১৫৮তম অধ্যায়
কর্ণের আত্মশ্লাঘা-কৃপাচার্য্যের নিন্দাবাণী
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! মহাবীর দুর্য্যোধন পাণ্ডব সৈন্যগণকে অতিশয় উদ্দপ্ত অবলোকন ও তাহাদের বিক্রম নিতান্ত অসহ্য জ্ঞান করিয়া কর্ণকে কহিলেন, ‘হে মিত্রবৎসল“ এক্ষণে মিত্ৰকাৰ্য্যের উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে; অতএব তুমি অস্মৎপক্ষীয় সমস্ত যোদ্ধৃগণকে পরিত্রাণ কর। উহারা নিশ্বসন্ত ভীষণ ভুজঙ্গসদৃশ মহারথ পাঞ্চাল, কেকয়, মৎস্য ও পাণ্ডবগণে পরিবেষ্টিত হইয়াছে। ঐ দেখ, ইন্দ্রতুল্যপরাক্রম, জয়শীল, মহারথ পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ হৃষ্টচিত্তে সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতেছে।’
“কর্ণ দুর্য্যোধনের বাক্য শ্রবণানন্তর কহিলেন, ‘হে মহারাজ। আজ আমি পুরন্দর স্বয়ং অর্জ্জুনের রক্ষাৰ্থ সমাগত হইলেও তাঁহাকে পরাজিত করিয়া অর্জ্জুনকে বিনাশ করিব, তুমি আশ্বস্ত হও; আমি সত্য বলিতেছি যে আজ তোমার প্রিয়ানুষ্ঠানের নিমিত্ত সমাগত পাঞ্চাল ও পাতনয়গণকে বিনষ্ট করিয়া, কাৰ্ত্তিকেয় ইন্দ্রকে যেরূপ বিজয় প্রদান করিয়াছিলেন, তদ্রূপ তোমাকে জয় প্রদান করিব। হে মহারাজ! মহাবীর ধনঞ্জয় সর্ব্বাপেক্ষা সমধিক বলবান; অতএব তাহার প্রতি আজ সেই বাসবদত্ত অমোঘ শক্তি নিক্ষেপ করিব। মহাধনুর্দ্ধর অর্জ্জুন নিহত হইলেই তাহার ভ্রাতৃগণ হয় তোমার বশীভূত হইবে, না হয় পুনরায় বনগমন করিবে। হে কুরুকুলতিলক! আমি জীবিত থাকিতে তোমার বিষাদ করিবার প্রয়োজনই নাই। আমি আজ পাণ্ডবগণের সহিত সমাগত পাঞ্চাল, কেকয় ও বৃষিগণকে সমরে পরাজয়পূর্ব্বক তাহাদিগকে শরনিকরে খণ্ড খণ্ড করিয়া তোমাকে পৃথিবী প্রদান করিব।’
“হে মহারাজ! মহাবাহু কৃপাচার্য্য কর্ণের বাক্যশ্রবণে গর্বিতভাবে তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে সূতপুত্র! যদি তোমার বাক্যে কাৰ্য্যসিদ্ধি হইত, তাহা হইলে তুমি থাকাতেই কুরুনাথ সনাথ হইতেন, সন্দেহ নাই। তুমি কুরুরাজসমীপে অনেকবার আত্মশ্লাঘা করিয়াছ; কিন্তু কখনই তোমার পরাক্রম বা বীর্য্যের ফল কিছুই লক্ষিত হয় নাই। তুমি কতবার অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছিলে; কিন্তু কখনই জয়লাভ করিতে সমর্থ হও নাই। গন্ধর্ব্বগণ যখন রাজা দুৰ্য্যোধনকে হরণ করিতে প্রবৃত্ত হয়, তখন সমস্ত সৈন্যগণ যুদ্ধ করিয়াছিল। কেবল তুমি একাকী সর্ব্বাগ্রে পলায়ন করিয়াছিলে। বিরাটনগরে যুদ্ধসময়ে সমস্ত কৌরবগণ পরাজিত হইলে তুমিও ভ্রাতৃগণের সহিত অর্জ্জুনের নিকট পরাজিত হইয়াছিলে। সূতনন্দন! তুমি একমাত্র মহাবীর অর্জ্জুনের সহিত যুদ্ধ করিতে অসমর্থ; তবে কিরূপে কৃষ্ণসহায় পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিতে উৎসাহী হইতেছ? হে সূতপুত্র। আত্মশ্লাঘা না করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হওয়া বীরপুরুষের কর্ত্তব্য; অতএব তুমি স্থির হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। তুমি শরৎকালীন মেঘের ন্যায় বৃথা গৰ্জন করিয়া আপনার অকৃতার্থতা প্রদর্শন করিতেছ; কিন্তু রাজা দুর্য্যোধন তাহা বুঝিতে সমর্থ হইতেছেন না। তুমি মহাবীর অর্জ্জুনকে দৃষ্টিগোচর না করিতে এবং তাঁহার বাণের সম্মুখবর্ত্তী না হইতেই মহাগৰ্জন করিয়া থাক; কিন্তু একবার ধনঞ্জয়ের শরে বিদ্ধ হইলে তোমার তর্জ্জনগৰ্জন অতি দুর্লভ হইয়া উঠে। ক্ষত্রিয়েরা বাহুবল, ব্রাহ্মণগণ বাগজাল এবং মহাবীর ধনঞ্জয় স্বীয় কার্মুকদ্বারা বীরত্ব প্রকাশ করেন; কিন্তু তুমি কেবল কল্পিত মনোরথদ্বারাই সৌর্য্যে প্রদর্শন করিয়া থাক। যে মহাবীর শৌর্য্যে রুদ্রকে প্রীত করিয়াছেন, সেই অর্জ্জুনকে প্রতিঘাত করা কাহার সাধ্য?’
“হে মহারাজা বীরপ্রধান মহাবীর কর্ণ কৃপাচার্যের সেই সমুদয় বাক্যশ্রবণে নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে কহিতে লাগিলেন, ‘হে কৃপাচাৰ্য্য! যথার্থ বীরপুরুষেরা বর্ষাকালীন জলধরের ন্যায় নিরন্তর গর্জ্জন এবং ক্ষিতিরোপিত বীজের ন্যায় আশু ফল প্রদান করিয়া থাকেন। সমধুরন্ধর বীরগণের সমরাঙ্গনে আত্মশ্লাঘা করা কিছুমাত্র দোষাবহ নহে। যে ব্যক্তি যে ভারবহনে মনে মনে দৃঢ় যত্ন করে, দৈবই তাহার সেই বিষয়ে সাহায্য প্রদান করেন। আমি মনে যাহা কল্পনা করি, তাহা কার্য্যেও পরিণত করিয়া থাকি। হে বিপ্র! আমি যদি বৃষ্ণিগণের সহিত কৃষ্ণসহায় পাণ্ডবগণকে বিনষ্ট করিয়া গৰ্জন করি, তাহাতে তোমার কি ক্ষতি হইবে? দূরদর্শী বীরগণ শারদ জলধরের ন্যায় কখনই বৃথা গর্জ্জন করেন না। তাঁহারা স্বীয় সামর্থ্যানুসারে গৰ্জন করিয়া থাকেন। হে গৌতম! আমি আজ রণে যত্নবান কৃষ্ণ ও ধনঞ্জয়কে পরাজিত করিতে সমর্থ হইব বলিয়াই গৰ্জন করিয়াছি। তুমি অবিলম্বেই আমার গর্জ্জনের ফল দর্শন করিবে। আমি আজ রণস্থলে কৃষ্ণসহায় পাণ্ডুতনয়দিগকে বৃষিগণের সহিত নিহত করিয়া দুর্য্যোধনকে নিষ্কণ্টকে পৃথিবী প্রদান করিব।’
“কৃপাচার্য্য কহিলেন, ‘হে কর্ণ! আমি তোমার এই স্বেচ্ছাকৃত প্রলাপবাক্য গ্রাহ্য করিব না। তুমি সতত কৃষ্ণ, অর্জ্জুন ও ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরের নিন্দাবাদ করিয়া থাক; কিন্তু দেবতা, গন্ধর্ব্ব, যক্ষ, মনুষ্য, উরগ ও পক্ষিগণেরও অজেয় অর্জ্জুন ও বাসুদেব যাঁহাদের পক্ষ অবলম্বন করিয়াছেন, সেই পাণ্ডবগণের নিশ্চয়ই জয়লাভ হইবে। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ব্রাহ্মণপ্রিয়, সত্যবাদী, বদান্য, সত্যধর্ম্মনিরত, শিক্ষিতাস্ত্র, বুদ্ধিমান, কৃতজ্ঞ এবং পিতৃগণ ও দেবগণের অর্চনায় নিরত। উঁহার ভ্রাতৃগণও মহাবলপরাক্রান্ত, সৰ্বাস্তুবিশারদ, ধর্ম্মপরায়ণ, প্রাজ্ঞ, যশস্বী ও গুরুকার্য্য সাধনপরতন্ত্র। আর দেখ, ইন্দ্ৰসমবিক্রম, একান্ত অনুরক্ত, মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন, শিখণ্ডী, দুর্মুখপুত্র জনমেজয়, চন্দ্রসেন, রুদ্রসেন, কীৰ্ত্তিবর্ম্মা, ধ্রুব, ধর, বসুচন্দ্র, দামচন্দ্র, সিংহচন্দ্র; সুতেজন, গজানীক, তানীক, বীরভদ্র, সুদর্শন, শ্রুতধ্বজ, বলানীক, জয়ানীক, জয়প্রিয়, বিজয়, লব্ধলক্ষ্য, জয়া, রথবাহন চন্দ্রোদয়, কামরথ, সপুত্র বিরাট ও তাহার ভ্রাতৃসমুদয়, যমজ নকুল ও সহদেব, দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র, রাক্ষ ঘটোৎকচ, মহারাজ দ্রুপদ ও তাঁহার পুত্রগণ এবং অন্যান্য অনেক মহারথ সমরকার্য্যে তাঁহার সাহায্য করিতেছেন। অতএব উঁহার কিছুতেই ক্ষয় হইবে না। হে কর্ণ! ভীম ও অর্জ্জুন অস্ত্রবলে দেবতা, অসুর, মনুষ্য, যক্ষ, রাক্ষস, ভূত, ভুজগ ও কুঞ্জরপরিপূর্ণ এই সমুদয় পৃথিবী নিঃশেষিত করিতেও অসমর্থ নহেন। ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরও রোষপ্রদীপ্ত কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া এই পৃথিবী দগ্ধ করিতে পারেন। হে সূতনন্দন! অমিতপরাক্রম বাসুদেব যাঁহাদের যুদ্ধে সাহায্য করিবার নিমিত্ত বর্ম্ম পরিগ্রহ করিয়াছেন, তুমি তাঁহাকে কিরূপে সমরে পরাজিত করিবে? তুমি যে কৃষ্ণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবার বাসনা করিতেছ, ইহা নিতান্ত অন্যায়।
কৃপাচার্যের প্রতি কর্ণের কটুক্তি
“হে মহারাজ। মহাবীর কর্ণ কৃপাচার্য্যকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া হাস্যমুখে তাঁহাকে কহিলেন, ‘হে ব্ৰহ্মন! তুমি পাণ্ডবগণকে লক্ষ্য করিয়া যে সমস্ত কথা কহিলে, সকলই সত্য। তাঁহাদিগের ঐ সমস্ত ও অন্যান্য বহুতর সদগুণ বিদ্যমান আছে, সন্দেহ নাই। আর তাঁহারা যে দেবগণসমবেত দেবরাজ ইন্দ্র এবং সমুদয় দৈত্য, যক্ষ, গন্ধর্ব্ব, পিশাচ, উরগ ও রাক্ষসগণেরও অজেয়, তদ্বিষয়ে আমি অণুমাত্র সংশয় করি না। কিন্তু দেবরাজ আমাকে এই যে অমোঘ শক্তি প্রদান করিয়াছেন, আমি ইহার প্রভাবে পাণ্ডবগণকে পরাজিত করিতে পারি। এক্ষণে আমি তদ্বারা অর্জ্জুনকেই সংহার করিব। অর্জ্জুন বিনষ্ট হইলে অবশিষ্ট পাণ্ডবেরা কদাচ জয়লাভপূর্ব্বক এই পৃথিবী উপভোগ করিতে সমর্থ হইবে না। তাঁহারা বিনষ্ট হইলে এই সসাগরা ধরণী অনায়াসে কৌরবরাজ দুৰ্য্যোধনের বশবর্ত্তিনী হইবে। হে আচাৰ্য্য! সুনীতি বিস্তার করিলে সকল কাৰ্য্যই সুসিদ্ধ হইয়া থাকে; এই নিমিত্তই আমি আস্ফালন করিতেছি। তুমি ব্রাহ্মণ, বৃদ্ধ ও সংগ্রামকাৰ্য্যে অনিপুণ; বিশেষতঃ পাণ্ডবগণের প্রতি তোমার সাতিশয় পক্ষপাত আছে; এই নিমিত্ত তুমি আমাকে অবমাননা করিতেছ। যাহা হউক, যদি তুমি পুনরায় আমার প্রতি ঐরূপ অপ্রিয় বাক্য প্রয়োগ কর, তাহা হইলে আমি খড়্গদ্বারা তোমার জিহ্বা ছেদন করিব। হে নির্বোধ! তুমি কৌরবপক্ষীয় সেনাগণকে ভয় প্রদর্শনপূর্ব্বক পাণ্ডবদিগের স্তুতি করিতে বাসনা করিতেছ। অতএব এক্ষণে আমি যাহা বলিতেছি, শ্রবণ কর। দুৰ্য্যোধন, দ্রোণাচার্য্য, শকুনি, দুর্মুখ, জয়, দুঃশাসন, বৃষসেন, মদ্ররাজ, সোমদত্ত, ভূরিশ্রবা, অশ্বত্থামা, বিবিংশতি ও তুমি, তোমরা যে যুদ্ধে বর্ত্তমান রহিয়াছ, তথায় বিপক্ষ ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী হইলেও কি জয়লাভ করিতে পারে? ঐ সমুদয় কৃতাস্ত্র, স্বর্গলিপ্সু, ধর্ম্মপরায়ণ, যুদ্ধপারগ বীরগণ দেবগণকেও সমরে নিপাতিত করিতে পারেন; উঁহারা পাণ্ডবগণের নিধন ও কৌরবগণের বিজয়কামনায় বর্ম্মধারণপূর্ব্বক রণক্ষেত্রে অবস্থিত রহিয়াছেন। যাহা হউক, বিক্রমসম্পন্ন ব্যক্তিগণের জয়লাভ দৈবায়ত্ত। দেখ, মহাবাহু ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করিয়াছেন এবং সমধিক বলসম্পন্ন দেবগণেরও দুর্জ্জয় মহাবীর বিকর্ণ, চিত্রসেন, বাহ্লীক, জয়দ্ৰথ, ভূরিশ্ৰবা, জয়, জলসন্ধ, সুদক্ষিণ, রথীশ্রেষ্ঠ শল, বীৰ্য্যবান্ ভগদত্ত এবং অন্যান্য অসংখ্য মহাবীর সমরে পাণ্ডবগণের হস্তে নিহত হইয়াছেন। অতএব নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে, দৈবপ্রতিকূলতাই এই বিনাশের মূল কারণ। হে পুরুষাধম! তুমি যে নিরন্তর দুৰ্য্যোধনরিপু পাণ্ডবগণকে স্তব করিতেছ, তাহাদিগেরও ত’ সহস্র সহস্র বীরপুরুষ নিহত হইয়াছে। পাণ্ডব ও কৌরব এই উভয়পক্ষীয় সেনা ক্ষয়প্রাপ্ত হইতেছে। হে নরাধম! তুমি পাণ্ডবগণকে সতত বলবান্ বলিয়া জ্ঞান কর; কিন্তু আমি তাহাদের কিছুমাত্র প্রভাব দেখিতে পাই না। যাহা হউক, আমি দুৰ্য্যোধনের হিতার্থ পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিতে যথাশক্তি যত্ন করিব; কিন্তু জয়লাভ দৈবায়ত্ত।”