পরের দিন রাত্রে।
রাত তখন বারোটা বেজে গিয়েছে।
সমস্ত ইন্দ্ৰালয় যেন একেবারে নিস্তব্ধ নিঝুম হয়ে গিয়েছে। কিরীটী আলো জ্বেলেই শুয়ে ছিল শয্যার ওপর চোখ বুজে। ঘুমোয়নি। ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতে দেখে শয্যা হতে উঠে পড়ল।
প্রস্তুত হয়েই ছিল সে। উঠে প্রথমেই ঘরের আলোর সুইচটা টিপে নিভিয়ে দিল। ঘর অন্ধকার হয়ে গেল।
বাইরের বাগানে ঝি ঝি ডাকছে। একটানা বিবির শব্দ নিযুতি রাতের কান্নার মতই যেন মনে হয়।
অন্ধকারেই কিরীটী তার শয়নঘরের মধ্যস্থিত গুপ্ত দরজা খুলে—যে দরজাপথে জয়ন্ত তাকে প্রথম রাতে গোপনে অন্য একটা সিঁড়ি দিয়ে চিত্রাঙ্গদা দেবীর বসবার ঘরে নিয়ে গিয়েছিল, সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে যায়।
চিত্রাঙ্গদা দেবীর বসবার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াল কিরীটী।
দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। কিরীটী বন্ধ দরজাটার গায়ে টুক টুক টুক করে পর পর তিনটি মৃদু টোকা দিল। ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল।
ঘর অন্ধকার।
কিরীটী চট করে ঘরের দরজা খুলতেই ভেতর ঢুকে যায়।
কে?
কিরীটি সে-কথার কোন জবাব না দিয়ে এগিয়ে হাত বাড়িয়ে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল।
সামনেই দাঁড়িয়ে সুরতিয়া।
বাবুজী আপ?
হ্যাঁ সুরতিয়া, তোমার সঙ্গে আমার কয়েকটা কথা আছে।
কেয়া আপ পুঝনে চাহতে হে বাবুজী মুঝসে?
কিরীটী সুরতিয়ার মুখের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কয়েক মুহূর্ত, তারপর তার জামার পকেট থেকে সেদিন চিত্রাঙ্গদা দেবীর শয়নঘরের মেঝেতে কুড়িয়ে পাওয়া ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরোটা বের করে সামনে মেলে ধরে বলে, দেখ তো সুরতিয়া, এটা কি।
সুরতিয়া একটু যেন অবাক হয়ে কিরীটীর হাতের পাতায় ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরোটার দিকে তালিয়ে পালটা প্রশ্ন করে, কেয়া!
বুঝতে পারছ না?
মালুম হোতা হ্যায় চুড়িয়া কি টুকরা!
ঠিক। কিন্তু কোথায় পেয়েছি জান এটা?
কোথায় বাবুজী?
সে-রাত্রে রাণীমার ঘরের মেঝেতে। রাণীমার হাতে তো কাচের চুড়ি ছিল না। আর তোমার দিদিমণির হাতেও নেই—আছে দেখছি তোমার হাতে।
কেয়া মতলব?
বুঝতে পারছি না। সুরতিয়া?
নেহি তা!
এটা তোমারই হাতের একটা ভাঙা চুড়ির টুকরো।
আমার?
হ্যাঁ যেটা সে-রাত্রে ভেঙে ঘরের মধ্যে পড়েছিল হয়তো।
আমার চুড়ি-ভাঙা!
হ্যাঁ, তোমারই। আর এটা কখন ভেঙেছিল জান?
কখন?
সে-রাত্রে-গণেশকে ডেকে দেবার পর, গণেশ তোমার রাণীমার ঘরে ঢুকে জয়ন্তবাবুকে ডাকতে বের হয়ে যাবার পর। এখন বল সে-রাত্রে রাণীমার নির্দেশে গণেশকে ডেকে দেবার পর তুমি কোথায় গিয়েছিলো।
কেন, নীচে বাগানে যেখানে গানবাজনা হচ্ছিল–
না।
বিশোয়াস কিজিয়ে বাবুজী–
নেহি, তুম ঝুট কহোঁতে হো।
ঝুট!
হ্যাঁ বুট—সাচ্ সাচ্ বাতাও।
লেকেন বাবুজী–
সাচ্ বাত ছুপানেসে কুছ ফায়দা নেহি হোগা—বাতাও—
সুরতিয়া বোবাদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী বলে চলে, গণেশকে ডেকে দিয়ে সোজা তুমি বাগানে যাওনি সে-রাত্রে। কোথায় গিয়েছিলে বল?
সুরতিয়া চুপ।
আমার ধারণা যদি মিথ্যে না হয় তো সে-রাত্ৰে তুমি নীচে আমার ঘরে ঢুকে যে পথ দিয়ে এইমাত্র আমি এসেছি, সে পথ দিয়ে গোপনে ওপরে উঠে আসো—, তারপর বল তুমি কি করেছ?
আপনার কথা কিছুই আমি বুঝতে পারছি না বাবুজী। আমি কেন আবার ওপরে আসব?
এসেছিলে তোমার কাজে এবং তার প্রমাণও আছে।
লোকেন। কিউ?–
কিউ? হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে, সুধন্য কে?
সুধন্য!
বল সে কে?
ওকে আমি চিনি না।
চেন।
নেহি!
আমি তাহলে বলি সুধন্য তোমার কে, তোমার ছেলে।
বাবুজী!
হ্যাঁ-রাজাবাবুর ঔরসে তোমার গর্ভে ওর জন্ম।
না, না–
আর্ত চিৎকার করে ওঠে সুরতিয়া।
হ্যাঁ, তোমার ছেলে। আর সেকথা তোমার রাণীমাও জানতেন বলেই নিজের স্বামীর লজ্জাকে ঢাকবার জন্য-নিজের আভিজাত্যকে বাঁচানোর জন্য তোমার এবং পাছে তুমি সব কথা প্রকাশ করে দাও, সেই ভয়ে সুধন্যকে থেকে থেকে টাকা দিয়ে এসেছেন বারবার। কেমন, তাই নয় কি!
সুরতিয়া একেবারে নিশ্চুপ।
সুধন্য তোমার ছেলে অবিশ্যি সে কথাটা এখনো জানে না। কিন্তু তোমার ব্ল্যাকমেলিং ক্রমশঃ যখন দিনের পর দিন বেড়েই চলতে লাগল, তখন তিনি আক্রোশের মাথায় বলে বসেন উইল তিনি বদল করবেন—যে উইলে সুধন্যরও একটা মোটা শেয়ারের ব্যবস্থা ছিল তার সম্পত্তির–
কিরীটীর কথা শেষ হল না—একে একে ওই সময় ঘরে এসে ঢুকল জগদীন্দ্র, মণীন্দ্ৰ, ফণীন্দ্র, শচীন্দ্র, স্বাতী, যোগেনবাবু, চৌবেজী ও সবশেষে জয়ন্ত।
এই যে আসুন আপনারা।
হঠাৎ জয়ন্তকে ঘরে ঢুকতে দেখে যেন একটা ক্রুদ্ধ বাঘিনীর মতই কোমর থেকে ধারালো একটা ছোরা বের করে জয়ন্তর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ল সুরতিয়া।
বেইমান।
সকলে মিলে সুরতিয়াকে ধরে ফেলবার আগেই ছোরাটা জয়ন্তর হাতে বিঁধে গিয়েছিল তবে বেশী আঘাত লাগেনি।
চৌবেজী ও মণীন্দ্র দুজনে সুরতিয়াকে দু হাতে শক্ত করে ধরে ফেলেন।
সুরতিয়া তখনো ক্ষিপ্ৰ বাঘিনীর মত চেঁচাচ্ছে, ছোড় দো—ছোড় দো মুঝে-ও বেইমানকে হাম খতম কর দুঙ্গি।
চৌবেজীর ইঙ্গিতে দুজন পুলিস এসে ধরে সুরতিয়াকে।
কিরীটী বলে, বলেছিলাম চৌবেজী, আততায়ীকে আজ ধরিয়ে দেব। হাতকড়া লাগান, সে-রত্রে সুরতিয়াই চিত্রাঙ্গদা দেবীকে হত্যা করেছিল আর ঐ ছোরাটা দিয়েই।