১৫.
শ্রীমতী অলিভারের বাসাবাড়ির বিপরীত ফুটে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ইতস্তত করলেন রোডা। তার মন দ্বিধার দোলায় দুলছে। চোখে মুখেও সঙ্কোচের ছাপ। ভেতরে যাবেন কি যাবেন না সেইটাই এতক্ষণে ঠিক করে উঠতে পারলেন না কিছুতে। একবার ভাবছেন যাই। ভদ্রমহিলার কথাবার্তায় আন্তরিকতার ছোঁয়া আছে। পরক্ষণেই মন বলছে কি দরকার! তোমার এতে মাথা গলাতে যাওয়া কেন? কোথা থেকে কি হয় বলা যায় না।
একটা খালি ট্যাক্সি সামনে এসে আশান্বিত চিত্তে হর্ণ বাজাল। ট্যাক্সির ম্যাডাম অসহিষ্ণু ভাবে মাথা ঝাঁকালেন রোডা।
একজন প্রৌঢ়া ভদ্রমহিলা টুকিটাকি দোকান সেরে ব্যস্ত পায়ে গৃহে ফিরছিলেন আর একটু হলেই দন্ডায়মান রোডার সঙ্গে ধাক্কা লাগবার উপক্রম। তিনি একবার রোষকষায়িত নেত্রে তার দিকে তাকিয়ে নিজের পথে চলে গেলেন। তখন রোডা মনস্থির করে উঠতে পারেননি। নানা রকম ভাবনা চিন্তা সেখানে উঁকিঝুঁকি মারছে।
মিসেস অলিভার তো তাকে দেখা করবার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েই রেখেছেন, তবে তার এত সঙ্কোচ কেন? কিংবা তিনি হয়তো সকলকেই এই রকম বলে থাকেন। ওটা তার অভ্যাস। ওর মধ্যে আন্তরিকতা কিছু নেই। তাছাড়া অ্যানাও এই ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ঠিক পছন্দ করে না। মেজর ডেসপার্ডের উপদেশ মতো কোনো সলিসিটরের সাহায্য নেওয়াই তার মনোগত অভিলাষ। ভদ্রলোকের সঙ্গে গিয়ে সে একলা সলিসিটরের সঙ্গে দেখা করতে চায়। রোকে নিয়ে যেতে চায় না। কারণ রোডা গেলে আবার অযথা ভিড় বাড়বে। তার ওপর এটা তো রোলার কোনো ব্যাপারই নয়।…..রোডা অবশ্য মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে সাক্ষাতের অভিপ্রায়ে সলিসিটরের কাছে যাবার কথা বলেনি। অ্যানার অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবেই সে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিল। মেজর ডেসপার্ড যদিও খুব সুন্দর ভদ্রলোক, দেখতে বেশ সুদর্শন।
–অ্যানাকে দেখে যে তিনি মজে গেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পুরুষ মাত্রই ওই রকম। প্রেমের ব্যাপারে কোনো কষ্ট স্বীকার করতে চায় না।….
একটা বাচ্চা ছেলে আপন মনে পথ চলতে চলতে রোডার গায়ের ওপর এসে পড়ল। নিজের ওপর অতিশয় বিরক্ত হলেন রোডা। আচ্ছা মুশকিল তো। কতক্ষণ আর এইভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকবেন। হাতে বাঁধা ঘোট রিস্টওয়াচটার দিকে নজর দিলেন। সাড়ে তিনটে। কারোর সঙ্গে দেখা করবার পক্ষে খুবই ভালো সময়। ভদ্র মহিলা ভাবতে পারবেন না লাঞ্চ খাওয়ার লোভে রোডা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। যাকগে, এতখানি যখন এসে পড়েছেন তখন না হয় একবার ঘুরেই যাবেন। ভদ্রমহিলা তো তাকে আর খেয়ে ফেলতে পারবেন না।
ঘাট পেরিয়ে শ্রীমতী অলিভারের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাঁড়ালেন রোডা। হাত বাড়িয়ে কলিং বেলের বোতাম টিপলেন।
একজন মধ্যবয়স্কা মহিলা এসে দরজা খুলে দিলো। সম্ভবত বাড়ির দাসী।
মিসেস অলিভার কি বাড়িতে আছেন? কোনো রকমে নিজেকে সংযত রেখে প্রশ্ন করলেন রোডা। আমি তার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
আসুন, ভেতরে আসুন।
রোডা দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেন।
আপনার নাম…..?
মিস দোয়াস,…মিস রোডা দোয়াস।
এক মিনিট অপেক্ষা করুন, আমি জিজ্ঞেস করে আসছি। রোডার মনে হল তিনি যেন কত যুগ ধরে একলা দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু আসলে এক মিনিট পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড। দাসী ফিরে এসে রোডাকে ডেকে নিয়ে গেল।
আমার সঙ্গে আসুন। মিসেস অলিভার আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।
রোডা আগের চেয়ে আরও বেশি বিবর্ণ হয়ে উঠলেন। একরাশ জড়তা এসে জড়িয়ে ধরল পায়ে। বুকের মধ্যে অস্থির উত্তেজনা আঁকুপাঁকু করছে। প্রৌঢ়া দাসীর পেছন পেছন যখন তিনি সরু বারান্দা পেরিয়ে শ্রীমতি অলিভারের ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়ালেন তখন তার মনে হল বুঝি আফ্রিকার জঙ্গলে এসে পড়েছেন। সারা ঘর জুড়ে জানা অজানা হাজার রকম পাখির মেলা। পায়রা, কাকাতুয়া, ম্যাকাও আরও সব ঝক ঝক বিভিন্ন ধরনের পাখি। সবগুলোর নামও জানেন না রোডা। জীবনে কোনো দিন দেখেননি তাদের। চিড়িয়াখানাতেও বোধহয় এতসব পাখির একত্র সমাবেশ কখনো ঘটেনি। এই সমস্ত পাখির ভিড়ের মধ্যেখানে একটা ছোট কাঠের টেবিল পাতা। টেবিলের ওপর একটা হাল্কা সৌখিন টাইপরাইটার। টাইপ করা কাগজপত্র অগোছালো ভাবে টেবিলের নীচে পড়ে আছে। কতগুলো উড়ে গিয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে। টেবিলের সামনে একটা চেয়ারে শ্রীমতী অলিভার বসে আছেন। তার চুল উস্কোখুস্কো অবিন্যস্ত।
আরে, রোডা যে, এসো এসো তোমাকে দেখে খুব প্রীত হলাম। শ্রীমতী অলিভার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে রোডাকে আহ্বান জানালেন। বেগুনি কার্বনের দাগ লাগা-ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলেন করমর্দনের অভিপ্রায়ে। বাঁ-হাত দিয়ে মাথার অবিন্যস্ত চুলগুলোকে ভদ্র সভ্য করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু সে এক দুঃসাধ্য প্রচেষ্টা।
উঠে দাঁড়াবার সময় তার হাত লেগে একটা কাগজের ব্যাগ মাটিতে পড়ে গেল। তার মধ্যে থেকে বড় বড় লাল মসৃণ আপেল বেরিয়ে এসে বীরদর্পে বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি শুরু করে দিলো। শ্রীমতী অলিভার সেদিকে হৃক্ষেপ করলেন না। বললেন, যাকগে ওর জন্যে কোনো চিন্তা করবার দরকার নেই। কেউ না কেউ এসে একসময় আবার গুছিয়ে রেখে যাবে। তুমি এই সামনের চেয়ারটায় আরাম করে বসো।
রোডা বসতে গিয়ে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তার হাতে ধরা পাঁচটা বড় আপেল।
ওহো, ওগুলো বোধহয় ব্যাগের মধ্যে ভরতে ভুলে গেছি। নাকি ব্যাগটার কোথাও ফুটো হয়ে গেছে। কিছু মনে করো না। আপেলগুলো টেবিলের ওপর রেখে দাও।……হ্যাঁ ঠিক আছে। আর ভয় নেই। এবার তুমি নিশ্চিন্তে বসতে পারো।
আমি বোধহয় হঠাৎ এসে আপনাকে খুব বিরক্ত করলাম। চেয়ারে বসতে বসতে বিব্রত কণ্ঠে বললেন রোডা, আগে থেকে খবর দিয়ে আসা উচিত ছিল।
আরে না না, তোমাকে অত ব্যস্ত হতে হবে না। শ্ৰীমতী অলিভার সহজভাবে বললেন, আমি অবশ্য লেখার কাজে মগ্ন ছিলাম, সে কথা ঠিক, আমার ধুরন্ধর গোয়েন্দা স্বোয়েন হিয়েন একটা সাংঘাতিক রহস্যের মধ্যে ভীষণভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। তবে সে এখন এক ডিশ সিদ্ধ বরবটির ভেতর থেকে একটা সূত্রের হদিশ খুঁজে পেয়েছে।
লেখিকার কাছ থেকে তাঁর সৃষ্টিরহস্যের সন্ধান পেয়ে রোড রোমাঞ্চিত হয়ে উঠলেন। রুদ্ধকণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, নিশ্চয় টিনের খাবার?
তা হতে পারে। শ্রীমতী অলিভারের কণ্ঠে উদাসীনতার ছোঁওয়া। তবে এই সমস্ত ছোটখাট ব্যাপার নিয়ে আমি বিশেষ মাথা ঘামাই না। যেমন ধরো, ফুল আমার খুবই প্রিয়। আমার গল্পের মধ্যেও আমি প্রায় বিভিন্ন ফুলের উল্লেখ করি। কিন্তু পাঠকেরা অভিযোগ করে পত্র দেয়। এরকম ফুল নাকি তখন সেখানে ফোটবার কথা নয়। যেন শুধু এই কারণেই গল্পটা মাঠে মারা গেছে বলে তাদের ধারণা।
এধরনের তুচ্ছ অভিযোগে আপনি কান দেবেন না। রোডা অকপটে তার মনের ভাব ব্যক্ত করলেন। তারপর উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, ইস, লিখতে না জানি কত মজা।
শ্রীমতী অলিভার তার কার্বনকলঙ্কিত হাতে কপাল চুলকোতে চুলকোতে প্রশ্ন করলেন, কেন?
কেন? একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন রোডা। তা তো হবেই। বসে বসে একটা গোটা উপন্যাস লিখে ফেলা নিশ্চয় খুব চমৎকার ব্যাপার।
ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ নয়। শ্রীমতী অলিভার ব্যাজার মুখে বললেন, লেখবার আগে তোমাকে অনেক ভাবতে হবে। আর বসে বসে চিন্তা করাটা খুবই ক্লান্তিকর ব্যাপার। তাছাড়া আগে থেকে সমস্তটা ভেবে নিলেই যে সমস্যার সমাধান হল, তা নয়। লিখতে বসলে আরও নানা রকম ঝামেলা এসে হাজির হয়। এক এক সময় মনে হয় বুঝি এই ঝামেলার আর শেষ নেই। এই সমস্ত ঝামেলা মিটিয়ে কাহিনিটা কোনোদিন শেষ করা যাবে কিনা, সন্দেহ। তাই বলছি লেখাটা খুব আরামের কাজ নয়, বিশেষ পরিশ্রম সাপেক্ষ।
কিন্তু বাইরে থেকে দেখলে তেমন কঠিন বলে মনে হয় না।
তোমার কাছে তা মনে না হবারই কথা। হাসিমুখে উত্তর দিলেন শ্রীমতী অলিভার, কারণ তোমাকে তো আর লিখতে হয় না। আমার কাছে এটা খুবই পরিশ্রমের কাজ, মাঝে মধ্যে কোনো নতুন উপন্যাসের মাঝামাঝি এসে লেখা আর এগোতে চায় না। তখন লেখাটা শেষ করে প্রকাশকের হাতে দিতে পারলে কত টাকা পাবো মনে মনে তার হিসেব করি। টাকার অঙ্ক দেখে বুকে আবার প্রেরণা আসে। নবোদ্যমে কাজ শুরু করি।
আপনি যে নিজের গল্প নিজেই টাইপ করেন সেটা আমার ধারণা ছিল না। ভেবে ছিলাম নিশ্চয় আপনার সেক্রেটারি আছে। আপনি তাকে ডিকটেশন দিয়ে যান।
আগে আমার সেক্রেটারি ছিল, আমি তাকে ডিকটেশনও দিতাম। কিন্তু সে মেয়েটি এত বেশি দক্ষ, গ্রামার পাঙ্কচুয়েশনে তার জ্ঞান এত বেশি যে শেষকালে আমারই কেমন কিন্তু কিন্তু লাগল। নিজেকে তার তুলনায় অনেক ছোট মনে হত। তারপর দেখেশুনে আনকোরা নতুন এবং জ্ঞানগম্যিও অনেক কম এমন একজন সেক্রেটারি নিযুক্ত করলাম। বলাবাহুল্য, একে দিয়েও তেমন সুবিধে হল না।
বসে বসে নতুন প্লটের কথা চিন্তা করতে নিশ্চয় আপনার খুব ভালো লাগে? একটা জমাট ভালো গল্প ফাঁদা তো সাধারণ কথা নয়।
হ্যাঁ, অনেক নতুন প্লট আমি কল্পনা করতে পারি, শ্রীমতী অলিভার উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, কিন্তু লিখতে গেলেই মুশকিল বাধে। যত রকমের ক্লান্তি এসে কলমের ডগায় জমা হয়। হয়তো ভাবলাম লেখাটা হয়ে গেছে কিন্তু গুণে দেখলাম মাত্র হাজার ত্রিশেক শব্দ আমি লিখেছি। অথচ ষাট হাজার শব্দের কমে একটা গোটা উপন্যাস ছাপতে দেওয়া যায় না। তখন পাতা ভরাবার জন্যে কোনো নতুন খুনের উদ্যোগ করতে হয় অথবা সুন্দরী নায়িকাকে কিডন্যাপ করে দুর্গম স্থানে পাঠিয়ে দিই। এই অবস্থাটা এত ক্লান্তিকর যে আর কি বলব।
রোডা কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি একদৃষ্টে শ্রীমতী অলিভারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার দৃষ্টিতে যৌবনোচিত শ্রদ্ধার সঙ্গে কিঞ্চিৎ হতাশার ভাবও মিশে আছে।
দেওয়ালের রঙটা তোমার কিরকম লাগছে?–শ্রীমতী অলিভার অন্য প্রসঙ্গের অবতারনা করলেন। বললেন, আর পাখিরা আমার খুব প্রিয়। দেওয়ালে যে সমস্ত লতা পাতা আঁকা আছে সেগুলো সব গরমের দেশের গাছপালা। এদের দিকে তাকালে আমার রৌদ্রতপ্ত গ্রীষ্মের দুপুরের কথা মনে পড়ে। আসলে ঘরের বাইরে তখন হয়তো বরফ পড়ছে। শরীরে উষ্ণতার আস্বাদ অনুভব করতে না পারলে আমি কিছু ভাবতে বা লিখতে পারি না। কিন্তু আমার গোয়েন্দা স্বোয়েন হিয়েন কনকনে ঠাণ্ডার দেশের মানুষ।
সমগ্র পরিবেশটাই কি চমৎকার! রোডার কণ্ঠ প্রশংসায় মুখর, তাছাড়া আমার উপস্থিতিতে যে আপনি বিরক্তি বোধ করছেন না তার জন্যেও আমি কৃতজ্ঞ।
তোমার জন্যে কফির বন্দোবস্ত করি। শ্ৰীমতী অলিভার উঠে দাঁড়ালেন বললেন, কালো কফি আর গরম টোস্ট–এ-দুটোই আমার খুব পছন্দ।
তিনি দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে দাসীকে ডেকে কফি আর টোস্টের অর্ডার দিলেন। তারপর ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, আসল প্রশ্নটাই এতক্ষণে জিজ্ঞেস করা হয়নি। হঠাৎ শহরে এলে কেন? কেনাকাটার প্রয়োজনে?
হ্যাঁ, কিছু জিনিসপত্র কিনতে।
মিস মেরিডিথ কি তোমার সঙ্গে এসেছে?
হ্যাঁ, ও মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে এক সলিসিটরের কাছে দেখা করতে গেছে।
সলিসিটর? শ্ৰীমতী অলিভার জিজ্ঞাসু নেত্রে তাকালেন।
মেজর ডেসপার্ডই ওকে সলিসিটরের সাহায্য নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। ভদ্রলোক সত্যিই বেশ ভালো…. খুব উপকারী।
আমিও তো সাহায্য করতে প্রস্তুত ছিলাম। ক্ষুণ্ণ কণ্ঠে বললেন শ্রীমতী অলিভার কিন্তু সেটা তো তোমার বন্ধুর তেমন ভালো লাগেনি। উপরন্তু সে আমাকে বাধাই দিলো। একরকম।
না না, আপনি ভুল বুঝছেন, বাধা দেওয়া তার উদ্দেশ্য নয়। রোডা বিচলিত হয়ে উঠলেন। সেই কথাটাই আজ আপনাকে ভালো করে বুঝিয়ে বলতে এসেছি। সেদিন অবশ্য অ্যানা কি রকম কাটাকাটা ভাবে কথাবার্তা বলেছিল, কিন্তু ও মোটেই তেমন মেয়ে নয়। খুবই বিনয়ী। আসলে ও আপনার আগমনকে কোনো খারাপ চোখে দেখেনি। তবে আপনার মুখে একটা কথা শুনে ও ওইরকম হয়ে গিয়েছিল। কেন? আমি কি বলেছিলাম? কথাটা অবশ্য মনে রাখবার মতো এমন কিছু নয়, খুবই তুচ্ছ; কিন্তু…
কিন্তু কথাটা কি?
সেদিন আপনি আলোচনা প্রসঙ্গে কি একটা দুর্ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু বা ওই ধরনের…
তাই বুঝি!
এখন হয়তো আপনার সঠিক মনে পড়ছে না। অ্যানা একবার এই ধরনের একটা সাংঘাতিক পরিস্থিতির মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল। সে এক সময় এক ভদ্রলোকের বাড়িতে চাকরি করত। সেই বাড়ির এক ভদ্রমহিলা ভুল করে ওষুধের বদলে এক ধরনের বিষাক্ত পালিশ খেয়ে ফেলেন। তাতেই তার মৃত্যু হয়। ব্যাপারটায় অ্যানা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিল। তাই সে এরকম কোনো আলোচনায় খবু অস্বস্তি বোধ করে। আপনার কথা শুনে ওর হয়তো পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল। আর এটা মনে পড়লেই অ্যানা ভয় সিঁটিয়ে ওঠে। আপনিও হয়তো সেটা লক্ষ্য করে থাকবেন। ওর সামনে তখন আমি কিছু বলিনি। কিন্তু আপনি ভুল বুঝবেন না। ও অকৃতজ্ঞ নয়।
শ্রীমতী অলিভার রোডার উজ্জ্বল সুন্দর মুখের দিকে ফিরে তাকালেন। বললেন, তা হবে। অ্যানা খুব স্পর্শকাতর;আগের কথার জের টেনে বলে চললেন রোডা, কোনো কিছুর সম্মুখীন হতে ও খুব ভয় পায়। যদি কোনো ব্যাপার ওকে বিচলিত করে তবে সে বিষয়ে ও সাধারণত কোনো আলোচনাই করতে চায় না। অবশ্য এটা যে খুব যুক্তিসঙ্গ–ত নয় আমিও তা স্বীকার করি। তুমি আলোচনা করো আর না করো, ঘটনা তো মিথ্যে হতে পারে না। এটা কেবল চোখ বুজে ভয়ের হাত থেকে আত্মগোপন করবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা। যেন তাকে এড়িয়ে চললেই সেটার আর অস্তিত্ব থাকবে না। যতই যন্ত্রণাদায়ক হোক না কেন আমি সমস্ত কিছুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সোজাসুজি ফয়সালা করে নেবার পক্ষপাতী।
হুঁ; শান্তভাবে মাথা নাড়লেন শ্রীমতী অলিভার। তোমাকে দেখে সত্যিই আমার খুব ভালো লাগছে। তোমার মধ্যে সাহস আছে। কিন্তু অ্যানার মধ্যে এই সাহসের একান্তই অভাব।
রোডা লজ্জা পেলেন। বললেন, কিন্তু অ্যানা খুব ভালো মেয়ে, শান্তশিষ্ট নম্র আর খুব মিষ্টি।
শ্রীমতী অলিভার মৃদু হাসলেন। তোমার কথা তো আমি একবারও অস্বীকার করিনি। তবে তোমার মতো দুর্জয় সাহস অ্যানার নেই।
শ্রীমতী অলিভার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন; তারপর আচমকাই প্রশ্ন করলেন, তুমি কি সত্যের মূল্য বিশ্বাস করো, না করো না?
নিশ্চয় করি; সত্যের ওপর আমার অগাধ আস্থা। সে তো তোমার মুখের কথা; কিন্তু এ বিষয়ে ভেবে দেখেছ কোনোদিন? সত্য অনেক সময় বড় কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বড় নিষ্ঠুর আকার ধারণ করে। সত্যের কঠোরতার কাছে কোনো মোহই বেশিক্ষণ জেঁকে না।
তা সত্ত্বেও সত্যকেই আমি চিরকাল আঁকড়ে থাকব। রোডার কণ্ঠে দৃঢ়তার আভাস।
আমারও তাই অভিপ্রায়। তবে আমাদের এই চাওয়াটা প্রকৃত জ্ঞানীর লক্ষণ কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে।
রোডা বিনীত কণ্ঠে বললেন, আপনাকে যা বললাম সেটা কিন্তু অ্যানার কাছে ফাঁস করে দেবেন না। এসব বিষয়ে আলোচনা ও খুব অপছন্দ করে।
তোমার চিন্তার কোনো কারণ নেই। একথা আমি কোনোদিন তোমার বন্ধুর সঙ্গে আলোচনা করতে যাব না।… আচ্ছা, এটা কি অনেক বছর আগের ঘটনা?
বছর চারেক হল। ব্যাপারটা ভারী অদ্ভুত তাই না, যে কোনো লোকের কাছে একই জিনিস বার বার ঘটে। আমার এক দূর সম্পর্কের পিসির কথা জানি, জীবনে তিনি অনেকবার জাহাজ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছিলেন। অ্যানার চোখের সামনেও দু-দুটো আকস্মিক মৃত্যু ঘটে গেল। অবশ্য শেষেরটা আরও বেশি মারাত্মক। হত্যা জিনিসটা খুবই ভয়ানক, নয় কি?
হ্যাঁ তা বটে।
এই সময় প্রৌঢ়া দাসী কালো কফি ও গরম টোস্ট নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন রোডা। এমন একজন খ্যানামা লেখিকার সামনে বসে কফি পান করা তার মতো মেয়ের পক্ষে এই প্রথম।
টোস্ট আর কফি শেষ করে রোডা উঠে দাঁড়ালেন। এমনভাবে আচমকা হানা দিয়ে হয়তো আপনার কাজের খুব ক্ষতি করলাম? আর বেশি বিরক্ত করব না। যদি আপনার লেখা কোনো বই পাঠিয়ে দিই তবে তার ওপর আপনি দয়া করে কি একটা স্বাক্ষর দেবেন?
শ্ৰীমতী অলিভার হেসে বললেন, তোমার অতটা কষ্ট করবার কোনো দরকার নেই। আমি নিজেই একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
তিনি এগিয়ে গিয়ে একটা বুককেসের সামনে দাঁড়ালেন। কোন বইটা তোমার ভালো লাগে? সোনালি মাছের রহস্যটাই অবশ্য আমার বেশি প্রিয়, এটা অন্যগুলোর মতো অতটা গাঁজাখুরি নয়।
স্বয়ং লেখিকাকে তার নিজের বই সম্বন্ধে এমন মন্তব্য করতে শুনে রোডা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। শ্রীমতী অলিভার বইটা খুলে প্রথম পাতায় নিজের অলঙ্কৃত হস্তাক্ষরে লিখলেন, কুমারী রোডাকে…শ্ৰীমতী অলিভার। তারপর বইটা রোডার দিকে এগিয়ে দিলেন।
কি বলে যে আপনাকে ধন্যবাদ জানাব!…আশা করি আমার আগমনে আপনি খুব বিরক্তবোধ করেননি?
আরে না না, মোটে না, আমিই বরঞ্চ তোমাদের এখানে আমন্ত্রণ জানিয়ে রেখে ছিলাম। একটু থেমে তিনি আবার শান্তকণ্ঠে বললেন, তুমি ভারি লক্ষী মেয়ে। শুভরাত্রি।…আর একটা কথা, খুব সাবধানে চলাফেরা করো কিন্তু!
রোডা বিদায় নেবার পর তিনি আবার আপন মনে বিড় বিড় করলেন। শেষ কথাটা কেন ওকে বলতে গেলাম হঠাৎ। সত্যিই কি…
শ্রীমতী অলিভার মৃদুমন্দ মাথা নাড়লেন। তারপর অবিন্যস্ত চুলের ওপর হাত বোলাতে বোলাতে স্বোয়েন হিয়েনের সমস্যার মধ্যেই তলিয়ে গেলেন ক্রমে ক্রমে।
.
১৬.
মিসেস লরিমার কয়েক মুহূর্তের জন্য সিঁড়ির মাথায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপরে নীচে নেমে এলেন ধীরে ধীরে। দরজা পেরিয়ে পা বাড়ালেন রাস্তায়। তার সারা মুখে এক অদ্ভুত অভিব্যক্তির ছাপ। দৃঢ়তার সঙ্গে দ্বিধার, নিশ্চিন্ততার সঙ্গে সংশয়ের এক অভূতপূর্ব সংমিশ্রণ। একবার আপনা থেকেই তার দীর্ঘ সুজোড়া কুঁচকে উঠল। যেন তার সমগ্র সত্তা কোনো সুগভীর সমস্যায় নিমগ্ন।
ঠিক সেই মুহূর্তে বিপরীত দিকের ফুটপাথে অ্যানা মেরিডিথের ওপর তার দৃষ্টি পড়ল। একটা গগনচুম্বী অট্টালিকার সামনে অ্যানা দাঁড়িয়ে আছেন। মিসেস লরিমার সামান্য ইতস্তত করলেন। তারপর, রাস্তা পেরিয়ে এগিয়ে গেলেন।
কেমন আছেন, মিস মেরিডিথ?
অ্যানা বড় বড় চোখ তুলে চমকে ফিরে তাকালেন। ওঃ আপনি। অনেকদিন বাদে আবার দেখা হল।
এখনও কি লণ্ডনেই আছেন?
না না, বিশেষ প্রয়োজনে আজ এখানে এসেছি। একটা আইনঘটিত ব্যাপারে হঠাৎ দরকার পড়ে গেল। তার দু’চোখের অপলক দৃষ্টি তখনও সেই ফ্ল্যাট বাড়ির দিকে নিবদ্ধ।
মিসেস লরিমার প্রশ্ন করলেন, ওদিকে অত ঘন ঘন আসছেন কেন? ওই বাড়িতে কোনো প্রয়োজন আছে বুছি?
অ্যানা ধরা পড়ে যাওয়া কণ্ঠে বললেন, না না, ও কিছু নয়, তেমন কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আপনার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে কোনো ব্যাপার আছে?
হ্যাঁ…না… মানে…. বোকার মতো মুখ করে অল্প হাসলেন অ্যানা। বললেন, আমি যার সঙ্গে বাস করি সেই বন্ধু রোডাকে যেন এই বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দেখলাম। ভাবছি ও কি মিসেস অলিভারের সঙ্গে দেখা করতে গেল।
তিনি কি এই ফ্ল্যাটেই থাকেন? আমার জানা ছিল না।
হ্যাঁ, ভদ্রমহিলা একদিন আমাদের ওখানে গিয়েছিলেন। তখনই তাঁর ফ্ল্যাটের ঠিকানা আমি জানতে পারি। আমার সন্দেহ হচ্ছে, আমি কি রোডাকে দেখলাম, না আর কাউকে?
আপনি কি ভেতরে গিয়ে দেখা করতে চান?
না, আজ আর যাব না।
তবে আসুন, আমার সঙ্গে এক কাপ চা খাবেন। মিসেস লরিমার তাকে আমন্ত্রণ জানালেন। কাছেই একটা ভালো দোকানে আছে।
অ্যানা একটু ইতস্তত করলেন, তারপর বললেন, বেশ চলুন।
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে তাঁরা দুজন একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন। জায়গাটা বেশ ছিমছাম। লোকজনের ভিড়ও বেশি নেই। একটা কেবিনে ঢুকে পর্দা টেনে দিলেন অ্যানা।
এতক্ষণ দু’জনের কেউ কোনো কথা বলেননি। যেন দু’জনেই গভীর চিন্তামগ্ন। অ্যানাই প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করলেন। মিসেস অলিভার কি আপনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন?
মিসেস লরিমার মাথা নাড়লেন, মঁসিয়ে পোয়ারো ছাড়া আর কেউ আমার ওখানে যাননি।
আমি ঠিক ও প্রশ্ন করিনি।
করেননি। মিসেস লরিমার বিস্মিত হলেন। কিন্তু আমার কেমন মনে হল এটাই আপনার প্রশ্নের মূল উদ্দেশ্য।
অ্যানার চোখে চকিতের জন্যে ভয়ের ছায়া পড়ল। কিন্তু মিসেস লরিমারের চোখে এমন কোনো অভিব্যক্তি তার নজরে পড়ল না যার মধ্যে ভয়ের কারণ থাকতে পারে। নিজেকে সংযত করে অ্যানা আবার পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন। ভদ্রলোক তো আমার সঙ্গে দেখা করতে যাননি। কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে আবার প্রশ্ন করলেন অ্যানা। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটল কি আপনার কাছে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ তিনি আমার সঙ্গে দেখা করে গেছেন।
অ্যানা একটু ইতস্তত করলেন, কি বিষয়ে প্রশ্ন করলেন তিনি? মিসেস লরিমার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। যা ওঁরা সচরাচর করে থাকেন। নিয়মমাফিক তদন্ত আর কি? তবে ভদ্রলোকের আচার-আচরণ বেশ ভালো।
আমার মনে হয় ভদ্রলোকে প্রত্যেকের সঙ্গেই দেখা করেছেন।
আমারও তাই বিশ্বাস।
আবার কয়েক মুহূর্ত নীরবে কেটে গেল।
আচ্ছা মিসেস লরিমার আপনার কি মনে হয় শেষ পর্যন্ত ওরা প্রকৃত অপরাধীকে খুঁজে বার করতে পারবে?
অ্যানার দু’চোখের দৃষ্টি চায়ের পেয়ালার মধ্যেই নিবিষ্ট ছিল। সেই জন্যে মিসেস লরিমার চোখে যে অদ্ভুত ছায়া খেলে গেল সেটা তার নজরে পড়ল না। তিনি শান্তস্বরে বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না।…
অ্যানা মৃদুস্বরে বিড়বিড় করলেন। ব্যাপারটা কি মারাত্মক, কি ভয়ানক।
মিসেস লরিমারের চোখে আবার সেই অদ্ভুত ছায়া পড়ল, তার সঙ্গে সমবেদনার ছোঁওয়া।
জিজ্ঞেস করলেন আপনার বয়স কত? মিস মেরিডিথ?
বয়স? আমার বয়স? অ্যানা তোতলাতে শুরু করলেন। পঁচিশ। আর আমার তেষট্টি, মৃদু কণ্ঠে বলে চললেন মিসেস লরিমার আপনার সামনে এখন সারা জীবনটাই পড়ে আছে…ঈষৎ কেঁপে উঠলেন অ্যানা। কিন্তু আমি তো আজ কোনো পথ দুর্ঘটনায় মারাও যেতে পারি।
হ্যাঁ সেটা একেবারেই অসম্ভব নয় এবং আমি হয়তো জীবনে এমন ধরনের কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীনই হব না। মিসেস লরিমারের কণ্ঠস্বর এমন অদ্ভুত শোনাল যে অ্যানা বিস্মিত দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ।
জীবন বড় জটিল। মিসেস লরিমার একই সুরে বললেন, আমার মতো বয়স হলে আপনি সে কথা বুঝতে পারতেন পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে গেলে দুটি জিনিসের একান্তই প্রয়োজন। প্রথম হচ্ছে অফুরন্ত সাহস, দ্বিতীয় অসীম সহ্যশক্তি। এবং শেষ লগ্ন সামনে এলে সকলেই অবাক হয়ে ভাবে সত্যিই এর কি কোনো প্রয়োজন ছিল?
অমনভাবে বলবেন না। ভীত কণ্ঠে বাধা দিলেন অ্যানা।
মিসেস লরিমার হেসে উঠলেন। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর ঠাণ্ডা হাসি। জীবন সম্বন্ধে এ ধরনের বিষাদময় অভিব্যক্তি হয়তো খুবই সস্তা দরের জিনিস। তিনি বেয়ারাকে ডেকে বিল মিটিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
রাস্তায় নামতে না নামতেই একটা খালি ট্যাক্সি পাওয়া গেল। মিসেস লরিমার হাত নেড়ে তাকে থামালেন।
আপনাকে কি কোনো লিফট দেব? অ্যানাকে প্রশ্ন করলেন তিনি।
না তার প্রয়োজন হবে না। উজ্জ্বল হাসিমুখে উত্তর দিলেন অ্যানা। ওই যে রাস্তার মোড়ে রোডা দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা নমস্কার।
মিসেস লরিমার বিদায় নিতেই অ্যানা দ্রুতপায়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন। অ্যানাকে দেখতে পেয়ে রোডার মুখও হাসিখুশি হয়ে উঠল। কিন্তু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে লক্ষ্য করলে দেখতো সে-মুখে একটা অপরাধীর ছাপও নজরে পড়ে।
রোডা, তুই মিসেস অলিভারের কাছে গিয়েছিলি? দৃঢ় কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন অ্যানা।
হ্যাঁ গিয়েছিলাম, কেন? আমি তাহলে ঠিকই ধরেছি। এতে আবার ধরাধরির কি আছে? আমি চুরি করতে গেছি নাকি? রোডার কণ্ঠে ঝঝের আভাস। তারপর সুর নামিয়ে বললেন, চল, বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোনো যাক। এতক্ষণ তো দিব্যি তোর বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে ঘুরে বেড়ালি। ভদ্রলোক নিশ্চয় তোকে চায়ে আপ্যায়িত করেছেন?
অ্যানা কোনো উত্তর না দিয়ে মিনিটখানেক চুপ করে রইলেন। তার কানের পর্দায় তখন টুকরো কথার সুর ভেসে বেড়াচ্ছে।
চলুন, অপনার বন্ধুকে নিয়ে কোথাও একসঙ্গে বসে চা খাওয়া যাক।
অ্যানা কোনো ভাবনা চিন্তা না করেই দ্রুত উত্তর দিলেন, অসংখ্য ধন্যবাদ। কিন্তু আজ এক জায়গায় আমাদের দুজনের চায়ের নিমন্ত্রণ আছে। তাহলে তো আর তাদের দুজনের মাঝখানে রোডার আগমনের কোনো প্রশ্ন উঠত না।
রোডাকে যে অ্যানা চায়ের আসরে উপস্থিত থাকতে দিতে চান না, সেটাও কেমন বিসদৃশ। এদিকে মেজর ডেসপার্ডকে ছেড়ে যাবারও তাঁর আদৌ ইচ্ছে নেই। মনে মনে বোধহয় তিনি রোডাকে হিংসে করেন। রোডা কেমন উজ্জ্বল প্রাণোজ্জ্বল। কত সহজে অপরের সঙ্গে আলাপ জমাতে পারে। সেদিন সন্ধ্যায় মেজর ডেসপার্ড মাঝে মাঝে এমনভাবে রোলার দিকে ফিরে তাকাচ্ছিলেন যাতে মনে হয় রোডাকে বুঝি তার খুব ভালো লেগে গেছে। কিন্তু তিনি তো অ্যানার জন্যেই সেখানে এসেছিলেন রোডার রকম সকমই ওই রকম। যদিও ওটা ওর ইচ্ছাকৃত নয়, কিন্তু দু’জনে একসঙ্গে থাকলে তুমি পেছনে পড়ে যেতে বাধ্য। অন্যকে ছাপিয়ে ও একলা সকলের দৃষ্টি কেড়ে নেবে। সেই জন্যেই তাদের দু’জনের মাঝখানে রোডার উপস্থিতি অ্যানার কাছে মোটেই কাম্য নয়।
তবে অ্যানা যে বোকার মতো কাজ করে বসেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সামান্য বুদ্ধি খরচ করলে তিনি এতক্ষণ ডেসপার্ডের সঙ্গে তাঁর ক্লাবে বা অন্য কোনো কাফেতে বসে মজা করে চা খেতে পারতেন। রোডার ওপর খুবই বিরক্ত হয়ে উঠলেন অ্যানা। রোডা সত্যিই অপদার্থ। তাছাড়া কি জন্যেই বা ও মিসেস অলিভারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল?
মনের ভেতরে বিরক্তি চেপে রেখে অ্যানা প্রশ্ন করলেন মিসেস অলিভারের কাছে হঠাৎ গেলি কেন?
কেন, তিনি তো আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েই রেখেছিলেন। তা রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি সত্যিই তেমন আন্তরিকভাবে কিছু বলেননি। আমি ভেবেছিলাম ও শুধু একটা কথার কথা। সকলকেই ও রকম বলে থাকেন।
না না, তুই তাহলে ভদ্রমহিলাকে চিনতে ভুল করেছিস। ভদ্রমহিলার মধ্যে আন্তরিকতার কোনো অভাব নেই। এমন সুন্দর মহিলা আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি, এই দেখ আমাকে তার একটা বইও উপহার দিলেন। রোডা হাসিমুখে বইখানা বার করে দেখলেন।
অ্যানার কণ্ঠে তখনও সন্দেহ আর অবিশ্বাস। কি বিষয় নিয়ে কথা হল? নিশ্চয় আমার সম্বন্ধে কিছু বলিসনি?
বোকা মেয়েটা কি উদ্ভট ধারণা করে বসে আছে দেখো।
না, কিন্তু সত্যিই কি কিছু বলেছিলি? এই..এই খুনের সম্বন্ধে, কোনো কথা হল?
তাঁর উপন্যাসে সে সমস্ত খুন খারাপির কথা থাকে সে বিষয়ে অনেক আলোচনা করলেন। মিসেস অলিভারের সঙ্গে কথা বলে তাকে আর পাঁচজন সাধারণ মহিলার মতোই মনে হল, তিনি বললেন, গল্প লেখা কঠিন পরিশ্রমের কাজ। কেমনভাবে প্লট তৈরি করেন সে রহস্যও ফাস করে দিলেন। পরিশেষে কালো কফি আর গরম টোস্ট খাওয়ালেন আমাকে।
রোডার কণ্ঠে বেশ গর্বের সুর ধ্বনিত হল। তারপর অল্প থেমে কুণ্ঠিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলেন অ্যানা তোর বোধহয় এখনও চা খাওয়া হয়নি?
হ্যাঁ, হয়েছে? মিসেস লরিমার আমাকে চা খাওয়ালেন।
মিসেস লরিমার? ভদ্রমহিলার নামটা যেন খুব চেনা চেনা লাগছে। তিনিও বোধহয় ওই খুনটার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন, তাই না?
অ্যানা মাথা নেড়ে সায় জানালেন।
কোথায় দেখা হল?
তুই কি তাঁর বাড়িতে গিয়েছিলি? না, হলে স্ট্রিটে ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
তাকে কি রকম মনে হল?
ঠিক বুঝতে পারছি না; ধীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন অ্যানা, একটু যেন কেমন কেমন। আগের বার যেমন দেখেছিলাম এখন আর সে রকম নেই। অনেক পরিবর্তন ঘটেছে।
তোর কি মনে হয় খুনটা তিনিই করেছেন?
অ্যানা অল্পক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপর জবাব দিলেন আমি জানি না। এখন এসব আলোচনা থাক। তোকে তো আমি বলেছি রোডা এ ধরনের আলোচনা আমি ভীষণ অপছন্দ করি।
আচ্ছা বাবা আচ্ছা! তা তোর সলিসিটর ভদ্রলোককে কেমন দেখলি? খুব কাঠখোট্টা গোছের, আইনের প্যাঁচপয়জার সব একেবারে কণ্ঠস্থ?
না না, ভদ্রলোক বেশ ভালো। দৃষ্টিও খুব সজাগ। সব সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখেন।
তাহলে তো ভালোই মনে হচ্ছে।
একটু থেমে যোডা আবার প্রশ্ন করলেন, মেজর ডেসপার্ডকে কেমন মনে হল?
ভারী দয়ালু ভদ্রলোক। নিশ্চয় তিনি তোর প্রেমে পড়েছেন। এতে আর আমার কোনো সন্দেহ নেই।
রোডা, আবোল তাবোল বকিস না।
ঠিক আছে, আমার কথা সত্যি কিনা পরে দেখে নিস, রোডা গুনগুন করে একটা মিষ্টি গানের কলি ভাজতে লাগলেন। তার মনের মধ্যে অনেক কথা ঢেউ খেলে বেড়াচ্ছে।
ভদ্রলোকে নিশ্চয় আনার প্রেমে পড়েছেন। অ্যানা দেখতে ভারী মিষ্টি। তবে একটু বেশি রকমের ভীতু, এই যা।……সে নিশ্চয় ভদ্রলোকের সঙ্গে দুর্গম বনে জঙ্গলে যেতে চাইবে না। সামান্য একটা সাপ দেখলেই যে ভয়ে নীল হয়ে ওঠে! পুরুষ মানুষ কেন যে তাদের বিপরীত স্বভাবের মেয়েদের বেশি পছন্দ করে…..? তারপর অ্যানাকে ডেকে চেঁচিয়ে উঠলেন, সামনের ওই বাসটা প্যাডিংটনে যাবে। চারটে পঞ্চাশে ছাড়বার কথা।
.
১৭.
ঝনঝন শব্দ করে পোয়ালোর ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার কানে তুলতেই অপর প্রান্ত থেকে স্পষ্ট পুরুষালি কণ্ঠস্বর ভেসে এলো।
আমি সার্জেন্ট ওকোনার সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের নির্দেশ মতো আপনাকে ফোন করছি। আজ সকাল সাড়ে এগারোটায় যদি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে তার সঙ্গে একবার দেখা করেন তবে তিনি বিশেষ বাধিত হবেন।
পোয়ারো সম্মতি জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখলেন। ঠিক সাড়ে এগারোটায় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সামনে ট্যাক্সি থেকে অবতরণ করলেন পোয়ারো। একেবারে শ্রীমতি অলিভারের মুখোমুখি। মঁসিয়ে পোয়ারো। বাঃ ভালোই হল। দয়া করে আমার একটা উপকার করবেন?
তেমন সুযোগ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করব ম্যাডাম, আপাতত আমার ট্যাক্সির ভাড়াটা যদি মিটিয়ে দেন। কেমনভাবে যে এটা ঘটল ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। ভুল করে অন্য একটা ব্যাগ নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছি। এব্যাগটায় অন্য সব দেশের মুদ্রা ভরা আছে। বিদেশ ভ্রমণের সময় এগুলো কাজে লাগে। কিন্তু এই ড্রাইভারটা এমনই আহাম্মক যে ফ্র্যাঙ্ক, লীয়্যার বা মার্ক কিছুই নিতে চাইছে না।
পোয়ারো মৃদু হেসে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। তারপর দুজনে সিঁড়ি বেয়ে ওপরের দিকে রওনা দিলেন।
তাঁদের দুজনকে মহাসামাদরে সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের বসবার ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। একটা বড়ো গোল টেবিলের সামনে ব্যাটেল বসে আছেন। আগের চেয়েও আর কঠোর দেখাচ্ছে তাঁকে। শ্রীমতি অলিভার পোয়ারোর কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ঠিক যেন আধুনিক ভাস্করের হাতে গড়া কোনো খোদাই করা প্রস্তুরমূর্তি। ব্যাটেল উঠে দাঁড়িয়ে প্রত্যেকের সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর তিনজন তিনটে চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।
ব্যাটেল বললেন, আমার মনে হয় এখন আমাদের মধ্যে একবার আলাপ-আলোচনা হওয়া দরকার। আমরা পরস্পর কে কতটা এগোতে পারলাম সেটা জানবার জন্যেই আজকের এই আলোচনাচক্র। এখন শুধু কর্নেল রেসের অপেক্ষা।
বলতে বলতে দরজা ঠেলে কর্নেল রেস ঘরে ঢুকলেন। আমি খুবই দুঃখিত। একটু দেরি করে ফেললাম।…..শ্রীমতি অলিভার, কেমন আছেন? হ্যাল্লো, মঁসিয়ে পোয়ারো। আমার জন্যে বোধহয় আপনারা অপেক্ষা করে আছেন? এজন্যে আমি খুবই লজ্জিত। কিন্তু আগামী কালই আমাকে সুদূর প্রাচ্যে রওনা হতে হচ্ছে। তার জন্যে অনেক প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিতে হল।
কোথায় যাচ্ছেন? উৎসুক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন শ্রীমতি অলিভার।
একটা শিকার পার্টির সঙ্গে বেলুচিস্থান যাব।
পোয়ারো সহাস্যে বললেন কাগজে দেখলাম সেখানে কি একটা গন্ডগোল দেখা দিয়েছে। সাবধান থাকবেন কিন্তু।
তাই বুঝি? রেসের কণ্ঠে কৃত্রিম আশঙ্কার সুর ফুটে উঠল। কিন্তু তাঁর চোখের তারায় প্রচ্ছন্ন কৌতুক মিটমিট করছে।
আমাদের এই ব্যাপারে কিছু করতে পারলেন? এবার প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল।
হ্যাঁ, মেজর ডেসপার্ডের বিষয়ে কিছু খবরাখবর সংগ্রহ করে এনেছি। এই নিন। কর্নেল রেস কতকগুলো টাইপকরা কাগজ সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের দিকে এগিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক কখন কোন দেশে ছিলেন তার সঠিক তারিখ আর জায়গার নাম লেখা আছে। আমার মনে হয় এর অধিকাংশই বর্তমান ঘটনার পক্ষে অপ্রয়োজনীয়। ভদ্রলোকের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো অভিযোগ নেই। শক্ত, সমর্থ বলিষ্ঠ পুরুষ। কোনো নিন্দনীয় ঘটনার সঙ্গেও কখনো নিজেকে জড়িয়ে ফেলেননি। সর্বদা সভ্য সমাজের আইনকানুন মেনে চলেন। যখনই যেখানে গেছেন সব সময়েই প্রতিবেশীদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠতে পেরেছেন, তারা তার ওপর আস্থাও রাখে যথেষ্ট। ভদ্রলোক কথা বলেন কম কিন্তু তার বিচার বুদ্ধি খুব পরিষ্কার। সাদা চামড়ার লোকেরাও তাকে একজন পাক্কা সাহেব বলে মনে করে। তার হাতের টিপও খুব নিখুঁত। বিপদে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারেন। দূরদৃষ্টি আছে এবং সবিশেষ নির্ভরযোগ্য।
এই সুবিপুল প্রশংসাতেও ব্যাটেল তেমন বিচলিত হলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, কোনো দুর্ঘটনা বা আকস্মিক মৃত্যুর সঙ্গে তার কি কোনো যোগাযোগ আছে?
আপনার নির্দেশ মতো আমি এই বিষয়ে প্রচুর অনুসন্ধান করেছি, একবার তিনি নিজেকে বিপদের মধ্যে ঠেলে দিয়েও তার এক ভৃত্য অনুচরকে সিংহের নিশ্চিত থাবা থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন।
ব্যাটেল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বাঁচানোর খবরে আমি এখন তেমন আগ্রহী নই।
কর্নেল রেস মৃদু হেসে বললেন আপনি দেখছি খুবই একগুঁয়ে ভদ্রলোক। হ্যাঁ, আর একটা খবর আছে যেটা আপনার পছন্দসই মনে হতে পারে।
ভদ্রলোক একবার দক্ষিণ আমেরিকায় গহিন অরণ্যে শিকারে গিয়েছিলেন। বিখ্যাত বোটানিক্স অধ্যাপক লাক্সমোরও সস্ত্রীক তার সঙ্গে ছিলেন। এক ধরনের কালাজ্বরে অধ্যাপকের মৃত্যু ঘটে। আমাজন নদীর ধারে সেই গভীর জঙ্গলের মধ্যেই তাঁকে কবরস্থ করা হয়।
কালাজ্বর?
হ্যাঁ, কালাজ্বর। তবে আসল ঘটনাটা খুলে বলি। ওই অভিযানে দু-একজন স্থানীয় আদিবাসী ভৃত্যও তাদের সঙ্গে ছিল। তাদের একজনকে চুরির অপবাদে পরে বরখাস্ত করা হয়। ঘটনাটা সেই-ই প্রথম রটিয়েছিল। তার বক্তব্য অধ্যাপক কালাজ্বরে মারা যাননি। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। কিন্তু এমন গুজবে কেউ তেমন কান দেয়নি। কারণ সকলেই মেজর ডেসপার্ডকে খুব শ্রদ্ধা করত। ফলে গুজবটা বেশিদূর ছড়াতে পারেনি।
এটা কতদিন আগের ঘটনাও?
রেস মাথা নাড়লেন। নেহাৎ আপনার অনুরোধেই আমি এই সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেছি। নইলে আমার তো আদৌ বিশ্বাস হয় না সেদিনের হত্যাকান্ডে মেজর ডেসপার্ডের কোন হাত আছে। মনে রাখবেন, তিনি একজন পাক্কা সাহেব।
তার দ্বারা কোনো প্রকার খুন খারাপি সম্ভব নয় বলছেন? কর্ণেল রেস ইতস্তত করলেন। আমি যাকে নরহত্যা বলে মনে করি সে কাজ ওঁর দ্বারা সম্ভব নয়।
কিন্তু যদি তিনি মনে করেন, কারো বেঁচে থাকা যুক্তি সঙ্গত নয়, মৃত্যুই তার উপযুক্ত শাস্তি, তেমন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটাতে ভদ্রলোকের কোনো দ্বিধা থাকবে না, এই তো আপনার বক্তব্য?
যদি সেই রকমই কিছু হয় তবে তার সিদ্ধান্তের পেছনে নিশ্চয় যথেষ্ট পরিমাণ যুক্তি থাকবে।
ব্যাটেল অধৈর্যভাবে মাথা নাড়লেন। মানুষ তার নিজের হাতে আইন তুলে নেবে এটা কখনোই সভ্য সমাজে চলতে দেওয়া যেতে পারে না।
তবু এমন ঘটনা পৃথিবীতে বহুবারই ঘটেছে…..ভবিষ্যতেও ঘটবে।
আমি বলতে চাই সেটা ঘটা উচিত নয়। ব্যাটেল তার সিদ্ধান্তে অবিচল। আপনার কি অভিমত, মঁসিয়ে পোয়ারো?
আমিও আপনার সঙ্গে একমত। বিশেষ করে খুনের ব্যাপারে আমি খুবই শুচিবাইগ্রস্ত।
বাঃ কি সুন্দর ভাবেই না আপনি আপনার বক্তব্য উপস্থিত করতে পারেন। তর্কের গন্ধ পেয়ে শ্রীমতি অলিভার সোজা হয়ে উঠে বসলেন। যেন কোনো শৃগাল বা খরগোস শিকারের কথা বলছেন। কিন্তু আপনি কি মনে করেন না যে পৃথিবীতে এমন লোকও আছে যাদের খুন হওয়াটা সমাজের পক্ষে অতীব প্রয়োজন?
হ্যাঁ, তা তো আছেই।
তাহলে?
আপনি সমগ্র পরিস্থিতিটা ঠিকমতো অনুধাবন করতে পারছেন না। আমার কাছে নিহত ব্যক্তিই সবচেয়ে বড় কথা নয়, হত্যাকারীর চরিত্রের ওপরও এর প্রভাব ব্যাপক এবং সুদূরপ্রসারী।
যুদ্ধকে তাহলে আপনি কোন অভিধায় ফেলবেন?
যুদ্ধে মানুষের ব্যক্তিসত্তার ওপর একটা আদেশের কঠিন আবরণ চাপিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে সেই নির্দেশটাই একমাত্র সত্য, ব্যক্তিসত্তা নয়। সেইজন্যে যুদ্ধকে অতটা সাংঘাতিক বলে অভিহিত করা চলে না। কিন্তু যখনই কোনো বিশেষ ব্যক্তির মনে এই ধারণার উদ্ভব হয় যে পৃথিবীতে কার বাঁচা উচিত বা উচিত নয় সেটা বোঝবার অধিকার তার হয়েছে তখনই তাকে আংশিকভাবে খুনে উন্মাদের সঙ্গে গণ্য করা উচিত। পৃথিবীতে এমন উন্মাদের–ও অভাব নেই, যে কোনো লাভের উদ্দেশ্যে নয়, নিছক একটা ধারণার বশবর্তী হয়েই খুন করে যায়। সে মনে করে, মঙ্গলময় ঈশ্বরের মহান কর্তব্য সম্পাদনের জন্যেই ধরাধামে তাঁর অবতরণ ঘটেছে।
কর্নেল রেস উঠে দাঁড়ালেন। আপনাদের আলোচনায় বেশিক্ষণ যোগ দিতে পারলাম না বলে দুঃখিত। কিন্তু আমার অনেক কাজ বাকি আছে। এই ব্যাপারটার শেষ দেখবার জন্যে আমি বিশেষ আগ্রহী। এমন কি শেষ পর্যন্ত কোনো নিষ্পত্তি না ঘটলেও খুব আশ্চর্য হব না। কারণ কে হত্যাকারী সেটা যদি জানাও যায় তাহলেও আদালতে প্রমাণ করা সহজসাধ্য নয়। যাক, যেসব তথ্য আপনারা জানতে চেয়েছিলেন সাধ্যমতো তা আপনাদের জোগাড় করে দিয়েছি। তবে আমার মতে ডেসপার্ড হত্যাকারী হতে পারেন না। তিনি সে ধরনের লোক নন। শ্যাতানা হয়তো অধ্যাপক লাক্সমোরের মৃত্যুর ব্যাপার নিয়ে কোনো গুজব শুনে থাকবেন। এর বেশি কিছু নয়। ডেসপার্ড একজন পাকা সাহেব। তাঁকে আমি খুনি বলে কল্পনাও করি না এবং তার মনের চরিত্র সম্পর্কে আমার কিঞ্চিৎ অভিজ্ঞতা আছে।
ব্যাটেল প্রশ্ন করলেন। মিসেস লাক্সমোর কি ধরনের মহিলা? তিনি এখন স্থায়ীভাবেই লন্ডনে বাস করেন। সুতরাং আপনারা নিজেরাই যোগাযোগ করে নিতে পারবেন। এই কাগজ পত্রের মধ্যে তার ঠিকানা লেখা আছে। যতদূর স্মরণ হচ্ছে, কেনসিংটনের কোনো জায়গায়। তাহলেও আবার বলে যাচ্ছি, ডেসপার্ড আপনাদের অভীষ্ট মানুষ নন।
কর্নেল রেস বিদায় জানিয়ে চলে গেলেন। তাঁর শব্দহীন পদবিক্ষেপের সঙ্গে অভিজ্ঞ শিকারীর পথ চলার সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায়।
রেস চলে যাওয়ার পর সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। তাঁর সারা মুখে সুগভীর চিন্তার ছায়া। ভদ্রলোক হয়তো ঠিকই বলছেন;স্বগতোক্তির সুরে বিড়বিড় করলেন ব্যাটেল। মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে ওঁর জ্ঞান খুব গভীর, কিন্তু তাহলেও সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া কেবল মুখের কথাকেই অভ্রান্ত বেদবাক্য বলে মেনে নেওয়া যায় না।
কর্নেল রেস যে নথিপত্রের স্তূপ রেখে গেছেন সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল তার মধ্যে চোখ ডোবালেন। মাঝে মাঝে তার নিজের প্যাডে পেন্সিল দিয়ে নোট করে নিলেন কিছু কিছু।
তাহলে সুপারিনটেনডেন্ট–শ্রীমতি অলিভার প্রশ্ন করলেন–আপনি এ বিষয়ে কিভাবে এগোচ্ছেন সে সম্বন্ধে কি কিছু বলবেন না?
ব্যাটেল চোখ তুলে মৃদু হাসলেন, হাসির ফলে তার প্রস্তুর কঠিন মুখে ঈষৎ খাঁজ পড়ল। এলোমেলো খাপছাড়া ভাবে সামান্য কিছু এগিয়েছি। তার মধ্যে সুনিশ্চিত ধারাবাহিকতা কিছু নেই। আশা করি আপনিও সেটা বুঝতে পারছেন?
শ্রীমতী অলিভারের চোখে সন্দেহের ছায়া ফুটে উঠল। আপনি যা বলতে চান না। তা যে কখনো বলবেন না সে আমি জানি।
না না, দৃঢ়ভাবে মাথা নাড়লেন ব্যাটেল, টেবিলে সমস্ত তাসই পড়ে আছে। তার থেকে আপনারা প্রভূত রহস্যের হদিশ বার করুন। আমি কিছুই গোপন রাখতে চাই না।
শ্ৰীমতী অলিভার তাঁর চেয়ারটা আরও খানিকটা কাছে টেনে এনে বললেন, তাহলে বলুন।
ব্যাটেল ধীরে ধীরে শুরু করলেন, প্রথমে আমি এই কথাই বলব যে মিঃ শ্যাতানার হত্যাকারী কে? সে সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র আলোর নিশানা এখন খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার ব্যক্তিগত কাগজপত্রের মধ্যেও এর কোনো সূত্র বা কোনো ইঙ্গিত নেই। সন্দেহভাজন চারজনের সম্বন্ধেও সমভাবে একই কথা প্রযোজ্য। আমার লোক সারাক্ষণ এদের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। কিন্তু এ পর্যন্ত তাতে কোনো ফল হয়নি। আমার বিশ্বাস, এর সাহায্যে কোনো প্রত্যক্ষ ফল পাওয়া যাবে না। তবে মঁসিয়ে পোয়ারো যা বলেছেন সেই একটা পথই আমাদের সামনে খোলা আছে, তা হচ্ছে অতীত। প্রথমে খুঁজে বার করতে হবে অতীতে এই চারজন কি ধরনের অপরাধ করেছিল তার সাহায্যে হয়তো আমরা বর্তমান খুনটার কোনো হদিশ পেতে পারি, তবে এদের মধ্যে একটা বিরাট কিন্তু থেকে যাচ্ছে। সত্যিই এই চারজন তেমন কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িত কিনা সেটাও যথেষ্ট সন্দেহের ব্যাপার, মিঃ শ্যাতানা হয়তো মঁসিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে বেয়াড়া ধরনের কোনো ঠাট্টা করেছিলেন।
এদের অতীত জীবন সম্বন্ধে কি কিছু জানতে পারলেন?
একজনের ওপর আমার কিছুটা সন্দেহ হচ্ছে?
সে কে?
ডাক্তার রবার্টস।
রোমাঞ্চিত আগ্রহে শ্রীমতি অলিভার টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়লেন।
মঁসিয়ে পোয়ারো জানেন যে আমি সমস্ত রকম থিওরিই হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখেছি, খবর নিয়ে জেনেছি ডাক্তার রবার্টসের কোনো নিকট আত্মীয়দের মধ্যে কারো আকস্মিক ভাবে মৃত্যু ঘটেনি। তবে তার অতীত জীবন তন্নতন্ন করে ঘেঁটে একটি মাত্র ঘটনার সন্ধান আমি পেয়েছি যার সঙ্গে বর্তমান মামলার কোনো যোগসূত্র থাকলেও থাকতে পারে। অবশ্য সম্ভাবনা খুবই কম। কয়েক বছর আগে ডাক্তার রবার্টস তাঁর কোনো মহিলা পেশেন্টের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। হয়তো এটা আসলে সত্যি নয় এবং সত্য না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি, মহিলাটি ছিলেন মানসিক রোগগ্রস্ত আর যথেষ্ট আবেগপ্রবণ, নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা করার ঝোঁকও তার ছিল। স্বামীটি হয়তো আসল সত্য টের পেয়ে যান কিংবা স্ত্রীই হয়তো কোনো দুর্বল মুহূর্তে তার কাছে প্রকৃত ঘটনা স্বীকার করে থাকবেন। যা হোক, ডাক্তার রবার্টসকে কেন্দ্র করে সেই পরিবারে একটা গন্ডগোলের সূত্রপাত ঘটে। ভদ্রমহিলার স্বামী অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে রবার্টসকে খুব শাসিয়ে ছিলেন। তার নামে মেডিক্যাল কাউন্সিলে রিপোর্ট করবেন বলেও জানালেন। যার ফলে তার সমূহ পসার বিনষ্ট হয়ওয়ার সম্ভাবনা।
তারপর কি হল? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন শ্রীমতী অলিভার।
যতদূর মনে হয়, ডাক্তার রবার্টস সাময়িকভাবে ভদ্রলোকের উত্তেজনা শান্ত করতে পেরেছিলেন, ভদ্রলোক অবশ্য এই ঘটনার অল্প কিছুদিন বাদেই অ্যানথ্রক্সে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
অ্যানথ্রক্সে, কিন্তু এটা তো সাধারণত গবাদি পশুদেরই হয়ে থাকে।
সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল মৃদু হাসলেন। তা ঠিক। এটা দক্ষিণ আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ানদের বিষাক্ত তীর নয় ডাক্তারি শাস্ত্রে যার কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। আপনার হয়তো স্মরণ আছে সস্তা দামের এক ধরনের সেভিং ব্রাশ সম্বন্ধে, এক সময় বাজারে খুব সোরগোল চলেছিল। তার মধ্যে অনেকগুলোই নাকি দুষিত। ওই ভদ্রলোকের সেভিং ব্রাশটাও দুষিত ছিল বলে প্রমাণিত হয়।
ডাক্তার রবার্টস কি তার চিকিৎসা করেছিলেন?
না না, তিনি, অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি। সন্দেহজনক একটি মাত্র সূত্র যা আমি পেয়েছি ছোট হলেও তা খুব মূল্যবান। সেটা হল তখন ডাক্তার রবার্টসের পেশেন্টদের মধ্যে একজন অ্যানথ্রক্সে ভুগছিলেন।
আপনি বলতে চান ডাক্তার বরাটসই ভদ্রলোকের সেভিং ব্রাশটা দূষিত করে রাখেন।
সেই রকমই আমার ধারণা। তবে বুঝতেই পারছেন, এ সমস্তই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। আর এগোবার কোনো উপায় নেই। সবটাই অনুমান, তাহলেও খুব একটা অসম্ভব ব্যাপার নয়।
তিনি কি মিসেস ক্র্যাডককে পরে বিয়ে করেছিলেন?
আরে না না; আমার বিশ্বাস দুর্বলতা যা কিছু ছিল তা সবই ওই ভদ্রমহিলার এক তরফা। ডাক্তার রবার্টস তেমন প্রেমটেমের ধার ধারতেন বলে মনে হয় না। মিসেস ক্র্যাডক তবু দু-একবার ভাঙা সম্পর্ক জোড়া লাগাবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু হঠাৎ একদিন এখানকার পাততাড়ি গুটিয়ে সেই শীতকালেই মিশর চলে গেলেন, সেখানেই শেষ পর্যন্ত মারা যান। এক ধরনের সাংঘাতিক সংক্রামক রোগ, যার ফলে শরীরের সমস্ত রক্ত দূষিত হয়ে যায়। এই রোগের একটা লম্বা চওড়া নাম আছে। মিশরেই এর প্রাদুর্ভাব বেশি।
তাহলে এর মধ্যে ডাক্তারের কোনো হাত নেই বলে মনে করেন?
ঠিক বলতে পারি না। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন। এ-বিষয়ে আমার একজন রোগজীবাণুবিদ বন্ধুর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেছি। এদের মুখ থেকে স্পষ্ট করে কোনো উত্তর পাওয়া শক্ত। তারা হ্যাঁ কি না কিছুই বলতে চায় না, এইটুকুই শুধু বলেছে, কোনো কোনো পরিস্থিতিতে ডাক্তারের হাত থাকা সম্ভব। রোগের অবস্থার ওপরেও এটা অনেকটা নির্ভরশীল। রুগির ব্যক্তিগত মেজাজও এ-ব্যাপারে বিচার্য। এই ধরনের ভাসা ভাসা অনেক কথাই আমাকে জানিয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত জেরা করে তার কাছ থেকে একটা কথা আদায় করেছি যেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার মতে ডাক্তার রবার্টসের পক্ষে মিসেস ক্র্যাডকের ইংলন্ড ত্যাগের প্রাক্কালে তার শরীরে এই রোগের জীবাণু কোনো উপায়ে প্রবিষ্ট করিয়ে দেওয়া সম্ভব। কারণ জীবাণু দেহে প্রবেশ করার বেশ কিছুদিন বাদে এই রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পেতে থাকে।
পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, মিসেস ক্র্যাডক কি মিশরে যাবার আগে টাইফয়েডের প্রতিষেধক কোনো ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন?
আপনি ঠিকই আন্দাজ করেছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো।
ডাক্তার রবার্টসই বোধহয় ইঞ্জেকশনটা দিয়েছিলেন?
হ্যাঁ তিনিই দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘুরে ফিরে আমরা সেই সত্যের সম্মুখীন হচ্ছি। আমাদের হাতে কোনো প্রমাণ নেই। যাবার আগে ভদ্রমহিলা ডাক্তার রবার্টসের চেম্বারে গিয়ে দুটো ইঞ্জেকশন নিয়েছিলেন, সেগুলো রোগের প্রতিষেধক হতে পারে আবার অন্য কিছু হওয়াও বিচিত্র নয়। আমরা কোনোদিনই নিশ্চিতভাবে তা জানতে পারব না। সমস্ত ব্যাপারটা অনুমান নির্ভর। শুধু এইটুকু বলা যায় আমাদের ধারণাটা সত্য হলেও হতে পারে।
পোয়ারো চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। এই ঘটনাটা মিঃ শ্যাতানার একটা মন্তব্যের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যাচ্ছে। তিনি সফল খুনিদের কথা বলেছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে আদালতে কোনো অভিযোগ উত্থাপন করা যাবে না। কারণ প্রমাণের অভাব।
শ্ৰীমতী অলিভার প্রশ্ন করলেন, মিঃ শ্যাতানা এত সব খবর জোগাড় করলেন কোথা থেকে?
পোয়ারো চিন্তাকুল চোখ তুলে তাকালেন। এ প্রশ্নের উত্তর পাবার আর কোনো উপায় নেই। তবে তিনি এক সময়ে মিশরে গিয়েছিলেন তা আমরা জানি। সেখানেই মিসেস লরিমারের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়, তিনি হয়তো স্থানীয় কোনো ডাক্তারের মুখে মিসেস ক্র্যাডকের কথা শুনে থাকবেন। সেই ডাক্তার হয়তো তার কাছে ভদ্রমহিলার রোগের লক্ষণ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহজনক মন্তব্য করেছিলেন। ডাক্তার রবার্টসের সঙ্গে মিসেস ক্র্যাডকের অবৈধ সম্পর্কের কথা তিনি নিশ্চয় আগে থেকে জানতেন। তার ফলেই একটা কিছু অনুমান করে নিয়েছিলেন। ডাক্তার রবার্টসকেও এ ঘটনার কোনো ইঙ্গিত দিতে পারেন! শ্যাতানার কথায় ডাক্তার বরার্টস বোধহয় চমকে উঠেছিলেন। কোনো কোনো লোকের এক ধরনের বিশেষ ক্ষমতা থাকে। তার সাহায্য তারা অনায়াসে অপরের গোপন কথা জেনে নিতে পারে। অবশ্য এ ধরনের আলোচনা এ ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, আমরা শুধু এইটুকু বলতে পারি, তিনি হয়তো কোনো কিছু সন্দেহ করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হল তার অনুমান বা সন্দেহ নির্ভুল কিনা?
আমার, তো মনে হয় তিনি নির্ভুল। ব্যাটেল বললেন, আমাদের সদাহাস্যময় অমায়িক ডাক্তার হয়তো সর্বদা সতর্ক থাতে পারেননি। এই ধরনের আরও কয়েকজনকে আমি জানি। এদের পরস্পরের মধ্যে কি করে যে এত অদ্ভুত সাদৃশ্য থাকে সেইটাই সবথেকে আশ্চর্যের। ভদ্রলোক যে একজন খুনি যে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। তিনিই মিঃ ক্র্যাডককে খুন করেছেন। যদি মিসেস ক্র্যাডকের জন্যে তার কোনো বদনাম ছড়াবার আশঙ্কা থাকে তবে তিনি তাঁকেও খুন করে থাকতে পারেন। কিন্তু মিঃ শ্যাতানাকে তিনি খুন করেছেন কিনা সেইটাই আসল প্রশ্ন। অপরাধের ধরণ দেখে এ-বিষয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। ক্র্যাডকের হত্যার ব্যাপারে তিনি তাঁর অধীত বিদ্যা কাজে লাগিয়েছিলেন যার ফলে সকলের চোখে মৃত্যুটা স্বাভাবিক বলে প্রতিপন্ন হয়েছিল। আমার মতে, যদি তিনি শ্যাতানাকে খুন করবার কথা ভাবতেন তবে ছুরির বদলে এই ধরনের কোনো উপায় উদ্ভাবন করতেন।
এটা যে তাঁর কীর্তি সেকথা আমার কখনো মনে হয়নি। শ্রীমতি অলিভার সুচিন্তিত মতামত প্রকাশ করলেন। এক মুহূর্তের জন্যেও আমি সেকথা ভাবিনি। কারণ সন্দেহটা সর্বপ্রথম তার ওপর গিয়েই পড়ে। আর এটা তো স্বতঃসিদ্ধ, যার ওপর প্রথম সন্দেহ হয়, সে কিছুতেই আসল অপরাধী হতে পারে না।
পোয়ারো কৌতুকের সুরে বিড়বিড় করলেন, তাহলে ডাক্তার রবার্টস মুক্তি পেলেন। বাকি রইলেন অন্যেরা।
ব্যাটেলের চোখে মুখে অসহায়তার ভাব ফুটে উঠল। অন্যদের সম্বন্ধে বিশেষ কোনো খবর নেই। বছর কুড়ি হল মিসেস লরিমার বিধবা হয়ছেন। ভদ্রমহিলা বছরের অধিকাংশ সময়েই লন্ডনে বাস করেন। শীতকালে মাঝে মধ্যে দেশ বিদেশে বেড়াতে যান। রিভারিয়া, মিশর ইত্যাদি সভ্যাসভ্য শহর তার পছন্দ। কোনো রহস্যময় মৃত্যুর সঙ্গে তাঁর কোনো সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাঁর মতো সম্ভ্রান্ত মহিলার যেভাবে জীবনযাপন করা উচিত তিনি তাই করছেন। সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং সম্মানীয় জীবন, প্রত্যেকেই তাকে শ্রদ্ধা করে এবং তাঁর চরিত্র সম্বন্ধেও সকলের ধারণা বেশ উঁচু। তাঁর দোষের মধ্যে শুধু এইটুকুই বলা যায় যে তিনি বোকামি বা মূর্খতা একদম সহ্য করতে পারেন না। বলতে বাধা নেই, সব দিকেই আমি ব্যাপক অনুসন্ধান করে দেখেছি কিন্তু কিছু খুঁজে পাইনি। অথচ একটা কিছু তার জীবনে আছে। শ্যাতানা অন্তত সেই রকমই মনে করতেন।
ব্যাটেল হতাশভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর মিস মেরিডিথ, তার ইতিহাসও আমি তদন্ত করে জেনেছি। সাধারণ সাদামাটা গল্প। তার পিতা সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন। মৃত্যুকালে মেয়ের জন্যে বিশেষ কিছু রেখে যেতে পারেননি, তার ফলে তাকে নিজেই নিজের অন্নের সংস্থান করতে হয়। কোনোরকম হাতের কাজেও তার কোনো শিক্ষণ নেই। কেন্টেনহ্যামে তার প্রথম জীবন সম্পর্কে আমি খোঁজ খবর নিয়েছি। সমস্তই সহজ সরল। প্রত্যেকেই হতভাগ্য মেয়েটির জন্যে আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। পিতার মৃত্যুর পর মেয়েটি প্রথমে উইট দ্বীপে একজনের বাড়িতে কাজ করত। দুটি ছোট ছেলেমেয়েকে দেখাশোনার ভার দেওয়া হয়েছিল, তার ওপর যাঁর বাড়িতে সে কাজ করত সেই ভদ্রমহিলা এখন স্বামীর সঙ্গে প্যালেস্টাইনে আছেন। তবে আমি তার বোনের সঙ্গে কথাবার্তা বলে জেনেছি সেই ভদ্রমহিলা মিসেস এল্ডন মেরিডিথকে খুব পছন্দ করতেন। বলা বাহুল্য কোনো রহস্যময় মৃত্যু বা আকস্মিক দুর্ঘটনা সেখানে ঘটেনি।
ভদ্রমহিলা প্যালেস্টাইনে চলে যাবার পর মিস মেরিডিথ ডেভনশায়ারে তার এক বান্ধবীর আত্মীয়ার বাড়িতে একটা কাজ পায়। স্কুল জীবনের সেই বান্ধবী, রোডা দোয়াসের সঙ্গে সে এখন বাস করে। মেরিডিথ দু’বছর সেই ভদ্রমহিলার বাড়িতে ছিলেন। ইদানিং তিনি এত অসুস্থ হয়ে পড়েন যে তার জন্যে একজন পাসকরা নার্সের বন্দোবস্ত করতে হয়। খবর নিতে জানলাম তাঁর ক্যান্সার হয়েছে। ভদ্রমহিলা এখনও বেঁচে আছেন তবে তেমনভাবে বেঁঢ় থাকার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়। প্রায় সারাক্ষণই তাঁকে মর্ফিয়া দিয়ে আচ্ছন্ন করে রাখতে হ। আমি তার সঙ্গেও দেখা করেছি। অ্যানাকে তার বেশ মনে আছে। তাঁর মতে আনা বেশ ভালো মেয়ে। সেখনাকার স্থানীয় আরও দু-চার জন লোকের সঙ্গেও আমি তৎকালীন ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনা করেছি। কিন্তু কোনো রহস্যময় মৃত্যুর সন্ধান পায়নি।
তার পর সুইজারল্যান্ড। ভাবলাম সেখানে হয়তো কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনার খবর খুঁজে বার করতে পারব কিন্তু তা পারিনি। এমনকি উইলকিং ফোর্ডেও এ-বিষয়ে কোনো খবর নেই।
তাহলে মেরিডিথকেও আমাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া যেতে পারে? প্রশ্ন করলেন পোয়ারো।
ব্যাটেল দ্বিধান্বিত চিত্তে বললেন, সেকথা আমি বলতে চাই না। কোথাও একটা গন্ডগোল নিশ্চয় আছে, তার চোখেমুখে প্রায়শই একটা বিহ্বল আতঙ্কের ছায়া ফুটে ওঠে যেটাকে কোনোমতেই শ্যাতানার মৃত্যুজনিত ভয় বলা চলে না। চারিদিকেই তার ভীতচকিত দৃষ্টি। সর্বদাই যেন বড় বেশি সশঙ্কিত হয়ে আছে। আমি শপথ করে বলতে পারি, নিশ্চয় সে কোনো ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু ওই যে বললাম মেরিডিথ নির্দোষ জীবনযাপন করে।
শ্রীমতী অলিভারের চোখের তারা চকচক করে উঠল। ঠোঁটের ফাঁকে সবজান্তার হাসি। বললেন, কিন্তু তবু অ্যানা মেরিডিথ এক সময় এমন এক বাড়িতে কাজ করত, যে বাড়ির এক ভদ্রমহিলা ওষুধের বদলে ভুল করে এক ধরনের বিষাক্ত পালিশ খেয়ে মারা যান।
তাঁর কথার ফল যে কি হল সে সম্বন্ধে তাঁর কোনো অভিযোগ করার কারণ থাকল না। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল অধীর উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠলেন। বিস্ময় বিস্ফারিত দু’চোখের দৃষ্টি শ্ৰীমতী অলিভারের মুখের ওপর নিবদ্ধ। জিজ্ঞেস করলেন তাই নাকি? এ-খবর আপনি কোথা থেকে সংগ্রহ করলেন?
আমিও একটু আধটু গোয়েন্দাগিরি করেছিলাম, শ্রীমতী অলিভারের কন্ঠে গর্বিত আমেজের সুর, তবে তা কেবল মেয়েদের মধ্যেই। ওদের ওয়েল্ডডন কুটিয়ে গিয়ে একটা আষাঢ়ে গল্প ফঁদলাম, বললাম ডাক্তার রবার্টসকেই আমার সন্দেহ। রোডা মেয়েটা খুব ভালো। আমার সঙ্গে সহৃদয় ব্যবহার করল। তার ধারণা আমি একজন খুব মস্ত বড় লেখিকা। তবে মিস মেরিডিথ আমার আগমনকে সুনজরে দেখেনি। এবং তার এই মনোভাবটা স্পষ্ট করেই আমাকে জানিয়ে দিলো। মেয়েটা খুবই সন্দেহপ্রবণ। গোপন করবার মতো কোনো কিছু না থাকলে সে অত সন্দেহপ্রবণ হয় কেন? আমি তাদের দু’জনকেই লণ্ডনে আমার ফ্ল্যাটে আসবার জন্যে আহ্বান জানিয়ে ছিলাম। কেবল রোডা এসেছিল। তার মুখ থেকেই কথায় কথায় সমস্ত ঘটনাটা জানতে পারলাম। আমার প্রতি অ্যানার মনোভাবের কথা উঠল। রোডা বলল, আমার একটা কথায় নাকি অ্যানার কোনো বেদনাদায়ক অতীত স্মৃতি মনে পড়ে গিয়েছিল। সেই জন্যেই সেদিন আমাকে ঠিক সহ্য করতে পারেনি, আমার কাছে আসল ঘটনাটার বর্ণনা দিলো।
কখন এবং কোথায় এটা ঘটেছিল তা জানতে পেরেছেন?
তিন বছর আগে। ডেভনশায়ারে, সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল বিড়বিড় করে কি যেন বললেন স্পষ্ট শোনা গেল না। প্যাডের ওপর পেন্সিল দিয়ে খসখস করে নোট লিখলেন। তার প্রস্তর কঠিন মুখে আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস।
শ্রীমতী অলিভার নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে সমগ্র পরিস্থিতিটা যেন মনোযোগ সহকারে উপভোগ করছেন। কেরামতি দেখাবার এই অপূর্ব সুযোগ পেয়ে তিনি গর্বিত।
আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ মিসেস অলিভার। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল সংযত চিত্তে তাকে অভিবাদন জানালেন। সত্যিই আপনি আমাদের ওপর একহাত টেক্কা দিয়েছেন। নিঃসন্দেহে অতিমূল্যবান সংবাদ। কত সহজেই যে কোনো ঘটনা একজনের নজর এড়িয়ে যেতে পারে এটা তারই উজ্জ্বলতম নিদর্শন।
তিনি কিছুক্ষণ মনে মনে চিন্তা করলেন, তবে মেয়েটা নিশ্চয় সেখানে খুব বেশি দিন বাস করেনি। বড় জোর মাস দুয়েক থাকতে পারে। উইট দ্বীপ আর মিস দোয়াসের আত্মীয়ার বাড়ি কাজে লাগবার মধ্যবর্তী সময়ের ঘটনা। অ্যানা যে সেখান থেকে বিদায় নিয়ে ডেভনশায়ারে গেছে এইটুকুই শুধু মিসেস এন্ডনের বোনের স্মরণে ছিল। কার কাছে গেছে তা ঠিক বলতে পারেননি।
পোয়ারো হঠাৎ প্রশ্ন করলেন, মিসেস এল্ডন কি খুব অগোছালো স্বভাবের মহিলা?
ব্যাটেলের চোখের তারায় এক আশ্চর্য বিস্ময় ফুটে উঠল। আপনার মুখ থেকে একথা শুনে আমার খুব অবাক লাগছে। মঁসিয়ে পোয়ারো, আলোচনা প্রসঙ্গে মিসেস এল্ডনের অগোছালো স্বভাবের কথা তার বোন একবার আমাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে খবর আপনার কাছে পৌঁছল কি করে?
শ্ৰীমতী অলিভার মন্তব্য করলেন, যেহেতু তিনি তাঁর দুই ছেলে মেয়েকে দেখাশোনা করবার জন্য অ্যানাকে নিযুক্ত করেছিলেন তার থেকেই হয়তো মঁসিয়ে পোয়ারো এমন সিদ্ধান্তে এসেছেন।
না না, তা নয়। সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। আমার অল্প কৌতূহল জেগেছিল বলেই কথাটা জিজ্ঞেস করলাম। ঠিক আছে, আপনি বলে যান, সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল।
আমি ভেবেছিলাম–আবার শুরু করলেন ব্যাটেল–যে অ্যানা হয়তো সোজা মিস দোয়াসের আত্মীয়র বাড়িতে গিয়েই উঠেছিল। মেয়েটা যে এত চতুর জানতাম না। আমাকে ঠকিয়েছে। সবসময় আমার কাছে মিথ্যে বলে গেছে।
মিথ্যে বলাটাই সব সময় অপরাধের চিহ্ন নয়। পোয়ারো মন্তব্য করলেন।
তা আমি জানি; ব্যাটেলও এ কথায় সায় দিলেন। মিথ্যে বলা অনেকের স্বভাব। এবং মিস মেরিডিথ তাদের একজন। সব সময় যা ভালো শোনায় তাই সে বলবে। কিন্তু এই রকম গুরুত্বপূর্ণ অর্থকে চাপা দেবার অপচেষ্টা তার পক্ষে একটা মারাত্মক ঝুঁকির কাজ হয়েছে।
শ্রীমতী অলিভার বললেন, ও হয়তো জানতো। না,অতীত অপরাধ সম্পর্কেই আপনার কৌতূহল বেশি।
সেই জন্যে এটা আরও বেশি সন্দেহজনক। কেনই বা সে এই সত্যটাকে চেপে যাবার চেষ্টা করবে? এটাকে তো দুর্ঘটনা বলেই সকলে জানে, তবে তার এত ভয়ের কারণ কি! অবশ্য সে যদি সম্পূর্ণ নির্দোষ হয়।
হ্যাঁ, ডেভনশায়ারে মৃত্যুর ব্যাপারে যদি সে সম্পূর্ণ নির্দোষ হয়। পোয়ারো ব্যাটেলের ভ্রম সংশোধন করে দিলেন।
ব্যাটেল পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন, আপনার কথার তাৎপর্য আমি বুঝতে পারছি, ওই দুর্ঘটনাটা শেষ পর্যন্ত হত্যাকান্ড বলে প্রমাণিত হলেও তার দ্বারা এটা প্রমাণ হয় না যে শ্যাতানাকেও সে খুন করেছে। তাহলেও আগের খুনটা খুনই। এবং প্রত্যেক হত্যাকারীর শাস্তিবিধানই আমার কাম্য।
পোয়ারো স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন কিন্তু মিঃ শ্যাতানার মতে তা সাধ্যাতীত।
হ্যাঁ ডাক্তার রবার্টসের বেলায় তা অসম্ভব। দেখা যাক, মিস মেরিডিথের ক্ষেত্রেও সেটা সমভাবে প্রযোজ্য কিনা। আমি কালই ডেভনশায়ারে রওনা হব।
কিন্তু কোথায় যেতে হবে তা কি আপনি জানেন? শ্রীমতী অলিভার প্রশ্ন করলেন, রোডাকে আমি এ-সম্বন্ধে আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
সেটা ভালোই করেছেন। বেশি ঘাঁটালে মনে কোন সন্দেহ জাগতে পারত। আমার পক্ষে আসল জায়গা খুঁজে বার করা খুব কষ্টকর হবে না। নিশ্চয় ব্যাপারটা করোনারের কোর্টে উঠেছিল। এসবই তো পুলিশের দৈনন্দিন কাজ। কাল সকালের মধ্যেই ওরা নিশ্চয়ই সব নথিপত্র হাজির করে দেবে।
মেজর ডেসপার্ডের কি খবর? প্রশ্ন করলেন শ্রীমতি অলিভার। তাঁর সম্বন্ধে কতদূর কি জানতে পারলেন?
এতদিন কর্নেল রেসের রিপোর্টের অপেক্ষায় ছিলাম। আমার নোক অবশ্য সব সময় তাকে চোখে চোখে রেখেছে। একটা মজার খবর আছে। ভদ্রলোক উইলিং ফোর্ডে মিস মেরিডিথের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, আপনাদের বোধহয় স্মরণ আছে, সেদিন জেরার সময় তিনি বলেছিলেন মেয়েটির সঙ্গে তাঁর কোনো পরিচয় নেই।
পোয়ারো বিড়বিড় করলেন, মেরিডিথ কিন্তু প্রকৃতই সুন্দরী! ব্যাটেল হেসে উঠলেন। আমার তো মনে হয় দেখা করতে যাওয়ার পক্ষে সেইটাই একমাত্র কারণ। হ্যাঁ, ভালো কথা, ডেসপার্ড কিন্তু কোনো সুযোগই হাতছাড়া করতে রাজি নন। ইতিমধ্যে সলিসিটরের পরামর্শ নিয়েছে। বোঝা যাচ্ছে। তিনিও বিপদের আশঙ্কা করেন।
ভদ্রলোক আগে থেকে ভাবনা চিন্তা করে কাজে হাত দেন। মন্তব্য করে কাজে হাত দেন। মন্তব্য করলেন পোয়ারো। যে-কোনো অবস্থার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত রাখেন।
ব্যাটেল দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, সেই জন্যেই তিনি কারো বুকে হঠাৎ একটা ছুরি বসিয়ে দেবেন, এটা ভাবা যায় না।
যদি না সেটাই একমাত্র অবশিষ্ট উপায় হয়। পোয়ারো কথার খেই ধরলেন, তিনি যে দ্রুতগতিতে বিচক্ষণ ও তৎপরতার সঙ্গে কাজ করতে পারেন, দয়া করে সে কথাটাও মনে রাখবেন।
ব্যাটেল পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন। আপনার হাতের তাস কি বলছে, মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি হাত উপুড় করবেন না এখন নিজেকে লুকিয়ে রাখবেন?
পোয়ারো ঠোঁটের ফাঁকে মৃদু হাসলেন। আমার তাসের ক্ষমতা খুবই সীমিত। হয়তো ভাবছেন, আপনাদের কাছ থেকে কিছু গোপন করছি। কিন্তু তা নয়, বিশেষ কোনো তথ্যই আমি জানি না। ডাক্তার রবার্টস এবং মিসেস লরিমারের সঙ্গে আমি দেখা করেছি। মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছে। বাকি কেবল মিস মেরিডিথ। এই তিনজনের সঙ্গে কথা বলে আমি কেবল এইটুকুই জেনেছি ডাক্তার রবার্টস চারদিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখে চলেন। মিসেস লরিমারের মানসিক একাগ্রতা মাত্রাতিরিক্ত বেশি এবং তারই অনিবার্য ফলশ্রুতিস্বরূপ নিজের পারিপার্শ্বিক অবস্থা সম্বন্ধে তিনি পুরোদস্তুর অন্ধ। ফুল তার খুবই প্রিয়। ডেসপার্ড যেসব বস্তু পছন্দ করেন কেবল সেইগুলোই তার বিশেষ ভাবে নজরে পড়ে রঙবেরঙের দামি দামি কম্বল, খেলা ধুলার ট্রফি ইত্যাদি। দৃষ্টি তার তেমন ব্যাপক নয়; অন্তদৃষ্টি বা মানসিক একাগ্রতাও কম। তাঁর দৃষ্টি ক্ষেত্রেবিশেষের মধ্যে সীমিত। যেসব জিনিসের সঙ্গে তার মনের মিল আছে কেবল তাই তিনি লক্ষ্য করেন।
তাহলে এই গুলোকেই আপনি ঘটনা বলছেন? ব্যাটেলের কণ্ঠে ক্ষুব্ধ কৌতুক। ক্ষুদ্র নগণ্য হলেও এগুলো তথ্য তো বটেই।
মিস মেরিডিথ সম্বন্ধে কি ভাবছেন?
আমার তালিকায় সকলের শেষে তার নাম। তবে তাকেও আমি একই প্রশ্ন করব, ওই ঘরের কি কি জিনিসের কথা তার স্মরণে আছে। আপনার কর্মপদ্ধতি কিন্তু ভারি অদ্ভুত। ব্যাটেল চিন্তিত গলায় বললেন, বড় বেশি মনস্তত্বের মারপ্যাঁচ। ধরুন, ওরা যদি সকলেই মিথ্যে কথা বলে?
পোয়ারো মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। না, তা সম্ভব নয়। তারা আমাকে সাহায্য করুক বা না করুক, কোনো অবস্থাতেই নিজের মনের গতি প্রকৃতিকে গোপন রাখতে পারবে না।
আপনার কর্মপদ্ধতির মধ্যে কিছু একটা বিশেষত্ব আছে, তা স্বীকার করি। ব্যাটেল বললেন, কিন্তু আমি ঠিক ওরকমভাবে কাজ করতে অভ্যস্ত নই।
পোয়ারোর চোখের কোণে কৌতুকের ছটা। বললেন, দেখতেই পাচ্ছেন, আপনার বা মিসেস অলিভারের তুলনায় আমি কত সামান্যই এগোতে পেরেছি। এমন কি কর্নেল রেসের তুলনায়ও আমি কত নগণ্য। আমার হাতের তাস আমি টেবিলের ওপর রাখলাম, কিন্তু সবই দুরি তিরিতে ভরা।
ব্যাটেল চোখ মিটমিট করলেন। কিন্তু মঁসিয়ে পোয়ারো, রঙের দুরি চেহারার সামান্য হলেও অন্য যে কোনো তিনটে টেক্কাকে তুরুপ করে নিয়ে নেবার ক্ষমতা ধরে। সে যা হোক, আমি এখন বাস্তব অর্থেই আপনার হাতে একটা কাজের ভার তুলে দিতে চাই।
কাজটা কি?
অধ্যাপক লাক্সমোরের বিধবা স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা।
আপনি নিজে কেন সে দায়িত্ব নিচ্ছেন না?
কারণ আগামী কালই আমি ডেভনশায়ার যাব। পোয়ারো যেন ব্যাটেলের কথা শুনতে পাননি। একইভাবে আবার প্রশ্ন করলেন। আপনি কেন দায়িত্বটা নিজে নিতে চাইছেন না?
ধাপ্পায় আপনি ভুলবেন না দেখছি, তাহলে সত্যি কথাটাই বলি। আমার বিশ্বাস, আপনি তার কাছ থেকে অনেক বেশি কথা আদায় করতে পারবেন যা আমার সাধ্যে কুলোবে না।
কিন্তু আমার পদ্ধতি তো আপনার মতো সহজ সরল নয়।
ঘুরিয়ে কথা বলা আপনার অভ্যাস। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল মৃদু হাসলেন। ইন্সপেক্টর জ্যাপের মুখে শুনেছি, আপনি নাকি লোকের মনে খুব খোঁচা দিতে পারেন।
পরলোকগত মিঃ শ্যাতানার মতো? আপনি কি মনে করেন তিনি ভদ্রমহিলার কাছ থেকে গুপ্ত কথা আদায় করে নিতে পরেছিলেন?
পোয়ারো ধীর গম্ভীর স্বরে বললেন, আমার বিশ্বাস, তিনি তা নিয়েছিলেন।
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ব্যাটেল চোখ তুলে তাকালেন। কি করে আপনার এ-ধরনের বিশ্বাস হল?
মেজর ডেসপার্ডের একটা মুখের কথায়।
তিনি বোধ হয় ভুল করে মনের কথা প্রকাশ করে ফেলেছিলেন। তাই না? কিন্তু এটা তাঁর স্বভাব বহির্ভূত।
তবে মনে রাখবেন, মনের কথা বুকের মধ্যে পুষে রাখা খুব শক্ত, যদি আপনি মুখ বন্ধ করে না থাকেন। মুখের কথাই মনের গভীর থেকে গোপন খবর বাইরে বার করে আনে।
আর লোকে যদি মিথ্যে কথা বলে? প্রশ্ন করলেন শ্রীমতী অলিভার।
তাহলে ম্যাডাম এই থিওরি নির্ভুল। কারণ আপনি যে একই ধরনের মিথ্যে বলছেন সেটা অবিলম্বে ধরা পড়ে যাবে।
আপনার কথা শুনে খুব অস্বস্তি বোধ করছি। শ্রীমতি অলিভার বিচলিত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন।
সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল তাকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন। তার সঙ্গে করমর্দন করলেন আন্তরিকভাবে। আপনি সত্যিই একজন দক্ষ গোয়েন্দা, মিসেস অলিভার। আপনার লেখা গল্পের ওই ল্যাপল্যান্ডবাসী গোয়েন্দার চেয়ে অনেক ভালো।
স্বোয়েন হিয়েন ফিনল্যান্ডের লোক। শ্রীমতি অলিভার ব্যাটেলের ভ্রম সংশোধন করে দিলেন। অবশ্য সে কিছুটা বোকা তবে প্রায় অধিকাংশ লোকই ওইরকম। আচ্ছা শুভরাত্রি।
আমাকেও এবার যেতে হবে। পোয়ারো নড়ে চড়ে বসলেন।
ব্যাটেল একটুকরো কাগজে একটা নাম ও ঠিকানা লিখে পোয়ারোর হাতে দিলেন। এই হচ্ছে মিসেস লাক্সমোরের ঠিকানা। ভদ্রমহিলাকে একবার ভালো করে বাজিয়ে দেখুন।
পোয়ারো মৃদু হাসলেন। আমি কিসের অন্বেষণে সেখানে যাব বলে আপনি আশা করেন?
অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের প্রকৃত মৃত্যুরহস্য আমি জানতে চাই। পোয়ারো চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু মঁসিয়ে ব্যাটেল এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ কি কখনো কোনো বিষয়ের প্রকৃত সত্য সম্বন্ধে অবগত হতে পেরেছে?
এই মামলার ব্যাপারে আমি কাল ডেভনশায়ার যাচ্ছি। সযত্নে দার্শনিক তর্কের পথ পরিহার করলেন ব্যাটেল।
পোয়ারো আপন মনে বিড়বিড় করলেন। সত্যিই আমার খুব অবাক লাগে…..
.
১৮.
যে দাসীটি সাউথ কেনসিংটনে মিসেস ল্যাক্সমোরের বাড়ির বদ্ধ দরজা খুলে দিল, পোয়ারোকে দেখে সে মোটেই প্রীত হল না। এ আপদ আবার কোথা থেকে এলো, এমনই তার মুখের ভাব। তাকে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতে দিতেও কোনো আগ্রহ দেখাল না সে।
পোয়ারো কার্ড বের করে বললেন, এটা তোমার কর্ত্রীর কাছে নিয়ে যাও, আমার বিশ্বাস তিনি আমার সঙ্গে দেখা
অপরের নজর কেড়ে রাখবার মতো তাঁর নামের যে কটা কার্ড আছে এটা হচ্ছে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। কার্ডের এককোণে বেসরকারি গোয়েন্দা? কথাটা সোনালি অক্ষরে লেখা আছে। মহিলাদের ক্ষেত্রে ভালো সুফল পাবার জন্যে তিনি এই কথা দুটো বিশেষভাবে খোদাই করে নিয়েছিলেন।
প্রায় প্রত্যেক ভদ্রমহিলারই বেসরকারি গোয়েন্দার ওপর এক ধরনের দুর্বলতা থাকে। তারা এই বিশেষ ধরনের জীবনটাকে স্বচক্ষে দেখতে চায়। জানতে চায় কি উদ্দেশ্যে তার আগমন।
রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পোয়ারো দরজার গায়ের হাতলটার দিকে নজর দিলেন। আপনা থেকেই তার ভ্রুকুঞ্চিত হয়ে উঠল। অনেক দিন পালিশের অভাবে সেটা কেমন ম্যাড়মেড়ে চাকচিক্যহীন অবস্থায় পড়ে আছে। অথচ একটা হাতল পরিষ্কার করতে কিই বা আর প্রয়োজন। কিছুটা ব্রাশো আর একটুকরো কাপড়।
দাসীটি হাঁফাতে হাঁফাতে ছুটে এসে পোয়ারোকে ভেতরে ডেকে নিয়ে গেল।
একতলায় ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে পোয়ারো ভালোভাবে চারিদিক তাকিয়ে দেখলেন। ঘরটা কেমন অন্ধকার অন্ধকার। ফুলদানির ফুলগুলোও সময়মতো বদলানো হয়নি। বাসি ফুলের গন্ধ পেলেন নাকে। টেবিলের ওপর একটা ছাই-ভর্তি অ্যাসট্রে। কত দিনকার ছাই তার ভেতর সঞ্চিত হয়ে আছে কে জানে? জানলার গায়ে বাহারি সিল্কের পর্দা লাগানো সেগুলোও ধুলি-মলিন। চারদিকের দেওয়াল ঘন সবুজ রঙ করা। ছাতের শিলিং তামাটে রঙের।
একজন দীর্ঘাকৃতি সুন্দরী ভদ্রমহিলা আগুনের চুল্লির কাছে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি পোয়ারোর দিকে এগিয়ে এসে ধরা-ধরা গলায় প্রশ্ন করলেন, আপনিই মঁসিয়ে এরকুল পোয়ারো?
পোয়ারো শশবস্তে মাথা নত করে অভিবাদন জানালেন। তাঁর আচার ব্যবহার এখন আর স্বাভাবিক নয়। তার ওপর একটা ছদ্ম আবরণ পরানো আছে। তিনি যে যথাযথই একজন বিদেশি, সে কথাটা বেশ সাড়ম্বরেই মহিলাটির সামনে ঘোষণা করতে চান। তাঁর ভঙ্গিমা দেখে অস্পষ্টভাবে পরলোকগত শ্যাতানার কথা মনে পড়ে।
আমার কাছে আপনার কি প্রয়োজন?
পোয়ারো আবার মাথা হেলিয়ে অভিবাদনের ভঙ্গিতে বললেন, বসতে পারি? অবশ্য খুব একটা বেশি সময় আমার লাগবে না।
ভদ্রমহিলা অধৈর্যভাবে হাত নেড়ে তাকে একটা চেয়ারে বসতে ইঙ্গিত করলেন। নিজে বসলেন সোফার একপ্রান্তে। বলুন, কি চান?
আপনি হয়তো জানেন ম্যাডাম, আমি মাঝে মধ্যে অনুসন্ধানের কাজ-টাজ করে থাকি। অবশ্য সেটা যে সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে, আশা করি তা বলা বাহুল্য।
পোয়ারো যতই ধীর সংযত কণ্ঠে কথা বলতে লাগলেন ভদ্রমহিলার উৎকণ্ঠা ততই বেড়ে চলল। বললেন হ্যাঁ, বুঝেছি। আপনি বলুন।
আমি অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুর বিষয় কিছু তদন্ত করেছি। ভদ্রমহিলা চমকে উঠলেন। তিনি যে রীতিমতো ভয় পেয়েছেন সেটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। জিজ্ঞেস করলেন, কিন্তু কেন? আপনার বক্তব্যটা কি? ওই ব্যাপারের সঙ্গে আপনার সম্পর্কই বা কিসের?
পোয়ারো পুনরায় কথা শুরু করবার আগে সর্তক দৃষ্টিতে ভদ্রমহিলাকে লক্ষ্য করলেন। আপনার কীর্তিমান স্বামীর জীবন কাহিনি নিয়ে একটা বই লেখা হচ্ছে। লেখক এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই সমস্ত তথ্য অবগত হতে চান যেমন ধরুন, আপনার স্বামীর মৃত্যুর ব্যাপারটা….
ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, আমার স্বামী কালাজ্বরে মারা যান। অ্যামাজন নদীর ধারে তাকে কবর দেওয়া হয়।
পোয়ারো চেয়ারে হেলান দিয়ে জাঁকিয়ে বসলেন। আস্তে খুব আস্তে মাথা দোলাতে লাগলেন এদিক-ওদিক। একঘেয়ে পাগল করা ভঙ্গি ম্যাডাম….ম্যাডাম…., তার কণ্ঠে প্রতিবাদের সুর।
কিন্তু আমি সবই জানি। তাঁর মৃত্যুর সময় আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম।
হ্যাঁ, তা ঠিক। আপনি সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আমার সংগৃহীত তথ্যই একথার সাক্ষী দিচ্ছে।
ভদ্রমহিলা চিৎকার করে উঠলেন, কি তথ্য সংগ্রহ করেছেন আপনি?
ভদ্রমহিলার চোখে চোখ রেখে পোয়ারো গম্ভীর স্বরে বললেন, পরলোকগত শ্যাতানার কাছ থেকে আমি অনেক রকম খবরই সংগ্রহ করেছি।
ভদ্রমহিলা এমনভাবে চমকে উঠলেন যেন তার মুখের ওপর কেউ চাবুকের আঘাত হেনেছে। শ্যাতানা….? অস্পষ্ট কণ্ঠে বিড় বিড় করলেন তিনি।
পৃথিবীর অনেক খবরই তিনি রাখতেন, বললেন পোয়ারো, নিঃসন্দেহে স্মরণীয় ব্যক্তি। অনেক গোপন খবর তাঁর জানা ছিল।
আমারও তাই মনে হয়। কথা বলার আগে শুকনো ফ্যাকাশে ঠোঁট দুটো জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলেন মিসেস ল্যাক্সমোর।
পোয়ারো সামনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। আপনার স্বামী যে কালাজ্বরে মারা যাননি, তা তিনি জানতেন।
ভদ্রমহিলা একদৃষ্টে পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। তাঁর দু’চোখে ভয় আর হতাশার যুগপৎ সমন্বয়।
পোয়ারো ঝুঁকে পড়ে তাঁর কথার ফলাফল লক্ষ্য করতে লাগলেন।
অনেক কষ্টে নিজে সংযত করে সোজা হয়ে বসলেন মিসেস ল্যাক্সমোর। আমি..আমি আপনার বক্তব্য ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না। তার কণ্ঠে এবার আর প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হল না, তার বদলে ফুটে উঠল সকাতর অনুনয়।
তাহলে ম্যাডাম আপনাকে সরাসরি প্রশ্ন করছি। আমি অবশ্য আমার সংগৃহীত সব তথ্যই আপনার সামনে হাজির করব। মৃদু হাসলেন পোয়ারো, আপনার বোটানিস্ট স্বামী কালাজ্বরে মারা যাননি, মারা গেছেন বন্দুকের গুলিতে।
ওঃ! একটা সকাতর আর্তনাদ নির্গত হল ভদ্রমহিলার কণ্ঠ দিয়ে। দু’হাতে মুখ ঢাকলেন তিনি। অবরুদ্ধ আবেগে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল তার সর্বাঙ্গ যেন এক সকরুণ বেদনাঘন
তবু তিনি যে তার সুপ্তমনের অন্তঃপুরে নিজের এই বিষাদপ্রতিম অবস্থাটা পরম পুলকে উপভোগ করছেন, পোয়ারো সে-বিষয়ে স্থির নিশ্চিত। তাহলে বুঝতেই পারছেন, স্পষ্ট ভাষায় বললেন পোয়ারো, পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে আর কোনো আপত্তি থাকবার কারণ নেই।
ভদ্রমহিলা ধীরে ধীরে মুখ থেকে হাত সরালেন। বললেন, কিন্তু আপনি যা ভাবছেন ব্যাপারটা সেরকম ভাবে ঘটেনি।
পোয়ারো আবার সামনের দিকে ঝুঁকে পরে সহৃদয় কণ্ঠে বললেন, আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না, মিসেস ল্যাক্সমোর আমি খুব ভালো করেই জানি গুলিটা আপনি করেননি। গুলি চালিয়েছিলেন মেজর ডেসপার্ড, কিন্তু উপলক্ষ তো আপনিই?
আমি ঠিক জানি না। আজও ভালো বুঝে উঠতে পারি না। হয়তো আমিই এর কারণ। সমস্ত ব্যাপারটাই এত ভয়ঙ্কর। আর সব থেকে আশ্চর্যের কি জানেন, দুর্ঘটনা যেন সর্বদাই আমার পেছন পেছন তাড়া করে ফেরে।
কিন্তু ব্যাপারটা খুবই সত্যিই। পোয়ারো সমঝদারের ভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন। এটা আমি প্রায় অনেকবারই লক্ষ্য করেছি। কোনো কোনো মহিলার ভাগ্যটাই এই রকম তারা যেখানেই যান, দুর্ঘটনা তাদের পেছন পেছন ধাওয়া করে। এটা তাদের দোষ নয়। এমন ঘটনাকে নিয়তি ছাড়া আর কি বলা যাবে?
মিসেস ল্যাক্সমোর একটা গভীর দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। আপনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন। কি করে যে এমন হয়। আর কত অনায়াসেই না হয়ে যায়।
আপনি বোধহয় ওই দলের সঙ্গে অভিযানে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ, আমার স্বামী ছিলেন উদ্ভিদবিদ–বললেন তিনি–দুষ্প্রাপ্য লতাগুল্ম সম্বন্ধে তিনি তখন একটা বই লিখছিলেন। মেজর ডেসপার্ডের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। তিনি নাকি ওই অঞ্চলের জলহাওয়া সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এই অভিযানের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সাহায্যও করতে পারবেন। ভদ্রলোকের সঙ্গে আলাপ করে আমার স্বামীর খুব ভালো লেগে গেল। আমরা সদলবলে যাত্রা শুরু করলাম।
বলতে বলতে মাঝপথে থেমে গেলেন মিসেস ল্যাক্সমোর। পোয়ারো মিনিট খানেক তাঁকে নীরব থাকবার সুযোগ দিলেন। কিন্তু তার পরেও ভদ্রমহিলা মুখ খুলছেন না দেখে তিনি নিজেই ঘটনার খেই ধরে কথা শুরু করলেন। হ্যাঁ, ব্যাপারটা কল্পনা করে নেওয়া শক্ত নয়। স্রোতস্বিনী, কল্লোলিনী পাহাড়ি নদী……জঙ্গলের উষ্ণ চরিত্র…….পতঙ্গের ঝিল্লিমুখর ঐকতান…সুঠাম স্বাস্থ্যবান পুরুষ…সুন্দরী মহিলা।
মিসেস ল্যাক্সমোর ঘন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আমার স্বামী ছিলেন বয়সে প্রায় দ্বিগুণ বড়। সত্যি কথা বলতে কি, তাঁর সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হয় তখন বিয়ের মর্মই আমি ভালোভাবে বুঝতে শিখিনি।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। বললেন আমি জানি, এমন ঘটনা আজকাল হামেশাই ঘটে থাকে।
অবশ্য কি ঘটছে, জিজ্ঞেস করলে দুজনের কেউই হয়তো তা স্বীকার করতাম না; মিসেস ল্যাক্সমোর পুরানো প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন, বললেন, জন ডেসপার্ড কোনো সময় মুখ ফুটে একটা কথাও বলেননি। তিনি যথাথই একজন ভদ্রলোক।
কিন্তু মেয়েরা পুরুষদের মুখেই মনের কথা বুঝতে পারে। মৃদু স্বরে বিড়বিড় করলেন পোয়ারো।
মিসেস ল্যাক্সমোর বেদনা বিধুর চোখ তুলে পোয়ারোর দিকে তাকালেন। আপনি ঠিকই বলেছেন। মেয়েরা সত্যিই মুখ দেখে মনের কথা টের পায়। তবে আমি যে সব জানি একথাটা তাঁকে কোনোদিন বুঝতে দিইনি। মেজর ডেসপার্ড এবং মিসেস ল্যাক্সমার হিসেবেই আমরা পরস্পরের কাছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিচিত ছিলাম। দুজনেই মনে মনে সিন্ধান্ত নিয়ে ছিলাম, এই খেলাই চলুক। তিনি আবার নীরব হয়ে গেলেন। অতীত প্রেমের ধূসর স্মৃতি তাকে উন্মনা করে তুলল।
ঠিকই! মৃদু সুরে বিড়বিড় করলেন পোয়ারো, ভব্যতাকে মান্য করা উচিত। আপনাদের এক কবিই তো বলে গেছেন, হে প্রিয় তোমায় আমি এমনভাবে ভালোবাসতেই পারতাম না, ভব্যতাকে ভালবাসতে না শিখলে!
না, না, কথাটা ভব্যতা নয়; ওটা হবে প্রেমের মহনীয়তা। পোয়ারোর ভ্রম সংশোধন করে দিলেন মিসেস ল্যাক্সমোর।
হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার মনে পড়েছে, প্রেমের মহনীয়তাকে ভালবাসতে না শিখলো।
তিনি বলতে লাগলেন, লাইনটা যেন আমাদের জন্যেই লেখা হয়েছিল। স্বপ্নের ঘোরে বললেন মিসেস ল্যাক্সমোর আমরা ঠিক করেছিলাম, বেদনায় হৃদপিন্ড পিষ্ট হয়ে যাক, তবু মুখ ফুটে সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর কথাটাকে উচ্চারণ করব না। তারপর….
তারপর….? প্রশ্ন করলেন পোয়ারো।
সেই নারকীয় রাত্রি। মিসেস ল্যাক্সমোর শিউরে উঠলেন বলতে গিয়ে। আমার মনে হয় ওদের দুজনের মধ্যে ঝগড়া বেধেছিল। জন আর টিমথি। আমি আমার তাবু থেকে বেরিয়ে এলাম….
মিসেস ল্যাক্সমোরের দু-চোখের তারা বিস্ফারিত হয়ে উঠল। তিনি যেন চোখের সামনে সেই ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করছেন। শুরু করলেন, আমি আমার তাঁবু থেকে বেরিয়ে এলাম। তিনি আবার পুরানো কথার পুনরাবৃত্তি করলেন। জন আর টিমথি…ওঃ। সভয়ে চোখ বুজলেন মিসেস ল্যাক্সমোর-সমস্তটা আমার ঠিক স্মরণ হচ্ছে না। আমি ওদের দুজনের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম, .. চেঁচিয়ে বললাম, এ সত্য নয়, সম্পূর্ণ মিথ্যে। কিন্তু টিমথি আমায় ভুক্ষেপ করল না। সে তখন প্রচন্ডভাবে জনকে শাসাচ্ছে। অবশেষে জন গুলি চালাল। আত্মরক্ষার জন্যে এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় ছিল না। টিমথি ওর গলায় একটা ছুরি বসিয়ে দিতে উদ্যত হয়েছিল।
মিসেস ল্যাক্সমোর আবার দু-হাতে মুখ ঢেকে ঝাঁকিয়ে কেঁদে উঠলেন, একটা গুলির আঘাতেই টিমথি মারা গেল। গুলিটা ওর হৎপিন্ড ফুড়ে দিয়েছিল।
পোয়ারো ধীরে ধীরে মন্তব্য করলেন, সেটাই বোধহয় ম্যাডামের জীবনে সবচেয়ে দুর্যোগময় মুহূর্ত।
হ্যাঁ। সেদিনের কথা আমি জীবনে ভুলব না। তবে সত্যিই মহৎ। সে নিজে থেকেই ধরা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি ওকে বাধা দিলাম। সারারাত ধরে আমাদের পর্ব চলল। শেষকালে বললাম অন্তত আমার মুখের দিকে চেয়েও ব্যাপারটা বিবেচনা করো। পাঁচজন আমার নামে মিথ্যে কলঙ্ক রটাবে। কথাটা জনের মনে ধরল। স্বাভাবিক ভাবেই ও আমাকে কলঙ্কের ভাগীদার হতে দিতে চায় না। শোক নিন্দা যে কি ভয়ঙ্কর সেটা ওর অজানা থাকবার কথা নয়। সংবাদপত্রের শিরোনামই বা কি হত। অরণ্যের অন্ধকারে দুই পুরুষ এক নারী। আদিম বাসনার অগ্ন্যুদগার।
সমস্তই জনকে বুঝিয়ে বললাম। শেষ পর্যন্ত জন রাজি হল। ভাড়া করা কুলি ভৃত্যরা এ-ঘটনার বিন্দুবিসর্গ জানতে পারেনি। তাদের তাবু ছিল আমাদের তাঁবু থেকে বেশ কিছুটা তফাতে। সেই সময় টিমথি অল্প জ্বরে ভুগছিল। আমরা কুলিদের ডেকে বললাম। টিমথি জ্বরে মারা গেছে। অ্যামাজনের তীরে ওকে কবর দেওয়া হল। একটা গভীর যন্ত্রণাময় দীর্ঘশ্বাস ভদ্রমহিলার সারা শরীর কাঁপিয়ে তুলল। তারপর আমরা সভ্যজগতে ফিরে এলাম। চিরকালের মতো বিদায় জানালাম পরস্পরকে।
তার কি সত্যিই কোনো প্রয়োজন ছিল ম্যাডাম?
হ্যাঁ ছিল। মৃত টিমথির স্মৃতি আমাদের দুজনের মাঝখানে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। টিমথি জীবিতকালে যা ছিল এখন যেন তার চেয়েও আর অপ্রতিরোধ্য। সেইজন্যেই আমরা পরস্পরের কাছ থেকে চিরকালের জন্য দূরে সরে গেলাম। এখনও অবশ্য মাঝে-মধ্যে দু-একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ঘটে যায়। দেখা হলে আমরা চোখ তুলে মৃদু হাসি। ভদ্রভাবে কথা বলি।…..আমাদের মধ্যে কি সম্পর্ক ছিল, বাইরে থেকে দেখে সেটা কেউ কল্পনাতে আনতে পারবে না। আমাদের দুজনের চোখের ভাষা কেবল আমরা দুজনেই পড়তে পারি। তার মধ্যে শুধু একটি কথার প্রতিধ্বনি ভুলব না…..ভুলব না।
আবার নীরব হলেন মিসেস ল্যাক্সমোের। চোখের কোণে মুক্তোর মতো দু’ফোঁটা জল টলটল করছে। পোয়ারোও এ নীরবতাকে শ্রদ্ধা জানালেন।
মিসেস ল্যাক্সমোর ভ্যানিটি ব্যাগ খুলে পাউডারের পাফ বার করে নাকে মুখে বুলিয়ে নিলেন। তারপর আবার বসে রইলেন একভাবে। কোথায় যেন ছন্দ কেটে গেছে।
আপনার ইতিহাস খুবই করুণ। পোয়ারো আবার কথা শুরু করলেন। কণ্ঠস্বরে উচ্ছ্বাসের প্রবণতা নেই।
আপনি নিশ্চয় অনুভব করতে পারছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো, মিসেস ল্যাক্সমোরের গলার স্বরে ব্যগ্রতা ফুটে উঠল, এ ইতিহাস বাইরের কাউকে শোনাবার নয়।
হ্যাঁ, নিজের পক্ষে সেটা খুবই যন্ত্রণাদায়ক।
একথা বাইরের কাউকে বলা অসম্ভব। সেই বন্ধু বা লেখক নিশ্চয় কোনো নির্দোষ মহিলার নামে কলঙ্ক লেপন করতে চাইবেন না?
অথবা কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে ফাঁসিকাঠে ঝোলাতে শেষটুকু জুড়ে দিলেন পোয়ারো।
আপনি তাহলে এদিক থেকেও চিন্তা করেছেন? এর জন্যে আমি আনন্দিত। ভদ্রলোক বাস্তবিকই নির্দোষ। ঝোঁকের মাথায় একটা অপরাধ করে বসলেই তাকে বরাবরের মতো অপরাধী বলে গণ্য করা যায় না। আবার এক্ষেত্রে আত্মরক্ষার জন্যেই তিনি একাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। গুলি ছোঁড়া ছাড়া সেই মুহূর্তে আর কোনো উপায় ছিল না। সব দিক বিচার বিবেচনা করে আপনি নিশ্চয় এটা উপলব্ধি করবেন যে টিমথি জ্বরে মারা গেছে, সেই কথাটাই সকলকে জানিয়ে দেওয়া সর্বতোভাবে শ্রেয়।
পোয়ারো স্বগতোক্তির সুরে বিড়বিড় করলেন, লেখকেরা মাঝে মাঝে এত বিপজ্জনকভাবে কৌতূহলী হয়ে ওঠে…আপনার লেখক বন্ধু কি নারী বিদ্বেষী? আমরা যন্ত্রণা পাই সেটাই কি তাঁর কাম্য? কিন্তু আপনার এতে বাধা দেওয়া উচিত। আমিও তো কোনোমতে সহ্য করব না। প্রয়োজন হলে নিজের ঘাড়েই সব অপরাধের বোঝ টেনে নেব, বলব, আমিই টিমথিকে হত্যা করেছি। মিসেস ল্যাক্সমোর দৃঢ় পায়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। মাথা উঁচু করে ফিরে তাকালেন সামনের দিকে। তার দু’চোখের দৃষ্টিতে একটা স্থির প্রতিজ্ঞাভাব জ্বল জ্বল করছে।
পোয়ারোও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে বললেন, ম্যাডামঃ এমন মহান আত্মোৎসর্গের কোনো প্রয়োজন দেখি না। সকরুণ সত্যটা যাতে বরাবরের মতো গোপন থাকে সে বিষয়ে আমি আমার সাধ্যমতো চেষ্টা করব।
একটা নারীসুলভ মৃদু হাসির সৌরভ মিসেস ল্যাক্সমোরের চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। ম্লান মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সোনালি রৌদ্রের রূপ রেখা। তিনি তাঁর ডান হাতটা আর একটু উঁচুতে তুললেন, যাতে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছাতেই হোক তাঁর হাতের তালুতে প্রীতির চুম্বন এঁকে দিতে বাধ্য হলেন মঁসিয়ে পোয়ারো।
একজন ভাগ্যহীন নারীর আন্তরিক ধন্যবাদ গ্রহণ করবেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। মৃদু সুরে তিনি বললেন।
নিঃসন্দেহে বিদায় নেবার ইঙ্গিত।
রাস্তায় বেরিয়ে মুক্ত বাতাসে গভীরভাবে শ্বাস নিলেন পোয়ারো।
.
১৯.
অভূতপূর্ব মহিলা। পোয়ারো আপন মনে বিড়বিড় করলেন। হতভাগ্য ডেসপার্ড। কি দুর্যোগময় অভিযান। হঠাৎ তিনি আপনমনে হাসতে শুরু করলেন।
পোয়ারো এখন ব্রম্পটন রোড দিয়ে হাঁটছেন। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পকেট থেকে ঘড়ি বার করলেন। মনে মনে হিসাব করে নিলেন সময়ের। হা, হাতে এখন সময় আছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে কোনো ক্ষতি হবে না। এই ফাঁকে অন্য একটা ছোট কাজ সেরে নিতে পারি। অনেকদিন আগে আমার পুরানো বন্ধু ইন্সপেক্টার জ্যাপ গুন গুন করে একটা গানের সুর ভাজতো সে আজ কতদিনের কথা।…..প্রায় চল্লিশ বছর আগে, সবটা স্পষ্ট মনে নেই-ছোট্ট পাখিটাকে একটুকরো মনভোলানো মিষ্টি দাও,–প্রথম কলিটা যেন এই রকম।
সেই ভুলে যাওয়া পুরানো গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে পোয়ারো একটা বড়সড় স্টেশনারী দোকানে ঢুকে পড়লেন। চারিদিকে তাকিয়ে দেখে মোজা বিক্রির কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। সেলস কাউন্টারে দন্ডায়মান তরুণীটি সুন্দরী না হলেও মন্দ নয়। তার দৃষ্টিতে সার্বজনীন সমবেদনার স্পর্শ আছে।
সিঙ্কের মোজা খুঁজছেন? আসুন, আসুন, আমাদের স্টকে ভালো ভালো মোজা আছে। শতকরা একশো ভাগ খাঁটি সিল্ক, সে-বিষয়ে গ্যারেন্টি দেব আমরা।
সাদামাটা মোজাগুলোকে পোয়ারো হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেন, ফরাসি দেশের তৈরি সিল্কের মোজা? কিন্তু বুঝতেই পারছেন, সরকারকে ডিউটি দিয়ে তার দাম অনেক পড়ে যায়। কথা বলতে বলতে তরুণীটি আর একটা মোজার বাক্স সামনে খুলে ধরলো।
এগুলো নিঃসন্দেহে ভালো। কিন্তু আমি আরও ভালো উৎকৃষ্ট জিনিস চাইছি।
এর সমস্তটাই ভালো সিল্কের তৈরি। অবশ্য এর চেয়েও ভালো জিনিস আমরা দেখাতে পারি, কিন্তু তার দাম অনেক বেশি। এক এক জোড়াই প্রায় পঁয়ত্রিশ শিলিং, এদিকে ঠেকসইও তেমন নয়। সৌখিন জিনিস সচরাচর যেমন হয়ে থাকে। অনেকটা মাকড়সার জালের মতো।
ঠিক….ঠিক এই জিনিসই আমি চাইছি।
তরণীটি বেশ কিছুক্ষণের জন্যে ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল। অবশেষে একটা ঝকমকে বাক্স নিয়ে ফিরে এলো। আমি একটু ভুল বলেছিলাম। এর দাম পঁয়ত্রিশ শিলিং নয়। সাড়ে সাঁইত্রিশ শিলিং কিন্তু দেখতে খুবই সুন্দর……তাই না? মেয়েটি সুদৃশ্য মোড়কের ভেতর থেকে অতি যত্ন সহকারে একজোড়া মোজা বার করে পোয়ারোর সামনে মেলে ধরল।
সত্যিই চমৎকার। পোয়ারোর কণ্ঠে প্রশংসার সুর।
হ্যাঁ, অপূর্ব। ….. কত জোড়া আপনার প্রয়োজন?
আমার দরকার? …. দাঁড়ান, ভেবে দেখি। …উনিশ জোড়া।
মেয়েটি বিস্ময়কর প্রবল ধাক্কায় আর একটু হলেই কাউন্টারের ওপাশে পড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু দীর্ঘ দিনের লব্ধ অভিজ্ঞতাই তাকে বিস্ময় দমন করে শান্ত হয়ে সোজা থাকতে সাহায্য করল। দু’ডজন নিলে আপনি কম দামে পেতে পারেন। অস্পষ্টভাবে কথাটা উচ্চারণ করল সে।
না, আমার উনিশ জোড়াই প্রয়োজন। দেখবেন, প্রত্যেকটি যেন ভিন্ন ভিন্ন রঙের হয়।
মেয়েটি বাধ্যভাবে মাথা নেড়ে বিভিন্ন রঙের ঊনিশটা মোজা বেছে নিয়ে একটা প্যাকেট করে দিল। পোয়ারো বিল মিটিয়ে ধন্যবাদ জানিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে এলেন।
পাশের কাউন্টারের অপর একটি তরুণী পোয়ারোকে লক্ষ্য করছিল। পোয়ারো দোকান থেকে নিষ্ক্রান্ত হবার পর সে মুখ খুলল। সেই মেয়েটির ভাগ্য কি ভালো। বুড়োটা নিশ্চয় খুব নোংরা প্রকৃতির এতদিনে মেয়েটা তাকে শায়েস্তা করে সোজা রাস্তায় নিয়ে আসতে পেরেছে। তা না-হলে সাড়ে সাঁইত্রিশ শিলিং খরচা করে একজোড়া মোজা কেনা সহজ কথা নয়। তাও একটা দুটো নয়….একসঙ্গে ঊনিশ জোড়া।
মেসার্স হার্ভে রবিনসনের দোকানের তরুণী কর্মচারীরা তার চরিত্র সম্বন্ধে যে হীন ধারণা পোষণ করত পোয়ারো সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র অবহিত ছিলেন না। প্যাকেটটা হাতে ধরে ঘাড় সোজা করেই তিনি গৃহের অভিমুখে হেঁটে চললেন।
বাড়িতে পৌঁছবার পর সবে আধঘন্টাও অতিবাহিত হয়নি এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল। অনতিবিলম্বে মেজর ডেসপার্ড এসে প্রবেশ করলেন। তার চোখে মুখে ক্রোধের স্পষ্ট ছায়া। ভদ্রলোক যেন অনেক কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছেন।
কি উদ্দেশ্য নিয়ে আপনি মিসেস ল্যাক্সমোরের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন, ঘরে পা দিতে না দিতেই ক্রুদ্ধ কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন ডেসপার্ড।
পোয়ারো মৃদু হাসলেন। আমার উদ্দেশ্যের কথা এতক্ষণে নিশ্চয় আপনার অগোচরে নেই। অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের মৃত্যুরহস্যের প্রকৃত তথ্য খুঁজে বের করাই আমার আন্তরিক অভিপ্রায়।
প্রকৃত তথ্য। ডেসপার্ডের কণ্ঠে ক্রুদ্ধ ব্যঙ্গের ঝঝ ফুটে উঠল। আপনি কি মনে করেন মহিলাদের পক্ষে সমস্ত ঘটনা জানা সম্ভব?
তা যা বলেছেন। পোয়ারো মাথা নেড়ে সায় দিলেন, মাঝে-মাঝে এটা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই…..
একথা আপনার বোঝা উচিত। পোয়ারো এবার প্রতিবাদ জানালেন। না না, মোটেই তা নয়। ভদ্রমহিলা একটু রোমান্টিক ধাঁচের এই যা।
রোমান্টিকতা তার একটা ধাপ্পা মাত্র। তিনি আসলে একজন ডাহা মিথ্যেবাদী। আমার তো মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি তাঁর এই মিথ্যেটাকেই সত্য বলে বিশ্বাস করেন।
হ্যাঁ, তাও একেবারে অসম্ভব নয়।
তার ওপর তিনি খুব ভীরু স্বভাবের। ওদের সঙ্গে বেরিয়ে সে কটা দিন কি সাংঘাতিক অশান্তিতেই না কেটেছিল।
এটাও আমি বিশ্বাসযোগ্য বলে মেনে নিতে পারি–পোয়ারো তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লেন।
ডেসপার্ড হঠাৎ একটা চেয়ার টেনে ধপ করে বসে পড়লেন। শুনুন মঁসিয়ে পোয়ারো, তাহলে সমস্ত কাহিনিটাই খুলে বলি।
তার অর্থ আপনি আপনার মুখে এই ঘটনার বিবরণ দিতে চান?
কিন্তু আমার বিবরণই যথার্থ সত্য।
পোয়ারো কোনো উত্তর দিলেন না।
ডেসপার্ড শুকনো গলায় শুরু করলেন, আমি জানি, আজ এতদিন বাদে প্রকৃত ঘটনা খুলে বললে কারোও কাছ থেকেই কোনো সমবেদনা পাব না। সকলেই আমাকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখবে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সামনে এই একটি মাত্র পথই খোলা আছে। তাই সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে বাধ্য হচ্ছি। আপনি বিশ্বাস করুন আর না করুন, এই হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা। অবশ্য এর স্বপক্ষে কোনো সুনিদিষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করা আজ আর আমার দ্বারা সম্ভব নয়।
মেজর ডেসপার্ড অল্প থামলেন। তার পর আরম্ভ করলেন তাঁর সুদীর্ঘ কাহিনি।
অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের অভিযানের যাবতীয় ব্যবস্থা আমিই করেছিলাম। তিনি প্রকৃতই একজন ভদ্রলোক। লতাগুল্ম আর গাছগাছড়া নিয়ে সব সময় মশগুল থাকতেন। আর ভদ্রমহিলার নতুন কি পরিচয় দেবো। তাকে তো আপনি স্বচক্ষেই দেখে এসেছেন। সারা অভিযানটাই আমার কাছে এক বিরাট দুঃস্বপ্ন। ভদ্রমহিলার প্রতি আমার কোনো দুর্বলতা ছিল না তো বটেই বরঞ্চ তাকে অপছন্দ করতাম বলা চলে। তিনি এত ভাবুক আর কল্পনাপ্রবণ যে আমি সব সময় কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করতাম। যা হোক দু’সপ্তাহ একরকম ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। তার পর আমরা তিনজনেই জ্বরে পড়লাম। ওই সব অঞ্চলের জল হওয়ায় এ-ধরনের জ্বর প্রায়ই হয়। তবে ভদ্রমহিলা আর আমি অল্প ভুগেই সেরে উঠলাম, কিন্তু অধ্যাপক ল্যাক্সমোরের জ্বর উত্তরোত্তর বেড়েই চলল। একদিন সন্ধ্যাবেলায় আমি আমার তাঁবুর বাইরে একটা চেয়ার পেতে বসে আছি। সবে জ্বর থেকে ওঠার পর শরীর খুবই দুর্বল। সারা দেহে অবসাদ আর ক্লান্তি জড়িয়ে আছে। এমন সময় দেখি অধ্যাপক ল্যাক্সমোর ঝোপ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে টলতে টলতে নদীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। তিনি যে জ্বরের ঘোরে বেঁহুশ হয়ে এমন পাগলের মতো কাজ করছেন তাতে আর সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আর এক মিনিটের মধ্যেই ভদ্রলোক নদীতে গিয়ে পড়বেন। সেখানে স্রোতও খুব প্রবল। একবার পড়লে বাঁচার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না। এদিকে আমার পক্ষে ঝোপঝাড় পেরিয়ে এত দূর ছুটে গিয়ে তাঁকে বাধা দেবারও আর সময় নেই। কেবল একটা উপায়ই অবশিষ্ট আছে। গুলিভরা বন্দুকটা পাশেই পড়েছিল। সেটা তুলে নিলাম। আমার হাতের টিপ একেবারে অব্যর্থ আমি ভদ্রলোকের পায়ে গুলি মেরে আপাতত তার চলার গতি রোধ করতে চাইলাম। কাজটা আমার পক্ষে মোটেই দুঃসাধ্য নয়, সে বিষয়ে মনে মনে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি বন্দুক তুলে নিশানা ঠিক করেছি সেই মুহূর্তেই ভদ্রমহিলা কোথা থেকে ছুটে এসে আমাকে বাধা দিলেন। বললেন, দোহাই আপনার আমার স্বামীকে যেন গুলি করে মারবেন না। তিনি এমন ভাবে আমার হাত টেনে ধরলেন যে নিশানা ভুল হয়ে গেল। গুলিটা সোজা তার পিঠে গিয়ে বিধলো। ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন।
পরিস্থিতিটা যে কত ভয়ঙ্কর নিশ্চয় তা আপনি উপলব্ধি করতে পারছেন? কিন্তু ভদ্রমহিলা এমনই নির্বোধ যে এই দুর্ঘটনার সমস্ত দায়িত্ব মূলত তাঁরই, সে কথা কিছুতেই বিশ্বাস করলেন না। তাঁর ধারণা, আমি ভদ্রমহিলার প্রেমে পড়ে তার স্বামীকে ঠান্ডা মাথায় খুন করেছি। এ-বিষয়ে তাঁর সঙ্গে অনেক তর্ক হল। শেষে তিনি বললেন, এ নিয়ে লোক জানাজানির প্রয়োজন নেই;অধ্যাপক ল্যাক্সমোর জ্বরে মারা গেছেন, এই কথা প্রচার করে দিলেই চলে যাবে। ভদ্রমহিলার জন্যে তখন আমার দুঃখ হল। তিনি কি করে বসেছেন তা নিজেই জানেন না। অবশ্য এ-ঘটনা যদি কোনোদিন বাইরের লোক জানতে পারে, তখন আমায় বাধ্য হয়ে প্রকৃত সত্য প্রকাশ করে দিতে হবে, এদিকে আবার আর এক মুশকিল দেখা দিলো। ভদ্রমহিলার অভ্রান্ত ধারণা। আমি নাকি তার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছি। এতে খুব বিচলিত বোধ করলাম। এই ডাহা মিথ্যেটা বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়লে তার ফল খুব সুদূরপ্রসারী হবে। সবদিক চিন্তা করে ভদ্রমহিলার কথাতেই রাজি হলাম। এর ফলে অন্তত শান্তিটা বজায় থাকবে। মৃত্যুটা জ্বর বা দুর্ঘটনা যে কারণেই হোক, তাকে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। শুধু শুধু একজন ভদ্রমহিলাকে অপ্রীতিকর পরিবেশের মধ্যে ঠেলে দিয়ে লাভ কি। পরের দিন সকালে কুলিদের জানিয়ে দিলাম অধ্যাপক ল্যাক্সমোর জ্বরে মারা গেছেন। সকলে মিলে তাকে আমরা নদীর ধারে কবর দিলাম। কুলিরা যদিও প্রকৃত ঘটনা জানতো, তবে তারা প্রত্যেকেই আমার খুব বিশ্বাসী। আমাকে শ্রদ্ধাও করতে যথেষ্ট। তারা এ-ঘটনা কোনোদিন বাইরে প্রকাশ করবে না বলে আমার কাছে প্রতিজ্ঞা করল। আমরা আবার সভ্য জগতে ফিরে এলাম। তার পর থেকে অনেকবারই আমাদের দেখা সাক্ষাৎ ঘটেছে। দেখা হলেই আমি তাকে সভয়ে এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি।
মেজর ডেসপার্ড মিনিটখানেক মৌন হয়ে রইলেন। অবশেষে শান্ত কণ্ঠে বললেন, এই হচ্ছে আমার কাহিনি, মঁসিয়ে পোয়ারো।
পোয়ারো এতক্ষণ গভীর মনোযোগ সহকারে সমস্তটা শুনে যাচ্ছিলেন। ধীরে ধীরে চোখ তুলে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, আপনার কি মনে হয়, সেদিন সন্ধ্যায় ডিনার টেবিলে মিঃ শ্যাতানা এই ঘটনারই কোনো ইঙ্গিত দিয়েছিলেন?
ডেসপার্ড মাথা নেড়ে সমর্থন জানালেন, বললেন, ভদ্রলোক হয়তো মিসেস ল্যাক্সমোরের কাছ থেকে এ কাহিনি শুনে থাকবেন।
কাহিনিটা কিন্তু আপনার পক্ষে বিপজ্জনক। বিশেষ করে মিঃ শ্যাতানার মতো লোক যখন এর সন্ধান পেয়েছিলেন…..
ডেসপার্ড অবহেলা ভরে মাথা ঝাঁকালেন। আমি শ্যাতানাকে ভয় পাই না।
পোয়ারো কোনো জবাব দিলেন না। ডেসপার্ড আবার বললেন এ-বিষয়ে আমি কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারব না। আমার মুখের কথাকেই সত্য বলে মেনে নিতে হবে। শ্যাতানাকে হত্যা করবার পেছনে আমার কোনো গোপন উদ্দেশ্য থাকা সম্ভব, এ সন্দেহ মনে জাগা অস্বাভাবিক নয়। সেই জন্যেই প্রকৃত ঘটনা খুলে বললাম, ইচ্ছে হলে বিশ্বাস করবেন, না হয় করবেন না।
পোয়ারো করমর্দনের অভিপ্রায় নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন। আপনার মুখের কথা সম্পূর্ণই বিশ্বাস করছি মেজর ডেসপার্ড। ব্যাপারটা নিশ্চয় এই রকমই ঘটেছিল।
ডেসপার্ডের মুখ চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। অসংখ্য ধন্যবাদ। ছোট্ট করে জবাব দিলেন তিনি।
তারপর আন্তরিক কৃতজ্ঞতায় দু’হাত দিয়ে পোয়ারোর সঙ্গে করমর্দন করলেন।