১৫৭. বকবধ পর্বাধ্যায়, একচক্রাপুরে রাক্ষসভীতি, রাক্ষসভয়ে ব্রাহ্মণের বিলাপ
সপ্তপঞ্চাশদধিকশততম অধ্যায়।
জনমেজয় কহিলেন, হে দ্বিজোত্তম! মুহারথ পাণ্ডুনন্দনগণ একচক্রায় বাস করিয়া কি কি কর্ম করিলেন, সবিশেষ কীর্তন করুন।
বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে নরনাথ! পাণ্ডবগণ একচক্ৰায় ব্রাহ্মণনিকেতনে দিবসের অল্পভাগমাত্র বাস করিতেন। অধিকাংশ সময় অনেকানেক সরিৎ, সরোবর, কানন ও অন্যান্য প্রদেশ সকল নিরীক্ষণপূর্বক ভিক্ষা করিয়া উদরপূর্তি করিতেন, এইরূপে তাহারা স্বীয় স্বীয় গুণগ্রাম দ্বারা ক্রমে ক্রমে নগরবাসী সমুদায় জনগণের পরম প্রিয় হইয়া উঠিলেন। পঞ্চভ্রাতা দিবাভাগে ভিক্ষা করিয়া সন্ধ্যাসময়ে জননীর নিকটে সমুদায় ভিক্ষালব্ধদ্রব্য সমর্পণ করিতেন। ভোজরাজদুহিতা সমস্ত ভক্ষবস্তু প্রথমতঃ ভাগদ্বয়ে বিভক্ত করিয়া এক ভাগ ভীমসেনকে প্রদান করিতেন এবং অন্য ভাগ পাক করিয়া পাঁচ অংশে বিভাগপূর্বক চারি ভাগ অপর পুল চতুষ্টয়কে প্রদান ও স্বয়ং একভাগ গ্রহণ করিতেন; এইরূপে মহাত্মা পাণ্ডবগণ তথায় বাস করিতে লাগিলেন।
একদা যুধিষ্ঠির, অর্জুন ও মাদ্রীনন্দনদ্বয় ভিক্ষার্থে গমন করিলেন, ঘটনাক্রমে বৃকোদর জননী-সমভিব্যাহারে আবাসে রহিলেন। তাহারা মাতাপুত্রে ব্রাহ্মণের নিকেতনে উপবিষ্ট আছেন, এমন সময়ে ব্রাহ্মণের অন্তঃপুরমধ্যে ঘোরতর ক্রন্দনধ্বনি সমুখিত হইল। সরলহৃদয়৷ দয়ার্জচিত্তা ভোজরাজদুহিতা সেই করুণরসোদ্দীপক ক্রন্দনশব্দ শ্রবণে সাতিশয় দুঃখিত হইয়া ভীমসেনকে কহিলেন, হে পুত্র! আমরা পাপাত্মা দুৰ্য্যোধনের অজ্ঞাতসারে এই ব্রাহ্মণনিকেতনে পরমসুখে বাস করিতেছি; ব্রাহ্মণ আমাদিগকে যৎপরোনাস্তি স্নেহ ও সমাদর করেন; তন্নিমিত্ত আমি ব্রাহ্মণের উপকার কি প্রকারে করিব, অনুক্ষণ এই চিন্তা করি। যে পুরুষ উপকারী ব্যক্তির প্রত্যুপকার করে এবং যে পুরুষ অন্যে যে পরিমাণে উপকার করে, তদপেক্ষা অধিক পরিমাণে উপকার করিয়া তাহার প্রতিশোধ দেয়, সেই যথার্থ পুরুষ; এক্ষণে স্পষ্টই বোধ হইতেছে যে, ব্রাহ্মণের কোন মহৎদুঃখ উপস্থিত হইয়াছে; এই সময়ে উহার সাহায্য করিলে যথেষ্ট উপকার করা হয়। ভীমসেন কহিলেন, মাতঃ! ব্রাহ্মণের কি দুঃখ উপস্থিত হইয়াছে এবং ঐ দুঃখের কারণই ঝ কি সবিশেষ জানিয়া আইস; যাহাতে ব্রাহ্মণের উপকার হয়, অতি দুষ্কর হইলেও আমি অহা সাধন করিব।
দুই জনে এইরূপ কথোপকথন করিতেছেন, এমন সময়ে পুনর্বার ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণপত্নীর ক্রন্দনধ্বনি তাঁহাদের কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইল। তখন কুন্তী বদ্ধবৎসা সৌরভেয়ীর ন্যায়শ্রুতবেগে ব্রাহ্মণের অন্তঃপুরে প্রবিষ্ট হইলেন এবং দেখিলেন যে, ব্রাহ্মণ স্বীয় পত্নী, দুহিতা ও পুত্র সমভিব্যাহারে অধোবদনে উপবেশন করিয়া বিলাপ করিতে করিতে কহিতেছেন, হায়! আমার এই পরাধীন জীবনে ধিক্! ইহা নিতান্ত অসার, অনর্থক ও দুঃখের নিদানভুত। এতদিনের পর বুঝিলাম জীবিত থাকিয়া কিছুমাত্র সুখ নাই; প্রত্যুত, যৎপরোনাস্তি দুঃখভোগ করিতে হয়। দেখ, আত্মই ধৰ্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গ ভোগ করেন। এই তিনের অভাবেই অনন্ত দুঃখ ঘটে। কেহ কেহ্ন এই ত্রিবর্গের অভাবের নাম মোক্ষ কহেন। আমার সেই মোক্ষ লাভ করিবার কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। অর্থপ্রাপ্তি নরক ভোগের প্রধান কারণ ও অর্থ লাভাকাঙ্খায় যৎপরোনাস্তি দুঃখ আছে; অর্থলাভ তদপেক্ষা, দুঃখদায়ক। আর যদি অর্থের উপর একবার স্নেহ জন্মে, তাহা হইলে অর্থনাশে দুঃখের আর পরিসীমা থাকে না। যাহা হউক, এখন কি করিয়া এই আপদ হইতে উত্তীর্ণ হইব; পুত্রকলত্ৰসমভিব্যাহারে পলায়ন করিয়া নিঃশঙ্ক প্রদেশে বাস করি। প্রিয়ে! তুমি জান, আমি ইতিপূৰ্বেই এই ভয়ে স্থান পরিত্যাগ করিতে উদ্যত হইয়াছিলাম; তুমি তাহাতে অসম্মত হইলে; আমি পলায়ন করিবার জন্য তোমাকে বারংবার কহিলাম, তুমি কোনমতেই আমার কথা শুনিলে না; তখন তুমি কহিলে যে, ইহা আমার পৈতৃক স্থান, ইহাতে আমার পিতা ও আমি জন্মগ্রহণ করিয়া বর্ধিত হইয়াছি। হে দুরাগ্রহে! তোমার পিতা বহুকাল বৃদ্ধ হইয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন, অন্যান্য বান্ধবগণও পরলোক প্রাপ্ত হইয়াছেন, তবে আর এখানে বাস করিয়া এ যন্ত্রণা, ভোগ করিবার আবশ্যকতা কি? তুমি তৎকালে বন্ধু পরিত্যাগের অয়ে আমার কথা শুনিলে না, কিন্তু এক্ষণে এই সাতিশয় দুঃখকর বন্ধুবিনাশ সমুপস্থিত হইয়াছে, এখন কি করিবে? অথবা আমারই বিনাশ উপস্থিত হইআছে, যেহেতু আমি স্বয়ং জীবিত থাকিয়া কি প্রকারে নৃশংসের ন্যায় স্বচক্ষে আত্মীয় বিনাশ দেখিব। দেখ, তুমি আমার সহধর্মিণী; তুমি দমগুণসম্পন্না, স্নেহশালিনী ও পরম বন্ধু। আমার পিতামাত} তোমাকে আমার গার্হস্থ্যভাগিনী করিয়াছেন। আমি বেদবিধানানুসারে মন্ত্রোচ্চারণপূর্বক তোমার পাণিগ্রহণ করিয়াছি; তুমি কুলশীলসম্পন্না, বিশেষতঃ অপত্য প্রসব করিয়াছ; আমি কি বলিয়া আপনার জীবন রক্ষার্থে তোমাকে পরিত্যাগ করিব। আর এই অপ্রাপ্ত বয়স্ক, অজাতশ্মশ্রু, বালক পুত্রকেও আমি কোনমতে পরিত্যাগ করিতে পারিব না। আরও দেখ, ভগবান্ বিধাতা যে মদীয় কন্যাকে ভণ্ডুলাভাৰ্থ আমার নিকটে ন্যাসম্বরূপ রাখিয়াছেন, যদ্বারা আমি পিতৃগণ সমভিব্যাহারে দৌহিব্ৰজ লোক লাভ করিবার প্রত্যাশা করিতেছি, সেই কন্যাকে আমি স্বয়ং উৎপাদন করিয়া কি প্রকারে পরিত্যাগ করি। কেহ কেহ কন্যা অপেক্ষা পুত্রকে অধিক স্নেহ করিয়া থাকে, কাহারও বা পুত্র অপেক্ষা কন্যাতে অধিক স্নেহ জন্মে; কিন্তু আমি পুত্র ও কন্যা উভয়কেই সমান স্নেহ করিয়া থাকি। কন্যা প্রসবদ্বারা জগৎ রক্ষা করে, অতএব আমি কি করিয়া আপনার প্রাণরক্ষার নিমিত্ত সেই অপাপা বালাকে পরিত্যাগ করিব। আমি স্বয়ং প্রাণ পরিত্যাগ করিলেও পরলোকে অনুতাপ করিতে হইবে, যেহেতু আমি ইহাদিগকে পরিত্যাগ করিলে পর অবশ্যই ইহারা মৃত্যুগ্রাসে পতিত হইবে। আমি উভয়সঙ্কটে পতিত হইয়াছি। দেখ, যদি ইহাদিগের একজনকে পরিত্যাগ করি, তাহা হইলে নিতান্ত নিষ্ঠুরের কাৰ্য্য করা হয়, আর যদি স্বয়ং প্রাণত্যাগ করি, তাহা হইলেও আমা ব্যতিরেকে ইহারা সকলেই কালগ্রাসে পতিত হইবে। হায়! কি কষ্ট! অদ্য আমি সবান্ধবে কি দুর্দশাগ্রস্তু হইলাম! আমাকে ধিক্! ইহাদের সমভিব্যাহারে প্রাণত্যাগ করাই আমার পক্ষে শ্রেয়ঃ; জীবিত থাকিয়া কিছুমাত্র লাভ নাই।