণরা আততায়ীদের দেখতে পেয়ে পালিয়ে যাবে- তাই ভূমিপৃষ্ঠে অর্ধশায়িত অবস্থায় জানু আর হাতের উপর ভর দিয়ে অগ্রসর হল শায়ন ও শশক। কর্ণদেব, পরন্তপ ও বল্লভমৃগয়া সম্পর্কে অনভিজ্ঞ, তাই তারা যেখানে ছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে রইল।
শৃঙ্গধারী পুরুষ হরিণটির দিকেই নিবদ্ধ ছিল শিকারিদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। হরিণী ও হরিণ শাবককে তারা বধ্য মনে করেনি। জানু আর হাতে ভর করে অগ্রসর হতে হতে কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা হরিণদের নিকটবর্তী হল– হরিণরা তখনও বিপদের আভাস পায়নি। আচম্বিতে টঙ্কারধ্বনি তুলে একসঙ্গে বাণ বর্ষণ করল দুটি ধনুক। পরক্ষণেই তিরবিদ্ধ পুরুষ হরিণটি মাটির ওপর ছিটকে পড়ে মৃত্যুযাতনায় ছটফট করতে লাগল। হরিণী ও হরিণশাবক দ্রুতবেগে ছুটে পশ্চাৎবর্তী অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করল।
আসন্ন ভোজের সম্ভাবনায় উৎফুল্ল বল্লভ প্রচণ্ড উল্লাসে সিংহনাদ করে উঠল– তারপরই ঝড়ের মতো ছুটল ভূপতিত শিকারের দিকে…
হঠাৎ শায়নের মুখের দিকে তাকিয়ে বল্লভ গতি সংবরণ করল। তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে, হাত তুলে দক্ষিণ দিক দেখিয়ে সে যেন কিছু বলার চেষ্টা করল। নির্দিষ্ট দিকে ফিরতেই বল্লভের নির্ভীক অন্তরেও জাগল আতঙ্কের শিহরন
দক্ষিণ দিকে অরণ্য ভেদ করে আত্মপ্রকাশ করেছে প্রকাণ্ড হস্তী, এবং দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে বল্লভকে লক্ষ্য করে! বল্লভের চিৎকারেই সে আকৃষ্ট হয়েছে সন্দেহ নেই।
মুহূর্তে পিছন ফিরে বল্লভ ছুটল। পরন্তপ ও কর্ণদেব সেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেইখানেই সে পৌঁছতে চাইছিল। ওখানে কেবল তার বন্ধুরাই নেই, ওখানে রয়েছে নিবিড় অরণ্যের অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয়। উন্মুক্ত প্রান্তরের উপর ক্ষিপ্ত হস্তীর কবল থেকে আত্মরক্ষা করা অসম্ভব। অসংখ্য মহীরুহ আর ঘন উদ্ভিদের আবরণে আচ্ছন্ন অরণ্যের গর্ভে আত্মগোপন করে হয়তো গজরাজকে ফাঁকি দেওয়া যায়
প্রাণপণে ছুটল বল্লভ পশ্চাত্বর্তী অরণ্যের অভিমুখে…
ছুটছে বল্লভ। পিছনে বৃংহণশব্দে অরণ্যকে মুখরিত করে ছুটছে মত্ত হস্তীও। শায়ন যেখানে দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকে ধাবমান হস্তীর পশ্চাৎভাগ ছাড়া দেহের অন্যান্য অংশ চোখে পড়ে না– অত দূর থেকে ক্রোধে ক্ষিপ্ত হস্তীর নিতম্বে বা পিছনের পায়ে বাণাঘাত করে তার গতিরোধ করা যাবে না বুঝে শায়ন ধনুর্বান নিয়ে হস্তীর পশ্চাদ্ধাবন করল– উদ্দেশ্য, যদি কাছাকাছি এসে দানবের মর্মস্থানে শরনিক্ষেপ করা যায়।
কিন্তু পিছন থেকে দৌড়ে ধাবমান হস্তীর নিকটস্থ হওয়া মানুষের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। শায়ন দেখল তার সঙ্গে হস্তীর দুরত্ব ক্রমশ বর্ধিত হচ্ছে এবং বল্লভের সঙ্গে হস্তীর দুরত্ব হ্রাস পাচ্ছে মুহূর্তে মুহূর্তে বল্লভের অপমৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে শায়ন হতাশ হৃদয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর ঠিক সেই সময়ে তার চোখে পড়ল এক আশ্চর্য দৃশ্য—
উদ্যত ধনুর্বাণ হস্তে ছুটতে ছুটতে ধাবমান গজরাজের খুব কাছে পৌঁছে গেছে শশক! সেই বিশালদেহী পুরুষ যেন মাটিতে পা ফেলছে না, তার প্রকাণ্ড দেহ যেন মাটির উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে শরীরী বিদ্যুতের মতো…
কর্ণদেবের ধনুক থেকে পর পর অনেকগুলো বাণ ছুটে গিয়ে হস্তীর ললাট, বক্ষ ও গণ্ডদেশকে বিদ্ধ করল, কিন্তু মত্ত মাতঙ্গের গতিরুদ্ধ হল না। পরন্তপ কয়েকটি ছুরিকা নিক্ষেপ করল সজোরে। ছুরিকা হস্তীর দেহে বিদ্ধ হল। গজরাজ সেই আঘাত গ্রাহ্যই করল না। তার বিশাল দেহে ছুরিকার আঘাত বোধহয় মানব দেহে মশক দংশনের মতোই তুচ্ছ। তীব্র বৃংহনে চারদিক কাঁপিয়ে বল্লভের নিকটস্থ হল মত্ত মাতঙ্গ,… কাছে, কাছে,… আরও কাছে..
বল্লভের পায়ের তলায় মাটি কাঁপছে দানবের পদভারে, কর্ণকুহরকে বধির করে জাগছে ঘন ঘন তীব্র বৃংহণ-ধ্বনি- বল্লভ অনুভব করল মৃত্যুদূত একেবারে তার কাছে এসে পড়েছে, আর বুঝি রক্ষা নেই!
হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বল্লভ, কুঠার তুলে রুখে দাঁড়াল। ক্ষুদ্র মানুষের স্পর্ধা দেখে হিংস্র বৃংহণে ক্রোধ প্রকাশ করল দানব, হত্যার উদগ্র আগ্রহে শূন্যে দুলে উঠল যমদণ্ডের ন্যায় প্রকাণ্ড শুণ্ড–
কিন্তু সেই আঘাত যথাস্থানে পড়ার আগেই ছুটে এসে হস্তীর দক্ষিণ পার্শ্ব থেকে বাণ নিক্ষেপ করল শশক। সঙ্গে সঙ্গে আর্ত চিৎকার করে থমকে দাঁড়াল মৃত্যুদূত– তার দক্ষিণ চক্ষু ভেদ করেছে শশকের বাণ!
আঘাতের ফলে হস্তীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য অপেক্ষা করল না শশক— একলাফে হস্তীর সম্মুখে এসে পড়ল সে এবং সেখান থেকে আর একলাফে বামপার্শ্বে- পরক্ষণেই জ্যা-মুক্ত বাণ অব্যর্থ সন্ধানে হস্তীর বামচক্ষুতে বিদ্ধ হল।
ভয়ংকর বৃংহণ-শব্দে আকাশ বুঝি ফেটে পড়তে চায়! অন্ধ গজরাজ বিষম আক্রাশে এগিয়ে এল, জান্তব অনুভূতি দিয়ে শত্রুর অবস্থান নির্ণয় করে সজোরে শুণ্ডাঘাত করল।
এক সদীর্ঘ লক্ষে স্থান ত্যাগ করল বল্লভ, সঙ্গে সঙ্গে তার পরিত্যক্ত স্থানে সশব্দে আছড়ে পড়ল হস্তীর ভয়ংকর শুণ্ড!
স্থূলকায় মল্ল অবিশ্বাস্য বেগে ছুটে গেল হস্তীর পিছন দিকে, দুই হাতে কুঠার তুলে ভীমবেগে আঘাত হানল দানবের পিছনে একটি পায়ের উপর। শাণিত কুঠারফলক পশ্চাৎভাগের দক্ষিণ চরণটিকে প্রায় দ্বিধাবিভক্ত করে মাংসের মধ্যে গম্ভীর হয়ে বসল, ফিনকি দিয়ে তপ্ত রক্তধারা সিক্ত করে দিল বল্লভের সর্বাঙ্গ! ভীষণ আর্তনাদ করে মাটিতে জানু পেতে বসে পড়ল হস্তী!
আবার ছুটে এল বল্লভ–এবার পিছনে নয়, সামনে, হস্তীর মস্তকের দক্ষিণপার্শ্বে আবার শূন্যে দুলে উঠল রক্তাক্ত কুঠার, তারপর নিদারুণ বেগে নেমে এল মাথার উপর, প্রচণ্ড আঘাতে বিদীর্ণ হয়ে গেল করিকুম্ভ! ছিটকে পড়ল খণ্ড খণ্ড অস্তি, মজ্জা, মেদ; এবং ধরণীকে লোহিতবর্ণে রঞ্জিত করে ছুটল রক্তনদীর স্রোত!
অস্ফুট আর্তনাদ করে তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করল গজরাজ!…
ছুটতে ছুটতে আর ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে বল্লভের পাশে এসে দাঁড়াল শায়ন, তারপর বলল, খুব বেঁচে গেছ বল্লভ! মদস্রাব ঘটলে পুরুষ হস্তী উন্মত্ত হয়ে বিচরণ করে-হস্তিনী ছাড়া অন্য যে-কোনো জীবকেই ওই সময়ে সে হত্যা করতে সচেষ্ট হয়। এই হস্তীও মত্ত অবস্থা প্রাপ্ত হয়েছিল। এই দেখ, চক্ষুর তলায় ক্ষুদ্র ছিদ্র থেকে ঘন পীতাভ নির্যাস বা মদ নির্গত হয়ে গণ্ডদেহকে প্লাবিত করেছে। মদনিঃস্রাবে সিক্তগণ্ড এই গজরাজ তোমার চিৎকারে আকৃষ্ট হয়ে তোমাকে আক্রমণ করেছিল। অরণ্যে অনর্থক চিৎকার করলে বিপদ ঘটতে পারে একথা মনে রেখো।
পরন্তপ বলল, আজকের ঘটনা আমার চিরকাল মনে থাকবে। ধনুর্বাণে শশকের আশ্চর্য নিশানা আর বল্লভের প্রচণ্ড শক্তির যে পরিচয় পেলাম, তা জীবনে ভুলব না।
শায়ন বলল, শশকের নিশানা দেখে আমি চমকিত হয়েছি। আক্রমণোদ্যত ধাবমান হস্তীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে নির্ভুল লক্ষ্যে তার দুই চক্ষুকে বিদ্ধ করতে আমিও পারব না।
কর্ণদেব বলল, বল্লভের কৃতিত্বও কম নয়। কুঠারের আঘাতে হস্তীকে বধ করা কি সহজ কর্ম?
পরন্তপ বলল, একথা সত্য। কেউ কারও চাইতে কম নয়।
বল্লভ বলল, না। শশকের ক্ষমতা আমার চাইতে বেশি। আমার পক্ষে হস্তীর দই চক্ষক বাণবিদ্ধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি যা করেছি শশকের পক্ষে সেই কাজ অসম্ভব বলে মনে হয় না।
কর্ণদেব বলল, শশক নীরব কেন? কি ভাবছ?
নির্বিকার কণ্ঠে শশক বলল, ভাবছি, হস্তীমাংসেই আজ ক্ষুন্নিবৃত্তি করব।
স্খলিত স্বরে হাস্য করে বল্লভ বলল, একটু আগেও আমি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত ছিলাম। কিন্তু এখন আদৌ ক্ষুধাবোধ করছি না।
শায়ন বলল, আহার্যের কথা চিন্তা করলেই আমার বিবমিষা আসছে।
কর্ণদেব বলল, আজ সারাদিনের মধ্যে কোনো বস্তু গলাধঃকরণ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
শশক বলল, আমি ক্ষুধার্ত। মৃগমাংসের পরিবর্তে এই হস্তীমাংস অগ্নিতে দগ্ধ করে ক্ষুধানিবারণ করব। শুল্য গজমাংস অতি উপাদেয় আহার্য। একবার এর স্বাদ গ্রহণ করলে জীবনে ভুলতে পারবে না। তোমরা আমার সঙ্গে গজমাংসের ভোজ যোগ দাও।
সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হল, অসম্ভব।
বন্যহস্তীর আকস্মিক আবির্ভাব এবং রক্তপাতের দৃশ্য তোমাদের স্নায়ুর উপর বিষম প্রতিক্রয়া সৃষ্টি করেছে; ফলে এই ক্ষুধামান্দ্য, শশক হেসে বলল, কিন্তু আমি তোমাদের এমন একটি সংবাদ দিতে পারি, যা শ্রবণ করলই পলাতক জঠরাগ্নি আবার তোমাদের উদরে ফিরে আসবে।
সকলেই জিজ্ঞাসু নেত্রে শশকের মুখের পানে দৃষ্টিপাত করল।
বিশ্বাস হচ্ছে না? শশক বলল, তবে শোনো। আমরা যে করোটি পর্বতের কাছে এসে পড়েছি সেকথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু কাছে বলতে কত কাছে, সে ধারণা তোমাদের নেই। একদিন! আর মাত্র একদিনের পথ চললেই আমরা যথাস্থানে পৌঁছে যাব।
–অহো! অপূর্ব বার্তা!
–সাধু! সাধু!
-ঈশ্বর তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন!
মধু! মধু! তোমার রসনা যেন মধুবৰ্ষণ করল!
সকলে সবিস্ময়ে আবিষ্কার করল পলাতক জঠরাগ্নি আবার যথাস্থানে প্রত্যাবর্তন করেছে।