১৫শ অধ্যায়
গান্ধারীর নিকট ভীমের ক্ষমাপ্রার্থনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে মহারাজ! তখন মহাবীর ভীমসেন গান্ধারীর বাক্য শ্রবণগোচর করিয়া ভীতচিত্তে তাঁহাকে অনুনয়সহকারে কহিতে লাগিলেন, “মাতঃ! আমি আত্মরক্ষা করিবার মানসে ভয়প্রযুক্ত যে কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছি, ধর্ম্মই হউক, আর অধর্ম্মই হউক, আপনি তদ্বিষয়ে ক্ষমা প্রদর্শন করুন। আমি অধর্ম্মানুসারেই আপনার আত্মজকে বিনাশ করিয়াছি। ধর্ম্মযুদ্ধে তাঁহাকে সংহার করা নিতান্ত দুষ্কর এবং সে আমাকে বিনাশ করিলেই রাজ্যগ্রহণ করিবে, এই ভাবিয়াই আমি অধর্ম্মপথ অবলম্বন করিয়াছিলাম। পূর্বে আপনার পুত্র দুৰ্য্যোধন অধর্ম্মানুসারে ধর্ম্মরাজকে পরাজয়, আমাদিগের সহিত সতত শঠতাচরণ এবং একবস্ত্রা রজঃস্বলা রাজকুমারী দ্রৌপদীর প্রতি বিবিধ দুর্বাক্য প্রয়োগ করিয়াছিল। বিশেষতঃ তাহাকে আয়ত্ত না করিলে আমাদিগের এই সসাগরা বসুন্ধরাভোগের কিছুমাত্র সম্ভাবনা ছিল না, এই নিমিত্ত আমি ঐরূপ কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছি। হে আৰ্য্যে! যৎকালে সেই দুরাচার সভামধ্যে আমাদিগের প্রতি যথোচিত কটুক্তি প্রয়োগ করিয়া দ্রৌপদীকে বাম উরু প্রদর্শন করিয়াছিল, আমরা তৎকালেই তাহাকে বিনাশ করিতাম, কেবল ধর্ম্মরাজের আদেশানুসারেই এত দিন সময় প্রতীক্ষা করিয়াছিলাম। হে আৰ্য্যে! রাজা দুর্য্যোধন এইরূপে ধর্ম্মরাজের অন্তঃকরণে বৈরানল সঙ্কুক্ষিত করিয়া আমাদিগকে অরণ্যে প্রেরণপূর্ব্বক বিস্তর ক্লেশ প্রদান করিয়াছে। আমি সেই নিমিত্তই ঐরূপ অধর্ম্ম কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছি। এক্ষণে দুৰ্য্যোধন বিনষ্ট হওয়াতে বৈরানল এককালে নিৰ্বাপিত হইয়া গিয়াছে। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির পুনরায় রাজ্য অধিকার করিয়াছেন এবং আমরাও রোষশূন্য হইয়াছি।”
তখন গান্ধারী বৃকোদরের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “ভীম! তুমি বৈরনির্য্যাতনমানসে দুৰ্য্যোধনকে অধর্ম্মানুসারে নিহত করিয়া প্রশংসার কাৰ্য্য কর নাই। আর বৃষসেন নকুলের অশ্ব বিনষ্ট করিলে তুমি যে দুঃশাসনের শোণিত পান করিয়াছিলে, তোমার সেই কার্য্যটি সাধুজনবিগর্হিত ক্রুর ও অনাৰ্য্য জনের সমুচিত হইয়াছে, সন্দেহ নাই।” তখন ভীমসেন কহিলেন, “আৰ্য্যে! আত্মীয়ের কথা দূরে থাকুক, অপরেরও রুধির পান করা অকৰ্ত্তব্য; বিশেষতঃ ভ্রাতা আত্মার তুল্য, সুতরাং দুঃশাসনের রুধিরপান আমার পক্ষে নিতান্ত অনুচিত, তাহাতে সন্দেহ কি? কিন্তু বস্তুতঃ আমি তাহার রুধিরপান করি নাই, দুঃশাসনের শোণিত আমার অধর-ওষ্ঠ অতিক্রম করিয়া উদরস্থ হয় নাই, কেবল তাহার শোণিতে আমার হস্তদ্বয় সংসিক্ত হইয়াছিল। এই বিষয় মহাবীর কর্ণ সম্যক অবগত ছিলেন। বৃষসেন নকুলের অশ্ব বিনাশ করিলে আপনার আত্মজগণ অতিশয় হৃষ্ট হইয়াছিল। আমি তৎকালে তাহাদিগের ত্রাসোৎপাদনের [ভয় জন্মাইবার] নিমিত্ত ঐরূপ অনুষ্ঠান করিয়াছিলাম। আর দেখুন, দ্রৌপদী দ্যূতে পরাজিত হইলে দুঃশাসন তাহার কেশাকর্ষণ করাতে আমি নিতান্ত রোষাবিষ্ট হইয়া তাহার রুধির পান করিব বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলাম। সেই প্রতিজ্ঞা অদ্যাপি আমার অন্তঃকরণে জাগরূক রহিয়াছে। যদি আমি সেই প্রতিজ্ঞা প্রতিপালন না করিতাম, তাহা হইলে আমাকে যাবজ্জীবন ক্ষত্রিয়ধর্ম্মপরিভ্রষ্ট হইয়া অবস্থান করিতে হইত। এই নিমিত্তই আমি ঐরূপ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছিলাম। এক্ষণে আপনি আমার প্রতি দোষারোপ করিবেন না। আপনার পুত্রগণ আমাদিগের নিকট বিলক্ষণ অপরাধী হইয়াছিল। পূর্বে তাহাদিগকে শাসন না করিয়া এক্ষণে আমাকে কি নিমিত্ত দোষী করিতেছেন?”
তখন গান্ধারী কহিলেন, “বৎস! তুমি আমাদিগের একশত পুত্রের মধ্যে যে তোমাদের নিকট অল্প অপরাধ করিয়াছিল, এমন একটিকেও কি নিমিত্ত অবশিষ্ট রাখিলে না? সেই পুত্রই এই অন্ধদ্বয়ের যষ্টিস্বরূপ হইত। এক্ষণে আমরা বৃদ্ধ ও অন্ধ হইয়াছি, আমাদিগের রাজ্যও অপহৃত হইয়াছে, এখন তুমিই আমাদিগের পুত্রস্বরূপ হইলে। যাহা হউক, যদি তুমি ধর্ম্মপথ অবলম্বন করিতে, তাহা হইলে আমার এরূপ দুঃখ উপস্থিত হইত না।”
যুধিষ্ঠিরের ক্ষমা প্রার্থনা
হে মহারাজ! পুত্রপৌত্রবধপীড়িতা [পুত্রপৌত্রমরণে দুঃখিতা] রাজমহিষী গান্ধারী এই বলিয়া ক্রোধান্বিতচিত্তে পুনরায় কহিলেন, “এক্ষণে ধর্ম্মরাজ কোথায়?” তখন ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির কৃতাঞ্জলিপুটে কম্পিত কলেবরে গান্ধাররাজতনয়ার সন্নিহিত হইয়া মধুরবাক্যে কহিলেন, “দেবি! আমি আপনার পুত্ৰহন্তা, অতি নৃশংস এবং আপনাদিগের রাজ্যনাশের একমাত্র হেতু; আপনি এক্ষণে আমাকে অভিশাপ প্রদান করুন। আমি আপনার শাপপ্রদানের উপযুক্ত পাত্র। আৰ্য্যে! আমি মিত্রদ্রোহী ও মূঢ়। আমি যখন তাদৃশ সুহৃদ্গণকে বিনষ্ট করিয়াছি, তখন আমার রাজ্য, জীবন ও ধনে আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই।” এই বলিয়া ধর্ম্মরাজ দেহ অবনত করিয়া গান্ধারীর চরণে নিপতিত হইবার উপক্রম করিলেন। তখন দূরদর্শিনী গান্ধারী যুধিষ্ঠিরের বাক্যশ্রবণে কিছুমাত্র প্রত্যুত্তর প্রদান না করিয়া দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক আবরণের মধ্য হইতে তাঁহার অঙ্গুলির অগ্রভাগ দর্শন করিলেন। তাঁহার দৃষ্টিপাত হইবামাত্র রাজা যুধিষ্ঠির কুনখী [নখে ক্ষতযুক্ত—পাপজ ব্যাধিযুক্ত] হইলেন। ঐ সময় অর্জুন সেই ব্যাপার প্রত্যক্ষ করিয়া বাসুদেবের পশ্চাদ্ভাগে গমন করিলেন এবং অন্যান্য পাণ্ডবগণ সকলেই ভীত হইয়া ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে লাগিলেন। তখন ধৃতরাষ্ট্রমহিষী গান্ধারী ক্রোধ সংবরণপূর্ব্বক জননীর ন্যায় তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা দান করিলেন।
যুধিষ্ঠিরাদির কুন্তীদর্শন দ্রৌপদী-বিলাপ
অনন্তর পাণ্ডবগণ গান্ধারীর অনুজ্ঞা গ্রহণপূর্ব্বক বীরপ্রসূতি জননী কুন্তীর নিকট গমন করিলেন। পুত্রবৎসলা কুন্তী বহুদিন তনয়গণের মুখচন্দ্র নিরীক্ষণ না করিয়া অতিশয় কাতর হইয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহাদিগকে দেখিয়া বসনে মুখ আচ্ছাদন পূর্ব্বক তাঁহাদিগের সহিত রোদন করিতে লাগিলেন এবং পুত্রগণকে অস্ত্রশস্ত্রে ক্ষতবিক্ষতকলেবর দেখিয়া তাঁহাদের প্রত্যেকের গাত্রে বারংবার করস্পর্শ করিয়া নিতান্ত দুঃখিত হইলেন। তৎপরে তিনি হতপুত্ৰা দ্রৌপদীকে ভূতলে নিপতিত ও অনর্গলনির্গলিত [অবিরাম পতিত] অশ্রুজলে অভিষিক্ত দেখিয়া বিস্তর অনুতাপ করিলেন।
তখন দ্রৌপদী কুন্তীকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “আৰ্য্যে! এক্ষণে অভিমন্যু ও আমার পুত্রেরা কোথায় গেল? তাহারা বহুদিনের পর এখনও আপনার সহিত সাক্ষাৎ করিবার নিমিত্ত আগমন করিতেছে না। আমি যখন পুত্রহীন হইয়াছি, তখন আর।আমার রাজ্যে প্রয়োজন কি?” তখন বিশাললোচনা [বিস্তৃতনেত্রা—প্রশস্তনয়না] কুন্তী যাজ্ঞসেনীকে ভূতল হইতে উত্থাপিত করিয়া পুত্রগণের সহিত আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন। ঐ সময় যশস্বিনী গান্ধাররাজতনয়া স্বীয় পুত্রবধূর সহিত তথায় আগমন করিয়া দ্রৌপদীকে কহিলেন, “বৎসে! তুমি আর দুঃখপ্রকাশ করিও না; দেখ, আমিও শোকদুঃখে একান্ত আকুল হইয়াছি; এক্ষণে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, এই লোকক্ষয় কালকৃত ও অবশ্যম্ভাবী। পূর্বে মহামতি বাসুদেব শান্তিস্থাপনের উদ্দেশ্যে আগমন করিয়া কৃতকাৰ্য্য না হওয়াতে মহাত্মা বিদুর যাহা কহিয়াছিলেন, তাহা সত্যই হইল; এক্ষণে এই দুর্নিবার বধব্যাপার অতিক্রান্ত হইয়াছে; অতএব এসময়ে আর শোকপ্রকাশের আবশ্যকতা নাই। যাহারা সংগ্রামে নিহত হইয়াছে, তাহাদের নিমিত্ত শোক করা অবিধেয়। আর দেখ, তুমি যেরূপ শোকে আকুল হইয়াছ, আমিও তদ্রূপ কাতর হইয়াছি; সুতরাং এক্ষণে কে আমাদিগকে আশ্বাসিত করিবে? বস্তুতঃ আমারই দোষে এই কুলক্ষয় হইল।”
জলদানিকপর্বাধ্যায় সমাপ্ত