১৫.
কোন রকম জানান না দিয়ে বৃষ্টি এল। ভিজিয়ে দিতে লাগল ওদের। আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল কিশোর। আবার কুচকুচে কালো হয়ে গেছে আকাশটা। মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়েছে চাঁদ।
কালো আকাশটাকে চিরে দিয়ে গেল বিদ্যুতের শিখা। গুড়গুড় মেঘ ডাকল।
ইস, একেবারে ভিজে গেলাম! বক্সের শব্দকে ছাপিয়ে চিৎকার করে : উঠল কিশোর।
এভাবে ভেজা ঠিক হচ্ছে না। সরে যাওয়া দরকার কোথাও, রবিন বলল। কিন্তু কোথায় যাব?
আরেকবার বিদ্যুৎ চমকাল। দিনের আলোর মত আলোকিত করে দিল। চতুর্দিক। বজ্রপাতের শব্দ। হাত দিয়ে মাথার পানি মোছার চেষ্টা করল কিশোর। মাথা থেকে মুখ বেয়ে গড়িয়ে নামছে পানি। চোখের সামনে জমে গিয়ে দৃষ্টি আচ্ছন্ন করে দিচ্ছে।
বিকট শব্দে বাজ পড়ল আবার। থরথর করে কেঁপে উঠল মাটি। সাদা। আলোয় দেখা গেল বালির ঢিবিতে জন্মানো ঘাসগুলো বাতাসের ঝাঁপটায় আন্দোলিত হচ্ছে। একবার এদিক মাথা নোয়াচ্ছে, একবার ওদিক। ওদের মতই ঝড়বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে।
পুলহাউজে চলে গেলে কেমন হয়? কিলোর বলল।
সুইমিং পুলের পেছনে লম্বা ঘরটায় সাঁতার কাটার পোশাক আর পুল পরিষ্কারের জিনিসপত্র রাখা হয়। দুর্গন্ধ আর ধুলাবালি-ময়লা নিশ্চয় আছে। কিন্তু মাথা গোঁজার ঠাই তো হবে।
মুসা বলল, চলো, যাই।
দৌড়াতে শুরু করল ওরা। ভেজা মাটিতে পা পিছলে আছাড় খেল। কিশোর। তাড়াতাড়ি উঠে পড়ল আবার। ব্যাগটা মনে হচ্ছে কয়েক মন ভারী। আবার ছুটল মুসা আর রবিনের পেছনে। ঘরের দরজাটায় এখন তালা। দেয়া না থাকলেই হয়।
নাহ, তালা নেই।
পাল্লা ঠেলে খুলে ফেলল মুসা। হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়ল তিনজনে। এত জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর, ফুসফুসটা যেন ফেটে যাবে। বাতাসে ক্লোরিনের কড়া গন্ধ। বদ্ধ থাকায় অতিরিক্ত গরম। চালে ঝমঝম শব্দ তুলেছে বৃষ্টির ফোঁটা।
বাতি জ্বালার জন্যে সুইচ টিপল মুসা। আলো জ্বলে উঠল।
না না, জলদি নেভাও! চিৎকার করে উঠল কিশোর। মিলার দেখতে পেলে…
জানালা নেই। আলো বেরোবে কোন দিক দিয়ে?
আর কিছু বলল না কিশোর। ভিজে কপালের সঙ্গে লেপ্টে আছে চুল।
হাত দিয়ে মাথা থেকে পানি মুছতে মুছতে রবিন বলল, আপাতত তো। ঢুকলাম। এরপর কোথায় যাব?
এখানে ফোনটোন আছে নাকি? চারপাশে তাকাতে লাগল কিশোর।
থাকার সম্ভাবনা খুব কম, তবু যদি থাকে? এই আশায় খুঁজতে শুরু করল ওরা। লম্বা, নিচু চালার নিচে লাগানো উজ্জ্বল ফ্লোরেসেন্ট লাইটের আলোয় সবুজ দেখাচ্ছে ভেজা শরীরগুলোকে, মনে হচ্ছে সাগর থেকে উঠে। আসা তিনটে জলজন্তু।
টেলিফোন সেট পাওয়া গেল না।
এখন এই দ্বীপ থেকে বেরোব কি করে? চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল রবিন। ইচ্ছে করেই ডকের গেটে তালা লাগিয়ে রেখেছেন মিলার। নৌকাগুলো সরিয়ে ফেলেছেন।
কে বলল? পেছনে বোমা ফাটাল যেন গমগমে কণ্ঠ।
ভীষণ চমকে গেল তিন গোয়েন্দা। নিজের অজান্তেই ছোট্ট চিৎকার বেরিয়ে এল রবিনের মুখ দিয়ে। কিশোরও চিৎকার করতে যাচ্ছিল, কিন্তু। আটকে গেল গলায়। কুঁকড়ে গেল মুসা।
দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন মিলার মেলবয়েস। হাতে সেই হান্টিং রাইফেল। লাঠির মত ধরে তাতে ভর দিয়ে রেখেছেন। আরেক হাতে ছাতা। গায়ের হলদে রঙের রেইন স্নিকারের ঝুল গোড়ালি ছুঁই ছুঁই করছে।
ছাতাটা মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাইফেল হাতে এগিয়ে এলেন কয়েক পা। আলোর নিচে ভয়ঙ্কর লাগছে চেহারাটা। সাদা চুল এলোমেলো হয়ে আছে। ঘাড়ের কাছে বেশ কিছু চুল খাড়া। এক চোখে কালো কাপড়। আরেকটা ভাল চোখ জ্বলছে। ঠোঁটের এককোণ বেঁকে গেছে বিচিত্র হাসিতে।
কি পচা একটা রাত। কিন্তু এখানে কি করছ তোমরা?
কেউ জবাব দিল না।
কিশোর ভাবছে, এত তাড়াতাড়ি আমাদের খুঁজে পেল কি করে? কিভাবে জানল আমরা এখানে আছি?
কি, কথা বলছ না কেন? মিলারের হাসিটা মুছে গেল ঠোঁটের কোণ থেকে।
বজ্রপাতের শব্দ যেন মুখ খুলে দিল কিশোরের। কোনমতে বলে ফেলল, আমরা চলে যাচ্ছি।
চলে যাচ্ছ? জবাবটা অবাক করল মিলারকে। রাইফেলে ভর দিয়ে। আরেক হাতে গাল চুলকালেন।
হ্যাঁ। এখানে আর থাকব না আমরা, মূসা বলল।
মুসার কথায় আহত হয়েছেন মনে হলো মিলার। কিন্তু তোমরা তো যেতে পারবে না।
পারতে হবে, দৃঢ়কণ্ঠে জবাব দিল কিশোর। চমকের প্রথম ধাক্কাটা অনেকখানি সামলে নিয়েছে। দরজাটা খোলা রেখে দিয়েছেন মিলার। সেদিকে তাকাল। বিদ্যুৎ চমকাল, আকাশে। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কড়াৎ করে বাজ পড়ল। বেড়ে গেল বৃষ্টির বেগ।
ওদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ একটা মুহূর্ত নীরব হয়ে রইলেন মিলার। নড়লেন না। কিন্তু তোমাদের তো যাওয়া হবে না, কঠিন, শীতল গলায় বললেন তিনি, পার্টিতে যেতে হবে। আমি নিজে তোমাদের দাওয়াত দিতে এলাম।
পার্টি? পেটের মধ্যে একধরনের শুন্য অনুভূতি হলো কিশোরের।
হ্যাঁ, পার্টি। শুরু হতে বেশি দেরি নেই, মিলারের একমাত্র চোখটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক পা এগিয়ে এলেন। সরে যেতে চাইল কিশোর। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।
পার্টি শুরু করার জন্যে অপেক্ষা করছি আমি আর রোজার, বিচিত্র হাসিটা ফিরে এল মিলারের ঠোঁটের কোণে। কি ধরনের পার্টি, অনুমান করতে পারো?
মিস্টার মিলার, রবিন বলল, দয়া করে আমাদের যেতে দিন। এসব পার্টিফার্টিতে যেতে চাই না আমরা। আপনাদের যা ইচ্ছে করুনগে…
কি ধরনের পার্টি, অনুমান করতে পারো? রবিনের কথা যেন কানেই যায়নি তাঁর। বলতে পারবে না তো? ঠিক আছে, বলেই দিই, হান্টিং পার্টি। খেকখেক করে হাসতে লাগলেন তিনি। হায়েনার হাসির মত লাগল রবিনের কাছে। এ মৌসুমে কাদের শিকার করব আমরা জানো? হাসিটা বাড়ছে তার।
বুঝে ফেলল কিশোর। মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে নেমে গেল ঠাণ্ডা শিহরণ। কল্পনায় ভেসে উঠল ট্রফি রূমের চারটে নরমুণ্ড।
কি করতে চাইছেন মিলার, মুসা আর রবিনও বুঝেছে। তাঁর হাতে হান্টিং রাইফেল। তিনি শিকারী, ওরা শিকার।
পাগল! উন্মাদ হয়ে গেছেন আপনি! কথাগুলো যেন বিস্ফোরিত হয়ে বেরিয়ে এল কিশোরের মুখ থেকে।
ঝট করে রাইফেলটা তুলে নিলেন মিলার।
সরে যাওয়ার চেষ্টা করল কিশোর। কিন্তু লুকানোর জায়গা দেখতে পেল না।
আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলা উচিত হয়নি তোমার! রেগে গেছেন মিলার। তোমাকে এলাম পার্টিতে দাওয়াত করতে, আর তুমি করছ আমাকে অপমান!
পার্টির দরকার নেই, অনুরোধ করে বলল মুসা, বেরোতে দিন আমাদের।
আমাকে পাগল বলছ কেন? আমি কি পাগল? রাইফেলটা আরও উঁচু করে ধরলেন মিলার। কিশোরকে নিশানা করলেন। দুপা আগে বাড়লেন আরও
মরিয়া হয়ে উঠল কিশোর। কোন রকম চিন্তাভাবনা না করে ছুটে গেল সামনের দিকে। একথাবায় সরিয়ে দিল নলের মুখ।
গুলি ফুটল বিকট শব্দে।
চিৎকার করে উঠলেন মিলার। রাইফেলের ধাক্কা এবং সেই সঙ্গে কিশোরের হাতের ঠেলা লেগে পেছনে উল্টে পড়ে গেলেন। একটা টেবিলের কোণায় বাড়ি খেল মাথা।
তার ওঠার অপেক্ষা করল না আর তিন গোয়েন্দা। ব্যাগগুলো যেখানে রেখেছিল সেখানেই রইল। খোলা দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে এল ওরা। মুষলধারা বৃষ্টির মধ্যে।
.
১৬.
এদিক দিয়ে! চিৎকার করে বলল মুসা।
সেদিকে ছুটল কিশোর। ভেজা মাটিতে জুতো পিছলে যাচ্ছে। মুসার পেছন পেছন বনে ঢুকে পড়ল। ফিরে তাকাল। ওর ঠিক পেছনেই রয়েছে রবিন। গাছপালার ফাঁক দিয়ে পুলহাউজটা দেখা যাচ্ছে। এখনও বেরোয়নি মিলার।
থামল না ওরা। যতটা সম্ভব দূরে সরে যাওয়া দরকার। বনের ভেতরের আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছুটছে বৃষ্টি কমেছে। গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে এখন। কিন্তু। বাতাসে পাতা নড়লেই ঝরঝব করে বড় বড় ফোঁটা বৃষ্টির মত ঝরে পড়ছে গায়ে।
চাঁদের ওপর থেকে সরে গেল মেঘ। গাছের মাথার ওপর দেখা গেল ফ্যাকাসে চাঁদ। ভূতুড়ে রূপালী করে তুলল বনভূমিকে। ভেজা পাতাগুলোকে কেমন বিকৃত দেখাচ্ছে। মাটি থেকে হালকা ধোয়ার মত উঠছে গরম বাষ্প।
যাচ্ছি কোথায়? জিজ্ঞেস করল রবিন।
কথা বোলো না, জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর, ছুটতে থাকো। কপালে ডালের বাড়ি খেয়ে আঁউক করে উঠল। ব্যথাটা এতই তীব্র, দাঁড়িয়ে গেল নিজের অজান্তে। ডলতে শুরু করল কপাল।
একঝলক দমকা বাতাস আবার পানির ফোঁটা ফেলল গায়ে। সরে যাওয়ার চেষ্টা করল। পারল না। ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল।
বনের ভেতর আরও খানিকক্ষণ দৌড়াল ওরা। পথ শেষ হয়ে গেল হঠাৎ। সামনে যেন হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে পথরোধ করে দিল কাটাঝোপ।
যাচ্ছি কোথায় আমরা? আবার জিজ্ঞেস করল রবিন। এভাবে দৌড়ে লাভটা কি?
বড় একটা গাছের নিচে দাঁড়াল ওরা। মাটি এখানে অনেকটাই শুকনো। গাছের পাতা এত ঘন, বৃষ্টির পানি নিচে পড়তে বাধা পেয়েছে।
দমকা বাতাস বয়ে গেল। জোরো রোগীর মত কাঁপিয়ে দিয়ে গেল গাছের পাতা।
পাগলটা কি আসবে নাকি? গাছের গায়ে পিঠ দিয়ে দাঁড়াল রবিন।
কান পেতে আছে তিনজনেই। কোন শব্দ নেই, শুধু বাতাসের ফিসফাস আর ওদের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া।
জানোয়ারের মত খুঁজে বের করে আমাদের খুন করবে সে, কিশোর বলল। দেয়ালের চারটে নরমুণ্ড আবার চোখের সামনে ভেসে উঠল ওর। আগের বছরের হান্টিং পার্টিতে ওদেরকেও নিশ্চয় এভাবেই দ্বীপময় তাড়িয়ে নিয়ে খুন করেছেন মিলার।
আসলেই এ ভাবে দৌড়াদৌড়ি করার কোন মানে হয় না, শার্টের হাতা দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে বাড়ি লাগা জায়গাটায় ব্যথা পেল কিশোর। কেয়ার করল না। একটা প্ল্যান দরকার আমাদের।
এ দ্বীপ থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, রবিন বলল। পেছনে তাকিয়ে দেখল মিলার আসছেন কিনা।
সে চেষ্টা তো ইতিমধ্যেই করেছি, হাতে বসা একটা মশাকে থাপ্পড় মারল কিশোর। নৌকা ছাড়া যাব কি নিয়ে?
গাছের বাকল দিয়ে বানিয়ে নিতে পারি, মুসা বলল, আমাজানের ইনডিয়ানদের মত।
হাত নেড়ে ওর কথাটা উড়িয়ে দিল কিশোর, ফ্যান্টাসি বাদ দাও এখন। গাছ কাটবে কি দিয়ে? বাধবে কি দিয়ে? কাটার শব্দ শুনে মিলার চলে আসবে না? তা ছাড়া অত সময় কই?
চুপ হয়ে গেল মুসা। ভাবতে লাগল তিনজনেই। বৃষ্টি এখন পুরোপুরি থেমে গেছে।
রবিন বলে উঠল, পাইরেট আইল্যান্ডের পুলিশকে একটা ফোন করা। গেলেই হত …
ফোনগুলো রয়েছে সব হোটেলে। চাপড় মেরে আরেকটা মশা তাড়াল কিশোর।
তাহলে ওখানেই যাওয়া উচিত আমাদের, মুসা বলল।
পাগল নাকি! ওর কথাটা নাকচ করে দিল রবিন।
ও ঠিকই বলেছে, মুসার সঙ্গে একমত হলো কিশোর। চুপি চুপি হোটেলে ঢুকে পুলিশকে ফোন করব।
কিন্তু উলফ আর মার্টিন যদি…
আমরা হোটেলে ঢোকার সাহস করব এটা এখন কল্পনাও করবে না ওরা। চটাস করে বাহুতে চাপড় মারল মুসা, শালার মশা!
কল্পনা করবে না এটা বলা যায় না, গাল থেকে টিপে একটা মশা মারল কিশোর। উলফ নিশ্চয় জানে না আমরা কোথায় আছি। রান্নাঘর কিংবা ডাইনিং রূমেই হয়তো এখন বসে আছে সে।
দুজনেই বন্দুক নিয়ে তেড়ে আসবে না তো আমাদের? কেঁপে উঠল রবিনের গলা। চটাস চটাস চাপড় মারতে আরম্ভ করেছে সে-ও। উফ, ড্রাকুলার বাচ্চা সব! খেয়ে ফেলল!…যেমন মনিব, তেমনি তার চাকর। দুজনেই হয়তো মানুষ শিকারে আনন্দ পায়। এ দ্বীপের সবাই রক্তলোভী। দেখছ না মশাগুলোর কাণ্ড!
উপায় এখন একটাই, কিশোর বলল, রিস্ক নিতে হবে। যত তাড়াতাড়ি পারি গিয়ে হোটেলে ঢুকে ফোন করে আবার পালাব। ওরা না আসা পর্যন্ত লুকিয়ে থাকব কোথাও।
কোথায়?
জানি না, অধৈর্য শোনাল কিশোরের কণ্ঠ, হোটেলের ভেতরই কোনখানে।
বনের মধ্যে লুকিয়ে থাকাটা বরং নিরাপদ।
কতক্ষণ? মুসার প্রশ্ন।
হোটলের মধ্যেও বেশিক্ষণ লুকিয়ে বাঁচতে পারব না আমরা, মুসার। কথার পিঠে বলল কিশোর। ওরা আমাদের খুঁজে বের করবেই। যে ভাবেই হোক বাঁচার একটা বুদ্ধি বের করতে হবে। আরেকটা কথা ভুলে গেলে চলবে, না, কোরিকে খুঁজে পাইনি আমরা এখনও। হোটেলে গিয়ে কোনমতে আগে একটা ফোন যদি করতে পারি, পরের ভাবনা পরে ভাবব।
আরও কয়েক সেকেন্ড আলোচনার পর রওনা হলো ওরা। কিশোর বলল, রাস্তা থেকে সরো। যতটা সম্ভব গাছপালার আড়ালে থেকে এগোব…
কথা শেষ হলো না তার। বাতাসে ঝরে পড়ল পানির ফোঁটা। পরক্ষণে শোনা গেল গুলির শব্দ।
চমকে মুখ তুলে তাকাল সবাই। সামনে দুটো গাছের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন মিলার। রাইফেলটা ওদের দিকে তাক করা। গুলি করেছেন ওদের লক্ষ্য করেই।
.
১৭.
আবার গুলি করলেন মিলার।
বিকট শব্দ গাছের গায়ে বাড়ি খেয়ে খেয়ে ফিরল দীর্ঘ সময় ধরে। মনে হলো যেন চতুর্দিক থেকে গুলি চলছে।
বুকে কিংবা মাথায় গুলি লাগার অপেক্ষায় ছিল কিশোর। লাগল না দেখে মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল। কার গায়ে লেগেছে? ওরাও কেউ আর্তনাদ করল না। দেরি না করে প্রায় ডাইভ দিয়ে লুকাল এসে একটা গাছের। আড়ালে। উপুড় হয়ে পড়ায় হাঁটুতে ব্যথা পেল।
হামাগুড়ি দিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়ল তিনজনেই। এখানে। থাকলেও বাঁচতে পারবে না। নিঃশব্দে বেরিয়ে এল ঝোপের অন্যপাশে। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল। দুহাতে গাছের ডাল সরাতে সরাতে ছুট লাগাল প্রাণপণে।
আবার শোনা গেল গুলির শব্দ।
খুব কাছে থেকে।
তারপর শোনা গেল কুৎসিত, কর্কশ হাসি। খুব মজা পাচ্ছেন উন্মাদ মিলার।
একটা বিখ্যাত গল্পের কথা মনে পড়ল রবিনের–দা মোস্ট ডেঞ্জারাস গেম! লেখকের নামটা এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। ঝড়ের মধ্যে জাহাজডুবী হয়ে বনে ছাওয়া এক দ্বীপে উঠতে বাধ্য হয় এক নাবিক। দুর্গের মত এক পুরানো বাড়িতে ওঠে রাতের আশ্রয়ের জন্যে। প্রথমে খুব খাতিরযত্ন করে তাকে বাড়ির মালিক। তারপর হাতে একটা অস্ত্র ধরিয়ে দিয়ে বলে পালিয়ে যেতে। রাইফেল আর শিকারী কুকুর হাতে নাবিকের পিছু নেয় সে, খুন করার জন্যে। রাতের অন্ধকারে তাড়া খেয়ে ভীত জানোয়ারের মত বনের মধ্যে প্রাণভয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে বেচারা নাবিক…অবিকল সেই গল্পের নকল চলছে এখন, ওদের ওপর। ওই ভয়ঙ্কর গল্প পড়েই কি হান্টিং পাটির উদ্ভট আইডিয়া মাথায় এসেছে মিলারের?
আতঙ্কে মাথা গরম হয়ে যাওয়ার অবস্থা হলো ওর। মনে হচ্ছে বাস্তবে ঘটছে না এই ঘটনা। সামনে পথজুড়ে থাকা ঝোপঝাড়, পিচ্ছিল ভেজা মাটি, চাঁদের আলোয় বিকৃত দেখানো ওই যে পাতাগুলো, কোনটাই বাস্তব নয়। রাইফেলের শব্দ, গুলি ফোঁটার পর প্রতিধ্বনি, সবই ঘটছে যেন ভয়াবহ কোন দুঃস্বপ্নে।
শিকারের উত্তেজনায় হেসে ওঠা মিলারের ওই শিকারী-হাসিও অবাস্তব।
কিশোরের চিৎকারে বাস্তবে ফিরে এল সে। কিশোর বলছে, অ্যাই দেখো, কোথায় বেরিয়েছি আমরা।
সাগরের কিনারে চলে এসেছে ওরা। ঝোড়ো বাতাসে ফুঁসে ওঠা বড় বড় ঢেউ চাঁদের আলোয় রূপালী হয়ে ভীমবেগে এসে আছড়ে পড়ছে নীলচে-সাদা বালিয়াড়িতে।
থমকে দাঁড়িয়ে পানির দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। সমতল, সরু এখানে সৈকত। কোথাও একটা বালির ঢিপিও নেই যে তার আড়ালে লুকাতে পারবে।
এখানে থাকা যাবে না, কিশোর বলল।
হ্যাঁ, একেবারেই খোলা, মুসা বলল।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে মিলারের আসার অপেক্ষা করছে ওরা। কান পেতে আছে গুলির শব্দের জন্যে। কার গায়ে বুলেট লাগবে প্রথমে কে জানে!
যাব কোথায়? কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে রবিনের। মোছার চেষ্টা করল না আর। চুলে আটকে আছে ভেজা পাতা। সেটাও সরাল না।
হোটেলেই ফিরে যাব, বলল কিশোর। বাঁচার এটাই একমাত্র উপায়।
সে-ই ভাল, মুসা বলল। এখানে থাকলে ডানাভাঙা হাঁসের মত গুলি করে মারবে।
শব্দ কিসের? শোনার জন্যে ঘাড় কাত করল রবিন।
মূসা আর কিশোরও কান পাতল।
তীরে আছড়ে পড়া ঢেউয়ের একটানা গুমগুম ছাড়া আর কোন শব্দ কানে ঢুকল না।
রাইফেলের গুলি হলো না আর। প্রতিধ্বনি নেই।
গাছের আড়াল থেকে ভেসে এল না উন্মাদের অট্টহাসি।
দাঁড়িয়ে থাকলে সময় নষ্ট। কিশোর বলল, চলো।
ফিরে এসে আবার বনে ঢুকল ওরা। সাবধান রইল আগের বার যেখান দিয়ে চলেছিল সেখানে যাতে আর না যায়। রাস্তায় উঠল না। গাছের আড়ালে আড়ালে খুব সাবধানে, নিঃশব্দে এগিয়ে চলল বাষ্প ওঠা গরম বনের ভেতর দিয়ে।
ভীত জানোয়ারের মত–ভাবল কিশোর। পা কাঁপতে শুরু করল হঠাৎ। ক্লান্তি, নাকি ভয়ে কাহিল হয়ে গেছে, বুঝতে পারল না। ভাঁজ হয়ে এল হাটু। বসে পড়ল ভেজা মাটিতে।
এগিয়ে এল মুসা। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, কি হলো?
না, কিছু না। পা দুটো চলতে চাইছে না আর। বেশি সাঁতরালে যেমন মাংসপেশীতে খিচ ধরে যায়, তেমন।
হু। জিরিয়ে নাও খানিক। ঠিক হয়ে যাবে।
শান্তিতে বসারও উপায় নেই। কোনদিক দিয়ে বেরিয়ে চলে আসবেন মিলার, বোঝা যাচ্ছে না। তবু হাঁটতে যখন পারছে না, না বসে উপায় কি?
কয়েক মিনিট বিশ্রাম নিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। হাঁটু ভাজ হচ্ছে না আর। গোড়ালির ওপরের মাংসে খিচধরা ভাবটাও কমেছে। পা বাড়াল আবার।
কি, অসুবিধে হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
মাথা নাড়ল কিশোর, না। চলো।
যতটা সম্ভব দ্রুত হেঁটে হোটেলের পেছন দিকে চলে এল ওরা। সামনে একচিলতে বালিতে ঢাকা জমি পেরোলে গিয়ে পড়বে ঘাসের মধ্যে। তারপর ঢাল বেয়ে উঠতে হবে।
জমিটা পেরোল ওরা। সামনে পাহাড়ের মত উঁচু বালির ঢিবির দিকে তাকিয়ে দমে গেল কিশোরের মন। বেয়ে ওঠা বড় কঠিন আর ভীষণ পরিশ্রমের কাজ।
কিন্তু উঠতেই হবে।
ওঠার পর কি দেখবে? মিলার কি কোনভাবে আন্দাজ করে ফেলেছেন। ওরা হোটেলে ফিরে যাচ্ছে? সেখানে গুলিভরা রাইফেল নিয়ে তৈরি হয়ে বসে আছেন? অন্ধকারে ওদের যাতে কায়দামত পেতে পারে, সেই সুযোগের জন্যেই কি সব আলো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে?
উলফ কোথায়? হান্টিং পার্টিতে যোগ দিয়েছে কি সে-ও?
এমনও হতে পারে মিলার যখন বনের মধ্যে ওদের তাড়া করে ফিরছেন, হোটেলে তখন রাইফেল হাতে ঘাপটি মেরে বসে আছে উলফ। ওদের ঢুকতে দেখলেই দেবে গুলি মেরে।
ভাবনাটা অস্থির করে তুলল কিশোরকে। বলল, ছড়িয়ে পড়ো। রাইফেল হাতে উলফ কিংবা মিলারকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে যে যেদিকে পারো। ঝেড়ে দৌড় মারবে। নিশানা করতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাবে তাহলে ওরা।
অনিচ্ছাসত্ত্বেও একে অন্যের কাছ থেকে আলাদা হয়ে গেল ওরা। মাথা নিচু করে, পিঠ বাঁকিয়ে উঠতে শুরু করল ঢাল বেয়ে। পেছন থেকে গায়ে এসে লাগছে বাতাস।
পেছনের আঙিনায় উঠে এল কিশোর। পুল হাউজের দরজাটা খোলা। তবে আলো নেভানো। সারা বাড়ির সমস্ত আলো নেভানো।
অন্ধকারে শিকার করতেই ভালবাসেন বোধহয় মিলার।
কাছেই একটা জোরাল শব্দ হলো। গুলির শব্দ ভেবে আরেকটু হলে চিৎকার করে উঠেছিল কিশোর। বুকের মধ্যে এত জোরে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা, মনে হচ্ছে পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসবে। মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে সব যেন সাদা হয়ে গেল। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে।
বুঝতে পারল কিসের শব্দ। একটা ধাতব ডেকচেয়ার সিমেন্টে বাধানো চত্বরে উল্টে ফেলেছে বাতাস।
শব্দটা রবিন আর মুসার কানেও গেছে। ওরা দুজনও যে যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে গেছে পাথর হয়ে। কান পেতে আছে। মিলারের কানেও কি গেছে চেয়ার পড়ার শব্দ? ভাবছেন ওরাই ফেলেছে? তাহলে খুজতে চলে আসবেন। এদিকে।
অপেক্ষা করতে লাগল ওরা।
এলোমেলো দমকা বাতাসে আরেকটা চেয়ার উল্টে পড়ল।
হোটেলের দিকে কোন নড়াচড়া নেই। রাইফেল হাতে এগিয়ে এলেন না মিলার।
চলো, ফিসফিস করে বলল কিশোর।
লম্বা দম নিয়ে হোটেলের দিকে পা বাড়াল সে।
মিনিটখানেকের মধ্যেই অন্ধকার ডাইনিং রূমে ঢুকে পড়ল ওরা। বদ্ধ বলে বাইরের চেয়ে এখানে গরম কম। নিঃশব্দে পাশ কাটিয়ে এল মিস্ত্রিদের মঞ্চটার। লবির ডাবল ডোরটার দিকে এগোল।
কেউ নেই, লবিতে উঁকি দিয়ে কিশোরের কানের কাছে ফিসফিস করে বলল রবিন।
দুজনেই বোধহয় বনে চলে গেছে, অনুমান করল মুসা।
গেলেই ভাল, বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।
দেয়াল ঘেঁষে থেকে লবির দিকে এগোল ওরা।
সামনের ডেস্কে যে ফোনটা আছে, রবিন বলল, সেটাই ব্যবহার করতে পারব আমরা।
লবিতে ঢুকে টেলিফোনের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।
রিসিভার তুলে কানে ঠেকাল মুসা। ডায়াল টোন নেই, হতাশ ভঙ্গিতে রিসিভারটা ধরিয়ে দিল কিশোরের হাতে। দেখো।
সর্বনাশ! ফিসফিস করে কথা বলার কথা ভুলে গিয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠল রবিন। ফোন খারাপ হলে করবটা কি?
রিসিভার কানে চেপে ধরে বার কয়েক ক্রেডল খটখট করল কিশোর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল, টোন এসেছে!
জলদি করো! উত্তেজনায় কিশোরের কাঁধ খামচে ধরল মুসা।
নম্বর দেখব কি করে? অন্ধকারে তো কিছু দেখা যাচ্ছে না…
কোমরে ঝোলানো টর্চটা খুলে নিল মুসা। আলো ফেলল সেটের ওপর। করো।
নম্বরও তো জানি না। রবিন, জলদি গাইড দেখো।
নম্বর বলল রবিন।
বোতামগুলো দ্রুত টিপে দিয়ে মুসাকে বলল কিশোর, লাইট নেভাও।
অপারেটর, অন্যপাশ থেকে কিশোরের কানে ভেসে এল একটা নাকি কণ্ঠ।
পাইরেট আইল্যান্ড পুলিশকে দিন, প্লীজ!
জরুরী? সন্দেহ ফুটল নাকি কণ্ঠটায়।
হ্যাঁ। প্লীজ, তাড়াতাড়ি করুন।
এক মিনিট।
অন্যপাশে খটাখট শব্দ হচ্ছে। ঘাড় ঘুরিয়ে হোটেলে ঢোকার দরজার দিকে তাকাল কিশোর। মিলারকে ঢুকতে দেখলেই ঝট করে বসে পড়বে ডেস্কের আড়ালে।
অনেক সময়, যেন দীর্ঘ এক যুগ পর কানে বেজে উঠল একটা ভোতা গলা, পুলিশ! কণ্ঠটা এমন কেন? যেন মাউথপিসে রুমাল চাপা দিয়ে কথা বলছে।
ভাবার সময় নেই। তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, অ্যাঁ!…হালো, আমাদের সাহায্য দরকার। এখুনি।
শান্ত হোন। কি সাহায্য?
কয়েকজন লোক পাঠান এখানে। ফাঁদে ফেলে আমাদের খুন করার চেষ্টা চলছে…
কোনখান থেকে বলছেন?
আঁ?..নাইট শ্যাডো…গোস্ট আইল্যান্ড। প্লীজ, এখুনি পাঠান। সাংঘাতিক বিপদে রয়েছি আমরা। ও আমাদেরকে খুন করতে চাইছে।
নাইট শ্যাডো? ওপাশে মনে হয় নামটা লিখে নিচ্ছে পুলিশ।
বড় বেশি ধীরে কাজ করছে মনে হলো কিশোরের। বলল, তাড়াতাড়ি করুন, প্লীজ।
শান্ত হোন। বিশ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাব আমরা। আরও কমও লাগতে পারে।
কট করে কেটে গেল লাইন।
ওরা আসছে, দুই সহকারীকে জানাল কিশোর।
কতক্ষণ লাগবে? জানতে চাইল রবিন।
বিশ মিনিট। বা তারও কম।
এই সময়টুকু উলফ আর মিলারের কাছ থেকে পালিয়ে থাকতে পারলেই বেঁচে যাব, মুসার কণ্ঠে স্বস্তি। চলো, লুকিয়ে পড়ি।
কোথায় লুকাব? রবিনের প্রশ্ন।
কেউ কোন জবাব দেয়ার আগেই দপ করে জ্বলে উঠল লবির লাইট। অফিসের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল একজন মানুষকে।
খাইছে! হাঁ করে তাকিয়ে আছে মুসা। দৌড়ানো দেয়ার কথাও ভুলে গেছে।
.
১৮.
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন রোজার মেলবয়েস। পরনে, সেই সাদা স্যুট। গলায় লাল রুমাল জড়ানো। উজ্জ্বল আলোর দিকে মুখ করে চোখ মিটমিট করছেন। দ্বিধায় পড়ে গেছেন মনে হলো।
কয়েক সেকেন্ড কেউ কোন কথা বলল না। তারপর চিৎকার করে উঠল রবিন, মিস্টার মেলবয়েস! আপনি বেঁচে আছেন।
কি বলছ? এগিয়ে এসে ডেস্কের ধার খামচে ধরলেন তিনি। অবাক হয়েছেন। বেঁচে আছি মানে?
হুড়াহুড়ি করে তার কাছে গিয়ে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। খুব খুশি হয়েছে। এই দ্বীপে একমাত্র তিনিই ওদের বন্ধু।
সাদা গোফের কোণ টানতে টানতে বললেন তিনি, তোমাদের এখানে দেখতে পাব ভাবিনি।
আমরাও ভাবিনি আপনাকে দেখব, রবিন বলল। আপনি ঠিক আছেন তো?
আছি, প্রশ্নটাও যেন অবাক করল তাঁকে। না থাকার কি কোন কারণ আছে? এখানে হচ্ছেটা কি?
এখানে… বলতে যাচ্ছিল রবিন।
কিন্তু বাধা দিয়ে বললেন রোজার, এত রাতে তোমরা এখানে কেন? ঘরে কি হয়েছে? চেহারার এই অবস্থা কেন! ভিজে চুপচুপে, সারা গায়ে কাদামাটি– •এখানে করছটা কি তোমরা?
আপনি আমাদের সাহায্য করুন, তাড়াতাড়ি বলল রবিন। পুলিশকে ফোন করেছি আমরা…
সতর্ক হয়ে উঠল ব্যারনের চোখজোড়া। পুলিশ?
উলফ আর আপনার ভাই মিলার…
কোথায় ওরা?
কোরিকেও পাওয়া যাচ্ছে না, মুসা বলল। মিলার আর উলফ রাইফেল নিয়ে তাড়া করেছে আমাদের। বনের মধ্যে গুলিও করেছিল।
দ্বিধান্বিত ভাবটা অনেক কমল। গাল ডললেন ব্যারন। রবিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, নিশ্চয় আরেকটা হান্টিং পার্টি?
হ্যাঁ। তাই তো বললেন মিস্টার মিলার, রবিন বলল। আপনি আমাদের বাঁচান। থামান ওদের।
থামাব? অদ্ভুত হাসি খেলে গেল ব্যারনের মুখে। পিছিয়ে গেলেন এক পা। ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বললেন, থামাব?
হ্যাঁ। আমাদের খুন করতে চায় ওরা। একমাত্র আপনিই আমাদের বাঁচাতে পারেন…
থেমে গেল রবিন। বদলে যাচ্ছে ব্যারনের চেহারার ভাব। হাসিটা। বাড়ছে। হাসছেন কেন ওরকম করে? ওই অদ্ভুত হাসি মুখটা বিকৃত করে দিয়েছে। চেহারাটাও কেমন অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে।
মুসাও তাজ্জব হয়ে গেছে। বেঁচে আছেন তো রোজার? না মরে ভূত হয়ে গেছে।
জিজ্ঞেস করল কিশোর, আপনার কি অসুস্থ লাগছে, ব্যারন?
চমৎকার কথা বলেছ–ওদের থামান! থামান ওদের! হাহহাহহাহ! পাগলের মত হেসে উঠলেন রোজার।
আপনার শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। আপনি বসুন।
এমন করছেন কেন? ব্যারনের এই পরিবর্তন দেখে রবিনও অবাক। কি যে হলো: আজকের রাতটাই যেন কেমন…
ওদের থামাব? ভুরু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ব্যারন, কেন থামাব? মাথার চুল খামচি দিয়ে ধরে টানতে শুরু করলেন। হ্যাঁচকা টানে গলা থেকে রুমালটা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন। কোটের বোতাম খুলে ফেললেন।
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল রবিন। ব্যারন! কি হয়েছে আপনার? অমন করছেন কেন?
কথাটা কানেই তুললেন না ব্যারন। কোট খুলে ছুঁড়ে ফেললেন ডেস্কে। দুই হাতে ভর দিয়ে ঝুঁকে দাঁড়ালেন ডেস্কের ওপর। কয়েক সেকেন্ড ওভাবে থেকে প্যান্টের পকেট হাতড়াতে শুরু করলেন। বের করে আনলেন একটুকরো কালো কাপড়। চোখে বাঁধার সেই কাপড়টা। বেঁধে দিলেন চোখের ওপর। এলোমেলো করে দিলেন মাথার সমস্ত চুল। মিলারের কণ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন, হান্টিং পার্টি! হান্টিং পার্টি! কোন কিছুর বিনিময়েই পার্টি আমি বন্ধ করব না।
পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা। পায়ে শেকড় গজিয়ে গেছে। যেন। স্তব্ধ বিস্ময়ে বোবা হয়ে তাকিয়ে আছে সামনের পরিবর্তিত মানুষটার দিকে।
বুঝতে অসুবিধে হলো না কিশোরের, এই লোক রোজার নন, তার ভাই মিলার। কোন কারণে রোজার সেজেছিলেন। হয়তো ওদের বোকা বানানোর জন্যেই।
.
১৯.
হান্টিং পার্টি বন্ধ করব? ভয়ঙ্কর মূর্তি নিয়ে ওদের মুখোমুখি হয়েছেন এখন মিলার। রোজারের ভদ্র, সৌজন্যে ভরা চেহারা উধাও হয়েছে, সেই জায়গায় বেরিয়ে এসেছে মিলারের বন্য, হিংস্র মুখ। পেছনে মাথা হেলিয়ে অট্টহাসি হেসে ওদের দিকে এক পা এগিয়ে এলেন। তোমরা আমাকে হান্টিং পার্টি বন্ধ করতে বলছ?
মিস্টার রোজার মানে, মিলার-প্লীজ! অনুরোধ করল কিশোর।
গটমট করে একটা চেয়ারের কাছে হেঁটে চলে গেলেন মিলার। ঠেস দিয়ে রাখা রাইফেলটা তুলে নিলেন। তার দিকে তাকিয়ে ছিল বলে এতক্ষণ চোখে পড়েনি ওদের।
রাইফেলটা চোখের সামনে এনে দেখতে লাগলেন মিলার। পানি মুছলেন ব্যাট থেকে।
এদিক ওদিক তাকাল কিলোর। পালানোর পথ নেই। ডাইনিং রূমে যাওয়ার দরজাটা খোলা। কিন্তু ওটা দিয়ে বেরোতে হলে মিলারের পাশ কাটিয়ে যেতে হবে। আর তা করতে গেলে দরজার কাছে যাওয়ার আগেই গুলি খাবে।
ইস, গাধার মত ইচ্ছে করে এসে ধরা দিলাম ভাবল সে। মরার জন্যে। এবার আর মুক্তি নেই। মিলারের হান্টিং পার্টি শেষ হওয়ার পথে।
চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল ট্রফি রূমের দেয়ালে বসানো চারটে নরমুণ্ড। আরও তিনটে যোগ হবে ওগুলোর সঙ্গে। ভয়ঙ্কর দৃশ্যটা মন থেকে দূর করার জন্যে ঘনঘন মাথা নাড়তে লাগল সে।
ওদের দিকে রাইফেল ঘোরালেন মিলার।
পুলিশ কই? ভাবল কিশোর। এতক্ষণে তো পৌঁছে যাওয়ার কথা।
জিজ্ঞেসপনি আকাশটা যেন হাত টোকা।
ওরা না আসা পর্যন্ত ঠেকানো দরকার মিলারকে। কথা বলানো দরকার, যাতে গুলি করার কথা ভুলে থাকে।
রাইফেলের সিলিন্ডার চেক করলেন মিলার। সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, লোডেড।
এ সব করে পার পাবেন না আপনি! চিৎকার করে উঠল রবিন। নিজের কানেই বোকা বোকা লাগল কথাটা।
কিশোর বলল মিলারকে, ব্যাপারটা নিয়ে একটু আলোচনা করতে পারি তো আমরা, নাকি?
আড়চোখে মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল সে। দরজার দিকে ঘন ঘন। তাকাচ্ছে ওরা। পুলিশ আসে কিনা দেখছে বোধহয়। রবিনের চেহারা ফ্যাকাসে। ঠোঁটের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট মুছছে। মুসা। বার বার ঢোক গিলছে। হাত ঢোকানো প্যান্টের পকেটে।
আলোচনা? প্রশ্নটা যেন অবাক করেছে মিলারকে।
আপনি…আপনি সত্যি এখন গুলি করবেন আমাদের? কোনমতে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
রাইফেল নামালেন মিলার। না… বিড়বিড় করে কি বললেন আরও, বোঝা গেল না। টান মেরে শার্টের কয়েকটা বোতাম ছিড়লেন। রাইফেলটা মাটিতে নামিয়ে তাতে ভর দিলেন। আরেক হাতে খোলা বুক চুলকালেন। একমাত্র ভাল চোখটা কিশোরের ওপর নিবদ্ধ।
জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। স্বস্তির। রবিনের চেহারা থেকেও দুশ্চিন্তা কমে গেল। গুলি করবেন না বলেছেন মিলার।
কিন্তু কিশোর স্বস্তি পেল না। এই পাগলের কথায় বিশ্বাস নেই। গুলি করবেন না?
মাথা নাড়লেন মিলার। লবিতে চোখ বোলালেন। রোজার গেল কই?
রোজার? জবাব দিল না কিশোর। তাকিয়ে আছে মিলারের মুখের দিকে। আশ্চর্য! ভাইকে গুলি করে মারার কথাটা বেমালুম ভুলে গেলেন নাকি? পাগল তো। যেতেই পারেন। মনে করাল না সে। আলোচনা চলুক। সময় নষ্ট হোক। ততক্ষণে পুলিশ চলে আসবে।
কোথায় ও? রাগত কণ্ঠে জানতে চাইলেন মিলার। আমার এই ভাইটাকে কোনদিন আর পার্টি পছন্দ করাতে পারলাম না। স্পোর্টস ও একদম বোঝে না।
শিকার পছন্দ করেন না নাকি তিনি?
বোঝে না, এটাই হলো কথা। সেজন্যেই আজ পার্টি শুরুর আগেই ওকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমি চাইনি বাধা দিয়ে আমার সমস্ত মজা। নষ্ট করুক।
নাহ, বদ্ধ উন্মাদ হয়ে গেছেন মিলার। গুলি করার পর বলেছিলেন রোজার মরে গেছে, এখন বলছেন সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। বুক কাঁপছে কিশোরের। এই পাগলকে বিশ্বাস করে কে! বলছেন বটে ওদেরকে বেরোতে দেবেন, কিন্তু যদি না দেন? অকারণেই খেপে গিয়ে এখনই গুলি শুরু করেন? বাইরে বেরোনোর ছুতো খুঁজতে লাগল সে। বলল, চলুন না সবাই মিলে তাকে খুঁজে বের করি। আমরা কি দেখব গিয়ে? মুসা আর রবিনের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কিশোর, ওরা ওর চালাকিটা ধরতে পেরেছে। কিনা।
যাবে কোথায় ও, ঠিকই ফিরে আসবে, তিক্তকণ্ঠে বললেন মিলার। জঘন্য হয়ে উঠেছে মুখের ভঙ্গি। ওকে সরানোর কত চেষ্টাই না করলাম। কিন্তু ঠিকই বেঁচে যায়। ফিরে ফিরে আসে।
আমাদের কি বেরোতে দেবেন? মুসা জিজ্ঞেস করল। কিশোরের পেছনে দাঁড়িয়ে একটা হাত রাখল ওর কাঁধে হাতটা বরফের মত শীতল।
হ্যাঁ।
সত্যি দেবেন? বিশ্বাস করতে পারছে না কিশোর।
হ্যাঁ, হাসি ফুটল মিলারের মুখে।
হঠাৎ যেন শরীরটা পালকের মত হালকা হয়ে গেল কিশোরের। মনে হলো শূন্যে ভাসতে শুরু করেছে। ভাসতে ভাসতে চলে যাচ্ছে হোটেল থেকে দূরে, দ্বীপ পেরিয়ে, সাগর পেরিয়ে…
একঘন্টা আগে বেরোতে দেব তোমাদের, হাসছেন মিলার।
ওপর থেকে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ল যেন কিশোর। কি করবেন?
এক ঘণ্টা সময় দেব, ঘড়ি দেখলেন মিলার। তারপর তোমাদের পিছু নেব। আলফ্রেড হিচককের বইতে সেই গল্পটা পড়োনি? দা মোস্ট ডেঞ্জারাস গেম?
কিন্তু…আ-আ-আপনি…
শিকারের এটাই আনন্দ। শিকারকে সুযোগ দেয়া। এ ধরনের স্পোর্টস খুব ভাল লাগে আমার।
দরজার দিকে তাকাল কিশোর। পুলিশ আসছে না কেন এখনও?
কথা বলার আর সময় নেই, ঘড়ি দেখলেন আবার মিলার। মুখ তুলেই চিৎকার করে উঠলেন, রেডি, গো! খেলা শুরু!
মিলার..প্লীজ… হাত তুলল কিশোর।
মুসার ঠাণ্ডা হাতটা এখনও খামচে ধরে আছে তার কাধ।
রবিন পাথর।
গুলি করবেন না, প্লীজ! আবার অনুরোধ করল কিশোর।
ভয়ানক রাগে লাল হয়ে গেল মিলারের মুখ। ঝটকা দিয়ে রাইফেল তুলে বাট ঠেকালেন কাঁধে। দেয়াল সই করে ট্রিগার টিপে দিলেন। দুবার। বদ্ধ জায়গায় কামানের গর্জনের মত শব্দ হলো।
চিৎকার করে উঠল রবিন।
যাও; বেরোও! তার চিৎকার ছাপিয়ে শোনা গেল মিলারের গলা। খেলা শুরু! তাকিয়ে আছেন রাইফেলের নলের দিকে। দুটো নলের মুখ দিয়েই ধোয়া বেরোচ্ছে।
হিংস্র লোকটার সামনে থাকার সাহস হলো না, আর গোয়েন্দাদের। দৌড় দিল দরজার দিকে।