১৫. অফিস ঘরের ফোন

১৫.

ব্রাডের অফিস ঘরের ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলে ব্রাড বলল, হ্যালো, ইয়েস, ব্রাড বলছি–কে? ও টম?

টমের কণ্ঠস্বর বন্ধ হয়ে আসছে, বলল, ব্রাড আমি আর সহ্য করতে পারছি না।

ব্রাড বলল, বন্ধু নিজেকে সামলাও, তোমার কষ্ট বুঝতে পারছি। আমিও ভীষণ মর্মাহত। তোমাকে সমবেদনা জানাবার সাহসটুকুও আমি জোগাড় করতে পারছিলাম না।

টনি জিজ্ঞাসা করল, চার্লসের খবরটা তুমি কোথা থেকে পেলে?

ব্রাড বলল, আমি আর টনি এই কিছুক্ষণ আগে শ্যানডন হাউস থেকে ফিরলাম। গেছিলাম চার্লসের সঙ্গে কিছু কথা বলব বলে। কিন্তু গিয়ে এমন একটা ঘটনা দেখবো ভাবিনি।

আচ্ছা চার্লসের কীভাবে মৃত্যু হোল তোমরা কী দেখেছ? টম জানতে চাইল।

ব্রাড বলল, আমরা কেন, কেউই দেখেনি।

 টম বলল, ব্রাড দয়া করে আমায় একটু খুলে বল, সত্যি কী ঘটেছে।

 ব্রাড জিজ্ঞাসা করল, তুমি কোথা থেকে ফোন করছ?

টম বলল, পুলিশ হাউস থেকে। ওরা সঠিক করে কিছুই বলতে পারছেনা। তোমরা শ্যানডন হাউসে গেছিলে শুনে তোমার কাছে জানতে চাইছি। বুঝতেই পারছ আমাদের অবস্থাটা। ডরোথি একদম ভেঙ্গে পড়েছে।

ব্রাড একটু চিন্তা করে নিল, তারপর সমস্ত ঘটনা, শ্যানডন হাউসের কথা, কেবল ফল্ট এর কথা, এবং দীঘিতে চার্লসের মৃতদেহের কথা একে একে সব বলল।

টম উত্তেজিত ভাবে বলল, ওই রিকনীলের হাত সর্বত্র, ওর কিছুকরা দরকার। কে ওর ব্যবস্থা করবে?

ব্রাড বলল, আমরা ওর ব্যবস্থা করতে যাচ্ছি।

টম চাপা গর্জন করে উঠল, কবে? কী ভাবে? ন্যাটো মেমোরেন্ডাম ফাঁস হয়ে আজ অনেকগুলো মাস কেটে গেল। কত জন মারা গেল। তোমরা তার কিছু করতে পারলে না।

ব্রাড বুঝতে পারল টমের অবস্থাটা। ও অবুঝ হয়ে উঠেছে। ব্রাড বলল, দেখো অফিসিয়াল অ্যাকশন নেবার মত যথেষ্ট সাক্ষী–সাবুদ আমাদের হাতে ছিল না। এখন যে সব ঘটনা ঘটছে তাতে আশা করছি রিক নীলের বিরুদ্ধে কিছু প্রমাণ হাতে পাবো।

ব্রাড বলল, যাই হোক ফোনে সব কথা বলা যাচ্ছে না। আর এই সম্পর্কে বেশী আলোচনা না করাই শ্রেয়।

টম বলল, আমি কালই শ্যানডন হাউসে একবার যাবো। দেখি একজন রিপোর্টারের চোখে আর কিছু ধরা পড়ে নাকি। আমি ওই স্কাউলেগুলোকে কিছুতেই ছাড়বোনা, যারা আমার ভাইকে খুন করেছে।

ব্রাড বলল, না আমি তোমাকে বাধা দেবনা। একজন সাংবাদিক হিসাবে তোমার যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাবার অধিকার আছে। তবে তোমায় অনুরোধ করছি এমন কিছু করোনা যাতে সব ভণ্ডুল হয়ে যায়।

টম বলল, জানো ব্রাড আমার নিজেকেই অপরাধী মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে চার্লসের মৃত্যুতে আমারও হাত আছে। কেন আমি ওকে জোর করে আমার কাছে নিয়ে আসলাম না, কেন?

কথাগুলো বলতে বলতে টম ভেঙ্গে পড়ল।

 ব্রাড কোন কথা বলতে পারলো না। সে একেবারে নীরব হয়ে গেল।

পুলিশ হাউস থেকে বেরিয়ে লন দিয়ে যেতে যেতে টম অনেক কথাই চিন্তা করছিল। পাশেই টমের ফিয়াটটা পার্ক করা আছে।

তখন রাত দশটা। টম ওভার কোটটা গায় টেনে নিল। টুপিটা আরও একটু নামিয়ে নিল।

রাস্তায় লোক চলাচল কমে গেলেও গাড়ি যাতায়াত কমেনি। অল্প অল্প কুয়াশা চারিদিকে, অন্ধকার পরিবেশ।

গাড়ির দরজা খুলে ঢুকতে গিয়ে ওপাশের দরজার পিছনে একটা কালো রঙের সাইট্রোন কার দেখতে পেল। আর ঐ গাড়ির পিছনে যে ছায়ামূর্তি নিশ্চল হয়ে ওর গাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে তার চেহারার আকৃতি দেখে টমের বুঝতে বাকি রইল না ও রিক নীলে ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। কিন্তু ও এখানে কী করছে? নিশ্চয়ই ওকে ফলো করছে।

চমক কাটতেই টম ঘৃণায়–ক্রোধে জ্বলতে লাগল। ওহ যদি হাতে একটা পিস্তল থাকত, তাহলে ওই শয়তানটাকে এখনই শেষ করে দিতাম। চার্লসের কথা মনে পড়তেই টম চঞ্চল হয়ে উঠল। না! কিছু একটা করতেই হবে।পিস্তল না থাক। দুটো হাত তত আছে। তা দিয়ে যদি ওর কণ্ঠনালীটা চেপে ধরা যেত। টমের মনের মধ্যে জেগে ওঠে আত্মপ্রত্যয়। টম ছুটে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হল, কিন্তু ওরা মনে হয় সব কিছু বুঝতে পারে।টম গাড়ি ছেড়ে নড়ার আগেই রিকসাইট্রোন–এর ভেতর ঢুকে গেল আর মুহূর্তে চোখের সামনে দিয়ে শহরের দিকে মিলিয়ে গেল।

.

অনেক রাত হয়েছে। সেন্ট্রাল পার্ক এখন জনশূন্য। যে সব গাছের তলায় বিকেল বেলা প্রকৃতি বিলাসী মানুষেরা প্রকৃতিকে উপভোগ করতে আসে এখন সেখানে ছায়া কালো নিস্তব্ধ অন্ধকার। এখন সেখানে যত শয়তানদের আড্ডা যদিও প্রহরী আছে তা সত্ত্বেও।

দ্রুত গতিতে টনি গাড়ি চালিয়ে আসছিল। ওর চোখ মুখ, মাংসপেশীগুলো শক্ত হয়ে গেছিল। আজ ওর মুক্তিযুদ্ধের শেষ লড়াই। ফ্রান্স, অটোয়া ও জেনেভাতেও এর থেকে অনেক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। আজ কী ও হেরে যাবে? সমস্ত ব্রাসেলস ওর দিকে চেয়ে আছে। টনি মনে মনে ছক কষে নিচ্ছিল। টনি জানে ওদের কাছ থেকে এখনই কোন কথা বার করা যাবে না। ওরা ভেঙে যাবার পাত্র কিন্তু মচকাবার নয়। তবে ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন কে দিয়ে কেটি কোলিয়ার সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিতে হবে। তা না করে আবার ব্রাডকে দিয়ে কেটির ফোন কলগুলোর সন্ধান নিলেও হয়। প্রতি সপ্তাহে সে কতবার কোথায় ফোন করেছে, ওর ঘর থেকে কে কোথায় ফোন করেছে, ওর কাছে কটা ফোন এসেছে, হ্যাঁ এইটাই সহজ হবে।

টনির মনে একটু সংশয় দেখা দিল। আচ্ছা আমি যাদের কাজে লাগিয়েছি তারা কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করছে না তো? বিল, নিকোলে, জর্জেস, ব্রিজেট, বারনারড…

সবার কথা একে একে ভাবলো। টনি কাউকেই বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ এখন যা পরিস্থিতি চলছে তাতে সব কিছুই সম্ভব। তবে বিল নিকোলে এদের বিশ্বাস যোগ্যতা সন্দেহাতীত। জর্জেস মোস্ট ফেইথফুল হ্যান্ড। আর জিন একটু কুঁড়ে হলেও রিককে সে ছায়ার মত অনুসরণ করে চলেছে। আর জেরার্ড যেভাবে জেনেভা থেকে খবর পাঠাচ্ছে তাতে তাকে সন্দেহের বাইরে রাখতে হয়। গেরস্কির যে ফাইল ন্যাটোর ইনটেলিজেন্স দপ্তরে আছে তার বহু রিপোর্ট জেরার্ড যেভাবে পাঠিয়ে চলেছে তাতে বোঝা যায় তার ভিতরে বিশ্বাস ভঙ্গের চিহ্নমাত্র নেই।

এই তো কদিন আগে জর্জেস বলল, স্যার আমরা জেনেভা থেকে জেরার্ডের রিপোর্ট পেয়ে গেছি।

টনি জিজ্ঞাসা করেছিল ব্রাসেলসে সব ঠিক আছে?

 জর্জেস জানিয়ে ছিল, চিন্তা করবেন না স্যার আপনার চিঠি জেরার্ড ঠিকমত পৌঁছে দিয়েছে।

টনি জানতে চেয়েছিল, জেরার্ড কি বলছে?

স্যার গেরস্কি সম্বন্ধে আমাদের যা ধারণা ছিল ও তার থেকে আরো বেশি সাংঘাতিক। জেরার্ডের রিপোর্ট আমি আপনাকে না জানিয়ে আমাদের ডিপার্টমেন্ট ভি একজিকিউটিভ অ্যাকশন ব্রাঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছি। আশা করি আপনি ক্ষুণ্ণ হবেন না।

টনি হেসে বলেছিল, না না, আরো কিছু পাঠিয়েছ?

হ্যাঁ, স্যার জেরার্ড বলেছিল, গেরস্কির ফাইল নাম্বার।

 টনি জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা জেরার্ড কী তোমার মতই অত্যুৎসাহী?

 জর্জেস বলেছিল, আরো বেশী।

কেন? কারণ কী?

জেরার্ড সোভিয়েতের ডিসইনফরমেশন ব্রাঞ্চ থেকে একজন লোককে এখানে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছিল। সোভিয়েত কোড ভাষাগুলো আয়ত্ত করার জন্য। কিন্তু গেরস্কি খুবই চালাক। সে বাবুর্চির সঙ্গে জেরার্ডের কিচেনে ঢুকে পড়ে তাকে তো মারলেই তার সঙ্গে আরও দুজনকে। ফুড পয়জনিং

টনি ভাবল, না! সেন্ট্রাল পার্ক প্রায় কাছাকাছি এসে গেল। আর এসব আবোল তাবোল কথা চিন্তা করবে না।

টনি গাড়ির সামনে হঠাৎ একটা ছায়া দেখতে পেয়ে ব্রেক কষল। জর্জেস!টনি জিজ্ঞাসা করল, তুমি অমন হাঁপাচ্ছ কেন? তোমায় অমন দেখাচ্ছে কেন?

জর্জেস বলল, স্যার, ভীষণ বিপদ হয়ে গেছে। আমরা বোকা বনে গেছি। আর প্যারাসিনি…

টনি ভাবল তাহলে তার অনুমান ভুল। প্যারাসিনি বিশ্বাসঘাতকতা করল… জর্জেস তুমি সব কিছু ভালো করে খুলে বল।

জর্জেস বলল, স্যার প্যারাসিনিকে খুন করা হয়েছে।

টনি রীতিমত শিউরে উঠল, বল কী?

টনি নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, ঘটনাটা কী করে ঘটল?

জর্জেস বলল, কোন শব্দ নেই, হৈ–হুল্লোড় নেই। সব কিছুই ঠিকমত হচ্ছিল। আমি গেরস্কি আর রিককে সেন্ট্রাল পার্কের গেটের পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আপনাকে ফোন করতে যাই। প্যারাসিনি পার্কের ভিতরে কোন এক জায়গায় লুকিয়ে ওদের ফলো করছিল।

আমি ফোন করে এসে দেখি গেরস্কি আর রিক সেখানে নেই। প্যারাসিনিকেও দেখতে পেলাম না, ভাবলাম প্যারাসিনি হয়তো ওদের পিছু নিয়েছে। তারপর কিছুক্ষণ বাদে সেন্ট্রাল পার্কের ভিতর যাই, দেখি প্যারাসিনি পড়ে আছে, ওকে খুন করা হয়েছে।

 টনি জিজ্ঞাসা করল, কোন আঘাতের চিহ্ন আছে?

না স্যার, কোন আঘাতের চিহ্ন নেই। মনে হচ্ছে হার্টফেলিওর কেস।

 টনি আপন মনেই বিড়বিড় করতে লাগল। গেরস্কির সেই একই কার্যপ্রণালী। গেরস্কি যেভাবে বুদ্ধির খেলায় টনিকে হারিয়ে দিচ্ছে তাতে এটা হজম করা ওর পক্ষে সহজ হবেনা এটা জর্জেস ভালোই বুঝতে পেরেছিল।

টনি জিজ্ঞাসা করল, বিল আর নিকোলে কোথায়?

বলতে বলতে একটা ছোট স্পোর্টিংকার চালিয়ে বিল আর নিকোলে সেখানে পৌঁছালো।ওদের ভীষণ উত্তেজিত দেখাচ্ছিল।

টনি বলল, প্যারাসিনির খবর জানো?

বিল বলল, জানি, আমরা ওর অবস্থা দেখে গেছি। একটা সাইট্রোন কার এ চেপে রিক আর গেরস্কি ফিফটি ফোর্থ অ্যাভেনর দিকে যাচ্ছিল। আমরা ওদের ফলো করছিলাম।

টনি চমকে উঠল, ফিফটি ফোর্থ অ্যাভেন্য। ওখানে তো টমের অ্যাপার্টমেন্ট।

টনিচট করে নিজের গাড়ি থেকে পিস্তলটা নিয়ে নিল আর জর্জেসকেবলল, তুমি আর নিকোলে প্যারাসিনির ব্যবস্থা কর।

আর বিল তুমি আমার সঙ্গে চলল। জর্জেস, তোমাদের কাজ হয়ে গেলে খুব তাড়াতাড়ি ফিরে যাবে। আর আমার ফোনের অপেক্ষা করবে।

.

১৬.

 টম কেলসো গাড়িটা বাড়ির লনে দাঁড় করালো। ফিয়াটের দরজা খুলে নিজে নেমে এল। তারপর পিছনের সীট থেকে চার্লসের সুটকেসটা নিল। বাড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল। সব ঠিক আছে। সে যেমনটি বলেছিল, সেইভাবেই ডরোথি কাজ করেছে।

ডরোথি শুধু দরজা ও জানালার পর্দা দেয়নি। কাঁচের শার্সি এমন কী কাঠের পাল্লা গুলোকেও বদ্ধ করে দিয়েছে। বারান্দায় উঠে দরজা খুলতে গিয়ে বুঝতে পারল টম দরজা লক করে আবার ভিতর দিয়ে ছিটকিনি তুলে দিয়েছে। যাতে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতর ঘরে ঢুকতে পারবে না।

টম দরজায় ঘা দিল, কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। তবে কী ডরোথি দোতলায় ঘুমিয়ে পড়েছে? টম ভাবলো তাহলে বাড়ির পিছনে গিয়ে ছোট পাথরের টুকরো ছুঁড়ে ডাকবে? এমন ছেলেমানুষীকরার আগেটম আবার বেশ কয়েকবার জোরে জোরে দরজায় ঘা দিল।কিছু মুহূর্তের জন্য টম অজানা ভয়ে শঙ্কিত হলো। তারপর ডরোথির গলার শব্দে নিশ্চিন্ত হল।

ডরোথি দরজা খুলতে, মোটামুটি হালকা মেজাজে দোরগোড়ায় ডরোথিকে পেতে টম জড়িয়ে ধরে ওর গালে আলতো চুম্বন করল। বলল, থিয়া তুমি আমার স্বর্গ, স্বপ্ন।

ডরোথির শরীরের ভেজা স্পর্শ পেয়ে টম জিজ্ঞাসা করল তুমি বুঝি বাথরুমে ছিলে?

ডরোথি বলল, হ্যাঁ একটু হট বাথ নিচ্ছিলাম…তোমার গাড়ীর শব্দ শুনেছি। বাথরুম থেকে বেরুতে একটু দেরী হল।

ডরোথি দরজা লক করে ছিটকিনি তুলে দিল।

টম বলল, এমন হাল্কা পোষাক পড়ে আছো কেন? গরম কিছু গায়ে দেওয়া দরকার ছিল।

ডরোথি বলল, অত সময় পাইনি স্যার, ডিনার তৈরীকরলাম, তারপর তোমার যা হুকুম, জানালা বন্ধ কর, দরজা বন্ধ কর, পর্দা দাও বাব্বা!

দোতলায় বেডরুমে গিয়ে টম আবার ডরোথিকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে ডরোথির গলায়, গালে, ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলল, আমার এখন মোটেও খিদে নেই। আমায় এখন কিছু কাজ করতে হবে, বুঝলে।

টম বাথরুমের কাজ সেরে, শোবার ঘরে গিয়ে বসল। ডরোথি কিচেনে চলে গেল।

ডরোথি একটা প্লেটে করে ওমলেট নিয়ে এলো। টম ওমলেটের প্লেটটা হাতে নিয়ে বলল, আমরা আবার আগের পরিবেশে আসার চেষ্টা করছি। শুধু…

ডরোথি বুঝতে পারল টমের চার্লসের কথা মনে পড়ছে। কিন্তু ডরোথি নিজেও কী কম কষ্ট পাচ্ছে, টম যাতে ভেঙ্গে না পড়ে তাই সে নিজেকে যতটা সম্ভব সামলে যাচ্ছে।

ডরোথি নিজের জন্যেও ওমলেট নিয়ে এলো। বলল, দরজা জানালা গুলো এভাবে বন্ধ রাখা কী খুবই জরুরী?

টম দরজা জানালা কেন বন্ধ রাখতে চায় সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে বলল, বাইরে ভীষণ ঠাণ্ডা ওগুলো বন্ধই থাক।

ডরোথি ওমলেটের প্লেট নিয়ে টমের পাশে বসে বলল, ব্রাডের সঙ্গে দেখা হয়েছিল?

টম বলল, ওসি একবার ফোন করেছিলেন। ভদ্রলোক তোমায় খুব স্নেহ করেন। তিনি খুবই চিন্তিত।

ডরোথি উৎকণ্ঠিত হয়ে বলল, পুলিশ হাউসে কী হল আমায় বল না? চার্লসের হঠাৎ এমন হল কেন?

বলতে গিয়ে টমের গলা ধরে এল, অল্প কথায় কি হয়েছিল বলে দিল, ব্রাডের কথা টনি লটন এর কথা সব একে একে ডরোথিকে বলল।

ডরোথি টেবিল পরিষ্কার করতে করতে বলল, আজ রাতেই তুমি চার্লসের সুটকেসটা খুঁটিয়ে দেখো, তার পর সামান্য রাগের সঙ্গে বলল, ব্রাড, টনি এরা কোন কাজের নয়, হোপলেস! তুমি বললে, তোমায় রিক নীলে ফলো করেছিল! কেন?

টম বলল, মনে হয় চার্লসের এই সুটকেসটার জন্য। আমি নিজে আগে দেখতে চাই এই সুটকেসে চার্লসের কী এমন মূল্যবান জিনিস আছে।

ডরোথি বলল, চলো আমি তোমায় সাহায্য করি।

দুজনে শোবার ঘরে বিছানায় সুটকেসটা নিয়ে বসল, ডরোথি এমন ভাবে সুটকেসটার দিকে তাকিয়ে আছে যেন প্যানডোরার বক্স খুলতে যাচ্ছে। তা থেকে এমন সব জিনিস বের হবে যে তাদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে।

টম সুটকেসটা খুললো, তাতে থরে থরে সাজানো আছে চার্লসের জামা–প্যান্ট। সেগুলোর দিকে তাকিয়ে টমের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। টম এমন আস্তে আস্তে জামা প্যান্টগুলোতে হাত বোলাতে লাগল যেন ও চার্লসকেই আদর করছে। ডরোথিরও কান্না পাচ্ছিল। তবু সে জোর করে নিজেকে সামলালো, পাছে টম ভেঙে পড়ে।

টম একে একে জামা–প্যান্টগুলো পাশে সরিয়ে রাখলো, জামা–প্যান্টের নীচ থেকে একটা ডায়েরী আর দুটো খাম পেল।

ডরোথি ধরা গলায় বলল, আমি জামা–প্যান্টগুলো দেখি, তুমি বরং ডায়েরীটা দেখো।

টম ছোট ডায়েরীটা তুলে দু–চারটে পাতা উল্টে দেখে বলল, এটাতে কিছু নেই শুধু কিছু ঠিকানা আর ফোন নম্বর আছে। টম শেষের দিকের একটা পাতায় গিয়ে থামলো, দেখলো তাতে কিছু হিসেব–নিকেশ। চার্লস খুব সংসারী ছিল। রেস্তোরাঁ, থিয়েটারে কত খরচ করেছে তাও পর্যন্ত লেখা আছে।

তারপর কি একটা দেখে টম থেমে গেল, বলল, থিয়া এগুলো পড়তে একটু সময় লাগবে, এর ভাষা একটু অদ্ভুত, সামথিং ইমপরট্যান্ট।

ডরোথি বলল, অদ্ভুত মানে কোড ভাষায়?

টম বলল, না, তুমি তোজানো একটা পোস্টকার্ডে আমরা যতটা লিখতে পারি চার্লস অদ্ভুতভাবে তাতে আরো অনেক কথা লিখতে পারত। অনেকটা সেই ধরনের।

টম বই–এর মধ্যে নিবিষ্ট হল।

ডরোথি চার্লসের জামা–প্যান্টগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। এটা শুধু টমকে সাহায্য করাই নয়, নিজের আড়ষ্টতাকে ঝেড়ে মুছে ফেলা।

ডরোথি একটা একটা করে দেখে পাশে সরিয়ে রাখছিল। একটা ব্লেজারের পকেটে একটা সিল্কের রুমাল পেল। সেই পকেটে আর কিছু না পেয়ে অন্য পকেটে হাত দিতেই একটা কাগজ হাতে ঠেকল। বার করে এনে দেখল একটা এয়ার–মেইল।

সব কিছুতেই এখন তাদের কৌতূহল। ডরোথি চটপট ভাজ খুলে ফেললো। এয়ার–মেইলের ভিতরে অর্ধেকটা টাইপ করা একটা চিঠি। ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারীতারিখ দেওয়া। প্রাপক, পল ক্ৰান্যজ। ঠিকানা, শ্যাডন হাউস, অ্যাপলেটন হাউস এন জে। চিঠির এক কোণে ছোট করে লেখা আছে কপি টু টম। আর চিঠির একেবারে নীচে সরু পেন্সিলে খুব তাড়াতাড়ি করে লেখা, টম যেহেতু আজ সন্ধ্যায়ই আমি বেড়িয়ে যাচ্ছি এ চিঠিটা আমি তোমায় দিয়ে গেলাম। এ চিঠির বিষয়বস্তু সম্বন্ধে তোমার সঙ্গে আগে থেকেই কোন কথা বলতে চাই না। তুমি একটু সময় করে এটা পড়ে নিও। আর এ নিয়ে ভাববার মত যেন যথেষ্ট সময় পাও সেজন্যই কোন আলোচনায় এখনই যেতে রাজী নই। এর ওরিজিন্যাল আমি সই করে খাম ঐটে ডাকে পাঠাবার জন্য প্রস্তুত করে রেখেছি। যদি নীলে আমার প্রথম প্রস্তাবে রাজী না হয়, তবে এটা ডাকে পাঠাতে আমি এক মুহূর্ত দেরী, করবনা। আজ সকালে ওর সঙ্গে আমার একচোট ঝগড়া হয়ে গেছে। প্রথমে ও অস্বীকার করছিল। শেষ পর্যন্তও বাধ্য হয় সর্বস্বীকার করতে। যাইহোক, ওকে আমি চব্বিশ ঘন্টা সময় দিয়েছিশ্যানন এলাকা থেকে ওর কার্যকলাপ সরিয়ে নিতে। যদি ও তা করে তাহলে ক্ৰানজ–এর কাছে চিঠি পাঠানোর প্রয়োজন নেই। তখন তুমি এর কপিও নষ্ট করে ফেলবে। কিন্তু ও যদি তা না করে তবে গ্যাতে যাবার আগে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাবো। এর মধ্যে যদি তুমি কিছু ভেবে থাকো তা জেনে নিতে পারব।তোমার চার্লস। তারিখ আটাশে ফেব্রুয়ারী।

চিঠিটা কোনরকমে শেষকরে ডরোথি লাফিয়ে উঠল। চার্লসের ব্লেজারের পকেট থেকে একটা নতুন জিনিস পেলাম বোধ হয় ন্যাটো সংক্রান্ত কিছু খবর লেখা, শ্যানডন হাউসের উদ্দেশ্যে চিঠি।

চিঠির বাকী অংশটুকুতে রয়েছে চার্লসের স্বীকারোক্তি। সে কিভাবে শ্যানডন হাউস থেকে ন্যাটো মেমোরেন্ডাম সরিয়েছিল। তারপর রিক নীলের সাহায্যে কিভাবে ওটা হোলজাইমারের হাতে যায়। চিঠির পরিসমাপ্তি ঘটেছে চার্লসের শ্যানডন হাউসে ইস্তফার মধ্য দিয়ে।

চার্লস বলতে চেয়েছে প্রতিটি আমেরিকানের ন্যাটোর মেমোরেন্ডাম–এর যথার্থতা বিচার করার অধিকার আছে। সেই জন্যই সে ন্যাটোর মেমোরেন্ডাম প্রকাশ করার সুযোগ করে দিয়েছে। এর জন্য যদি কোন অপরাধ হয়ে থাকে, তার দায় দায়িত্ব বহন করতে সে প্রস্তুত।

ডায়েরীর থেকে টম দুটো পেপার কাটিং পেল। বলল, জানো চার্লস নিশ্চয়ই জানত রিক ওর সঙ্গে নানা রকম চালাকি করে চলেছে। এই পেপার কাটিংগুলো ওয়াশিংটন পোস্টকাগজের। এর একটা হচ্ছে, এইরকম ক্যাপসন দিয়ে শুরু, এখন এ প্রকাশ করা চলে। এটা মাত্র গত মঙ্গলবারের কাগজের সংবাদ। এর বিষয়বস্তু হলো খুব সাংঘাতিক। ওয়াশিংটন পোস্টের বিশেষ সংবাদদাতা লিখেছে। গত ডিসেম্বরের তিন তারিখে একটি বিখ্যাত দৈনিকে ন্যাটো মেমোরেন্ডামের যে কপি ছাপা হয়েছিল তার সমস্তটাই এখন সোভিয়েট ইউনিয়নে পাচার হয়ে গেছে। পেন্টাগনের একজন নির্ভরযোগ্য কর্তাব্যক্তি মন্তব্য করেছেন যে এর দ্বারা স্বদেশের কোন মঙ্গল সাধন তো হয়নি বরং আরো বিরাট ক্ষতি করা হয়েছে।

কাগজটা ঠিক করে রেখে টম বলল, থিয়া ভাবতে পারো এটা কত বড় অন্যায় হয়েছে। ব্রাড জিলন ওকে রিক নীলে সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিল। কিন্তু তখন ও তার কথায় গুরুত্ব দেয়নি। এখন কীহলো, ওয়াশিংটন পোস্টেসব বেড়িয়ে গেল। বুধবার দিনই ও বুঝতে পারল যে ও প্রতারিত হয়েছে। হ্যাঁ রীতিমত প্রতারিত। তখন ও পল ক্রানৎজকে চিঠি লিখতে বসল। আর নীলের সঙ্গে বোঝাপড়ায় বসল। আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। ও যে এত বড় বোকা তা জানা ছিল না। চার্লস একবারও বুঝলো না যে সে কত বড় অন্যায় করতে চলেছে। এতে দেশের কত বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। সে তো বাচ্চা নয়। রিক নীলেকে তার আগে চেনা উচিৎ ছিল। চিরকালই সে এরকম না ভেবে কোন কাজ হুট করে করবে আর পরে সেই নিয়ে পস্তাবে।

টম একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আর কাকে এসব বোঝাবো। সে তো সব কিছু বোঝার উর্ধে চলে গেছে।

ডরোথি টমকে কীভাবে সান্ত্বনা দেবে ভেবে পেল না। ও আস্তে আস্তে চার্লসের জামা প্যান্টগুলো গুছিয়ে রাখতে লাগল। তারপর কিছুক্ষণ বাদে সে আস্তে আস্তে টমকে জিজ্ঞাসা করল আচ্ছা টাইপ করা চিঠিতে একটা কথা আছে ফাস্ট অলটারনেটিভ, ওটা বলতে চার্লস কী বোঝাতে চেয়েছে?

টম রাগে জ্বলে উঠল।ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছিল। যদি রিক ওর কথানা মেনে নেয়, রাবিশ। আর যদি মেনে নেয় তাহলে সে তো আর এই চিঠি পল ক্রানজকে পাঠাতোনা। এমনকীআমায়ও দিত না। ব্লেজারের পকেট থেকে বার করে ছিঁড়ে ফেলে বন্ধু গর্বে গর্বিত হয়ে রিককে বুকে জড়িয়ে ধরত। সত্যি আমার ধারণা ছিল না এত বোকা কেউ হতে পারে।

তারপর টম আবার পড়ে শোনাতে লাগল ডরোথিকে নীলে যদি আমার প্রথম বিকল্প মেনে না নেয় তাহলে–ঠিক তখনই পাশের ঘরে ফোনটা বেজে উঠল।

টম ডায়েরীর একটা পাত দেখিয়ে বলল, তুমি পড়োতাহলেই সব বুঝতে পারবে। আমি দেখি এখন আবার কে ফোন করল।

ডরোথি খুব তাড়াতাড়ি চোখ বোলাতে লাগলঃ বিকল্প হয় এখানকার সমস্ত রকম কর্মসংস্থা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যাবে নতুবা–আমি পল ক্রানঞ্জকে সব কিছু জানিয়ে চিঠি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ডরোথি মনেমনে ভাবল, চার্লস নিশ্চয়ই ভেবেছিল নীলে বন্ধুর কথা শুনে চলে যাবে। সত্যতা স্বীকার করবে। ওকে আর বিব্রত করবেনা। চার্লসকেও আর চাকরি থেকে পদত্যাগকরেঅপমানিত হতে হবেনা। ডরোথি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ওহ চার্লস সেই যদি চলে গেলে, কেন আগে বুঝলে না? কেন আমাদের কাছে এলে না? টমের একটা পরামর্শ নিতে পারতে। তোমার জন্য আমরা কত রাত অপেক্ষা করে থেকেছি। তোমার চাকরি গেলে যেত কিন্তু আমরা তো আর তোমাকে চিরকালের জন্য হারাতাম না। ডরোথির চোখ জলে ভরে উঠল।

টমকে আসতে দেখে ডরোথি তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছে ফেলল, মিথ্যে হাসির চেষ্টা করল।

টম বলল, ব্রাড ফোন করেছিল। ও জানাতে চাইছিল আমরা কোন রকম নার্ভাস ফিল করছি কিনা। আমি ওকে কিছু সংবাদ দিলাম। আর ওই কেটি বলে মেয়েটার খোঁজ নিতে বললাম। আর জানিয়ে দিলাম রিক যে কোন সময়ে পালিয়ে যেতে পারে। ও একটা বড় শয়তান।

টম ডায়েরীটা রেখে দিল। চিঠিটা ভাজ করে তার মধ্যে রাখল। তারপর সব একসঙ্গে বড় টেবিল ক্লক–এর পিছনে রাখল।

টম ডরোথিকে বলল, তুমি ভীষণ শীতে কাঁপছ। তুমি বরং শুয়ে পরো আমি দেখি টনিকে ফোনে ধরতে পারি কিনা।

ডরোথি বলল, না, আমার এখন শুতে ইচ্ছে করছে না।

টম বলল, তাহলে তুমি গরমের কোন পোষাক গায়ে দাও আমি ফায়ার প্লেসের আগুনটা জ্বেলে দিচ্ছি।

 ডরোথির বাইরের ঠাণ্ডায় যত নাশীত করছিল তার থেকে বেশী চিন্তা ভাবনাগুলো ওকে শীতল করে তুলছিল।

টম ফায়ার প্লেসে আগুন ধরিয়ে দুটো গ্লাসে করে ব্রান্ডি নিয়ে এল। সোফার সামনে যে টেবিল তাতে রেখে ডরোথিকে টেনে নিয়ে পাশে বসিয়ে বলল, চিন্তাগুলোকে সব ব্রাড আর টনির জন্য রেখে দাও, লেটস হ্যাভ এ ড্রিঙ্ক। তোমার হাত পা দেখছি ভীষণ ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। এসো আমরা একটু উষ্ণ হয়েনি। বলে টম ডরোথিকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরল। তারপর বলল, থিয়া আমি আর ভাবতে পারছি না। তুমি আমায় মাদকতায় ডুবিয়ে দিয়ে সব ভুলিয়ে দাও। ডরোথির নরম গালে মুখ ঘষতে ঘষতে টম লাইটটা অফ করে দিল।

তারা আস্তে আস্তে কামনার আগুনে বিলীন হতে শুরু করল। ডরোথি টমকে দু–হাত দিয়ে নিবিড় করে আকড়ে ধরে টমের লোমশ বুকে মুখ ঘষতে থাকলো। টমের হাত অস্থির হতে শুরু করল। তা ডরোথির সোয়োরের ভিতর দিয়ে নীচে ক্রমশ নীচের দিকে এগোতে লাগল। টমের ঠোঁট ডরোথির নরম ঠোঁটকে টেনে নিল। ঠিক তখনই

একটা ছোট্ট শব্দে দুজনের দেহ আড়ষ্ট হল। চোখ হল পলকহীন। শরীরে কাঁটা দিতে শুরু করল।

টম আস্তে আস্তে নিজের হাত সরিয়ে নিতে নিতে বলল, কীসের শব্দ হোল না? তুমি শুনতে পেয়েছে?

ডরোথি কাঁপতে কাঁপতে বলল, হ্যাঁ।

ডরোথি টমের বাঁধন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বলল, নিশ্চয়ই কেউ ঢুকেছে। কিচেনে ওমলেট করে প্যানটা আমি মেঝেতে রেখেছিলাম, অন্ধকারে নিশ্চয়ই কারো পা পড়েছে ওতে।

টম বলল, তাহলে জানালা দিয়ে কেউ এল কী?

টম ডরোথির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বলল, তুমি অন্ধকারেই সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাও পিছনের দরজা দিয়ে গিয়ে নার্সারী স্কুলের দারোয়ানকে ডেকে বলবে এখুনি পুলিশে একটা ফোন করতে।

ডরোথি বলল, টনিকে নয়?

 টনি এখন কোথায় কে বলতে পারে। তুমি আর দেরী করো না। তাড়াতাড়ি যাও।

ডবোথি যাবার জন্য পা বাড়িয়েছে ঠিক তখনই বসবার ঘর আর শোবার ঘরের মাঝের দরজায় দীর্ঘদেহী পুরুষের ছায়া।

ডরোথি একটা আর্তনাদ করে টমকে জড়িয়ে ধরল।

ছায়াটির গম্ভীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, চালাকীর চেষ্টাকরোনা। একটু এদিক ওদিক নড়লে আমার লোক তোমাদের গুলি দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেবে।

টম কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ফায়ার প্লেসের আগুন খোঁচানোর লোহার দণ্ডটির দিকে চোখ পড়ল। ওটার একদিক ভয়ঙ্কর সঁচালো। সেটা টমের হাতের কাছেই ছিল।

ওই ছায়া মূর্তিটি পিছন ফিরে বাকী লোকেদের ইশারায় ডাকলো সেই সুযোগে টম লোহার দণ্ডটি হাতে নিয়ে জামার ভেতর লুকিয়ে ফেলল। অবশ্য বুঝতে পারল না এটা কোন কাজে আসবে কিনা।

আরও দুজন লোক এসে দাঁড়ালো,সবার পরনে স্কিকরার পোষাক, মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত সব ঢাকা। শুধু চোখ দুটো খোলা। সবার হাতে পিস্তল ওচানো।

টম বুঝতে পারল একটা আগুন খোঁচানোর দণ্ড নেহাৎ ছেলেমানুষ এদের কাছে। কিন্তু তাই নিয়েই কিছু করা যায় কিনা ভাবতে লাগল টম।

.

১৭.

 টম আর ডরোথির কাছে এক এক মিনিট মনে হচ্ছে এক এক যুগ। একটা ভয়াল নির্জনতা বিরাজ করছে তাদের চারিদিকে। অন্ধকারের মধ্যে একদিকে দুটি নারী পুরুষ অন্য দিকে তিনটি ভয়াল মূর্তি। টম ভাবছিল নিশ্চয়ই ডরোথি ডাইনিং–স্পেস এর জানালার শার্সিগুলো আটকাতে ভুলে গেছে। কিন্তু এই প্রশ্ন তোলা এখন বৃথা।

যে দুটো ছায়ামূর্তি দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল তারা টম বা ডরোথিকে দেখছিল না। তারা তাদের অপর সঙ্গীটিকে দেখছিল। সে মনে হয় নিজেকে একটু আড়াল করে রাখতে চাইছিল। টমও ওকে একটু খুঁটিয়ে দেখছিল। লম্বায় ছয় ফুটের মত; টমের মতই। বেশ মোটা সোটা চেহারা। ওজন অনেক বেশী হবে। মুখের ওপর কাপড় থাকায় কণ্ঠস্বর পালটে গেছিল, এ–ই যে ওদের নেতা তা বুঝতে টমের দেরী হল না কারণ বাকী দুজন তার আদেশের অপেক্ষা করছিল।

ওদের যে নেতা সে ফরাসী ভাষায় বাকী দুজনের মধ্যে যে লম্বা তাকে বলল, তুমি নিচের ঘরে গিয়ে কাজ শুরু করে দাও আর অপরজনকে বলল তুমি দোতলাটা দেখ। নিজে লম্বা কোটের পকেট থেকে একটা রিভলবার বার করে টম আর ডরোথির দিকে তাক করে দাঁড়ালো।

ডরোথি টমের কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিস ফিস করে বলল, ওরা নিশ্চয়ই চার্লসের সুটকেসের জন্য এসেছে।

ওদের নেতা বলে উঠল, উঁহু। কোন কথা নয়। তোমার পেছনে ওটা কি লুকিয়ে রেখেছ বার করা শিগগির।

টমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।

লোকটা ফরাসী ভাষায় চেঁচিয়ে উঠল, কোন চালাকি করার চেষ্টা করো না। হাতে কি আছে ফেলে দাও নাহলে বোকামির বড় মাশুল দিতে হবে।

টম ডরোথির কানে কানে বলল, ওরা যত বুঝবে আমরা ফরাসী নই তত ওরা খোলা মনে আলোচনা করবে আর আমাদেরও ওদের উদ্দেশ্য বুঝতে সুবিধা হবে।

লোকটা আবার চেঁচিয়ে উঠলো। চোপ! আমাকে বাধ্য করোনা আমার এই রিভার ব্যবহার করতে।

টম ডরোথিকে বলল, এরকম বোকার মত আচরণ করো যেন ওদের কথা কিছুই বুঝতে পারছ না। ডরোথি ধীরে ধীরে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে উঠছিল।

এবার লোকটা ইংরাজীতে বলল, কোন কথা নয় ওটা ফেলে দাও।

 টম যেন এতক্ষণে বুঝতে পারল এমন ভাবে হাতের যন্ত্রটা ফেলে দিল। আর লোকটার দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরানোর জন্য ডরোথিকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বলল, আশা করি তুমি এতে বাধা দেবে না, আমার স্ত্রী মোটেই সুস্থবোধ করছে না।

লোকটা বলল, কথা বলল না, যেখানে যেমন ভাবে আছ থাকো।

যে লোকটা নীচে গেছিল সে ফিরে এসে বলল, নীচের ঘরে কিছুই নেই। এদের কোন চাকর বাকর ও নেই, এরা এই বাড়ীতে একাই থাকে।

ঠিক তখনই টেলিফোন বেজে উঠল, ওদের দলপতি বলল, না তার কাটার প্রয়োজন নেই। তাহলেই সন্দেহ বাড়বে। তখন আশ–পাশের বাড়ীতে ফোন করা শুরু হবে। লোকটা নিজের হাতঘড়িটা দেখে নিয়ে বলল, বেশী দেরী নয়, চটপট সব কাজ করো।

পাশের ঘর থেকে অন্যজন এক গোছা কাগজ নিয়ে ঢুকলো।

ডরোথি চিৎকার করে উঠল টম তোমার পাণ্ডুলিপি। ওটা ওদের কী কাজে লাগবে?

টম ডরোথির গালে আলতো চুমু খাওয়ার আছিলায় বলল, শোন, এই সুযোগে তুমি ক্লোসেট থেকে চার্লসের সুটকেশটা বার করে নিয়েই বাথরুমে ঢুকে গিয়ে ভিতর থেকে ছিটকিনি তুলে দেবে। টেলিফোনের শব্দে ওদের একান্ত কথাবার্তা ঢাকা পড়ে গেল।

ডরোথি টমের মনের কথা বুঝে আর সময় নষ্ট করল না। টেলিফোনের শব্দের থেকেও জোরে চেঁচিয়ে বলল, শোন, এই পাণ্ডুলিপি তোমাদের কোন কাজে আসবেনা।…তোমরা কী খুঁজছআমায় বল, আমি তোমাদের তা বের করে দিতে পারি। টমের কাছ থেকে সে কয়েক পা এগিয়ে গেল।

টম ডরোথির সাহস দেখে বেশ আনন্দিত হচ্ছিল। টম চেঁচিয়ে বলতে পারছিল না, কিন্তু ও মনে মনে বলছিল, থিয়া, আরো একটু তাড়াতাড়ি কর। ওই নেতা গোছের লোকটা শোবার ঘর তল্লাশি করছে। ও যে টেবিল ক্লকের দিকেই এগোচ্ছে। সর্বনাশ যদি একবার ঘড়ির পেছনে হাত দেয়। ওহ।

টেলিফোনটা বাজতে বাজতে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল।

 প্রায় এক ঘণ্টা কেটে গেল ডরোথি গুটিগুটি করে আরো কয়েক পা এগিয়েছে।

এই বার লোকটাও একটু ইতস্ততঃ করছিল। ভাবছিল বলবে না বলবে না? অবশেষে খুব সংক্ষেপে বলল, আমরা সেই সুটকেসটার খোঁজ করছি। যেটা তোমরা পুলিশ হাউস থেকে নিয়ে এসেছ।

ডরোথি অবাক হবার ভান করে বলল, সুটকেস!

টম মনে মনে বলল ও থিয়া মাই ডারলিং আর দেরী করো না, লোকটা যে ঘড়ির থেকে আর কয়েক পা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। টম ছটফট করছে।

ডরোথি যেন এতক্ষণে বুঝতে পারল ওরা কী চাইছে। বলল, ও এই সুটকেসটার কথা বলছ তোমরা? বলতে বলতে ডরোথি বসবার ঘরে চলে এল।

মুখোশধারী লোকটা ডরোথিকে ধমকালো, স্টপ, তোমাকে যেতে হবে না। কোথায় আছে শুধু বলে দাও।

ডরোথি ওর ধমকানোর তোয়াক্কা করল না। বলল, তোমরা খুঁজে পাবে না। পুরোন দেওয়াল আলমারী হাজার চেষ্টা করেও তোমরা খুলতে পারবে না। আমাকেই খুলে দিতে হবে।

দুজন মুখোশধারী ছুটে এসে ডরোথির হাত ধরল, ডরোথি তাদের হাত ছাড়িয়ে রেগে গিয়ে বলল, এমন করলে তোমরা সারা রাত ধরে খুঁজে বের করতে পারবে না। আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।

ডরোথি বলল, এই তো এখানে, তোমরা এত বোকা! সত্যিই যে ডরোথি ওদের বোকা বানিয়ে ছাড়ছে এটা ওরা ঘুণাক্ষরেও টের পাচ্ছে না।

সত্যি ওরাও অবাক হলো। এই পুরনো গোছর ক্লোসেট তাদের চোখ এড়িয়ে গেছে। ওরা তিনজনে একসঙ্গে তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

 ডরোথি একটু পিছিয়ে এলো। বসবার ঘরের পরে ডাইনিং স্পেস, তারপর বাথরুম সেখানে দাঁড়িয়েই সে ওদের ক্লোসেট খোলার কায়দা দেখিয়ে দিল।

ওরা তিনজনে দুহাতে চাপ দিল। সঙ্গে সঙ্গে আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপের মত ঘটনা ঘটল। ধড়াস করে ভেতরের একটা লম্বা ড্রয়ার ছিটকে বেরিয়ে এল। ভেতরে সুটকেস। তখন ডরোথি

পিছন ফিরেই ডরোথি দৌড় লাগালো। সব থেকে পেছনে যে লোকটা ছিল সে ডরোথির মতলবটা ধরে ফেলেই ড্রয়ার ছেড়ে ওর পিছনে ধাওয়া করল। লোকটা অন্ধকারে কিচেনের দরজায় ধাক্কা খেয়ে আছড়ে পড়ল। কিন্তু সে তখন মরিয়া ডরোথিকে ধরবার জন্য। ডরোথির কাছে প্রতিটি মুহূর্ত মূল্যবান। পিছন ফিরে দেখা দুরের কথা দম ফেলবার পর্যন্ত সময় নেই। কিচেন পেরিয়ে সে সোজা বাথরুমে ঢুকে গেল।

ভিতরে ঢুকে বাথরুমের কাঠের ভারী দরজাটা ভিতর থেকে লক করে ছিটকিনি তুলে দিল। লোকটার অন্ধকারে অনেক সময় নষ্ট হয়েছে বাথরুমের দরজা খুঁজে পেতেই তাতে বেধড়ক কিল চড় ঘুষি, সপাটে লাথি মারতে থাকল।

ডরোথি ওর নিজের চলাফেরারশব্দ ঢাকবার জন্য বাথরুমের শাওয়ার খুলে দিল, আলো জ্বালল না পাছে ওরা ওর গতিবিধি টের পায়।

ডরোথি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বাথরুমের পিছনের জানালা ধরল। শব্দ যাতে না হয় সেই ভাবে আস্তে আস্তে কাঁচের জানালার ছিটকিনি খুলে ফেলল, জানালা গরাদ হীন, গভীর রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া হু হু করে ঢুকতে লাগল।

খোলা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখল একটু দুরে অ্যাকশিয়া গাছের মগডাল। ডরোথি ভাবলো, আমি কী পারব? যদি না পারি? ওর হাত কাঁপতে শুরু করেছে।না পারলে চলবেনা ওকে পারতেই হবে। ডরোথি জানালায় উঠে বসে একটা পা ঝুলিয়ে দিল। পায়ের কাছে একটা ডাল পেয়ে গেল। ওই ডালটা ওর ভার সামলাতে পারবে তো? পারবে নাই বা কেন? ডরোথি ভাবল। এই গুলোই তো অনেক সময় ছাদ ফুটো করে ওঠে যায়। যাই হক ওকে তো বাঁচতে হবে সেই সঙ্গে টমকেও

ডরোথি কিছুনা ভেবেই ডাল ধরে শূন্যে লাফ দিল। পরিণতি সম্বন্ধে ওর কোন ধারণাই নেই। উল্টে পড়ল গাছের ডাল পালার মধ্যে। চোখে মুখে খোঁচা খেল, হাত পা যেখানে সেখানে ছড়ে গেল।

ফুট তিনেক উপরে ডরোথি দোল খেল। ওই ডালটার জন্য ও সরাসরি পড়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচলো। আস্তে করে ও ঘাসের উপর লাফিয়ে পড়ল। উঠে দাঁড়ানোর জন্য ও পা সোজা করতে পারছিল না। তবু তাকে ছুটতে হবে। কোন রকমে দুলতে দুলতে নিজেকে সে টেনে নিয়ে চলল।

টমের ভীষণ দুঃশ্চিন্তা হচ্ছিল ডরোথি কী পারবে?মুখোশধারীগুলো সুটকেস নিয়ে কি করছে সেদিকে টমের কোন লক্ষ্য ছিল না। ওকান পেতে শোনার চেষ্টা করছিল। দরজায় লাথির আওয়াজ সব শুনছিল টম। তার পর সব শব্দ থেমে গেল। টম কোন মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনতে পেল না বা ধস্তাধস্তির আওয়াজও পেল না। এদিকে অন্য দুজন যারা সুটকেশ নিয়ে ছিল তাদেরও অন্য সঙ্গীটির দিকে ভ্রূক্ষেপ ছিল না তারা সুটকেশ নিয়ে ব্যাস্ত।

যে লোকটা ডরোথির পিছনে ধাওয়াকরেছিল, সে ফিরে এল। কোন উৎকণ্ঠা নেই। খুবই সহজ ভাবে বলল, মেয়েটা বাথরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। থাক, বাথরুমেই থাক।

ওরা চার্লসের সুটকেশটা পোকা বাছার মত খুঁটিয়ে দেখছে প্রতিটি জামা প্যান্ট, পাসপোর্ট বিমান যাত্রার টিকিট হোটেল রিজাভেশন স্লিপ। যে কোনও রকম হাতের লেখা। দুটো পেপার ব্যাক এমন কী ম্যাগাজিনের প্রতিটি পাতা কোন কিছুই বাদ গেল না।

হু হু করে সময় চলে যাচ্ছে। তবু তাদের তল্লাশি শেষ হচ্ছে না। যদি নিশ্চিত হবার মত কোন আশ্বাস মেলে, কিন্তু সবই বৃথা।

ওদের নেতার হাবভাব দেখে টমের বুঝতে অসুবিধা হল না যে সে ক্রমেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলছে। টমের দুর্ভাবনা ক্রমে বেড়ে যেতে লাগল। সুটকেসে কিছু না পেয়ে এবার ওরা নিশ্চয়ই ওকে নিয়ে পড়বে। এখান থেকে পালানোর একটাই পথ বসবার ঘরের খোলা জানালা। কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে গেলে টমকে দুজন মুখোশধারীকে আহত করে যেতে হবে। কিন্তু এটা চিন্তা করা একেবারে ছেলে মানুষী। দিস্ ইস ইমপসিবল।

ওদিকে ওদের খোঁজা শেষ হচ্ছে না, খনিতেও বুঝি এভাবে হীরে খোঁজা হয় না। সুটকেশের লাইনিং কিছুই বাদ দিচ্ছে না। দুজন সুটকেস নিয়ে ব্যস্ত। অন্যজন টমের কাছেই ঘুর ঘুর করছে কোন পথ নেই। হঠাৎ টমের সেই লোহার দণ্ডটার দিকে চোখ পড়ল–কিন্তু টম হতাশ হল–ওদের তিনজনের হাতে তিনটে রিভলবার। না! কিছুই বুঝি করার নেই।

হঠাৎ টমের একটা বুদ্ধি খেলে গেল। মাঝখানে দরজা তার বাঁ–দিকে নীচে নামার সিঁড়ি। ডানদিকের ঘরে ওরা সুটকেস নিয়ে ব্যাস্ত। অন্যজন ওর কাছেই রয়েছে।

জীবন মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে একটা ঝুঁকি তাকে নিতেই হবে। টম হঠাৎ বলে উঠল, তোমরা যদি কোন বই বা ডায়েরী খুঁজে থাকো তাহলে তার সন্ধান আমি দিতে পারি। এই ঘরে যে টেবিল ক্লকটা আছে তার পিছনেই পাবে। সেখানে একটা চিঠিও আছে।

বলার সঙ্গে সঙ্গে তিনজনে লাফিয়ে উঠল। যে টমের কাছে ছিল সে দাঁড়িয়ে রইল বাকী দুজন সুটকেস ফেলে ছুটে এল।

টম বলে চলল, এটা একটা চিঠির কপি মাত্র। এর আরো চারখানা কপি ইতিমধ্যে নির্দিষ্ট ঠিকানায় দেওয়া হয়ে গেছে। রিকনীলে যদি ভাবে এখানে একটা ডাকাতি করিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করবে তা তার মূখামি ছাড়া আর কিছুই নয়।

তোমরাও ঠিক তেমনই মূর্খ। টম বলল, রিক নীলেকে এতক্ষণে পেন্টাগন ন্যাটোর গোয়েন্দা দপ্তর চিনে ফেলেছে। এখন শুধু বাকী তার ধরা পড়া।

টমের এই কথাগুলো কাজ করল। একজন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, তাকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত মনে হল। অন্য দু–জন কিন্তু থামল না। তাদের একজন ঘড়ির কাছে ছুটে গেল আর কাগজগুলো সব টেনে বের করল। বলল–এই তো সেই চিঠি আর বই।

যে মুখোশধারী লোকটা টমের পাশে ছিল সে স্বাভাবিক কারণেই ভীষণ অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। টম ভাবল এটাই মস্ত বড়ো সুযোগ, এই সুযোগ হারালে চলবেনা। কেননা টম বুঝেছিল মুখোশধারীরা সব কিছু পেয়ে গেলে তাকে আর জ্যান্ত রেখে যাবেনা। তাই তার আগে এই একটাই উপায়। সেটা তাকে যেভাবে হোক কাজে লাগাতে হবে।

টম চোখের পলকে মেঝেতে পড়ে থাকা লোহার দণ্ডটা উঠিয়ে নিল। আর পাশের লোকটা কিছু বুঝে ওঠার আগে মুহূর্তে সজোরে দণ্ডটির ছুঁচালো দিকটা বসিয়ে দিল তার উরুর, মধ্যে। লোকটা তীব্র যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল….

অন্য দুজন মুখোশধারী লোক কিছু বোঝার আগেই টম দিগবিদিগ জ্ঞান শূন্য হয়ে তীরের বেগে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে শুরু করল।

অন্ধকারে রিভলবার ঝলসে উঠল, একটা নয় পর পর এলোপাথারি গুলি চলতে লাগল। দেওয়ালের চুন বালি খসতে লাগল,–নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান হতে লাগল। তবু গুলির বৃষ্টি থামল না।

.

এদিকে ব্রাডকে এর পরের কাজ সম্বন্ধে জানিয়ে ফিরতে টনি লটনের একটু দেরীই হয়েছিল। গুলির শব্দ শুনতে ওর একটুকুও ভুল হয়নি।

রাস্তার মোড়ে গাড়ী রেখে তার কোমর থেকে রিভলবারটা হাতে নিয়ে নিল। টমের বাড়ীতে একটা ছায়ামূর্তি দেখে টনি নিজেকে সঙ্গে সঙ্গে আড়াল করে নিল।

 ছায়া মূর্তিটা কাছে আসতেই টনি তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।

লোকটা আচমকা আক্রমণে মাটিতে পড়ে গিয়ে ভয়ে বলতে লাগল, আমি পাশের বাড়ীর দারোয়ান অগস্তে। গুলির আওয়াজ শুনে এদিকে দেখতে এসেছি ডাকাত পড়েছে কিনা। যদি কোন সাহায্য করতে পারি।

টনি বলল, আচ্ছা তুমি এখানেই থাকো।

টনির পোষাক আর পিস্তল দেখে অগস্তে বুঝতে পারল, যাই হোক এ ডাকাত দলের লোক নয়।

টনি জিজ্ঞাসা করল, তুমি কাউকে দেখতে পেয়েছ?

অগস্তে বলল, না, স্যার।

তারপর হঠাৎ অগস্তে টনির হাতটা চেপে ধরে বলল, মনে হচ্ছে ওই ঝোঁপের ভেতর দিয়ে কেউ যেন বেড়িয়ে আসছে।

টনি ভালো করে নিরীক্ষণ করে অগস্তের হাত ধরে টান দিল, বলল, মনে হচ্ছে আহত টলতে টলতে হাঁটছে।

মূর্তিটা ঝোঁপ থেকে বেড়িয়ে এগিয়ে এলে তাকে স্পষ্ট দেখা গেল।

টনি অগস্তের হাত ছেড়ে তার দিকে এগোতেই পায়ের শব্দ পেয়ে ডরোথি পিছন দিকে ছুটতে শুরু করল।

টনি চেঁচিয়ে উঠল, ভয় পাবেন না, আমি টনি, থামুন।

ডরোথি টনির গলার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ালো। তারপর দুহাতে মুখ ঢেকে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

টনি কাছে আসতেই ডরোথি আর কিছু বলতে পারল না, শুধু বলল, মিঃ লটন, টম টম।

টম কোথায়? টনি জিজ্ঞাসা করল।

 ডরোথি বলল, বাড়ীতে।

একা?

না ওর সঙ্গে আরো তিনজন মুখোশধারী ডাকাত রয়েছে। প্লিজ আপনি টমকে বাঁচান, তাড়াতাড়ি করুন, টম একা

অগস্তে বলল, স্যার আমি কী গাছ বেয়ে ওপরে উঠে যাবো?

টনি বলল, উঠে কোন লাভ নেই। তুমি বরং মিসেস কেলসোকে দেখো আমি দেখছি কি করা যায়।

টম বাড়ী থেকে বেড়িয়ে ওই গাছটার আড়ালে লুকিয়ে ছিল।

ওর কানে ওদের কথাবার্তা আসছিল। কিন্তু ঠিক হদিশ করতে পারছিল না; মেয়েলি কণ্ঠের আওয়াজ শুনে ডরোথিকে চিনতে ভুল হল না। তাহলে ডরোথির কোন ক্ষতি হয় নি।

ডরোথিকে ডাকতে গিয়েও ডাকতে পারল না টম, ওর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না। অগস্তে পায়ের শব্দে আর টমের গলার ঘড়ঘড় শব্দে চেঁচিয়ে উঠল, কে ওখানে?

টনি বাড়ীতে ঢোকার জন্য এগিয়ে গেছিল, অগস্তের চিৎকার শুনে পিস্তল তাক করে দাঁড়ালো।

টম চেঁচিয়ে উঠল, এদিকে গুলি ছুঁড়বেন না, আমি টম

 টনি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, টম!

টম ডরোথির দিকে তাকিয়ে বলল, থিয়া তুমি ঠিক আছে তো?

ডরোথি বলল, হ্যাঁ টম আমি খুব ভালো আছি। ডরোথি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।

 টম ডরোথিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ভেঙে পড়ো না থিয়া সব ঠিক হয়ে যাবে।

টনিকে বলল টম, টনি, ওদের মধ্যে একজন যে রিকনীলে ছিল সে বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।

টনি জিজ্ঞাসা করল, গেরস্কি ছিল?

টম বলল, আমি তো গেরস্কিকে চিনি না। তাই ঠিক বলতে পারবো না, তবে তাদের মধ্যে মুস্কো চেহারার একজন ছিল।

টনি বলল, গেরস্কির চেহারাটাও তো অনেকটা ওই রকম। ওরা কী এখনও তোমার বাড়ীতে আছে?

টম বলল, না, আমি আড়াল থেকে দেখেছি একজনকে ওরা কাঁধে ঝুলিয়ে গিয়ে চলে গেল।

 টনি বলল, কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে?

 টম বলল, হ্যাঁ আমি একজনকে লোহার দণ্ড দিয়ে আচমকা ঘায়েল করে পালাই।

টম টনিকে বলল, ওরা চার্লসের সুটকেশের খোঁজেই এসেছিল। ওরা কেটি কোলিয়ার–এর এপার্টমেন্টের কথা বলছিল।

টনি বলল, ওরা এখন নিশ্চয়ই কেটি কোলিয়ার–এর বাড়ীতে যাবে। চার্লসের সুটকেশে কী কিছু ছিল?

— টম উত্তেজিতে হয়ে পড়ল, ছিল ছিল অনেক কিছুই ছিল শ্যানডন হাউসের কথা, ন্যাটোর মেমোরেন্ডামের কথা,কীভাবে রিকনীলে ওকে বোকা বানিয়ে মেমোরেন্ডাম হাতিয়েছে; চার্লসের নিজের ভুল বোঝার কথা। ওয়াশিংটন পোস্টে যখন খবরটা বেড়িয়ে পড়ে তখন চার্লস ওর ভুল বুঝতে পারে। আর তখনই ওদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া শুরু হয়। চার্লস রিককে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দেয়, হয় সে এখানকার সমস্ত কাজকর্ম গুটিয়ে নিয়ে চলে যাবে নচেৎ চার্লস শ্যানডন হাউসের ডিরেক্টরকে সব কিছু জানিয়ে চিঠি দেবে। সেই চিঠিটাও ছিল।

টনি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল, আর দেরী করা চলবে না, এখুনি কেটি কোলিয়ার–এর বাড়ী ঘেরাও করতে হবে। 

টম বলল, আমিও যাবো।

টনি বলল, না তোমার যাবার দরকার নেই কেননা ডরোথিকে একা বাড়ীতে রাখা ঠিক হবে না। আমি ব্রাড জিলনকে নিয়ে এখুনি রওনা হচ্ছি।

টনির চোখ মুখ পাথরের মত শক্ত হয়ে উঠল। কোনোভ মৃত, এখন গেরস্কি আর রিক নীলে, তাহলে রিক নীলে নিশ্চয়ই অ্যালেক্সি।

টনি টমকে বলল, টম, তোমায় এত কষ্ট পেতে হল বলে দুঃখিত। গুড নাইট টম, গুড নাইট ডরোথি।

.

১৮.

 কেটির ঘরে ওরা গিয়ে উঠেছিল। রিক নীলে অশান্ত ভাবে ঘোরাঘুরি করছিল, আর অনেক কিছু ভাবছিল।

পাশের ঘরে গেরস্কি, পোষাক পাল্টে তৈরীহয়ে নিচ্ছিল। এখুনি ওদের বেড়িয়ে পড়তে হবে।

 রিক এই গেরস্কি লোকটাকে ঠিক চিনতে পারছেনা। লোকটা এখনো পর্যন্ত কোন কথা বলছে না।

রিক ভাবছে, মিশচার–এর এই আবিষ্কারের কথা। কি নিষ্ঠুর আর ভয়ঙ্কর ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।

রিক ভেবেছিল, ওয়াশিংটনে দেখা হবার পর আর হয়ত এই লোকটার সঙ্গে ওর দেখা হবে না। কিন্তু ভাগ্যের এমন পরিহাস এই লোকটা, যে ওলেগ নামে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে তার হাতে ও আজ পুতুল হয়ে গেছে।

লোকটার এতটুকু সহানুভূতি নেই। কোন কাজেই সে সন্তুষ্ট হয় না। এই যে টম কেলসোর বাড়ী থেকে কত বুদ্ধি খাটিয়ে রিক ওদের এখানে নিরাপদ স্থান নিয়ে এলো এর জন্য ওর মনে এতটুকু কৃতজ্ঞতা নেই। অথচ এই রিক নীলে না থাকলে ওরা কিছুতেই পালিয়ে বাঁচত না। আর এই লোকটার কী নিষ্ঠুর আচরণ!

রিক বুঝতে পারছে গেরস্কি সব কিছুর জন্য তাকেই দোষারোপ করছে। টমের বাড়ীতে এই ডাকাতি করার পরিকল্পনা গেরস্কিরই অথচ এখন উল্টে ওকেই চেপে ধরবে।

গেরস্কি পাশের ঘর থেকে পরিষ্কার জামা–প্যান্ট পরে বেরিয়ে এলো। সে বেরিয়ে যাবার জন্য তৈরী।

গেরস্কির মুখ গম্ভীর, থমথমে চোখ। চোখ তুলে রিককে দেখল।

রিক নিজের অজান্তেই একটু কেঁপে উঠল।

 গেরস্কি বলল, তুমি তৈরী? বলেই যাবার জন্য পা বাড়ালো।

 রিকও পুতুলের মত ওকে অনুসরণ করল।

এদিকে টনি আর ব্রাড জিলন যখন কেটি কোলিয়ার–এর বাড়ী পৌঁছালে তখন কেটি কোলিয়ার–এর শূন্য ঘর, খোলা দরজা তাদের বিদ্রূপ করে উঠল। অন্ততঃ মিনিট খানেকের মত তারা দুজনে কথা বলতে পারল না।

অবশেষে ব্রাড জিলন কথা বলল। তাহলে নীচে যে ফিংগার প্রিন্ট এক্সপার্টদের দাঁড় করিয়ে রেখেছ তাদের তো আর প্রয়োজন নেই। আসল লোকই তো পালিয়েছে। বরং এখন আমাদের উচিৎ সমস্ত প্রিসিঙ্কট–এ খবর দেওয়া যে কোন সাইট্রোন কার দেখলেই আটক করা। আর সব রাস্তা যেন ব্লক করে দেয়।

টনি তার এই বার বার ব্যর্থতা সহ্য করতে পারছিল না। কিন্তু গেরস্কি যে এত তাড়াতাড়ি এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে পালাবে তা টনি চিন্তা করতে পারেনি।

ব্রাড টনিকে তাড়া দিল। বেশী দেরী করা ঠিক হবে না।

টনি বলল, না ঠিক হবে না। ব্রাড, পরাজয় আমাকে ক্লান্ত করে দিয়েছে। ওহ যদি ওই শয়তান দুটোকে ধরতে পারতাম…

 ব্রাড টনিকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, টনি ভেঙ্গে পড়োনা।হয়ত এবার আমরা জিতবো। ওরা কতদূর আর যেতে পারবে? আমি এয়ারপোর্ট, স্টেশন সব জায়গায় সতর্ক করে দিচ্ছি। ওরা যেন কোন মতেই ওয়াশিংটন ছাড়তে না পারে। এখন ওরা আর আমাদের অপরিচিত নয়। ওদের পরিচয় আমরা পেয়ে গেছি।

টনি বলল, আমি ফিংগার প্রিন্ট এক্সপার্টদের এনেছিলাম এই জন্যই, ন্যাটোর মেমোরেন্ডামের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে চার্লসের আঙ্গুলের ছাপ ছাড়াও আরো ছাপ পাওয়া গেছে। সেটা কার দেখার জন্য। বুঝতেই পারছি এ রিক নীলে ছাড়া আর কারোর নয়।

.

রিক গাড়ী চালাচ্ছিল, পাশে গেরস্কি বসেছিল। কেউ কোন কথা বলছে না।

নিউইয়র্ক ছাড়তেই গেরস্কি বলল, ওয়াশিংটনের পথ ধরো।

রিক চুপচাপ ওর হুকুম পালন করল। রিক ঠাণ্ডায় কাঁপছিল। গাড়ীর কাঁচ তোলাই ছিল। হতে পারে তার ভিতরের অবসন্নতা–ওকে শীতল করে তুলছিল।

লোকালয় ছেড়ে নির্জন মাঠের মধ্যে দিয়ে গাড়ী ছুটছিল। আবার দুজনের মাঝে নিস্তব্ধতা।

হঠাৎ গেরস্কির অনুযোগে রিক চমকে উঠল।

 গেরস্কি ঠাণ্ডা গলায় বলল, তোমার জন্যই ফেলিক্সকে এমন আহত হতে হল।

রিক ওর কথায় আহত হল। আমার জন্য! আমার জন্য ফেলিক্স আহত হল! আমি এর জন্য দায়ী?

গেরস্কি বলল, আমি মনে করি। তুমি যদি চার্লস কেলসোকে আয়ত্তে রাখতে পারতে, তাকে আরো সু–পরিকল্পিত ভাবে কাজে লাগাতে পারতে তাহলে আজ এমন ঘটনা ঘটত না।

রিক বলল, এর থেকে আর বেশী কী করতে পারতাম! ও আমাকে ভয় দেখাতে শুরু করল। আমি ওকে থামাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু ও ছিল একেবারে নাছোড়বান্দা। তখন আমি ওর কাছ থেকে কিছু সময় চেয়ে নিই। তাতে তোমার সুবিধা হয়।

গেরস্কি বলল, সুবিধা! কি সুবিধা হয়েছে? চার্লসের মৃতদেহ আবিষ্কারের মধ্যে যে সময়টুকু আমি পেয়েছিলাম তাতে কী ওর সব কিছু তল্লাশি নিতে পারতাম। তোমাদের মধ্যে যে এরকম ব্যবধান তৈরী হচ্ছে তা তো আমার জানার কথা নয়। যখন আমরা চার্লসকে নিয়ে ব্যস্ত তখন তুমি ওর কোয়াটারে থাকতে পারতে তাহলে যা খুজতে আমাদের এত হয়রানি হতে হল তার কোন কিছুই হতো না। চুপচাপ সব কাজ সারা হয়ে যেত। কিন্তু তুমি কী করলে, না আমাদের সঙ্গে চালাকি করতে গেলে!তুমি আরো কী করলে অজুহাত দেখিয়ে অন্য জায়গায় থাকতে চলে গেলে। যাতে তুমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণিত করতে পারো। যেন চার্লসের মৃত্যুতে তোমার কোন হাত নেই।

 একটু থেমে গেরস্কি বলল, কাছে না এসে তুমি গোমেজের মত দূরে দাঁড়িয়ে নজর রাখতে পারতে। আর গোমেজহা, গোমেজ একটা মহামূর্খ। ও পুলিশের হেফাজতে চলে গেল। যদি এটা প্রমাণ হয় যে শ্যানডন হাউসে ইলেকট্রিসিয়ানদের মধ্যে সেও একজন, তাহলে–গেরস্কি রিকের দোষগুলোকে আবৃত্তির মত আওড়ে গেল। তুমি বলেছিলে চার্লস কেলসো তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে। তুমি যদি এখান থেকে চলে না যাও তাহলে ও চিঠি লিখতে বদ্ধপরিকর। সবই তো বুঝলাম কিন্তু তুমি তো একবারও বলনি যে, ওর চিঠি লেখা হয়ে গেছে।

রিক মিনমিন করে উঠল। চিঠি তোত লেখা হয়নি। চিঠির একটা খসড়া তৈরী করেছিল মাত্র।

গেরস্কি চড়া গলায় বলল, মোটেই না। আমার কাছে একটা কপি আছে। এর থেকে আরো চারটে কপি হয়েছে। ওরিজিন্যাল না থাকলে তার কপি হয় না। এটা একটা বাচ্চাও জানে। সিলমোহর দিয়ে ডাকে পাঠাবার জন্য তৈরী। চিঠির কপিগুলো কাকে কাকে পাঠাতে যাচ্ছে তা কী তোমাকে বলেছে?

রিক একটু জোর গলায় বলল, ও শুধু আমায় ভয় দেখিয়েছিল, চিঠির খসড়া তৈরী করেছিল।

গেরস্কি বলল, আর তুমি আহাম্মকের মত তা বিশ্বাস করেছিলে।

 ও হয়ত ওর ফ্ল্যাটে লুকিয়ে রেখেছিল। আমায় বলেনি, রিক বলল।

গেরস্কি এবার চেঁচিয়ে উঠল, তোমার কথা শুনে বিশ্বাস করে যেভাবে তল্লাশি করেছি তাতে সাগর থেকে মুক্তো তোলার থেকেও বেশী।

কিন্তু নীলে, আমি বাধ্য হচ্ছি বলতে যে তোমার ভাগ্য তোমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে।

 রিকের কণ্ঠ কেঁপে গেল, তাহলে হয়ত ও আমাকে মিথ্যে ভয় দেখিয়েছিল আসলে কোন খসড়াই নয় ওটা।

আর ডাকে পাঠাবার মত কোন চিঠিই ছিল না? গেরস্কি রিককে বিদ্রূপ করল। চমৎকার! ইডিয়েট! টমের কাছে লেখা চিঠিটা ভালো করে পড়ে দেখেছ? ওতেই পরিষ্কার লেখা আছে।

একটা চিঠি নিশ্চয়ই আছে সেটা এমন লোকের কাছে আছে যাকে চার্লস বিশ্বস্ত বলে মনে করে। আর সে যখনই চার্লসের মৃত্যু সংবাদ শুনবে তখনই হয় সেটা ডাকে দিয়ে দেবে, না হয় খুলে পড়বে। দুটোই আমাদের ক্ষেত্রে বিপদজনক।

গেরস্কি খুব ধীরে ধীরে বলল, আর সেই কারণেই তোমার আর এখানে থাকা চলবে না। তুমি পদত্যাগ কর। আর ওয়াশিংটন থেকে চলে যাও। আমার দুজন লোক তোমায় নিরাপদে মস্কো রেখে আসবে।

রিক চমকে উঠল, মস্কো? রিক এতটা ভাবতে পারেনি। সঙ্গে সঙ্গে রিক মনে মনে একটা চিন্তা করল, এ নিশ্চয়ই গেরস্কির চাল। ওকে এখান থেকে সরিয়ে নিজে জেঁকে বসতে চায়। কিন্তু এটা অসম্ভব। রিক আমেরিকার প্রাচুর্যের মধ্যে যেভাবে দিন কাটিয়ে এসেছে তাতে মস্কোর কঠোরতার মধ্যে ও কিছুতেই নিজেকে মানাতে পারবে না।

রিক ভাবল, না!সব চিন্তা দূর করে গেরস্কির সঙ্গে অন্য ভাবে মুখোমুখি হতে হবে। এই খুনীটার সঙ্গে খুনীর মতই ব্যবহার করতে হবে।

রিক ওর উত্তেজনা চেপে রইল, তাকে প্রকাশ হতে দিল না।

রিক শান্ত গলায় বলল, কিন্তু আমি পদত্যাগ করলে চলবে কী করে? আমি চলে গেলে সে সব কে দেখবে? নতুন কেউ কি পারবে?

গেরস্কি বলল, ফেলিক্স পারবে।

রিক বুঝতে পারল ও নাছোড়বান্দা। গেরস্কি তৈরী হয়েই এসেছে। ফেলিক্সের নাম মিছিমিছি বলছে। আসলে ওর মতলব অন্য। তবু শেষ চেষ্টা করার মত রিক বলল : শ্যানডন হাউসে আমার মত কেউ নজর রাখতে পারবে না। ওর নাড়ী নক্ষত্র আমার মুখস্থ আর শ্যানডন যদি আমাদের হাতছাড়া হয় তাহলে ওয়াশিংটন থেকে আমাদের পাততাড়ি গোটাতে হবে।

রিক তখন অন্য কথা ভাবছে। যদি গেরস্কি ওর কথায় একটুকুও না গলে তাহলে অন্য পথ দেখতে হবে। ও নিজেকে পালটে ফেলবে। ওর গায়ে কেজিবির পোশাক আর রাখবে না। রিক নিজে নতুন জীবন শুরু করবে।

টনি লটনের কথা রিকের মনে পড়েছে আগেই। রিক টনি লটনের কাছে নিজে হাজির হবে। তাকে সব কিছু বলে দেবে। বলবেঃ আমি সত্যিকারের একজন আমেরিকান নই। হাইনরিক নীলে ও আমার নাম নয়। আমার জন্ম উনিশ শ একচল্লিশে ব্রুকলীনে আমি সাইমাস নোসকা।

জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক থেকে উনিশশো তেষট্টিতে আমি পালিয়ে আসি তখন কেজিবির একজন শিক্ষিত গোয়েন্দা হিসাবে আমার নতুন নামকরণ হয় হাইনরিক নীলে।

তারপর উনিশশো পঁয়ষট্টি থেকে ওয়াশিংটনে কেজিবির গোয়েন্দা দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করতে থাকি।

কিন্তু এখন আমি ওদের কার্যপদ্ধতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছি না। হত্যা খুন এসব আমার ভালো লাগেনা। চার্লস কেলসোর মৃত্যুতে আমি মর্মাহত। তাই আমি এখন আপনার আশ্রয় চাইছি।

গেরস্কি চেঁচিয়ে উঠল,কী অত ভাবছ? তোমার ভীষণ পরিশ্রম গেছে। গেরস্কির কণ্ঠে মোটেই সহানুভূতি ছিল না। তার ওপর তোমার বন্ধু চার্লসের মৃত্যু তোমাকে ভীষণ মর্মাহত করেছে। তাই তোমার স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য দুসপ্তাহের বিশ্রাম অবশ্যই প্রয়োজন।

রিক বলল, দু–সপ্তাহ কেন, কোন বিশ্রামই আমার প্রয়োজন নেই। আমার শরীর ঠিক আছে।

গেরস্কি আদেশের সুরে বলল, তাই নেবে। এখানকার কাজ সারতে দু–সপ্তাহ সময় লাগবে যদি আরো বেশী লাগে তাহলে তোমায় ছুটি বাড়াতে হবে। কিন্তু ছুটি তোমায় নিতেই হবে।

রিক বলল, তাহলে দেখছি তুমি শ্যানডন হাউস হাতছাড়া করতে চাইছ।

গেরস্কি বলল, সে নিয়ে তোমায় মাথা ঘামাতে হবে না। কিছুদিন আমরা চুপচাপ থাকবো। তারপর আবার নতুন করে শুরু করব। শ্যানডন হাউসের ওপর এখন ন্যাটোর নজর পড়েছে। ওই স্থান এখন আমাদের পক্ষে বিপদজনক।

রিক বলল, আমার মাথায় ঢুকছে না ন্যাটো এখানে কি করে আসতে পারে?

গেরস্কি হেনস্থা করে বলল, তোমার মত মূর্খদের মাথায় কিছু আসে না। যদি তোমার ঘটে একটু বুদ্ধি থাকত তাহলে দেখতে পেতে ইতিমধ্যে ন্যাটোর তিনজন এজেন্ট ভীষণ তৎপর হয়ে উঠেছে, তাদের মধ্যে একজন এমিল বাহেরেন, একজন জর্জেস ডিসপিনার্ড এবং তৃতীয় জন টনি লটন।

টনি লটনের নামটা শুনে রিক চমকে গেলেও সহজ ভাবে বলল, টনি লটন যদি একজন ন্যাটো এজেন্ট হয়ও–তাহলেও তার শ্যানডন হাউসের ব্যাপারে কী আগ্রহ থাকতে পারে? আমরা তো সব দিকেই নজর রেখেছি।

গেরস্কি গম্ভীর গলায় বলল, তোমার জন্যই ন্যাটো উৎসাহিত হয়ে উঠেছে। গত তিনমাস ধরে ওরা তোমাকে ফলো করছে। যদি টম কেলসোর কথা সত্যি হয়।

রিক বলল, টম কেলসো মিথ্যে কথা বলেছে, ও কতটুকু জানে? গেরস্কি বলল, টম কেলসো নয়, তার অনেক আগেই আমি খবর পেয়েছি, তাই টমের কথা আমি অবিশ্বাস করতে পারিনি।

রিক উত্তেজিত হল, না! আমাকে কেউ ফলো করছেনা। তাহলে আমি ঠিক বুঝতে পারতাম।

গেরস্কি বলল, তুমি আমার সঙ্গে তর্ক করছ?

রিক বলল, তর্ক নয়, আমি তোমাকে বলতে চাইছিযখন একজন লোকের ওপরে বিরুদ্ধ পক্ষের সন্দেহ হয় তখন তারা তাকে চটপট ধরে না। কোন বড় কিছুর জন্য অপেক্ষা করে। কাজেই

রিকের কথা মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে গেরস্কি বলল, তোমার কোন কথা আমি শুনতে রাজী নই। তোমার ব্যাপারে আমাদের সব ঠিক হয়ে গেছে। কাজেই তোমাকে আর একটা দিনও থাকতে দেওয়া যাবে না। কারণ তাতে কেজিবির বিপদ হতে পারে।

গাড়ীটা একটা গাছের কাছে দাঁড় করিয়ে রিক ওর পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিল পিস্তলটা ঠিক আছে কিনা।

গেরস্কি একটা কাগজ বের করে গাড়ীর আলোটা মেলে দিল।

তারপর কাগজটা রিকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, নাও চটপট এতে একটা ছুটির দরখাস্ত লিখে ফেল।

রিক একটু ঘুরে বসল, গেরস্কির হাত থেকে কাগজটা নিয়ে নিল। আর পেন বার করার অছিলায় পিস্তলটা বার করতে গেল।

কিন্তু তার আগেই রিক তার ঘাড়ের কাছে একটা ঠাণ্ডা স্পর্শ পেল বুঝতে অসুবিধা হল না ওটা গেরস্কির পিস্তলের নল। গেরস্কি যে কত বড় শয়তান তা রিক পদে পদে টের পাচ্ছে।

রিক একটু মুচকি হেসে বলল, না, অতটা প্রয়োজন হবে না। আমি পেনটা খুঁজছিলাম।

গেরস্কি পিস্তলেরনলটা রিকের ঘাড়ের কাছে আটকে রেখে বলল, নিজেকে অত চালাক ভেবো না অ্যালেক্সি। তোমার থেকেও চালাক লোক এই দুনিয়াতে আছে জেনে রেখো। নাও চটপট করো, বেশী সময় নষ্ট করা  যাবে না।

রিক চুপচাপ ছুটির দরখাস্ত লিখতে শুরু করল। কিন্তু মনে তার একটাই চিন্তা। এই দরখাস্ত হাতে পেলে গেরস্কি কী করবে? একটা বুলেট দিয়ে কাজ সারবে না তো? অসম্ভব তো কিছু নয়। এতক্ষণ পর্যন্ত রিক ওর যা পরিচয় পেয়েছে তাতে ওর পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়। হয়ত রিককে খুন করে গাড়ীটা জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যাবে আর রিকের দেহটা গাড়ীর মধ্যে পুড়ে ছাই হয়ে পড়ে থাকবে। কালকের কাগজে একটা খবর বেরুবে–হাইওয়েতে একটা সামান্য অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। চালক সমেত গাড়ীটা পুড়ে গেছে। ব্যাস এই পর্যন্ত। রিক কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।

রিক হঠাৎ লেখা থামিয়ে বলল, গেরস্কি তোমার ব্যাপারে আমি নিজেকে খুব একটা নিরাপদ মনে করছি না। তুমি গাড়ী থেকে না নামলে আমি এই দরখাস্ত লিখবো না।

গেরস্কির মুখে বিদ্রুপের রেখা ফুটে উঠল। মুচকি হেসে গেরস্কি বলল, ঠিক আছে তাই হবে। তুমি যদি তাতেই নিরাপদ মনে কর। তোমার পিস্তলটা বের করে আমায় দিয়ে দাও।

রিক মনে মনে ভাবল, লোকটা কি ভীষণ চালাক। ওটাই রিকের শেষ সম্বল ছিল।

গেরস্কি বলল, তোমার যেমন নিরাপত্তাবোধ আছে, আমারও তেমন থাকতে পারে।নাও চটপট করো। আর একটা কথা মনে রেখো, চালাকি করে তুমি বাঁচতে পারবে না। আমরা আমাদের প্রয়োজনে যেমন বাঁচিয়ে রাখি তেমনই প্রয়োজন ফুরোলে সরিয়ে দিতে দ্বিধা করি না।না! তোমার প্রয়োজন এখনো ফুরোয়নি। তুমি হচ্ছ আমাদের সেরা এজেন্ট। তাই তোমাকে এখুনি মেরে ফেলতে পারি না।

রিক ভাবলো পিস্তল না থাকলেও গাড়ীটা তো তার কাছে থাকছে। গেরস্কি নেমে গেলেই গাড়ী স্টার্ট করে পালাবে। রিক মনে মনে একটু আনন্দিত হল।

রিক অসহায় ভাবে নিজের পিস্তলটা বের করে গেরস্কির দিকে এগিয়ে দিল। রিক মনের চিন্তা ভাবনাগুলো মনেই চেপে রাখলো।

রিক বলল, নাও, তুমি এবার নেমে যাও।

গেরস্কি বলল, নামছি নামছি। অত ব্যস্ত হচ্ছ কেন? তুমি তোমার লেখা চালিয়ে যাও। রিক বাধ্য ছেলের মত আবার লিখতে শুরু করল। গেরস্কি যেই গাড়ী থেকে মাটিতে পা রেখেছে রিক সঙ্গে সঙ্গে পেনটা ছুঁড়ে ফেলে গাড়ী স্টার্ট করবে বলে হাত বাড়ালো।

হঠাৎ একটা ভীষণ আওয়াজ, গুড়ুম! আর গাড়ীটা কেঁপে উঠল।

রিক ভেবেছিল, গেরস্কি বুঝি ওকেই গুলি করেছে। কিন্তু ওতো অক্ষত। সঙ্গে সঙ্গেই সব কিছু বুঝে ফেলল। গেরস্কি টায়ারে গুলি করে ফাটিয়ে দিয়েছে। গাড়ীটা একদিকে কাত হয়ে গেছে। রিকের হাত পা অসাড় হয়ে গেল। রিক আর কিছু ভাবতে পারল না।

গেরস্কি যেন কিছুই হয়নি এমন ভাবে হাসতে হাসতে রিকের কাছে এগিয়ে এসে বলল, দাও চিঠিটা দাও।

.

১৯.

 ওয়াশিংটন পোস্টে পরের দিন দুটো দুর্ঘটনার খবর বের হলো।

প্রথমটি খুবই সামান্য ধরনের। গত রাতে ট্রেন্টনের কাছে একটা গাড়ী জ্বলে যায়। গাড়ীটার নম্বর প্লেট কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তবে মার্ক আছে, সাইট্রোন। কোন আরোহী ছিল না। গাড়ীতে আগুন লাগল কিভাবে পুলিশ তা তদন্ত করে দেখছে।

দ্বিতীয় ঘটনাটি গুরুত্বপূর্ণ। তার নীচে বিশেষ সংবাদদাতার কিছু সংযোজন আছে।

প্রথম খবর : সিক্সটি নাইনথ স্ট্রীটের একটি বাড়ীর চার তলায় একটি ঘরে একটি মৃতদেহ পাওয়া গেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে এটি আত্মহত্যা। পুলিশ তদন্ত চালাচ্ছে।

খবরের ঠিক নীচে বিশেষ সংবাদদাতার সংযোজন :

জানা গেছে হাইনরিক নীলে চার্লস কেলসোর ভীষণ বন্ধু। পেন্টাগনের গোপন সূত্র থেকে খবর পাওয়া গেছে সিক্সটিনাইনথ স্ট্রীটের এই মৃত ব্যক্তির নাম হাইনরিকনীলে। আর ইনিই হচ্ছেন চার্লস কেলসোর বন্ধু। ইনি মাথায় গুলি বিদ্ধ করে আত্মহত্যা করেছেন। তার হাতে একটা পিস্তল পাওয়া গেছে আর ওটা থেকে একটাই গুলি ছোঁড়া হয়েছে।

আসল কথা হল এই হাইনরিক নীলেই যদি সেই হাইনরিক নীলে হন যিনি চার্লস কেলসোর ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন, তাহলে আমাদের রীতিমত ভাবনার কারণ আছে। কেননা কেজিবিরহাত তাহলে আমেরিকার কতটা গভীরে প্রবেশ করেছে তা সহজে অনুমান করা যায়।

.

পেন্টাগনের বাড়ীটা বাইরে থেকে দেখলে মনে হয় কোন পড়ে থাকা বাড়ী–যেখানে কোন লোকের আনা গোনা নেই। কোন কাজকর্ম হয় না। পেন্টাগনের সদর দপ্তরের চেহারাটাও অনেকটা একই রকম। ভিতরের অফিস ঘরগুলোতে কোন কাজকর্ম হয় কিনা বাইরে থেকে বোঝা মুস্কিল।

বিকেলের দিকে টম কেলসোকে এখানে হন্তদন্ত হয়ে আসতে দেখা গেল। সংবাদিক হবার জন্য যত্রতত্র অবাধ বিচরণের অধিকার তার আছে। তাছাড়া ব্রাড জিলনের ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়ায় এখানে তো কোন কথাই নেই।

ব্রাড গম্ভীর মুখে বসে আছে। টম ব্রাডের দিকে তাকিয়ে বলল, কী ব্যাপার বলত, তোমাকে এত গম্ভীর দেখাচ্ছে কেন? হ্যাঁ আমি স্বীকার করছি তোমার কিছু কিছু কথা না শুনে আমরা ভুল করেছি।

ব্রাড চুপচাপ চুরুটে টান দিল।

 টম বলল, কী ব্যাপার আবার সেই ন্যাটোর মেমোরেন্ডামের মত কোন কিছু নাকি?

ব্রাড বলল, তা ঠিক নয়। টনিকে এইমাত্র মেনটনের পথে প্লেনে তুলে দিয়ে এলাম।

 টম উৎকণ্ঠার সঙ্গে বলল, টনি মানে টনি লটন? কিন্তু হঠাৎ কী হল?

 ব্রাড বলল, আজকের ওয়াশিংটন পোস্টের খবরটা দেখেছ? হঠাৎই পরিস্থিতি পালটে গেল।

টম বলল, সত্যি রিকের মৃত্যুটা আমার কাছে রহস্যজনক। হঠাৎ ওই বা আত্মহত্যা করতে গেল কেন?

ব্রাড বলল, ওইখানেই রহস্য লুকিয়ে আছে। আমার মনে হয় এটা আত্মহত্যা নয় এটা খুন। আর নির্ঘাত আর কী সু–কৌশলে একের পর এক খুন করে চলেছে এই গেরস্কি।

টনি তো একেবারে নাছোড়বান্দা হয়ে গেছে। গেরস্কিকে না ধরা পর্যন্ত ও স্বস্তি পাচ্ছে না।

ব্রাড বলল, হ্যাঁ তোমাকে একটা সুখবর দিতে ভুলে যাচ্ছি, টনির প্রমোশন হয়েছে। নীলের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া মাত্র ন্যাটো এই অর্ডার পাশ করেছে।

টম বলল, খুব আনন্দ পেলাম। যদিও রিকের মৃত্যুতে টনির কোন হাত নেই কিন্তু ও যেভাবে রিকের পিছনে উঠে পড়ে লেগেছিল তাতে কেজিবি রিককে বাঁচিয়ে–রাখার রিস্ক নিতে পারল না। এ রকম একটা কিছু হবে তা আমার মনেও উঁকি দিয়েছিল। তা টনি এখন মেনটনে কেন হঠাৎ?

ব্রাড বলল, ভূমধ্যসাগরের ওই জায়গাটা মস্কো তার সমস্ত গোয়েন্দা সংস্থার কেন্দ্র বিন্দুতে পরিণত করেছে, এটা ব্রাসেলসের আগেই খবর ছিল।

অবশ্য এর কারণ তোমার জানা। ওই শ্যানডন ভিলা। ঠিক একই রকম ধাঁচে গড়া ওই দুর্ভেদ্য জায়গাটায় এখন যে কাজকর্ম হবে সে খবর ওরাও রেখেছে। শ্যানডন হাউসে এই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে টনির এখানকার গোয়েন্দা দপ্তর ওকে আজ সকালে এই খবরটা দেয়। গেরস্কি আজ সকালের প্লেনে মেনটনের দিকেই গেছে।

টম অবাক হয়ে গেল, পালিয়ে গেল গেরস্কি?

 ব্রাড বলল, ও খুবই চালাক আর শয়তান।

 টম বলল, আশ্চর্য! এটা কী করে সম্ভব হল, তোমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ও পালিয়ে গেল?

টমের কথা শুনে ব্রাড একটু হাসল। বলল, দ্যাখো এর জন্য আমাদের এতটুকু আফসোস নেই কারণ বরিস গেরস্কি আমাদের কাছে শত্রু হলেও ওদের দেশের কাছে ও একজন সফল নায়ক। এটা তো মানো? এটা আদি অনন্ত কাল ধরে চলে এসেছে যে আমরা ওদের পেছনে ধাওয়া করবো ওরা আমাদের পেছনে ধাওয়া করবে। কখনো আমরা জিতবো কখনো ওরা জিতবে।

যেমন আমাদের লোকেরা আড়ালে থেকে ওদের কাজকর্মের খবর রাখছে। তারা নিশ্চয়ই ওদের কাছে শত্রু কিন্তু আমাদের কাছে তারাই মহামূল্যবান হীরের থেকে কম দামী নয়।

তোমায় আমি আগেই বলেছি আমাদের কাজের সঙ্গে সিভিল পুলিশদের কাজের অনেক তফাৎ। আমরা কাউকে চিনলেও তাকে চট করে ধরি না। আরো কোন মূল্যবান দলিল বা সংবাদ বা গোপন তথ্য পাচার করার সময় হাতে নাতে ধরার জন্য অপেক্ষা করি।

রিক নীলের কথাই ধরো, চার্লস কেলসোর মত গভীর আর বিশ্বাসী ছেলেকে কি ভাবে ধীরে ধীরে কজা করে ওকে আমেরিকান সরকারের বিরুদ্ধে মন বিষিয়ে দিয়েছিল। চার্লসের নিজস্ব মতবাদটাই পালটে যায়।নাহলে কোন অর্থের লোভে তত চার্লস এই কাজ করেনি। নিতান্ত একটা ঘোরের বশে চার্লস এই সাংঘাতিক কাজটা করে ফেলে।

কাজেই আমার মতে হাইনরিক নীলে ওদের দেশের কাছে এজেন্ট হিসাবে অতুলনীয়।

টম বলল, তবুও তো ওকে মরতে হল। যাক সে কথা। হ্যাঁ ভালো কথা, ম্যাকলেহোসের কোন খবর জানো? কেননা চার্লসের মৃত্যুটা আমার কাছে এখনও রহস্যজনক।

ব্রাড বলল, আমাদের কাছেনয়। ম্যাকলেহোস এখন জেলে আছে ও সব দোষ স্বীকার করেছে। অবশ্য এমন একটা নীচ কাজ না করে ওর উপায় ছিল না। আমি বা তুমি হলে আমরাও বাধ্য হতাম এই কাজ করতে। কারণ ওর ছেলেকে আর মেয়েকে আটকে রেখে ওকে ভয় দেখানো হচ্ছিল।

টম বলল, এ মৃত্যু নিয়ে খেলা। চার্লস যে কেন এমন একটা ভুল করল?

সাতদিন পরে টনির খবর এল, নিকোলে নামে একজন ভদ্রমহিলা চিঠি লিখেছে। খুব সুন্দর আর বড় করে লিখেছে

প্রিয় মিঃ ব্রাড,
ওয়াশিংটন থেকে সমস্ত পথটা আমি ছায়ার মত টনিকে অনুসরণ করে এসেছি, ওর দুশ্চিন্তার কথা আপনি জানেন। ও বড় একগুঁয়ে। একবার কোন কাজে হাত দিলে তা শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিন্তি নেই।

টনি এখন মিলিটারী হাসপাতালে। খুব আহত হয়েছে। সেরে উঠতে একটু সময় লাগবে। ও এখন শান্তিতে আছে। এতেই আমি খুশী। একটা সু–খবর জানাচ্ছি আপনাকে! মোনিক নামে একটা লঞ্চে করে গেরস্কি পালাচ্ছিল। ও বোধহয় জানতনা যে ওই লঞ্চে প্রচুর গোলা বারুদ মজুত ছিল। আমরা সী–ব্রিজে করে ওকে অনুসরণ করছিলাম। টনি তো গেরস্কিকে হাতছাড়া করতে চায় না। ও তো ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়। আর এক মুহূর্ত দেরী হলে কি হতে ভগবান জানেন।

এরই মধ্যে অন্য আরেকটা লঞ্চের সঙ্গে মোনিকের ধাক্কা লাগে। মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটে যায়।

এই দুর্ঘটনায় আমরা সবাই একটু না একটু আহত হয়েছিলাম। টনির আঘাতটা ছিল গুরুতর।

যাইহোক মোনিকের একটা কেবিনে আমি গেরস্কিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। প্রথমে বুঝতে পারিনি পরে বুঝলাম গেরস্কি অনেক আগেই মৃত। আজ এই পর্যন্তই.

ব্রাড অনেক দুঃখের মধ্যেও খুশী হল। টনি সুস্থ হয়ে উঠেছে জেনে।

.

ব্রাড তখনই একটা চিঠি লিখতে বসল। শুভেচ্ছা আর প্রাপ্তি সংবাদ জানিয়ে।

উত্তরটা হল এই রকম–

টনি আমার ভালোবাসা, আর অন্তরের গভীর সমবেদনা গ্রহণ কর। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি তুমি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠো। আর নতুন দায়িত্বে আরো সফল ভাবে কাজ করো।

গেরস্কির মৃত্যু সত্যি আমার কাছে খুবই সুখের সংবাদ।

এই সঙ্গে আমার অভিমানটুকু জানিয়ে রাখি। তোমার সঙ্গী এই সুন্দরীটি কে? যে এত গুছিয়ে তোমার মনের কথা লেখার অধিকার রাখে! তার কথা তুমি কিন্তু আমাকে বলনি বা তাকে দেখাও নি!

নীচে নাম সই করে ডাকে পাঠাবার মত তৈরী করে ফেলল ব্রাড।