কিরীটী পাতার পর পাতা পড়ে চলে ডাইরীর।
বাবা আর আমার বিয়ের কথা বলেননি। বলবেনও না জানি। বুঝি বাবা জানতে চান কোথায় আমার মন বাঁধা পড়েছে। কিন্তু কি বলবো তাকে? যাকে মন দিলাম তারই যে সাড়া নেই!
আজ হঠাৎ সুহাসের সঙ্গে দেখা হয়েছিল—কলেজ স্ট্রীটের একটা বইয়ের দোকানে। ও আমাকে দেখতে পায়নি—আমিই ওকে দেখতে পেয়ে ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ডাকলাম, সুহাস!
চমকে ও ফিরে তাকাল, মিত্রানী—
হ্যাঁ—চিনতে পেরেছো তাহলে!
চিনতে পারবো না হঠাৎ একথা তোমার মনে হলো কেন মিত্রানী? সুহাস বললে।
মিত্রানীকে মনে আছে আজো তোমার?
প্রত্যুত্তরে মৃদু হাসলো সুহাস। কোন কথা বললো না।
বই কেনা হলো?
না।
কেন?
টাকা নেই।
আমার কাছে আছে নাও না, দেবো?
না। ধন্যবাদ।
নিতে বাধা আছে বুঝি?
তা নয়–
তবে?
পাওয়াটা যেখানে সুনিশ্চিত, সেখানে হাত বাড়ানোর মধ্যে যে কতখানি লজ্জা–থাক, সে তুমি বুঝবে না।
তা তুমি এখানে এসেছিলে কোন নতুন বই কিনতে বুঝি?
হ্যাঁ—এসেছিলাম কিন্তু বইটা আসেনি এখনো।
দুজনে একসঙ্গে দোকান থেকে বের হয়ে এলাম। পাশাপাশি হেঁটে চলেছি—সন্ধ্যা হয়ে গেলেও ঐখানে তখনো বেশ ভিড়।
কফি খাবে সুহাস?
মন্দ কি, চলো।
দুজনে গিয়ে কফি হাউসে ঢুকলাম।
কতদিন পরে আবার কফি হাউসে এলাম।
কফি হাউসটা তখন গমগম করছে। এক কোণে কয়েকজন কলেজেরই ছাত্রছাত্রী মনে হলো, একটা টেবিলে বসে জোর গলায় তর্কাতর্কি করছে। কোনমতে একটা নিরিবিলি টেবিলে গিয়ে দুজনে মুখোমুখি বসলাম। কফির অর্ডার দিলাম।
বললাম, বেশ ছিলাম কলেজ-জীবনে, তাই না!
সুহাস হাসলো নিঃশব্দে।
বরাবরই ও কথা কম বলতো—আজ যেন মনে হলো আরো গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। কফি খেতে খেতে একসময় বললাম, আচ্ছা সুহাস, তুমি কোন কমপিটিটিভ পরীক্ষা দিলে না কেন?
দিলেও হতো না।
সজল পাস করলো, আর তুমি পারতে না?
সকলের দ্বারা তো সব কিছু হয় না মিত্রানী। যা হয়েছে তাতেই আমি খুশি। কি জানো মিত্রানী, যোগ্যতার বাইরে কখনো লোভের হাত প্রসারিত করতে হয় না। এতে করে কেবল দুঃখই বাড়ে—ওসব কথা থাক—অনেকদিন পরে তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে সত্যি খুব ভাল লাগছে
সত্যি বলছো?
বাঃ, মিথ্যা বলবো কেন।
তা ইচ্ছে করলেই তো মধ্যে মধ্যে আমাদের দেখাসাক্ষাৎ হতে পারে—
কি হবে—তার চাইতে আজকের মত হঠাৎ দেখা হয়ে যায় যদি সেই ভাল। আকস্মিকতার যে আনন্দ আছে, নিত্যনৈমিত্তিকতার মধ্যে তা থাকে না।
সামনে শুক্রবার আমার জন্মদিন—প্রতি বছরই তোমাকে নিমন্ত্রণ করি, তুমি আসনি আজ পর্যন্ত—শুক্রবার আসবে?
গেলে তুমি খুশি হবে?
খুশির আমার অন্ত থাকবে না।
বেশ যাবো।
সত্যি বলছ?
হ্যাঁ, যাবে।
আজ শুক্রবার আমার জন্মদিন ছিল।
সজল আর সুহাস বাদে সবাই এসে হৈ-হৈ করে চলে গেল। সজল আসতে পারবে। জানি, সে দিল্লীতে ট্রেনিং-এ আছে–কিন্তু সুহাস কেন কথা দিয়েও কথা রাখলো না!
শেষ পর্যন্ত রাত নটা নাগাদ সুহাস এলো–হাতে একগোছা রজনীগন্ধা।
এতক্ষণে সময় হলো?
কি করি বললা, টিউশনী সেরে আসতে হলো। রাগ করেছো?
না। আজকের দিনটি টিউশনী না হয় নাই করতে।
ছেলেটার ক্ষতি হতো—সামনে তার ফাইনাল পরীক্ষা।
সুহাসকে প্লেট ভরে খাবার দিলাম—সব সে খেল। যাবার সময় আমার হাতে একটা মুখবন্ধ খাম দিয়ে বললে, পরে পড়ো।
বুকটার মধ্যে সে আমার কি ধুকপুকুনি। সুহাস চলে যাবার পর কম্পিত হাতে খামটা খুললাম। এক টুকরো সাদা কাগজে লেখা–রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতার কয়েকটি লাইন :
স্বপন-পারের ডাক শুনেছি, জেগে তাই তো ভাবি
কেউ কখনো খুঁজে কি পায় স্বপ্নলোকের চাবি।।
নয়তো সেথায় যাবার তরে নয় কিছু তো পাবার তরে,
নাই কিছু তার দাবি–
বিশ্ব হতে হারিয়ে গেছে স্বপ্নলোকের চাবি।।
গানটা আমার জানা। গুনগুনিয়ে উঠল যেন সুর আর কথাগুলো আমার বুকের মধ্যে।
চাওয়া-পাওয়ার বুকের ভিতর না-পাওয়া ফুল ফোটে,
দিশেহারা গন্ধে তারি আকাশ ভরে ওঠে।
রাত্রি বারোটা–আমার জন্মদিন। ঘুম কেন আসছে না চোখে–সুহাস-সুহাস–