অবিনাশ চৌধুরীর ঘরের দরজা ভেতর হতে ভেজানোই ছিল।
দরজার গায়ে মৃদু করাঘাত করে কিরীটী। ভেতর হতে সুমিষ্ট শান্ত গলায় প্রশ্ন আসে, কে?
আমি কিরীটী।
আসুন। ভেতর থেকে আহ্বান আসে।
দরজা ঠেলে কিরীটী ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
খোলা দরজার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন অবিনাশ চৌধুরী।
হাত দুটি তাঁর পশ্চাতের দিকে নিবদ্ধ। পরিধানে দামী শান্তিপুরী মিহি ধুতি। গিলে করা কোঁচাটা মেঝেতে লুটোচ্ছে। গায়ে একটা সবুজ রঙের কাশ্মীরী কলকাতোলা দামী শাল।
মেঝেতে পুরু দামী গালিচা বিছানো। একপাশে কয়েকটি বাদ্যযন্ত্র এলোমেলো পড়ে আছে। দেয়ালের দিকে ঘেঁষে একটি কাঁচের আলমারি। ভেতরে সুন্দরভাবে সাজানো নানা বই।
অবিনাশ চৌধুরী একবার ফিরেও তাকালেন না। যেমন পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তেমনই নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন।
কিরীটীও নিঃশব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল।
তারপর রায় মশাই, কি মনে করে আমার ঘরে? মৃদু শান্ত কণ্ঠে এক সময় অবিনাশ চৌধুরী আগের মত দাঁড়ানো অবস্থাতেই প্রশ্ন করলেন।
আপনার সঙ্গে কয়েকটা কথা ছিল কাকা সাহেব।
কথা?
আজ্ঞে।
আবার কিছুক্ষণ পীড়াদায়ক স্তব্ধতা।
কেবল ঘরের দেয়ালে বসানো একটি সুদৃশ্য দামী জামান ক্লক সময়-সমুদ্রের বুকে একটানা শব্দ জাগিয়ে চলেছে টক টক টক্ টক্ টক।
বলে ফেলুন, শুনি কি কথা! পুনরায় কিছুক্ষণ বাদে অবিনাশ চৌধুরীই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন।
আপনি বোধহয় বুঝতেই পেরেছেন কাকা সাহেব, কি সম্পর্কে এবং কি কথা আমি বলতে চাই? কিরীটী বলে।
আমি তো অন্তযামী নই যে আপনার মনের কথা জানতে পারব মশাই। তবে যা জিজ্ঞাসা করতে চান একটু চটপট করলে বাধিত হব।
সামান্য কয়েকটা কথাই আমি জিজ্ঞাসা করব, বেশীক্ষণ আপনাকে আমি বিরক্ত করব না। আমি বলছিলাম রায়বাহাদুরের–
সহসা এতক্ষণে ফিরে দাঁড়ান অবিনাশ চৌধুরী এবং ক্ষণকাল তীব্র তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নিঃশব্দে।
সত্যিই তো, ভুলেই গিয়েছিলাম, আপনি সেই রহস্যভেদী না? দুযযাধনের অঘটন-পটিয়সী অদ্ভুত শক্তিধর কিরীটী রায়! তা বেশ, দুযযাধনের হত্যার রহস্যভেদের জন্য লেগেছেন বুঝি? কিন্তু পারবেনধরতে পারবেন দুযোধনের হত্যাকারীকে? পারবেন ধরতে?
কিরীটীর ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু একটু হাসি ফুটে ওঠে। মৃদু হাস্যোদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলে, চেষ্টা করে দেখি।
কিরীটীর কথায় কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিঃশব্দে তার মুখের দিকে চেয়ে থেকে অবিনাশ চৌধুরী বললেন, করুন চেষ্টা তবে। হ্যাঁ, পারেন যদি আমি নিজে আপনাকে একটা reward দেব। কিন্তু দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।
না, আপনাকে বেশী বিরক্ত করব না। দু-চারটে কথা জিজ্ঞাসা করেই চলে যাব।
দু-চারটে কেন, হাজারটা করুন না! হ্যাঁ, আমিও ভাবছিলাম ব্যাপারটা ঠিক কি হল! আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটাই এখনও যেন একটা দুঃস্বপ্ন বলেই মনে হচ্ছে। দুর্যোধন সত্যি-সত্যিই শেষ পর্যন্ত নিহত হল! কিন্তু কেন? কেন—কেন সে এমন brutally নিহত হবে—শেষের দিককার কথাগুলো কতকটা যেন আত্মগত ভাবেই উচ্চারণ করে অবিনাশ চৌধুরী ঘরের মধ্যে আবার পরিক্রমণ শুরু করলেন।
নিঃশব্দে গালিচা-বিস্তৃত ঘরের মেঝেতে অবিনাশ চৌধুরী পরিক্রমণ করছেন। পূর্বের মতই। হাত দুটি তাঁর পশ্চাতের দিকে নিবদ্ধ।
আত্মগত ভাবেই যেন অবিনাশ চৌধুরী আবার বলতে লাগলেন, Its a curse! বুঝলে, curse—অভিশাপ! সুরমার অভিশাপ। একটা দিনের জন্যও মেয়েটাকে শান্তিতে থাকতে দেয়নি। একটা দিনের জন্যও শান্তি দেয়নি।
কার কথা বলছেন কাকা সাহেব? কিরীটী মৃদু কণ্ঠে প্রশ্ন করল।
কিরীটীর প্রশ্নে অবিনাশ চৌধুরী যেন চমকে ওঠেন, হ্যাঁ, কি বললেন! না, কারও কথাই নয়। কিন্তু আপনি—আপনি এখানে কি চান? কি প্রয়োজন আপনার? শেষের দিকে অবিনাশ চৌধুরীর কণ্ঠস্বরও যেন বদলে গেল। রুক্ষ, কর্কশ।
এবং পরক্ষণেই মহাবীর সিং! মহাবীর সিং!বলে অবিনাশ চৌধুরী চিৎকার করে ভৃত্যকে ডাকেন।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরের ভেতর দিকের একটা দরজা খুলে গেল এবং বৃদ্ধগোছের একজন, বোধ। হয় রাজপুত, ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল, জি মহারাজ!
বাঈজী! অবিনাশ চৌধুরী বললেন।
মহাবীর সিং আবার পূর্বদ্বারপথেই অন্তর্হিত হয়ে গেল।
এবং মহাবীর সিং ঘর ছেড়ে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আবার কিরীটীর দিকে তাকিয়ে অবিনাশ রুক্ষ স্বরে বলেন, এখনও দাঁড়িয়ে আছেন?
আপনার সঙ্গে আমার গোটাকতক কথা মিঃ চৌধুরী—
কথা! কি কথা? এখন আমার সময় নেই কোন কথা শোনবার বা বলবার।
কিন্তু–
আঃ, বলছি না সময় নেই!
বেশিক্ষণ আমি সময় নেব না।
এক মিনিট সময়ও আমার নেই।
মুন্না বাঈজী ঘরের মধ্যে এসে এমন সময় প্রবেশ করল।
অতি সাধারণ একখানি রক্তলাল চওড়াপাড় বাসন্তী রঙের খদ্দরের শাড়ি পরিধানে। অনুরূপ রক্তলাল বর্ণের সাটিনের হাফ-হাতা ব্লাউজ গায়ে। বিকীর্ণ-কুন্তলা। চোখের কোলে সূক্ষ্ম সুমার টান।
সরু সরু চাঁপার কলির মত আঙুলগুলো। নখ হতে যেন রক্ত চুঁয়ে চুঁয়ে পড়ছে।
আমায় ডাকছিলেন চৌধুরী মশাই?
এস মুন্না। এবারে সম্পূর্ণ অন্য কণ্ঠস্বর। যেন অবিনাশ চৌধুরী নয়।
আজ সকালে তুমি যে ভৈরো রাগটা ধরেছিলে, কিছুতেই মনের মধ্যে আর সে সুরটাকে খুঁজে পাচ্ছি না। সুরটাকে ফিরিয়ে আনতে পার বাঈজী?
মুন্না বাঈজী নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে মেঝের গালিচার ওপর হতে বীণাটা কোলে টেনে নিয়ে তারে মৃদু আঘাত করল।
তারের বুকে রিনিঝিনি শব্দ জাগে। এবং সেই সঙ্গে কণ্ঠও বাঈজীর গুনগুনিয়ে ওঠে। অবিনাশ গালিচার ওপরে বসে একটা তাকিয়া কোলের কাছে হাত বাড়িয়ে টেনে নিয়ে নিজেকে তাকিয়ার ওপর এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলেন।