ধৃতরাষ্ট্র-বনযাত্রা—যুধিষ্ঠিরাদির অনুতাপ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, অনন্তর একাদশ দিবসে অন্ধরাজ ধৃতরাষ্ট্র প্রাতঃকালে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক ঐ দিন কার্ত্তিকী পূর্ণিমা অবগত হইয়া, পাণ্ডবগণকে আহ্বান করিয়া, তাঁহাদিগের প্রতি যথোচিত সম্প্রীতি প্রকাশ করিলেন এবং অচিরাৎ বেদবেত্তা ব্রাহ্মণগণদ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়া বল্কলাজিন [গাছের বাকল] পরিধানপূর্ব্বক গান্ধারী ও অন্যান্য কৌরবধূগণের সহিত স্বীয় ভবন হইতে বহির্গত হইলেন। ঐ সময় কৌরবকুলকামিনীগণের আর্ত্তস্বরে অন্তঃপুর আকুলিত হইয়া উঠিল। তখন অন্ধরাজ লাজদ্বারা আপনার গৃহ অর্চ্চিত করিয়া ভৃত্যগণকে ধনরাশি প্রদানপূৰ্ব্বক অরণ্যযাত্রা করিলেন। ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির তদ্দর্শনে নিতান্ত শোকসন্তপ্ত হইয়া বাষ্পরুদ্ধকণ্ঠে উচৈঃস্বরে ‘হা তাত! কোথায় চলিলেন’ বলিয়া ধরাতলে নিপতিত হইলেন। মহাত্মা ধনঞ্জয় নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বারংবার দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মরাজকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।
অনন্তর যুধিষ্ঠির, ভীমসেন, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেব, বিদুর, সঞ্জয়, যুযুৎসু, কৃপাচার্য্য, ধৌম্য ও অন্যান্য ব্রাহ্মণগণ নিতান্ত শোকাভিভূত হইয়া বাষ্পবারি পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রের অনুগমন করিতে আরম্ভ করিলেন। কুন্তী ও বস্ত্রাচ্ছাদিতনয়না গান্ধারী আপনাদের স্কন্ধদেশে অন্ধরাজের হস্তদ্বয় সন্নিবেশিত করিয়া তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে গমন করিতে লাগিলেন এবং দ্ৰৌপদী, সুভদ্রা, নবপ্রসূতা উত্তরা, চিত্রাঙ্গদা ও অন্যান্য রমণীগণ কুররীর [উৎক্রোশ পাখীর] ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিতে করিতে তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবমান হইলেন। ঐ সময় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চারিবর্ণের বনিতাগণই শোকাকুলিতচিত্তে চতুর্দ্দিক হইতে রাজমার্গে আগমন করিতে লাগিল, ফলতঃ পূৰ্ব্বে পাণ্ডবগণ দ্যূতে পরাজিত হইয়া কৌরবসভা হইতে বহির্গত হইলে পৌরজনেরা যেরূপ দুঃখিত হইয়াছিল, এক্ষণে অন্ধরাজকে অরণ্যে গমন করিতে দেখিয়াও তাহাদিগের সেইরূপ দুঃখ সমুপস্থিত হইল। যেসমুদয় কুলকামিনী পূৰ্ব্বে চন্দ্রসূৰ্য্যকেও দর্শন করে নাই, এক্ষণে তাহারাও শোকাভিভূত হইয়া রাজমার্গে আগমন করিতে লাগিল।