১৫৬তম অধ্যায়
নারদকর্ত্তৃক বৃক্ষ-পবনের বিবাদ সংঘটন
“হে ধৰ্ম্মরাজ: তপোধনাগ্রগণ্য [তপস্বিশ্রেষ্ঠ] নারদ শাল্মলীকে এই কথা বলিয়া বায়ুর নিকট গমনপূৰ্ব্বক কহিলেন, সমীরণ! হিলাময় পৰ্ব্বতের উপর এক নিবিড়ছায়াসমন্বিত বহুশাখাপরিশোভিত বিপুল শাল্মলীবৃক্ষ আছে। সে তোমাকে অবজ্ঞা করিয়া তোমার প্রতি যেরূপ কটুবাক্য প্রয়োগ করিয়াছে, তাহা তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করা আমার উচিত নহে। আমি তোমাকে বলবানদিগের অগ্রগণ্য, গৌরবান্বিত ও কৃতান্ততুল্য ক্রোধপরায়ণ বলিয়া অবগত আছি।’
“দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিলে ভগবান সমীরণ শাল্মলীর প্রতি যারপরনাই ক্রোধাবিষ্ট হইয়া তাহার নিকট আগমনপূর্ব্বক কহিলেন, ‘শাল্মলে! তুমি মহাত্মা নারদের নিকট আমার নিন্দা করিয়াছ। আমি পবন। অবিলম্বেই তোমাকে স্বীয় প্রভাব ও পরাক্রম প্রদর্শন করিব। আমি তোমার পরাক্রমের বিষয় বিলক্ষণ অবগত আছি। লোকপিতামহ ভগবান্ ব্রহ্মা প্রজাসৃষ্টিকালে তোমাকে অবলম্বনপূর্ব্বক বিশ্রাম করিয়াছিলেন বলিয়াই আমি তোমার প্রতি প্রসন্ন হইয়া তোমাকে রক্ষা করিয়া থাকি। তুমি আত্মবীর্য্যপ্রভাবে রক্ষিত হইতেছ, কদাচ এরূপ বিবেচনা করিও না। যাহা হউক, যখন তুমি আমাকে সামান্য লোকের ন্যায় অবমাননা করিয়াছ, তখন আমি তোমাকে এরূপ বল প্রদর্শন করিব যে, তুমি বিশেষরূপে আমার প্রভাব অবগত হইবে।
“ভগবান্ পবন এইরূপে ক্রোধ প্রকাশ করিলে শাল্মলী সহাস্যমুখে তাহাকে কহিল, ‘সমীরণ! ক্রুদ্ধ হইয়া সাধ্যানুসারে আমার প্রতি পরাক্রম প্রকাশ কর। তোমার ক্রোধে আমার কি হইতে পারে? তোমা হইতে আমার কিছুমাত্র ভয়ের সম্ভাবনা নাই, আমি তোমা অপেক্ষা বলবান্। যাহাদের বুদ্ধিবল থাকে, তাহাদিগকেই যথার্থ বলবান্ বলিয়া নির্দেশ করা যায়। কেবল শারীরিক বলসম্পন্ন ব্যক্তিরা কখন বলবান্ বলিয়া গণনীয় হইতে পারে না।’
পবনের শাল্মলী-আক্রমণে উদ্যোগ
“শাল্মলী এই বলিয়া বায়ুর প্রতি অবজ্ঞা করিলে সমীরণ ‘আমি কল্যই তোমার প্রতি পরাক্রম প্রকাশ করিব’ বলিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে রজনী সমাগত হইল। তখন শাল্মলী বৃক্ষ মনে মনে পবনের অভিসন্ধি ও তদপেক্ষা আপনার দৌর্ব্বল্য বিবেচনা করিয়া কহিতে লাগিল, আমি দেবর্ষি নারদের নিকট যাহা কহিয়াছি, তৎসমুদয়ই মিথ্যা। আমি সমীরণের পরাক্রম কখনই সহ্য করিতে পারিব না। তপোধনাগ্রগণ্য নারদ যাহা কহিয়াছেন, কিছুই মিথ্যা নহে। বায়ু যথার্থই অতিশয় পরাক্রমশালী। যাহা হউক, আমি অন্যান্য বৃক্ষ হইতে দুর্ব্বল বটে, কিন্তু আমার তুল্য বুদ্ধিমান্ বনস্পতি আর কেহই নাই। অতএব আমি বুদ্ধিবল আশ্রয় করিয়াই সমীরণের ভয় হইতে পরিত্রাণ লাভ করিব। এক্ষণে আমার যেরূপ কৌশল অবলম্বন করিতে ইচ্ছা হইতেছে, যদি সমুদয় বৃক্ষ সেইরূপ কৌশল আশ্রয় করিয়া এই অরণ্যে অবস্থিতি করে, তাহা হইলে পবনের ক্রোধনিবন্ধন তাহাদের আর কিছুমাত্র শঙ্কা থাকে না। কিন্তু সমুদয় পাপীদের বুদ্ধি বালকদিগের ন্যায়। সমীরণ ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাদিগকে যেরূপে উন্মূলিত করে, তাহা তাহারা কিছুমাত্র অবগত হয় না। ”