১৫৯তম অধ্যায়
কৃপনিন্দায় অশ্বত্থামার কর্ণবধোদ্যম
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাবীর অশ্বত্থামা সূতপুত্রকে মাতুল কৃপাচার্য্যের প্রতি এইরূপে কঠোর বাক্য প্রয়োগ করিতে দেখিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে সিংহ যেমন মত্তমাতঙ্গের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ কুরুরাজ দুর্য্যোধনের সমক্ষেই অসি নিষ্কাশনপূর্ব্বক কর্ণের প্রতি ধাবমান হইয়া কহিলেন, ‘রে নরাধম! মহাত্মা কৃপাচার্য্য অর্জ্জুনের প্রকৃত গুণসকল কীৰ্ত্তন করিতেছিলেন; কিন্তু তুমি বিদ্বেষবুদ্ধিপ্রভাবে ইহার ভৎর্সনায় প্রবৃত্ত হইয়াছ। রে মূঢ়! তুমি অহঙ্কারপরতন্ত্র হইয়া কিছুই লক্ষ্য করিতেছ না এবং ধনুর্দ্ধরদিগের সমক্ষে আপনার বলবীর্য্যের শ্লাঘা করিতেছ। যখন মহাবীর অর্জ্জুন তোমাকে পরাজিত করিয়া তোমার সমক্ষেই জয়দ্রথকে বিনষ্ট করিলেন, তৎকালে তোমার এই বীৰ্য্য ও অস্ত্রসমুদয় কোথায় ছিল? হে সূতকুলাঙ্গার! যিনি পূর্ব্বে স্বয়ং মহাদেবের সহিত সংগ্রাম করিয়াছিলেন, তুমি সেই অর্জ্জুনকে পরাজিত করিবার নিমিত্ত কেন মনে বৃথা কল্পনা করিতেছ? সুররাজসনাথ সমুদয় দেব ও অসুরগণ কৃষ্ণসহায় অর্জ্জুনকে পরাজিত করিতে সমর্থ হয়েন নাই। তুমি সেই অপরাজিত অদ্বিতীয় বীরকে এই সমস্ত ভূপালগণের সহিত কিরূপে পরাজয় করিতে পারিবে? হে দুর্বুদ্ধে! এক্ষণে তুমি এই স্থানে অবস্থান করিয়া আমার বলবীৰ্য্য অবলোকন কর, আমি অদ্য তোমার মস্তকচ্ছেদন করিব। অশ্বত্থামা এই বলিয়া মহাবেগে তাঁহার শিরচ্ছেদনে সমুদ্যত হইলেন। তদ্দর্শনে কুরুরাজ দুর্য্যোধন ও কৃপাচার্য্য তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন।
দুৰ্য্যোধনাদিকর্ত্তৃক অশ্বত্থামার সান্ত্বনা
“তখন কর্ণ দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, ‘হে রাজন্! ঐ ব্রাহ্মণাধম নিতান্ত দুর্বুদ্ধিপরতন্ত্র ও সমরশ্লাঘী; তুমি উহাকে পরিত্যাগ কর। ঐ দুরাত্মা এক্ষণে আমার ভুজবীৰ্য্য দর্শন করুক। অশ্বত্থামা কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে সূতপুত্র! আমি তোমাকে ক্ষমা করিলাম; কিন্তু মহাবীর অর্জ্জুন তোমার এই দর্প চূর্ণ করিবেন।’ তখন দুৰ্য্যোধন কহিলেন, ‘হে ব্ৰহ্মন্! আপনি প্রসন্ন হইয়া ক্ষমা করুন, সূতপুত্রের প্রতি ক্রোধপ্রদর্শন করা আপনার কৰ্ত্তব্য নহে। আপনাকে এবং কৃপ, কর্ণ, দ্রোণ, মদ্ররাজ ও শকুনিকে অতি গুরুতর কার্য্যভার বহন করিতে হইবে। ঐ দেখুন, পাণ্ডবগণ কর্ণের সহিত যুদ্ধ করিবার বাসনায় স্পর্ধা প্ৰকাশপূর্ব্বক আমাদিগের অভিমুখীন হইতেছে।’
“হে মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন মনস্বী অশ্বত্থামাকে এইরূপে প্রসন্ন করিলে দ্রোণতনয় ক্রোধবেগ সংবরণ করিলেন। তখন শান্তস্বভাব কৃপাচার্য্য অবিলম্বে মৃদুভাব অবলম্বনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘হে সূতনন্দন! এক্ষণে আমরা তোমাকে ক্ষমা করিলাম, কিন্তু মহাবীর অর্জ্জুন তোমার এই দর্প চূর্ণ করিবেন, সন্দেহ নাই।
কর্ণ-পাণ্ডবের তুমুল যুদ্ধ
“হে মহারাজ! অনন্তর সেই যশস্বী পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ মিলিত হইয়া বারংবার তর্জ্জন করিয়া আগমন করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন রথীপ্রধান তেজস্বী কর্ণও দেবগণপরিবৃত দেবরাজের ন্যায় কৌরবগণে পরিবেষ্টিত হইয়া স্বীয় বাহুবল অবলম্বনপূর্ব্বক অবস্থান করিতে লাগিলেন। অনন্তর পাণ্ডবদিগের সহিত কর্ণের ভীষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। যশস্বী পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ কর্ণকে নিরীক্ষণ করিয়া কেহ কেহ ‘এই কর্ণ’, কেহ কেহ ‘কর্ণ কোথায়’ এবং কেহ কেহ ‘ওরে দুরাত্মন্ সূতনন্দন! রণস্থলে অবস্থানপূর্ব্বক আমাদিগের সহিত যুদ্ধ কর’ এই বলিয়া উচ্চস্বরে শব্দ করিতে আরম্ভ করিলেন। অন্যান্য যোধগণ কর্ণকে অবলোকনপুর্ব্বক রোষকষায়িতলোচনে কহিতে লাগিলেন যে, যাবতীয় নৃপসত্তমগণ ঐ অল্পবুদ্ধি গর্বিতচিত্ত সূতপুত্রকে সংহার করুন। উহার জীবনে কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অত্যন্ত বিপক্ষ, দুৰ্য্যোধনের হিতৈষী ও. সকল অনর্থের মূল; অতএব উহার প্রাণসংহার কর।’ পাণ্ডবপ্রেরিত মহারথ ক্ষত্রিয়গণ এই কথা কহিতে কহিতে কর্ণবিনাশার্থ ধাবমান হইয়া অসংখ্যশরবর্ষণে চতুর্দ্দিক সমাচ্ছাদিত করিতে লাগিলেন। সংগ্ৰামবিজয়ী লঘুহস্ত বলবান সূতনন্দন সেই কালান্তকযমোপম অদ্ভুত সৈন্যসাগর ও মহাবলপরাক্রান্ত পাণ্ডবগণকে অবলোকন করিয়া কিছুমাত্র ব্যথিত বা শঙ্কিত হইলেন না; প্রত্যুত শরবর্ষণপূর্ব্বক অরাতিসৈন্যগণকে নিবারিত করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন পাণ্ডবপক্ষীয় যোধগণ শরবর্ষণ ও শরাসন কম্পনপূর্ব্বক পূর্ব্বে দানবগণ যেমন দেবরাজের সহিত সংগ্রাম করিয়াছিল, তদ্রূপ কর্ণের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। মহাবীর কর্ণ অসংখ্য শরবর্ষণপূর্ব্বক সেই ভূপালগণনির্মুক্ত শরজাল ছেদন করিয়া ফেলিলেন। ঐ সময় সূতপুত্র এরূপ অদ্ভুত হস্তলাঘব প্রদর্শন করিতে লাগিলেন যে বিপক্ষবর্গ সমরে যত্নবান্ হইয়াও তাঁহাকে আক্রমণ করিতে সমর্থ হইল না।
“এইরূপে মহাবীর কর্ণ নৃপগণের শরসমূহ নিরাকৃত করিয়া তাঁহাদের যুগকাষ্ঠ, ঈষা, ছত্র, ধ্বজ ও ঘোটকসমুদয়ের উপর স্বনামাঙ্কিত নিশিত শরনিকর পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন কর্ণশরনিপীড়িত ভূপালগণ ব্যাকুলচিত্তে শীতাৰ্দিত গোসমূহের ন্যায় ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলেন। বিপক্ষপক্ষীয় অসংখ্য অশ্বসকল, গজ ও রথী কর্ণের শরে নিপীড়িত হইতে লাগিল। সমরে অপরাঙ্মুখ শূরগণের চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ মস্তকসমুদয়ে রণভূমি সমাচ্ছন্ন হইল। যোধগণ ইতস্ততঃ নিহত, হন্যমান ও রোরুদ্যমান হওয়াতে সমরক্ষেত্র অতিভীষণ যমালয়ের ন্যায় বোধ হইতে লাগিল। ঐ সময় মহারাজ দুৰ্য্যোধন কর্ণের পরাক্রম দেখিয়া অশ্বত্থামাকে কহিলেন, ‘হে ব্ৰহ্মন্! ঐ দেখুন, মহাবীর কর্ণ বর্ম্মধারণপূর্ব্বক বিপক্ষপক্ষীয় সমস্ত ভূপতিগণের সহিত যুদ্ধ করিতেছেন। পাণ্ডবসেনাগণ কর্ণাণে নিপীড়িত হইয়া পলায়ন করিতেছে। ঐ দেখুন, অর্জ্জুন স্বীয় সৈন্যগণকে কার্ত্তিকেয়নির্জিত অসুরসেনার ন্যায় কর্ণশরে নির্জিত দেখিয়া সূতপুত্রের বিনাশার্থ ধাবমান হইতেছে। অতএব যাহাতে ধনঞ্জয় যোধগণের সমক্ষে তাঁহাকে বিনাশ করিতে না পারে, আপনি এরূপ উপায় অবলম্বন করুন। দুৰ্য্যোধন অশ্বত্থামাকে এই কথা বলিলে অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য্য, শল্য ও হার্দ্দিক্য দৈত্যসেনাভিমুখীন দেবরাজের ন্যায় অর্জ্জুনকে আগমন করিতে দেখিয়া সূতপুত্রের রক্ষাৰ্থ তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় পাঞ্চালগণে পরিবৃত হইয়া, পুরন্দর বৃত্রাসুরের প্রতি যেরূপ ধাবমান হইয়াছিলেন, তদ্রূপ কর্ণের অভিমুখে গমন করিলেন।
কর্ণার্জ্জুনযুদ্ধ-কর্ণপরাজয়
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “হে সঞ্জয়! সুৰ্য্যতনয় মহারথ কর্ণ প্রতিনিয়ত অর্জ্জুনের সহিত স্পর্ধা ও তাহাকে পরাজিত করিতে বাসনা করিয়া থাকে। এক্ষণে সেই জাতবৈর কালান্তক যমসদৃশ ক্রুদ্ধ মহাবীর ধনঞ্জয়কে সহসা অবলোকন করিয়া কি করিল?”
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! গজ যেমন প্রতিপক্ষ গজের প্রতি ধাবমান হয়, তদ্রূপ মহাবীর কর্ণ ধনঞ্জয়কে সমাগত সন্দর্শন করিয়া তাঁর প্রতি গমন করিলেন। মহাবীর অর্জ্জুন সেই মহাবেগে, সমাগত সূতপুত্রকে সুবর্ণপুঙ্খ সরল শরসমুদয়ে সমাচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলেন। মহাবাহু কর্ণ তদ্দর্শনে সাতিশয় ক্রুদ্ধ হইয়া সত্বর তিনশরে অর্জ্জুনকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর ধনঞ্জয় কর্ণের হস্তলাঘব সহ্য করিতে না পারিয়া তাঁহার উপর ত্রিংশৎ শাণিত শর নিক্ষেপপূর্ব্বক ক্রোধভরে এক নারাচে তাঁহার বামহস্তের অগ্রভাগ বিদ্ধ করিলেন। ধনঞ্জয়ের ভীষণ নারাচের আঘাতে কর্ণের হস্ত হইতে সহসা কার্মুক নিপতিত হইল। মহাবলপরাক্রান্ত সূতপুত্র তৎক্ষণাৎ সেই কোদণ্ড গ্রহণপূর্ব্বক হস্তলাঘব প্রদর্শন করিয়া নিমেষমধ্যে অর্জ্জুনকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় তদ্দর্শনে হাস্য করিয়া শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক কর্ণপরিত্যক্ত শরজাল ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে সেই পরস্পর প্রতীকারপরায়ণ বীরদ্বয় শরজালে চতুর্দ্দি সমাচ্ছন্ন করিলেন। করিণীর নিমিত্ত বন্য মাতঙ্গদ্বয়ের যেরূপ যুদ্ধ হইয়া থাকে, তৎকালে কর্ণ ও অর্জ্জুনের তদ্রূপ ঘোরতর সংগ্রাম হইতে লাগিল।
“অনন্তর মহাধনুর্দ্ধর ধনঞ্জয় সূতপুত্রের পরাক্রম অবলোকন করিয়া সত্বর তাঁহার করস্থিত কার্মুকের মুষ্টিদেশ ছেদন ও ভল্লাস্ত্রে চারি-অশ্বকে শমনসদনে প্রেরণপূর্ব্বক সারথির মস্তকচ্ছেদন করিয়া ফেলিলেন। এইরূপে মহাবীর কর্ণ অশ্ব, সারথি ও কার্মুকবিহীন হইলে ধনঞ্জয় তাঁহাকে চারিবাণে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর কর্ণ অর্জ্জুনের শরে বিদ্ধ হইয়া শল্লকীর [সজারুর-তাড়া পাইলেই সজারুর গায়ের কাঁটাগুলি খাড়া হইয়া উঠে] ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন এবং জীবিতরক্ষাৰ্থ সত্বর সেই অশ্বহীন রথ হইতে অবরোহণপূর্ব্বক কৃপাচার্য্যের রথে সমারূঢ় হইলেন। তখন অর্জ্জুনশরে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ কৌরবপক্ষীয় সৈন্যগণ সূতপুত্রকে পরাজিত দেখিয়া চারিদিকে পলায়ন করিতে লাগিল। রাজা দুৰ্য্যোধন তাহাদিগকে পলায়নপরায়ণ অবলোকন করিয়া নিবারণপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, ‘হে ক্ষত্রিয় প্রধান বীরগণ! তোমাদের পলায়ন করিবার প্রয়োজন নাই; এই আমি স্বয়ং অর্জ্জুনের বধার্থ সমরাঙ্গনে গমন করিতেছি। আমি অবিলম্বেই অর্জ্জুনকে পাঞ্চালগণের সহিত বিনাশ করিব। আজ আমি গাণ্ডীবধম্বর সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইলে অন্যান্য পাণ্ডবগণ যুগান্তকালের ন্যায় আমার বিক্রম দর্শন করিবে। আমার শরনিকর শলভশ্রেণীর ন্যায় তাহাদের দৃষ্টিগোচর হইবে। আজ আমি শরজাল বিস্তার করিতে আরম্ভ করিলে আমার সৈনিকপুরুষেরা বর্ষাকালীন জলধরনির্মুক্ত জলধারার ন্যায় আমার শরধারা, সন্দর্শন করিবে। হে বীরগণ! তোমরা অর্জ্জুন হইতে ভয় পরিত্যাগপূর্ব্বক রণস্থলে অবস্থান কর। আমি আজই সন্নতপর্ব্ব সায়কনিচয়দ্বারা তাহাকে পরাজিত করিব। মকরাকুল মহার্ণব যেমন তীরভূমি অতিক্রমণে অসমর্থ, তদ্রূপ ধনঞ্জয় আজ আমার পরাক্রম সহ্য করিতে পারিবে না।
“হে মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন এই কথা বলিয়া, অসংখ্যসৈন্যে পরিবৃত হইয়া রোষকষায়িতলোচনে অর্জ্জুনের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন মহাত্মা কৃপাচার্য্য মহাবাহু দুৰ্য্যোধনকে যুদ্ধে গমন করিতে দেখিয়া অশ্বত্থামাকে কহিলেন, ‘হে দ্রোণনন্দন! ঐ দেখ, রাজা দুৰ্য্যোধন ক্ৰোধান্ধ হইয়া পতঙ্গবৃত্তি অবলম্বনপূর্ব্বক যুদ্ধার্থ অর্জ্জুনের নিকট গমন করিতেছেন। উঁহাকে শীঘ্ৰ নিবারণ কর, নচেৎ উনি আমাদের সমক্ষে অর্জ্জুনের শরে বিনষ্ট হইবেন। উনি যে পৰ্য্যন্ত অর্জ্জুনশরনিকরের পথবর্তী না হইবেন, সেই অবধিই রণস্থলে জীবিত থাকিতে পারিবেন; অতএব উনি নির্মোকনির্মুক্ত ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ অর্জ্জুনশরে ভস্মীভূত না হইতে হইতেই উঁহাকে যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত কর। হে মহাত্মন্! আমরা উপস্থিত থাকিতে দুৰ্য্যোধনের অসহায়ের ন্যায় স্বয়ং যুদ্ধার্থ গমন করা কোনক্রমেই উপযুক্ত নহে। বিশেষতঃ দুর্য্যোধন শার্দুলের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হস্তীর ন্যায় অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে উহার জীবনরক্ষা করা অতিশয় সুকঠিন হইবে।’
“হে মহারাজ! অস্ত্রবিশারদ অশ্বত্থামা মাতুলের বাক্যশ্রবণানন্তর সত্বর রাজা দুৰ্য্যোধনকে কহিলেন, ‘হে গান্ধারীপুত্র! আমি সতত তোমার হিতানুষ্ঠানে যত্ন করিয়া থাকি। অতএব আমি জীবিত থাকিতে আমাকে অনাদর করিয়া স্বয়ং যুদ্ধে গমন করা তোমার উচিত হইতেছে না। হে দুৰ্য্যোধন! অর্জ্জুনের পরাজয়নিমিত্ত তোমাকে কিছুমাত্র ব্যস্ত হইতে হইবে না, তুমি এই স্থানে অবস্থান কর, এক্ষণে আমিই ধনঞ্জয়কে নিবারণ করিতেছি।
সমপরাজয়ে ভীত দুর্য্যোধনের ধিক্কার
“দুর্য্যোধন কহিলেন, “হে ব্ৰহ্মন্! আচার্য্য পাণ্ডবগণকে সুতনির্ব্বিশেষে রক্ষা করিয়া থাকেন এবং আপনিও প্রতিনিয়ত তাহাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেন। এক্ষণে আমার দুরদৃষ্টবশতঃই হউক বা যুধিষ্ঠির ও দ্রৌপদীর প্রিয়ানুষ্ঠান করিবার নিমিত্তই হউক, রণস্থলে আপনার পরাক্রম খর্ব্ব হইয়া থাকে।
আমি অতিশয় লুব্ধস্বভাব; আমাকে ধিক্! বান্ধবগণ আমার সুখলাভের নিমিত্তই পরাজিত ও সাতিশয় দুঃখপ্রাপ্ত হইতেছেন। যাহা হউক, হে ব্ৰহ্মন্! আপনি ব্যতিরেকে মহেশ্বরসম মহাবলপরাক্রান্ত শস্ত্রবিদগণের অগ্রগণ্য অন্য কোন্ বীর সমর্থ হইয়াও বিপক্ষগণের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করে? হে গুরুপুত্র! এক্ষণে আপনি প্রসন্ন হইয়া আমার শত্রুবিনাশে প্রবৃত্ত হউন। দেবদানবগণও আপনার অস্ত্রের নিকট অবস্থান করিতে সমর্থ হয়েন না। অতএব আপনি অনুচরবর্গের সহিত সোমক ও পাঞ্চালগণকে সংহার করুন। পশ্চাৎ আমরা আপনারই ভুবলে পরিরক্ষিত হইয়া অবশিষ্ট শত্রুগণকে বিনষ্ট করিব। ঐ দেখুন, সোমক ও পাঞ্চালগণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দাবানলের ন্যায় আমার সৈন্যমধ্যে বিচরণ করিতেছে। অতএব আপনি উহাদিগকে এবং কেকয়গণকে নিবারণ করুন। নচেৎ উহারা ধনঞ্জয়কর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া আমাদিগকে নিঃশেষিত করিবে। হে ব্রহ্মন্! আপনি অবিলম্বেই উহাদিগকে বিনাশ করুন। এই কাৰ্য্য এক্ষণেই হউক বা পরেই হউক, আপনাকেই সাধন করিতে হইবে। সাধু সিদ্ধগণ কহিয়া থাকেন যে, আপনি পাঞ্চালগণকে বিনাশ করিবার নিমিত্তই উৎপন্ন হইয়াছেন; আপনার প্রভাবে সমগ্র পৃথিবী পাঞ্চালশূন্য হইবে। হে ব্রহ্ম! সিদ্ধপুরুষদিগের বাক্য কদাচ মিথ্যা হইবার নহে। অতএব আপনি অনুচরগণসমবেত পাঞ্চালগণকে সংহার করুন। পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাকুক, অমরগণও আপনার অগোচরে অবস্থান করিতে সমর্থ নহেন। হে পুরুষপ্রবর! আমি সত্য কহিতেছি যে, সোমক ও পাণ্ডবেরা বলপ্রকাশপূর্ব্বক আপনার সহিত যুদ্ধ করিতে কদাচ সমর্থ হইবে না। এক্ষণে আপনি গমন করুন, আর কালবিলম্ব করিবেন না। ঐ দেখুন, আমার সৈন্যগণ ধনঞ্জয়ের শরজালে একান্ত নিপীড়িত হইয়া ইতস্ততঃ ধাবমান হইতেছে। হে আচাৰ্য্যকুমার! আপনি স্বীয় দিব্যতেজঃপ্রভাবে পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণের নিগ্রহ করিতে সমর্থ হইবেন, সন্দেহ নাই।”