১৫৩তম অধ্যায়
মৃতের পুনর্জ্জীবন—গৃধ্র-জম্বুকসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! আপনি কি কখন কোন মনুষ্যকে প্রাণত্যাগপূৰ্ব্বক পুনরুজ্জীবিত হইতে দর্শন বা শ্রবণ করিয়াছেন?”
ভীষ্ম কহিলেন, “বৎস! আমি এই উপলক্ষে গৃধ্র-জম্বুকসংবাদ নামক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূৰ্ব্বকালে নৈমিষারণ্যনিবাসী এক ব্রাহ্মণ বহুকষ্টে এক বিশালনেত্র সুকুমার কুমার লাভ করিয়াছিলেন। ঐ বালক গ্ৰহবৈগুণ্য[গ্রহের বিরুদ্ধতা]প্রযুক্ত অকালে কালকবলে নিপতিত হইল। তখন ব্রাহ্মণের বন্ধুবান্ধবগণ নিতান্ত শোকবিহ্বল হইয়া রোদন করিতে করিতে সেই কুলের সৰ্ব্বস্বভূত মৃতশিশুকে গ্রহণপূৰ্ব্বক শ্মশানাভিমুখে গমন করিলেন এবং তথায় তাহাকে ক্রোড়ে লইয়া অধিকতর ক্রন্দন করিতে লাগিলেন। বালকের পূর্ব্বোক্ত মধুরবাক্য বারংবার স্মরণ হওয়াতে তাঁহাদিগের শোক দ্বিগুণ পরিবর্দ্ধিত হইয়া উঠিল। তখন তাঁহারা কোনক্রমেই সেই মৃতশিশুকে ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া গৃহে প্রতিগমন করিতে সমর্থ হইলেন না।
“ঐ সময় এক গৃধ্র তাঁহাদিগের রোদনশব্দ শ্রবণপূৰ্ব্বক তথায় সমুপস্থিত হইয়া তাঁহাদিগকে কহিল, “হে মানবগণ! সকলকেই মৃত্যুগ্রাসে নিপতিত হইতে হইবে; অতএব তোমরা অবিলম্বেই এই বালককে এই স্থানে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান কর। মানবগণ এই স্থানে সহস্র সহস্র স্ত্রী ও পুরুষের মৃতদেহ পরিত্যাগ করিয়া স্ব স্ব আবাসে গমন করিয়াছে। সমুদয় জগৎই সুখ-দুঃখে পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে। ইহলোকে সকলকেই পৰ্য্যায়ক্রমে বারংবার সুযোগ ও বিপ্রযোগ [বিচ্ছেদ] লাভ করিতে হয়। যাহারা মৃতদেহ পরিত্যাগ না করে এবং যাহারা মৃতদেহের অনুগামী হয়, তাহাদিগের আয়ুক্ষয় হইয়া থাকে। অতএব তোমরা অচিরাৎ প্রস্থান কর। এই গৃধশৃগালসঙ্কুল কঙ্কালপূর্ণ ভীষণ শ্মশানে ক্ষণমাত্রও অবস্থান করিও না। মর্ত্ত্যলোকে জীবমাত্রকেই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইতে হইবে। কৃতান্তের নিয়ম উল্লঙ্ঘনপূৰ্ব্বক মৃতব্যক্তিকে পুনর্জ্জীবিত করা কাহারও সাধ্যায়ত্ত নহে। ইহলোকে সকলকেই কৰ্ম্মসূত্রে আবদ্ধ থাকিতে হইয়াছে। ঐ দেখ, দিবাকর অস্তগত হইতেছেন, অতএব তোমরা পুত্রস্নেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক অবিলম্বে স্বস্থানে প্রস্থান কর। গৃধ্র এই কথা কহিলে সেই ব্রাহ্মণগণ মৃতবালকের দর্শনলালসা ও জীবিতাশা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক রোদন করিতে করিতে তাহাকে ভূমিতলে নিক্ষেপ করিয়া গৃহে গমন করিবার মানসে পথে দণ্ডায়মান হইল।
শবরক্ষাৰ্থ শৃগালের অনুরোধ—মমতাকর্ষণ
“ঐ সময় এক কৃষ্ণবর্ণ শৃগাল বিবর হইতে বহিগত হইয়া সেই গৃহগমনোদ্যত ব্যক্তিদিগকে ভৎর্সনা করিয়া কহিল, ‘হে মানবগণ! তোমরা নিতান্ত নির্দ্দয়। দেখ, এখনও দিনমণি অস্তগত হয়েন নাই; তথাপি তোমরা নিতান্ত ভীত হইয়া এই বালকের স্নেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক গমন করিতেছ। মুহূর্ত্তের প্রভাব অতি চমৎকার। মুহূৰ্ত্তপ্রভাবে এই বালকের পুনর্জ্জীবনলাভ নিতান্ত অসম্ভাবিত নহে। অতএব তোমরা কি করিয়া নিতান্ত নির্দ্দয় ব্যক্তিদিগের ন্যায় এই বালককে শ্মশানে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক প্রস্থান করিতেছ? পূৰ্ব্বে যাহার মধুরবাক্য কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইবামাত্র তোমরা যারপরনাই পুলকিত হইতে, এক্ষণে সেই মিষ্টভাষী শিশুসন্তানদের প্রতি কি তোমাদিগের কিছুমাত্র স্নেহ হইতেছে না? তোমরা পশুপক্ষীদিগের অপত্যস্নেহ অনুধাবন করিয়া এই বালকের প্রতি দয়া প্রকাশ কর। পশু, পক্ষী, কীট প্রভৃতি প্রাণীগণের অপত্যস্নেহ কৰ্ম্মসন্ন্যাসী [কৰ্ম্মফলত্যাগী] মুনিগণের যজ্ঞের ন্যায় নিতান্ত ফলবিহীন [কাম্যফলশূন্য]। তাহারা কি ইহলোক, কি পরলোক কখন সন্তান হইতে সুখলাভ করিতে সমর্থ হয় না। তাহাদের সন্তানগণ বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে স্বেচ্ছানুসারে আহারবিহার করে, কদাচ পিতামাতাকে প্রতিপালন করে না; তথাপি তাহারা অপত্যগণের লালনপালনে নিয়ত নিযুক্ত রহিয়াছে। হায়! আমি এতদিনে বিশেষরূপে অবগত হইলাম যে, মানবগণের শরীরে কিছুমাত্র স্নেহ নাই, সুতরাং তাহাদের শোক কিরূপে সম্ভবপর হইতে পারে? তোমরা কিরূপে এই কুলরক্ষক পুত্রকে শ্মশানে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক গমন করিতেছ? এই স্থানে অবস্থানপূৰ্ব্বক বহুক্ষণ বাষ্পবারি পরিত্যাগ ও এই শিশুকে সস্নেহনয়নে নিরীক্ষণ করাই তোমাদের কর্ত্তব্য। এতাদৃশ ইষ্টবস্তু পরিত্যাগ করা নিতান্ত দুঃসাধ্য সন্দেহ নাই। ক্ষীণ, অভিযুক্ত ও শ্মশানস্থিত ব্যক্তির নিকট বান্ধবগণ অবস্থান করিলে আর কেহই তাহাদিগকে আক্রমণ করিতে পারে না। প্রাণ সকলেরই প্রিয় এবং সকলেই স্নেহের বশীভূত। সাধুব্যক্তিরা পশুদিগের প্রতিও সবিশেষ স্নেহ প্রদর্শন করিয়া থাকেন। এক্ষণে তোমরা মাল্যবিভূষিত নববিবাহিত কুমারের ন্যায়, এই পদ্মপলাশলোচন বালককে পরিত্যাগ করিয়া কিরূপে প্রস্থান করিতেছ?’ জম্বুক এইরূপ করুণবাক্য প্রয়োগ করিলে সেই ব্রাহ্মণগণ সত্বর শবরক্ষার্থে প্রত্যাগমন করিলেন।
গৃধ্রের অনুরোধ—দেহের অনিত্যতা প্রদর্শন
“তখন গৃধ্র কহিল, ‘হে মানবগণ! তোমরা নিতান্ত নিৰ্ব্বোধ, নচেৎ কি নিমিত্ত এই নীচাশয় নৃশংস অল্পবুদ্ধি জম্বুকের কথা শ্রবণ করিয়া প্রতিনিবৃত্ত হইলে? আর কি নিমিত্তই বা আপনাদের আত্মার উপর নিরপেক্ষ হইয়া পঞ্চভূতপরিশূন্য কাষ্ঠবৎ নিপতিত বালকের নিমিত্ত শোকে একান্ত অভিভূত হইতেছ? অতঃপর তীব্রতর তপঃপ্রভাবে পাপ হইতে বিমুক্ত হইতে পারিবে। সেই তপানুষ্ঠানে যত্নবান্ হওয়াই তোমাদের আবশ্যক। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করিলে কিছুই দুর্ল্লভ হয় না; অতএব এক্ষণে শোকপরিত্যাগ কর। দুর্ভাগ্য ও সৌভাগ্য লোকের দেহের সহিত জন্মপরিগ্রহ করিয়া থাকে। তোমাদের দুর্ভাগ্যপ্রভাবেই এই বালক তোমাদিগকে শোকসাগরে নিপাতিত করিয়া মর্ত্ত্যলীলা সংবরণ করিয়াছে। সন্তানসন্ততি, গাভী, সুবর্ণ ও মণিমুক্তাদি বিবিধ সম্পত্তি সমুদয়ই তপোবললভ্য। পূৰ্ব্বজন্মে যেরূপ তপস্যা করা যায়, ইহজন্মে তদনুসারে সুখদুঃখ লাভ হইয়া থাকে। জীবগণ অগ্রে সুখদুঃখ সংগ্রহ করিয়া পশ্চাৎ জন্মপরিগ্রহ করে। পুত্র পিতার অথবা পিতা পুত্রের কৰ্ম্ম অনুসারে ফলভোগ করেন না। সকলকেই স্ব স্ব সুকৃত ও দুষ্কৃত অনুসারে ফলভোগ করিতে হয়। অতএব এক্ষণে তোমরা অধৰ্ম্ম হইতে বিরত হইয়া যত্নসহকারে দেবতা ও ব্রাহ্মণের প্রতি ভক্তি প্রদর্শনপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্ম আচরণ কর। শোক, দীনতা ও স্নেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ঐ বালককে শূন্য প্রদেশে নিক্ষেপ করিয়া সত্বর এ স্থান হইতে প্রতিনিবৃত্ত হও। কৰ্ত্তাকেই শুভাশুভ কাৰ্য্যের অনুরূপ ফল ভোগ করিতে হয়। তাহার বান্ধবদিগের সহিত তাহার কিছুমাত্র সংস্রব থাকে না। বান্ধবগণ এই শ্মশানভূমিতে প্রিয়তম বন্ধুকে পরিত্যাগ করিয়া আর ক্ষণমাত্র এ স্থানে অবস্থান করেন না; অচিরাৎ মৃতব্যক্তির স্নেহ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক বাষ্পকুললোচনে স্বস্থানে প্রস্থান করেন। কি বিদ্বান, কি মূর্খ, কি ধনবান্, কি নির্দ্ধন, সকলকেই স্ব স্ব শুভাশুভ কার্য্যের ফল-সমভিব্যাহারে কালকবলে নিপতিত হইতে হয়। এক্ষণে আর কেন বৃথা শোক করিতেছ? কাল সকলেরই নিয়ন্তা এবং ধৰ্ম্মতঃ অপক্ষপাতী। মৃত্যু কি বালক, কি যুবা, কি বৃদ্ধ, কি গর্ভস্থ সকলকেই আক্রমণ করে। এ জগতের গতিই এইরূপ।’
শৃগালের প্রত্যুক্তি—জীবনাশায় প্রলোভন
“গৃধ্র এই কথা কহিলে সেই ব্রাহ্মণগণের মধ্যে একজন গৃহে গমন করিবার নিমিত্ত অগ্রসর হইলেন। তখন জম্বুক তাঁহাকে গমন করিতে দেখিয়া সেই ব্রাহ্মণকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিল, ‘হে মানবগণ! এক্ষণে এই ব্যক্তি স্নেহপরিত্যাগপূৰ্ব্বক গমন করাতে আমার নিশ্চয় বোধ হইতেছে যে, গৃধ্রের বাক্যে তোমাদিগের স্নেহের হ্রাস হইয়াছে। আজ এই বালক বিনষ্ট হওয়াতে বৎসহীন গোযূথের[গরুর পালের] ন্যায় তোমাদিগের অতিশয় কষ্ট হইতেছে। মর্ত্ত্যলোকে মানবদিগের যতদুর শোক হইয়া থাকে, আজ তাহা অবগত হইলাম। স্নেহপ্রযুক্ত আজ আমার অশ্রুপাত হইতেছে। সকল বিষয়েই প্রথমতঃ যত্ন করা সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। যত্ন করিলে পর দৈববলসহযোগে কার্য্যকলাপ সুসিদ্ধ হইয়া থাকে। পুরুষকারপ্রভাবেই দৈববল লাভ করা যায়। সর্ব্বদা পরিতাপ করা কৰ্ত্তব্য নহে; পরিতাপ করিলে সুখলাভের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। যত্নদ্বারাই অভীষ্টসিদ্ধ হইয়া থাকে। অতএব তোমরা এই বালককে জীবিত করিবার নিমিত্ত বিশেষ যত্ন কর। কি নিমিত্ত নির্দ্দয় হইয়া এখান হইতে প্রস্থান করিতেছ? পুত্র পিতার শরীর হইতে উৎপন্ন হয় ও বংশ রক্ষা করে। উহা জনকের অর্দ্ধ-অঙ্গস্বরূপ। তোমরা সেই পুত্রকে বনমধ্যে পরিত্যাগ করিয়া কোথায় গমন করিতেছ? কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা কর। সূর্য্য অস্তাচলে গমন করিলে সায়ংকালে একেবারে পুত্রের সহিত গৃহে গমন অথবা এই স্থানে অবস্থান করিবে।’
গৃধ্রের প্রত্যুক্তি—মৃতের পরিণাম প্রদর্শন
“তখন গৃধ্র কহিল, ‘হে মানবগণ! আমি সহস্র বৎসর হইল জন্মপরিগ্রহ করিয়াছি, কিন্তু কখন কোন স্ত্রী, পুরুষ বা ক্লীবকে একবার কালকবলে নিপতিত হইয়া পুনরুর্জ্জীবিত হইতে দেখি নাই। কেহ কেহ গর্ভ হইতে মৃতাবস্থায় নিঃসৃত হয় এবং কেহ কেহ জাতমাত্রেই, কেহ কেহ অঙ্গচালন করিতে করিতেই মৃত ও কেহ কেহ বা যৌবনাবস্থাতেই বিনষ্ট হইয়া থাকে। পশু, পক্ষী প্রভৃতি সকল জন্তুরই ভাগ্য অনিত্য। কি স্থাবর, কি জঙ্গম, সকলেই পরমায়ুর অধীন। অনেকেই প্রিয়তম পুত্ৰকলত্রদিগকে শ্মশানে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক শোকসন্তপ্তচিত্তে গৃহে গমন করিয়া থাকে। মনুষ্যমাত্রেই অসংখ্য অনিষ্ট ও ইষ্টবস্তু পরিত্যাগপূর্ব্বক দুঃখিতমনে পরলোকে প্রস্থান করিতে হয়। অতএব তোমরা অচিরাৎ এই জীবিতশূন্য কাষ্ঠপ্রায় বালককে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক গৃহে গমন কর; এখন উহার প্রতি স্নেহ প্রকাশ করা নিতান্ত নিরর্থক। উহাকে জীবিত করিবার নিমিত্ত সবিশেষ পরিশ্রম করিলেও তাহাতে কিছুমাত্র ফলোদয় হইবে না। এক্ষণে উহার শ্রবণেন্দ্রিয় বা দর্শনেন্দ্রিয়ের কোন কাৰ্য্যই হইতেছে না। তবে তোমরা কি নিমিত্ত উহাকে পরিত্যাগ করিয়া গৃহগমনে বিরত হইতেছ? আমি মোক্ষধৰ্ম্ম অবলম্বনপূৰ্ব্বক যুক্তি অনুসারে অতি কঠোরবচনে তোমাদিগকে উপদেশ প্রদান করিতেছি; এক্ষণে তোমরা তদনুসারে অবিলম্বে স্ব স্ব গৃহে প্রতিগমন কর। এখন উহাকে দর্শন ও উহার অঙ্গচেষ্টাদি [শরীরচালনাদি হস্তপদাদির নাড়াচাড়া] স্মরণ করিলে তোমাদের শোকাবেগ দ্বিগুণিত হইয়া উঠিবে।’ গৃধ্র এই কথা কহিলে ব্রাহ্মণগণ তথা হইতে প্রস্থানে উদ্যত হইল।
মৃতশিশুর জীবনবিষয়ে শৃগালের আশ্বাসবাক্য
“তখন সেই জম্বুক দ্রুতপদসঞ্চারে তথায় আগমন করিয়া সেই মৃতবালককে অবলোকনপূৰ্ব্বক তাহাদিগকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিল, ‘হে মানবগণ! তোমরা কি নিমিত্ত গৃধ্রের বাক্যে স্নেহশূন্য হইয়া এই তপ্তকাঞ্চনসন্নিভ দিব্যভূষণ-ভূষিত বালককে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক গমন করিতেছ? এই বালক তোমাদের পিতৃলোকের পিণ্ডদাতা, ইহাকে পরিত্যাগ করিলে তোমাদের স্নেহ, বিলাপ বা রোদনের কিছুমাত্র শান্তি হইবে না; বরং পরিশেষে মহা অনুতাপ উপস্থিত হইবে। আমি শুনিয়াছি যে, সত্যপরাক্রম মহাত্মা রামচন্দ্র তপঃপরায়ণ শম্বুকনামক শূদ্রকে বিনাশ করিলে সেই ধৰ্ম্মপ্রভাবে এক ব্রাহ্মণ বালক পুনর্জ্জীবিত হইয়াছিল। ধার্ম্মিকশ্রেষ্ঠ রাজর্ষি শ্বেতও তাঁহার মৃতপুত্রকে পুনর্জ্জীবিত করিয়াছিলেন। অতএব মৃতব্যক্তির পুনর্জ্জীবন নিতান্ত অসম্ভাবিত নহে। তোমরা এইস্থানে দীনভাবে রোদন করিলে কোন সিদ্ধপুরুষ বা মুনি অথবা কোন দেবতা তোমাদিগের প্রতি দয়া প্রকাশ করিতে পারেন। জম্বুক এই কথা কহিলে সেই শোকার্ত্ত মানবগণ গৃহগমনে প্রতিনিবৃত্ত হইয়া পুনরায় পুত্রকে ক্রোড়ে লইয়া নিরন্তর রোদন করিতে আরম্ভ করিল।
গৃধ্রের নৈরাশ্যসূচক উক্তি
“তখন সেই গৃধ্র তাহাদিগের রোদনশব্দ শ্রবণ করিয়া তথায় আগমনপূর্ব্বক পুনরায় তাহাদিগকে কহিল, “হে মানবগণ! তোমরা অকারণে কেন এই বালককে নেত্রজলে অভিসিক্ত ও করদ্বারা সংঘটিত করিতেছ? ঐ শিশু কৃতান্তের শাসনানুসারে দীর্ঘনিদ্রা প্রাপ্ত হইয়াছে। কি তপস্বী, কি বুদ্ধিমান, কি ধনাঢ্য সকলকেই উহার ন্যায় শমনভবনে গমন করিতে হয়। মানবগণ এই প্রেতভূমিতে সহস্র সহস্র বালক ও বৃদ্ধকে পরিত্যাগ করিয়া অতিকষ্টে দিবারাত্রি ভূতলে নিপতিত হইয়া থাকে। আজি এই বালককে জীবিত করিবার নিমিত্ত নির্ব্বন্ধাতিশয়সহকারে [অত্যন্ত আগ্রহের সহিত] শোক করিবার কোন প্রয়োজন নাই। ঐ শিশু কখনই জীবিত হইবে না। লোকে একবার কলেবর পরিত্যাগ করিলে কি পুনরায় জীবিত হইয়া থাকে? শত শত শৃগালও শত শত বৎসর পর্য্যন্ত প্রাণপণে যত্ন করিলেও এই বালকের জীবনদানে সমর্থ হইবে না। তবে যদি ভগবান রুদ্রদেব, কাৰ্ত্তিকেয়, ব্রহ্মা বা বিষ্ণু স্বয়ং আসিয়া বর প্রদান করেন, তাহা হইলে এই শিশু পুনর্জ্জীবিত হইতে পারে। তোমরা অনবরত অশ্রুপাত, দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ ও উচ্চৈঃস্বরে রোদন করিলে উহার জীবনলাভের কিছুমাত্র সম্ভাবনা নাই। আমি, শৃগাল এবং তোমরা, আমরা সকলেই স্ব স্ব পাপপুণ্যভার বহনপূর্ব্বক কৃতান্তের পথে অবস্থান করিতেছি, বিজ্ঞ ব্যক্তিরা এই স্থির করিয়াই অন্যের অপ্রিয়াচরণ, পরুষবাক্য-প্রয়োগ, পরদ্রোহ ও পরদারগমনাভিলাষ একেবারে পরিত্যাগ করেন। এক্ষণে তোমরা যত্নপূৰ্ব্বক ধর্ম্মানুষ্ঠান, সত্যবাক্য প্রয়োগ, শাস্ত্রালোচনা, ন্যায়পথ অবলম্বন এবং প্রাণীগণের প্রতি সরল ব্যবহার ও দয়া প্রকাশের চেষ্টা কর। যাহারা জীবিত থাকিয়া পিতা, মাতা ও অন্যান্য বান্ধবগণের তত্ত্বাবধারণ না করে, তাহাদিগকে নিশ্চয়ই অধর্ম্মে লিপ্ত হইতে হয়। এক্ষণে এই বালকের কিছুমাত্র ইঙ্গিত দৃষ্টিগোচর হইতেছে না; সুতরাং ইহার জীবনলাভের নিমিত্ত রোদন করা নিতান্ত নিষ্ফল।’ গৃধ্র এই কথা কহিলে ব্রাহ্মণগণ সেই বালককে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক স্নেহনিবন্ধন শোকে নিতান্ত অভিভূত হইয়া তথা হইতে স্বগৃহে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইল।
শৃগালের পুনরুক্তি—কপট বৈরাগ্য
“তখন জম্বুক কহিল, মর্ত্ত্যলোক অতি ভয়ানক স্থান, ইহাতে কাহারও নিস্তার নাই। এখানে লোকের জীবিতকাল অতি অল্প এবং সততই প্রিয়তম বন্ধুবিয়োগ হইয়া থাকে। এই জগতে প্রায় সকল কাৰ্য্যই অলীক ও অপ্রিয়। বিশেষতঃ আজ এই শোকবর্দ্ধক ভাব দর্শনে আর ক্ষণমাত্র ইহলোকে অবস্থান করিতে অভিরুচি হইতেছে না। বন্ধুবিয়োগ কি কষ্টকর! হে মানবগণ! তোমাদের শরীরে কি কিছুমাত্র স্নেহ নাই? তোমরা পাপাত্মা গৃধ্রের বাক্যশ্রবণে এককালে স্নেহে জলাঞ্জলি দিয়া শোকভরে কেন গৃহে প্রতিগমন করিতেছ? সুখের অবসানে দুঃখ এবং দুঃখের অবসানে সুখানুভব হইয়া থাকে। ইহলোকে কেহই চিরকাল দুঃখ বা সুখ ভোগ করে না। এক্ষণে তোমরা এই রূপবান কুলপ্রদীপ পুত্রকে ভূতলে নিক্ষেপ করিয়া মূঢ়ের ন্যায় কোথায় গমন করিতেছ? এই রূপগুণসম্পন্ন বালকের লাবণ্যদর্শনে ইহাকে জীবিত বলিয়া বোধ হইতেছে। এই শিশু অবশ্যই জীবিত হইবে এবং তোমরা সুখলাভ করিবে। আজ তোমাদের মঙ্গললাভের কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। অতএব কোনক্রমেই এই বালককে পরিত্যাগ করিও না।’ শ্মশানবাসী নিশাচর শৃগাল স্বকাৰ্য্যসাধনার্থ এইরূপ অতি মনোহর মিথ্যা প্রিয়বাক্য প্রয়োগ করিলে ব্রাহ্মণগণ কত্তর্ব্য নির্দ্ধারণে অসমর্থ হইয়া তথায় সেই বালকের নিকট অবস্থান করিতে লাগিলেন।
গৃধ্রের পুনরুক্তি—শ্মশান-বিভীষিকা কীৰ্ত্তন
“তখন গৃধ্র কহিল, ‘হে মানবগণ! এই শবসমাকীর্ণ পেচক নাদনিনাদিত [পেচকের ভীষণ স্বরে শব্দিত] নীলমেঘসদৃশ শ্মশানভূমি অতি ভয়ানক স্থান। যক্ষরাক্ষসগণ ইহাতে নিরন্তর বাস করিয়া থাকে। অতএব সূৰ্য্য অস্তাচলগামী ও দিঙ্মণ্ডল অন্ধকারাবৃত্ত না হইতে হইতেই এই বালককে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক উহার প্রেতকার্য্যের অনুষ্ঠান কর। ঐ দেখ দিবাকর অস্তাচলচুড়াবলম্বী হইয়াছেন। শ্যেনগণ অতি কঠোর শব্দ করিতেছে; শৃগালকুলের ভীষণ চীৎকারে শ্মশানভূমি প্রতিধ্বনিত হইতেছে; সিংহগণ গর্জ্জনপূর্ব্বক ইতস্ততঃ সঞ্চরণে প্রবৃত্ত হইয়াছে; নীলবর্ণ চিতাধূম পাপসমুদয় রঞ্জিত করিয়াছে এবং মাংসাশী প্রাণীগণ অনাহারনিবন্ধন ভীষণ ধ্বনি করিতেছে। ক্ষণকাল পরেই বিকৃতাকার মাংসলোলুপ হিংস্ৰজন্তুগণ এই স্থানে উপস্থিত হইয়া তোমাদিগকে আক্রমণ করিবে। এই অরণ্য অতি ভয়ানক স্থান। আজ এখানে অবস্থান করিলে নিশ্চয়ই তোমাদের মহাভয় উপস্থিত হইবে। অতএব জম্বুকবাক্যে অনাস্থা প্রদর্শনপূৰ্ব্বক অচিরাৎ এই বালককে পরিত্যাগ করিয়া প্রস্থান করাই তোমাদের শ্রেয়ঃ। যদি তোমরা জ্ঞানশূন্য হইয়া শৃগালের মিথ্যাবাক্যে বিশ্বাস কর, তাহা হইলে নিশ্চয়ই সকলকে বিনষ্ট হইতে হইবে। অস্তাচলে গমন না করেন, তোমরা সেইকাল পর্য্যন্ত স্নেহনিবন্ধন রোদনপূর্ব্বক নির্ভীকচিত্তে এই স্থানে অবস্থানপূর্ব্বক বালককে নিরীক্ষণ কর। মোহবশতঃ গৃধ্রের নিষ্ঠুরবাক্যে বিশ্বাস করিলে আর উহার মুখাবলোকনে সমর্থ হইবে না।
ধূৰ্ত্তের ব্যর্থতা—শিববরে বালকের জীবনলাভ
“হে ধৰ্ম্মরাজ! ক্ষুধার্ত্ত গৃধ্র ও শৃগাল এইরূপে স্বকাৰ্য্যসাধনার্থ [সোজাবুদ্ধি শকুনির স্বকার্য্য—পিতৃমাতৃ-পরিত্যক্ত শব-শিশুর মাংসভক্ষণ; ধূৰ্ত্ত শৃগালের স্বকাৰ্য্য ব্রাহ্মণগণ একান্ত প্রস্থান না করিলে শকুনি হতাশ হইয়া চলিয়া যাইবে; ব্রাহ্মণেরাও অবশেষে শিশু পরিত্যাগে বাধ্য হইবে—শৃগাল সবটা একলা খাইবে।] তুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী হইয়া বুদ্ধিপ্রভাবে সেই বালকের আত্মীয়গণকে প্রতারিত করিতে লাগিল। ব্রাহ্মণগণ উহাদের উভয়ের মনোগত অভিপ্রায় বুঝিতে না পারিয়া তাহাদের সেই যুক্তিযুক্ত বাক্যশ্রবণে বিমুগ্ধপ্রায় ও ইতিকর্ত্তব্যবিমূঢ় হইলেন এবং পরিশেষে সেই স্থানে অবস্থান করাই শ্রেয়স্কর বিবেচনা করিয়া দুঃখিতমনে রোদন করিতে করিতে তথায় উপবেশন করিলেন। ঐ সময় ভূতভাবন ভবানীপতি সেই ব্রাহ্মণগণের দুঃখদর্শনে নিতান্ত দয়াপরায়ণ ও পার্ব্বতীকর্ত্তৃক প্রেরিত হইয়া তথায় আগমনপূৰ্ব্বক করুণাচিত্তে তাঁহাদিগকে কহিলেন, ‘হে বিপ্রগণ! আমি মহাদেব, তোমাদিগকে বর প্রদান করিতে আসিয়াছি; অতএব তোমরা অচিরাৎ অভিলষিত বর প্রার্থনা কর।’ তখন সেই ব্রাহ্মণগণ মহাদেবকে দণ্ডবৎ প্রণাম করিয়া কহিলেন, ‘ভগবন্! এই বালকের বিনাশনিবন্ধন আমরা সকলেই মৃতপ্রায় হইয়াছি; অতএব এক্ষণে ইহার জীবন প্রদান করিয়া আমাদিগকে জীবিত করুন।’ ব্রাহ্মণগণ এই কথা কহিলে জীবহিতৈষী ভগবান ভূতনাথ জলাঞ্জলি গ্রহণপূৰ্ব্বক ‘শতায়ু হও’ বলিয়া বালককে পুনর্জ্জীবিত করিলেন। ঐ সময় গৃধ্র ও শৃগালও তাহার প্রসাদে তৃপ্তিজনক আহার প্রাপ্ত হইল।
“এইরূপে সেই ব্রাহ্মণেরা ভগবান্ ভূতনাথের প্রসাদে মৃতবালকের পুনর্জ্জীবন লাভ করিয়া পুলকিতচিত্তে দেবাদিদেবকে অভিবাদনপূৰ্ব্বক পরমসুখে অবস্থান করিতে লাগিলেন। অনৌদাস্য [অনালস্য], অধ্যবসায় ও ভগবান শঙ্করের অনুগ্রহে অবিলম্বেই শুভফল লাভ হইয়া থাকে। দৈববল ও অধ্যবসায়ের কি আশ্চর্য্য প্রভাব! ব্রাহ্মণেরা অতি দীনভাবে রোদন করিতেছিলেন; কিন্তু দৈব ও অধ্যবসায়বলে অচিরাৎ তাঁহাদিগের সমস্ত দুঃখ দূরীভূত হইল। অনন্তর সেই ব্রাহ্মণগণ বালক-বিনাশজনিত শোক পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মহাহ্লাদে সেই শিশুসমভিব্যাহারে নগরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। ব্রাহ্মণেরা যেরূপ বুদ্ধি অবলম্বন করিয়াছিলেন, সকলেরই সেই বুদ্ধি আশ্রয় করা শ্রেয়। যে ব্যক্তি এই ধৰ্ম্ম, অর্থ ও মোক্ষলাভের উপদেশাত্মক ইতিহাস সতত শ্রবণ করে, সে উভয় লোকেই সুখী হইতে সমর্থ হয়, সন্দেহ নাই।”