১৫৫. ভীম-হিড়ম্বা-মিলন, ভীমতনয় ঘটোৎকচের জন্ম
পঞ্চপঞ্চাশদধিকশততম অধ্যায়।
বৈশম্পায়ন কহিলেন,—হে রাজন্! ভীমপরাক্রম ভীমসেন হিড়িম্বাকে আপনাদিগের সমভিব্যাহারে আসিতে দেখিয়া তাহাকে কহিলেন, রাক্ষসগণ মোহিনী মায়া বিস্তার করিয়৷ বৈরনিৰ্যাতন করে; অতএব রে নিশ্বচরি! তোর আর আমাদের সঙ্গে থাকা উচিত নহে, তুইও স্বীয় সহোদরের পশ্চাৎ পশ্চাৎ শমনভবনে যাত্রা কর। ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির ভীমসেনকে ক্রুদ্ধ দেখিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা করত কহিলেন, হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! স্ত্রীহত্যা করিও না; হে পাণ্ডব! শরীররক্ষা অপেক্ষা ধর্মরক্ষা শ্রেষ্ঠ। সেই দুরাত্মা হিড়িম্বই আমাদিগকে বধ করিবার মানসে আসিয়াছিল, তাহাকে ত তুমি বিনষ্ট করিয়াছ, এ তাহার ভগিনী; এ ক্রুদ্ধ হইলেই বা আমাদের কি করিতে পারিবে।
হিড়িম্বা ভীমের ক্রোধ দর্শনে সাতিশয় বিষণ্ণ হইয়া যুধিষ্ঠির সমক্ষে কুন্তীকে কৃতাঞ্জলিপুটে অভিবাদনপূর্বক কহিতে লাগিল, অৰ্য্যে! অবলাজন অনঙ্গশরে জর্জরিত হইলে কিরূপ দুঃখভোগ করে, তাহা অপিনি সবিশেষ অবগত আছেন; হে মাতঃ! আমি ভীমসেনকে নিরীক্ষণ করিয়া অবধি সেই যন্ত্রণা ভোগ করিতেছি। আমি সুখপ্রত্যাশায় এতক্ষণ অপেক্ষা করিয়াছিলাম; এক্ষণে আমার সেই সুখসম্ভোগের সময় সমুপস্থিত হইয়াছে, এখন আমাকে বঞ্চিত করা নিতান্ত অবিধেয়; আরও দেখুন, আমি স্বকীয় পাতিব্ৰত্যধর্ম ও বন্ধুবান্ধব প্রভৃতি সমুদায় পরিত্যাগ করিয়া আপনার পুত্রকে পতিত্বে বরণ করতঃ তাহার শরণাপন্ন হইয়াছি। হে যশস্বিনি! যদি সেই মহাবলপরাক্রান্ত পুরুষশ্রেষ্ঠ কিম্বা আপনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেন, তাহা হইলে নিশ্চয়ই প্রাণত্যাগ করিব, অতএব আপনি আমাকে মূঢ় বলিয়া হউক, বা ভক্ত বলিয়া হউক, কিম্বা অনুগত বলিয়া হউক, অনুগ্রহ করিয়া যাহাতে ভীমসেন আমার পাণিগ্রহণ করেন, তাহা বিধান করুন। আমি সেই দেবরূপী বৃকোদরকে লইয়া যথেচ্ছ গমন করিব এবং পুনর্বার আপনাদিগের সমীপে, অনিয়ন করিয়া দিব। আপৎকালে আপনার আমাকে স্মরণ করিলে আমি তদ্দণ্ডে আসিয়া উপস্থিত হইব এবং আপনাদিগকে বিপদ হইতে পরিত্রাণ করিব। আপনারা শীঘ্রগমনে অভিলাষ করিলে আমি স্বীয় পৃষ্ঠে করিয়া আপনাদিগকে লইয়া যাইব। আপনারা অনুগ্রহ করিয়া ভামের সহিত আমার মিলন করিয়া দিন। আপদ হইতে পরিত্রাণ পাইবার নিমিত্ত যে কোন প্রকারে হউক প্রাণধারণ করা কর্তব্য, কিন্তু ধাৰ্মিক ব্যক্তি কি বিপদ, কি সম্পদ সর্বকালেই স্বকৃত অঙ্গীকার প্রতি পালন করিয়া থাকেন; আপৎকালেই ধাৰ্ম্মিকগণের ধর্মের বিঘ্ন হইবার সম্পূর্ণ সম্ভাবনা; অতএব যিনি অপৎসময়েও স্বীয় ধর্ম পরিত্যাগ না করেন, তিনিই যথার্থ ধাৰ্মিক; লোকে পুণ্যবলেই জীবিত থাকে; পুণ্যই প্রাণধারণের একমাত্র উপায়; যে কাৰ্য্য করিলে ধর্মানুষ্ঠান করা হয়, তাহা কাহারও পক্ষে দূষণাবহ নহে।
ধর্মাত্মা যুধিষ্ঠির হিড়িম্বার বাক্য শ্রবণানন্তর তাহাকে কহিলেন, হে সুমধ্যমে! তুমি যাহা কহিলে ইহা যথার্থ বটে, তুমি সূর্যাস্তের প্রাক্কালে কৃতস্নানাত্নিক ও কৃতকৌতুকমঙ্গল ভীমসেনকে ভজনা করিও; দিবাভাগে উহাকে লইয়া যথেচ্ছ৷ গমন করিয়া স্বচ্ছন্দে বিহারাদি করিও; কিন্তু রজনীযোগে আমদের সমীপে আনয়ন করিয়া দিতে হইবে। বৃকোদর যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণানন্তর “তথাস্তু” বলিয়া অনুমোদন করিলেন এবং হিড়িম্বাকে কহিলেন,–হে রাক্ষসি! আমি জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অজ্ঞানুসারে তোমার পাণিগ্রহণ করিব যথার্থ বটে, কিন্তু যতদিন পর্যন্ত তোমার গর্ভে সন্তান না জন্মিবে, ততদিন তোমার সহবাস করিব।
মনোবেগগামিনী হিড়িম্বা ভীমের বাক্য শ্রবণ করিয়া ‘যে আজ্ঞা’ বলিয়া স্বীকার করিল এবং তাহাকে লইয়া আকাশমার্গে গমন করিল। সে পরম রমণীয় রূপলাবণ্য প্রদর্শন ও সুমধুর বাক্য দ্বারা তাহার মনোহরণপূর্বক কখন বা দেবগণের আবাসস্থান মৃগপক্ষীসংঙ্কীর্ণ রমণীয় শৈলশৃঙ্গে, কখন সুপুষ্পিত দ্রুমসমাকীর্ণ বনদুর্গে, কখন প্রফুল্ল কমলবনযুক্ত মনোহর সরোবরে, কখন বৈদূর্যসিকতাময় দ্বীপসমূহে, কখন কাননসুশোভিত সুশীতল জলপরিপূর্ণ গিরিনদীতে, কখন পুষ্পিত মলতাচ্ছাদিত কোকিলকুলকূজিত কাননকুঞ্জে, কখন মণিকাঞ্চনাঢ্য সাগরপ্রদেশে, কখন পবিত্র দেবারণ্যে, কখন গুহ্যকগণের নিবাসস্থানে, কখন বা তাপসদিগের অশ্রমে, স্বচ্ছন্দে বিহার করিতে লাগিল। কিয়দ্দিন এইরূপ বিহার করিতে করিতে ভীমের সহযোগে হিড়িম্বা গর্ভবতী হইল। রাক্ষসীর। গর্ভধারণমাত্রেই সন্তান প্রসব করে। হিড়িম্বা গর্ভধারণ করিয়াই এক বীরূপাক্ষ মহাবল পরাক্রান্ত, মহাভূজ, মহাধনুর্ধর, অমানুষ পুত্র প্রসব করিল। ঐ পুত্রের মুখ অতি বিশাল, কর্ণ গর্দভকর্ণের ন্যায় দীর্ঘ, ওষ্ঠদ্বয় তাম্রবর্ণ, দশন সকল সুতীক্ষ্ণ, নাসিকা দীর্ঘ ও বক্ষঃস্থল সুবিস্তীর্ণ। পুত্র মাতৃগর্ভ হইতে বিনির্গত হইবামাত্র যৌবনপ্রাপ্ত ও সৰ্বাস্ত্রবিশারদ হইল এবং সত্বরে পিতামাতাকে প্রণাম করিয়া তাহাদের পদগ্ৰহণ করিল। তাহার পুত্রের নাম ঘটোৎকচ রাখিলেন। ঘট শব্দের অর্থ করিমস্তক ও উৎকোচ শব্দের অর্থ কেশশূন্য; উহার মস্তক করিমুণ্ডের ন্যায় কেশশূন্য ছিল বলিয়া ঐ প্রকার নামধেয় হইল। ঘটোৎকচ পাণ্ডবদিগের প্রতি নিতান্ত অনুরক্ত ও একান্ত ভক্তিমান্ ছিল; তাহারাও তাহার প্রতি যৎপরোনাস্তি স্নেহ প্রকাশ করিতেন। নিশাচরী হিড়িম্বা আপনার স্বামীসহবাসের সময় অতীত বুঝিয়া মাতৃসমবেত পাণ্ডবগণকে সম্ভাষণপূর্বক স্বস্থানে প্রস্থান করিল। মহাবীর ঘটোৎকচও প্রস্থানকালে বিনয়গর্ভবচনে “ভৃত্য আপনাদের কাৰ্যকালে উপস্থিত হইবে” বলিয়া গুরুজনের নিকটে বিদায় লইয়া উত্তরদিকে গমন করিল। মহারথ ঘটোৎকচ অপ্রতিমবীর্য্য কর্ণের সহিত সংগ্রামনিমিত্ত ইন্দ্রের অংশে পাণ্ডুবংশে জন্ম গ্রহণ করেন।