১৫৮. ব্রাহ্মণের প্রতি ব্রাহ্মণীর সান্ত্বনা
অষ্টপঞ্চাশদধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে রাজন! ব্রাহ্মণের এইরূপ বিলাপবাক্য শ্রবণ করিয়া ব্রাহ্মণী তাঁহাকে সান্ত্বনা করিয়া কহিতে লাগিলেন, মহাশয়! আপনি বিদ্বান হইয়াও কি নিমিত্ত প্রাকৃত লোকের ন্যায় অনুতাপ করিতেছেন? দেখুন, যে সমস্ত মানবগণ ধরাতলে জন্ম গ্রহণ করিয়াছে, সকলকেই একবার মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইতে হইবে, সন্দেহ নাই; অতএব যাহা অবশ্যম্ভাবী, কোনমতে খণ্ডিবার নহে, তদ্বিষয়ে সন্তাপ করা কর্তব্য হয় না। হে বিদ্বন্! শাস্ত্রকারের কহেন, কি ভাৰ্য্যা, কি পুত্র, কি দুহিতা, সকলই আপনার নিমিত্ত; অতএব আপনি আমাকে পরিত্যাগ করিয়া আত্মরক্ষা করুন। আমি স্বয়ং তথায় যাইব, কারণ, প্রাণ পৰ্যন্ত পরিত্যাগ করিয়া পত্বির হিতসাধন করাই সাধ্বী স্ত্রীর প্রধান ধর্ম ও অবশ্যকর্তব্য কর্ম। বিশেষতঃ আমি আপনার নিমিত্ত অকিঞ্চিৎকর ক্ষণভঙ্গুর দেহত্যাগরূপ এই কর্ম করিলে পরলোকে অক্ষয় সদগতি ও ইহলোকে অপরিমিত যশোরাশি লাভ করিতে পারিব। আমি আপনাকে যাহা কহিতেছি, ইহাতে আপনার প্রচুর পরিমাণে অর্থ ও ধৰ্মলাভ হইবে। দেখুন, লোকে যে নিমিত্ত পত্নী কামনা করে, আপনার তাহা হইয়াছে; আপনি আমাতে এক কন্যা ও এক পুত্র উৎপন্ন করিয়াছেন। আমি অমৃণা হইয়াছি; আমার পরলোক প্রাপ্তি হইলে পর আপনি অনায়াসে ইহাদিগকে প্রতিপালন করিতে পারিবেন; কিন্তু আপনি না থাকিলে আমাদের দুর্দশার আর পরিসীমা থাকিবে না। আমি বিধবা, অনাথা ও অসহায় হইয়৷ কিরূপে সৎপথাবলম্বনপূর্বক এই শিশু কুমার ও কুমারীকে বঁচাইতে পারি? সাতিশয় অহঙ্কত ও অনুপযুক্ত ব্যক্তিরাও এই কন্যাকে প্রার্থনা করিলে আমি কোন মতেই রক্ষা করিতে পারিব না। যেমন পক্ষিগণ ভূমিনিহিত আমিষখণ্ড গ্রহণে সাতিশয় লোলুপ হয়, সেইরূপ অধার্মিক লোকেরা পতিবিহীনা কামিনীকে বাসনা করে; অতএব হে দ্বিজোত্তম! যখন দুরাত্মাগণ অনাথা দেখিয়া আমাকে আক্রমণ করিতে উদ্যত হইবে, তখন আমি কিরূপে আপনার ধর্মরক্ষা করিব। আর আপনার কুরক্ষার এক হেতু এই কন্যাকেই বা কিরূপে পিতৃপিতামহসেবিত পথে নিযুক্ত করিতে পারি। আপনি ধর্মতত্ত্ববো; আপনি এই বালককে যেরূপ বিদ্যাশিক্ষা করাইতে পারিবেন, আমি কোনমতেই সেরূপ পারিব না। ইহার পর আর দুঃখের বিষয় কি যে, অনুপযুক্ত ব্যক্তিরা বেদশ্রুতি-গ্রহণেচ্ছু শূদ্রদিগের ন্যায় অপনার এই কন্যা প্রার্থনা করিবে। আমি যদি তাহাতে অস্বীকার করি, তাহা হইলে যেমন কাকগণ যজ্ঞ হইতে যজ্ঞীয় দ্রব্য অপহরণ করিয়া পলায়ন করে, দুরাত্মার। সেইরূপ অত্যাচার করিয়া কলপূর্বক কন্যাকে হরণ করিয়া লইবে, সন্দেহ নাই। হে ব্রহ্মন্! আমি এই পুত্রকে তোমার অনুরূপ গুণসম্পন্ন, এই কন্যাকে অনুপযুক্ত পাত্রের হস্তগত এবং আপনাকে অহঙ্কত জনগণকর্তৃক অজ্ঞাত দেখিয়া কখনই জীবন ধারণ করিতে প্লাবি না। আমি মরিলে এই বালক ও বালিক। অবশ্য প্রাণত্যাগ করিবে, জলক্ষয় হইলে মৎস্য অবশ্যই বিনষ্ট হয়। হে নাথ! এইরূপে আপনকার মরণে আমাদের তিন জনেরই মৃত্যু হইবে, নিশ্চয় জানিবেন; অতএব তাহ৷ না করিয়া কেবল আমাকেই পরিত্যাগ করুন। পুত্রবতী রমণীর, পতির অগ্রে পরলোকফাত্রা পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আমি আপনার নিমিত্ত এই পুত্র, দুহিতা, বান্ধব ও স্বীয় প্রাণ পরিত্যাগ করিতে অভিলাষ করিয়াছি। পতিপরায়ণা স্ত্রী পতির হিতসাধন করিয়া যাদৃশ ফল প্রাপ্ত হয়, যজ্ঞ, তপ, দান নিয়মাদিদ্বারা কদাচ তাদৃশ ফল লাভ করিতে পারে না; আমি যে ধর্ম অনুষ্ঠানে উদ্যত হইয়াছি,ইহা আপনার ও আপনার কুলের ইষ্ট ও হিতকর। সজ্জনেরা কহেন যে, ইষ্ট, অপত্য,অভি– লষিত দ্রব্য, প্রিয় বন্ধু ও প্রণয়িনী ভাৰ্য্যা, এই সমস্ত আপ নিবারণের নিমিত্ত হয়। প্রাচীন পণ্ডিতগণের এই উপদেশবাক্য আছে যে, আপদ নিবারণের নিমিত্ত ধন সঞ্চয় করিয়া রাখিবে, সেই ধন দ্বারা ভাৰ্য্য রক্ষা করিবে এবং কি ভাৰ্যা, কি ধন, যাহাদ্বারা হউক, আত্মরক্ষণে সর্বথা যত্নবান্ হইবে। ভাৰ্য্যা, পুত্র, ধন ও গৃহ এই চতুষ্টয় দৃষ্টাদৃস্ট ফল লাভের নিমিত্ত হয়; অতএব এই সমস্ত দ্বারা দৃষ্ট ফল ও অদৃষ্ট ফল সাধন করিবে। আরও তাঁহারা কহিয়াছেন যে, সমস্ত কুলক্ষয় করিয়াও যদি আত্মরক্ষা করিতে হয়, তাহাও মনুষ্যের পক্ষে কর্তব্য; কারণ, আত্মার সমান আর কেহই নাই; অতএব আপনি আমাকে এই পরম হিতকর কাৰ্যানুষ্ঠানে অনুমতি প্রদান করুন। হে মহাশয়! ধর্মজ্ঞ ব্যক্তিগণধর্মনির্ণয়স্থলে কহিয়াছেন, স্ত্রীলোক সকলের অবধ্য, রাক্ষসগণ ধর্মবিৎ; বোধ হয়, সে রাক্ষস আমাকে স্ত্রীলোক দেখিয়া বধ করিবে না; অতএব যখন পুরুষের বধে নিশ্চয় ও স্ত্রীলোকের বধে সংশয় রহিল, তখন আমাকে সেস্থানে প্রেরণ করা আপনার অবশ্য কর্তব্য। আমি উমোক্ত দ্রব্য ভোগ কবিয়াছি, অভিলষিত দ্রব্য সকল প্রাপ্ত হইয়াছি, আমার ধর্মানুষ্ঠান হইয়াছে এবং আপনা হইতেই এই অপত্যদ্বয় লাভ করিয়াছি; এক্ষণে আমার মরণে কিছুমাত্র দুঃখ নাই। আমি পুত্রবতী, বিশেষতঃ বৃদ্ধা হইয়াছি; অধিকন্তু এই কাৰ্য্য করিলে আপনার হিতানুষ্ঠান করা হয়; এই সকল ভাবিয়া আমি ইহাতে প্রবৃত্ত হইয়াছি। আর দেখুন, আমি মরিলে আপনি অন্য স্ত্রী গ্রহণ করিয়া গাহস্থ্যধর্মানুষ্ঠান করিতে পারিবেন। হে নাথ! পুরুষদিগের বহুবিবাহ দোষাবহ নহে, কিন্তু নায়ীগণের পত্যন্তর স্বীকারে মহান্ অধর্ম জন্মে; অতএব আপনি এই সমস্ত এক আত্মত্যাগের দৈাষ বিবেচনা করিয়া আমাকে ত্যাগ করুন; তাহা হইলে আপনার কুল ও এই শিশু সন্তানদ্বয়ের রক্ষা হইতে পারে। হে ভরতবংশাবতংস জনমেজয়! ব্রাহ্মণ পতিহিতৈষিণী ভাৰ্যার এই সমস্ত বাক্য শ্রবণে যৎপরোনাস্তি দুঃখিত হইয়া তাহাকে আলিঙ্গন করিয়া তাঁহার সহিত বাষ্পমোচন করিতে লাগিলেন।