তৃতীয় অভিযানেও পিজারো তিনটি জাহাজ নিয়ে রওনা হন। তবে এবারের জাহাজগুলি আগেকার চেয়ে মজবুত ও বড়। মাঝিমাল্লা লোক-লশকর কাউন্সিল অফ ইন্ডিজ-এর চাহিদামাফিক না হলেও খুব অল্প নয়। সবসুদ্ধ তিনটি জাহাজে একশো আশিজন তোক আর সাতাশটি সওয়ার সেপাই বাহিনীর ঘোড়া। অস্ত্রশস্ত্র গুলিবারুদের পরিমাণও এবার একটু বেশি।
কিন্তু বেশি হলেও সবসুদ্ধ জড়িয়ে তিনটে জাহাজে ওই তো মাত্র একশো আশিজন মানুষ আর সাতাশটা ঘোড়া। তাই দিয়ে যে রাজ্য জয় করতে যাচ্ছেন উত্তর-দক্ষিণে তা লম্বাই তো দু-হাজার মাইলের বেশি। তখনকার পেরু সাম্রাজ্য উত্তরে এখনকার ইকোয়েডরের কুইটো থেকে বলিভিয়ার উঁচু পাহাড়ি ডাঙা আর আর্জেন্টিনার উত্তর-পশ্চিম অংশ নিয়ে চিলির মাউলে নদী পর্যন্ত ছড়িয়ে সত্যিই দু-হাজার মাইলের অনেক বেশি লম্বা ছিল।
ওই ক-টা সেপাই আর ঘোড়া নিয়ে সেই পেরুর মতো বিশাল সাম্রাজ্য জয় করার কথা ভাবা মোচার খোলায় সাগর পার হওয়ার কথা ভাবার মতোই হাস্যকর আজগুবি দিবাস্বপ্ন।
কিন্তু পিজারোর আত্মবিশ্বাস প্রায় উন্মত্ততারই শামিল। দু-দুবার ব্যর্থতার পর প্রৌঢ় বয়সে অদম্য উৎসাহে তিনি আবার সেই অসাধ্য সাধনের আশায় পাড়ি দিয়েছেন।
পিজারোর ইচ্ছা ছিল প্রথমেই আর কোথাও জাহাজ না ধরে একেবারে টম্বেজ , বন্দরে গিয়ে জাহাজ ভেড়ানো। কিন্তু প্রতিকূল হাওয়ায় আর স্রোতে তা সম্ভব হয় না। তেরো দিন সমুদ্রযাত্রার পর পিজারোকে নৌবাহিনী নিয়ে টমবেজ-এর অনেক আগেই জাহাজ ভেড়াতে হয়। সেখান থেকে তিনি সৈন্য-সামন্ত নিয়ে হাঁটাপথে যাত্রা শুরু করেন আর জাহাজ তিনটিকে বলা হয় সমুদ্রপথে তাঁদের সঙ্গী হতে।
অজানা দুর্গম দেশ। আণ্ডিজ পাহাড়ের নদীতে শীতের দিনেই ঢল নামে। সেই ঢল নেমে নদীগুলি ফুলে ফেঁপে দুস্তর হয়ে উঠেছে। লোক-লশকরের হয়রানি আর দুর্দশার সীমা নেই। সোনার লোভ আর পিজারোর আশ্চর্য দৃষ্টান্ত চোখের সামনে না থাকলে ক-জন এই অভিযানে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকত বলা কঠিন।
পিজারো সত্যিই যেন দানোয় পাওয়া মানুষ। পিজারোর জন্মতারিখ নিয়ে অনেক গোলমাল আছে সত্যি, কিন্তু তৃতীয় অভিযানের সময় তাঁর বয়স যে পঞ্চাশ ছাড়িয়ে প্রায় ষাটের কাছে পৌঁছেছে এবিষয়ে মতভেদ নেই। প্রায় ষাট বছরের এই বুড়ো সেদিন শক্ত-সমর্থ জোয়ানদের লজ্জা দিয়েছেন। তাঁর শ্রান্তি ক্লান্তি হতাশা বলে কিছু নেই। দরকার হলে খিদে-তেষ্টা সব তিনি জয় করতে পারেন। শত্রুরা যেমন, অসুখ-বিসুখও তেমনই তাঁকে এড়িয়ে চলে।
এই ফ্রানসিসকো পিজারোর দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে সৈন্যরাও অসাধ্য সাধন করে। অসাধ্য সাধন অবশ্য নিজেদের চেয়ে সংখ্যায় অনেক গুণ বেশি দেশোয়ালিদের মার-কাট আর লুঠতরাজ।
নতুন মহাদেশে সাদা চামড়ার আগন্তুকদের সম্বন্ধে সাধারণ অধিবাসীদের ধারণা। তখনই পালটাতে শুরু করেছে। এর আগেরবার অজানা শ্বেতাঙ্গ এই বিদেশিদের লোকে দেবতার মতো অভ্যর্থনা করেছে। এবারে সেই দেবতার আসল পরিচয় ধরা পড়ে গেছে অনেকের কাছেই।
হাঁটাপথে পাড়ি দেওয়ার কিছুদিন বাদেই প্রথম যে আধাশহর তাদের সামনে পড়ে পিজারোর বাহিনী তা লুঠেপুটে ছারখার করে। শহরের লোকেদের কাছে ব্যাপারটা তখনও কল্পনাতীত। কারও কোনও ক্ষতি তারা যখন করেনি তখন তাদের ভয় করবার কিছু নেই এই বিশ্বাসে তারা সরল আন্তরিকতার সঙ্গে গৌরাঙ্গ বিদেশিদের তাদের বসতিতে স্বাগত জানায়। কিন্তু বিদেশিরা এ প্রীতির জবাব দেয় খোলা তলোয়ার নিয়ে তাদের তাড়া করে তাদের ঘরবাড়ির যা-কিছু লুঠেপুটে নিয়ে।
এই আধাশহরেই পিজারোর লোক-লশকরেরা প্রথম নুড়ি পাথরের মতো এক মণিরত্নের ছড়াছড়ি দেখে। এ মণিরত্ন হল পান্না।
পিজারোর দলে হিড্যালগো অর্থাৎ বড়ঘরের ছেলে কিছু ছিল না এমন নয়। কিন্তু তারাও বেশির ভাগ ঘটি-ডোবেনা নামে-তালপুকুর গোছের পড়ে-আসা বংশের। দুলাল। তাও বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো। তারা বা বাকি সব নেহাত নিচু ঘরের ডানপিটে মুখখু গোঁয়াররা পান্নার মর্ম কী বুঝবে। পায়রার ডিমের মতো একটা অমূল্য পান্না তারা এই শহরেই পায়। সে পান্না তারা হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ভেঙেছিল। ভেঙেছিল আবার এক পাদরির কথায়। পারিবাবা সকলকে বুঝিয়েছিলেন যে পান্না সাচ্চা কি ঝুটো তা বোঝবার পরীক্ষাই নাকি হাতুড়ি দিয়ে পেটানো। সাচ্চা পান্না নাকি হাতুড়ি দিয়ে পিটেও ভাঙা যায় না। পারিবাবার এই পরামর্শ শুনেই পৃথিবীর অমূল্য একটি রত্ন নষ্ট হয়ে গেছে।
অমূল্য রত্ন মানে পায়রার ডিমের মতো একটা পান্না!—এতক্ষণ বাদে খোঁচা দেওয়ার এ সুযোগটুকু মর্মরের মতো মস্তক যাঁর মসৃণ সেই শিবপদবাবু ছাড়লেন না—তা, সে অস্পৃশ্য পান্নার ভাঙা টুকরোগুলো কেউ কুড়িয়ে রেখেছিল বোধহয়! নইলে পায়রার না ঘোড়ার ডিম জানা গেল কী করে?
কী করে জানা গেল?—দাসমশাই অবোধকে জ্ঞান দিতে করুণার হাসি হাসলেন—জানা গেল, রিলেথিওনেস দেল দেশকিউব্রিসিয়েন্তো ঈ কনকুইস্তা দে লস রেনস দেল পেরু-র দৌলতে।
শিবপদবাবু ভুরু কুঁচকে কী যেন বলতে যাচ্ছিলেন। তাঁকে সে সুযোগ না দিয়ে দাসমশাই আবার বললেন, না, এসপানিওল-এর বিদ্যে জাহির করছিমনে করবেন না। শুধু সে যুগের চাক্ষুষ দেখা একটি বিবরণের নাম বলছি। যিনি এ বিবরণ লিখে গেছেন তাঁর নাম পেড্রো পিজারো। পিজারো পদবি দেখে যা মনে হয় তা কিন্তু ভুল। তিনি ফ্রানসিসকো পিজারোর আপন বা সতাতো ভাইটাই কেউ নন। পিজারোদের জন্মস্থান এসক্রেমাদুরা প্রদেশের টোলেডোতেই অবশ্য তিনি জন্মেছেন, আর খুঁজলে তাদের সঙ্গে দূরসম্পর্কের একটা জ্ঞাতিত্ব হয়তো পাওয়া যেতে পারে। পেড্রো পিজারো পনেরো বছর বয়সেই ফ্রানসিসকো পিজারোর খাস অনুচর হিসেবে তাঁর তৃতীয় অভিযানে যোগ দেন। পেরু-বিজয়ের প্রায় সমস্ত বড় বড় ঘটনাতেই তিনি উপস্থিত ছিলেন। পেরু অভিযানের নেতা ফ্রানসিসকো তাঁকে বিশ্বাস করে অনেক কঠিন দুঃসাহসিক কাজের ভার দিয়েছেন। পেড্রো সে সমস্ত কাজে তাঁর বিচক্ষণতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। নেতার বিশ্বাসের অমর্যাদা কখনও করেননি। সম্পদে বিপদে সৌভাগ্যে আর ভাগ্যবিপর্যয়ে তিনি সমানভাবে ফ্রানসিসকো পিজারোর অনুগত থেকেছেন। নিজের ধনপ্রাণ রক্ষা করতেও তাঁর বিরুদ্ধে নেমকহারামি কখনও করেননি।
পেড্রো পিজারো সম্বন্ধে এত কথা বলার কারণ এই যে, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে যে বিবরণ তিনি রেখে গেছেন, সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ আবিষ্কার ও অধিকারের যথার্থ বৃত্তান্ত সংগ্রহের ব্যাপারে তা অমূল্য। পেড্রো পিজারো এ বিবরণে নিজের ঢাক পেটাবার চেষ্টা কোথাও করেননি। নিজের কথা যেখানে বলতে হয়েছে সেখানে তিনি উত্তম পুরুষের আমির বদলে প্রথম পুরুষের সে ব্যবহার করেছেন। দেখবার চোখ ও বর্ণনার ক্ষমতার সঙ্গে আন্তরিকতা ও সততা মিশে তাঁর বিবরণটিকে অত্যন্ত দামি করে তুলেছে।
এই অমূল্য বিবরণটিও কিন্তু প্রায় হারাতে বসেছিল। এ বিবরণের হাতে লেখা একটিমাত্র পাণ্ডুলিপির কথা সেই ষোড়শ শতাব্দীর পর বহুদিন পর্যন্ত বিশেষ কারও মনেই ছিল না। শ-খানেক বছর আগে সেনিয়র দে নাভাররেতের হাতে পড়বার পর মাদ্রিদ থেকে এটি ছাপাবার ব্যবস্থা হয়।
এ বিবরণ থেকে শুধু পায়রার ডিমের মতো পান্নার কথাই নয়, পেরু-অভিযানের আরও অনেক ঘটনার উজ্জ্বল বর্ণনা পাই।
অমূল্য একটি পান্না মূর্খের মতো ভেঙে নষ্ট করলেও পিজারোর লোক-লশকর লুঠপাট করে যা পেয়েছিল তা প্রচুর। ফ্রানসিসকো পিজারো তাঁর বাহিনীর লোকেদের লুঠপাট করায় বাধা তখন দেননি। কিন্তু তাঁর একটি অলঙ্ঘ্য আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে সকলকে বাধ্য করেছেন। সে আদেশ হল এই যে যেখান থেকে যা কিছু লুণ্ঠিত তোক সমস্ত পিজারোর সামনে এক জায়গায় জড়ো করতে হবে। লুঠের মাল পিজারো নিজে তারপর ভাগ করে দেবেন।
লুঠের মালের পাঁচ ভাগের এক ভাগ পিজারো বরাদ্দ করেছিলেন স্পেনের সম্রাটের জন্যে, বাকি চার ভাগ নির্দিষ্ট ছিল পদমর্যাদা অনুযায়ী তাঁদের সকলের জন্যে। এ আদেশ অমান্য করার শাস্তি ছিল ছোটোখাটো কিছু নয়, একেবারে প্রাণদণ্ড।
এই কড়া বিধানে আর যা-ই হোক লুঠ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকাটি পিজারোর বাহিনীতে বন্ধ হয়েছে।
লুঠের মাল ভাগবাটোয়ারার পর পিজারো প্রথমেই স্পেন সম্রাটের বরাদ্দ পানামায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। সম্রাটের জন্যে যা পাঠানো হয়েছে তা সামান্য কিছু নয়। পেড্রো পিজারো লিখে গেছেন যে সে সওগাতের দাম কমপক্ষে বিশ হাজার কাস্তেললানো। কাস্তেলোনো হল প্রাচীন স্প্যানিশ স্বর্ণমুদ্রা! ওজন ত্রিশ রতির কম নয়।
এই সওগাত পাঠাবার পেছনে রাজভক্তি ছাড়া একটু কূটবুদ্ধিও ছিল। সেভিল থেকে জাহাজ নিয়ে পালিয়ে আসতে পারলেও শত্রুদের তাঁর বিরুদ্ধে রাজদরবারে গুঞ্জন তোলবার সুযোগ তিনি দিয়ে এসেছেন। সম্রাটের নামে এই ধনরত্নের ভেট পৌঁছোলে সে গুঞ্জনই শুধু বন্ধ হবে না, তাঁর অভিযান সম্বন্ধে যারা বিরূপ কি উদাসীন ছিল এতদিন, তারাও নতুন উৎসাহ পেয়ে হয়তো যোগ দিতে পারে।
পিজারোর হিসাবের ভুল হয়নি। নিজে সৈন্যসামন্ত নিয়ে হাঁটাপথে রওনা হয়ে এবার তিনটি জাহাজই তিনি পানামায় ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর একটি জাহাজ পানামা থেকে ফিরে তাঁদের সঙ্গ ধরেছে। সে জাহাজে রাজখাজাঞ্চি ভিভর অর্থাৎ পরিদর্শক ইত্যাদি নিয়ে স্পেন রাজ্যের বেশ কয়েকজন বড় আমলাই ছিলেন। সেভিল থেকে এঁদের সঙ্গে আনবারই কথা। কাউন্সিল অফ ইন্ডিজ-র চোখে ধুলো দিতে অমন লুকিয়ে পালাবার দরুনই তা সম্ভব হয়নি।
রাজপ্রতিনিধিরা এখন বেশ প্রসন্নমনেই পিজারোর অভিযানে যোগ দিয়েছেন। আরও কিছুটা এগিয়ে পুয়ের্তো ভিয়েখো অর্থাৎ ভিয়েশখা বন্দর পর্যন্ত পৌঁছোবার পর দ্বিতীয় একটি জাহাজও বেলালকাজার বলে একজন সেনাপতির অধীনে নতুন জনত্রিশ সৈন্য নিয়ে তাঁদের সঙ্গে ভিড়েছে।
দলে একটু ভারী হলেও পিজারোকে এবার বেগ পেতে হয়েছে অজানা দেশের লোকের শত্রুতার জন্যে। পিজারোর বাহিনীর লোকেদের কীর্তিকলাপের খবর তাদের আগে হাওয়ায় ছড়িয়ে গেছে। এই সাদা চামড়ার মানুষগুলো যে দেবতা নয়, দানব, সমুদ্র-উপকূলের শহরে গ্রামে কারও তা জানতে বোধহয় তখন বাকি নেই।
পিজারোর দলকে আগের বারের মতো অভ্যর্থনা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। যেখানেই তারা গেছে, হয় লোকেরা যা কিছু সম্ভব নিয়ে ঘরদোর ছেড়ে বনে গিয়ে লুকিয়েছে, কিংবা প্রাণপণে তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাধা দিয়েছে।
পিজারোর প্রথম লক্ষ্য হল টম্বেজ। সে শহরে পৌঁছোবার আগে কিন্তু অনেক বিপদ তাঁকে কাটাতে হয়েছে।
টম্বেজ শহরে যেতে ছোট্ট একটি উপসাগর পথে পড়ে। নাম গুয়াকুইল উপসাগর। সেখানে পুনা বলে ছোট্ট একটি দ্বীপের সর্দারের নিমন্ত্রণে বর্ষাকালটা কাটাতে গিয়ে পিজারো সমস্ত বাহিনীসমেত প্রায় ধ্বংস হতে বসেছিলেন।
পুনা দ্বীপের লোকেদের সঙ্গে পেরুর ইংকাদের প্রজাদের ঝগড়া। এই ঝগড়ার সুযোগ নিয়ে পুনাবাসীদের নিজের কাজে লাগাবার ফন্দি কিন্তু সফল হয়নি! পিজারোর বাহিনীর লোকেদের নির্মমতা ও কপটতায় খেপে উঠে পুনার অধিবাসীরা একদিন তাদের আক্রমণ করেছে।
শরীরের বর্ম দিয়ে লম্বা বল্লম আর বন্দুকের জোরে কোনওরকমে সে আক্রমণ ঠেকালেও পুনা দ্বীপে থাকা পিজারোর পক্ষে সর্বনাশা হয়েছে। সম্মুখ যুদ্ধে গুলি-বারুদের সামনে দাঁড়াতে না পেরে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নিলেও পুনার লোকেরা তাদের শত্রুতা ত্যাগ করেনি। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে হানা দিয়ে তারা পিজারোবাহিনীর রসদ নষ্ট করেছে, দল-ছাড়াভাবে বাগে পেলে নিকেশ করে দিয়েছে।
এই দুর্দিনে পানামা থেকে আরও শ-খানেক নতুন সেপাই আর কিছু ঘোড়াসমেত দুটি জাহাজ এসে পৌঁছোবার দরুন পিজারো ধড়ে প্রাণ পেয়েছেন!
এই নতুন সেনাদল যাঁর অধীনে এসেছে তাঁর নাম হার্নারেমন্ডো দে সটো-পেরু অভিযানে অবজ্ঞা করবার মতো না হলেও এ নাম স্মরণীয় হয়ে আছে আরও একটি বড় কীর্তির জন্যে। সে কীর্তি হল উত্তর আমেরিকার মিসিসিপি নদী আবিষ্কার। সেই মিসিসিপির তীরেই তাঁর সমাধি বহুকাল তাঁর অক্ষয় কীর্তি ঘোষণা করছে।
হার্নারেমন্ডো দে সটো নতুন সৈন্যসামন্ত-সমেত দুটি জাহাজ নিয়ে আসার পর পিজারো তাঁর পক্ষে অভিশপ্ত পুনাদ্বীপ ছেড়ে আবার পেরুর উপকূলে গিয়ে উঠেছেন। সেই উপকূলের পথে টম্বেজ পর্যন্ত পৌঁছোনো অবধি দুর্ভাগ্য তাঁকে একেবারে ত্যাগ করেনি। পুনা দ্বীপ থেকে উপকূলে নামবার সময়েই একটি ছোট দল একলা পড়ে গিয়ে শত্রুদের হাতে মারা পড়েছে! টাবেজ শহরে পর্যন্ত এবারে পিজারো প্রথমে সম্পূর্ণ ভিন্ন অভ্যর্থনা পেয়েছেন!
আগেরবার যে টম্বেজ শহরের সুখশান্তি ঐশ্বর্য দেখে তাঁরা মুগ্ধ বিস্মিত হয়ে ফিরে গিয়েছিলেন, সে শহর এখন যেন শ্মশান। লোকজন তো শহরে নেই-ই, তার ওপর দু-চারটি ছাড়া সমস্ত বাড়িঘরও সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। বৃথাই এ দুর্দশার যথার্থ কারণ জানবার চেষ্টা করেছেন পিজোরা। টবেজের কুরাকা অর্থাৎ শাসকও শহর ছেড়ে পালিয়েছিল। কোনওরকমে তাকে ধরে আনবার ব্যবস্থা হয়েছে। কুরাকা যা বলেছে তা বিশ্বাস করা পিজারোর পক্ষে সম্ভব হয়নি। পুনাদ্বীপের অধিবাসীরাই অতর্কিত আক্রমণ করে টমবেজের এই দুর্দশা করেছে বলে বোঝাতে চেয়েছে কুরাকা।
টমবেজ শহরে যে দু-জন প্রতিনিধি পিজারো রেখে গিয়েছিলেন এবারে ফিরে এসে তাদের আর দেখতে পাননি। তাদের নিশ্চিহ্ন হওয়ার ব্যাপারে উলটোপালটা নানা কথা শোনা গেছে।
কেউ বলেছে, তারা মারা গেছে মহামারিতে, কেউ বলেছে, পুনার লোকেদের সঙ্গে লড়াই-এ। দু-একজন ভয়ে ভয়ে জানিয়েছে যে মেয়েদের ইজ্জৎ নষ্ট করবার চেষ্টার দরুনই তাদের প্রাণ হারাতে হয়েছে।
শেষের ব্যাখ্যাটাই ঠিক মনে হলেও পিজারো রক্তের বদলে রক্ত চেয়ে এবার কাউকে সাজা দেবার ব্যবস্থা করেনি। নিঃশব্দে সমস্ত ব্যাপারটা যেন হজম করে নিয়েছেন।
এ দেশের মানুষ সম্বন্ধে পিজারোকে তাঁর নীতিই হঠাৎ বদলে ফেলতে দেখা গেছে। এর পর। আর কারণে-অকারণে মারকাট জুলুম জবরদস্তি লুঠ নয়, একেবারে তৃণাদপি সুনীচ আর তরোরিব সহিষ্ণু হতে হবে সকলকে। বাহিনীর প্রত্যেকটি সৈনিকের ওপর এই আদেশ।
হঠাৎ এ পরিবর্তন কেমন করে হল?
এ কি মনেরই পরিবর্তন, না শুধু নীতির?
পরিবর্তন যে রকমই হোক, তার মূলে কিছু একটা ব্যাপার নিশ্চয় আছে। কী সে ব্যাপার? একটি নতুন মানুষের আমদানি?
সেই মানুষ কি হার্নারেমন্ডো দে সটো স্বয়ং? না। হার্নারেমন্ডো দে সটোর অধীনে দুটি জাহাজে শুধু ঘোড়া আর সোনা সন্ধানী সেপাই ছাড়া আরও একটি মানুষ এসেছেন।
পানামা থেকে ১৫৩১-এর জানুয়ারিতে সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের উদ্দেশে পাড়ি দেবার সময় পিজারোর কোনও জাহাজে তিনি ছিলেন না।
হ্যাঁ, ঘনরামই সেই আশ্চর্য মানুষ যিনি পিজারোর অভিযানের নীতি বদলাবার মূলে ছিলেন।
কিন্তু পিজারোর সঙ্গে এক জাহাজেই তো তিনি কাপিন সানসেদোকে নিয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন মধ্যরাতে সেভিল-এর বন্দর ছেড়েছিলেন বেদের সাজে। গোপনে নোঙর তুলে জাহাজ ছাড়ার ফন্দিও তাঁর।
তারপর তিনি গেলেন কোথায়। ১৫৩১-এর জানুয়ারি মাসে পিজারো যখন পানামা থেকে তাঁর তৃতীয় অভিযানে বার হন তখন ঘনরাম আর সানসেদো পিজারোর দল থেকে বাদ পড়েছিলেন কেন?
না, বাদ তাঁরা পড়েননি। ঘনরাম কাপিন সানসেদোকে নিয়ে নিজে থেকেই পিজারোর খাস জাহাজ ছেড়ে পানামায় পৌঁছোবার আগেই সান্তা মার্তায় নেমে গিয়েছিলেন।
সান্তা মার্তায় জাহাজ ভেড়ানো পিজারোর পক্ষে শুভ হয়নি। ১৫৩০-এর জানুয়ারি মাসে সেভিল ছেড়ে সান লকার-এর চড়া এড়িয়ে ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জের গামেরাতে জাহাজ ভিড়িয়ে তিনি ভাই হার্নারেমন্ডোর জন্যে অপেক্ষা করেন।
কাপিন সানসেদো সেভিল-এ জাহাজ নিয়ে লুকিয়ে পালাবার সময় যে, আশ্বাস দিয়েছিলেন তা মিথ্যে হয়নি। পিজায়োর ভাই হার্নারেমন্ডো সেভিল-এ কাউন্সিল অফ ইন্ডিজ-এর মাতব্বরদের ধোঁকা দিয়ে ঠিকই সেখানে এসে তাঁর সঙ্গে মিলিত হন।
তারপর মহাসাগর নিরাপদে পেরিয়ে তাঁদের জাহাজ ভেড়ে সান্তা মার্তা বন্দরে। এইখানেই পিজারোর লোক-লশকরের মধ্যে অনেকে বিগড়ে যায়। সান্তা মার্তার বাসিন্দারা তাদের বেশ দমিয়ে দেয়। এসব বাসিন্দারাও এককালে এসপানিয়া থেকে সোনা-দানা আর নাম-যশের লোভে পাড়ি দিয়েছিল। তারপর তাদের সব আশায় ছাই পড়েছে। জোয়ার বয়ে যাওয়ার পর স্রোতের জঞ্জালের মতো তারা আটকে পড়ে আছে এই জলা-জঙ্গরে রাজ্যে।
এসব পোড়-খাওয়া বানচাল মানুষের কোনও কিছুতেই আর বিশ্বাস নেই। পিজারোর লোক-লশকর বন্দরে নেমে বুঝি তাদের অভিযান সম্বন্ধে একটু বড়াই করেছিল।
সান্তা মার্তার লোকেরা তাদের উৎসাহে একেবারে বরফজল ঢেলে দিয়েছে। তারা হেসে যা বলেছে তার সোজা বাংলা হল এই যে, মার কাছে মাসির গল্প আর কোরো না। খোলামকুচির মতো সোনা ছড়ানো এমন দেশ সত্যি কোথাও আছে নাকি! ওই সব ভুজুং দিয়ে শুধু তোমাদের স্পেন থেকে ভুলিয়ে আনা।
সান্তা মার্তার লোকেরা নিজেদের দৃষ্টান্তই দিয়েছে। তারাও দেশ ছেড়ে অমনই সব মিথ্যে আশ্বাসে ভুলেই এসেছিল। এসে এখন তাদের এই হাল। তাদের এ-অঞ্চল তো তবু পদে আছে। সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ তো এরও অধম। সে-দেশের কথা জানতে তো আর তাদের বাকি নেই। সে যদি সত্যি অমন সোনার দেশ হত তা হলে তারা নিজেরা পচে মরত নাকি এই নরকে! পিজারোকে যে স্পেন পর্যন্ত ধাওয়া করতে হয়েছে লোক-লশকর আনতে, তাতেই তো তার ফাঁকিটা বোঝা উচিত। হাতের কাছে
এখানে লোক পেলে সাগরপারে তাকে পাড়ি দিতে হয়?
মুখে একটু-আধটু তর্ক করবার চেষ্টা অবশ্য পিজারোর লোকেরা করেনি এমন নয়, কিন্তু তাদের মনে একটু করে খোঁচা উঠতে শুরু করেছে সেই থেকেই।
কিন্তু সে-দেশ কেমন কেউ তো তোম জানো না। দু-একজন মৃদু প্রতিবাদ জানিয়েছে, ভালোও তো হতে পারে।
হ্যাঁ, তা পারে বইকী! তারা টিটকিরি দিয়ে বলেছে, সেখানকার আবহাওয়া আরও গরম আর ভ্যাপসা। মশা-মাছি জংলা পোকা-মাকড়ের ঝাঁক আরও পাগল করা, ডাঙায় কিলবিলে সাপ আরও বড় আর বিষাক্ত, আর জলে কেম্যান অর্থাৎ কুমির আরও ভয়ংকর। সবদিক দিয়েই সে-দেশ ভালো তো বটেই!
সান্তা মার্তায় বসে কথাগুলো শোনার দরুনই তা মনে দাগ কেটেছে আরও বেশি। স্পেন ছেড়ে যারা বড়জোর ক্যানারিজ দ্বীপপুঞ্জ কি হিসপানিওলা ফার্নানদিনা পর্যন্ত এক-আধবার এসেছে তাদের কাছে সান্তা মার্তা সত্যিই প্রত্যক্ষ নরক।
এরকম জায়গার সঙ্গে তাদের পরিচয়ই নেই। তারা আর যাই হোক, খোলামেলা জায়গার মানুষ। এ-ধরনের বুকচাপা লতাপাতায় ডালপালায় দিনদুপুরেই অন্ধকার। দুর্ভেদ্য জঙ্গল তারা কল্পনাই করেনি। শুধু জঙ্গল নয়, যেন বিষাক্ত নিশ্বাসে আকাশ ভারী করে রাখা বিরাট সব জলা। আর শয়তানের দূতের মতো বিদঘুটে সব কীট-পতঙ্গের জ্বালায় এক দণ্ড স্বস্তি নেই। এ-জলাজঙ্গলের জন্তুজানোয়ারগুলোও যেন সত্যি-হয়ে-ওঠা দুঃস্বপ্ন।
প্রথম অভিজ্ঞতা যাদের এইরকম, নতুন মহাদেশটা আগাগোড়াই ভয়াবহ বলে তাদের বোঝানো খুব কঠিন হয়নি। প্রথম পরিচয়টুকুই সারাদেশের নমুনা বলে তারা মেনে নিয়েছে।
এরকম ধারণা ঠেকাবার চেষ্টা কেউ করেনি এমন নয়। কিন্তু তাতে বিশেষ কিছু ফল হয়নি।
তখন সান্তা মার্তার বন্দরে জাহাজ তিনটিতে সামান্য কিছু রসদ আর জল তোলার সঙ্গে সেগুলির ছোটখাটো একটু-আধটু মেরামতি চলছে। মাঝিমাল্লা সেপাইরা বেশির ভাগই বন্দরের লোকজনের সঙ্গে সেই সুযোগে অবসরমতো একটু আড্ডা দেয়। আড্ডা মানে অবশ্য শুড়িখানায় বসে পুলকে টানা। আমেরিকার-ই একটি অদ্ভুত গাছ। আগেভির ডাঁটার রস থেকে গাঁজানো, দুধে রং-এর এই পুলকে তখন নেশা হিসেবে এসপানিওলদের দারুণ পেয়ারের হয়ে উঠেছে।
এই পুলকের আসরেই সান্তা মার্তার লোকেরা পিজারোর লোকেদের কান ভাঙিয়েছে।
বাধা দেবার চেষ্টা যে করেছে সে একটা বেদে মাত্র! পিজারোর দলের লোকেরা তাকে গানাদো বলে জানে। সেভিল-এর বন্দর ছাড়বার পর জাহাজে নতুন মুখ হিসেবে তাকে দেখা গিয়েছিল। তা নতুন মুখ তো ওই একটাই নয়। এ-ধরনের অভিযানে হামেশাই তা দেখা যায়। গানাদো নামটা একটু অদ্ভুত, কিন্তু বেদেদের নাম হিসেবে তাও কানে সয়ে গিয়েছে।
কিছু যারা পুরনো তারা বেদে বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কি ঘেন্না যেমন করেনি, তেমনই সমীহও নয়। আসলে গানাদোকে নিয়ে তাদের বিশেষ মাথা ঘামাতেই হয়নি। লোকটা নিজে থেকেই একটু যেন সরে সরে থেকেছে সবকিছু থেকে।
এই গানাদোকে কিন্তু পুলকের মৌতাতের আসরে একটু ঘন ঘন দেখা গেছে আর সব দলের সঙ্গে।
সেটা কিছু এমন অদ্ভুত নয়। পুলকের মতো নেশার টানে কে না বেরিয়ে আসে।
কিন্তু সান্তা মার্তার লোকেদের সঙ্গে তাকে কথা কাটাকাটি করতে দেখে সবাই একটু অবাক।
সূর্য কাঁদলে সোনার দেশের নিন্দে শুনে গানাদো অবশ্য খেপেটেপে যায়নি। সে যা বলেছে, তা বিদ্রূপের সুরে।
বলেছে, হ্যাঁ, কথাটা মন্দ নয়। নিজের পচা জলের গর্ত যার ছাড়বার ক্ষমতা নেই, সে কুয়োর ব্যাঙের পক্ষে বাইরের সব-ই এঁদো পুকুর মনে করাই ভাল।
পুলকের নেশা ভেদ করে খোঁচাটা মর্মে গিয়ে পৌঁছোতে একটু দেরি হয়েছে। সান্তা মার্তার মাতালরাই খেপেছে তারপর।
আমরা কুয়োর ব্যাঙ! নিজেদের মান বাঁচাতে আমরা বানিয়ে বানিয়ে মিথ্যে দুর্নাম রটাচ্ছি। তা হলে শুনবে একটা ছড়া?
কী ছড়া? জিজ্ঞাসা করেছে পিজারোর মাঝিমাল্লাদের অনেকে।
গানাদো অর্থাৎ ঘনরাম প্রমাদ গনেছেন তখনই। ছড়ার উল্লেখ শুনেই তিনি বুঝেছেন সমস্যাটা সঙ্গিন।
সান্তা মার্তার মাতাল নিন্দুকরা তখন ছড়া আওড়াতে শুরু করেছে—
পুয়েস সেনিয়র গোবেরনাদর
মিরেললা বিয়েন পোর এন্তেরো
কুয়ে আলিয়া ভা এল রেকোখেদর
ঈ আকা কুয়েদা এল কার্নিথেরো।
এ-ছড়া আওড়ানো শেষ হওয়ার পর গানাদোকে আর সেখানে দেখা যায়নি। অবস্থা বেগতিক দেখে গানাদোরূপী ঘনরাম সরে পড়েছেন আগেই।
কেন? ঘনরাম ওই ছড়া শুনেই পালালেন কেন? ও-ছড়া ভূতের মন্তর-টন্তর নাকি! শিরোদেশ যাঁর মর্মরের মতো মসৃণ সেই শিবপদবাবু জো পেয়ে চিমটিটুকু কাটলেন।
না, ভূতের মন্তর নয়। ক্ষমার অবতার হয়ে দাসমশাই কিন্তু অনায়াসে এ-বেয়াদপি মাপ করে বললেন, তবে এ বড় সাংঘাতিক ছড়া। এ-ছড়ার নাম শুনেই ঘনরাম বুঝেছিলেন যে সান্তা মার্তা তাঁদের পক্ষে বেশ একটু গরম জায়গা! এ-ছড়া যারা আওড়ায় তাদের ঠাণ্ডা করবার মতো জবাব তখনও তৈরি হয়নি।
কিন্তু ছড়াটা অত সাংঘাতিক কেন? ওর মানেটানে কিছু আছে? মেদভারে হস্তীর মতো যিনি বিপুল সেই সদাপ্রসন্ন ভবতারণ সরল কৌতূহলে জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ, মানে আছে বই কী! দাসমশাই আশ্বস্ত করে জানালেন, আর সেই মানেটার জন্যেই ছড়াটা সাংঘাতিক। ও-ছড়ার বাংলা মানে মোটামুটি এইরকম করা যায়—
ফৌজদারসাব থাকুন হুঁশিয়ার,
আড়কাটিটার ওপর রাখুন নজর!
ভেড়ার পাল সে যায় তাড়িয়ে আনতে
কসাই হেথায় ছুরি শানায় জবর!
এই ছড়াকে— পর্যন্ত বলেই শিবপদবাবুকে থামতে হল।
শিবপদবাবু টিপ্পনিটুকু নিজেই পূরণ করে দিয়ে দাসমশাই বললেন, এই ছড়াকে এত ভয়! সবাই আপনারা তা-ই ভাবছেন নিশ্চয়। ছড়াটার ইতিহাস জানলে তা আর ভাবতেন না। ছড়াটা রচনা হিসেবেও উঁচুদরের নয়, মানেটার ভেতরেও এমন ভয়ংকর কিছু শুধু কানে শুনে পাওয়া যায় না। তা পাওয়া যায়, কেন, কারা, কবে, ও-ছড়া বেঁধেছিল, তা জানলে। ও ছড়া বেঁধেছিল পিজারোর দ্বিতীয় অভিযানের কয়েকজন খাপ্পা নাবিক সেপাই! সোনার প্রলোভনে পিজারোর অভিযানে যোগ দেওয়ার পর তাদের তখন সব দিক দিয়ে দুর্দশার একশেষ হয়েছে। কোনও রকমে দেশে ফিরতে পারলে তারা বাঁচে। কিন্তু পিজারো আর আলমাগরো তাদের জোর করে গাল্লো বলে এক অখদ্দে দ্বীপে ধরে রাখবার ব্যবস্থা করেন। খেপে আগুন হয়ে নাবিক-সেপাইদের বেশির ভাগই তখন পানামায় তাদের বন্ধুদের কাছে তাদের অবস্থার কথা জানাবার চেষ্টা করে। গাল্লো দ্বীপে এক দলকে রেখে নেহাত রুগ্ন আর অকর্মণ্য কয়েকজনকে নিয়ে আলমিগরো তখন নতুন লোকজন আর রসদ সংগ্রহ করে আনতে একটি জাহাজে পানামায় ফিরছেন। এই জাহাজে ফিরে যাওয়া সেপাইদের মারফতই গাল্লো দ্বীপে যাদের থাকতে বাধ্য করা হয় তারা তাদের চিঠি পাঠাবার ব্যবস্থা করে। কিন্তু ব্যাপারটা জানতে পেরে আলমাগরো সেসব চিঠি কেড়ে নিয়ে তাদের বিক্ষোভ পানামায় পৌঁছোবার রাস্তা বন্ধ করেন। তা সত্ত্বেও একটি চিঠি পানামায় গিয়ে পৌছোয়। পৌঁছোয় আবার যার তার কাছে নয়, একেবারে খোদ গভর্নর পেড্রো দে লস রিয়স-এর বিবিসাহেবের কাছে।
কেমন করে এ-চিঠি তাঁর হাতে পৌঁছোল? সাবধানের মার নেই বলে আলমাগরো তো তন্ন তন্ন করে খুঁজিয়ে লেখা কাগজের একটা টুকরোও কোথাও জাহাজে থাকতে দেননি। এ-চিঠি তাঁর নজর এড়াল কী করে?
নজর এড়িয়েছিল খুব চতুর একটি ফন্দির জোরে। আলমাগরো ভাবতেই পারেননি যে তাঁরই হাত দিয়ে চিঠিটা যথাস্থানে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা হয়েছে। আলমাগরো তাঁদের ভেট হিসেবে পানামার গভর্নর আর তাঁর স্ত্রীর কাছে যা সব নিয়ে গিয়েছিলেন তার মধ্যেই চিঠিটা সুকৌশলে রাখা ছিল!
না, সোনাদানার কোনও জিনিসে নয়, শুধু একটা তুলোর গুলির ভেতর। নতুন দেশের আজব তুলো হিসেবে সেটা উপহার দেওয়া হয়েছিল গভর্নরের স্ত্রীকে।
গভর্নরের স্ত্রী সেই তুলোর গুলি একটু ছাড়িয়ে দেখতে যেতেই সে চিঠি বেরিয়ে পড়েছে। এক-আধজন নয়, বেশ কয়েকজনের সইকরা চিঠি। সে চিঠিতে তারা পিজারো, আর আলমাগরের নির্মম জুলুমবাজির বিরুদ্ধে তীব্র নালিশ জানিয়েছে, আর সেই সঙ্গে বর্ণনা দিয়েছে নিজেদের অকথ্য দুর্দশার। এই চিঠির শেষেই ওই ছড়াটি ছিল।
পুরোপুরি সত্য হোক বা না হোক এ চিঠির কথা জানবার পর তা বিশ্বাস করে গভর্নর পেড্রো দে লস রিয়স আগুন হয়ে উঠেছিলেন রাগে। টাফুর নামে একজন সেনাপতিকে দুটি জাহাজ দিয়ে তখনই তিনি হুকুম করেন পিজারো আর তার অনিচ্ছুক সাঙ্গোপাঙ্গকে ফিরিয়ে আনতে।
টাফুর গভর্নরের সে-হুকুম পুরোপুরি তামিল করতে পারেনি। পিজারো সব পরিণাম তুচ্ছ করে পানামায় না ফিরে অভিযান চালিয়ে যাবার সংকল্পই জানিয়েছেন।
টাফুর ব্যর্থ হয়ে ফিরে পিজারোর অবাধ্যতার কথা গভর্নরকে জানিয়েছ। গভর্নর তাতে ক্ষিপ্ত হয়েছেন নিশ্চয়ই, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাদরি লুকে আর আলমাগরোর ধরাধরিতে গভর্নরের রাগ খানিকটা পড়েছে। জ্বালা যায়নি শুধু টাফুর-এর। টাফুর সেই থেকে পিজারোর শত্রু। গভর্নরের স্ত্রীকে লেখা চিঠির ছড়া সাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে তার বেশ কিছুটা হাত থাকা অবিশ্বাস্য কিছু নয়।
গভর্নরের বিরূপতার চেয়ে এই ছড়া পিজারোর ক্ষতি করেছে বেশি। মুখে মুখে ছড়িয়ে ও অঞ্চলের মানুষের মনে পিজারোর অভিযান সম্বন্ধে অবিশ্বাস তীব্র করে তুলেছে।
এ ছড়া যেখানে পৌঁছেছে সেখানে পিজারোর স্বপক্ষে কোনও কথায় কেউ কান দেবে না বুঝেই অত্যন্ত ভাবিত হয়ে সেদিন ঘনরাম পুলকের আড্ডা ছেড়ে সরে পড়েন।
আজ্ঞা ছেড়ে তিনি সোজা বন্দরে গিয়ে কাপিন সানসেদোকে খুঁজে বার করে সব কথা আলোচনা করেন।
তাহলে কী করা এখন উচিত? জিজ্ঞাসা করেন সানসেদো।
উচিত এখনই এ বন্দর ছেড়ে যাওয়া। জোর দিয়ে বলেন ঘনরাম, তা না হলে এই সান্তা মার্তা থেকে জাহাজ নিয়ে বার হওয়ার তোক পাওয়া যাবে না। খবর নিয়ে জেনেছি, টাফুর এখানকার ফৌজদার হয়ে কিছুকাল কাটিয়ে গেছে। পিজারোর বিরুদ্ধে এখানকার মন বিষিয়ে দেওয়ার কিছু সে বাকি রাখেনি। এখানে বেশিদিন থাকলে আমাদের লোক-লশকর সব ছেড়ে যাবে।
কাপিন সানসেদো পিজাররাকে সেই পরামর্শ দিতে গেছেন।
কিন্তু পিজারো যদি বা তাঁর কথায় কান দিতেন, তাঁর দাম্ভিক ভাই হার্নারেমন্ডো প্রায় অপমান করেই হটিয়ে দিয়েছে সানসেদোকে। অবজ্ঞাভরে বিদ্রূপ করে বলেছে, এখানকার শুড়িখানায় একটু বেশি পুলকে টানা হয়ে গেছে, না? যাও সেই আসরে গিয়ে এ-সব গুল ঝাড়ো।
সানসেদো অপমানিত হয়ে ফিরে গিয়ে ঘনরামকে সব জানিয়েছেন।
তার পরদিনই জানা গেছে যে একটি দল জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছে। দলটা খুব। বড় নয় এই যা রক্ষে। সে দলে যারা পালিয়েছে তাদের মধ্যে কাপিন সানসেদোর নামটাই পিজারো খেয়াল করেছেন। গানাদো নামে একটা বেদের কথা তাঁকে জানানো কেউ প্রয়োজনও মনে করেনি।
দল ছোট হলেও তাতেই পিজারোর টনক নড়েছে। সান্তা মার্তায় আর একটা বেলাও তিনি কাটাতে সাহস করেননি। সেইদিনই বাকি লোকলশকর নিয়ে রওনা হয়েছেন নোমৰ্বে দে দিওস-এ। সেইখানেই লুকে আর আলমাগরো পানামা যোজকের শিরদাঁড়ার পাহাড় ডিঙিয়ে তাঁর সঙ্গে মিলেছেন। তারপর ছোটখাটো বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও পিজারোর তৃতীয় অভিযান বন্ধ হয়নি।
পনেরোশো ত্রিশের জানুয়ারিতে তিনি সেভিল ছেড়েছিলেন কাউন্সিল অফ ইন্ডিজ-এর ভয়ে। পুরো এক বছর বাদে ঠিক ওই জানুয়ারি মাসে তিনি পানামা থেকে রওনা হতে পেরেছেন।
সান্তা মার্তা ছাড়বার পর এতদিনের মধ্যে কাপিন সানসেদো বা তার সঙ্গী বেদে সেই গানাদোর কোনও খবর তিনি পাননি। তাদের কথা পিজারোর মনেই ছিল কি না সন্দেহ।
টম্বেজ শহরে হঠাৎ একদিন একটি লোককে দেখে তিনি বিস্মিত হন। বিস্মিত হন তার অদ্ভুত পাগলামিতে। তখনও তাকে দেখে তাঁর স্মৃতিতে কোনও সাড়া জাগেনি।
লোকটির চেহারা পোশাক দেখে তাঁর নিজের বাহিনীর কেউ বলেই বুঝতে পারেন। হার্নারেমন্ডো দে সটোর সঙ্গে তারই জাহাজে এসেছে নিশ্চয়। এ নতুন দলের দু-একজন ছাড়া কেউই তাঁর চেনা নয়।
লোকটি যা করছে তাই অদ্ভুত লাগবার জন্যেই তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। টম্বেজ শহরে এবারে এসে তখনও বেশিদিন তাঁদের কাটেনি। শ্মশানের মতো শহরের চেহারা দেখেই সবাই তাঁরা তখন বিমূঢ়। তাঁদের নিজেদের লোকজন ছাড়া শহরের বাসিন্দা কেউ নেই বললেই হয়।
সেই নির্জন শহরে একটা ছোট পুকুরের ধারে লোকটা করছে কী? কাছে গিয়ে সেই কথাই জিজ্ঞেস করতে গিয়ে সম্পূর্ণ অন্য প্রশ্ন করেন পিজারো। তার কারণ লোকটার মুখের দিকে চাইতেই ঢাকা-পড়া স্মৃতিটা একটু ঝিলিক দিয়ে উঠেছে।
তুমি! তুমি সেই বেদে না? ভুকুটিভরে জিজ্ঞাসা করেন পিজারো।
হ্যাঁ, গোবেরনাদর, আমি সেই বেদে গানাদো—
গানাদোর আর তার কথাটা শেষ করবার সুযোগ মেলে না। পিজারো জ্বলন্ত স্বরে বলেন, তুমি না সান্তা মার্তায় জাহাজ ছেড়ে পালিয়েছিলে সেই বদমাশদের সঙ্গে। আবার তুমি ফিরে এসেছ?
তাতেই তো বুঝবেন, আদেলানতাদো, যে ইচ্ছে-সুখে পালাইনি। পালাতে তখন চাইনি বলেই আবার ফিরে এসেছি। ঘনরামের গলায় সম্ভম থাকলেও ভয়ের লেশ নেই।
পিজারো তাতে আরও গরম হয়ে ওঠেন—পালাতে চাওনি তবু পালিয়েছিলে? কার পরামর্শে? সেই কাপিন সানসেদো? পালের গোদা তাহলে সে?
আজ্ঞে হ্যাঁ, আদেলানতাদো।ঘনরাম শ্রদ্ধাভরে বলেন, তিনি ছাড়া দলপতি আর কে হবেন? তিনি আপনার অভিযানের ভালর জন্যেই অত বড় ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন।
প্রথমটা হতভম্ব হয়েই বোধহয় পিজারোর মুখ দিয়ে কোনও কথা বার হয় না। তারপর একবারে আগুন হয়ে তিনি বলেন, আমার অভিযানের ভালর জন্যেই তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন! জাহাজ থেকে লোক ভাঙিয়ে পালানোর নাম আমার অভিযানের ভাল করা? আর তা-ই হল ত্যাগ স্বীকার?
আজ্ঞে হ্যাঁ, গোবেরনাদর। ঘনরাম অবিচলিত হয়ে জানান, তিনি আমাদের ক-জনকে নিয়ে দল বেঁধে না পালালে আপনার টনক নড়ত না। আপনি তাঁর হুঁশিয়ারি গ্রাহ্য না করে আর কিছুদিন সান্তা মার্তায় থাকলে আপনার সব লোক-লশকরই বিগড়ে যেত। আপনার বিপদ ঠেকাতেই ছোট একটা দল ভাঙিয়ে নিয়ে গিয়ে তিনি আপনাকে সজাগ করে দিয়েছেন। বেছে বেছে যাদের তিনি সঙ্গে নিয়ে গেছেন তারা আপনার বাহিনীর সবচেয়ে উঁচা বদমাশ। তাদের সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আর সকলকে ছোঁয়াচ থেকে বাঁচানো একটা বড় কাজ। এ ছাড়া নিজে তিনি ত্যাগ স্বীকার করেছেন অনেক। প্রথমত যেচে মিথ্যে দুর্নাম মাথায় নিয়ে আপনার অভিশাপ কুড়িয়েছেন, তার ওপর বুড়ো খোঁড়া মানুষ হয়ে জলাজঙ্গল আর পাহাড় ডিঙিয়ে পালাতে গিয়ে দুর্ভোগ যা ভুগেছেন তার সীমা নেই। একেও ত্যাগ স্বীকার বলবেন না?
পিজারো খানিক চুপ করে থাকেন। কথাগুলো গুছিয়ে বুঝতে তাঁর বেশ একটু সময় লাগে বোধহয়। তারপর রাগটা কাটিয়ে উঠলেও একটু উত্তাপের সঙ্গে তিনি জিজ্ঞাসা করেন গম্ভীর হয়ে, তা অভিযানের খাতিরেই অত কষ্ট যিনি করলেন তিনি তোমার সঙ্গে ফিরলেন না কেন? তুমি তো একাই এসেছ দেখছি?
পিজারোর গলায় রাগটা না থাকলেও একটু জ্বালা তখনও আছে।
হ্যাঁ, আমি একাই এসেছি। ঘনরামের মুখে তাইতেই এবার একটু হাসির আভাস বোধহয় দেখা যায়, আসতে চাইলেও তাঁর মতো বুড়ো খোঁড়া মানুষকে ও-অভিযানে কেউ পাত্তা দিত কি! না, উপায় নেই বলেই পানামাতেই তাঁকে ফেলে আসতে হয়েছে।
ও। একটু বোধহয় অপ্রস্তুত হয়ে সেটা ঢাকবার জন্যেই পিজারো এবার তীক্ষ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করেন, কিন্তু তুমি করছ কী এ পুকুরের ধারে?
গানাদো বলে যে নিজের পরিচয় নিয়েছে সে যা করছিল তা সত্যিই অবাক করবার মতো।
তার অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা দেখেই পিজারো প্রথম নির্জন জলাশয়টার ধারে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন কৌতূহল ভরে। কাউকে লম্বা একটা আঁকশি গোছের কাঠি নিয়ে কোনও পুকুরের ধারে খামোকা জল ঠেঙাতে দেখলে বিস্ময় কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক।
সেখানে দাঁড়িয়ে পড়বার পর অপ্রত্যাশিতভাবে মানুষটাকে চিনতে পেরে তারই উত্তেজনায় অন্য প্রসঙ্গ তুললেও শেষ পর্যন্ত অদ্ভুত ব্যাপারটার মানে না জেনে চলে যাওয়া পিজারোর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
পিজারোর প্রশ্নে গানাদো একটু কি অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে?
পিজারোর তা-ই অন্তত মনে হয়েছে।
কয়েক মুহূর্ত একটু ইতস্তত করে গানাদো যা বলেছে তাতে হাসবেন না আহাম্মক। বলে ধমক দেবেন, পিজারো ঠিক করতে পারেননি।
শেষ পর্যন্ত নিজের গাম্ভীর্য বাঁচিয়ে ধমকই তিনি দিয়েছেন।
আহাম্মক কোথাকার। জলে তোমার আংটি পড়েছে, আর তাই তুলতে তুমি আঁকশি দিয়ে জল ঠেঙাচ্ছে। লাঠি আছড়ালে জল সরে গিয়ে তোমার আংটি ফিরিয়ে দেবে? জলটা থিতোতে দিয়ে আস্তে আস্তে আঁকশিটা নামাও উজবুক,আংটি থাকলে বিনা হাঙ্গামায় পাবে। বুঝেছো?
আজ্ঞে হ্যাঁ, আদেলানতাদো। গানাদোকে অত্যন্ত লজ্জিত মনে হয়েছে।
এ আহাম্মকটার কাছে আর সময় নষ্ট না করে পিজারো তাঁর নিজের সাময়িক শিবিরের দিকে এগিয়ে গিয়েছেন।
কিন্তু খানিকদূর যেতেই হঠাৎ তাঁর মনে একটা খটকা লেগেছে। গানাদো একটা। বেদে মাত্র বটে, কিন্তু আংটি তুলতে জল ঠেঙাবার মতো আহাম্মক বলে তো তাকে মনে হয় না, দেবতা-টেবতার ভর হয়ে দৈববাণী গোছের যা সে পেয়েছে বলেছে, তার মধ্যে তার নিজস্ব বুদ্ধিশুদ্ধির কোনও প্রমাণ নেই বলে ধরলেও সাধারণ কাজকর্ম কথায়বার্তায় ওরকম নির্বুদ্ধিতার পরিচয় তো সে দেয়নি এ পর্যন্ত।
কেমন একটু সন্দিগ্ধ হয়ে পিজারো আবার সেই জলাশয়টার ধারে ফিরে গিয়েছেন। ফিরে গিয়ে কিন্তু গানাদোকে আর দেখতে পাননি।
সে কি এর মধ্যেই তার আংটিটা তুলে ফেলে চলে গেছে। পুকুরের ধারে যখন সে নেই তখন তা-ই বুঝে নেওয়া উচিত। কিন্তু পিজারোর মনের খটকাটা যায়নি। আর সেই খটকা থেকেই হঠাৎ তিনি যেন নতুন এক হদিস পেয়েছেন তাঁর অভিযান সম্পর্কে।
তিনি নিজেও হাতে আঁকশি নিয়ে জল ঠেঙাচ্ছেন নাকি? ঠেঙালে জল সরে, না সমান জোরে পালটা ঘা দেয়? –
নতুন দেশের মানুষ সম্বন্ধে পিজারোর নীতি সেইদিন থেকেই বদলেছে। অন্তত তখনকার মতো।
আর মারকাট লুঠতরাজ নয়। বন্ধুর মতো প্রীতির হাত বাড়িয়ে দিয়ে অজানা দেশের রহস্যময় দুর্গমতা জয় করতে এগিয়ে যাওয়া।
পিজারো পনেরোশো বত্রিশ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে টম্বেজ শহরে সামান্য কিছু অক্ষম রুগ্নকে রেখে ইংকা সাম্রাজ্যের হৃদয়স্থল খুঁজতে তুষার কিরীটি কার্দোলিয়েরাস-এর দিকে যাত্রা শুরু করেন।
পথে টমবেজ থেকে নব্বই মাইল দূরে সান মিগুয়েল নামে একটি নতুন শহরেরও পত্তন করে যান। এ শহর ছাড়বার আগে এ পর্যন্ত যা-কিছু সংগ্রহ হয়েছে সমস্ত সোনা-রুপো গলিয়ে তার পাঁচভাগের একভাগ যথারীতি সম্রাটের জন্য বরাদ্দ করে বাকি সব কিছু দেনা শোধের জন্যে তিনি পানামায় পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। দেনা তো কম নয়, জাহাজ যার কাছে কেনা হয়েছে তার কাছে যেমন, তেমনই মালপত্র অস্ত্রশস্ত্র সব কিছুর জোগানদারদের কাছেই তখনও তাঁরা বাকি দামের জন্যে দেনদার। সে দেনার টাকা মেটাবার জন্যে তাঁর নোক-লশকরদের ভাগের সোনাদানাও তাঁকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নিতে হয়েছে। তারা যে পিজারোর কথায় বিশ্বাস করে ভবিষ্যতের আশায় অত কষ্টের ও সাধের বখরা ছাড়তে রাজি হয়েছে এতেই অভিযাত্রীদের মধ্যে তখন নতুন উৎসাহের সঞ্চার হয়েছে বলে বোঝা যায়।
এ উৎসাহ তারপর ম্লান না হয়ে আরও তীব্র হওয়ার কারণই ঘটেছে।
প্রায় আধা-মরুর তীরভূমি ছেড়ে যত তারা আকাশছোঁয়া পাহাড়ের দেশে এগিয়েছে তত মধুর অপরূপ হয়ে উঠেছে তাদের পরিবেশ। আর সেই ভ্যাপসা জলাজংলার দুর্দশা নয়, চারিদিকে যেন স্বপ্নরাজ্যের খেত-খামার বাগান বিছানো। এদেশের লোক পাহাড়ি নদীকে বাগ মানিয়ে চাষের জন্যে সেচের কাজে লাগাতে শিখেছে, পাহাড়কে খাঁজে খাঁজে কেটে ফসলের খেত বানাবার কৌশল তারা জানে। যেখানে খেত খামার গ্রাম নেই সেখানে বিরাট সব অজানা মহীরূহের অরণ্য আর ঢেউ-এর পর ঢেউ তোলা পাহাড়ের সারির মহিমাময় রূপ। ইংকাদের প্রতাপ যেন সে নিসর্গ শোভার মধ্যে ফুটে উঠেছে।
বন্ধুভাবে অগ্রসর হওয়ার জন্যে পিজারোর বাহিনী প্রায় সর্বত্রই সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছে এবার। যেখান দিয়ে তারা গেছে সেখানকার বসতির লোকেরা অতিথি হিসেবে তাদের সৎকারের কোনও ত্রুটি রাখেনি।
যাত্রাপথে পার্বত্য উপত্যকায় এই সব বসতিতে পিজারো যা দেখেছেন শুনেছেন তা বেশ একটু ভয়-ভাবনা জাগাবার মতো। ইংকা সাম্রাজ্যের বিধি ব্যবস্থা যে কীরকম উঁচুদরের, তীরভূমি থেকে পাহাড়ের দেশে আসবার পথে পদে পদে তার নিদর্শন মিলেছে। পার্বত্য নদী কোথাও বেঁধে কোথাও সুড়ঙ্গপথে চালিয়ে তাদের সেচের ব্যবস্থা তাঁর নিজের দেশকেও লজ্জা দেওয়ার মতো। তীরভূমি থেকে সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলে দূর-দূরান্তরের যোগাযোগের জন্যে যেভাবে রাস্তাঘাট তৈরি ও তা রক্ষার। ব্যবস্থা চালু রাখা হয়েছে তা সত্যিই বিস্ময়কর। নিরক্ষর পিজারোর পূর্তবিদ্যা সম্বন্ধে কোনও জ্ঞান না থাকলেও এসব দুঃসাধ্য কারিগরির অসাধারণত্ব বুঝতে কষ্ট হয়নি। নেহাত নগণ্য না হলে পার্বত্য পথের প্রতি জনপদে পিজারো ইংকা নরেশের জন্যে নির্দিষ্ট বিশাল সব পান্থ-নিবাসই শুধু দেখেননি, দেখেছেন প্রতিরক্ষার জন্য সুনির্মিত সব দুর্গ।
জনপদের অধিবাসীদের কাছে ইংকা সাম্রাজ্যের বিস্তারিত বিবরণও তিনি সংগ্রহ করেছেন। মাত্র বাষট্টি জন রিসালা নিয়ে সবসুদ্ধ একশো আটষট্টি জন সৈন্য যাঁর সম্বল তাঁর পক্ষে সে বিবরণ একেবারেই মনোরম নয়।
ইংকা সাম্রাজ্য কত বড় আর কতখানি তার ঐশ্বর্য এ সবের চেয়ে ইংকা নরেশের সৈন্যবল কত ও কী দরের সেই কথা জানবার আগ্রহই পিজায়োর তখন বেশি। সঠিক খবর পাওয়া না গেলেও তাঁর মুষ্টিমেয় বাহিনীকে ইংকা সাম্রাজ্যের বিরাট সেনাদল যে পায়ে মাড়িয়েই শেষ করে দিতে পারে এটুকু পিজারো জেনেছেন।
সৈন্যবল কত ইংকা নরেশের? কেউ তা ঠিকমতো বলতে পারে না, কিন্তু এটুকু তারই মধ্যে জানা গেছে যে সম্প্রতি ইংকা সম্রাট যেখানে শরীর সারাবার জন্যে আস্তানা নিয়েছেন সেখানেই তাঁর সঙ্গে আছে অন্তত হাজার পঞ্চাশ সেপাই।
পিজারোর কি এবার মানে মানে ফিরে যাবার ব্যবস্থাই করা উচিত ছিল না? কিন্তু তিনি তা করলেন কই? একশো আটষট্টি জন্য সৈন্য সঙ্গে নিয়েই তিনি। আতাহুয়ালপার সঙ্গে দেখা করবার জন্যে কাক্সামালকার উদ্দেশে এগিয়ে চললেন।
আতাহুয়ালপা কে তা বোধহয় আর বলতে হবে না।
তিনি হলেন সূর্যপ্রভব ইংকা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর, আর কাক্সামালকা হল পেরুর এক আশ্চর্য ঝরনা-জলের শহর, তখনকার ইংকা নরেশদের মতো এখনও মানুষ যেখানে স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে যায়।
ইংকা আতাহুয়ালপার নিজের ডেরার কডিলিয়েরাস-এর পার্বত্য গোলোক ধাঁধা ভেদ করে এ ভাবে যাওয়া এক হিসেবে বাতুল গোঁয়ার্তুমি ছাড়া কিছু নয়। কী করবেন পিজারো তাঁর ওই ক-টা সঙ্গী নিয়ে সেই ইংকা সম্রাটের কাছে উপস্থিত হয়ে? তিনি কি শুধু সেই মহামহিমের দর্শনলাভের জন্যেই যাচ্ছেন? অকূল সাগর আর দুর্গম গিরি-মরু পেরিয়ে এসেছেন শুধু কিছু অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে?
সে অনুগ্রহ চাইলেই যে পাবেন তারই বা ভরসা কী? রাজা-গজার মেজাজের কিছু ঠিক আছে? পিজারো আর তাঁর দলবল এ অজানা দেশের রেওয়াজ দস্তুর আদব-কায়দা কিছুই জানেন না বললে হয়। সামান্য একটু ভুলচুক হওয়া আশ্চর্য কী! আর তাতেই ইংকা রাজ্যেশ্বরের মেজাজ যদি বিগড়ে যায়, তখন? যে পঞ্চাশ হাজার সৈন্য ইংকা আতাহুয়ালপার সঙ্গে রক্ষী হিসেবে আছে তারা সবাই একটা করে টোকা। দিলেই তো তাঁরা গুঁড়িয়ে ধুলো হয়ে যাবেন। যদি বা তাদের এড়িয়ে কোনওমতে কাক্সামালকা থেকে পালাতে পারেন, তারপর নিস্তার পাবেন কি? এ পাহাড়ি গোলকধাঁধার রাজ্যে পথে পথে দুর্গের পাহারা। তা ছাড়া দূর-দূরান্তরে রাজাদেশ। নিয়ে যাওয়া ও খবর দেওয়া-নেওয়ার জন্যে দৌড়বাজ দূতের ব্যবস্থা আছে। তাঁরা পাঁচ পা না যেতে যেতেই তাঁদের খবর পাহাড় থেকে সাগর-তীর পর্যন্ত পৌঁছে যাবে।
এ সব কথা একেবারেই ভাবেননি, পিজারো এমন নির্বোধ গোঁয়ার সত্যিই নন। তবু তিনি যে অটল সংকল্প নিয়ে কামালকা শহরের দিকে এগিয়ে গেছেন তা শুধু বাতুল জেদের জন্যই বোধহয় নয়। ভরসা পাওয়ার মতো কিছু একটা তিনি সম্ভবত জেনেছিলেন।
ভরসা যা থেকে পেয়েছিলেন তা কি ইংকা সাম্রাজ্যের সাম্প্রতিক ইতিহাস? মনে হয় তাই। এ বিশাল রহস্যময় সাম্রাজ্যের ভয়-জাগানো নানা বিবরণের মধ্যে আতাহুয়ালপার রাজ্যেশ্বর হওয়ার কাহিনীটুকু হয়তো তাঁকে কিছুটা আশা দিয়ে থাকতে পারে।
আশা এই কারণে যে আতাহুয়ালপার ভাগ্যে নিরঙ্কুশ সাম্রাজ্য লাভ ঘটেনি। রক্তসমুদ্র পার হয়ে তাঁকে সিংহাসনে পৌঁছোতে হয়েছে। আর তাও তিনি পৌঁছেছেন মাত্র সেদিন ভ্রাতৃহত্যার পাতকে কলঙ্কিত হয়ে।
ইতিহাসের জ্ঞান নিরক্ষর পিজারোর ছিল না বটে, কিন্তু ধূর্ত বিচক্ষণতা নিশ্চয় ছিল যাতে ঘরোয়া খুনোখুনিই যে বাইরের দুশমনির রাস্তা সাফ করে দেয় তা তিনি বুঝতেন।
সাম্রাজ্য নিয়ে যে ঘরোয়া সংগ্রামে আতাহুয়ালপাকে ভ্রাতৃহত্যার পাতকী হতে হয়। ইংকা রাজবংশের ইতিহাসে তা অভাবনীয়।
ইংকাদের আদি অভ্যুত্থান টিটিকাকা হ্রদের তীরের সময়ের কুজঝটিকায় অস্পষ্ট। নিজেদের যাঁরা সূর্যের সন্তান বলতেন সেই ইংকা রাজবংশের ইংকা টুপান য়ুপানকি ছিলেন এক অসামান্য পুরুষ। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তাঁর মৃত্যু হয়। তার আগেই ইংকা সাম্রাজ্য তাঁর বাহুবলে উত্তরে বর্তমান ইকোয়েডর-এর কুইটো থেকে দক্ষিণে এখনকার চিলি রাজ্যের মরুপ্রায় তীরভূমি আতাকামা ছাড়িয়েও বিস্তৃত হয়েছে।
ইংকা য়ুপানকির পুত্র ও উত্তরাধিকারী হুয়াইনা কাপাক কীর্তিতে পিতাকেও তারপর ছাড়িয়ে গেছেন। ইংকা সাম্রাজ্যের সবচেয়ে সুখ শান্তি ও সম্মানের যুগ তাঁর। রাজত্বকালেই এসেছিল। কিন্তু এ সাম্রাজ্যের ধ্বংসের বীজও তিনি নিজের অজ্ঞাতে রোপণ করে গিয়েছিলেন।
পনেরোশো চব্বিশের নভেম্বর মাসে পিজারো যখন প্রথম পানামা বন্দর থেকে সূর্য কাঁদলে সোনার দেশ আবিষ্কারের আশায় পাড়ি দেন, হুয়াইনা কাপাক তখনও জীবিত।
নতুন মহাদেশে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক শ্বেতাঙ্গ জাতের বিদেশি মানুষের পদার্পণের কথা তিনি জেনে গিয়েছিলেন বলে শোনা যায়। জেনেছিলেন সম্ভবত পিজারোর প্রথম অভিযান শুরু হওয়ার আগেই। বালবোয়া প্রশান্ত মহাসাগর আবিষ্কার করে সেন্ট মাইকেল উপসাগর পার হয়ে ইংকা সাম্রাজ্যের প্রথম কিংবদন্তি যখন শোনেন তখনই এই অচেনা আগন্তুকদের খবর হয়তো হুয়াইনা কাপাক-এর কানে পৌঁছেছিল। তখন যদি এ খবর না-ও পেয়ে থাকেন, পিজারো আর আলমাগরো তাঁদের প্রথম অভিযানে রিও দে সান খুয়ান নদী পর্যন্ত পৌঁছোলে তার বিবরণ হুয়াইনা কাপাক নিশ্চয় পেয়েছিলেন। শোনা যায় এ বিবরণ শুনে তিনি নাকি বেশ একটু বিচলিত হয়েছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। পিজারোর সৈন্যদের বন্দুক ও সওয়ারি ঘোড়ার বর্ণনা বেশ একটু অতিরঞ্জিতভাবেই কাপাক শুনেছিলেন নিশ্চয়। এ রকম অদ্ভুত যাদের শক্তি তাদের নামমাত্র সংখ্যা আর ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার কথা জেনেও হুয়াইনা কাপাক নিশ্চিন্ত হননি। দিকচক্রবালে সামান্য একটা কালো ফোঁটা থেকেই ইংকা সাম্রাজ্যের ভিত নাড়ানো প্রলয়-তুফানের আবির্ভাব তিনি নাকি অনুমান করেছিলেন। নিজের অনুমান সত্য হয়ে ওঠা দেখে যাওয়ার দুর্ভাগ্য তাঁর হয়নি। সঠিক তারিখ নিয়ে কিছু মতভেদ আছে তবু পনেরোশো পঁচিশ কি ছাব্বিশে তিনি মারা যান।
মারা যাওয়ার আগে এমন একটি কাজ তিনি করে যান যা ইংকা রাজবংশের চিরকালের রীতি ও সংস্কারের বিরোধী। ইংকা রাজবংশের প্রাচীন রীতি অনুসারে ইংকা নরেশের নিজের ভগিনীই একমাত্র খাসরানি হওয়ার যোগ্য এবং তারই প্রথম পুত্রসন্তান রাজশক্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী।
সে হিসেবে হুয়াইনা কাপাক-এর সাম্রাজ্য তাঁর বৈধ বিবাহজাত জ্যেষ্ঠ পুত্র হুয়াসকার-এর ওপরই বর্তাবার কথা। হুয়াসকার পুত্র হিসেবে কাপাক-এর অপ্রিয়ও ছিলেন না। তাঁর হুয়াসকার নামের কুইচুয়া ভাষার অর্থ হল শৃঙ্খল। এরকম অদ্ভুত নাম রাখবার কারণ এই যে হুয়াসকার-এর জন্মােৎসবের নাচের আসরে অভিজাত খানদানিদের জাতীয় নৃত্যের সময় ধরবার জন্যে হুয়াইনা কাপাক চারশো হাতেরও বেশি লম্বা ও জোয়ান মানুষের কবজির মতো মোটা একটি স্বর্ণশৃঙ্খল তৈরি করিয়েছিলেন।
হুয়াসকার-এর প্রতি তাঁর স্নেহের অভাব তারপর ঘটেনি, কিন্তু আর এক টান তাঁর ছিল প্রবলতর।
হুয়াইনা কাপাক উত্তরের কুইটো জয় করবার পর সে রাজ্যের শেষ স্কিরি বা অধীশ্বর পরাধীনতার দুঃখেই মারা যান। কাপাক তাঁর কন্যাকে তখন বিয়ে করেন। তখনকার যুগের প্রায় সব দেশের রাজাবাদশার মতো ইংকাদের বৈধ মহিষী ছাড়া অন্য রানি ও শয্যাসঙ্গিনী থাকত অসংখ্য। কাপাকের সবচেয়ে প্রিয় রানি ছিল কুইটোর এই রাজকন্যা। এরই প্রেমে শেষ জীবনটা তিনি নিজের রাজধানী ছেড়ে কুইটো থেকেই শাসনকার্য চালিয়েছেন।
কুইটোর এই রাজকন্যাই আতাহুয়ালপার জননী। ছেলেবেলা থেকে আতাহুয়ালপা বাপের সঙ্গে সঙ্গেই থেকেছে। বড় হয়ে উঠেছে তাঁরই শিক্ষাদীক্ষায় স্নেহের প্রশ্রয়ে। ইংকা ছাড়া আতাহুয়ালপার শরীরে অন্য রক্ত ছিল বলেই বোধহয় ছেলেবেলা থেকে তার মধ্যে একটা অতিরিক্ত বুদ্ধির উজ্জ্বলতা আর প্রাণের উচ্ছলতা দেখা গেছে। দিনে দিনে পুত্রস্নেহাতুর হুয়াইনা কাপাকের তিনি নয়নের মণি হয়ে উঠেছেন। মৃত্যুকালে স্নেহান্ধ হয়েই হুয়াইনা কাপাক ইংকা রাজবংশের সমস্ত বিধিনিষেধ লঙঘন করে সমস্ত সাম্রাজ্য বৈধ উত্তরাধিকারী হুয়াসকার আর আতাহুয়ালপার মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন। ধ্বংসের বীজ রোপিত হয়েছে তখনই।
হুয়াইনা কাপাকের মৃত্যুর পর প্রথম পাঁচ বছর একরকম নিঝঞাটেই কেটেছে। হুয়াসকার দক্ষিণে আর আতাহুয়ালপা উত্তরে নিজের নিজের অংশে রাজত্ব করেছেন পরস্পরের সম্মান রেখে। কিন্তু বিরোধের কারণ দেখা দিতে দেরি হয়নি।
হুয়াসকার আতাহুয়ালপার চেয়ে বয়সে বছর-পাঁচেক বড়। বিধিসম্মতভাবে একমাত্র ন্যায্য উত্তরাধিকারী হলেও প্রকৃতিটা শান্তশিষ্ট হওয়ার দরুন পিতার পক্ষপাতিত্ব মেনে নিয়ে তিনি হয়তো নির্বিরোধে নিজের অংশটুকুর ওপরে রাজত্ব করেই সুখী থাকতে পারতেন, কিন্তু আতাহুয়ালপার সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্রের জন্যেই তা সম্ভব হয়নি।
বাইরে থেকে দেখলে বিরোধের প্রথম প্রত্যক্ষ সূত্রপাত হুয়াসকারই করেছেন, কিন্তু করেছেন অনেক কিছুতেই ধৈর্য হারিয়ে।
আতাহুয়ালপার প্রকৃতি হুয়াসকার-এর ঠিক উলটো। সুখে স্বচ্ছন্দে শান্তিতে রাজত্ব করবার মানুষ তিনি নন। রাজ্য পেয়েই তিনি তা বাড়াবার জন্যে নানাদিকে সৈন্য-সামন্ত নিয়ে হানা দিতে শুরু করেছেন। প্রথমে হুয়াসকার-এর এলাকায় হাত না বাড়ালেও অন্যদিকে তাঁর দুর্দান্ত সব অভিযানের সাফল্যের খবর হুয়াসকারকে ভাবিত করে তুলেছে। রাজসভায় তাঁকে উসকে দেওয়ার লোকের অভাব হয়নি। তারা বুঝিয়েছে , গোড়াতেই বিষদাঁত না উপড়ে নিলে এ-সাপ বড় হয়ে এক দিন হুয়াসকারের রা ধানী কুজকোর ওপর ছোবল দেবে। আতাহুয়ালপার চালচলন। ভাবগতিক দের এ-সন্দেহ আরও জোরদার হয়েছে। শেষপর্যন্ত হুয়াসকার আতাহুয়ালপার রাজধানী কুইটোতে দূত পাঠিয়েছেন।
এসপানিওন দের এ রাজ্যে পা দেওয়ার কিছুদিন মাত্র আগের ঘটনা। তবু পেরুর রাজতক্ত নিয়ে দুই ভাই-এর সংগ্রামের সঠিক বিবরণ কেউ সংগ্রহ করতে পারেনি। এক মত অনুসারে হুয়াসকার কুইটোতে দূত পাঠিয়ে আতাহুয়ালপাকে খুশিমতো নিজের রাজ্যের বাইরে চড়াও হতে মানা করেছিলেন আর তাঁর কাছে বশ্যতার প্রমাণস্বরূপ রাজত্ব চেয়েছিলেন। অন্য এক বিবরণে পাওয়া যায় যে, ঝগড়ার সূত্রপাত টুমেবাম্বা বলে এক প্রদেশ নিয়ে। আতাহুয়ালপার অধিকারে থাকলেও সেটি তাঁর প্রাপ্য বলে দাবি করেই নাকি হুয়াসকার দূত পাঠান।
কারণ যা-ই হোক, ভেতরে ভেতরে যা ধোঁয়াচ্ছিল সে-বিরোধের আগুন দাউ দাউ করে এবারে জ্বলে ওঠে। আতাহুয়ালপা প্রথম দিকে এ লড়াই-এ সুবিধে করতে পারেননি। যে টুমেবাম্বা নিয়ে বিরোধ, সেই জায়গাতেই হুয়াসকার-এর কাছে যুদ্ধে হেরে গিয়ে তিনি বন্দী হন।
পেরুর ভাগ্য নির্ণয় অত সহজে কিন্তু হয়ে যায়নি। আতাহুয়ালপা বন্দিশিবির থেকে পালাবার সুযোগ পেয়েছেন আর তারপর নিজের রাজধানী কুইটোয় ফিরে গিয়ে দুই প্রবীণ বিচক্ষণ সেনাপতির সাহায্যে এমন এক বাহিনী গড়ে তুলেছেন যা প্রলয়ের ঢেউয়ের মতো দুর্বার গতিতে হুয়াসকার-এর রাজধানী কুজকো পর্যন্ত পৌঁছে গেছে।
আতাহুয়ালপার সহায় এই দুই প্রবীণ সেনাপতির একজন হলেন তাঁর বাবা হুয়াইনা কাপাকেরই বন্ধু কুইথকুইথ, আর দ্বিতীয়জন আতাহুয়ালপার মাতুল চালিকুচিমা।
আতাহুয়ালপার বাহিনী রাজধানী কুজকোর কাছের প্রান্তর কুইপেইপান-এ এসে পৌঁছে গেলেও হুয়াসকার ভয় পাননি। শত্রুকে একেবারে নিজের এলাকায় মুঠোর মধ্যে এনে ফেলাই নাকি ছিল তাঁর গোপন অভিসন্ধি। কোনও নিপুণ অভিজ্ঞ সেনাপতি নয়, এ রণ-কৌশলের পরামর্শ তাঁকে দিয়েছিলেন সূর্যমন্দিরের পুরোহিতরা।
এ-পরামর্শ হুয়াসকার-এর পক্ষে সর্বনাশা হয়ে দাঁড়ায়। কুইপেইপান-এর যুদ্ধে হুয়াসকারের সৈন্যবাহিনী বিশ্বাসঘাতকতা করেনি, প্রাণ দিয়ে তারা লড়েছে, বিশুদ্ধ ইংকা রক্ত যাঁর মধ্যে বইছে, সাম্রাজ্যের সেই যথার্থ অধীশ্বরের জন্যে, কিন্তু আতাহুয়ালপার সৈনিকদের শিক্ষা ও শৃঙ্খলা অনেক উঁচু দরের। মাতুল চালিকুচিমা আর পিতৃবন্ধু কুইথকুইথ-এর রণকৌশলও অনেক শ্রেষ্ঠ। হুয়াসকারের বাহিনী মৃত্যুপণ করে যুঝেও তাদের সামনে দাঁড়াতে না পেরে ছারখার হয়ে গেছে।
হুয়াসকার হাজারখানেক সেনার ছোট একটি অনুগত দল নিয়ে পালাবার চেষ্টা করে সফল হতে পারেননি। তাঁকে বন্দি করে বিজয়ী বাহিনী কুজকো নগর দখল করেছে।
এর পরেরকার যে-ইতিহাস পাওয়া যায় তা হয়তো অতিরঞ্জিত, কিন্তু তার মধ্যে আতাহুয়ালপার নৃশংতার সব বিবরণ সম্পূর্ণ অবিশ্বাস করা যায় না।
আতাহুয়ালপা প্রথমে বড়ভাইকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েই নাকি বন্দি করে রাখবার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু সে ব্যবস্থা হয়তো একটা ধূর্ত রাজনীতির চাল মাত্র। হুয়াসকারের হিতৈষী অন্য অভিজাত ইংকা-প্রধানরা তাতে বেশ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিলেন, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা না হলে সমস্ত দেশের দূরদূরান্ত থেকে কুজকো নগরে এসে সমবেত হতে তাঁরা রাজি হবেন কেন!
আতাহুয়ালপা তাঁদের ডেকে পাঠিয়েছিলেন পেরু সাম্রাজ্য দুই ভাই-এর মধ্যে। ন্যায্যভাবে ভাগবাঁটোয়ারায় সাহায্য করবার জন্যে। এমন ভাগাভাগি তিনি চান ভবিষ্যতে যাতে বিরোধের কোনও জড় আর না থাকে।
বিশ্বাস করে যাঁরা কুজকো নগরে সেদিন জড়ো হয়েছিলেন তাঁদের কেউই আর নিজের ঘরে ফিরে যেতে পারেননি। আতাহুয়ালপার সৈন্যরা তাঁদের ঘেরাও করে প্রত্যেককে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
শুধু এই ইংকা-প্রধানদেরই নয়, ইংকা রক্তে যাদের জন্ম ও এ-রক্ত ভবিষ্যতে যাদের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে, এমন বালক-বালিকা যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা কাউকেই জীবিত থাকতে দেওয়া হয়নি। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে সাম্রাজ্যের অধিকার দাবি করতে পারে এমন সব বংশধারা আতাহুয়ালপা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন।
এ বিবরণ আর কারও কাছে নয়, ইংকা বংশেরই উত্তরপুরুষ স্বয়ং সার্সিলাসো দে লা ভেগা-র কাছে পাওয়া বলে একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
এসব ঘটনার মাত্র কিছুদিন বাদে পেরুতে পৌঁছে পিজারোর, যত বিকৃত জটিলভাবেই হোক, কোনও বিবরণ শুনতে নিশ্চয় বাকি থাকেনি। ভাই-এ ভাই-এ এই ঘরোয়া লড়াই আর দু-পক্ষের দলাদলির খবরই তাঁকে উৎসাহিত করেছে। সাম্রাজ্য বিরাট হতে পারে, কিন্তু তার মাঝখানে এই সর্বনাশা ফাটল যখন ধরেছে। তখন ধ্বংস একেবারে অসম্ভব কিছু হয়তো নয়।
তাঁর সেনাদল নিয়ে পিজারো তখন থারান বলে এক পাহাড়ি শহরে আস্তানা পেতেছেন। তাঁর আস্তানা ইংকা রাজপুরুষদের ব্যবহারের জন্যে নির্দিষ্ট একটি চমৎকার সরাইখানা। সে শহরের কুরাকা মানে মোড়ল পিজারো ও তাঁর লোকজনের যথাসম্ভব পরিচর্যাই করেছে।
কিন্তু সে আদর আপ্যায়নে পিজারোর উদ্বেগ অশান্তি আরও বেড়েছে।
সমুদ্রের তীরভূমি থেকে তুষার ঢাকা পাহাড়ে অনেক দূর পর্যন্ত তো উঠে এসেছেন, এখনও ইংকা আতাহুয়ালপার কোনও সাড়াশব্দ নেই কেন?
এই পাহাড়ি চড়াই উত্রাই-এর গোলকধাঁধার রাজ্যে পিজারো আর তাঁর দলবলের জন্যে নতুন ধরনের কোনও ফাঁদ পাতা হচ্ছে কি?
থারান ছেড়ে নিজে আর না অগ্রসর হয়ে পিজারো তাঁর বিশ্বস্ত বুদ্ধিমান সহকারী হার্নারেমন্ডো দে সটোকে কয়েকজন অনুচর সঙ্গে নিয়ে সামনের পথে কিছুদূর পর্যন্ত টহল দিয়ে আসতে বলেছেন। টহল দিতে পাঠাবার উদ্দেশ্য কাক্সাস বলে একটি জায়গার খবর নেওয়া। পিজারো কয়েকজনের মুখে শুনেছেন যে কাক্সাস-এ ইংকা সেনাদের একটি বড় গুপ্ত ঘাঁটি আছে। এ সব ঘাঁটি কী ধরনের, সেখানকার অস্ত্রশস্ত্র ও লোকবল কী রকম তার একটু আভাস না পেলে অন্ধের মতো সদলবলে এগিয়ে যাওয়া অত্যন্ত আহাম্মকি হবে।
কিন্তু দে সটো সেই যে গেছে তার আর ফেরবার নাম নেই। একদিন দু-দিন করে পুরো হপ্তাই কেটে গেছে, দে সটোর কোনও সাড়া-শব্দ মেলেনি।
এই পাহাড়ি গোলকধাঁধায় সে তার দলবল সমেত কোথাও গুম হয়ে গেল নাকি! পিজারো যখন রীতিমতো শঙ্কিত হয়ে উঠে সদলে এগোবেননা-পেছোবেন মনে মনে তোলাপাড়া করছেন তখন দে সটো হঠাৎ আশাতীতভাবে ফিরে এসেছে। ফিরে এসেছে একা নয়, সঙ্গে তার স্বয়ং ইংকা আতাহুয়ালপারই এক রাজদূত।
রাজদূত যে পেরুর বড় ঘরোয়ানা তা তাঁর চেহারা পোশাকেই বোঝা যায়। তাঁর সঙ্গে অনুচরই এসেছে বেশ কয়েকজন। কাক্সাস দুর্গ-শহরে দে সটোর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ইংকা রাজ্যেশ্বরের বার্তা আর উপহার তিনি পিজারোর কাছে পৌঁছে দিতে এসেছেন।
উপহার যা তিনি এনেছেন তা বেশ দামি ও অদ্ভুত। এনেছেন আলপাকা আর ভিকুয়ানার পশমে বোনা সোনা রুপোর ভরির কাজ করা পোশাক, খাবার জন্যে নয়, গুঁড়িয়ে সুগন্ধ হিসেবে ব্যবহার করবার জন্যে মশলা মাখা শুখানো বিচিত্র একতাল হাঁসের মাংস আর দুটি পাথরের তৈরি ফোয়ারা। এই শেষের উপহার দুটিই একটু উদ্বিগ্ন করে তোলার মতো খেলনা ফোয়ারা দুটি দুর্গের আকারে তৈরি। এই দুর্গাকার খেলনা উপহার হিসেবে পাঠাবার মধ্যে কোনও গূঢ় ইঙ্গিত আছে কি না পিজারোকে ভাবতে হবে।
ইংকার রাজদূত যে শুধু পেরু সম্রাটের আমন্ত্রণবার্তা নিয়ে সৌজন্য দেখাতে আসেননি, এসপানিওলদের খোঁজখবর নিয়ে তাদের ক্ষমতার বহর জেনে যাওয়াই যে তাঁর আসল উদ্দেশ্য পিজায়োর তা বুঝতে দেরি হয়নি। মনের কথা মনেই চেপে রেখে বাইরে পিজারো যথাসাধ্য সমাদরই করেছেন রাজদূত আর তাঁর অনুচরদের। রাজদূতকে বিদায় দেওয়ার সময় উপহারের বদলি উপহার দিতেও ভোলেননি। সেই সঙ্গে সবিনয়ে জানিয়েছেন যে সুদূর অকূল সমুদ্রপারের এক দেশের মহামহিম অধীশ্বরের প্রজা হিসেবে এই অজানা দেশে এসে ইংকা আতাহুয়ালপার আশ্চর্য বীরত্বের বহু কাহিনী তাঁরা শুনেছেন। তাই শুনে আতাহুয়ালপাকে শত্রু দমনে সাহায্য করতে পিজারো সদলবলে উৎসুক। ইংকা রাজ্যেশ্বরের আমন্ত্রণ পাবার সৌভাগ্য যখন তাঁদের হয়েছে তখন তাঁরা রাজসন্দর্শনে যেতে আর একমুহূর্ত বিলম্ব করবেন না।
তা, বিলম্ব করবেন না ঠিকই, কিন্তু রাজসন্দর্শনে যাবেন কোথায়? ইংকা রাজ্যেশ্বরের দূত তার হদিস তো দিয়ে যায়নি।
শেষ পর্যন্ত সে হদিস পাওয়া গেছে। জানা গেছে যে, ইংকা রাজ্যেশ্বর বিরাট বাহিনী নিয়ে কাক্সামালকায় বিশ্রাম করছেন। হ্যাঁ, সেই স্বাভাবিক উষ্ণ প্রস্রবণের শহর কামালকা, তখনকার ইংকা সম্রাটের মতো আজও যেখানে ধনী-মানীরা স্বাস্থ্যোদ্ধারের জন্যে যায়।
অনেক দ্বিধা সংশয় দমন করে অনেক বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে পিজারোর বাহিনী একদিন সেই কাক্সামালকার নগর সীমান্তেই উপস্থিত হয়েছে। কামালকায় পৌঁছোতে পাহাড়ের ওপর থেকে উত্রাই-এর পথে নামতে হয়। নামতে নামতে যে দৃশ্য চোখে পড়ে তা অপূর্ব। চারিদিকে অভ্রভেদী পর্বত প্রাচীরে ঘেরা নাতিপ্রশস্ত একটি ডিম্বাকৃতি উপত্যকা। লম্বায় আন্দাজ সাড়ে চার ক্রোশ আর চওড়ায় তিন। এ উপত্যকার মাঝখান দিয়ে বেশ বড় ও চওড়া একটি নদী বয়ে গেছে। এই মনোহর উপত্যকার মধ্যে পরিচ্ছন্ন যেন দুধে ধোওয়া সব বাড়ি দিয়ে সাজানো নগর কামালকা।
পিজারো তাঁর বাহিনীর সঙ্গে পাহাড় ঘেরা উপত্যকার সৌন্দর্য আর নীল আকাশে পতাকার মতো উষ্ণ প্রস্রবণের সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলী তোলা শহরের শোভা দেখে মুগ্ধ হওয়ার অবসর কিন্তু পাননি। নীচের শহরের দিকে চেয়ে আর একটি যে দৃশ্য তাঁদের
চোখে পড়েছে তাতেই বুক তাঁদের তখন কেঁপে উঠেছে নিশ্চয়।
শহর ঘিরে যে সব পাহাড়ের দেওয়াল উঠে গেছে তার কোলে কোলে ক্রোশের পর ক্রোশ মুঠো মুঠো করে ছড়ানো সাদা তুষারের মতো ওগুলো কী?
ওগুলো যে কী তা বুঝতে দেরি হয়নি। ওগুলো আর কিছু নয়, ইংকা আতাহুয়ালপার বিরাট সৈন্যবাহিনীর অগণন সব তুষারশুভ্র শিবির।
শিবিরই যেখানে অমন অগুনতি সেখানে সৈন্য যে কত তা বুঝে পিজারোর লোকেদের বুক যদি বেশ দমে গিয়ে থাকে তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। উপায় থাকলে তাদের ক-জন ওই উত্রাই-এর পথে নীচের উপত্যকায় তখন নামত তা বলা কঠিন। ইংকা আতাহুয়ালপার ওই সৈন্যসমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়া মানে নিশ্চিত নিষ্ফল আত্মহত্যা বুঝে অনেকের মনেই ফিরে যাওয়ার আকুলতা যে জেগেছিল, কনকুইস্তেদর মানে অভিযাত্রীদের একজনই তা স্বীকার করে গেছেন তাঁর লেখায়।
ভয় যতই হোক—তিনি লিখে গেছেন—ফিরে যাওয়ার তখন আর সময় নেই। এতটুকু দ্বিধা দুর্বলতা দেখালেও সর্বনাশ। সঙ্গে ওদেশি যেসব লোকজন আছে তারাই তাহলে আমাদের ওপর প্রথমে চড়াও হবে। সুতরাং যথাসাধ্য মনের ভাব মনেই চেপে আমরা উত্রাই-এর পথে নামতে শুরু করলাম।