১৫১তম অধ্যায়
ব্ৰহ্মঘাতী জনমেজয়ের প্রায়শ্চিত্ত প্রার্থনা
“হে ধৰ্ম্মরাজ! রাজা জনমেজয় মহর্ষিকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া তাঁহাকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘তপোধন! আমি অতিশয় নিন্দনীয়, সুতরাং আমার ও আমার কাৰ্য্যের বারংবার নিন্দা করা আপনার উচিত নহে। এক্ষণে আমি আপনাকে বিনীতবচনে কহিতেছি, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হউন। আমি হুতাশনমধ্যে নিক্ষিপ্ত হইয়াই যেন প্রজ্বলিত হইতেছি এবং স্বীয় কুকর্ম্ম স্মরণ করিয়া কিছুতেই শান্তিলাভে সমর্থ হইতেছি না। যম হইতে আমার অন্তঃকরণে যারপরনাই ভয়সঞ্চার হইতেছে। অতএব এক্ষণে হৃদয় হইতে এই দুর্ভাবনারূপ বিষম শল্য উদ্ধার করিয়া কিরূপে প্রাণধারণ করিব? অতঃপর আপনি আমার প্রতি ক্রোধ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমাকে উপদেশ প্রদান করুন। আমি পুনরায় ব্রাহ্মণগণের প্রতি গাঢ়তর ভক্তি প্রদর্শন করিব। আমার কুল এককালে উন্মূলিত হইয়া যাউক। যাহারা ব্রহ্মহত্যাপাপে দূষিত হইয়া স্বজাতীয়দিগের সহিত সহবাস [বাস] ও সম্মানলাভে সমর্থ হয় না, তাহাদিগের বিনষ্ট হওয়াই শ্রেয়স্কর। এক্ষণে আমি যারপরনাই নিৰ্ব্বেদপ্রাপ্ত হইয়া আপনাদিগের নিকট প্রার্থনা করিতেছি যে, নিষ্পরিগ্রহ[দানাদিগ্রহণে পরাঙ্মুখ] যোগীরা যেমন নিৰ্দ্ধন ব্যক্তিকে রক্ষা করিয়া থাকেন, তদ্রূপ আপনারা আমাকে রক্ষা করুন। যাগযজ্ঞশূন্য পাপাত্মারা কদাচ ইহলোকে মঙ্গল লাভ করিতে পারে না এবং পরলোকে পুলিন্দ, শবর প্রভৃতি ম্লেচ্ছজাতির ন্যায় নিরন্তর নরকে বাস করিয়া থাকে। হে শৌনক! আপনি পরম সুপণ্ডিত; অতএব আমাকে বালকের ন্যায় বিবেচনা করিয়া পুত্রের প্রতি পিতার ন্যায় আমার প্রতি প্রীত ও প্রসন্ন হউন।
অজ্ঞানকৃত পাপের প্রায়শ্চিত্তাব্যবস্থা
‘ইন্দ্রোত কহিলেন, মহারাজ! অপ্রাজ্ঞ ব্যক্তি যে মোহপ্রভাবে অন্যায্য কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিবে, ইহা আর বিচিত্র কি? এই নিমিত্ত পণ্ডিতেরা মোহাবিষ্ট ব্যক্তিগণের প্রতি কদাচ ক্রোধ প্রকাশ করেন না। লোকে প্রজ্ঞারূপ প্রাসাদে আরোহণ করিলেই স্বয়ং অশোচ্য হইয়া শোচ্য ব্যক্তিদিগের নিমিত্ত শোক প্রকাশ করিয়া থাকেন। পর্ব্বতশিখরারূঢ় ব্যক্তিগণ যেমন নিম্নস্থ ব্যক্তিদিগকে অবলীলাক্রমে অবলোকন করিতে পারে, তদ্রূপ প্রজ্ঞাপ্রাসাদে সমারূঢ় মহাত্মারা অনায়াসে অন্যের হৃদয়গত ভাব অবধারণে সমর্থ হয়েন। যে ব্যক্তি সাধুলোকের প্রতি বিরক্ত, সাধুদিগের দৃষ্টিপথবহির্ভূত এবং সাধুজনকর্ত্তৃক সতত তিরস্কৃত হয়, তাহার কদাচ প্রজ্ঞালাভ হয় না এবং তাদৃশ ব্যক্তির প্রজ্ঞালাভ না হওয়াতে কেহই বিস্ময়ান্বিত হয় না। হে মহারাজ! তুমি ব্রাহ্মণের সামর্থ্য, বেদশাস্ত্রপ্রসিদ্ধ মাহাত্ম বিদিত হইয়াছ, এক্ষণে বিধানানুসারে পাপশান্তি করিবার চেষ্টা কর। পাপশান্তি বিষয়ে ব্রাহ্মণেরাই তোমার আশ্রয় হইবেন। ব্রাহ্মণের প্রতি ক্রোধপ্রকাশে পরাঙ্মুখ হইলে এবং ধর্ম্মের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া পাপকার্য্যে অনুতাপ করিলেই পরলোকে মঙ্গললাভ হইয়া থাকে।
“জনমেজয় কহিলেন, ভগবন্! আমি পাপের নিমিত্ত অনুতাপ ও যাহাতে ধৰ্ম্ম উচ্ছিন্ন না হয়, সতত তদ্বিষয়ে যত্ন করিয়া থাকি। এক্ষণে আমি মঙ্গললাভার্থে আপনার নিকট বারংবার প্রার্থনা করিতেছি, আপনি আমার প্রতি প্রসন্ন হউন।
‘ইন্দ্রোত কহিলেন, ‘মহারাজ! তুমি অহঙ্কার ও অভিমান পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমার প্রতি প্রীতি প্রদর্শন কর এবং ধর্ম্মানুসারে যাহাতে সকলের হিতসাধন হয়, তদ্বিষয়ে যত্নবান্ হও। আমি ভয়, কার্পণ্য বা লোভপরতন্ত্র না হইয়া কেবল ধৰ্ম্মের নিমিত্তই তিরস্কার করিতেছি। এক্ষণে তুমি ব্রাহ্মণগণসমভিব্যাহারে আমার সত্য উপদেশ শ্রবণ কর। তোমাকে উপদেশ প্রদান করিলে লোকে আমাকে পাপিষ্ঠসংগৃহীত এবং কেহ কেহ বা অধাৰ্ম্মিক বলিয়া দূষিত করিবে, আমার বন্ধুবান্ধবগণও আমার প্রতি অতিশয় অসন্তুষ্ট হইয়া আমাকে পরিত্যাগ করিবেন; কিন্তু প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা, আমি ব্রাহ্মণগণের হিতসাধনার্থেই এই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিয়াছি, ইহা সুস্পষ্ট অবগত হইবেন। অতএব আমি অজ্ঞ ব্যক্তিদিগের অনাদরে কিছুমাত্র বিষণ্ন না হইয়া তোমাকে উপদেশ প্রদান করিব। ব্রাহ্মণের রক্ষাবিধানই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য। অতএব এক্ষণে যাহাতে তাঁহারা আমার সাহায্যে শ্ৰেয়োলাভ করিতে সমর্থ হয়েন, তুমি তদ্বিষয়ে যত্নবান্ হও এবং আর কখন তাঁহাদিগের অনিষ্টাচরণ করিবে না বলিয়া প্রতিজ্ঞা কর।’ জনমেজয় কহিলেন, ‘ভগবন্! আমি আপনার চরণ স্পর্শ করিয়া শপথ করিতেছি যে, আর আমি কদাচ কায়মনোবাক্যে ব্রাহ্মণের অনিষ্টাচরণ করিব না।’ ”