১৫৯. পিতার প্রতি কন্যার পরামর্শদান
ঊনষষ্ট্যধিকশততম অধ্যায়
বৈশম্পায়ন কহিলেন,—সেই ব্রাহ্মণের কন্যা স্বীয় পিতামাতার বিলাপবাক্য শ্রবণে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া তাহাদিগকে কহিতে লাগিলেন, হে তাত! হে মাতঃ! আপনারা কি নিমিত্ত অনাথের ন্যায় রোদন করিতেছেন? আমি যাহা কহিতেছি, তদনুসারে কাৰ্য্য করিলে আপনাদিগের মঙ্গল হইবে। আমাকে কিছু দিন পরে অবশ্যই পরগৃহে পরিত্যাগ করিতে হইবে; অতএব তংপরিবর্তে এক্ষণেই আমাকে পরিত্যাগ করিয়া সকলের পরিত্রাণ করুন। ‘সন্তান বিপদ হইতে পরিত্রাণ করিবে’ এই ভাবিয়াই লোকে অপত্য কামনা করিয়া থাকে; এক্ষণে আপনাদের এই বিপৎসময় উপস্থিত হইয়াছে, অতএব আমাকে পরিত্যাগ করিয়া এই দুস্তর দুঃখসমুদ্র উত্তীর্ণ হউন। ইহকালে ও পরকালে পরিত্রাণ করে বলিয়া পণ্ডিতগণ পুত্রের পুত্র নাম দিয়াছেন। পিতামহগণ, আমার গর্ভে দৌহিত্র উৎপন্ন হইবে, এই অভিলাষ করেন; কারণ, তাহা হইলে পিণ্ডলোপের ভয় হইতে পরিত্রাণ হয়। আমি স্বীয় পিতার জীবন রক্ষা করিয়া তাহাদিগকে সে ভয় হইতে মুক্ত করিতেছি। হে পিতঃ! যদি আপনি স্বয়ং তথায় গমন করিয়া প্রাণত্যাগ করেন, তাহা হইলে আপনার বিরহে অল্প দিনের মধ্যেই আমার এই অল্পবয়স্ক ভ্রাতাটী বিনষ্ট হইবে, সন্দেহ নাই। আপনি ও প্রাণাধিক সহোদর মানবলীলা সম্বরণ করিলে পিতৃলোকের পিণ্ডেচ্ছেদ হইবে এবং আমিও আপনাদের বিনাশে যৎপরোনাস্তি শোকসন্তপ্ত হইয়া প্রাণত্যাগ করিব। কিন্তু যদি আপনি কেবল চামাকে পরিত্যাগ করিয়া এই ঘোর বিপদ হইতে মুক্ত হয়েন, তাহা হইলে আমার মাতা ও শিশু ভ্রাতা রক্ষা পাইবে এবং এই বংশের সন্ততি ও পিণ্ড অবিচ্ছিন্নভাবেই থাকিবে। আরও দেখুন, শাস্ত্রকারের৷ কহিয়া গিয়াছেন যে,পুত্র আত্মার স্বরূপ, ভাৰ্য্যা, সখিম্বরূপ এবং কন্যা কৃচ্ছ স্বরূপ হয়; অতএব আপনি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া কৃচ্ছ হইতে বিমুক্ত হউন। হে তাত! আপনি না থাকিলে আমার কষ্টের সীমা থাকিবে না। আমি অনাথা ও দীন হইয়া যথাতথা ভ্রমণ করিব। যদি আমি রাক্ষসসমীপে আত্মপ্ৰদানরূপ কর্ম করি, তাহা হইলে পিতৃলোকের বংশ রক্ষা ও আমার মরণ সফল হয়, আর যদি আপনি আমাকে পরিত্যাগ না করিয়া পরলোকযাত্রা করেন, তাহা হইলে, আমাকে যংপয়োনাস্তি ক্লেশ পাইতে হইবে; অতএব আমার প্রতি অনুকম্পা প্রকাশ করুন এবং উভয় পক্ষ বিবেচনা করিয়া আমার ক্লেশাবসান নিমিত্ত, ধর্মরক্ষার নিমিত্ত ও কুলসন্ততির অবিচ্ছেদের নিমিত্ত, অবশ্যপরিত্যাজ্যাকে অবিলম্বে ত্যাগ করিয়া আপনার প্রাণরক্ষা করুন। হে তাত! অবশ্যকর্তব্য বিষয়ে বিমুখ হইবেন না; দেখুন, ইহার পর আর দুঃখের বিষয় কি যে, আপনি স্বর্গপ্রাপ্ত হইলে পর অমির। কুকুরের ন্যায় দ্বারে দ্বারে অশ্ন যাফ্রা করিয়া ভ্রমণ করিব। আর যদি আপনি কেবল আমাকে পরিত্যাগ করিয়া সবান্ধবে পরিত্রাণ পাইতে পারেন, তাহা হইলে আমি পরলোকে গমন করিয়াও জীবিতার ন্যায় পরমসুখে বাস কবিব। হে পিতঃ! আপনি আমাকে রাক্ষসের মুখে ত্যাগ করিলে দেবগণ ও পিতৃগণ তত্ত তোয়ে পরম পরিতুষ্ট হইয়া আপনার হিতসাধনে তৎপর রহিবেন।
ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণী কন্যার এইরূপ পরিবেদন বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহার সমভিব্যাহারে রোদন করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের তিনজনকে এইরূপ ক্রন্দন করিতে দেখিয়া ব্রাহ্মণের শিশু সন্তান প্রত্যেকের নিকটে গমন করিয়া উৎফুল্ললোচনে, জট মধুরশ্বরে কহিতে লাগিলেন, হে তাত! হে মাতঃ! হে ভগিনি! তোমরা ক্রন্দন করিও, না, স্থির হও, আমার হস্তে এই যে তৃণটী দেখিতেছ, আমি ইহার আঘাতে সেই দুরাত্মা। রাক্ষসের প্রাণ নাশ করিব। তাঁহার। তিন জনে যৎপরোনাস্তি বিষ ছিলেন, কিন্তু বালকের মুখে মৃদু মধুর এই কথা শ্রবণে পরম আনন্দিত হইলেন। কুন্তী এতাবৎ ফাল দণ্ডায়মান ছিলেন, এক্ষণে অবসর বুঝিয়া তাহাদের দুঃখের কারণ জিজ্ঞাসা করিবার নিমিত্ত সমীপবর্তিনী হইলেন।