১৪. সব ভালো তার শেষ ভালো যার

এডিনবরায় যেদিন আসল চোর ধরা পড়লো, সেদিন ছিলো সতেরোই ডিসেম্বর। তখন আবার একটা হৈ-চৈ পড়ে গেলো। এতদিন ফগ একটা সাধারণ হীন দস্য হিশেবে। পরিচিত হয়েছিলেন, একমুহূর্তেই সেই কলঙ্ক অপসৃত হলো। তখন আবার লোকের মুখে-মুখে ফিরতে লাগলো ফিলিয়াস ফগের নাম। আবার আশিদিনে পৃথিবী ঘোরা নিয়ে ধরা হতে লাগলো বাজি। জগে-মা সব খবরের কাগজগুলো ফের ফগের সম্পর্কে প্রত্যেক দিন নয়া-নয়া তত্ত্বকথা আউড়ে যেতে লাগলো।

শনিবার, একুশে ডিসেম্বর সন্ধ্যা হতেই রিফর্ম ক্লাবের আশপাশ লোকে-লোকারণ্য হয়ে গেলো। সকলের মুখে এক কথা : আজ ফিলিয়াস ফগের আসবার দিন। রাস্তায়ঘাটে এত ভিড় হলো যে যানবাহন সমস্তই গেলো বন্ধ হয়ে। পুলিশ এসে চারদিকে কড়া পাহারা বসালে, যাতে কোনো গোলযোগ না-হয়।

রিফর্ম ক্লাবের সভ্যরা বিকেলবেলাতেই ক্লাব-ঘরে এসে হাজির হয়েছিলেন। আটটা বেজে কুড়ি মিনিটের সময় আন্দ্রে স্টুয়ার্ট বললেন : আর পঁচিশ মিনিট বাদেই নির্দিষ্ট সময় অতিক্রান্ত হবে। কই, মিস্টার ফগ তো এলেন না এখনও!

ফ্লানাগেন শুধোলেন : লিভারপুলের শেষ ট্রেন ক-টায় লণ্ডনে আসে?

র‍্যাল্‌ফ বললেন : সাতটা তেইশ মিনিটে। তার পরের ট্রেন রাত্রি বারোটার আগে আসে না।

স্টুয়ার্ট তখন বলতে লাগলেন : তাহলেই দেখুন, ফগ যদি সেই সাতটা তেইশের ট্রেনেই আসতেন, তাহলে এতক্ষণে আমরা তাকে নিশ্চয়ই এখানে দেখতে পেতুম। কাজেই বাজিটায় আমারই জিত।

ফলেস্টিন বললেন : অত ব্যস্ত হবেন না। মিস্টার ফগের রীতি-নীতি তো জানাই। আছে আপনাদের। তার মাথাটা সবসময় তেমন ঠিক থাকে না বটে, কিন্তু তিনি যে সব কাজ ঘড়ির কাঁটায়-কাঁটায় করেন, সেটা তো আপনারা জানেন। তিনি যদি ঠিক শেষমুহূর্তেও এসে হাজির হন, আমি কিন্তু তাতে একটুও অবাক হবো না।

ফ্লানাগেন বললেন : ওঁর প্রস্তাবটাই তো একটা পাগলামো। যতই তিনি ঘড়ির কাটা ধরে কাজ করুন না কেন, পথে বেরুলেই তো হাজার ফ্যাচাং। কোনো-না-কোনো অভাবিত কারণে দু-একদিন দেরি হবেই। তাহলেই তো মিস্টার ফগের সব বন্দোবস্ত উলটে যাবে।

র‍্যাল্‌ফ বললেন : তবে আর কী! কালই বারিং-এর গদি থেকে মিস্টার ফগের টাকাগুলো তুলে-আনা যাক।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্টুয়ার্ট বললেন : আর পাঁচ মিনিট!

ফলেস্টিন বললেন : আর কেন? জয় তো আমাদেরই হলো, আসুন এখন খেলা যাক। ঐ দেখুন, পাঁচ মিনিটের দু-মিনিট গেলো।

তাঁরা খেলবার জন্যে হাতে তাশ তুলে নিলেন। কিন্তু দেয়ালের ঘড়ি থেকে চোখ কিছুতেই ফিরতে চাইলো না। তারা জানতেন যে বাজিতে তারাই জিতবেন, তবুও সময় যেন আর কাটতে চাচ্ছে না। তাশ শাফল করতে-করতে র‍্যাল্‌ফ বললেন : আর মোটে দু-মিনিট!

হঠাৎ বাইরের বিপুল লোকারণ্য থেকে সাংঘাতিক হট্টগোল শুরু হলো। চমকে উঠলেন সবাই, শুধু কাপাগলায় সুলিভান বললেন : আর একমিনিট!

এক… দুই… তিন… চার… পাঁচ… ত্রিশ সেকেণ্ড গেলো। ফিলিয়াস ফগ এলেন না। চল্লিশ গেলো, পঞ্চাশ সেকেণ্ড গেলো… তখনও এলেন না ফগ। আর মাত্র দশ সেকেণ্ড। ফ্লানাগেন গুনতে লাগলেন : এক, দুই, তিন, চার….

বাইরে হৈ-চৈ তুলকালাম হয়ে উঠলো। অত হৈ-চৈ কেন?

পাঁচ. ছয়. সাত…

ফ্লানাগেন আট বলবার আগেই হঠাৎ খুলে গেলো ক্লাব-ঘরের দরজা। উত্তেজিত জনতার আগে-আগে বিজয়গর্বে ঘরে ঢুকলেন ফিলিয়াস ফগ। সবাইকে হাসিমুখে নমস্কার জানিয়ে উদাত্তগলায় বললেন : আমি এসেছি!

 

তবে কি সত্যিই এলেন ফিলিয়াস ফগ? সকলে সবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখলেন, সত্যিই ফিলিয়াস ফগ—সেই ভাবলেশহীন সৌম্য প্রশান্ত মূর্তি।

পাঠকের বোধহয় মনে আছে, সেদিন রাত্রি আটটা পাঁচ মিনিটের সময় পাসপার্তু বিয়ের বন্দোবস্ত করবার জন্যে বিশপের কাছে গিয়েছিলো। বিশপের ওখানে গিয়ে মিনিট পনেরো তাকে বসে থাকতে হলো শুধু-শুধু, কারণ বিশপ তখন বাইরে গিয়েছিলেন।

আটটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের সময় উন্মাদের মতো বিশপের বাড়ি থেকে বেরুচ্ছে। পাসপার্তু। দৌড়দৌড়দৌড়! প্রাণপণে সে দৌড়চ্ছিলো। তিন মিনিটের মধ্যেই সে বাড়ি এসে পৌঁছেছিলো।

রুদ্ধকণ্ঠে ফগকে সে বললে : কাল বিয়ে হতে পারে না!

কেন?

কাল রোববার!

না—সোমবার।

আজ শনিবার! আপনার ভুল হয়েছে! আমরা ঠিক সময়ের চব্বিশ ঘণ্টা আগেই এসে পৌঁছেছি। আর দশ মিনিট মাত্র সময় আছে। আপনি চলুন! আর-কোনো কথা না-বলে ফগকে টানতে-টানতে রাস্তায় নিয়ে গেলো সে, একটা ট্যাক্সিতে উঠে ড্রাইভারকে বললে : রিফর্ম ক্লাব। জলদি! জলদি! হাজার টাকা বখশিশ!

 

ফগের এ-রকম ভুল কেন হয়েছিলো? দিন গুনতেই কী ভুল করেছিলেন?

এর জবাব কিন্তু খুবই সোজা। নিজের অজান্তেই ফগ অল্প-অল্প করে চব্বিশ ঘণ্টা সময় অগ্রবর্তী হয়েছিলেন। লণ্ডন থেকে যাত্রা করা অব্দি বরাবর তিনি পুবদিকে আসছিলেন কাজেই মোটের উপর একদিন বেড়েছিলো। যদি পশ্চিম থেকে চলতেন তবে তাকে একদিন পিছিয়ে পড়তে হতো। বরাবর পুবদিকে যেতে-যেতে ফগ ক্রমে দক্ষিণ মেরুর কাছে এসে পড়েছিলেন। কাজেই প্রত্যেক ডিগ্রিতে দিন চার মিনিট করে ছোটো হচ্ছিলো। সুতরাং তিনশো ষাট ডিগ্রিতে মোটের উপর চব্বিশ ঘণ্টা অগ্রবর্তী হয়েছিলেন।

আরো খোলশা করে বলতে গেলে বলতে হয়, ফগ পুবদিকে এগুতে-এগুতে আশিবার সূর্যকে দেখেছিলেন মাথার উপর, আর ঠিক সেইটুকু সময়ের মধ্যেই তার বন্ধুরা লণ্ডনে বসে সূর্যকে দেখেছিলেন ঊনআশিবার। এতেই একদিনের গণ্ডগোল হয়েছিলো।…

সেই আশ্চর্য বাজির কাহিনী তাই এবারে শেষ করতে হয়। কারণ ফিলিয়াস ফগের গলায় এখন দুলছে জয়মাল্য—ফগই বাজি জিতেছেন। সঙ্গে-সঙ্গে বাজির গল্পও তো শেষ হয়ে যেতে বাধ্য। নয়-কি?