১৫৫তম অধ্যায়
শাল্মলীর গৰ্ব্ব প্রকাশে দেবর্ষির রুক্ষবাক্য
“নারদ কহিলেন, “হে বৃক্ষ! এক্ষণে নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে। যে, তুমি মহাবলপরাক্রান্ত বায়ুর সহিত মিত্রতা সংস্থাপন করিয়াছ বলিয়াই তিনি পরম-আত্মীয়ের ন্যায় তোমার রক্ষণাবেক্ষণে যত্নবান্ আছেন। এই ভূমণ্ডলে বায়ুবেগে ভগ্ন হইতে পারে না, এরূপ পর্ব্বত, গৃহ বা বৃক্ষ আমি কদাচ নিরীক্ষণ করি নাই; তুমি বন্ধুত্বনিবন্ধনবশতঃ বায়ুকর্ত্তৃক শাখাপল্লবের সহিত রক্ষিত হইতেছ বলিয়াই নিৰ্বিঘ্নে অবস্থান করিতেছ।’
“বৃক্ষ কহিল, ‘ভগবন্! সমীরণ আমার সুহৃৎ বা বিধাতা নহেন যে, তিনি অনুগ্রহ করিয়া আমায় রক্ষা করিবেন। আমার তেজ ও বল তাঁহার অপেক্ষা অধিক, তাঁহার বল আমার বলের অষ্টাদশ অংশের একাংশমাত্র। তিনি বৃক্ষপৰ্ব্বতাদি ভিন্ন [বিদারণ] করিয়া মহাবেগে আগমন করিলেও আমি স্বীয় বলপ্রভাবে তাঁহাকে স্তম্ভিত করিয়া রাখি। এইরূপে আমার নিকট তিনি বারংবার প্রতিহত হইয়া গিয়াছেন। এক্ষণে তাঁহাকে রোষাবিষ্ট দেখিলেও আর আমার কিছুমাত্র ভয় উপস্থিত হয় না।
“নারদ কহিলেন, ‘হে বৃক্ষ! তুমি অতি অজ্ঞের ন্যায় কথা কহিতেছ। বায়ুর তুল্য বলশালী আর কেহই নাই। তোমার কথা দূরে থাকুক-ইন্দ্র, যম, কুবের ও বরুণ ইঁহারা কেহই বায়ুর তুল্য বলশালী নহেন। এই ভূমণ্ডলে যেসমস্ত প্রাণী বিচরণ করিতেছে, ভগবান বায়ু উহাদের সকলেরই প্রাণপ্রদ। ইনি শান্তভাবে সৰ্ব্বত্র বিস্তীর্ণ হইয়া সকল প্রাণীকে জীবিত রাখিয়াছেন। ইনি যদি অশান্তপ্রকৃতি অবলম্বন করেন, তাহা হইলে সকলকেই জীবনের প্রত্যাশা পরিত্যাগ করিতে হয়। অতএব তুমি যে পরমপূজ্য জগৎপ্রাণ সমীরণকে সম্মান কলিতেছ না, ইহাতে তোমার নির্বুদ্ধিতা ব্যতীত আর কিছুই প্রকাশ পাইতেছে না, তুমি অতি অসার; এক্ষণে আপনার দুর্বুদ্ধিবলে কেবল বাচালতা প্রকাশ ও ক্রোধাদির বশীভূত হইয়া মিথ্যাবাক্য প্রয়োগ করিতেছ। তোমার নিকট বায়ুর নিন্দাবাদ শ্রবণ করিয়া আমি যারপরনাই ক্রোধাবিষ্ট হইয়াছি, অতএব এক্ষণে বায়ুর সমক্ষে গমন করিয়া তোমার এই অহঙ্কার প্রকাশ করিয়া দিব। চন্দন, স্যন্দন [তিনিশ বৃক্ষ], তাল, দেবদারু, বেতস ও বকুল প্রভৃতি মহাবল পাদপসমুদয় বায়ুর প্রতি কদাচ, এইরূপ কটুবাক্য প্রয়োগ করে নাই। তাহারা আপনাদিগের ও বায়ুর বলের তারতম্য বিলক্ষণ অবগত আছে, এই নিমিত্তই তাহারা সতত সমীরণকে নমস্কার করিয়া থাকে। তুমি কেবল মোহপ্রভাবে বায়ুর অনন্ত বল অবগত হইতে সমর্থ হইতেছ না। যাহাই হউক, এক্ষণে আমি এই কথা প্রকাশ করিবার নিমিত্ত পবনের নিকট চলিলাম।”