১৪শ অধ্যায়
সঙ্কুলযুদ্ধ-কৌরবপক্ষীয় বিন্দ-অনুবিন্দ বধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর মহাধনুর্দ্ধর মহাবীর কর্ণ নতপর্ব্বশরনিকরদ্বারা পাণ্ডবসেনাগণকে নিপীড়িত করিতে লাগিলেন; পাণ্ডবেরাও কোপাবিষ্ট হইয়া কর্ণের সম্মুখে কৌরব সৈন্যগণকে সংহার করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন সূতপুত্র সূৰ্য্যরশ্মিসমপ্রভ কর্ম্মার [অস্ত্রনির্ম্মাণকারী কর্ম্মকার-কামার] পরিমার্জ্জিত নারাচাস্ত্ৰদ্বারা পাণ্ডবসেনাগণকে নিহত করিতে লাগিলেন। মাতঙ্গগণ কর্ণের নারাচপ্রহারে ম্লান ও অবসন্ন হইয়া ভীষণ শব্দ করিয়া চতুর্দ্দিকে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিল। হে মহারাজ! এইরূপে পাণ্ডবসেনাগণ সূতপুত্রকর্ত্তৃক নিপীড়িত হইলে মহাবীর নকুল মহারথ কর্ণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। ভীমসেন দুষ্কর কার্য্যকারী অশ্বত্থামাকে ও সাত্যকি কেকয়দেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দকে নিবারণ করিলেন। তখন রাজা চিত্রসেন সমাগত শ্রুতকর্ম্মার প্রতি, প্রতিবিন্ধ্য বিচিত্রধ্বজ শরাসনশোভিত চিত্রের প্রতি, দুর্য্যোধন ধর্ম্মনন্দন যুধিষ্ঠিরের প্রতি ও ধনঞ্জয় ক্রুদ্ধ সংশপ্তকগণের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্ন কৃপাচার্য্যের সহিত, অপরাজিত শিখঞ্জী কৃতবর্ম্মার সহিত, মহাবীর শ্রুতকীৰ্ত্তি শল্যৈর সহিত এবং প্রতাপশালী মাদ্ৰীসূত সহদেব আপনার পুত্র দুঃশাসনের সহিত মিলিত হইলেন। ঐ সময় কেকয়দেশীয় বিন্দ ও অনুবিন্দ সাত্যকিকে এবং সাত্যকিও ঐ বীরদ্বয়কে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন। নাগদ্বয় যেমন প্রতিদ্বন্দ্বী মাতঙ্গের উপর দন্তাঘাত করে, তদ্রূপ কেকয়দেশীয় ভ্রাতৃদ্বয় সাত্যকির বক্ষঃস্থলে দৃঢ়তর শরাঘাত করিতে লাগিলেন। তখন সাত্যকি হাস্যপূর্ব্বক শরবর্ষণে দশদিক সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহাদিগকে নিবারিত করিলেন। বীরদ্বয় সাত্যকির শরে নিবারিত হইয়া ক্রোধভরে শরনিকর নিক্ষেপপূর্ব্বক তাঁহার রথ আবৃত করিয়া ফেলিলেন। মহাযশস্বী শিনিপুঙ্গব তদ্দর্শনে সেই বীরদ্বয়ের শরাসন, ছেদনপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে সুতীক্ষ্ণ শরজালে নিবারণ করিলেন। তখন তাঁহারা সত্বর অন্য শরাসন গ্রহণ করিয়া সাত্যকিকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া সংগ্রামে বিচরণ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের কঙ্কপত্রান্বিত [পাখাযুক্ত—কাকের পাখার ন্যায় পাখাওয়ালা] স্বর্ণমণ্ডিত শরজাল দশদিক আলোকময় করিয়া নিপতিত হইতে লাগিল। ভ্রাতৃদ্বয়ের শরনিকরে কিয়ৎক্ষণমধ্যে সংগ্রামভূমি তিমিরাচ্ছন্ন হইল। অনন্তর সাত্যকি সেই ভ্রাতৃদ্বয়ের ও তাঁহারা সাত্যকির শরাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন যুদ্ধদুর্ম্মদ যুযুধান সত্বর অন্য চাপ গ্রহণপূর্ব্বক জ্যাযুক্ত করিয়া সুতীক্ষ ক্ষুরপ্রদ্বারা অনুবিন্দের মস্তকচ্ছেদন করিলেন। সমরনিহত শম্বরাসুরের মস্তক যেরূপ ভূমিসাৎ হইয়াছিল, তদ্রূপ সেই অনুবিন্দের কুণ্ডলমণ্ডিত মস্তক ভূতলে নিপতিত হইল। তদ্দর্শনে কেয়গণের শোকের আর পরিসীমা রহিল না।
“তখন মহারথ, বিন্দ ভ্রাতার নিধনদর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া সত্বর শরাসনে জ্যারোপণপূর্ব্বক শরনিকরে সাত্যকিকে নিবারণ করিতে লাগিলেন এবং অবিলম্বে তাঁহাকে সুবর্ণপুঙ্খ শিলানিশিত যষ্টিশরে বিদ্ধ করিয়া ‘থাক থাক’ বলিয়া তৰ্জন করিয়া পুনরায় তাঁহার বাহু ও ঊরুদেশে অসংখ্য শর নিক্ষেপ করিলেন। সত্যবিক্রম সাত্যকি বিন্দের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষতকলেবর হইয়া পুষ্পিত কিংশুকবৃক্ষের ন্যায় শোভমান হইলেন। তখন তিনি হাস্যপূর্ব্বক সত্বর পঞ্চবিংশতিবাণে কেকয়কে বিদ্ধ করিলেন। তৎপরে তাঁহারা পরস্পর পরস্পরের উৎকৃষ্ট কোদণ্ড দ্বিখণ্ড এবং অশ্বগণ ও সারথিকে নিহত করিয়া ফেলিলেন, পরিশেষে রথপরিত্যাগপূর্ব্বক শতচন্দ্রভূষিত চর্ম্ম ও অসি গ্রহণ করিয়া মণ্ডলাকারে বিচরণ করিয়া অবিলম্বে অসিযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া পরস্পরের বিনাশে সাতিশয় যত্ন করিতে লাগিলেন। দেবাসুরসংগ্রামে খড়্গধারী জম্ভাসুরও পুরন্দরের যেরূপ শোভা হইয়াছিল, এক্ষণে মহাবীর সাত্যকি ও বিন্দ খড়্গ ধারণপূর্ব্বক সেইরূপ শোভা ধারণ করিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে মহাবীর সাত্যকি খড়াঘাতে কেকয়রাজের চর্ম্ম দ্বিধা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবীর কেকয়রাজও যুযুধানের শত শত তারাসঙ্কুল চর্ম্ম ছেদন করিয়া কখন মণ্ডলাকারে বিচরণ এবং কখন বা গমন ও প্রত্যাগমন করিতে লাগিলেন। তখন মহাবীর সাত্যকি সত্বর বক্রহস্তে সেই রণচারী তরবারিধারী কেকয়রাজকে দ্বিধা ছেদন করিয়া ফেলিলেন। বৰ্মধারী মহাধনুর্দ্ধর কৈকয় শস্ত্রাঘাতে ছিন্ন হইয়া বজ্রাহত অচলের ন্যায় ধরাতলে নিপতিত হইলেন।
“হে মহারাজ! মহারথ সাত্যকি এইরূপে কেকয়রাজ বিন্দকে নিহত করিয়া সত্বর যুধামনুর রথে আরোহণ করিলেন এবং তৎপরে যথাবিধি সুসজ্জিত অন্য এক রথে আরূঢ় হইয়া পুনরায় সুতীক্ষ্ণ শরনিপাতে কেকয়সৈন্যগণকে বিদলিত করিতে লাগিলেন। সৈন্যগণ যুযুধানের শরাঘাতে ব্যথিত হইয়া তাঁহাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক চারিদিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।”