১৪. স্কাউটশিপের ভেতরে ছোট টেবিল

স্কাউটশিপের ভেতরে ছোট টেবিলটার ওপর মানুষের একটা হাত, সেটি শুকিয়ে অস্থিচর্মসার হয়ে আছে, কিন্তু তারপরেও বুঝতে এতটুকু সমস্যা হয় না যে হাতটি মানুষের। রায়ীনার গুলিতে হাতটি শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে কিন্তু যে ব্যাপারটা তারা বুঝতে পারছে না সেটি হচ্ছে যে হাতটি এখনো জীবন্তু। তার আঙুলগুলো নড়ছে এবং মাঝে মাঝেই সেটা উল্টে যাওয়ার চেষ্টা করে। যতবার এটা উপুড় হয়েছে ততবার সেটা তার আঙুলগুলো দিয়ে খামচে খামচে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধু তাই নয়, ধরে ফেলার মতো কোনো কিছু পেলে হাতটা সেটা শক্ত করে ধরে ফেলে এবং তখন সেটাকে ছুটিয়ে নিতে যথেষ্ট কষ্ট হয়। য়ুহা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে এই কাটা হাতটির দিকে তাকিয়ে থাকে, আঙুল দিয়ে খামচে খামচে সেটা টেবিলের কিনারা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, য়ুহা হাত দিয়ে ঠেলে সেটাকে টেবিলের মাঝামাঝি এনে বলল, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না একটা হাত কেমন করে জীবন্ত থাকে।

রায়ীনা কোনো একটা ভাবনায় ড়ুবে ছিল, এবারে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা হাত আলাদাভাবে জীবন্ত থাকে না।

এই যে থাকছে। নাড়াচাড়া করছে।

রায়ীনা হাসার চেষ্টা করে বলল, নাড়াচাড়া করে মানে জীবন্ত থাকা নয়! অনেক রকেট, মহাকাশযান, বাইভার্বাল নাড়াচাড়া করে, তার মানে এই নয় যে সেগুলো জীবন্ত।

তুমি বলছ এটা জীবন্ত না?

আমার তা-ই ধারণা।

তাহলে এটা কেমন করে নড়ছে?

এটাকে নাড়ানো হচ্ছে।

কে নাড়াচ্ছে? কীভাবে নাড়াচ্ছে?

রায়ীনা মুখে হাসি টেনে বলল, এতক্ষণ পর তুমি একটা সত্যিকারের প্রশ্ন করেছ। কে নাড়াচ্ছে এবং কীভাবে নাড়াচ্ছে। আমাদের সেটা খুঁজে বের করতে হবে।

তার মানে তুমি বলতে চাইছ–

রায়ীনা মাথা নাড়ল, আমি আসলে এখনো কিছুই বলতে চাইছি না। তবে তুমি যদি খুব বিরক্ত না হও তাহালে খানিকক্ষণ জোরে জোরে চিন্তা করতে পারি।

করো। জোরে জোরে চিন্তা করো, তোমার চিন্তাটা শুনি।

তোমাকে যখন প্রাণীগুলো আক্রমণ করল তখন সেখানে আবছা অন্ধকারে পরিষ্কার করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না, তার পরেও মনে হচ্ছিল প্রাণীগুলোর হাত-পা আছে, শরীর আছে, মাথা আছে। মাথায় নাক মুখ চোখ আছে কী না আমরা এখনো জানি না। অন্ধকারের মাঝে গুলি করে শরীরের একটা অংশ আমরা আলাদা করে ফেলেছি—সেটা হচ্ছে একটা হাত। কাজেই মোটামুটি নিশ্চিত যে প্রাণীগুলো আসলে মানুষের আকৃতির।।

তার মানে তুমি বলছ এখানে মহাজাগতিক প্রাণী নেই, আছে মানুষ–

রায়ীনা বলল, আমি যখন তোমার সাথে কথা বলব তখন তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে পারবে। এখন আমি চিন্তা করছি। চিন্তার ভেতরে কেউ প্রশ্ন করতে পারে না!

ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কর। আমি আর প্রশ্ন করব না।

হাতটা যেহেতু মানুষের, তার মানে শরীটাও মানুষের। কিন্তু আমরা জানি মানুষের শরীর অত্যন্ত কোমল একটা জিনিস। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, নির্দিষ্ট চাপ এবং সুনির্দিষ্ট পরিবেশ না থাকলে সেটা বেঁচে থাকতে পারে না। তাকে কিছুক্ষণ পরপর খেতে হয়। তাকে প্রতি মুহূর্তে ফুসফুসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন নিতে হয়, সেটা রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে দিতে হয়—এ রকম নানা ধরনের ঝামেলা আছে।

রায়ীনা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমরা জানি এই গ্রহটির তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি, বায়ুমণ্ডল বলতে গেলে নেই এবং যেটুকু আছে সেখানে অক্সিজেনের কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের দুজনকে দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই গ্রহটিতে বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের কী বেটপ একটা পোশাক পরে থাকতে হচ্ছে কিন্তু এই মানুষগুলোর কোনো পোশাক নেই—বাতাসবিহীন, অক্সিজেনবিহীন শীতল একটা গ্রহে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সেটা হতে পারে শুধু একটি উপায়ে–

কী উপায়ে? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে য়ুহা থেমে গেল, রায়ীনার চিন্তার প্রক্রিয়াটাতে সে বাধা দিতে চায় না।

রায়ীনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সেটা হতে পারে যদি আসলে মানুষগুলো হয় মৃত!

মৃত? মাঝখানে কথা বলার কথা নয় জেনেও য়ুহা নিজেকে সামলাতে পারল না।

হ্যাঁ। মৃত। কিন্তু মৃত মানুষ হাঁটে না, চলাফেরা করে না, কাউকে আক্রমণ করে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে না। কাজেই অনুমান করছি এই মৃত মানুষগুলোকে অন্য কেউ চালাচ্ছে। তার স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এই কাটা হাতটা। দেখা যাচ্ছে এটা এখনো নিজে নিজে চলছে।

আমি অনুমান করছি এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে এবং আমার অনুমান সত্যি কী না সেটা খুব সহজেই পরীক্ষা করে দেখা যায়। যদি এই হাতটা বৈদ্যুতিক পরিরাহী কিছু দিয়ে আমরা ঢেকে দিই তাহলে এর মাঝে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ পৌঁছাতে পারবে না। তখন নাড়াচাড়াও করতে পারবে না।

রায়ীনা স্কাউটশিপের জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, এই জানালায় পাতলা মাইলারের ওপর বৈদ্যুতিক পরিরাহী স্বর্ণের একটা সূক্ষ্মা স্তর আছে। আমার অনুমান সত্যি হলে আমরা এটা দিয়ে হাতটা যদি মুড়ে দিই তাহলে হাতটা নাড়াচাড়া করা বন্ধ করে দেবে।

য়ুহা চোখ বড় বড় করে বলল, তোমার জোরে জোরে চিন্তা করা শেষ?

হ্যাঁ।

তাহলে আমরা এই মাইলার আর স্বর্ণের আবরণ দিয়ে হাতটাকে মুড়ে দেব?

হ্যাঁ। এলুমিনিয়ামের ফয়েল দিয়েও করা যেত কিন্তু এই স্কাউটশিপে সেটা খুঁজে পাব বলে মনে হয় না।

য়ুহা জানালা থেকে মাইলারের পর্দাটুকু খুলে আনে, সেটা দিয়ে হাতটাকে মুড়ে দিতেই হঠাৎ করে কাটা হাতটা স্থির হয়ে গেল। য়ুহা চোখ বড় বড় করে বলল, তোমার অনুমান সত্যি, রায়ীনা! তোমাকে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।

রায়ীনা নিচু গলায় বলল, বোঝা যাচ্ছে তুমি মুগ্ধ হবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাক! তোমাকে মুগ্ধ করা খুব কঠিন নয়। যাই হোক, আমাদের পরীক্ষাটা সম্পূর্ণ করার জন্যে কাটা হাতটার ওপর থেকে স্বর্ণের আবরণ দেয়া মাইলারের পর্দাটা আবার খুলে ফেলতে হবে, তাহলে কাটা হাতটা আবার নাড়াচাড়া করতে শুরু করবে।

য়ুহা বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। দেখি তো। সে বেশ উৎসাহ নিয়ে মাইলারের পর্দাটা খুলে ফেলল এবং প্রায় সাথে সাথেই হাতটা নড়তে শুরু করে। য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, রায়ীনা তুমি সত্যিই অসাধারণ! এখন পর্যন্ত তোমার প্রত্যেকটা কথা সত্যি বের হয়েছে।

কথাগুলো সহজ ছিল সে জন্যে!

এবারে তুমি বল এই মহাকাশের প্রাণীটা সম্পর্কে। যে প্রাণীটা এই মৃত মানুষগুলোকে নাড়াচাড়া করাচ্ছে সেটা কী রকম? তাদের কী অক্টোপাসের মতো শুড় আছে? অনেকগুলো চোখ? মাকড়সার মতো অনেকগুলো পা? কী খায়?

রায়ীনা মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। আমার কী মনে হয় জানো?

কী?

আসলে এখানে কোনো মহাকাশের প্রাণী নেই!

য়ুহা চোখ কপালে তুলে বলল, মহাকাশের প্রাণী নেই?

না। এখানে হয়তো মানুষের একটা বসতি ছিল, কিংবা কোনো একটা মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে মহাকাশচারীরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সাথে ছিল কোনো ধরনের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক, সেই কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক ধীরে ধীরে সবকিছু দখল করে নিয়েছে। সেটা ধীরে ধীরে আরো ক্ষমতাশীল হয়েছে, মানুষগুলো যখন মারা গেছে তখন তাদের মৃতদেহ ব্যবহার করতে শুরু করেছে।

য়ুহা অবাক হয়ে বলল, তুমি সত্যিই তা-ই মনে করো?

হ্যাঁ। আমার তা-ই ধারণা।

কেন? তোমার এ রকম ধারণা কেন হলো?

দেখছ না এই প্রাণীগুলোর প্রযুক্তি ঠিক আমাদের মতন। যদি একেবারে ভিন্ন ধরনের বুদ্ধিমান প্রাণী হতো তাহলে তাদের প্রযুক্তি হতো একেবারে অন্য রকম। হয়তো বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে যোগাযোগ না করে যোগাযোগ করত নিউট্রিনো বীম দিয়ে। হয়তো মানুষের দেহ ব্যবহার করে অন্য কিছু ব্যবহার করত।

য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, তোমার কথায় এক ধরনের যুক্তি আছে।

রায়ীনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, শুধু যুক্তি থাকলেই হয় না। আমি দেখেছি জীবনে যে সব ব্যাপার ঘটে তার বেশির ভাগেরই কোনো যুক্তি নেই!

এ রকম কেন বলছ?

আমার দিকে দেখ? আমার কি একটা গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করে এখন এই গ্রহে আটকা পড়ার কথা ছিল? আমার জন্ম হয়েছিল একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে হিসেবে। আমি বড় হয়েছি জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিবেশে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে। অথচ এখন আমার বন্ধু মহাজগতের বড় বড় গেরিলারা। আমি যুদ্ধ করতে পারি, আমার প্রাণের বন্ধু মারা গেলেও আমি চোখ থেকে এক ফোটা পানি ফেলি না। আমার বুকের ভেতরটা এখন পাথরের মতো কঠিন।

য়ুহা আস্তে আস্তে বলল, আসলে মানব জাতির পুরো ইতিহাসটাই হচ্ছে এ রকম। মানুষের একটা গোষ্ঠী সবকিছু নিয়ে নিচ্ছে। অন্য গোষ্ঠী তার প্রতিবাদ করছে। সেটা নিয়ে বিরোধ। সংঘর্ষ। যুদ্ধ। যে জিনিসটি খুব সহজে মেনে নেয়া যায় সেটি কেউ মানছে না–একজনের সাথে আরেকজন শুধু শুধু যুদ্ধ করছে।

রায়ীনা বিষণ্ণ গলায় বলল, মাঝে মাঝে আমি এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করি। মনে হয় অস্ত্রটা ভাঁজ করে রেখে একটা ল্যাবরেটরিতে খানিকটা সময় কাটাই।

য়ুহা নরম গলায় বলল, নিশ্চয়ই তুমি একসময় তোমার অস্ত্রটা ভজ করে রেখে ল্যাবরেটরিতে ঢুকবে। নিশ্চয়ই ঢুকবে।

রায়ীনা কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের ছত্রিশ ঘণ্টার কত ঘণ্টা পার হয়েছে য়ুহা।

বেশি না, খুব বেশি হলে মাত্র বারো ঘণ্টা।

রায়ীনা স্কাউটশিপের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, উপরে কুচকুচে কালো আকাশ, সেই আকাশে এই মুহূর্তে একটি মহাকাশযান এই গ্রহটাকে ঘিরে ঘুরছে। তার দলের মানুষেরা এই মুহূর্তে হয়তো সেই মহাকাশযানটা দখল করার চেষ্টা করছে। তারা কি পারবে দখল করতে? তারপর তারা কি আসবে তাদের এই ভয়ঙ্কর গ্রহ থেকে উদ্ধার করতে? যদি কেউ না আসে?

রায়ীনা জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল।