১৫. চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে

চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে য়ুহার চোখে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল, ঠিক এ রকম সময় একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো এবং তার সাথে সাথে স্কাউটশিপটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে। য়ুহা চমকে উঠে বলল, ওটা কীসের শব্দ?

রায়ীনা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, গুলির শব্দ।

গুলির শব্দ?

হ্যাঁ। মনে হয় ওরা এখন অস্ত্র নিয়ে এসেছে!

সর্বনাশ!

য়ুহার কথা শেষ হবার আগেই আবার বিস্ফোরণের শব্দ হলো এবং স্কাউটশিপটা ভয়ানকভাবে দুলে উঠল।

রায়ীনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এ জন্যে আমি এদের সাথে গোলাগুলি করতে চাইনি! আমরা গুলি করেছি তাই আমরা এখন তাদের শত্রু হয়ে গিয়েছি।

আবার একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো, এবারে স্কাউটশিপের ভেতরে কিছু ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে। এক কোনা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠতে থাকে। য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, সর্বনাশ! আমরা এখন কী করব?

সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হতো যদি আমরা কিছু না করতাম।

কিন্তু তাহলে আমাদের মেরে ফেলবে না?

মেরে ফেলার কথা না। আমি যদি আরেকটি বুদ্ধিমান প্রাণী পেতাম তাহলে কখনোই রাগ হয়ে তাকে মেরে ফেলতাম না। আমি মৃত অবস্থায় যেটুকু গুরুত্বপূর্ণ বেঁচে থাকা অবস্থায় তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ

রায়ীনার কথার মাঝখানে ঠিক মাথার ওপর একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো এবং সেখান থেকে কিছু যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে নিচে এসে পড়ল। য়ুহা শুকনো গলায় বলল, রায়ীনা, কিছু একটা কর।

রায়ীনা স্কাউটশিপের নিচে গুড়ি মেরে বসে বলল, আমি একটা জিনিস ভাবছি।

য়ুহা একটু অস্থির হয়ে বলল, ভাবাভাবির অনেক সময় পাবে। এখন কিছু একটা কারো। গুলি শুরু কর! মৃত মানুষকে তো আর দ্বিতীয়বার মারা যায় না। তোমার ভয়টা কীসের?

গুলি করা থেকে ভালো কিছু করা যায় কী না ভাবছি।

সেটা কী?

গুলি করা মানেই শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। তা ছাড়া গুলি করা মানে ধ্বংস করা

কাছাকাছি আরেকটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো এবং স্কাউটশিপের একটা বড় অংশ হুঁড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। য়ুহা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, তারা আমাদের ধ্বংস করলে কোনো দোষ নেই, আমরা করলেই দোষ?

যুক্তিতর্কের সময় এটা না— রায়ীনা নিচু গলায় বলল, আমাদের খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে।

কী করবে?

যেহেতু আমরা দেখছি বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে এরা যোগাযোগ করছে, তাই আমরা ইচ্ছে করলে তাদের সমস্ত সিগন্যাল জ্যাম করে দিয়ে তাদেরকে অচল করে রাখতে পারি।

সেটা কেমন করে করবে?

রায়ীনা হাত দিয়ে স্কাউটশিপের যোগাযোগ মডিউলটা দেখিয়ে বলল, এই যোগাযোগ মডিউলটা দেখেছো?

হ্যাঁ, দেখেছি।

এটা থেকে খুব শক্তিশালী সিগন্যাল বের হয়। মহাকাশযান থেকে মহাকাশযানে এই সিগন্যাল পাঠানো হয়। আমরা তাদের ফ্রিকোয়েন্সিতে আমাদের সিগন্যাল পাঠাব, সবকিছু জ্যাম হয়ে যাবে!

য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি পারবে?

গুলি করে যোগাযোগ মডিউলটাই যদি উড়িয়ে না দেয় তাহলে পারার কথা?

তাহলে দেরি করো না। শুরু করে দাও।

একটু সময় দাও-ওটা খুলে আনি।

য়ুহা অধৈৰ্য্য গলায় বলল, কেন? খুলে আনতে হবে কেন?

আমার মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এসেছে!

কিন্তু তোমার বুদ্ধি কাজে লাগানোর আগেই আমরা মরে ভূত হয়ে যাব।

না। এত সহজে আমরা মরে ভূত হয়ে যাব না! এই প্রাণীগুলো আমাদের দিকে গুলি করতে পারে কিন্তু আমাদের মারবে না।

রায়ীনা গুড়ি মেরে স্কাউটশিপের কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে গিয়ে টেনেহিঁচড়ে যোগাযোগ মডিউলটা খুলে আনে। আবার গুড়ি মেরে য়ুহার কাছে এসে যোগাযোগ মডিউলের কন্ট্রোল বোতামটি চেপে ধরে বলল, আগে দেখে নিই কোন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করছে।

রায়ীনা সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি বের করে সেখানে তীব্র কিন্তু অর্থহীন সিগন্যাল পাঠাতেই হঠাৎ করে বাইরের গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। য়ুহা সাবধানে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল স্কাউটশিপ ঘিরে ইতস্তত কিছু প্রাণী নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো হঠাৎ করে আবার নড়ে উঠবে না ব্যাপারটা নিশ্চিত হবার পর য়ুহা আবার রায়ীনার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আসলেই অসাধারণ রায়ীনা!

এর মাঝে অসাধারণের কিছু নেই। রায়ীনা একটু হেসে বলল, আমি যেটা করেছি সেটা হচ্ছে একেবারে প্রাগৈতিহাসিক একটা ব্যাপার। এই প্রাগৈতিহাসিক উপায়ে আমি যে এটা করতে পেরেছি সেটাই হচ্ছে রহস্য!

য়ুহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, আমরা এখন কী করব?

স্কাউটশিপের ভেতরে থাকাটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে! যে কোনো মুহূর্তে নতুন একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে সিগন্যাল আসতে পারে। ফ্রিকোয়েন্সিটা এমনভাবে অদলবদল করতে পারে যে আমরা হয়তো আর তাল রাখতে পারব না। এই প্রাণী বল, মানুষ বল, মৃতদেহ বল–তারা নতুন করে আক্রমণ শুরু করতে পারে। বসে বসে গুলি খাওয়ার কোনো অর্থ নেই আমাদের বের হয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ঠিকই বলেছ।

সাথে যোগাযোগ মডিউলটা রাখি—আবার কাজে দেবে।

একেবারে ম্যাজিকের মতো কাজে দেবে।

রায়ীনা বলল, প্রয়োজন না হলে আমি এই প্রাণীগুলোর শত্রু হতে চাই। আমি শত্রু হয়ে দেখেছি। খুব কষ্ট।

য়ুহা কোনো কথা না বলে রায়ীনার মুখের দিকে তাকালো। কমবয়সী একটা মেয়ে কিন্তু এর ভেতরেই তার জীবনে কত কিছু ঘটে গেছে।