১৫. পত্রাবলী ৫১৫-৫২৪

৫১৫*

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১১ ডিসেম্বর, ১৯০০

প্রিয় জো,
পরশু রাত্রে আমি এখানে পৌঁছেছি। কিন্তু হায়! এত তাড়াহুড়া করে এসেও কোন লাভ হল না। ক্যাপ্টেন সেভিয়ার বেচারা কয়েক দিন পূর্বেই দেহত্যাগ করেছেন। এভাবে দুজন মহাপ্রাণ ইংরেজ আমাদের জন্য—হিন্দুদের জন্য আত্মদান করলেন। শহীদ কোথাও থাকে তো—এঁরাই। মিসেস সেভিয়ারকে এইমাত্র পত্র লিখলাম—তাঁর ভাবী কার্যক্রম জানবার জন্য।

আমি ভাল আছি। এখানকার সবই সবদিক দিয়ে ভালভাবেই চলছে। তাড়াতাড়ি চিঠি লিখলাম—কিছু মনে কর না। শীঘ্র দীর্ঘ পত্র দেব। ইতি

সর্বদা সত্যাশ্রয়ী
তোমাদেরই বিবেকানন্দ

৫১৬*

[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৫ ডিসেম্বর, ১৯০০

মা,
কয়েক দিন আগে এখানে পৌঁছেছি। আমার আগমন একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল, সকলে খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল।

আমার অনুপস্থিতি-কালে আমি যতটা আশা করেছিলাম, কাজ তার চেয়েও ভালভাবে চলেছে; শুধু মিঃ সেভিয়ার দেহত্যাগ করেছেন। এটা সত্যই একটা প্রচণ্ড আঘাত—হিমালয়ে কাজের ভবিষ্যৎ যে কি হবে জানি না। মিসেস সেভিয়ার এখানও সেখানে আছেন এবং আমি রোজই তাঁর কাছ থেকে চিঠি আশা করছি।

সারদানন্দ ও ব্রহ্মানন্দ আগের থেকে ভাল আছে; এ বছর এখানে ম্যালেরিয়া নাই। গঙ্গার ধারের এই ফালি জমিটা সব সময়েই ম্যালেরিয়া-মুক্ত। শুধু প্রচুর বিশুদ্ধ জলের ব্যবস্থা হলেই অবস্থা সর্বাঙ্গসুন্দর হবে। ইতি

বিবেকানন্দ

৫১৭*

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
১৯ ডিসেম্বর, ১৯০০

কল্যাণীয়া নিবেদিতা,
মহাদেশসমূহের আর একপ্রান্ত থেকে একটি স্বর তোমায় প্রশ্ন করছেঃ ‘কেমন আছ?’ এতে তুমি অবাক হচ্ছ না কি? বস্তুতঃ আমি হচ্ছি ঋতুর সঙ্গে বিচরণকারী একটি বিহঙ্গম।

আনন্দমুখর ও কর্মচঞ্চল প্যারিস, দৃঢ়গঠিত প্রাচীন কনস্তান্তিনোপল্, চাকচিক্যময় ক্ষুদ্র এথেন্স, পিরামিড-শোভিত কায়রো—সবই পেছনে ফেলে এসেছি; আর এখন আমি এখানে, গঙ্গার তীরে মঠে আমার ঘরে বসে লিখছি। চতুর্দিকে কি শান্ত নীরবতা! প্রশস্ত নদী দীপ্ত সূর্যালোকে নাচছে; শুধু ক্বচিৎ দু-একখানা মালবাহী নৌকার দাঁড়ের শব্দে সে স্তব্ধতা ক্ষণিকের জন্য ভেঙে যাচ্ছে।

এখানে এখন শীতকাল চলেছে; কিন্তু প্রতিদিন মধ্যাহ্ন বেশ উষ্ণ ও উজ্জ্বল। এ হচ্ছে দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার শীতেরই মত। সর্বত্র সবুজ ও সোনালী রঙের ছড়াছড়ি, আর কচিঘাসগুলি যেন মখমলের মত। অথচ বাতাস শীতল, পরিষ্কার ও আরামপ্রদ। ইতি

 

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৫১৮

[শ্রীমতী মৃণালিনী বসুকে লিখিত]

দেওঘর, বৈদ্যনাথ
বাবু প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের বাড়ী
২৩ ডিসেম্বর, ১৯০০

মা,
তোমার পত্র পাইয়া বড়ই আনন্দিত হইলাম; তুমি যা বুঝিয়াছ, তাহা ঠিক। ‘স ঈশ অনির্বচনীয়ঃ প্রেমস্বরূপঃ’—সেই ঈশ্বর অনির্বচনীয় প্রেমস্বরূপ, নারদোক্ত লক্ষণটি যে প্রত্যক্ষ এবং সর্ববাদিসম্মত, আমার জীবনের ইহা স্থিরসিদ্ধান্ত। অনেকগুলি ব্যক্তির একত্র নাম ‘সমষ্টি’, এক-একটির নাম ‘ব্যষ্টি’, তুমি আমি ‘ব্যষ্টি’, সমাজ ‘সমষ্টি’। তুমি আমি পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ বৃক্ষ লতা পৃথিবী গ্রহ নক্ষত্রাদি এক একটি ‘ব্যষ্টি’, আর এই জগৎটি ‘সমষ্টি’—বেদান্তে ইহাকেই বিরাট বা হিরণ্যগর্ভ বা ঈশ্বর বলে। পৌরাণিক ব্রহ্মা, বিষ্ণু, দেবী ইত্যাদি নাম।

ব্যষ্টির ব্যক্তিগত স্বাধীনতা আছে কিনা এবং কত পরিমাণে হওয়া উচিত, সমষ্টির নিকট ব্যষ্টির একেবারে সম্পূর্ণ আত্মেচ্ছা, আত্মসুখ ত্যাগ করা উচিত কিনা—এই প্রশ্নই সমাজের অনাদি কালের বিচার্য। এই প্রশ্নের সিদ্ধান্ত লইয়াই সকল সমাজ ব্যস্ত; আধুনিক পাশ্চাত্য সমাজে ইহাই প্রবল তরঙ্গ-রূপ ধারণ করিয়া সমুত্থিত হইয়াছে। যে মতে ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে সমাজের প্রভুতার সম্মুখে বলি দিতে চায়, তাহার ইংরেজী নাম সোশ্যালিজম্, ব্যক্তিত্বসমর্থক মতের নাম ইণ্ডিভিজুয়ালিজম্।

সমাজের নিকট ব্যক্তির—নিয়মের ও শিক্ষার শাসন দ্বারা চিরদাসত্বের ও বলপূর্বক আত্মবিসর্জনের কি ফল ও পরিণাম, আমাদের মাতৃভূমিই তাহার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এদেশে লোকে শাস্ত্রোক্ত আইন অনুসারে জন্মায়, ভোজন-পানাদি আজীবন নিয়মানুসারে করে, বিবাহাদিও সেই প্রকার; এমন কি, মরিবার সময়ও সেই সকল শাস্ত্রোক্ত আইন অনুসারে প্রাণত্যাগ করে। এই কঠোর শিক্ষার একটি মহৎ গুণ আছে, আর সকলই দোষ। গুণটি এই যে, দুটি-একটি কার্য পুরুষানুক্রমে প্রত্যহ অভ্যাস করিয়া অতি অল্পায়াসে সুন্দর রকম লোকে করিতে পারে। তিনখানা মাটির ঢিপি ও খানকতক কাষ্ঠ লইয়া এদেশের রাঁধুনী যে সুস্বাদু অন্ন-ব্যঞ্জন প্রস্তুত করে, তাহা আর কোথাও নাই। একটা মান্ধাতার আমলের এক টাকা দামের তাঁত ও একটা গর্তের ভিতরে পা, এই সরঞ্জামে ২০ টাকা গজের কিংখাব কেবল এদেশেই হওয়া সম্ভব। একখানা ছেঁড়া মাদুর, একটা মাটির প্রদীপ, তায় রেড়ির তেল, এই উপাদান-সহায়ে দিগ‍্গজ পণ্ডিত এদেশেই হয়। খেঁদাবোঁচা স্ত্রীর উপর সর্বসহিষ্ণু মহত্ত্ব ও নির্গুণ মহাদুষ্ট পতির উপর আজন্ম ভক্তি এদেশেই হয়! এই তো গেল গুণ।

কিন্তু এই সমস্তগুলিই মনুষ্য প্রাণহীণ যন্ত্রের ন্যায় চালিত হয়ে করে; তাতে মনোবৃত্তির স্ফূর্তি নাই, হৃদয়ের বিকাশ নাই, প্রাণের স্পন্দন নাই, ইচ্ছাশক্তির প্রবল উত্তেজনা নাই, তীব্র সুখানুভূতি নাই, বিকট দুঃখেরও স্পর্শ নাই; উদ্ভাবনা-শক্তির উদ্দীপনা একেবারেই নাই, নূতনত্বের ইচ্ছা নাই, নূতন জিনিষের আদর নাই। এ হৃদয়াকাশের মেঘ কখনও কাটে না, প্রাতঃসূর্যের উজ্জ্বল ছবি কখনও মনকে মুগ্ধ করে না। এ অবস্থার অপেক্ষা কিছু উৎকৃষ্ট আছে কিনা, মনেও আসে না, আসিলেও বিশ্বাস হয় না, বিশ্বাস হলেও উদ্যোগ হয় না, উদ্যোগ হইলেও উৎসাহের অভাবে তাহা মনেই লীন হইয়া যায়।

নিয়মে চলিতে পারিলেই যদি ভাল হয়, পূর্বপুরুষানুক্রমে সমাগত রীতিনীতির অখণ্ড অনুসরণ করাই যদি ধর্ম হয়, বল, বৃক্ষের অপেক্ষা ধার্মিক কে? রেলের গাড়ীর চেয়ে ভক্ত সাধু কে? প্রস্তরখণ্ডকে কে কবে প্রাকৃতিক নিয়মভঙ্গ করিতে দেখিয়াছে? গো-মহিষাদিকে কে কবে পাপ করিতে দেখিয়াছে?

অতি প্রকাণ্ড কলের জাহাজ, মহাবলবান্ রেলের গাড়ীর ইঞ্জিন—তাহারাও জড়; চলে ফেরে, ধাবমান হয়, কিন্তু জড়। আর ঐ যে ক্ষুদ্র কীটাণুটি রেলের গাড়ীর পথ হইতে আত্মরক্ষার জন্য সরিয়া গেল, ওটি চৈতন্যশীল কেন? যন্ত্রে ইচ্ছাশক্তির বিকাশ নাই, যন্ত্র নিয়মকে অতিক্রম করিতে চায় না; কীটটি নিয়মকে বাধা দিতে চায়, পারুক বা নাই পারুক, নিয়মের বিপক্ষে উত্থিত হয়, তাই সে চেতন। এই ইচ্ছাশক্তি যেথায় যত সফল বিকাশ, সেথায় সুখ তত অধিক, সে জীব তত বড়। ঈশ্বরে ইচ্ছাশক্তির পূর্ণ সফলতা, তাই তিনি সর্বোচ্চ।

বিদ্যাশিক্ষা কাকে বলি? বই পড়া?—না, নানাবিধ জ্ঞানার্জন? তাও নয়। যে শিক্ষা দ্বারা এই ইচ্ছাশক্তি বেগ ও স্ফূর্তি নিজের আয়ত্তাধীন ও সফলকাম হয়, তাহাই শিক্ষা। এখন বোঝ, যে শিক্ষার ফলে এই ইচ্ছাশক্তি ক্রমাগত পুরুষানুক্রমে বলপূর্বক নিরুদ্ধ হইয়া এক্ষণে লুপ্তপ্রায় হইয়াছে, যাহার শাসনে নূতন ভাবের কথা দূরে থাক, পুরাতনগুলিই একে একে অন্তর্হিত হইতেছে, যাহা মনুষ্যকে ধীরে ধীরে যন্ত্রের ন্যায় করিয়া ফেলিতেছে, সে কি শিক্ষা? চালিত যন্ত্রের ন্যায় ভাল হওয়ার চেয়ে স্বাধীন ইচ্ছা—চৈতন্য-শক্তির প্রেরণায় মন্দ হওয়াও আমার মতে কল্যাণকর। আর এই মৃৎপিণ্ডপ্রায়, প্রাণহীন যন্ত্রগুলির মত উপলরাশির ন্যায় স্তূপীকৃত মনুষ্যসমষ্টির দ্বারা যে সমাজ গঠিত হয়, সে কি সমাজ? তাহার কল্যাণ কোথায়? কল্যাণ যদি সম্ভব হইত, তবে সহস্র বৎসরের দাস না হইয়া আমরাই পৃথিবীর সর্বোচ্চ জাতি হইতাম, মহামূর্খতার আকর না হইয়া ভারতভূমিই বিদ্যার চিরপ্রস্রবণ হইত।

তবে কি আত্মত্যাগ ধর্ম নহে? বহুর জন্য একের সুখ—একের কল্যাণ উৎসর্গ করা কি ‍একমাত্র পুণ্য নহে? ঠিক কথা, কিন্তু আমাদের ভাষায় বলে, ‘ঘষে-মেজে রূপ কি হয়?’ ধরে-বেঁধে প্রীত কি হয়?’ চিরভিখারীর ত্যাগে কি মাহাত্ম? ইন্দ্রিয়হীনের ইন্দ্রিয়সংযমে কি পুণ্য? ভাবহীন, হৃদয়হীন, উচ্চ-আশাহীনের, সমাজের অস্তিত্ব-নাস্তিত্ব-জ্ঞানহীনের আবার আত্মোৎসর্গ কি? বলপূর্বক সতীদাহে কি সতীত্বের বিকাশ? কুসংস্কার শিখাইয়া পুণ্য করানোই বা কেন? আমি বলি, বন্ধন খোল, জীবের বন্ধন খোল, যতদূর পার বন্ধন খোল। কাদা দিয়ে কাদা ধোয়া যায়? বন্ধনের দ্বারা কি বন্ধন কাটে? কার কেটেছে? সমাজের জন্য যখন নিজের সুখেচ্ছা বলি দিতে পারবে, তখন তুমিই বুদ্ধ হবে, তুমিই মুক্ত হবে, সে ঢের দূর! আবার তার রাস্তা কি জুলুমের উপর দিয়ে? আহা!! আমাদের বিধবাগুলি কি নিঃস্বার্থ ত্যাগের দৃষ্টান্ত, এমন রীতি কি আর হয়!!! আহা, বাল্য-বিবাহ কি মধুর!! সে স্ত্রী-পুরুষে ভালবাসা না হয়ে কি যায়!!! এই বলে নাকে কান্নার এক ধুয়া উঠেছে। আর পুরুষের বেলা অর্থাৎ যাঁদের হাতে চাবুক, তাঁদের বেলা ত্যাগের কিছুই দরকার নাই। সেবাধর্মের চেয়ে আর কি ধর্ম আছে? কিন্তু সেটা বামুন-ঠাকুরের বেলা নহে, তোমরাই কর। আসল কথা, মা-বাপ আত্মীয়-স্বজন প্রভৃতি এদেশের—নিজের স্বার্থের জন্য, নিজে সামাজিক অবমাননা হইতে বাঁচিবার জন্য পুত্র-কন্যাদি সব নির্মম হইয়া বলিদান করিতে পারেন, এবং পুরুষানুক্রমে শিক্ষা মানসিক জড়ত্ব বিধান করিয়া উহার দ্বারা উন্মুক্ত করিয়াছে। যে বীর, সেই ত্যাগ করিতে পারে; যে কাপুরুষ, সে চাবুকের ভয়ে এক হাতে চোখ মুচছে আর এক হাতে দান করছে, তার দানে কি ফল? জগৎপ্রেম অনেক দূর। চারাগাছটিকে ঘিরে রাখতে হয়, যত্ন করতে হয়। একটিকে নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসতে শিখতে পারলে ক্রমে বিশ্বব্যাপী প্রেমের আশা করা যায়। ইষ্ট-দেবতাবিশেষে ভক্তি হলে ক্রমে বিরাট ব্রহ্মে প্রীতি হতে পারে।

অতএব একজনের জন্য আত্মত্যাগ করতে পারলে তবে সমাজের জন্য ত্যাগের কথা কহা উচিত, তার আগে নয়। সকাম থেকেই নিষ্কাম হয়। কামনা না আগে থাকলে কি কখনও তাহার ত্যাগ হয়? আর তার মানেই বা কি? অন্ধকার না থাকলে কি কখনও আলোকের মানে হয়?

সকাম সপ্রেম পূজাই প্রথম। ছোটর পূজাই প্রথম, তারপর আপনা-আপনি বড় আসবে।

মা, চিন্তিত হয়ো না। বড় গাছেই বড় ঝড় লাগে। কাঠ নেড়ে দিলে বেশী জ্বলে, সাপের মাথায় আঘাত লাগলে তবে সে ফণা ধরে ইত্যাদি।৩৭ যখন হৃদয়ের মধ্যে মহা যাতনা উপস্থিত হয়, চারিদিকে দুঃখের ঝড় উঠে, বোধ হয় যেন এ-যাত্রায় আলো দেখতে পাব না, যখন আশা ভরসা প্রায় ছাড়ে ছাড়ে, তখনই এই মহা আধ্যাত্মিক দুর্যোগের মধ্য হইতে অন্তর্নিহিত ব্রহ্মজ্যোতি স্ফূর্তি পায়। ক্ষীর-ননী খেয়ে, তুলোর উপর শুয়ে, এক ফোঁটা চোখের জল কখনও না ফেলে কে কবে বড় হয়েছে, কার ব্রহ্ম কবে বিকশিত হয়েছে? কাঁদতে ভয় পাও কেন? কাঁদো। কেঁদে কেঁদে তবে চোখের জল সাফ হয়, তবে অন্তর্দৃষ্টি হয়, তবে আস্তে আস্তে মানুষ জন্তু গাছপালা দূর হয়ে তার জায়গায় সর্বত্র ব্রহ্মদর্শন হয়। তখন—

‘সমং পশ্যন্ হি সর্বত্র সমবস্থিতমীশ্বরম্।
ন হিনস্ত্যাত্মনাত্মানং ততো যাতি পরাং গতিম্॥’

সর্বত্র সমানভাবে বিদ্যমান ঈশ্বরকে জানিয়া নিজে আর নিজেকে হিংসা করেন না (অর্থাৎ সবই তিনি), তখনই পরমা গতি প্রাপ্ত হন।

 

সদা শুভাকাঙ্ক্ষী
বিবেকানন্দ

৫১৯

[স্বামী রামকৃষ্ণানন্দকে নিখিত]

ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়

মঠ, বেলুড়
২৬ ডিসেম্বর, ১৯০০

কল্যাণবরেষু,
তোমার পত্রে সমস্ত অবগত হলুম। শরীর যদি খারাপ হয়, অবশ্য এখানে তোমার আসা উচিত নয়—এবং আমিও কল্য মায়াবতী যাচ্ছি। সেখানে আমার একবার যাওয়া অত্যন্ত আবশ্যক।

আলাসিঙ্গা যদি আসে, আমার প্রত্যাগমন-অপেক্ষা তাকে করতে হবে। কানাই সম্বন্ধে এরা কি করছে—তা জানি না। আমি আলমোড়া হতে শীঘ্র ফিরব, তারপর মান্দ্রাজ যাওয়া হতে পারে। ওয়ানিয়ামবড়ি (Vaniyambadi) হতে এক পত্র পেয়েছি—তাদের আমার আশীর্বাদ ও ভালবাসা জানিয়ে এক পত্র লিখো এবং আমি মান্দ্রাজ আসবার সময় অবশ্য সে-স্থান হয়ে আসব, একথা জানিও। সকলকে আমার ভালবাসা জানাবে। তুমি অতিরিক্ত পরিশ্রম করবে না। আর আর সমস্ত মঙ্গল। ইতি

 

বিবেকানন্দ

৫২০*

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৬ ডিসেম্বর, ১৯০০

প্রিয় জো,
আজকের ডাকে তোমার চিঠি পেলাম। সেই সঙ্গে মা এবং এলবার্টার চিঠিও পেলাম। এলবার্টার পণ্ডিত বন্ধুবর রাশিয়া সম্বন্ধে যা বলেছেন, তা প্রায় আমার ধারণারই মত। তাঁর চিন্তার একটা জায়গায় শুধু মুশকিল দেখছি—সমগ্র হিন্দুজাতির পক্ষে এককালে রাশিয়ার ভাবে ভাবিত হওয়া সম্ভব কি?

আমাদের প্রিয় বন্ধু মিঃ সেভিয়ার—আমি পৌঁছবার আগেই দেহত্যাগ করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত আশ্রমের পাশ দিয়ে যে নদীটি প্রবাহিত তারই তীরে হিন্দুরীতিতে তাঁর সৎকার করা হয়েছে। ব্রাহ্মণেরা তাঁর পুষ্পমাল্য-শোভিত দেহ বহন করে নিয়েছিল এবং ব্রহ্মচারীরা বেদধ্বনি করেছিল।

আমাদের আদর্শের জন্য ইতোমধ্যে দু-জন ইংরেজের৩৮ আত্মদান হয়ে গেল। এর ফলে প্রিয় প্রাচীন ইংলণ্ড ও তার বীর সন্তানগণ আমার আরও প্রিয় হয়ে উঠেছে। ইংলণ্ডের শ্রেষ্ঠ শোণিতধারায় ভবিষ্যৎ ভারতের চারাগাছটি মহামায়া যেন বারিসিঞ্চিত করেছেন—মহামায়ারই জয় হউক।

মিসেস সেভিয়ার অবিচলিত আছেন। প্যারিসের ঠিকানায় তিনি আমাকে যে চিঠি লিখেছিলেন, তা এই ডাকে ফিরে এল। আগামী কাল আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে পাহাড়ে যাব। ভগবান্‌ তাকে আশীর্বাদ করুন—এই নির্ভয়প্রাণাকে।

আমি নিজে দৃঢ় এবং শান্ত আছি। আজ পর্যন্ত কোন ঘটনা কখনও আমাকে বিচলিত করতে পারেনি; আজও মহামায়া আমাকে অবসন্ন হতে দেবেন না।

শীতাগমের সঙ্গে সঙ্গে এ স্থান বেশ আরামপ্রদ হয়ে উঠেছে। অনাচ্ছাদিত তুষারাবরণে হিমালয় আরও সুন্দর হয়ে উঠবে।

মিঃ জনস্টন নামক যে যুবকটি নিউ ইয়র্ক থেকে রওনা হয়ে এসেছিল, সে ব্রহ্মচর্য-ব্রত গ্রহণ করেছে এবং মায়াবতীতে আছে।

টাকাটা সারদানন্দের নামে মঠে পাঠিয়ে দিও, কারণ আমি পাহাড়ে চলে যাচ্ছি। তারা তাদের সাধ্যমত ভাল কাজই করেছে। আমি খুশী এবং স্নায়বিক বিরক্তির জন্য নিজেকেই বেকুব মনে করছি। তারা বরাবরের মত সৎ ও বিশ্বাসী আছে এবং তাদের শরীরও সুস্থ।

মিসেস বুলকে এ-সকল সংবাদ লিখো এবং বল যে, তিনিই বরাবর ঠিক বলেছেন, আর আমারই ভুল হয়েছে। সে-জন্য আমি সহস্রবার তাঁর নিকট ক্ষমা চাইছি। তাঁকে ও—কে আমার অগাধ ভালবাসা দিও।

সমুখে পিছনে তাকাই যখন
দেখি সবকিছু ঠিকই আছে।
আত্মার জ্যোতি জ্বল জ্বল করে
আমার গভীর দুঃখের মাঝে।৩৯

—কে, মিসেস—কে, প্রিয় জুল বোয়াকে আমার ভালবাসা জানাবে। প্রিয় জো, তুমি আমার প্রণাম জানবে। ইতি

বিবেকানন্দ

৫২১*

প্রবুদ্ধ ভারত আপিস
মায়াবতী, হিমালয়
৬ জানুআরী, ১৯০১

প্রিয় ধীরামাতা,
ডাক্তার বসু আপনার মারফত যে ‘নাসদীয় সূক্ত’ পাঠিয়েছিলেন, আমি এখনই তার অনুবাদ পাঠাচ্ছি। আমি অনুবাদটিকে যতটা সম্ভব আক্ষরিক করতে চেষ্টা করেছি। আশা করি, ডাক্তার বসু ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

মিসেস সেভিয়ার খুব দৃঢ়চিত্ত মহিলা এবং খুব শান্ত ও সবলভাবে শোক সহ্য করে নিয়েছেন। তিনি এপ্রিল মাসে ইংলণ্ডে যাচ্ছেন এবং আমিও তাঁর সঙ্গে যাচ্ছি।

এ স্থানটি অতি সুন্দর এবং তারা (আশ্রমবাসীরা) একে খুব মনোরম করে তুলেছে। কয়েক একর পরিমিত বিশাল স্থানটি সযত্নে রাখা হয়েছে। আশা করি মিসেস সেভিয়ার ভবিষ্যতে ইহা রক্ষা করতে পারবেন। অবশ্য তিনি বরাবরই এরূপ আশা করছেন।

জো-র কাছ থেকে শেষ চিঠিতে জানতে পেলাম, সে মাদাম কালভের সঙ্গে … যাচ্ছে।

জেনে সুখী হলাম, মার্গট ভবিষ্যতে কাজে লাগাবার জন্য তার বিদ্যা রেখে দিচ্ছে। তার বইখানা এখানে খুব সমাদর লাভ করেছে, কিন্তু মনে হয় প্রকাশকেরা বিক্রীর জন্য তেমন চেষ্টা করছে না।

কলিকাতার প্রথম দিনের ছোঁয়াচেই আমার হাঁপানি আবার দেখা দিয়েছিল। সেখানে যে দু-সপ্তাহ ছিলাম, প্রতি রাত্রেই রোগের আক্রমণ হত। হিমালয়ে বেশ ভাল আছি। এখানে খুব বরফ পড়ছে, পথে প্রবল হিমঝঞ্ঝার মধ্যে পড়েছিলাম; কিন্তু ঠাণ্ডা তত বেশী নয়। এখানে আসার পথে দুদিন ঠাণ্ডা লাগায় খুব উপকার হয়েছে বলে মনে হয়।

আজ মিসেস সেভিয়ারের জমিগুলি দেখতে দেখতে বরফের উপর দিয়ে মাইলখানেক চড়াই করেছি। সেভিয়ার সব জায়গায় সুন্দর রাস্তা তৈরী করেছেন। প্রচুর বাগান মাঠ ফলগাছ এবং দীর্ঘ বন তাঁর দখলে। থাকবার কুটীরগুলি কি সাদাসিধে পরিচ্ছন্ন সুন্দর, এবং সর্বোপরি কাজের উপযোগী!

আপনি কি শীঘ্র আমেরিকা যাচ্ছেন? যদি না যান, তাহলে তিনমাসের মধ্যে লণ্ডনে আপনার সঙ্গে দেখা হবে, আশা করি।

অনুগ্রহ করে মিস ওলকককে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন। এর পরে যখন মূলারের সঙ্গে আপনার দেখা হবে, তাকে ও স্টার্ডিকে আমার গভীর ভালবাসা জানাবেন। কলিকাতায় আমার মা, ভগ্নী ও অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করেছি।

এখানকার সকলকেই আপনাকে ভালবাসা জানাচ্ছে।

 

আপনার চিরস্নেহাবদ্ধ সন্তান
বিবেকানন্দ

পুনঃ—কালী দুটি বলি গ্রহণ করেছেন; মহৎ উদ্দেশ্যে দু-জন ইওরোপীয় শহীদ আত্মত্যাগ করেছেন, এখন কাজ অতি সুন্দরভাবে এগিয়ে চলবে।

বি

এলবার্ট ও—কে আমার ভালবাসা জানাচ্ছি।

চারিদিকে ছ-ইঞ্চি গভীর বরফ পড়ে আছে, সূর্য উজ্জ্বল ও মহীয়ান্, আর মধ্যাহ্নে বাহিরে বসে আমরা বই পড়ছি। আমাদের চারধারেই বরফ! বরফ থাকা সত্ত্বেও শীতকাল এখানে বেশ মৃদু। বায়ু শুষ্ক ও স্নিগ্ধকর, এবং জল প্রশংসার অতীত।

বি

৫২২*

মায়াবতী, হিমালয়
১৫ জানুআরী, ১৯০১

প্রিয় স্টার্ডি,
সারদানন্দের কাছে খবর পেলাম যে, ইংলণ্ডের কাজের জন্য যে ১,৫২৯।/৫ পাই হাতে ছিল, তা তুমি মঠে পাঠিয়ে দিয়েছ। এ টাকা ভাল কাজেই লাগবে নিশ্চিত।

প্রায় তিন মাস আগে ক্যাপ্টেন সেভিয়ার দেহত্যাগ করেছেন। তাঁরা এই পাহাড়ের উপর একটা সুন্দর আশ্রম স্থাপন করেছেন; আর মিসেস সেভিয়ারের ইচ্ছা যে, তিনি আশ্রমটি সংরক্ষণ করেন । আমি এখানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি এবং হয়তো তাঁরই সঙ্গে ইংলণ্ডে যেতে পারি।

আমি প্যারিস থেকে তোমায় একখানি চিঠি লিখেছিলাম, তুমি বোধ হয় তা পাওনি।

মিসেস স্টার্ডির দেহত্যাগের খবরে বড়ই দুঃখিত হলাম। তিনি সাধ্বী স্ত্রী ও স্নেহময়ী মাতা ছিলেন; জীবনে এরূপ মহিলা বড় একটা চোখে পড়ে না। এ জীবন আঘাতপূর্ণ; কিন্তু সে আঘাতের ব্যথা যেমন করেই হোক চলে যায়—এই যা আশা!

আগের চিঠিতে খোলাখুলিভাবে তোমার মনভাব প্রকাশ করেছ বলে যে আমি চিঠি লেখা বন্ধ করেছি—তা নয়। আমি শুধু ঢেউটা চলে যাবার অপেক্ষায় ছিলাম, এই হচ্ছে আমার রীতি। চিঠি লিখলে তিলকে তাল করে তোলা হত।

মিসেস জনসন ও অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে তাদের আমার শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানিও। ইতি

 

চিরসত্যবদ্ধ
বিবেকানন্দ

 

৫২৩*

[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২৬ জানুআরী, ১৯০১

মা,
আপনার উৎসাহপূর্ণ কথাগুলির জন্য অশেষ ধন্যবাদ। এখনই আমার ঐরূপ উৎসাহবাক্যের অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। নূতন শতাব্দী এসেছে, কিন্তু অন্ধকার কাটেনি, বরং স্পষ্টই তা ঘন হয়ে উঠছে। মিসেস সেভিয়ারকে দেখতে মায়াবতী গিয়েছিলাম। পথে খেতড়ির রাজার আকস্মিক মৃত্যুসংবাদ পেলাম। যতদূর বোঝা যাচ্ছে, তিনি নিজব্যয়ে আগ্রায় কোন পুরাতন স্থাপত্যকীর্তির সংস্কার করছিলেন, কাজ পরিদর্শনের জন্য কোন গোম্বুজে উঠেছিলেন, গম্বুজটির অংশবিশেষ ভেঙে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

জো এখানে আছে, কিন্তু তার সঙ্গে এখনও দেখা হয়নি।

বাঙলাদেশে, বিশেষতঃ মঠে যে মুহূর্তে পদার্পণ করি, তখনই আমার হাঁপানির কষ্টটা ফিরে আসে, এ স্থান ছাড়লেই আবার সুস্থ।

আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে তীর্থে যাচ্ছি। তীর্থযাত্রা সম্পূর্ণ করতে কয়েক মাস লাগবে। তীর্থদর্শন হল হিন্দু বিধবার প্রাণের সাধ; সারা জীবন আত্মীয়স্বজনদের কেবল দুঃখ দিয়েছি। তাঁদের এই একটি ইচ্ছা অন্তত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছি।

মার্গট সম্বন্ধে সব কিছু জেনে আনন্দিত হলাম। এদেশে ফিরে আসছে জেনে সকলে তাকে স্বাগত জানাতে উৎসুক।

আশা করি, ডক্টর বসু ইতোমধ্যে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করেছেন।

মিসেস হ্যামল্ডের কাছ থেকেও একখানি সুন্দর চিঠি পেয়েছি। তিনি মহীয়সী নারী।

যা হোক, আমি এখন অত্যন্ত শান্ত ও আত্মস্থ; সব কিছুকে অনেক ভাল দেখছি, যা কখনও দেখবার আশা করিনি।

আপনার স্নেহের চিরসন্তান
বিবেকানন্দ

৫২৪*

[মিসেস ওলি বুলকে লিখিত]

মঠ, বেলুড়, হাওড়া
২ ফেব্রুআরী, ১৯০১

মা,
কিছুদিন আগে আপনার একখানা চিঠি ও তার মধ্যে একখানা ১৫০ টাকার চেক পেয়েছিলাম। এটা আমি ছিঁড়ে ফেলব, কারণ আগের তিনটি চেক আমার এক ভগিনীকে (cousin) দিয়ে দিয়েছি।

জো এখানে; দুবার তার দেখা পেয়েছি, সে দেখাসাক্ষাৎ নিয়ে ব্যস্ত। ইংলণ্ডে যাবার পথে মিসেস সেভিয়ারের শীঘ্রই এখানে আসার কথা। তাঁর সঙ্গে ইংলণ্ডে যাবার আশা করেছিলাম, কিন্তু এখন অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে, তাতে মাকে নিয়ে দীর্ঘ তীর্থযাত্রায় আমাকে যেতেই হচ্ছে।

বাঙলাদেশে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই আমার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়; যা হোক, তার জন্য আজকাল বিশেষ ভাবি না, আমি ভালই আছি, আর আমার পারিপার্শ্বিক অবস্থাও ভাল।

মার্গটের সাফল্যের সংবাদ জেনে আনন্দিত, জো কিন্তু বলছে, টাকা পয়সা জুটছে না; ঐখানেই গোলমাল। কেবল মাত্র ধারাবাহিকতা রক্ষা করার মূল্য সামান্যই এবং লণ্ডন থেকে কলিকাতা অনেক দূর। মা-ই জানেন। মার্গটের ‘কালী দি মাদার’ (Kali the Mother) বইয়ের প্রশংসা সকলেই করছে। কিন্তু হায়! কেনার জন্য কেউ একটা বই পাচ্ছে না; পুস্তক-বিক্রেতারা বিক্রয় বাড়ানোর ব্যাপারে নিতান্ত উদাসীন।

এই নূতন শতাব্দী আপনাদের আরও মহত্তর ভবিষ্যতের জন্য অপূর্ব স্বাস্থ্য ও সামর্থ্য দিক্‌—এই আপনার সন্তান বিবেকানন্দের সতত প্রার্থনা।

বিবেকানন্দ