১৫০তম অধ্যায়
দুর্য্যোধনের সবিলাপ ত্রাস
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এদিকে আপনার আত্মজ দুর্য্যোধন সিন্ধুরাজের নিধনদর্শনে শত্রুজয়ে উৎসাহশূন্য ও নিতান্ত বিমনায়মান হইয়া বাষ্পকুললোচনে দীনবদনে ভগ্নদন্ত [বিষদভগ্ন] ভুজঙ্গের ন্যায় দীর্ঘনিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তিনি মহাবীর অর্জ্জুন, ভীম ও সাত্যকির শরনিকরপ্রভাবে আপনার সৈন্যগণের সংহার নিরীক্ষণপূর্ব্বক বিবর্ণ, কৃশ ও একান্ত দীনভাবাপন্ন হইয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, ‘এই পৃথিবীতে অর্জ্জুনের তুল্য যোদ্ধা আর নাই। সে ক্রোধাবিষ্ট হইলে কি দ্রোণ, কি কৃপ, কি কর্ণ, কি অশ্বত্থামা, কেহই তাহার সর্মুখে অবস্থান করিতে সমর্থ হন না। মহাবীর পার্থ আমার পক্ষীয় সমুদয় মহারথকে পরাজিত করিয়া সিন্ধুরাজ জয়দ্রথকে সংহার করিল; কিন্তু কেহই তাহাকে নিবারণ করিতে পারিলেন না। এক্ষণে পাণ্ডবগণ নিশ্চয়ই আমার বিপুল বল বিনষ্ট করিবে; সাক্ষাৎ সুররাজ ইন্দ্রও উহাদিগকে রক্ষা করিতে পারিবেন না। আমরা যাঁহাকে আশ্রয় করিয়া শস্ত্র সমুদ্যত করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়াছি, সেই মহারথ কর্ণকে অর্জ্জুন সমরে পরাজিত করিয়া জয়দ্রথকে নিহত করিল। আমি যাঁহার বলবীৰ্য্য আশ্রয় করিয়া সন্ধিস্থাপনলালস বাসুদেবকে তৃণজ্ঞান করিয়াছিলাম সেই মহারাজ কর্ণ আজ সমরে পরাজিত হইয়াছেন।’
“হে মহারাজ! রাজা দুৰ্য্যোধন এইরূপ কলুষিতচিত্ত হইয়া দ্রোণকে সন্দর্শন করিবার বাসনায় তৎসন্নিধানে গমনপূর্ব্বক বিজয়বাসনাপরবশ ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের বিনাশ ও পাণ্ডবগণের বিজয়বৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত কীৰ্ত্তন করিয়া কহিলেন, “হে আচার্য্য! অস্মৎপক্ষীয় মহীপালগণের বিনাশ অবলোকন করুন। তাঁহারা যে মহাবীর ভীষ্মকে সম্মুখবৰ্ত্তী করিয়া সমরে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন, শিখণ্ডী তাঁহাকে সংহারপূর্ব্বক পূর্ণমনোরথ ও বিজয়ান্তর লাভে একান্ত লোলুপ হইয়া পাঞ্চালগণসমভিব্যাহারে সেনামুখে অবস্থান করিতেছে। ধনঞ্জয় আপনার শিষ্য, নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ, সাত অক্ষৌহিণীর সেনা-সংহর্ত্তা, মহাবীর জয়দ্রথকে নিহত করিয়াছে। হে আচাৰ্য্য! এক্ষণে আমি কিরূপে আমাদিগের বিজয়াভিলাষী উপকারনিরত, যমসদনে প্রস্থিত সুহৃদ্গণের ঋণ হইতে মুক্ত হইব? যেসকল ভূপালগণ আমাকে রাজ্য প্রদান করিতে অভিলাষ। করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহারই সমস্ত ঐশ্বৰ্য্য পরিত্যাগপূর্ব্বক, শরাসনে শয়ান রহিয়াছেন। আমি অতি কাপুরুষ। আমি এইরূপে মিত্রগণকে মৃত্যুমুখে নিপাতিত করিয়াছি। এক্ষণে সহস্র অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করিলেও আমার এই পাপ ধ্বংস হইবে না। আমি অতি লুব্ধস্বভাব ও পাপপরায়ণ; নৃপতিগণ আমারই নিমিত্ত যুদ্ধে জয়লাভার্থী হইয়া কালকবলে নিপতিত হইয়াছেন। এক্ষণে বসুন্ধরা কেন এই মিত্রদ্রোহী পাপাত্মাকে স্থানপ্রদানার্থ বিদীর্ণ হইতেছেন না? আরক্তলোচন নিতান্ত দুর্দ্ধর্ষ মহাবীর ভীষ্ম ভূপালগণমধ্যে আমাকে কি বলিবেন? হে মহারথ! সাত্যকি প্রাণপণে যুদ্ধ করিয়া আমার কাৰ্য্যসাধনার্থ সমুদ্যত মহাবলপরাক্রান্ত জলসন্ধকে বিনাশ করিয়াছে। হায়! অদ্য কাম্বোজরাজ, অলম্বুষ ও অন্যান্য সুহৃদগণকে নিহত নিরীক্ষণ, করিতে হইল। আর আমার প্রাণধারণের আবশ্যক কি? যাহা হউক, এক্ষণে যে সমস্ত বীরেরা আমার বিজয়লাভার্থ সাধ্যানুসারে যত্নবান্ হইয়া সমরে কলেবর পরিত্যাগ করিয়াছেন, আজ আমি স্বীয় বিক্রম প্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহাদের নিকট ঋণশূন্য হইয়া যমুনায় গমন ও তাঁহাদের উদ্দেশ্যে জলাঞ্জলি প্রদান করিয়া তাঁহাদিগের তৃপ্তিসাধন করিব। আমি ইষ্টাপুর্ত্ত, বলবীৰ্য্য ও পুত্রের শপথ করিতেছি যে, আমি হয় পাণ্ডবগণকে পাঞ্চালদিগের সহিত বিনাশ করিয়া শান্তিলাভ করিব, না হয় তাহাদের শরে নিহত হইয়া আমার কাৰ্য্যসাধনার্থ নিহত ভূপতিগণের সলোকতা প্রাপ্ত হইব। আমার সাহায্যদানে প্রবৃদ্ধ বীরপুরুষেরা যথোচিত রক্ষিত না হইয়া এক্ষণে আর আমাদের পক্ষ অবলম্বন করিতে অভিলাষ করেননা। তাঁহারা আমাদের অপেক্ষা পাণ্ডবগণের আশ্রয়গ্রহণ নিতান্ত শ্রেয়স্কর বলিয়া বিবেচনা করিতেছেন। হে আচাৰ্য্য! আপনি সংগ্রামে আমাদিগের তৃপ্তিসাধন করুন। আমি ইষ্টাপুৰ্ত্ত, বলবীৰ্য্য আপনি অর্জ্জুনকে শিষ্য বলিয়া উপেক্ষা প্রদর্শন করাতে আমাদিগের বিজয়াভিলাষী বীরগণ বিনষ্ট হইতেছে। এক্ষণে কেবল কর্ণকে আমাদিগের জয়ার্থী বলিয়া বোধ হইতেছে। হে ব্রহ্মন্! মন্দবুদ্ধি ব্যক্তি যেমন যথার্থ বন্ধু অবগত না হইয়া তাহার নিমিত্ত জয়াভিলাষ করিয়া স্বয়ং অবসন্ন হয়, আমার সুহৃদ্গণ আমার নিমিত্ত তদ্রূপ হইতেছেন। আমি অতি মূঢ়, পাপাশয়, কুটিল হৃদয় ও ধনলোভী। আমার নিমিত্তই মহাবীর সিন্ধুরাজ, ভূরিশ্রবা এবং অভীষাহ, শূরসেন, শিবি ও বসাতিগণ অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রাম করিয়া বিনষ্ট হইয়াছেন। অতএব আজ আমি সেই সকল মহাত্মাদিগের অনুগমন করিব। যখন তাঁহাদিগের মৃত্যু হইয়াছে, তখন আমার আর জীবনধারণ করিবার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই। হে পাণ্ডবগণের আচাৰ্য্য! আমি উক্ত মহাবীরগণের অনুগমনে নিতান্ত উৎসুক হইয়াছি, আপনি আমাকে তদ্বিষয়ে অনুজ্ঞা প্রদান করুন।