১৫শ অধ্যায়
কৌরবপক্ষীয় চিত্র-চিত্রসেনাদি নিধন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর শ্রুতকর্ম্মা কোপাবিষ্ট হইয়া পঞ্চাশৎশরে মহীপতি চিত্রসেনকে আহত করিলেন। তখন অভিসারাধিপতি চিত্রসেন নতপর্ব্বনয়বাণে শ্রতকর্ম্মাকে নিপীড়িত ও পাঁচবাণে তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিয়া বীরত্ব প্রকাশ করিতে লাগিলেন। মহাবীর শ্রুতকর্ম্মা তদ্দর্শনে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া নিশিত নারাচাস্ত্রদ্বারা সেনাগ্রবর্তী চিত্রসেনের মর্ম্ম ভেদ করিলেন। মহাবীর চিত্রসেন শ্রুতকর্ম্মার হস্তনিক্ষিপ্ত নারাচাস্ত্রে অতিমাত্র বিদ্ধ হইয়া বিচেতন ও মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলেন। ঐ সময় মহাযশস্বী শ্রুতকীৰ্ত্তি নবতিশরে শ্রুতকর্ম্মাকে সমাচ্ছন্ন করিলেন। অনন্তর মহারথ চিত্রসেন সংজ্ঞালাভ করিয়া ভল্লদ্বারা শ্রুতকর্ম্মার শরাসন ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাকে সাতবাণে বিদ্ধ করিলেন। তখন শ্রুতকর্ম্মা সুবর্ণভূষণ অন্য কার্ম্মুক গ্রহণ করিয়া শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক চিত্রসেনের বিচিত্র রূপ বিনষ্ট করিয়া দিলেন। চিত্রমালাধর যুবা চিত্রসেনভূপতি শ্রুতকর্ম্মার শরে সমাহত হইয়া গোষ্ঠমধ্যস্থ মহাবৃষভের ন্যায় শোভমান হইলেন। তখন তিনি ‘থাক থাক’ বলিয়া নারাচদ্বারা শ্রুতকর্ম্মার বক্ষঃস্থল বিদারণ করিলেন। শ্রুতকর্ম্মা চিত্রসেন-নিক্ষিপ্ত নারাচের আঘাতে গৈরিকবর্ণ রুধিরক্ষরণ করিয়া শোণিতাক্তকলেবর হইয়া গৈরিক ধাতুধারাস্রাবী অচলের ন্যায়, কুসুমিত কিংশুকবৃক্ষের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। অনন্তর তিনি চিত্রসেনের শত্রুবারণ শরাসন ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাকে ত্রিশতনারাচে সমাচ্ছন্ন ও শরনিকরে নিপীড়িত করিয়া এক সুশাণিত ভল্লদ্বারা তাঁহার শিরস্ত্রাণ সুশোভিত মস্তক ছেদন করিলেন। চিত্রসেনের মস্তক গগনমণ্ডল হইতে যদৃচ্ছাক্রমে ভূতলে নিপতিত চন্দ্রমার ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইল। সৈনিকগণ তাঁহাকে নিহত দেখিয়া মহাবেগে ইতস্ততঃ ধাবমান হইল। অনন্তর মহাধনুর্দ্ধর শ্রুতকর্ম্মা ক্রোধাবিষ্ট প্রেতরাজ যেমন প্রলয়কালে ভূতগণকে সংহার করেন, তদ্রূপ রোষাবিষ্ট হইয়া শরনিকরনিপাতে সৈন্যগণকে বিভ্রাবিত করিতে আরম্ভ করিলে সৈন্যগণ একান্ত নিপীড়িত হইয়া দাবানলদগ্ধ গজযূথের ন্যায় চারিদিকে ধাবমান হইল। মহাবীর শ্রুতকর্ম্মা তাহাদিগকে শত্ৰুপরাজয়ে নিরুৎসাহ দেখিয়া তাহাদের উপর অনবরত সুশাণিত শরনিকর নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।
“ঐ সময় মহাবীর প্রতিবিন্ধ্য চিত্রকে পাঁচবাণে বিদ্ধ করিয়া একবাণে তাঁহার ধ্বজ ও তিনবাণে সারথিকে বিদ্ধ করিলে মহাবাহু চিত্র প্রতিবিন্ধ্যের বাহু ও ঊরুদেশে কঙ্কপত্রবিরাজিত, শাণিতাগ্র, সুবৰ্ণপুঙ্খ নয় ভল্ল নিক্ষেপ করিলেন। তখন মহাবীর প্রতিবিন্ধ্য শরনিপাতে চিত্রের শাসন ছেদন করিয়া তাঁহার প্রতি নিশিত পাঁচ শর প্রয়োগ করিলেন। বীরবর চিত্র প্রতিবিন্ধ্যের শরাঘাতে ক্রুদ্ধ হইয়া স্বর্ণঘণ্টাসমাযুক্ত অগ্নিশিখাসদৃশ এক ভীষণ শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর প্রতিবিন্ধ্য সেই মহোল্কাসন্নিভ শক্তি সমাগত সন্দর্শন করিয়া অবলীলাক্রমে ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন সেই চিত্রবিক্ষিপ্ত বিচিত্র শক্তি প্রতিবিন্ধ্যশরে দ্বিধা ছিন্ন হইয়া যুগান্তকালীন সর্ব্বভূতত্রাসজনক অশনির ন্যায় ভূতলে নিপতিত হইল। মহাবীর চিত্র আপনার শক্তি ব্যর্থ নিরীক্ষণ করিয়া সুবর্ণজালজড়িত এক মহাগদা গ্রহণপূর্ব্বক প্রতিবিন্ধ্যের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। গদা নিক্ষিপ্ত হইবামাত্র প্রতিবিন্ধ্যের অশ্ব, সারথি ও রথ চুর্ণ করিয়া ধরাতলে নিপতিত হইল। ইত্যবসরে মহাবীর প্রতিবিন্ধ্য রথ হইতে লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক অবনীতলে অবতীর্ণ হইয়া চিত্রের উপর এক কনকবিভূষিত শক্তি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবাহু চিত্র সহসা সেই শক্তি গ্রহণপূর্ব্বক প্রতিবিন্ধ্যের প্রতি নিক্ষেপ করিলে শক্তি তাঁহার দক্ষিণবাহু বিদারণপূর্ব্বক অশনির ন্যায় সমরাঙ্গন উদ্ভাসিত করিয়া নিপতিত হইল। তখন মহাবীর প্রতিবিন্ধ্য ক্রোধাবিষ্টচিত্তে এক সুবর্ণভূষিত তোমর গ্রহণপূর্ব্বক চিত্রের বিনাশবাসনায় তাঁহার প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। তোমর চিত্রের বর্ম্ম ও হৃদয় বিদীর্ণ করিয়া বিল প্রবেশোদ্যত ভীষণ ভুজঙ্গের ন্যায় মহাবেগে ধরাতলে নিপতিত হইল। মহারাজ চিত্র প্রতিবিন্ধ্যের তোমরে সমাহত হইয়া পরিঘাকার পীন[সর্পের]বাহুযুগল প্রসারণপূর্ব্বক রণশয্যায় শয়ান হইলেন। কৌরবসৈন্যগণ চিত্ররাজকে নিহত নিরীক্ষণ করিয়া দ্রুতবেগে প্রতিবিন্ধ্যের প্রতি ধাবমান হইয়া কিঙ্কিণীসমাযুক্ত শতঘ্নী ও বিবিধ বাণ বিসর্জনপূর্ব্বক মেঘ যেমন সূৰ্য্যকে সমাচ্ছন্ন করে, তদ্রূপ তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। তখন মহাবাহু প্রতিবিন্ধ্য অসুরসৈন্য-নিসূদন বজ্রধরের ন্যায় সেই সৈন্যগণকে শরনিকরনিপাতে নিপীড়িত ও বিদ্রাবিত করিতে আরম্ভ করিলেন। সৈন্যগণ প্রতিবিন্ধ্যশরে বিদ্ধ হইয়া বায়ুবেগ-সঞ্চালিত ঘনঘটার ন্যায় ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িল। হে মহারাজ! এইরূপে কৌরবগণ চারিদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিলে অশ্বত্থামা একাকী অবিলম্বে মহাবলপরাক্রান্ত ভীমসেন অভিমুখে গমন করিলেন। তখন দেবাসুরসংগ্রাম-সময় বৃত্তসুর ও পুরন্দরের যেরূপ সংগ্রাম হইয়াছিল, তদ্রূপ সেই বীরদ্বয়ের ঘোরতর যুদ্ধ উপস্থিত হইল।”