আঙ্গিক ও ভাষা
অথর্ববেদের ব্যাকরণ ও শব্দভাণ্ডার থেকে এর তুলনামূলক অর্বাচীনত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। প্রাচীনতর উদীচ্য বা মধ্যদেশীয় ভাষার ‘অশ্রীর’ বা ‘অশ্লীল” অথর্ববেদে ‘অশ্লীল’ রূপে রয়েছে; এতে মনে হয় যে, আর্যরা ইতোমধ্যে মগধের উপভাষার সংস্পর্শে এসেছে, ‘র’ এর পরিবর্তে ল’-এর প্রয়োগ যার সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।
পরিমাণগতভাবে অথর্ববেদে সাংকেতিক বৈশিষ্ট্যযুক্ত রচনা অনেক বেশি। সাধারণভাবে সুলভ ধ্রুবপদগুলি ছাড়াও বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ক্রমে লব্ধ পঙক্তি ও অর্ধপঙক্তিসমূহের যান্ত্রিক পুনরাবৃত্তি আমরা লক্ষ্য করি। প্রচলিত অর্থে এইগুলি অবশ্য ধ্রুবপদ নয়, কিংবা অসংখ্য পুনরাবৃত্তিকে তাদের স্মৃতিসহায়ক প্রয়োগের দ্বারা ব্যাখ্যাও করা যায় না। বস্তুত, কেবলমাত্র ঐন্দ্ৰজালিক তাৎপর্যের সাহায্যেই অন্যান্য সংহিতার তুলনায় অথর্ববেদে এগুলির অধিকতর মাত্রায় ব্যবহারের ব্যাখ্যা করা চলে। তেমনি একই ব্যাখ্যা ভাষা প্রকরণের যান্ত্রিক প্রয়োগের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য-যেমন আবেগের সাংগীতিক উচ্চােবচতা অনুযায়ী আরোহী-অবরোহী ক্ৰমে শব্দবিন্যাস কিংবা তুলনামূলক উৎকর্ষ বা শ্রেষ্ঠত্ববাচক শব্দ প্রয়োগ অথবা বিভিন্ন অর্থালঙ্কার ও শব্দালঙ্কারের ব্যবহার ইত্যাদি ইন্দ্ৰজালের উপযুক্ত মোহময় পরিবেশ সৃষ্টিতে সাহায্য করে।
অথর্ববেদের শব্দভাণ্ডারেও যথেষ্ট অভিনবত্ব লক্ষ্য করা যায়। অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় শব্দ ছাড়াও বিদেশী প্রভাবের নিদর্শন রয়েছে মধ্যপ্ৰাচ্য থেকে আসা কিছু শব্দের প্রয়োগে, যেমন তৈমত, উরুগুল ও আলিগি-বিলিগি (এই বিলিগি শব্দের সম্ভাব্য উৎস প্রাচীন আসীরীয় দেবনাম—বিল্গি)। নৌবাণিজ্যের মাধ্যমে ভারতবর্ষের সঙ্গে সেসব দেশের যে সম্পর্ক খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দে স্থাপিত হয়েছিল,—সে সম্পর্কে অন্তত আট শতাব্দীর কিছু বেশি সময় পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে অথর্ব বেদ অবশ্য সামগ্রিকভাবে ঋগ্বেদের তুলনায় পরবর্তী সময়স্তরের প্রমাণ বহন করে। রচনাশৈলীতে ঋগ্বেদের তুলনায় একই সঙ্গে প্রাচীনতর ও নবীনতর উপাদান বহন করলেও অথর্ববেদের কিছু কিছু নিজস্ব চরিত্রবৈশিষ্ট্যও রয়েছে। এ গদ্য নিশ্চিতভাবেই স্বরপ্রবাহ যুক্ত, ফলে পদ্যের নিকটবর্তী। আবার, এ পদের গঠনভঙ্গি প্রচলিত ছন্দোরীতির তুলনায় জটিলতর। অধিকতর জনপ্রিয় ও স্বল্পপরিশীলিত ছন্দপ্রকরণের প্রভাবেই সম্ভবত পদ্যের গড়ন এরকম হয়েছিল। জনপ্রিয় স্মৃতিসহায়ক কাব্যরীতির সাধারণ বৈশিষ্ট্যরূপে অনুপ্রাসের প্রয়োগ বারবার ঘটেছে, যেহেতু ঐন্দ্ৰজালিক প্রতিক্রিয়ার পক্ষে তা কার্যকরী। ঐন্দ্ৰজালিক সাংকেতিকতার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যরূপে পরিগণিত নানাবিধ বাকপ্রকরণের প্রয়োগ অথর্ববেদে লক্ষণীয়; শ্রোতাদের কাছে স্পষ্টভাবে বিষয়বস্তুকে প্রকাশের পরিবর্তে প্রকৃতপক্ষে এইগুলি ঐন্দ্ৰজালিক যথার্থ উদ্দেশ্যটিকে গোপনই করেছে। ভাষা। এখানে ছায়াছন্ন অন্ধকারে প্রবেশ করে। রহস্য-গৃঢ় প্ৰহেলিকা হয়ে উঠেছে, যা শুধুমাত্র গ্রামীণ জাদুপুরোহিত বা শামান এবং প্রকৃতির কল্পিত অধিষ্ঠাতা উপদেবতার নিকটই বোধগম্য বলে মানুষ মনে করত।
অথর্ববেদে এমন কিছু ভাষাগত ও রচনাশৈলীগত বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ঋগ্বেদে পাওয়া যায় না, যদিও সামবেদের স্তোত্রসমূহ বা যজুর্বেদের সংক্ষিপ্ত মন্ত্রোচ্চারণ বিধি ভাবগত দিক দিয়ে এর সঙ্গে সাযুজ্য বহন করে। অথর্ববেদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের অন্যতম হ’ল প্ৰহেলিকপূর্ণ অর্থাৎ আপাতদৃষ্টিতে অর্থহীন বাক্যাংশ বা শব্দের পুনরাবৃত্তি। এক-চতুর্থাংশ, অর্ধেক বা সম্পূর্ণ পঙক্তি ও স্তবকের পুনরাবৃত্তি চরিত্রবৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে সংকেতপূর্ণ, স্মৃতি ও ঐন্দ্ৰজালিকতার সহায়ক। এই ত্রিবিধ বৈশিষ্ট্যকে পৃথকভাবে ভাষাতাত্ত্বিক, যাজকতান্ত্রিক ও জাদুপুরোহিতের উপযোগী ব’লে ভাবার কারণ নেই; বস্তু গ্ৰাহ্য জগতে হস্তক্ষেপ করার উপযোগী অলৌকিক শক্তি উৎপন্ন করার প্রাথমিক প্রয়োজনে এই বৈশিষ্ট্যগুলি পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। অথর্ববেদের যে বৈশিষ্ট্য ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলেও লক্ষ্য করা যায়, তা হ’ল খুব সংক্ষিপ্ত কলেবর সূক্তের উপস্থিতি। অথর্ববেদে কোনও কোনও ক্ষেত্রে একটিমাত্র পঙক্তিতে একটি সূক্ত সম্পূর্ণ। ষষ্ট অধ্যায়ে কেবলমাত্র সংক্ষিপ্ত সূক্তগুলিই পাওয়া যায়; এগুলি সম্ভবত সতর্ক সম্পাদনার চিহ্ন বহন করে। এছাড়া প্রায়ই ‘পর্যায়’ শ্রেণীর সূক্ত পাওয়া যায়, যেখানে বেশ কিছু সংক্ষিপ্ত মন্ত্রের সাহায্যে একটি দীর্ঘ সূক্ত গ্রথিত—এর বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন বিষয়বস্তুর উল্লেখ পাওয়া যায়–কেবলমাত্র বিষয়ের দ্বারাই প্ৰথিত সূক্তটি অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট অনুষ্ঠানের অঙ্গ-রূপেই মন্ত্রগুলি একটি অভিন্ন সূক্তের অন্তর্গত।
‘দৰ্ভমণি’র প্রতি উদ্দিষ্ট সূক্তে বিদ্বেষসূচক ভাষা যেন অতিরিক্ত মাত্রায় স্পষ্টতা ও শক্তি অর্জন করেছে; ঐন্দ্ৰজালিক ক্ষমতাকে এখানে সামগ্রিকভাবে শত্রুনিধনের উদ্দেশ্যে প্রয়োগ ক’লা হয়েছে; অত্যাচার ও ধ্বংসাসূচক বিবিধ ক্রিয়াপদের ব্যবহারে আবেগের সূক্ষ্ম তারতম্যও স্পষ্ট অভিব্যক্ত; যেমন বিদ্ধ করা, ভেঙে ফেলা, বিমুক্ত করা, চুৰ্ণ করা, খোঁচা দেওয়া, তীক্ষ্ম অস্ত্ৰ দিয়ে ভেদ করা, ছিদ্র করা, অবরোধ, হত্যা, মন্থন, দগ্ধ, আত্মসাৎ ও ধবংস করা।
ভাষার দিক দিয়ে অথর্ববেদ ঋগ্বেদের তুলনায় অধিকতর পরিশীলিত পর্যায়ের রচনা। পদ্য ও স্বরপ্রবাহ যুক্ত গদ্য অথর্ববেদে যথেচ্ছভাবে মিশ্রিত হয়েছে; সংহিতা সাহিত্যে গদ্য বিলম্বে আবির্ভূত হয়েছিল। চরিত্রগতভাবে এ সংহিতাটির ঐন্দ্ৰজালিক বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। বস্তুত, অথর্ববেদে গদ্য ও পদ্য এমনভাবে সংমিশ্রিত যে, তাদের মধ্যে পার্থক্য নিরাপণ করা কঠিন। ছন্দোযুক্ত গদ্য ও নিতান্ত আটপৌরে তাৎপর্যবর্জিত পদ্য যথার্থ সংহিতাশ্রেণীর ছন্দের সঙ্গে স্বাধীনভাবে মিশ্রিত হওয়ায় এবং প্রায়ই সংযোজন ও প্রক্ষিপ্ত বিষয়ের যুগপৎ সন্নিবেশ ঘটায়। এ সংহিতাটির সাহিত্যমূল্য বহুলাংশে নষ্ট হয়েছে।
কখনো কখনো আমরা সেইসব উপাদানের সংরক্ষণের একটি প্রবণতা লক্ষ্য করি, যেগুলি রক্ষা না করলে হয়ত জনসাধারণের স্মৃতি থেকে তা’ লুপ্ত হয়ে যেত। সুতরাং, এদের সংরক্ষণ থেকে রচনার অর্বাচীনত্ব প্রমাণিত না হলেও সংগ্রহের বিলম্বিত প্ৰয়াস সম্পর্কে নিশ্চিত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। নিশ্চিতভাবে এই প্রক্রিয়ায় ভাষাও যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছিল। শব্দের আঙ্গিকগত রূপান্তরের সঙ্গে সঙ্গে অন্তত কিছুটা শব্দার্থগত পরিবর্তনও ঘটে; আবার, তার মধ্যেই নিহিত থাকে সামাজিক ও ধর্মীয় চেতনায় পরিবর্তনের প্রবণতা। ঋগ্বেদে যে ‘ব্ৰহ্মণ্’ শব্দের তাৎপর্য ছিল ভক্তি, প্রার্থনা, বা আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন মন্ত্রোচ্চারণ, অথর্ববেদে তার শব্দার্থগত পরিবর্তন ঘটে গেল; সম্ভবত, ‘ব্ৰহ্ম’ শ্রেণীর পুরোহিতের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়ে এর অর্থ দাঁড়াল ঐন্দ্ৰজালিক মোহাবেশ। শুধু তাই নয়, ঋণরূপে গৃহীত ঋগ্বেদীয় সূক্তগুলির আনুষ্ঠানিক প্রয়োগও নতুন তাৎপর্যবহ, প্রধান শ্রৌতযাগসমূহ পুরাতন প্রসঙ্গ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অথর্ববেদে পারিবারিক ও ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে ক্রমশ অধিকমাত্রায় ব্যবহৃত হতে থাকল; ফলে, কোনো একসময় এই সূক্তগুলি বিপদ থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার উপযোগী জাদুমন্ত্রে পর্যবসিত হ’ল।
সূক্তগুলির সঙ্গে সঙ্গে দেবতাদেরও অবনমন ঘটলো। ইন্দ্র ও অগ্নির মত ঋগ্বেদের প্রধান দেবতারা এখন তুচ্ছ বিপদ ও ক্ষুদ্র আশঙ্কা থেকে রক্ষা করার জন্যে আহূত হচ্ছেন। এই সমগ্র প্রক্রিয়া থেকে সম্ভবত দুটি দিক স্পষ্ট হয়ে উঠছেঃ প্রথমত, প্রধান যজ্ঞগুলি কালক্রমে জনপ্রিয়তা হারিয়েছে; কেননা, কেবলমাত্র মুষ্টিমেয় রাজন্য বা ঐশ্বৰ্যবান পৃষ্ঠপোষকের পক্ষেই তখন যজ্ঞানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা সম্ভব। সেইসঙ্গে সাঙ্কেতিক মন্ত্রগুলিও তখন ক্রমশ গাৰ্হস্থ্য অনুষ্ঠানসমূহে অধিকতর মাত্রায় ব্যবহৃত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, অথর্ববেদে প্ৰতিফলিত লঘু ঐতিহ্যকে স্বীকরণের একটি পদ্ধতি হ’ল আদিম অধিবাসীদের কিছু কিছু ঐন্দ্ৰজালিক অনুষ্ঠানকে মূলধারায় যথাযথ শুচিতার সঙ্গে গ্রহণের মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত করা। বহুযুগ ধরে এ সমস্ত জাদু-প্রক্রিয়ার নিহিত গুরুত্ব স্বীকৃত হওয়ায় রক্ষণশীল সমাজের কাছেও লোক ঐতিহ্যের প্রায়োগিক কুশলতা অনিবাৰ্যভাবেই গৃহীত হয়েছিল। বস্তুত, দুটি ভিন্ন ঐতিহ্যের মধ্যে আপস-মীমাংসার পক্ষে প্রয়োজনীয় অনুঘটক রূপেই অথর্ববেদের এই প্রবণতা সক্রিয় ছিল।
অবশ্য, এ সবই অথর্ববেদের বিলম্বিত স্বীকৃতির কারণগুলির প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে; এই যুগে যাজকতান্ত্রিক সাহিত্যপ্রক্রিয়া রূপে সংহিতা রচনা তার শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। অথর্ববেদ সংহিতায় বিষয়বস্তুগত বৈচিত্র্যের কারণরূপে আমরা পুরোহিতদের সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের অবক্ষয়কে নির্দেশ করতে পারি। ঋগ্বেদ (সামবেদ ও যজুর্বেদিও এই ধারারই অন্তর্গত) ও অথর্ববেদ—এই দ্বিবিধ ধারার পুরোহিতসম্প্রদায় প্রচলিত সূক্ত, জাদুমন্ত্র, মোহাবেশ সৃষ্টিকারী শব্দবন্ধ, যুদ্ধগীতি, প্ৰহেলিকা ইত্যাদি সংকলন ও সংগ্রহ করে এসব রচনাকে সংরক্ষিত করার জন্যে সিদ্ধান্ত গ্ৰহণ করেন, কেননা, ইতোমধ্যেই কাব্যিক ঐতিহ্য সজীব শক্তিরাপে আপন গুরুত্ব সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলেছে। তাছাড়া কোনো মৌলিক মন্ত্রও যেহেতু আর বহুদিনের মধ্যে রচিত হয়নি, তাই নিঃশেষ মন্ত্রসংগ্ৰহ প্ৰস্তুতির প্রয়াস কেবলমাত্র তখনই সম্ভব বলে বিবেচিত হ’ল।