জরাসন্ধবধে অর্জ্জুনের নির্ব্বন্ধ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! আমি সাম্রাজ্য লাভ করিবার আশায়ে কেবল সাহসমোত্র অবলম্বনপূর্ব্বক নিতান্ত স্বার্থপরায়ণের ন্যায় কি করিয়া তোমাদিগকে তথায় প্রেরণ করি? দেখ, ভীম ও অর্জ্জুন আমার দুই চক্ষুস্বরূপ, এবং তুমি মনঃস্বরূপ, অতএব আমি তোমাদের তিনজনকে তথায় প্রেরণ করিয়া মনোহীন ও চক্ষুহীন হইয়া কিরূপে জীবন ধারণ করিব? বিশেষতঃ জরাসন্ধের মহাবল পরাক্রান্ত দুৰ্জয় সৈন্যগণকে সংগ্রামে যমও পরাজয় করিতে পারে না; তোমরা যুদ্ধ করিয়া তাহাদের কি করিতে পরিবে? হে জনার্দ্দন! যখন স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, এ কাৰ্য্যে হস্তক্ষেপ করিলে অনৰ্থপাত হইবে, তখন আমার মতে এ বিষয়ে প্রবৃত্ত হওয়া অনুচিত। এক্ষণে আমি যাহা বিবেচনা করিয়াছি, শ্রবণ কর। রাজসূয় যজ্ঞানুষ্ঠানের অভিলাষ একবারে পরিত্যাগ করাই শ্ৰেয়ঃ; রাজসূয় সম্পন্ন করা নিতান্ত দুষ্কর বোধ হইতেছে।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, অর্জ্জুন পূর্ব্বে উৎকৃষ্ট ধনু, অক্ষয় তৃণীরদ্বয়, রথ ও ধ্বজ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। তিনি সভামধ্যে গমন করিয়া যুধিষ্ঠিরকে কহিতে লাগিলেন, “হে রাজন্! ধনু, শস্ত্ৰ, শর, বীৰ্য্য, স্বপক্ষ, কাৰ্য্যনিশ্চয়, যশ ও বল এই সকল অতি দুষ্প্রাপ্য কিন্তু আমি এই সমস্ত প্রাপ্ত হইয়াছি। বিদ্বান ব্যক্তিরা প্ৰসিদ্ধ বংশজাত লোকদিগকে প্রশংসা করিয়া থাকেন, কিন্তু আমার মতে যে ব্যক্তি বলবান ও উৎসাহশীল, তিনিই যথার্থ প্রশংসার পাত্র। দেখুন বীৰ্য্যবানদিগের কুলে সমুৎপন্ন দুর্ব্বল ব্যক্তি কিছুই করিতে পারে না; কিন্তু নির্বীৰ্য্য-কুলোদ্ভব বীৰ্য্যবান ব্যক্তি সম্ভ্রামাস্পদ হয়। যে শত্রুজয় দ্বারা বর্দ্ধিত হয়, সেই যথার্থ ক্ষত্ৰিয়। বীৰ্য্যবান ব্যক্তি অন্যান্য সমস্ত গুণবিবর্জিত হইলেও শত্রু জয় করিতে পারেন। নিবীৰ্য্য ব্যক্তি সর্ব্বগুণসম্পন্ন হইলেও তদ্দ্বরা কোন কাৰ্য্যই সম্পন্ন হয় না। পরাক্রমশালী ব্যক্তিতে সমস্ত গুণ গুণীভূত হইয়া থাকে। অভিনিবেশ জয়ের হেতু, উহা কর্ম্ম ও দৈব এই উভয়ের আয়ত্ত। যে ব্যক্তি বলসংযুক্ত হইয়াও অনবধানতাবশতঃ কাৰ্য্যকালে ঔদাসীন্য অবলম্বন করে, সে-ই সসৈন্য শত্রু কর্তৃক পরাজিত হয়, সন্দেহ নাই। বলবিহীন বিপক্ষপক্ষে দৈন্য অবলম্বন যেরূপ দোষাবাহ, বলবান শত্রুর নিকট অনবহিত হওয়াও তদ্রুপ। অতএব যে রাজা জয়াভিলাষী, তাঁহাকে অবশ্যই উক্ত সাংঘাতিক হেতুদ্বয় পরিত্যাগ করিতে হইবে। দেখুন, যদি আমরা যজ্ঞ করিবার উপলক্ষে জরাসন্ধকে বিনাশ ও অন্যান্য ভূপতিগণকে রক্ষা করি তাহা হইলে তদপেক্ষা আর কি উৎকৃষ্ট কর্ম্ম হইতে পারে? যুদ্ধাদিচেষ্টারহিত ব্যক্তিকে লোকে নির্গুণ জ্ঞান করে, তবে আপনি কি নিমিত্ত গুণপক্ষ অবলম্বন না করিয়া নির্গুণ হইবার বাসনা করিতেছেন? লোকে যাহাকে নির্গুণ বলিয়া বোধ করে, তাহার শম-গুণ অবলম্বন ও কাষায় বসন পরিধানপূর্ব্বক বনে গমন করা শ্রেয়ঃ; অতএব আমরা তাহা না করিয়া সাম্রাজ্যলাভের নিমিত্ত শক্রগণের সহিত সংগ্রাম করিব।”