সুবীর বলে ওঠে ঐ সময়, আমি হলপ করে বলতে পারি মিঃ রায়, রামদেও-ই কাকাকে সেরাত্রে হত্যা করেছে। আপনারও কি তাই মনে হয় না!
হোয়াই ইউ আর সো সার্টেন সুবীরবাবু? কিরীটী মৃদু হেসে পালটা প্রশ্ন করে।
কারণ কাকার সঙ্গে রামদেওর যুবতী স্ত্রীর ইল্লিসিটু কনেকশন ছিল।
সেই কারণেই আপনাদের মনে হয় সে হত্যা করেছে তার মনিবকে?
নিশ্চয়! কে সহ্য করতে পারে–মানে কোন্ পুরুষ সহ্য করতে পারে বলুন নিজের স্ত্রীকে অন্যের শয্যাসঙ্গিনী হতে দেখলে রাতের পর রাত?
আপনার ভুলও তো হতে পারে সুবীরবাবু?
ভুল! না, ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। অন্ততঃ আমি রামদেও হলে তো পারতাম না।
খুন করতেন, তাই না?
খুন? সুবীর যেন চমকে ওঠে।
হ্যাঁ–খুন। সুবিনয়বাবু, আপনি?
জানি না।
যাক সে কথা। আপনারও কি সুবীরবাবুর মতই মনে হয় কাজটা রামদেওরই?
সুবীরদা যা বলেছে তাই যদি হয়—
সুবীরদার কথা থাক। আমি আপনার কথা জানতে চাইছি।
মানুষ মনের ঐ অবস্থায়—
হত্যাও করতে পারে। আচ্ছা শমিতা দেবী সম্পর্কে আপনার কি ধারণা সুবিনয়বাবু?
তাঁকে তো আমি চিনি না। মানে তাঁর সঙ্গে আমার তো কোন আলাপ–পরিচয় নেই।
চেনেন না–মানে তাঁর সঙ্গে হয়ত আপনার কোন আলাপ–পরিচয় নেই সত্যি, কিন্তু দেখেছেন তো তাঁকে বহুবার। তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছেনও।
এখানে তিনি প্রায়ই আসতেন। কখনও-সখনও দেখেছি।
আপনার মামার সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল?
ছিল বলেই শুনেছি।
শোনেননি তাঁকে আপনার মামা বিবাহ করবেন বলে স্থির করেছিলেন?
না।
কিন্তু তাঁর সঙ্গে যে গগনবিহারীবাবুর রীতিমত ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে, কথাটা কার কাছ থেকে শুনেছিলেন?
সুবীরদাই বলেছে।
আর কারো মুখে কথাটা শোনেননি?
রামদেওর মুখেও শুনেছি।
রামদেওর সঙ্গে তাহলে আপনার ঐ সব আলোচনাও হত?
কি বললেন?
বলছি হঠাৎ রামদেও সেকথা আপনাকে বলতে গে, কেন? আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন কখনও?
ঐ–মানে কথায় কথায় হঠাৎ একদিন বলেছিল রামদেও।
হুঁ। রামদেও তাহলে আপনাদের ঘরে আসত?
তা মধ্যে মধ্যে আসত বৈকি।
রামদেওর স্ত্রী রুক্মিণী আসত না?
না।
ভাল কথা সুবিনয়বাবু, আপনি আমার প্রশ্নের জবাবে পুলিসের কাছে জবানবন্দীতে বলেছেন–সেরাত্রে শমিতা দেবী নাকি রাত সাড়ে নটা পৌনে দশটা নাগাদ এ বাড়িতে এসেছিলেন!
হ্যাঁ।
আপনি তাঁকে আসতে দেখেছিলেন, না কারো মুখে শোনা কথা?
দেখেছি।
কেমন করে দেখলেন? কোথায় দেখেছিলেন?
আমি সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে মাথার যন্ত্রণার জন্য শুয়ে ছিলাম, তারপর রাত সোয়া নটা নাগাদ প্রিয়লাল ডাকতে আসে খাবার জন্য
রাত্রে বুঝি খাওয়াদাওয়া তাড়াতাড়ি সারতেন?
না। সেদিন বিকেলে এসে কোন জলখাবার খাইনি, তাই ঠাকুর আমাকে একটু আগেই খাবার জন্য ডাকতে এসেছিল।
তারপর?
খাওয়দাওয়া সেরে ঘরে ঢুকে জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই সময়ই শমিতা দেবীকে একটা ট্যাক্সিতে এসে গেটের সামনে নামতে দেখি।
সেরাত্রে কোন জ্যোৎস্না ছিল না, অন্ধকার রাত্রি–আপনার এ ঘর থেকেও গেটটা বেশ দূর, ঠিক কি করে চিনলেন যে তিনি শমিতা দেবীই?
মনে হল। তাছাড়া অত রাত্রে তিনি ছাড়া আর স্ত্রীলোক কে মামার কাছে আসতে পারে?
যুক্তির মধ্যে আপনার কোন ফাঁক নেই দেখতে পাচ্ছি। কিরীটী মৃদু হেসে কথাটা বলে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। আচ্ছা সুবিনয়বাবু, আপনি মরালী সঙ্ঘের নাম শুনেছেন?
শুনেছি।
কার কাছে–আপনার মামার কাছে, না শমিতা দেবীর কাছে?
ওদের কারো কাছেই না। তবে শুনেছি। ঠিক কার কাছে শুনেছি মনে পড়ছে না।
গেছেন কখনও সেখানে?
না।
ব্যারিস্টার সত্যেন ঘোষালকে চেনেন?
না।
তিনি মরালী সঙ্ঘের একজন বড় পেট্রন। নামটা তাঁর শোনেননি তাহলে কখনও?
না।
আমি কিন্তু ভেবেছিলাম শুনেছেন।
কেন?
কারণ শমিতা দেবীর সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল।
থাকতে পারে, কিন্তু সেকথা আমি জানব কি করে?
জানা স্বাভাবিক, কারণ শমিতা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল।
আ–আমার?
হ্যাঁ। আপনি মিথ্যে বলছেন যে তাঁর সঙ্গে আপনার কোন পরিচয় ছিল না।
শমিতা দেবী আপনাকে ঐ কথা বলেছেন? সুবিনয়ের কণ্ঠস্বরে একটা উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়–যেটা সে চাপা দিতে সক্ষম হয় না।
কিরীটী শান্ত গলায় বলে, যেমন করেই হোক আমি জেনেছি কথাটা। বলুন সত্যি কি না?
সেরকম কিছু জানাশোনা নেই, তবে—
তবে?
আমার এক বন্ধুর সুপারিশে আমার লেখা একটা নাটক ওঁরা বছরখানেক আগে ওঁদের মরালী সঙঘ থেকে নিউ এম্পায়ারে অভিনয় করেন। সেই সময় দু–চার দিন আমি রিহাশাল দেখতে গিয়েছি। সেই সময়ই দু–চারদিন দু–চারটে কথা হয়েছিল।
বন্ধুটির নাম কি?
মনোজিৎ ঘোষাল। ঐ ব্যারিস্টার সত্যেন ঘোষালের ছোট ভাই।
তবে একটু আগে যে বললেন ব্যারিস্টার সত্যেন ঘোষালকে আপনি চেনেন না?
মনোজিৎ আমার বন্ধু হলেও তার দাদার সঙ্গে আমার কোন পরিচয় নেই।
হুঁ। তাহলে আপনি একজন নাট্যকারও।
দু–চারটে নাটক লিখেছি।
আপনার মামাবাবু জানতেন কথাটা?
কোন কথা?
যে আপনার সঙ্গে শমিতা দেবীর পূর্ব হতেই পরিচয় ছিল?
না। জানতেন না।
শমিতা দেবীও কখনও বলেননি?
বলতে পারি না। তবে ব্যাপারটা এমন কিছু নয় যে তাঁকে বলতেই হবে!
তা ঠিক। আচ্ছা সুবিনয়বাবু, এবারে আমার আর একটা কথার জবাব দিন।
বলুন?
শমিতা দেবীর প্রতি আপনার কোন দুর্বলতা ছিল?
না, না–এসব কি বলছেন আপনি?
লজ্জার কি আছে এতে? সী ওয়াজ ভলাপচুয়াসলি সেক্সি! যে কোন পুরুষের পক্ষেই তাকে দেখে–বিশেষ করে তার সাহচর্যে তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া খুবই তো স্বাভাবিক। আপনার মনেও সেরকম দুর্বলতা যদি কখনও জেগেও থাকে, আপনাকে নিশ্চয়ই তার জন্য দোষ দেওয়া যায় না। কখনও কোন দুর্বলতা তাঁর প্রতি আপনার জাগেনি বলতে চান? কাম্ অন–আউট উইথ ইট!
না–না—
ঘরের মধ্যে অন্যান্য সকলে নিঃশব্দে একপাশে দাঁড়িয়ে কিরীটী ও সুবিনয়ের প্রশ্নোত্তর শুনছিল। কিরীটী যে তার আলোচনার ধারাটা কোন দিকে নিয়ে চলেছে–সত্যি কথা বলতে কি অরূপ বা সুবীর কেউই বুঝতে পারছিল না।
তীক্ষ্ণবুদ্ধি বাকপটু কিরীটী যে কোন কৌশলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে সহজ স্বচ্ছন্দভাবে কেমন করে সুবিনয়কে একেবারে কোণঠাসা করে এনেছিল ওরা সত্যিই প্রথমটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু হঠাৎ কিরীটীর শেষ প্রশ্নে অরূপ যেন সজাগ হয়ে ওঠে।
আপনার চোখমুখ, দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠস্বরই বলছে সুবিনয়বাবু–শমিতা দেবীর প্রতি আপনার দুর্বলতা ছিল। অবচেতন মনে তাঁকে ঘিরে আপনার একটা আকাঙ্ক্ষাও ছিল হয়ত।
সুবিনয়ও যেন এতক্ষণে হঠাৎ কিরীটীর শেষ প্রশ্নে সজাগ হয়ে ওঠে। শান্ত গলায় বলে, না। আপনি যদি তা ভেবে থাকেন তো মিঃ রায় সেটা আপনার ভুল।
ভুল কিরীটী রায় করেনি সুবিনয়বাবু। যাক গে সেকথা। অরূপ!
অরূপ কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, বলুন?
ওঁদের দুজনকে আর নজরবন্দী করে রাখার তোমার প্রয়োজন নেই। সুবীরবাবু, সুবিনয়বাবু–আপনারা ফ্রি।
সুবীর বললে, ধন্যবাদ।
চল অরূপ, একবার গগনবাবুর শোবার ঘরটা ঘুরে যাওয়া যাক। কিরীটী অরূপের দিকে ফিরে বললে।
চলুন।
দুজনে ওরা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ওরা দুজনে সুবীর ও সুবিনয় যেন প্রস্তরমূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কারো মুখেই কোন কথা নেই। হঠাৎ সুবীর বলে একসময়, তাহলে তোমার সঙ্গে শ্ৰীমতীর আলাপ ছিল সুবিনয়?
ডোন্ট টক ননসেন্স সুবীরদা!
কিন্তু সত্যি বল তো ব্যাপারটা কী? কিরীটীবাবু যা বলে গেলেন কেমন কেমন যেন মনে হল–
সুবীরদা, তোমারও কি মাথা খারাপ হয়েছে?
আহা, চটছ কেন সুবিনয়! ব্যাপারটা যদি ঘটেই থাকে সেটা তো এমন কিছু অঘটন নয়। বরং বলতে পার স্বাভাবিকই।
ঐ সব কথা উচ্চারণ করাও পাপ সুবীরদা।
পাপ! কেন?
তুমি জান ওঁর প্রতি মামার কি মনোভাব ছিল–
ও, এই কথা! তা কাকার তো সত্যিই মাথা খারাপ হয়েছিল। না হলে ঐ বয়সে ঐ সব কেচ্ছা কেউ করে!
ভালবাসার কোন বয়স নেই সুবীরদা।
ওটাকে ভালবাসা বলে না সুবিনয়, ওটা বিকৃত যৌন-লালসা ছিল কাকার। শ্রদ্ধেয় এবং গুরুজন হলেও কথাটা না বলে আমি পারলাম না।
ওসব আলোচনা থাক সুবীরদা। আমার সত্যিই ভাল লাগছে না।
আমি রাজীবকে বিলেতে সব লিখব।
না, না সুবীরদা। তাছাড়া রাজীবদা একদিন সব নিজে থেকেই জানতে পারবে।
তবু আমাদেরও তো কৃতজ্ঞতা বলে একটা বস্তু আছে—
কৃতজ্ঞতা!
নয়? ভেবে দেখ মামা যদি আমাদের এভাবে আশ্রয় না দিতেন?
আশ্রয় আবার কি? আমরা কিছু ভেসে যাচ্ছিলাম না! বরং এখানে এসে থাকার জন্য মিথ্যা খানিকটা লজ্জার সঙ্গে আমরা জড়িয়ে গেলাম।
লজ্জা!
নয়? ভেবে দেখ, কাকার ব্যাপারটা আর চাপা থাকবে? সবাই একদিন জানবে।
তা জানে জানুক। তাহলেও আমাদের দিক থেকে আমরা কেন অকৃতজ্ঞ হব।
তোমার যুক্তি আমি মেনে নিতে পারছি না সুবিনয়। আমি আর এখানে থাকছি না।
তুমি চলে যাবে সুবীরদা?
নিশ্চয়ই।
কিন্তু কেন?
এখানে থাকার আর কোন অধিকার নেই বলে।
সুবিনয় আর কোন কথা বলে না।