১৫৪তম অধ্যায়
ভীমকর্ত্তৃক সৌগন্ধিক-পদ্মচয়ন
ভীমসেন কহিলেন, “হে রাক্ষসগণ! আমি মহারাজ পাণ্ডুর নন্দন, যুধিষ্ঠির-অনুজ, আমার নাম ভীমসেন। আমি ভ্রাতৃগণের সহিত বদরীতীর্থে আগমন করিয়াছি; একদা প্ৰিয়তমা পাঞ্চালনন্দিনী সেই আশ্রমে একটি সৌগন্ধিক-পুষ্প অবলোকন করিয়াছিলেন। ঐ পুষ্পটি এই স্থান হইতেই বায়ুবেগসহকারে তথায় নীত হইয়াছিল। তিনি তদবধি সেইরূপ অধিকসংখ্যক পুষ্প প্রাপ্ত হইবার নিমিত্ত সমুৎসুক হইয়াছেন। আমি তাহার প্রিয়কারী, এক্ষণে হার অভিলষিত পুষ্পচয়ন করিবার নিমিত্ত এই স্থানে আগমন করিয়াছি।”
রাক্ষসগণ কহিলেন, “হে ভীষণ! এই সরোবর যক্ষরাজের অতিপ্রিয় ক্রীড়াস্থান, কোন মর্ত্যধর্ম্ম এ স্থানে বিচরণ করিতে সমর্থ হয় না। দেব, দেবর্ষি, যক্ষ, গন্ধর্ব্ব ও অপ্সরাগণ যক্ষরাজকে আমন্ত্রণ না করিয়া ইহার জলপান বা এই স্থানে বিচরণ করেন না। যে-কোন দুর্ব্বত্ত ধনেশ্বরকে অবমাননা করিয়া অন্যায়াচরণপূর্ব্বক এই স্থানে বিচরণ করিতে বাসনা করে, তাহাকে কালকবলে প্রবিষ্ট হইতে হয়, সন্দেহ নাই। তুমি যদি কুবেরকে অনাদর করিয়া বলপূর্ব্বক সৌগন্ধিক হরণ করিতে উৎসুক হও, তাহা হইলে কি প্রকারে আপনাকে ধর্ম্মরাজের ভ্রাতা বলিয়া পরিচয় প্রদান করিতেছ? হে বৃকোদার? এক্ষণে যক্ষরাজকে আমন্ত্ৰণ করিয়া ইহার জলপান ও পদ্ম আহরণ কর; নতুবা উহার প্ৰতি নেত্রপাতও করিও না।”
ভীমসেন কহিলেন, “হে রাক্ষসগণ! এক্ষণে ধনেশ্বরকে এ স্থানে অবলোকন করিতেছি না, অতএব কাহাকে আমন্ত্রণ করিব? ফলতঃ সাক্ষাৎকার হইলেও তাঁহার নিকট প্রার্থনা করিতে পারিব না। কারণ ভূপালগণের ঈদৃশ সনাতন ধর্ম্ম প্রচলিত আছে যে, তাহারা কুত্ৰাপি যাঞা করেন না। আমি কোনপ্রকারে ক্ষত্রধর্ম্ম পরিত্যাগ করিতে অভিলাষ করি না, বিশেষতঃ এই সরোবর মহাত্মা কুবেরের ভবনে উৎপন্ন হয় নাই, ইহা পর্ব্বতনির্ঝরে জন্মিয়াছে, অতএব ইহাতে কুবেরের যেরূপ, সকল লোকেরই সেইরূপ অধিকার আছে। অতএব এবংবিধ স্থলে কোন ব্যক্তি কাহার নিকটে যাত্রা করিয়া থাকে?”
কুবেরানুচরসহ ভীমের যুদ্ধ
মহাবল ভীমসেন রাক্ষসগণকে এইরূপ প্ৰত্যুত্তর প্রদান করিয়া সরোবরে অবগাহন করিলেন। রাক্ষসগণ চতুর্দ্দিক হইতে ভৎসনাপূর্ব্বক নিষেধ করিতে লাগিল, কিন্তু ভীমপরাক্রম ভীমসেন তাহাতে কৰ্ণপাতও করিলেন না। অনন্তর রাক্ষসগণ রোষসহকারে “ভীমসেনকে ধর, বধ কর, ছেদন কর, পাক কর, ভক্ষণ কর” বলিয়া উদ্যতশস্ত্ৰে বিবৃত্ত-নেত্রে [ক্ৰোধে চক্ষু পকাইতে পাকাইতে] দ্রুত পদে বৃকোদরকে যেমন আক্রমণ করিল, অমনি তিনি কাঞ্চনপট্টমণ্ডভ যমদণ্ডতুল্য গদা গ্রহণপূর্ব্বক ‘তিষ্ঠ তিষ্ঠ’ বলিয়া, প্রচণ্ডবেগে তাহাদের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। তাহারাও জিঘাংসাপরবশ হইয়া তোমার, পট্টিশ প্রভৃতি বিবিধ আয়ুধ-সহকারে সহসা ভীমসেনকে পরিবেষ্টন করিল। ভীমসেন কুন্তীগর্ভে পবনের ঔরসে উৎপন্ন, শূর, তরস্বী, অরাতিগণের কালান্তক; সত্য, ধর্ম্ম ও পরাক্রমে অনুরক্ত এবং দুৰ্দ্ধৰ্ষ, সুতরাং অনায়াসে শাত্ৰবগণের শরজাল সংহারপূর্ব্বক সেই পুষ্করিণীসমীপে তাহাদিগের শত শত যোদ্ধাকে মৃত্যুমুখে প্রবেশিত করিলেন।
সমরপরাজিত অনুচরহণের পলায়ন
ক্রোধবশ রাক্ষসগণ ভীমসেনের বিদ্যাবল ও বাহুবীৰ্য্যের পরিচয় প্রাপ্ত এবং তাহা সহ্য করিতে অসমর্থ হইয়া সহসা সমরপরাঙ্মুখ হইল। ভীমসেন তাহাদিগকে এরূপ আঘাত করিয়াছিলেন যে, তাহারা ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ও বিচেতন্যপ্ৰায় হইয়া পরিশেষে শূন্যপথ অবলম্বনপূর্ব্বক কৈলাস-শৃঙ্গে পলায়ন করিল। যেমন দেবরাজ দানবগণকে পরাক্রমে পরাজিত করিয়াছিলেন, তদ্রূপ ভীমসেন নিশাচরগণকে অপসারিত করিয়া সরোবরে অবগাহনপূর্ব্বক স্বেচ্ছানুসারে সরোরুহ [সৌগন্ধিক পদ্ম] গ্রহণ করিতে লাগিলেন এবং তাহারা পীযুষসম সলিল পান করিয়া সমধিক তেজস্বী হইয়া উঠিলেন।
এদিকে ভীমবলতাড়িত রাক্ষসগণ সাভয়চিত্তে ধনেশ্বরের সমীপে আগমনপূর্ব্বক ভীমসেনের বল-বীৰ্য্য প্রভৃতি সমুদয় বৃত্তান্ত আনুপূর্ব্বিক বর্ণন করিল। কুবেরদেব সেই সকল কথা শ্রবণ করিয়া সহাস্য-বদনে কহিলেন, “হে রক্ষিগণ! ভীমসেন পাঞ্চালকুমারীর নিমিত্ত কমল চয়ন করিতেছেন; আমি তাহা অবগত হইয়াছি; অতএব তিনি স্বচ্ছন্দে সৌগন্ধিক গ্ৰহণ করুন।” ক্রোধবশ রাক্ষসগণ অনুজ্ঞাত হইয়া ভীমসমীপে গমনপূর্ব্বক দেখিলেন, তিনি একাকী সেই সরোবরে সুখে সঞ্চরণ করিতেছেন।