১৫২তম অধ্যায়
পাপনাশক তীর্থ—যযাতি মনু-সত্যবানের মত
“ইন্দ্রোত কহিলেন, ‘মহারাজ! এক্ষণে তোমার চিত্ত অতিশয় উদভ্রান্ত হইয়াছে, এই নিমিত্ত তোমাকে ধর্ম্মোপদেশ প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি এক্ষণে স্বয়ং ধৰ্ম্মানুসরণে ব্যগ্র হইয়াছ। ভূপতি যে প্রথমতঃ নিতান্ত উগ্ৰস্বভাব ও দুশ্চরিত্র হইয়া পরিশেষে লোকের প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করেন, ইহা অতি আশ্চর্য্যের বিষয়। লোকে কহিয়া থাকে যে, যে মহীপাল দুশ্চরিত্রতা আশ্রয় করিয়া রাজ্যশাসনে প্রবৃত্ত হয়েন, তিনি লোকসকলকে একান্ত সন্তপ্ত করিয়া থাকেন; কিন্তু তুমি যে এক্ষণে লোকের অনিষ্টসাধনে পরাঙ্মুখ হইয়া ধর্ম্মের অনুসরণে ও ভূপালভোগ্য দ্রব্যসমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক তপানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইয়াছ, ইহা অতিশয় অদ্ভুত সন্দেহ নাই। যাহা হউক, কাৰ্য্য সবিশেষ বিবেচনা করিয়া অনুষ্ঠান করিলে তাহাতে বিস্তর গুণ দর্শে [দৃষ্ট হয়]। যজ্ঞানুষ্ঠান, দান, দয়া প্রদর্শন, বেদাধ্যয়ন, সত্যবাক্য প্রয়োগ, তপঃসাধন ও পুণ্যস্থান পর্য্যটন লোকের পবিত্রতা সম্পাদন করিয়া থাকে। তন্মধ্যে তপস্যা নৃপতিগণের পক্ষে পরমপবিত্র। তুমি সম্যকরূপে তপোবল অবলম্বন করিলে নিশ্চয়ই ধর্ম্মলাভে সমর্থ হইবে। এই স্থলে রাজা যযাতি যেরূপ আত্মমত ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন, কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তিনি কহেন যে, যে মনুষ্য জীবিত থাকিবার অভিলাষ করেন, তিনি যত্নসহকারে যজ্ঞানুষ্ঠানপূর্ব্বক তপঃসাধনে প্রবৃত্ত হইবেন। কুরুক্ষেত্র অতি পবিত্র স্থান। কুরুক্ষেত্র অপেক্ষা সরস্বতী, সরস্বতী অপেক্ষা উহার তীর্থ এবং সরস্বতীতীর্থ অপেক্ষা পৃথুদক [তন্নামক অংশ—জলতীর্থ] অতি পবিত্র। পৃথুদকের সলিলে অবগাহন ও উহা পান করিলে অকালমৃত্যু-যন্ত্রণা ভোগ করিতে হয় না। মহাসরোবর, পুষ্কর, তীর্থসমুদয়, প্রভাস, উত্তর-মানস, মানসসরোবর ও কালোদক তীর্থে গমন করিলে সুদীর্ঘ জীবনলাভ হইয়া থাকে। অতএব স্বাধ্যায়সম্পন্ন মনুষ্য এই সমস্ত তীর্থে অবগাহন করিবেন।
মনু কহিয়াছেন, পবিত্র ধর্ম্মসমুদয়মধ্যে দানই উৎকৃষ্ট এবং দান অপেক্ষা সন্ন্যাস সমধিক শ্রেষ্ঠ। এই বিষয়ে রাজকুমার সত্যবান্ যেরূপ অভিপ্রায় ব্যক্ত করিয়াছেন, শ্রবণ কর। লোকে বালকের ন্যায় রাগদ্বেষাদিশূন্য ও পাপপুণ্যবর্জ্জিত হইবে। পৃথিবীতে সুখদুঃখ-ভোগ কেবল কল্পনামাত্র। যাঁহারা সন্ন্যাসধৰ্ম্ম আশ্রয়পূৰ্ব্বক পাপপুণ্যশূন্য হইয়া ব্রহ্মস্বরূপ হইতে পারেন, তাঁহাদের জীবিত থাকাই শ্রেয়ঃ।
প্রায়শ্চিত্তপ্রসঙ্গে বিবিধ রাজনীতি নির্ণয়
‘এক্ষণে ভূপতির যাহা কর্ত্তব্য, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি ধৈৰ্য্য ও দানদ্বারা স্বর্গ অধিকার করিতে যত্নবান হও। যে মনুষ্যের ধৈৰ্য্য ও ইন্দ্রিয়সংযম আছে, তিনিই যথার্থ ধাৰ্ম্মিক। তুমি ব্রাহ্মণগণের সুখবৃদ্ধির নিমিত্ত পৃথিবী পালন এবং ব্রাহ্মণগণকর্ত্তৃক বারংবার ধিকৃত ও পরিত্যক্ত হইয়াও তাঁহাদিগের প্রতি ঈর্ষা পরিত্যাগপূৰ্ব্বক তাঁহাদিগের সন্তোষ উৎপাদন কর, আর আপনার এই দুরবস্থার বিষয়ে মনোমধ্যে বদ্ধমূল করিয়া “কদাচ ব্রহ্মহিংসা করিব না” বলিয়া প্রতিজ্ঞারূঢ় হও। যাহাতে শ্ৰেয়োলাভ হয়, তাহারই অনুষ্ঠানে যত্ন কর। কোন রাজা তুষারের ন্যায় শীতল, হুতাশনের ন্যায় তেজস্বী ও যমের ন্যায় সূক্ষ্মদর্শী এবং কেহ বা লাঙ্গলের ন্যায় দুষ্টগণের মূলোন্মূলনে তৎপর হইয়া থাকেন; আর কেহ বজ্রের ন্যায় সহসা দুর্দ্দান্তদিগকে আক্রমণ করে। যে ব্যক্তি আত্মরক্ষা করিবার অভিলাষ করেন, সামান্য বা বিশেষরূপে খলের সহিত সংসর্গ করা তাঁহার কখনই কর্ত্তব্য নহে। যে পাপ একবার অনুষ্ঠিত হয়, তাহা অনুতাপদ্বারা, যাহা দুইবার অনুষ্ঠান করা যায়, তাহা প্রতিদ্বারা এবং যাহাতে তিনবার প্রবৃত্ত হওয়া যায়, তাহা ধর্ম্মাচরণদ্বারা বিলুপ্ত হইতে পারে। আর যে পাপ বার বার অনুষ্ঠিত হইয়া থাকে, তাহা তীর্থপর্য্যটনদ্বারা তিরোহিত হয়, সন্দেহ নাই। যিনি শ্ৰেয়োলাভার্থী, মঙ্গলজনক কার্য্যের অনুষ্ঠান করাই তাঁহার কর্ত্তব্য। যে ব্যক্তি সতত সুগন্ধ সেবন করিয়া থাকে, তাহার গাত্র হইতে সুগন্ধ নির্গত হয়; আর যে সতত দুর্গন্ধ সেবন করে, তাহার কলেবর হইতে দুর্গন্ধই নির্গত হইয়া থাকে। তপঃসাধনে প্রবৃত্ত হইলে অচিরাৎ পাপ ধ্বংস হইয়া যায়। লোকে সংবৎসর অগ্নির উপাসনা করিলে অশেষ পাপ হইতে মুক্ত হইতে পারে। তিন বৎসর অগ্নির উপাসনা করিলে অথবা শত যোজন দূর হইতে মহাসরোবর, পুষ্করতীর্থ, প্রভাসতীর্থ ও উত্তর-মানসে গমন করিলে ব্রহ্মহত্যাজনিত পাপ হইতে মুক্ত হওয়া যায়। যে ব্যক্তি যে পরিমাণে যে জীবের হিংসা করে, সে ব্যক্তি সেই পরিমাণে তজ্জাতীয় জীবের বন্ধন মুক্ত করিতে পারিলেই তাহার পাপক্ষয় হয়। মনু কহিয়াছেন, যে ব্যক্তি অঘমর্ষণ মন্ত্র জপ করিতে করিতে জলে নিমগ্ন হয়, সেই ব্যক্তি অশ্বমেধযজ্ঞাবসানে স্নাত ব্যক্তির ন্যায় পাপমুক্ত হইয়া জনসমাজে সৎকার লাভ করে এবং প্রাণীগণ জড় ও মূকের ন্যায় তাহার প্রতি প্রসন্ন হইয়া থাকে।
বৃহস্পতির পাপনাশক মত—জনমেজয়ের যজ্ঞ
‘পূৰ্বে সমুদয় সুরাসুর একত্র হইয়া সুরগুরু বৃহস্পতির নিকট গমনপূর্ব্বক বিনীতভাবে কহিয়াছিলেন, “মহর্ষে! আপনি ধৰ্ম্ম ও পাপের ফলসমুদয় সবিশেষ অবগত আছেন। এক্ষণে যে যোগশীল ব্যক্তির সুখ দুঃখতুল্য তিনি পাপ ও পুণ্য উভয় হইতেই মুক্ত হইতে পারেন কি না, আর ধর্ম্মশীল ব্যক্তি কিরূপে ধৰ্ম্মানুষ্ঠানদ্বারা স্বীয় পাপক্ষয় করিতে সমর্থ হয়েন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
‘বৃহস্পতি কহিলেন, “যে ব্যক্তি অজ্ঞানতানিবন্ধন পাপাচারণ করিয়া জ্ঞানপূর্ব্বক পুণ্যকাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করে, ক্ষারযুক্ত মলিন বস্ত্রের মালিন্যের ন্যায় তাহার সেই পাপ অচিরাৎ ক্ষয় হইয়া যায়। যে ব্যক্তি পাপকাৰ্য্য করিয়া অভিমান না করে এবং অসূয়া পরিত্যাগপূৰ্ব্বক ধৰ্ম্মে শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, তাহার নিশ্চয়ই কল্যাণলাভ হয়। যে ব্যক্তি সাধুদিগের ছিদ্র গোপন করিয়া রাখেন, তিনি পাপকাৰ্য্য করিয়াও কল্যাণলাভে সমর্থ হয়েন। দিবাকর যেমন প্রাতঃকালে সমুদিত হইয়া সমুদয় অন্ধকার বিনষ্ট করেন তদ্রূপ ধৰ্ম্মানুষ্ঠানপরায়ণ ব্যক্তি পুণ্যকাৰ্য্যদ্বারা অচিরাৎ স্বীয় পাপনিবারণে সমর্থ হয়েন।”
“হে ধৰ্ম্মরাজ! মহর্ষি ইন্দ্রোত মহারাজ জনমেজয়কে এই বলিয়া তাঁহাকে বিধিপূৰ্ব্বক অশ্বমেধযজ্ঞানুষ্ঠানে প্রবর্ত্তিত করিলেন। যজ্ঞ সুসম্পন্ন হইলে মহাত্মা জনমেজয় নিস্পাপ, মঙ্গলান্বিত ও প্রজ্বলিত অনলের ন্যায় তেজস্বী হইয়া নবোদিত পূর্ণশশধরের ন্যায় স্বীয় রাজ্যে সমুপস্থিত হইলেন।”