১৫. গ্যাব্রিয়েলা খুব অবাক

গ্যাব্রিয়েলা খুব অবাক হয়ে বৃদ্ধের দিকে তাকালেন। তাঁর বান্ধবী যে মারা গিয়েছে এ-খবর যে জানতেন না সেটা মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন, তোমরা বিশ্রাম করো। খবরাখবর পাওয়ার পর কী করতে হবে তা তোমাদের জানানো হবে।

বৃদ্ধ চলে গেলে সেই লোকটি তাদের অনুসরণ করতে ইঙ্গিত করল। ঘর থেকে বেরিয়ে, খানিকটা প্যাসেজ দিয়ে হাঁটার পর ওরা যে ঘরে ঢুকল সেটা দিয়ে ভেতরের আর একটা ঘরে যাওয়া যায়। ওদের পৌঁছে দিয়ে লোকটা দরজা বন্ধ করে চলে গেল। মেজর বললেন, বাঃ, তোফা আরাম করা যাবে। মেয়েরা ভেতরের ঘরে চলে যান, এখানে আমরা একটু বিশ্রাম নিই।

গ্যাব্রিয়েলা চিন্তিত মুখে ভেতরের ঘরে চলে গেলেন। অর্জুন চারপাশে তাকাল। হোটেলের ঘরের সঙ্গে কোনও পার্থক্য নেই। একপাশে ভারী পরদা। সে পরদা সরাতেই বন্ধ কাচের জানলার ওপারে সমুদ্র দেখতে পেল। এই জানলা সম্ভবত খোলা হয় না। পরদাটা আগের মতো করে দেওয়ার সময় তার চোখে বস্তুটা ধরা পড়ল। পরদার পেছনে ছোট্ট মাইক্রোফোন লাগানো আছে। তারবিহীন। খুব দ্রুত, যেন সে কিছুই দ্যাখেনি এমন ভান করে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখল সিম্বা তখনও মাঝখানের দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি অর্জুনের ওপর।

অর্জুন হাসল, কী হল, ও-ঘরে গেলে না?

লকেটটা কি ড়ুপ্লিকেট? সরাসরি প্রশ্ন করল সিম্বা।

অর্জুন শক্ত হল, হঠাৎ এই প্রশ্ন?

কারণ আমি সরলভাবে নিয়েছিলাম। ওই ভদ্রলোক বলার পর মনে হয়েছে আপনি আমার সারল্য নিয়ে খেলা করেছেন। বলুন, ঠিক কি না? সিম্বার মুখ শক্ত।

অর্জুন বলল, উনি বলেছেন লকেটটা যেহেতু এখানকার কারও কারও কাছে খুব মূল্যবান তাই ওটা আমি তোমার হাতে নিশ্চিন্তে ছেড়ে দিতে পারি না। তাই তো?

কথাটা তো ঠিকই।

দ্যাখো, লকেটটা আর কারও কাছে মূল্যবান হতে পারে, আমার কাছে তো নয়। তা ছাড়া তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই ওটা দেখতে বা রাখতে দিয়েছিলাম এমন ভাবতে পারছ না কেন?

আপনি আমাকে বিশ্বাস করেছিলেন?

অবিশ্বাস করার মতো কোনও কাজ কি তুমি করেছ? উলটে নিজের সব কাজ ফেলে আমাদের সাহায্য করার জন্যে এতটা পথ গাড়ি চালিয়ে এসেছ।

অর্জুনের কথা শুনে একটু সহজ হল সিম্বা। তার মুখে সামান্য হাসি ফুটল। পাশের ঘরে চলে গেল সে।

মেজর ততক্ষণে বিছানায় শরীর ছেড়ে দিয়েছেন। বাংলায় বললেন, তুমি ওকালতি করলে নাম করতে হে। কীরকম লাঠি না ভেঙে সাপ মেরে ফেললে। যাকগে, শুয়ে পড়ো। একটু আরাম করা যাক।

অর্জুন বলল, যে ব্যক্তি অকারণে নিদ্রামগ্ন হয় তাহার ভাগ্যও জাগ্রত হয়।

মেজর চোখ বড় করলেন। দাড়ির জঙ্গলে আঙুল বুলিয়ে বললেন, একেবারে পৌরাণিক ভাষায় কথা বলছ। ব্যাপারটা কী?

অর্জুন বলল, এই কক্ষে অনেক কর্ণ সংস্থাপন করা হইয়াছে। চক্ষু আছে কিনা তাহা এখনও আবিষ্কার করিতে পারি নাই।

মেজর বললেন, মাই গড!

ফিরিঙ্গি ভাষায় বাক্য বলিবেন না।

অ। কিন্তু মুশকিল হল, তোমার ওই ভাষা আমি বলতে পারব না। মেজর উঠে বসলেন, এরা বাংলা জানে বলে মনে হয় না।

উহাই স্বাভাবিক। বাঙালি কর্মচারী এই প্রাসাদে না থাকিবার সম্ভাবনাই বেশি। যাহোক, আমরা ডাঙার বাঘকে এড়াতে গিয়ে জলে নেমে কুমিরের কাছে পৌঁছে গিয়েছি বলে মনে হচ্ছে।

তার মানে, গ্যা—, না নাম বলব না, বড় দিদিমণি আমাদের প্ল্যান করে এখানে নিয়ে এসেছেন নাকি? ওই যা! প্ল্যান শব্দটা তো ইংরেজি। আমরা কথায় কথায় এত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করে থাকি যে, বাদ দেওয়া মুশকিল।

আমার মনে হয় না উনি ইচ্ছে করে এখানে নিয়ে এসেছেন। অর্জুন বলল।

উঁহু। এটা ঠিক কথা হল না। তোমার উচিত সবকিছুকে সন্দেহ করা। এত জায়গা থাকা সত্ত্বেও ভদ্রমহিলা জ্যাকসন হাইট থেকে আটলান্টিক সিটিতে আমাদের নিয়ে এলেন কেন? আমরা আসামাত্র জ্যাক কী করে এখানে হাজির হবে? আর তার ভয়ে উনি আশ্রয় নিতে এই বাড়িতে যে চলে এলেন এটা আগে থেকে প্ল্যা, না, পরিকল্পনা করা নয় তাই বা ভাবব না কেন?

হ্যাঁ। আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ওভাবে ভাবতে আমার ভাল লাগছে না। তা হলে তো সিম্বাকেও সন্দেহ করতে হয়। সব কাজ ফেলে সে কোন স্বার্থে আমাদের এতদূরে নিয়ে এল?

হুঁ। আচ্ছা, এই যে আমরা কথা বলছি এটা ওরা শুনতে পাচ্ছে?

হ্যাঁ। শুনতে পাচ্ছে তবে বুঝতে পারছে কিনা তা জানি না।

তা হলে তো এরা ডে-ডে, না, ভয়ঙ্কর লোকজন।

একটু আগের কথাবার্তা শুনে আপনার তা মনে হয়নি? আমি শুধু খুঁজছি এই ঘরে কোথাও ক্যামেরা লুকনো আছে কিনা। যাকগে, এখন কথা হল, কতক্ষণে এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়া যাবে! অর্জুন দেখল সিম্বা আবার এসে দাঁড়িয়েছে ভেতরের ঘরের দরজায়, আপনারা কি এখানেই থেকে যাবেন?

অর্জুন বলল, কখনওই নয়।

কিন্তু আমাকে এখনই নিউ ইয়র্কে ফিরতে হবে।

গ্যাব্রিয়েলা কী করছেন?

ওঁর বান্ধবীর মারা যাওয়ার খবর শুনে খুব আপসেট হয়ে পড়েছেন?

ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই। অর্জুন বলল।

সিম্বা মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেল। অর্জুন পকেট থেকে কলম বের করে এক টুকরো কাগজে লিখল, অনুগ্রহ করে মুখে উত্তর না দিয়ে ইশারায় জবাব দেবেন।

একটু বাদেই গ্যাব্রিয়েল সিম্বার সঙ্গে এই ঘরে এলে ও ইশারায় চুপ করতে বলে চিরকুটটা এগিয়ে দিল। গ্যাব্রিয়েল সেটি পড়ে ইশারায় কারণ জানতে চাইলেন। অর্জুন নিঃশব্দে পরদাটা সরিয়ে মাইক্রোফোন দেখাল। ওটা দেখতে পেয়ে গ্যাব্রিয়েলা এবং সিম্বার মুখের চেহারা পালটে গেল।

অর্জুন কাগজটা ফিরিয়ে নিয়ে লিখল, আপনার বান্ধবীর বাবাকে আপনি অনেকদিন থেকে চেনেন? গ্যাব্রিয়েলা সেটা পড়ে মাথা নাড়লেন, না।

 

এই সময় দরজায় শব্দ হতেই অর্জুন ইশারা করল মেয়েদের পাশের ঘরে চলে যেতে। তারা যাওয়ামাত্র সেই লোকটাকে দরজায় দেখা গেল, আপনাকে একটু আসতে হবে।

কেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

সেটা গেলেই জানতে পারবেন। ঠোঁট কামড়াল লোকটা।

অর্জুন এগোতেই মেজর ধড়মড়িয়ে উঠে ওকে অনুসরণ করলেন। লোকটা ঝটপট বলে উঠল, না। আপনাকে আমাদের প্রয়োজন নেই।

অর্জুন বলল, আমি ওঁকে ছাড়া কোথাও যাই না।

এবার যাবেন।

সরি। আপনারা আমাদের ওপর জোর খাটাতে পারেন না। অর্জুন বেঁকে বসল। লোকটা পকেট থেকে টেলিফোন বের করে চাপা গলায় দুটো কথা বলে কাঁধ ঝাঁকাল, ঠিক আছে, চলুন।

 

বৃদ্ধ বই পড়ছিলেন। ওরা ঘরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা তো ইন্ডিয়ান। ইংরেজরা কি আপনাদের মাতৃভাষা কেড়ে নিয়েছে?

মেজর বললেন, তার মানে?

আপনারা চমৎকার ইংরেজি বলেন। আগাথা ক্রিস্টির নাম শুনেছেন?

যে-কোনও শিক্ষিত লোক শুনেছে।

না। শোনেনি। একজন শিক্ষিত ফরাসি, স্প্যানিশ, জাপানি, চিনা, ইতালিয়ান ওঁর নাম না শুনেও চমৎকার শিক্ষিত থাকতে পারেন। অথচ আপনি যেভাবে বললেন, তাতে মনে হচ্ছে আপনার ভাষায় ভদ্রমহিলা এই বইগুলো লিখেছেন। বৃদ্ধ হাসলেন।

অর্জুন বলল, আমরা বাঙালি। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। কিন্তু পৃথিবী সম্পর্কে খবরাখবর রাখতে আমরা ইংরেজিও শিখি। আর আমরা যে নিজেদের মধ্যে বাংলা বলি না সেটা আপনিও জানেন।

কীরকম?

ঘরে আমরা দুজনে যেসব কথা বলেছি তা আপনার কানে গিয়েছে কিন্তু আপনি তার কিছু আগে বুঝতে পারেননি। তাই না?

বৃদ্ধ অর্জুনের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন, তুমি দেখছি সত্যি বুদ্ধিমান। তোমার প্রয়োজন কী?

মেজর বললেন, ও সত্যসন্ধানী।

তাই নাকি? বৃদ্ধের ঠোঁটের কোণে হাসি চলকে উঠল।

ওদের বসতে বলা হয়নি। অর্জুন এবার বিরক্ত হল, আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। এই শহরে এসে আমরা বিপদে পড়েছিলাম বলে গ্যাব্রিয়েলা আপনার বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার জন্যে আমাদের এখানে এনেছিলেন। কিন্তু আপনাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে আমরা কোনও আন্ডারওয়ার্ল্ডের নেতার বাড়িতে ঢুকে পড়েছি। ওই লোকটা যেভাবে আমাদের সঙ্গে কথা বলছে তাতে নিজেদের বন্দি ছাড়া অন্য কিছু ভাবা যাচ্ছে না।

বৃদ্ধ হাসলেন, আচ্ছা, বলুন তো, আপনাদের আশ্রয় দিয়ে আমার কী লাভ হবে? বিশেষ করে কিছু লোক তো আমার শত্রু হয়ে যাবে।

অর্জুন বলল, আমরা নিজের ইচ্ছেয় এখানে আসিনি। গ্যাব্রিয়েলা ভেবেছিলেন ওঁর বান্ধবীর বাড়িতে আশ্রয় পাওয়া যাবে।

বৃদ্ধ বললেন, শোনো, জীবন আমাকে একটা সত্যি শিখিয়েছে। কোনও কিছু পেতে গেলে তার দাম দিতে হয়। আমি কিছু না দিয়ে যেমন কিছু নিই না, তেমনই কিছু না পেলে দেওয়ার কথাও ভাবতে পারি না।

আপনি কী চাইছেন?

লকেটটা।

ওটা নিয়ে কী করবেন?

খুব সহজ উত্তর। যারা এটা খুঁজে বেড়াচ্ছে তাদের কাছে বিক্রি করে দেব। যে লকেটটা ওই কালো মেয়েটি পরে ছিল সেটা জাল।

ওটা আপনার অনুমান।

যখন তোমরা প্রথম এলে তখন অনুমান করেছিলাম। এখন জেনে গেছি। অনুমানটাই সত্যি। দ্যাখো, আমার বাজে কথা বলার সময় নেই। দাও।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।

তৎক্ষণাৎ বৃদ্ধের মুখ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। কিন্তু সেটা লহমার জন্যে। তারপরেই সহজ গলায় বললেন, নিউ ইয়র্ক থেকে এখানে আসার পথে মাত্র একটি দোকান আছে। ওই দোকানে আমার লোক গিয়েছিল। দোকানদারের নাম টমসন। সে বলেছে নতুন লকেটটা একটু বেশি চকচকে আর কিঞ্চিৎ হালকা। আশা করি আমার কথা বুঝতে পারছ।

মেজর বললেন, অদ্ভুত ব্যাপার। আপনার লোক এর মধ্যেই টমসনের দোকানে পৌঁছে গেছে। কী কাণ্ড! কিন্তু টমসন কি বলেনি আমাদের এক বন্ধু সঙ্গে ছিল, যে আসল লকেটটাকে নিয়ে ফিরে গেছে নিউ ইয়র্কে।

তোমাদের সঙ্গে আর একজন ছিল?

হ্যাঁ। মেজর মাথা নাড়লেন।

কী নাম তার?

মিস্টার আলাম্বা।

আলাম্বা? আফ্রিকার লোক?

হ্যাঁ। কিন্তু দেশের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই।

কোথায় থাকে সে?

কুইনসে।

তোমরা মিথ্যে কথা বলছ।

ঠিক আছে, একটা টেলিফোন দিন।

বৃদ্ধ ইশারা করতে লোকটি একটা কর্ডলেস ফোন এগিয়ে দিল। মেজর খুব স্বচ্ছন্দে নাম্বার টিপলেন। অর্জুন বুঝতে পারছিল না মেজর কী করতে চাইছেন। মিস্টার আলাম্বা তো সরাসরি অস্বীকার করবেন।

মেজর খানিকক্ষণ রিসিভারটা কানে চেপে এগিয়ে ধরলেন, সরি। মিস্টার আলাদা তার ফ্ল্যাটে নেই।

লোকটি রিসিভার নিয়ে রিডায়াল টিপল। রেকর্ডেড মেসেজ শুনে বলল, মিস্টার আলাম্বা বলছে যে সে লাঞ্চে গিয়েছে।

লোকেট করো। বৃদ্ধ বলতেই লোকটি পাশের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল। বৃদ্ধ হাসলেন, তোমাদের সঙ্গে আমার শত্রুতা নেই। কিন্তু যারা তোমাদের পেছনে লেগেছে তারা খুব ভয়ঙ্কর মানুষ। আমার সাহায্য ছাড়া মেরা এই আটলান্টিক সিটি থেকে বের হতে পারবে না। অবশ্য শহরের মধ্যে যতক্ষণ আছ ততক্ষণ কোনও ক্ষতি হবে না তোমাদের। কথা শেষ হওয়ামাত্র বৃদ্ধের পাশে রাখা টেলিফোন বেজে উঠল। চাপা গলায় কিছু কথা বলে বৃদ্ধ রিসিভার রাখলেন, জল দেখছি অনেকদূরে গড়িয়েছে। ওরা বোর্ডের কাছে আপিল করেছে তোমাদের জন্যে।

আপিল করেছে মানে?

যেহেতু এই শহরের প্যারালাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সমস্ত ব্যাপার নিয়ন্ত্রণ করে তাই কাউকে আক্রমণ করলে বোর্ড তাকে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য। বোর্ডের কাছে ওরা অ্যাপিল করেছে যাতে তোমাদের এই শহর অথবা আমার বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। আধ ঘণ্টার মধ্যে বোর্ড মিটিং-এ বসছে। আমি একজন মেম্বার। আমাকে যেতে হবে ওখানে। তোমরা এবাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকো। আমি তোমাদের হয়ে কথা বলব। আশা করি তার মধ্যে ওই মিস্টার আলাদা তাঁর লাঞ্চ সেরে ফিরে আসবেন। বৃদ্ধ উঠে দাঁড়ালেন।