১৫৯তম অধ্যায়
উলূকের যুধিষ্ঠিরসমীপে দৌতকাৰ্য্য
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! অনন্তর কৈতব্য [কিতবতনয়] উলূক পাণ্ডবগণের সেনানিবেশে প্রবেশ করিয়া ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কহিল, “মহারাজ! আপনি দূতাবাক্যে অভিজ্ঞ; অতএব রাজা দুৰ্য্যোধন যেসমস্ত কথা কহিয়াছেন, তাহা শ্রবণ করিয়া আমার প্রতি ক্রোধাবিষ্ট হইবেন না।” যুধিষ্ঠির কহিলেন, “হে উলূক! তোমার কোন ভয় নাই; সেই অদূরদর্শীষ [ভবিষ্যৎ দর্শনে অসমৰ্থ] লুব্ধ দুৰ্য্যোধন যাহা কহিয়াছে, তুমি তাহা অকুষ্ঠিতচিত্তে কীর্ত্তন কর।”
“তখন উলূক পাণ্ডব, সৃঞ্জয়, মৎস্য ও অনেকানেক নৃপতিগণ, মহাপতি [সর্ব্বপালক] কৃষ্ণ, সপুত্র বিরাট ও দ্রুপদসন্নিধানে ধৰ্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে কহিল, মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন কৌরবগণসমক্ষে আপনাকে যাহা কহিয়াছেন, শ্রবণ করুন: “হে যুধিষ্ঠির! আপনি দ্যূতক্ৰীড়ায় পরাজিত হইলে আপনাদের প্রণয়িনী দ্রুপদনন্দিনী সভামধ্যে আনীত হইয়াছিল; সুতরাং ইহাতে পুরুষাভিমানী ব্যক্তির অবশ্যই রোষোদ্রেক হইতে পারে। আপনারা দ্বাদশ বৎসর অরণ্যে বাস ও এক বৎসর বিরাটের দাসত্ব স্বীকার করিয়া বিরাটভবনে অবস্থিতি করিয়াছিলেন। এক্ষণে পূর্ব্ব অমর্ষ, রাজ্যাপহরণ, বনবাস ও দ্রৌপদীর ক্লেশ স্মরণ করিয়া পুরুষকার প্রদর্শন করুন। ভীম অশক্ত হইয়াও “আমি দুঃশাসনের রুধির পান করিব।” এইরূপ অঙ্গীকার করিয়াছিল, এক্ষণে যদি সমর্থ হয়, তাহার অনুষ্ঠান করুক। অস্ত্রশস্ত্রের নীরাজনবিধি সমাহিত হইয়াছে, কুরুক্ষেত্ৰ কৰ্দমশূন্য, পথ্যসকল সমতল ও আপনার অশ্বগণও হৃষ্টপুষ্ট হইয়াছে; অতএব কল্যই কেশবসমভিব্যাহারে সংগ্রামে প্রবৃত্ত হউন। আপনি রণস্থলে ভীষ্মদেবের সহিত সমাগত না হইয়া কেন আত্মশ্লাঘা করিতেছেন? যেমন মন্দগামী ব্যক্তি গন্ধমাদনপর্ব্বতে আরোহণ করিবার অভিলাষে শ্লাঘা করিয়া থাকে, তদ্রূপ আপনিও আপনার শ্লাঘা করিতেছেন। এক্ষণে অহঙ্কার পরিহার করিয়া পুরুষকার প্রদর্শন করুন। আপনি একান্ত দুরাক্রম্য সূতপুত্র, মহাবলপরাক্রান্ত শল্য ও দেবরাজতুল্য প্রভাবসম্পন্ন দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরাজয় না করিয়া কিরূপে রাজ্যলাভের অভিলাষ করিতেছেন? তিনি ব্রহ্মবিদ্যা ও ধনুবিদ্যার আচাৰ্য্য, যিনি বেদ ও শাস্ত্রবিদ্যায় পারগ, যিনি যুদ্ধের সমগ্র ধুরন্ধর [সকলের শ্রেষ্ঠ] এবং নিতান্ত অক্ষুব্ধ, সেই সেনানায়ক বিজয়ী দ্রোণাচাৰ্য্যকে পরাজিত করিতে বৃথা ইচ্ছা করিয়াছেন। বায়ুবেগে সুমেরুগিরি উন্মলিত হইয়াছে, এ কথা আমরা কখনই শ্রবণ করি নাই। আপনি আমাকে যেরূপ কহিয়াছেন, তাহা যদি সত্য হয়, তাহা হইলে অনিল [বাতাস] সুমেরু [পর্ব্বত] বহন করিবে, নভোমণ্ডল ভূতলে নিপতিত হইবে এবং যুগ পরিবর্ত্তিত হইবে। কোন ব্যক্তি অরিনিসূদন দ্রোণকে প্রাপ্ত হইয়া জীবনাভিলাষ করিয়া থাকে? গজ, অশ্ব বা রথ, ইহারাও দ্রোণাচাৰ্য্যকে প্রাপ্ত হইয়া কখনই নির্ব্বিঘ্নে গৃহে প্ৰতিগমন করিতে সমর্থ হয় না। দ্রোণ ও কর্ণ যাহাকে বিনাশ করিতে অভিলাষী হয়েন, সে নিদারুণ শরজালে ভিন্নকলেবর হইয়া জীবিতাবস্থায় তাহাদের হস্ত হইতে পরিত্রাণপ্ৰাপ্ত হইয়া কদাচি গমন করিতে পুরে না। আপান কূপমণ্ডুকের ন্যায়, নৃপতি রক্ষিত দেবসেনাসদৃশ নিতান্ত দুৰ্দ্ধৰ্ষ যে সেনাসমুদয় সমবেত হইয়াছে, ইহা কি অবগত হইতেছেন না? হে অল্পবুদ্ধে! আমি যখন নাগবল [গজারোহী সৈন্য] মধ্যে অবস্থিত হইব, তৎকালে কিরূপে আপনি আমার ও দুৰ্নিবার বেগবতী ভাগীরথী প্রবাহের ন্যায় অনিবাৰ্য্য পূর্ব্ব পশ্চিম, দক্ষিণ ও উত্তরদেশীয় ভূপাল, কাম্বোজ, শক, খগ, শাল্ব, মৎস্য, কুরুমধ্যদেশীয় স্লেচ্ছ, পুলিন্দ, দ্রাবিড় ও অন্ধকগণসঙ্কুল সমূহের সহিত সংগ্রাম করিতে অভিলাষ করিতেছেন?”
অর্জ্জুন সম্বন্ধে দৌত্যকাৰ্য্য
মহারাজ দুৰ্য্যোধন আপনাকে বলিবার জন্য যাহা বলিয়াছেন, তাহা যথাযথভাবে নিবেদন করিতেছি। তিনি বলিয়াছেন: “হে ধনঞ্জয়! তুমি এক্ষণে অহঙ্কারশূন্য হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, বারংবার আত্মশ্লাঘা করিতেছ কেন? সমরে যুদ্ধের নানাপ্রকার রীতিপদ্ধতি প্রদর্শন করিলে শ্লাঘা সফল হইয়া থাকে। দেখ, শ্লাঘা প্রকাশে কেহই শত্রু নহে, যদি কেবল শ্লাঘা প্ৰকাশ করিলেই কাৰ্য্যসিদ্ধি হইত, তাহা হইলে সকলেই কৃতকাৰ্য্য হইতে পারিত। তোমার তালপ্রমাণ গাণ্ডীব ও প্রধান সহায় বাসুদেবকে জ্ঞাত হইয়াছি। তোমার তুল্য যোদ্ধা আর নাই, ইহাও সবিশেষ অবগত আছি; তথাপি তোমার সমুদয় রাজ্যসম্পত্তি অপহরণ করিয়া ভোগ করিতেছি। মানবগণ কখন সঙ্কল্পদ্বারা সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হয় না; বিধাতাই সঙ্কল্পদ্বারা অনুকূল কাৰ্য্যসকল সংসাধন করিয়া থাকেন। দেখ, আমি তোমাকে দুঃখসাগরে নিমগ্ন করিয়া ত্ৰয়োদশ বৎসর রাজ্যভোগ করিয়াছি; এক্ষণে আবার বান্ধবের সহিত তোমাকে সংহার করিয়া পুনর্ব্বার পৃথিবী শাসন করিব। যখন তুমি দাসত্বপণে পরাজিত হইয়াছিলে, তৎকালে তোমার গাণ্ডীবপ্রভাব এবং ভীমের বলবীৰ্য্য ও গদা কোথায় ছিল? দ্রৌপদী ব্যতিরেকে তোমাদের মুক্তিলাভের আর প্রত্যাশা ছিল না; সেই দ্রৌপদীই তোমাদিগকে দাসত্বশৃঙ্খল হইতে বিমোচিত করিয়াছে। তোমরা বিরাটনগরে মনুষ্যত্বশূন্য হইয়া দাসকর্মে নিযুক্ত ছিলে; সুতরাং আমি তোমাদিগকে যে ষণ্ডতিল বলিয়াছিলাম, তাহা নিতান্ত অমূলক নহে। আমারই পৌরুষপ্রভাবে ভীম বিরাটের মহানসে সূপকারবৃত্তি অবলম্বন করিয়া একান্ত ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হইয়াছিল। তুমি ষণ্ডবেশ পরিগ্রহ ও বেণীধারণ করিয়া বিরাটকন্যা উত্তরাকে নৃত্যশিক্ষা করাইয়াছিলে। দেখ, ক্ষত্ৰিয়েরা ক্ষত্ৰিয়গণের প্রতি এইরূপই দণ্ডবিধান করিয়া থাকেন। আমি তোমার ও বাসুদেবের ভয়ে ভীত হইয়া কখনই রাজ্যপ্ৰদান করিব না, তুমি এক্ষণে কেশবসমভিব্যাহারে যুদ্ধে প্ৰবৃত্ত হও। মায়া, ইন্দ্ৰজাল [যাদুবিদ্যা] বা অতি ভীষণ কুহক [মোহকারক মিথ্যা ঘটনা] সকল সমরে অস্ত্ৰধারী বীরপুরুষকে কদাচ বিভীষিকা প্রদর্শন করিতে সমর্থ হয় না। সহস্র বাসুদেব বা শত শত অর্জ্জুন সমরে আমার সম্মুখীন হইলেও অবশ্যই তাহাদিগকে দিগদিগন্তে পলায়ন করিতে হইবে। তুমি যুদ্ধে ভীষ্মদেবের সহিত সমাগত হও বা মস্তকদ্বারা গিরি বিদীর্ণ করা অথবা বাহুদ্বারা অগাধ সৈন্যসাগর উত্তীর্ণ হও, আমার সম্মুখীন হইলে দিগদিগন্তে পলায়ন করিতে হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। ঐ মহাসাগরে শারদ্বত মীন, বিবিংশতি উরগ, ভীষ্ম প্রবলবেগ, দ্রোণ দুরাসদ গ্রাহ, কৰ্ণ আবর্ত্ত, কাম্বোজ বাড়বানল, সোমুদত্তি তিমিঙ্গিল, বৃহদ্বল মহাতরঙ্গ, শ্রুতায়ু, হার্দ্দিক্য ও যুযুৎসু সলিল, ভগদত্ত প্রবল মারুত, দুঃশাসন মহাপ্রবাহ, জয়দ্ৰথ অভ্যন্তরগিরি [প্রত্যন্ত পর্ব্বত—বড় বড় পাহাড়ের মধ্যে ছোট ছোট পাহাড়], শকুনি কুল, সুষেণ মাতঙ্গ, চিত্রায়ুধ নক্ৰ বেং পুরুমিত্ৰ গাভীৰ্য্য। তুমি যখন ঐ মহাসাগরে অবগাহন [বীরগণরূপ সমুদ্রে অবতরণ] করিয়া হতবান্ধব ও পরিশ্রমে একান্ত ক্লান্তচিত্ত হইবে, তখন তোমার পরিতাপের আর পরিসীমা থাকিবে না। যেমন অশুচি ব্যক্তির মন স্বৰ্গ হইতে প্রতিনিবৃত্ত হয়, তদ্রুপ তোমার মন পৃথিবীর শাসন হইতে বিনিবর্ত্তিত হইবে [তুমি মরিয়া যাইবে]। যেমন তপানুষ্ঠানপরাভূখ ব্যক্তি স্বৰ্গপ্রাপ্ত হইতে অভিলাষ করে, সেইরূপ তুমিও নিতান্ত দুর্লভ রাজ্যলাভ করিতে ইচ্ছা করিয়াছ।’ ”