১৫০তম অধ্যায়
কামরূপী হনূমানের পূর্ব্বরূপ প্ৰদৰ্শন
ভীমসেন কহিলেন, “হে মহাত্মন! আমি আপনার পূর্ব্বরূপ অবলোকন না করিয়া কদাচ গমন করিব না, অতএব অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়া আমাকে পূর্ব্বরূপ প্রদর্শন করনও।”
হনূমান ভীমসেনের বাক্য-শ্রবণানন্তর ঈষৎ হাস্য করিয়া তাঁহার প্রিয়ানুষ্ঠানের নিমিত্ত যেরূপ পূর্ব্বে সাগর-লঙ্ঘন করিয়াছিলেন, সেইরূপ ধারণ করিলেন; তখন তাহার দেহ পূর্ব্বাপেক্ষা অধিকতর বৰ্দ্ধিত হইয়া বিস্তারে কদলীখণ্ড আচ্ছাদন [কদলীবৃক্ষের পত্ৰসমূহে যতদূর স্থান ব্যাপ্ত থাকে, উক্ত পরিমাণ] ও দৈর্ঘ্যে পর্ব্বত অতিক্ৰম করিল। তিনি দ্বিতীয় পর্ব্বতের ন্যায় দণ্ডায়মান রহিলেন। তাঁহার নয়নদ্বয় তাম্রবর্ণ, তীক্ষ্ণ, মুখমণ্ডল ভ্রূকুটিবদ্ধ ও লাঙ্গুল চতুর্দ্দিকে ব্যাপ্ত হইল।
কুরুবংশাবতংস ভীমসেন হনূমানের সেই অর্কসদৃশ তেজঃসম্পন্ন, সুবৰ্ণ-পর্ব্বতের ন্যায় প্রদীপ্ত, আকাশের ন্যায় ভীষণ রূপ-সিন্দর্শনে এককালে হৰ্ষবিস্ময়ে পরিপূর্ণ হইয়া নেত্ৰনিমীলন করিলেন। তখন কপিবরাগ্রগণ্য হনূমান হাস্য করিয়া ভীমসেনকে কহিতে লাগিলেন, ‘ভ্ৰাতঃ! আমি যত ইচ্ছা করি, তত অধিক বর্দ্ধিত হইতে পারি, কিন্তু তাহা হইলে তুমি আমার রূপ-সিন্দর্শনে অসমর্থ হইবে। হে ভীম! শত্রুগণসমক্ষে আমার কলেবর ইহা অপেক্ষাও সমধিক বদ্ধিত হয়।”
পবননন্দন ভীমসেন সেই বিন্ধ্যপর্ব্বতসন্নিভ অতি ভয়ানক হনূমানের শরীর-সন্দর্শনে লোমাঞ্চিত—কলেবর হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে তাহাকে কহিলেন, “হে প্ৰভো! আপনার শরীরের বিপুলতা দেখিলাম, এক্ষণে দেহসঙ্কোচ করুন। আমি মৈনাকপর্ব্বতের ন্যায় সমুদিত দিবাকরসদৃশ তোমার শরীর আর নিরীক্ষণ করিতে পারি না। এক্ষণে আমার মনে এই বিস্ময় সমুদিত হইতেছে যে, তুমি সর্ব্বদা রামের পার্শ্বে থাকিতে, তবে কি নিমিত্ত তিনি স্বয়ং রাবণকে বধ করিয়াছিলেন! তুমি একাকী স্বীয় বাহুবলে সযোদ্ধা সবাহনা সমুদয় লঙ্কা বিনষ্ট করিতে সমর্থ। হে পবনতনয়! তোমার কিছুই অপ্রাপ্য নাই, রাবণ ও তাহার সমুদয় অনুচরগণ তোমার সমক্ষে পৰ্য্যাপ্ত নহে।”
প্লবগোত্তম হনূমান ভীমসেনের বাক্য-শ্রবণানন্তর স্নিগ্ধগভীরস্বরে কহিতে লাগিলেন, “হে মহাবাহো! তুমি যথার্থ কহিয়াছ, রাক্ষসাধম রাবণ বস্তুতঃই আমার পক্ষে পৰ্যাপ্ত নহে। কিন্তু যদি আমি সেই লোককণ্টক দশাননের প্রাণসংহার করিতাম, তাহা হইলে রঘুবংশাবতংস রামের কীর্ত্তি লোপ হইত এই নিমিত্তই আমি স্বয়ং রাবণবধে উপেক্ষা করিয়াছিলাম, মহাবীর রাম দশানন ও তাহার অনুচরগণের প্রাণসংহার করিয়া জানকীকে স্বপুরে আনয়ন করাতে লোকমধ্যে তাঁহার অনুপম কীর্ত্তি সংস্থাপিত হইয়াছে।”
ভীমের প্রতি হনূমানের বিবিধ উপদেশ
“হে মহাত্মন! তুমি স্বীয় ভ্রাতা ধর্ম্মরাজের প্রিয়চিকীর্ষু ও যথার্থ হিত্যাভিলাষী, এক্ষণে গমন কর, পথে তোমার কিছুমাত্ৰ বিঘ্ন হইবে না, গমনকালে বায়ু তোমাকে রক্ষা করিবেন, সৌগন্ধিকবনে গমন করিবার এই পথ, এই পথে গমন করিলে কুবেরের যক্ষরাক্ষসরক্ষিত উদ্যান অবলোকিত হইবে; কিন্তু তথায় বলপূর্ব্বক পুষ্পবচয়ন করিও না। দেবগণ মনুষ্যদিগের মান্য, তাহারা বলি, হোম, নমস্কার, মন্ত্র ও ভক্তিদ্বারা প্ৰসন্ন হয়েনি। হে ভ্ৰাতঃ! সাহস পরিত্যাগপূর্ব্বক স্বধর্ম্ম প্রতিপালন কর। স্বধর্ম্মস্থ হইয়া সনাতনধর্ম্মের যথার্থ অন্বেষণ ও অনুষ্ঠান কর। বৃহস্পতিসমান ব্যক্তিগণও প্রথমতঃ ধর্ম্ম না জানিয়া ও বৃদ্ধগণের সেবা না করিয়া কোনমতেই ধর্ম্মার্থের যথার্থ্য বুঝিতে পারেন না। যে স্থানে অধর্ম্ম ধর্ম্ম বলিয়া ও ধর্ম্ম অধর্ম্ম বলিয়া নিৰ্দ্ধারিত হইয়াছে, তথায় বিশেষ বিবেচনাপূর্ব্বক ধর্ম্মের অবধারণ করিতে হইবে, মূঢ়গণ ঐপ্রকার ধর্ম্মাবধারণে নিতান্ত অসমর্থ। আচার হইতে ধর্ম্মের সম্ভব হইয়াছে, বেদ সকল ধর্ম্মে প্রতিষ্ঠিত আছে, বেদ হইতে যজ্ঞসমুদয় সমুৎপন্ন হইয়াছে এবং দেবগণ যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। দেবগণ বেদাচারবিধানোক্ত যজ্ঞ এবং মনুষ্যগণ বৃহস্পতি ও শুক্রের নীতি অবলম্বন করিয়া আছেন। পৃথিবীস্থ সমুদয় লোক সেবা, বাণিজ্য, কৃষি এবং পশুপালন প্রভৃতি জীবিকাদ্বারা জীবনধারণ করিতেছে। ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যগণ ত্ৰয়ী, বাৰ্ত্তা ও দণ্ডনীতি অবলম্বন করিয়া আছেন, যাহারা এই ত্ৰিবিধ বিদ্যায় অভিজ্ঞতালাভ করিয়াছেন, তাঁহারা উহা সম্যকরূপে প্রয়োগ করিয়া অনায়াসে লোকযাত্ৰা নির্ব্বাহ করেন, ত্ৰয়ী না থাকিলে জগতে ধর্ম্মের সম্পর্কও থাকিত না, দণ্ডনীতির অভাবে সমুদয় জগৎ বিশৃঙ্খল হইত ও বার্ত্তাবিরহে প্ৰজাগণ বিনষ্ট হইয়া যাইত। কিন্তু এই তিনটি বিদ্যা সম্যকরূপে প্ৰযুজ্যমান হইলে প্ৰজাগণ ধর্ম্মপরায়ণ হয়।
“তত্ত্বজ্ঞান ব্রাহ্মণগণেরই প্রধান ধর্ম্ম; উহাতে অন্য কাহারও অধিকার নাই। যজ্ঞ, অধ্যয়ন ও দান এই তিনটি সর্ব্ববর্ণের সাধারণ ধর্ম্ম; যাজন, অধ্যাপন ও প্রতিগ্রহ ইহাও ব্রাহ্মণের ধর্ম্ম, ক্ষত্ৰিয়ের ধর্ম্ম পালন ও বৈশ্যের ধর্ম্ম পোষণ আর কেবল দ্বিজাতিগণের শুশ্রূষাই শূদ্রদিগের ধর্ম্ম। গুরুসেবী শূদ্রগণের ভৈক্ষ্য, হোম ও ব্রতে অধিকার নাই। ক্ষত্ৰিয়ের প্রধান ধর্ম্ম রক্ষণ; উহা তোমারও অবশ্য কর্ত্তব্য। লোকে বুদ্ধিমান, শ্রাতশীল, বৃদ্ধ ও সজ্জনগণের সহিত পরামর্শ করিয়া সকলের অনুগৃহীত হইয়া অনায়াসে দণ্ডদ্বারা শাসন করে; কিন্তু ব্যসনী হইলে অবশ্যই পরাভবপ্রাপ্ত হয়। রাজা নিগ্রহ ও অনুগ্রহে সম্যক প্রবৃত্ত হইলে লোকমৰ্যাদা সুব্যবস্থিত থাকে, অতএব ভূপতিগণ সতত চরদ্বারা শত্ৰুগণের দুর্গ ও বল এবং আপনার দেশ, দুর্গ, সিদ্ধিরক্ষা, বৃদ্ধি ও ক্ষয় বিশেষরূপে অবগত হইবেন। চর, বুদ্ধি, মন্ত, পরাক্রম, নিগ্রহ ও অনুগ্রহ ভূপতিগণের উপায় আর দক্ষতা এক প্রধান কাৰ্য্যসাধক। সাম, দান, ভেদ, দণ্ড ও উপেক্ষা এই সমুদয় উপায় একত্র বা পৃথক পৃথক প্রযুক্ত হইয়া কাৰ্য্যসাধন করে, কিন্তু মন্ত্রণাই এই সকলের মূল; মন্ত্রণা ব্যতীত কি নীতি, কি চর, কিছুতেই কাৰ্য্যসিদ্ধি হয় না। মন্ত্রণাদ্বারা যে বিষয়ের সিদ্ধি হইবার সম্ভাবনা, ব্রাহ্মণের সহিত তাহার মন্ত্রণা করিবে। স্ত্রী, বালক, বৃদ্ধ, লঘুচেতাঃ ও উন্মাদলক্ষণাক্রান্ত ব্যক্তিদিগের সহিত কদাচি গৃঢ় মন্ত্রণা করিবে না। বিদ্বানের সহিত মন্ত্রণা, সমর্থ ব্যক্তিদ্বারা কর্ম্মসাধন ও হিতেচ্ছু ব্যক্তির সহিত নীতিবিদ্যার আলোচনা করিবে। মূখ্যগণকে সকল বিষয়েই পরিত্যাগ করা কর্ত্তব্য। ধর্ম্মকাৰ্য্যে ধামিক, অর্থকাৰ্য্যে পণ্ডিত, স্ত্রীলোকের নিকটে কীব ও ক্রুরকর্ম্মে ক্রুরগণকে নিয়োগ করবে। কোন কর্ম্ম উপস্থিত হইলে উহা চর বা পরের কর্ত্তব্য কি অকর্ত্তব্য, ইহা বিবেচনা করিবে এবং বুদ্ধিপ্রভাবে রিপুগণের বলাবল পরীক্ষা করিবে। শরণাগত সাধু ব্যক্তির প্রতি অনুগ্রহপ্রদর্শন করিয়া অশিষ্ট ও উচ্ছঙ্খল ব্যক্তিদিগের দণ্ডদান করিবে। রাজা এইরূপ নিগ্রহ ও অনুগ্রহে সম্যক প্রবৃত্ত হইলে লোকমৰ্য্যাদা সুব্যবস্থিত থাকে।
“হে পাৰ্থ! আমি তোমাকে এই দুরবগাহ রাজধর্ম্ম কহিলাম, এক্ষণে তুমি বিনীত হইয়া স্বধর্ম্ম প্রতিপালন কর। যেমন বিপ্ৰগণ তপ, ধর্ম্ম দম ও যজ্ঞানুষ্ঠানদ্বারা স্বৰ্গলাভ করেন, যেমন বৈশ্যগণ দান ও আতিথ্যদ্বারা সদগতিপ্রাপ্ত হয়েন, তদ্রূপ ক্ষত্ৰিয়গণ কাম, দ্বেষ, লোভ ও ক্রোধবিবর্জ্জিত হইয়া সম্যক দণ্ড প্রয়োগ ও প্রজাপালন করিলে সুরপুরে গমনপূর্ব্বক সাধুলোকের সহবাসজনিত সুখ-সম্ভোগ করেন।”