পনেরো – নকীবদ্বয় এবং বিঘোষণা
এক সকালে হঠাৎ লোকেরা শোনে গুড় গুড় গুড় গুড় ডিম ডিমা ডিম ডিম ঢ্যাঁড়রার রব। এই রবটি খুব চেনা। রাঙামাটির ঘগা বায়েন ছাড়া আবার কে? একমাইল ধুলোউড়ির মাঠ পেরিয়ে মধুপুরের সামনে লাইন ডিঙিয়ে জোড়া বেলতলায় মুড়ি খেয়েছে। পুকুরের সুন্দর স্বচ্ছ কাজল জল পান করেছে। কানের আধপোড়া বিড়িটি হাতে নিয়ে হাপিত্যেশ করেছে চন্না বাগদির—অর্থাৎ চরণ চৌকিদারের। হুঁ, টিশিনে চাঁদঘড়ির কাছে বাঁশি চুষে (গাঁজা খেয়ে) এতক্ষণে ওই সে আসে লাইনের ধারে ধারে, নীল কুর্তি কাঁধে লাঠি, ঝিমধরা সাপের গতি! তার কুর্তির পকেটে ছোট্ট চকমকি আছে।
এসে পরস্পর দেরির জন্য দোষারোপ করে যথারীতি ভাবও হয়েছে। বিড়ি খাওয়া হয়েছে। উপায় নেই—দুই হাভেতের মাথার ওপর তো মুনিব একজনাই। তবে কী, চরণ ঘোষক—তার মর্যাদা ঢুলির চেয়ে বেশি। এবং তারই কথামতো প্রথমে ঢুকতে হয়েছে মধুপুর।
সেকালের গ্রামে এই এক চিরাচরিত উত্তেজনা। যেন ‘রাসনীলে!’ তুখোড় ঘগা বলে। ‘যেন কী হল—না, চিকিষ্ণোর বংশীধ্বনি শুনে যে যেখানে ছিল, সম্মাই (সব্বাই) পড়ি—কী—মরি করে হাজির হল। কারও হাতে গোবর, কেউ ছেলেকে তোন (স্তন) দিচ্ছিল—সে চাকবারও সময় পেল না। কী? না—ওই বুঝি বাঁশি বাজে…’এই শেষ বাক্যটি গানের কলি এবং ঘগার গলাটি খাসা।
গুড় গুড় গুড় গুড় ডিম ডিমা ডিম ডিম! গাঁয়ের মুখে রব উঠল। ঘাট থেকে সাঁৎ সাঁৎ করে উঠে দাঁড়াল বউঝিরা। পিছনের দেওয়ালে গোবর চাপড়ি দিতে দিতে চমকে এবং থমকে কান পাতল বিষয়িনী বাঁজা এক বুড়ি। ঠশা (কালা) মোড়ল আর্তনাদ করে উঠল দাওয়ায়—’কীসের লুটিশ? কীসের লুটিশ?’ পিলপিল করে বেরিয়ে এল কাচ্চাবাচ্চারা। মুনিশ মাহিন্দার দাঁত বের করে অকারণ হাসতে লাগল। গেরস্থরা রুদ্ধশ্বাসে তাকাল। ঘগা বায়েন দ্বিগুণ জোরে বাজালো গুড় গুড় গুড় গুড় ডিম ডিমা ডিম ডিম!
তখন তৈরি হয়েছে চরণ চৌকিদার। মাথায় নীল পাগড়িটি বেঁধে কাঁধে লম্বা লাঠিটি ফেলে ঢোল থামবার অপেক্ষা করছে। অধৈর্য হয়ে সে ধমকাল—’বাস, বাস!’ এবং চিরাচরিত মুখস্থ ও তালিমপ্রাপ্ত ঘোষণাটি সগর্জনে (গাঁজা খেয়ে গলার নিকুচি করে ফেলেছে) আওড়ালো:
‘এই বাবুভদ্র ছোট বড় হেঁদুমোছলমান তাবৎ পোজা (প্রজা) সাধারণকে কহা যায় কী, আঙামাটির মা গঙ্গার মজা সোঁতার এক রংশে বাহান্ন বিঘা জলা জমা সৈদাবাদ জমিদারির ক্ষুদে (ছোট) তরফ বাবদ লিলামি সম্পত্তি মুশ্বিদাবাদ কালেকটোর বাহাদুর বরাবর সত্ব দখল ছিল—অদ্য হইতে ফাদার শমন (সাইমন) বাহাদুর বরাবর জিম্মাদারি মুতাবেক কেউ বিনিহুকুমে মচ্ছ (মৎস) ধরা কিংবা কোনোপোকার (প্রকার) ভোগ দখল করতে পারবা না, শমন সায়েবের কাছারি থেকে হুকুম লিবা—আ—আ—আ—আ!’
তিনদিন ধরে তালিম নিয়েছে চরণ। বরাবর একাজ তাকে করতে হয়। তাই সে পারে। যন্ত্রের মতন পারে।
আবার ঢোল বেজে উঠল। সব গাঁয়ের মাঝবরবার একটি সদর রাস্তা থাকবেই—এটা প্রাকৃতিক নিয়মের মতন অনিবার্য। এবং শেষপ্রান্তে পৌঁছতে চরণকে আরও দুবার এই দীর্ঘ জটিল ও অস্পষ্ট বাক্যটি উচ্চারণ করতে হল। কিন্তু এ তো স্বপ্নের মধ্যে উচ্চারণ তার। নিজেকে পোশাকের রঙের মতন একটি নীল রহস্যময় জগতে সে ভাসমান। পিছনে তার পালেপালে ন্যাংটো—আধন্যাংটো মনুবংশ—ওটাই টের পায় সে এবং বাস্তবতা অনুভব করে।
ফেরার পথে গাঁয়ের মধ্যিখানে শিসাল বটতলায় চণ্ডীমণ্ডপে একবার দাঁড়িয়ে জলপানের ইচ্ছা প্রকাশ করল। আশেপাশে কতিপয় বর্ণহিন্দুর বাস। সেকালে চৌকিদারদের সম্মান ও প্রযত্ন অধুনা ভাবা যায় না। বিরিঞ্চিবাবু নামে একজন ঘটি থেকে তার মুখে জল ঢেলে দিলেন। কিন্তু চরণ যে বাগদি, সেটা স্মরণ করিয়ে দিতেও ভুললেন না…’অ্যাই শালা বাগদি! জল তো খেলি—জমাদারবাবুকে বলিস, বিরিঞ্চিবাবুর খবর ভালো। কেমন?’ চরণ জানে ওটা গূঢ় সংকেতবাক্য। ওইসব কোড ডিসাইফর করার ক্ষমতা তার আছে। চৌকির জমাদারবাবুকে বলবে, হ্যাঁ—মধুপুরের বিরিঞ্চিবাবুর ‘খবর’ ভালো।
মধুপুর থেকে উত্তরমুখী হাঁটল নকীবদ্বয়। উঁচু—উঁচু খসখসে শুকনো ঘাসের আল, কেয়াঝোপ কোঙাঝোপ, ফণীমনসা, মাদার, শ্যাওড়াগাছ, দুধারে ছোটবড়ো পুকুর, উষর খেত পেরিয়ে আচমকা সামনে স্নিগ্ধ শ্যামলতা গোবিন্দপুর। পোস্টআপিস। লালবরণ ঢোল ঝুলছে দেয়ালে। ক’পা এগিয়ে বাঁশবাদাড় পেরোলে ছোট্ট নদী বাঁকী—শুকনো সোনালি বালি।
চরণরা ওদিকে যাবে না। গুড় গুড় ডিম ডিমা ডিম ডিমা চলেছে পিছনে কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে। যারা শোনেনি ঘোষণাটা, তারা বলে, ‘কীসের ঢেঁড়ি হে চরণদা?’ চরণ পিছনে দেখায়—শুনে নাও গে পোস্টমাস্টার মুখে। সে হাঁটে গর্বিত ভঙ্গিতে। গোবিন্দপুর থেকে পূর্বমুখী তার যাত্রা। শ্যামলিমার দুর্গ পেরোলে হঠাৎ উজ্জ্বল সূর্যের আলো বাজখাঁই চিৎকার হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঘগা ধুকুর, ধুকুর প্রায় দৌড়য়। বলে—পা চালিয়ে, পা চালিয়ে!’ চরণ বলে, ‘ক্যানে?’
ঘগা জবাব দেয় না, চরণও প্রশ্ন করে না আর। ধুলোর রঙ লাল হতে থাকে রেললাইন পেরোতেই। উঁচুতে উঠে চলে পথ। কী লাল, কী লাল। হ্যাঁ, এবার খাস রাজা শশাঙ্কের রাজধানীতে পা। ধুলোর লাল রঙ গাঢ়তর হতে থাকে। বড়বড় বাঁজা ডাঙা, স্তূপ, খোলমকুচি, ফণীমনসা, একলা অশত্থ শ্রীভ্রষ্ট ও উদাসীন, কিছু জরাজীর্ণ কুঁড়েঘর, কী দারিদ্র্য চারিদিকে, হুহু ঘূর্ণি চলে যায় গায়ের ওপর দিয়ে—’বছরের গতিক ভালো লয় হে’ ঘগা বলে, এবং যদুপুরে ঢুকতে ঢুকতে ঢোল বাজায় ডিম ডিমা ডিম ডিমা। অন্যরব, অন্য ছাঁদ। তাক গুড় গুড় গুড়তাক, গুড়তাক চাকুম চাকুম! চরণ খেকায়, ‘আরে হলটা কি? তোমার মায়ের বিহা নাকি হে?’ ঘগার চোখে ঝিলিক। দুপাশে বায়েন পাড়া! বংশীবায়েনের নামডাক কাছে তল্লাটে—সেই ঈর্ষা! বংশী বহরমপুরে বায়না পায় পুজোর। তবে কী, এখন ঘগা রাজঘোষক—তার সঙ্গে নীল উর্দিপরা রাজপ্রতিনিধি। সে হাতের চরম খেল দেখায়—গুড়ড়াক গুড়তাক…নাক ঢাক চোখ ঢাক, ডিম ডিমা…দেখবি কী দেখবি না…অগত্যা চরণ বলে, ‘বহুৎ আচ্ছা!’
উঁচু পৈঠা থেকে হুঁকো হাতে বংশীবদনও বলে—’ভালো, ভালো!’ অমনি ঢ্যাঁড়রার সনাতন বোল ধরে ঘগা বায়েন। চরণ চেঁচায় যথারীতি—বাস বাস! এই বাবুভদ্র ছোটবড় হেঁদুমোছলমান তাবৎ পোজা সাধারণকে কহা যায় কী…..’
রাঙা—লালমাটির দেয়াল, দেয়ালে সাদা রেখার পদ্মফুল পাখি লক্ষ্মীমায়ের চরণ। গরিবগুরবো ছোটনোকের বউঝির কাঁধবরাবর নজর হয়। তারা নাকমুখ কুঁচকে বলে—’মরণ! কী বুলে, বুঝাও যায় না!’
‘মজা সোতার ঝিলে, বুজলি? আর কেউ যেতে পাবে না।’ চরণ সহাস্যে বলে।
‘ক্যানে, ক্যানে?’
‘পাদরিবাবার হুকুম। তেনার সম্প্রত্তি এখন।’
‘পাদরি না বেলেস্টোরের (ব্যারিস্টার) হাকিম।’
‘বললে কী হবে মাভগ্নীরা, আমরা কিনা বিটিশের পোজা বটি।’
ঠোঁটকাটাগোছের মুখরা কোনো যুবতী বলে—’তাইলে তুমার মেয়ে বিন্নিও যেতে পাবে না?’
চরণ এতক্ষণে বাস্তবতা টের পেয়ে অন্যমনস্ক বলে—’হুকুম লিলে যেতে পাবে বইকি?’
‘তুমি তো চৌকিদার। তুমার হুকুম হয়েই আছে। আমাদের বেলা?’
হাত তুলে আশ্বস্ত করে চৌকিদার—’হবে, হবে।’
‘হ্যাঁ—তুমার ভাইপো—ভাগ্নের মতন জাত দিলেই হবে!’
চরণ লাঠি ঠুকে রেগে কিছু বলতে গিয়ে হা হা হা হা হেসে ফেলে। তারপর বলে, ‘চলো চলো হে ঘগা। বেলা বেড়ে গেল! এখনও তিনটে গাঁ বাকি।’
গুড়গুড় ডিম ডিমা গিয়ে থমকে দাঁড়ায় গাঁয়ের শেষে—আচমকা নিচে দেড়শো ফুট খাত, রক্তবর্ণ মাটি, মজা ভাগীরথী। অতএব ডাইনে দক্ষিণে পা এগোয়। ঝিলের ধারে—ধারে চলে রাঙামাটির দিকে। চৌকিদারের নিজের গ্রাম। ওখানে সবাই জেনে গেছে আগাম—তত পেয়োজন নাই—তাহলেও নিয়মভঙ্গ করা চলবে না। বাঁয়ে পূর্বে ঝিলের দুর্গম বিস্তার—দূর দিগন্তে বর্তমান গঙ্গার ধুধু চড়া, সবে বিহারি সবজিওয়ালারা (চাঁই সম্প্রদায়) বসত শুরু করেছে ওখানটায়। ওপারে মহুলা, গভীর দহের ধারে। বিস্তৃত বাবলাবন, ঝিলের জল, পাখিরা, কী যেন মনে পড়ে যায়, অবচেতনায় গাঁথা জন্মান্তরের ঘটনাসূত্র এবং কিছু অস্পষ্ট ভাব, তেরোশো বছর আগে এখানে দাঁড়িয়ে কি চরণ চৌকিদার ও ঘগা বায়েন দেখেছিল মহাবণিক শ্রীবুদ্ধগুপ্তের বাণিজ্যপোত পাল উড়িয়ে দিয়েছে, শঙ্খধ্বনি হচ্ছে চতুর্দিকে প্রাসাদ অলিন্দে ভিজে চোখে চেয়ে আছে বধূ ও কন্যারা?
গুড় গুড় গুড় গুড় ডিম ডিম ডিম ডিমা…আওয়াজ বাড়ে দ্বিগুণতর। অদূরে টিলার চার্চঘরের বারান্দায় বসে পাদরি সাইমন শুনছে বুঝি! বখশিসের লোভে দুই প্রতিনিধি আবেগ অবলম্বন করে। ডিম ডিম ডিম ডিমা ডিমা! এই বাবু ভদ্র ছোট বড় হেঁদুমোছলমান তাবৎ পোজাসাধারণকে কহা যায় কী আঙামাটি মা গঙ্গার মজা সোঁতায়…
উরে ব্বাস! হাতি! হাতি এসেছে! কখন এল, কার হাতি! শমনসাহেবের কাছারির সামনে ভিড়। অশ্বারোহীরা রয়েছে। সেপাইলস্করও রয়েছে। টাট্টুর পিঠে নির্ঘাৎ আফতাব দারোগা! চরণ চোখ কচলায়। কালেকটর সাহেব আসবার কথা ছিল বটে। তো আগাম, এমন বিনিলুটিশে! গ্রাম পেরিয়ে চলে দুই নকীব। কেউ ওদের প্রশ্ন করে না। সবাই জানে চাঁদপাড়া পেরিয়ে যেতে যেতে দূর পশ্চিমে বারোটার হাওড়া ডাউন সবুজ রেখার মতো আঁরোয়া জঙ্গলের গায়ে মিলিয়ে যায়, কেবল শূন্যে ভেসে চলে থকথকে কালো ধুঁয়ো মেঘের মতন—কতক্ষণ। গুম গুম গুম গুম ডিমা ডিমা…বায়েনের হাত ক্লান্ত হয়ে পড়ে। বাঁজাডাঙার ওপর তালবন। অনেক শুকনো বাগড়া পড়ে রয়েছে। আড়চোখে দেখে যায় দুজনেই। মেয়েগুলোকে পাঠাতে হবে। কিছু স্নিগ্ধ মাটি, গঙ্গার পাড়, শ্মশান, বটতলা, ইয়াকুব সাধুর ভিটে, কোদলার ঘাট, ডাবকই চিরোটি—চারটি ক্লান্ত পা পড়ে ধুপ ধুপ। ঢোলের বোল থেকে নির্জনতা ঝরে—ঝরে পড়ে। চাষাভুষো হিন্দু মুসলমান উঁকি মারে, উত্তেজনা পূর্ববৎ—কিন্তু চরণের কণ্ঠস্বর অসহায় এখন। দুপুরবেলার নির্জন হয়ে ওঠা গ্রাম কিছু উত্তেজনার পর ফের শান্ত ও নির্জন হয়। চিল ডাকে। নিমফুলের গন্ধ ভাসে। শোকবিলাসিনী কোনো মেয়ে সুর ধরে কাঁদে একটানা—দুপুরের ঐকতানে এক অবিচ্ছেদ্য অংশের মতন, এবং মসজিদ থেকে জুহা মৌলবি বেরিয়ে কান করে ঘোষণা শোনেন, তারপর নিঃশব্দে প্রস্থান করেন, দুই নকীব পশ্চিমমুখী হয়ে আঁরোয়া বটতলায় স্টেশনের এপারে ময়রাবুড়ির দোকানে পৌঁছায়। ঢোল বেজে ওঠে। চৌকিদার হাঁকে—এই বাবুভদ্র ছোট বড় হেঁদুমোছলমান পোজাসাধারণকে কহা যায় কী…
গোরাংডাক্তারের ডাক্তারখানার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। খুলে যায়। লেডি ডাক্তারকে দেখা যায় একবার। ফের দরজা বন্ধ হয়। চরণ ঘগাকে বলে, ‘মুড়ি খেয়ে জিরোও, আমি আসি।’
‘কতি?’ ঘগা শুধোয়।
‘বঁধুর কাছ হতে আসি।’ বলে চলে যায়।
ঘগা জানে, চাঁদঘড়ি ওর বন্ধু—ফের শালা গাঁজা টানতে গেল। যাক। এবার ঘগার ছুটি। শমন সায়েবের কাছারিতে যাবে। মজুরি নেবে। কিন্তু কালেকটার সায়েব এসেছে—পাদরিবাবার নাগাল পাওয়া যাবে না হয়তো । ঘগা ঘাবড়ে যায়। পরে ভাবে, চন্না শালা তো আছে!
ওখানে ঘরের ভিতর শুয়ে গোরাংডাক্তার পুরনো পত্রিকা পড়ছিলেন। স্বর্ণকে শুধোন—’কীসের ঢেঁড়ি পেটাচ্ছে?’ এবং তক্ষুনি উঠে বসেন।
স্বর্ণ বলে, ‘ও কিছু না। তুমি চুপ করে শুয়ে থাকো তো!’
গোরাংবাবু একটু হাসেন—’তুমি না বললে কী হবে, আমি শুনে ফেলেছি। শালা পাদরি এবার মরবে। হুঁউ—আর কটা দিন। দ্যাখ না কী হচ্ছে! ওরা এল বলে। আর দেরি নেই।’
গোরাংবাবুর কথাবার্তা ইদানীং কেমন অস্বাভাবিক লাগে। চুপচাপ ঘরে শুয়ে থাকেন বেশিরভাগ সময়, কদাচিৎ বেরোন। লাইনের ধারে গিয়ে বসে থাকেন। আপন মনে বিড় বিড় করে কীসব বলেন। মাঝে মাঝে কাকে শাসান—’থাম, থাম। এল বলে—আর দেরি নেই!’ কে আসবে? স্বর্ণ বুঝতে পারে না। নার্ভ শান্ত করার ওষুধ খাইয়ে দেয়।
স্বর্ণ মেঝেয় গিয়ে শোয়। এখন তার ঘুমের সময়। গোরাংবাবু ফের পত্রিকা পড়ছেন। কতক্ষণ পরে ঘগা বায়েনের ঢোলের শব্দ হয় ফের। শব্দটা লাইন পেরিয়ে স্টেশনে চলে যায়। ফের ধুড়মুড় করে উঠে বসেন গোরাংবাবু। নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন স্বর্ণের দিকে। স্বর্ণ ঘুমোচ্ছে—হয়তো চোখ বুজে রয়েছে এবং স্বর্ণের শরীরেই কি তিনি ওই ঢোলের শব্দগুলো মুদ্রিত দেখেন? তাঁর দৃষ্টি সন্দেহকুল।
ঢোলের শব্দ মিলিয়ে যেতে রেলগাড়ির শব্দ আসে। দীর্ঘ কয়েকটা মিনিট একটা মালগাড়ি গড়িয়ে যেতে থাকে। তখন হতাশভাবে গোরাংবাবু শুয়ে পড়েন।
এখানে স্টেশনের বারান্দায় ঘগা বায়েন চরণের প্রতীক্ষায় ক্লান্ত হতে হতে শুয়ে পড়েছে। একটু তন্দ্রাও আসে তার। সে স্বপ্ন দেখে। পাদরিবাবা তাকে মজুরি দিচ্ছেন না। বলছেন—’নেহি দেগা! চলা যাও!’….ও পাদরিবাবা, তোমার এই বিচার? ঠোঁট কাঁপে বুড়ো বায়েনের—ঘুমের ঘোরে সে প্রচণ্ড দুঃখে কাঁদে! কাঁদতে কাঁদতে ডাকে, চন্না চন্না হে! ই কী কথা!…