১৫. গলায় আনন্দের কাঁপন

লীনা কিছুতেই, প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও, তার গলায় আনন্দের কাঁপনটিকে থামাতে পারল না। গাঢ় শ্বাস ফেলে বলল, কী হয়েছিল আপনার? কোনও অ্যাক্সিডেন্ট?

না, মিসেস ভট্টাচারিয়া। এ সিম্পল কেস অফ প্রহার।

কারা আপনাকে মারল, আর কেন?

পয়সা পেলে তারা সবাইকেই মারে। প্রফেশনাল ঠ্যাঙাড়ে। মারাঠি ভাষায় যাদের বলা হয় দাদা। দাদা মানে জানেন?

জানি, দাদা মানে গুন্ডা।

কলকাতাতেও দাদা আছে মিসেস ভট্টাচারিয়া। আপনি কোনও রিমোট জায়গায় কিছুদিনের জন্য পালিয়ে যান।

কেন, বলুন তো! পালানোর মতো কী হয়েছে?

ইউ আর ইন ডেঞ্জার, চাইল্ড।

ড্রপ দি চাইল্ড বিট। আমি কাউকে ভয় পাই না।

বোকা-সাহস দিয়ে কিছু হয় না মিসেস ভট্টাচারিয়া। ট্যাক্টফুল হতে হয়।

আপনি আমাকে বোকা ভেবে কি স্যাডিস্ট আনন্দ পান? জেনে রাখুন, আপনি আমার চেয়ে বেশি চালাক নন।

ববির দীর্ঘশ্বাস টেলিফোনে ভেসে এল। আরও স্তিমিত গলায় ববি বললেন, চালাকিতে আমি বরং আপনার চেয়ে কিছু খাটোই হব। কিন্তু আমার অ্যানিম্যাল ইন্সটিংক্ট খুব প্রবল। তাই মরতে মরতে আমি বার বার বেঁচে যাই। আপনার ওই ইটিংক্টটা নেই।

থাকার কথাও নয় মিস্টার বস।

আপনাদের অনেক কিছু নেই মিসেস ভট্টাচারিয়া। তাই আপনি অত্যন্ত ইজি টারগেট। ওরা যদি আপনাকে ক্রাশ করে তা হলে আমার কী আর ক্ষতিবৃদ্ধি বলুন! আমি চাইলেই আর একজন স্মার্ট এফিসিয়েন্ট সেক্রেটারি পেয়ে যাব। কিন্তু ক্ষতিটা হবে যদি আপনার কাছ থেকে ওরা এন এম-র হদিশটা পেয়ে যায়। তাই বলছি, কিছুদিনের জন্য গা-ঢাকা দিন।

এন এম? সেটা আবার কী?

আর একটু বুদ্ধি প্রয়োগ করুন, বুঝতে পারবেন। আপনি যে ব্রেনলেস এ কথা আমি বলছি না। গ্রে-ম্যাটার কিছু কম, এই যা। কিন্তু যেটুকু আছে সেটুকুও যদি অ্যাক্টিভেট করা যায় তা হলে একজন মোটামুটি বোকাকে দিয়েও কাজ চলতে পারে। আপনি যদি এই গ্রে-ম্যাটারগুলোকে…

ওঃ, ইউ আর হরিবল। এন এম মানে কি নীল মঞ্জিল? আমি আজই যে সেখানে যাচ্ছি!

ববি আবার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ভগবান করুন যেন কেউ আপনার টেলিফোনে ট্যাপ করে থাকে। দয়া করে এন এম-এর কথা ভুলে যান, ওর ত্রিসীমানায় আপনার যাওয়ার দরকার নেই।

কিন্তু কেন?

ইউ আর আন্ডার অবজারভেশন মাই ডিয়ার। স্ক্যাম কিড, স্ক্র্যাম।

একটু তিক্ত স্বাদ মুখে নিয়ে বসে রইল লীনা। হাতে বোবা টেলিফোন। ববি লাইন কেটে দিয়েছেন।

অনেকক্ষণ বাদে বিবশ হাতে টেলিফোনটা ক্র্যাডলে রাখল লীনা। তারপর সারা শরীরে এক গভীর অবসাদ নিয়ে উঠল। আজ একটু অ্যাডভেঞ্চার করার ইচ্ছে ছিল তার। নীল মঞ্জিল নামক

জায়গাটিকে আবিষ্কার করতে যাবে। ববি সেই প্রস্তাবে জল ঢেলে দিলেন।

জল ঢেলে দিলেন আরও অনেক কিছুর ওপর। ববি বেঁচে আছেন জেনে যে আবেগটা থরথরিয়ে উঠেছিল বুকের মধ্যে, লোকটা মার খেয়েছে শুনে যে করুণার উদ্রেক হয়েছিল, সবই ভেসে গেল সেই জলে।

মার খেয়েছে ঠিক হয়েছে। খাওয়াই উচিত ওরকম অসভ্য লোকের।

কথা ছিল আজ তার সঙ্গে দোলনও যাবে। ঠিক ন’টায় দোলন আসবে। তারপর একসঙ্গে বেরোনোর কথা।

প্রোগ্রামটা পালটাতে হবে। কিন্তু কোথায় যাবে তারা?

লীনা আর শুতে গেল না। দাঁত মাজল, ব্যায়াম করল, স্নান করল।

বেলা ন’টার একটু আগেই চোব-চোর মুখে ভয়ে ভয়ে ফটক পেরিয়ে দোলনকে ঢুকতে দেখল লীনা। সে তখন বারান্দায় দাঁড়িয়ে তেরছা হয়ে আসা কবোষ্ণ বোদ গায়ে শুষে নিচ্ছে। দোলনের হাবভাব দেখে হেসে ফেলল। গোবেচারা আর কাকে বলে!

এসো দোলন, ব্রেকফাস্ট খাওনি তো?

খেয়েছি।

বাঃ, আর আমি যে তোমার জন্যই বসে আছি না-খেয়ে! কী খেয়েছ?

ওঃ, সেসব মিডলক্লাস ব্রেকফাস্ট। আবার খাওয়া যায়।

বাঁচালে। শোনো, আজ আমাদের সেই প্রোগ্রামটা হচ্ছে না।

দোলনের মুখ হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হচ্ছে না! কেন বলো তো?

 

আমার বস বারণ করেছে।

বসটা কে? ববি তো পটল তুলেছেন।

মোটেই না। বেঁচে আছে।

বাঁচা গেল। কেউ মরেছে-টরেছে শুনলে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়।

ব্রেকফাস্ট টেবিলে মায়ের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল লীনার। দোকান খুলতে যাচ্ছেন বলে মা খুব ব্যস্ত। ঘন ঘন ঘড়ি দেখতে দেখতে প্রোটিন বিস্কুট আর ওটমিল খাচ্ছিলেন।

মা, এই যে দোলন!

কে বলো তো?

আমার বন্ধু।

ওঃ, দ্যাট চ্যাপ! বসুন আপনি। আজ তো সময় নেই, অন্যদিন ভাল করে আলাপ হবে।

এই বলে খাবার একরকম অর্ধসমাপ্ত রেখে মিসেস ভট্টাচার্য বেরিয়ে গেলেন।

দোলন সপ্রতিভ হয়ে বলল, আমাকে উনি তেমন পছন্দ করলেন না কিন্তু।

জানি। তোমার বেশি লোকের পছন্দসই হওয়ার দরকারও নেই। একজন পছন্দ করলেই যথেষ্ট।

সেও কি করে?

সন্দেহ হচ্ছে?

একটু সন্দেহ থেকেই যায় লীনা। তুমি কত বড় ঘরের মেয়ে।

আই হেট দিস সেট আপ। তাড়াতাড়ি খেয়ে নাও তো! চলল, বেরিয়ে পড়ি। আজ চমৎকার রোদ উঠেছে। চনচনে শীত। এরকম দিনে একদম নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে।

ব্রেকফাস্ট খেয়ে দু’জনেই উঠে পড়ল।

গাড়িটা নেবে লীনা?

নিশ্চয়ই। গাড়ি ছাড়া মজা কিসের? তবে অন্য গাড়ি। ফিয়াট। বাবা দিল্লি গেছে, বাবার গাড়িটাই নিচ্ছি।

গ্যারাজ থেকে গাড়িটা বের করে আনল লীনা। দোলন আর সে পাশাপাশি বসল। তারপর বেরিয়ে পড়ল।

তুমি কখনও বারুইপুর গেছ?

বহুবার। আমার এক পিসি থাকে যে।

চলো তা হলে পিসিকে টারগেট করি আজ।

চলো, বহুকাল পিসিকে দেখতে যাইনি। বারুইপুর দারুণ জায়গা।

দক্ষিণের দিকে গাড়ি ছেড়ে দিল লীনা। ক্রমে গড়িয়া-টড়িয়া পেরিয়ে গেল। রাস্তা ফাঁকা এবং চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্য চারধারে।

লীনা!

কী?

একটা গাড়ি অনেকক্ষণ ধরে ফলো করছে আমাদের। দেখেছ?

তো! ওই কালো গাড়িটা? মনে হচ্ছে পন্টিয়াক।

অনেকক্ষণ ধরে দেখছি।

দাঁড়াও, আমাদেরই ফলো করছে কি না একটু পরীক্ষা করে দেখি। সামনে একটা ডাইভারশন দেখা যাচ্ছে না?

ওটা কাঁচা রাস্তা। কোথায় গেছে ঠিক নেই।

তবু দেখা যাক। আমরা তো বেশি দূর যাব না। একটু গিয়েই ফিরে আসব।

বলতে বলতে লীনা গাড়িটাকে ডানধারের রাস্তায় নামিয়ে দিল। একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা নামল বটে, কিন্তু তারপরই খটাং একটা শব্দ হল পিছনে। হু-উস করে হাওয়া বেরিয়ে গেল ডানদিকের চাকা থেকে।

লীনা! কী হচ্ছে বলো তো!

সামওয়ান ইজ শুটিং অ্যাট আস।

তা হলে মাথা নামিয়ে বোসো। ওঃ বাবা, এরকম বিপদে জীবনে পড়িনি।

লীনা তার হ্যান্ডব্যাগটা খুলে পিস্তলটা বের করে নিয়ে বলল, সেভ ইয়োর লাইফ ইন ইয়োর ওন ওয়ে। আমি ওদের উচিত শিক্ষা দিয়ে তবে ছাড়ব।

লীনা এক ঝটকায় দরজাটা খুলে নেমে পড়ল। আজ তার পরনে স্নাক্স আর কামিজ, তাই চটপট নড়াচড়া করতে পারছিল সে। দরজাটা খোলা রেখে তার আড়ালে হাঁটু গেড়ে বসে সে পিস্তল তুলল।

মাত্র হাত দশেক দূরে পন্টিয়াকটা বড় রাস্তায় থেমে আছে। দু’জন লোক অত্যন্ত আমিরি চালে নেমে এল গাড়ি থেকে। পরনে দু’জনেরই গাঢ় রঙের প্যান্ট আর ফুলহাতা সোয়েটার। দু’জনেই নিরস্ত্র।

লীনা তীব্র স্বরে বলল, আই অ্যাম গোয়িং টু শুট ইউ রাসক্যালস।

দুজনেই ওপরে হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গি করে বলল, ডোন্ট শুট প্লিজ। উই ওয়ান্ট টু টক।

একজনকে চিনতে পারল লীনা। সেই সাদা পোশাকের পুলিশ।

কী চান আপনারা?

আমরা শুধু আপনার পিস্তলটা বাজেয়াপ্ত করতে চাই। আর কিছু নয়।

সেটা সম্ভব নয়। আর এগোলে আমি গুলি চালাব।

মিস ভট্টাচার্য, আপনি গুলি চালাবেন না। পুলিশকে গুলি করা সাংঘাতিক অপরাধ।

আপনারা পুলিশ নন। ইমপস্টার।

আমরা যথার্থই পুলিশ। আই ডি-র লোক।

তার প্রমাণ কী?

আমাদের আইডেনটিটি কার্ড দেখবেন?

ওখান থেকে ছুড়ে দিন। কাছে আসবেন না।

একজন পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে লীনার দিকে ছুড়ে দিল।

রোদে একটা ঝকঝকে বিভ্রম তুলে কার্ডটা ছুটে এল লীনার দিকে। তারপর লীনা কিছু বুঝে উঠবার আগেই একটা পটকা ফাটবার মতো আওয়াজ হল। সামান্য একটু ধোঁয়া এবং অদ্ভুত গন্ধ।

লীনা কেমন যেন কাঠের মতো শক্ত হয়ে গেল। নড়তে পারল না।

পরমুহূর্তেই দু’টি লোক কাছে এসে দাঁড়াল তার। একজন পিস্তল কুড়িয়ে নিল মাটি থেকে। অন্যজন ভারী মায়াভরে লীনাকে পরে দাড় করাল।

যে পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়েছিল সে গাড়ির মধ্যে মুখ বাড়িয়ে দোলনের দিকে তাকাল।

দোলনের অবস্থা সত্যিই লজ্জাজনক। সে ফিয়াটের সামনের সিটের স্বল্প পরিসর ফাঁকের মধ্যে উবু হয়ে বসে অসহায়ভাবে চেয়ে আছে।

বেরিয়ে আসুন।

দোলন কাতরস্বরে বলল, আমি তো কিছু করিনি।

লোকটি খুব মোলায়েম গলায় বলল, না। আপনি কিছুই করেননি। সেইজন্য আপনাকে আমরা ধরছিও না। বেরিয়ে আসুন।

দোলন বেরিয়ে এল।

লোকটা দোলনের কাঁধে একটা হাত রাখল। মৃদু হেসে বলল, এ ব্রেভ ম্যান, কোয়াইট এ ব্লেড ম্যান।

তারপরই লোকটার ডান হাত দোলনের নাকের কাছে একটা চমৎকার জ্যাব মারল। নক-আউট জ্যাব। মুষ্টিযোদ্ধারাও যা সামাল দিতে পারে না দোলন তা কী করে সামলাবে?

সামনের সিটেই পড়ে গেল দোলন। চিৎপাত হয়ে।

লোকটা দরজাটা বন্ধ করে দিল। কাছাকাছি লোকজন বিশেষ নেই। যারা আছে তারা বেশ দূরে।

দু’জন লোক লীনাকে একরকম বহন করে নিয়ে এল পন্টিয়াকে। গাড়িটা এর মধ্যে কলকাতার দিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা উঠতেই তীব্র গতিতে ছুটতে শুরু করল।

গোটা ব্যাপারটা ঘটে যেতে ছ’-সাত মিনিটের বেশি লাগেনি।

বেশিক্ষণ নয়, মিনিট দশেক বাদেই লীনার চেতনা সম্পূর্ণ ফিরে এল। সে দেখল প্রকাণ্ড গাড়ির পেছনের সিটে অস্বস্তিকর রকমের নরম ও গভীর গদিতে সে বসে আছে। দু’পাশে দু’জন শক্ত সমর্থ পুরুষ।

লীনা হঠাৎ একটা ঝটকা মেরে উঠে পড়ার চেষ্টা করল, বাঁচাও! বাঁচাও!

দু’জন লোক পাথরের মতো বসে রইল দু’পাশে। বাধা দিল না।

কিন্তু লীনা কিছু করতেও পারল না। তার কোমর একটা সিট বেল্ট-এ আটকানো।

আপনারা কী চান?

সেই সাদা পোশাকের ছদ্ম-পুলিশ বলল, আমরা নীল মঞ্জিল যেতে চাই মিস ভট্টাচার্য। আপনি পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন। আজ আপনার সেখানেই যাওয়ার কথা ছিল।

আমি ও-নাম জন্মেও শুনিনি।

শুনেছেন মিস ভট্টাচার্য। আজ সকালে ববি রায়ের সঙ্গে আপনার টেলিফোনে যেসব কথা হয়েছে তা টেপ করা আছে আমাদের কাছে।

আপনারা আমার টেলিফোন ট্যাপ করেছিলেন?

না করে উপায় কী? ববি রায়কে আমরা বাগে আনতে পারিনি বটে, কিন্তু আমাদের সেখানে যেতেই হবে।

আমি পথ চিনি না।

মিস ভট্টাচার্য, মেয়েদের নানারকম অসুবিধে আছে। আপনি নিশ্চয়ই বিপদে পড়তে চান না।

আমি আপনাদের ভয় পাই না। আমি চেঁচাব।

লাভ নেই। এ গাড়ি সাউন্ডপ্রুফ। বাইরে থেকে ওয়ান-ওয়ে গ্লাস দিয়ে গাড়ির ভিতরে কিছু দেখাও যায় না। আপনি বুদ্ধিমতী, কেন চেঁচিয়ে শক্তিক্ষয় করবেন?

আপনি পুলিশ নন।

না হলেই বা। আপনার কী যায় আসে? ববি রায়ের সিক্রেট নিয়ে আপনি কেন মাথা ঘামাচ্ছেন? দোলন! দোলনের কী হল?

কিছু হয়নি। চিন্তা করবেন না। তবে বলে রাখি ও লোকটা কিন্তু আপনার বিপদে বাঁচাতে আসেনি।

লীনা এত বিপদের মধ্যেও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, পুরুষরা সবাই সমান।