রুখ মানববসতির বাইরে, যেখানে বনাঞ্চল শুরু হয়েছে তার গোড়ায় একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে বসেছিল। ক্রীনাকে দেখে সে কোমল গলায় বলল, ক্রীনা! তুমি এসেছ?
হ্যাঁ।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল তুমি আসবে।
অবশ্যই আমি আসব।
তাই আমি এখানে অপেক্ষা করছি। মনে আছে যখন সবকিছু ঠিক ছিল তখন সারা দিন কাজের শেষে আমরা এখানে সময় কাটাতে আসতাম।
মনে আছে।
তোমাকে আমার খুব ভালো লাগত কিন্তু কখনো মুখ ফুটে বলি নি। আমার কেমন জানি সংকোচ হত।
আমি বুঝতে পারতাম।
সবকিছু কেমন জানি হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল।
না। ক্রীনা রুখের কাছে এসে তার হাত স্পর্শ করে বলল, কিছুই শেষ হয় নি।
রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, কী বলছ তুমি? তুমি মনে কর এখনো আমাদের। জীবনের কিছু অবশিষ্ট আছে? আমার জীবনের?
আছে। ক্রীনা রুখকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, আছে।
কী বলছ তুমি ক্রীনা? আমার কাছে আসতে তোমার ভয় করছে না? তুমি জান না আমি আসলে মানুষ নই। কিহিতা আর আরো চার জন তৃতীয় মাত্রার বিস্ফোরক দিয়ে আমাকে হত্যা করতে পারে নি?
আমি জানি।
তা হলে? তা হলে তোমার কেন ভয় করছে না?
কারণ আমি জানি আসলে তুমি রুখ!
রুখ একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, না ক্রীনা আমি রুখ না। আমি মহাজাগতিক প্রাণী। তুমি জান না কী ভয়ঙ্কর নৃশংসতায় আমি কিহিতাকে হত্যা করেছি তার সঙ্গীদের হত্যা। করেছি? তুমি জান না আমি কী ভয়ঙ্করদর্শন, কী কুৎসিত? কী নৃশংস। আমি দেখেছি।
না রুখ, আমি তোমাকে সেই কথাটিই বলতে এসেছি।
কী বলতে এসেছ?
ক্রীনা রুখের হাতে চাপ দিয়ে বলল, আমি তোমাকে বলতে এসেছি যে তুমি কাউকে হত্যা কর নি। তারা নিজেদেরকে নিজেরা হত্যা করেছে।
তুমি কী বলছ বুঝতে পারছি না।
তোমার সাথে যে মহাজাগতিক প্রাণী এসেছে সেটি ভয়াবহ নৃশংস নয়।
সেটি তা হলে কী?
আমরা সেটাকে যেরকম কল্পনা করব তারা ঠিক সেরকম। বুদ্ধিমান এনরয়েডদের কাছে এসেছিল ভয়াবহ বিশাল একটি রোবট হিসেবে। তারা যন্ত্র, তাদের চিন্তা–ভাবনাও রোবটকেন্দ্রিক। তারা ধরে নিয়েছে মহাজাগতিক প্রাণী তাদের বন্ধু নয়, তাদের শত্রু, তাই সেই রোবট এসেছিল অস্ত্র হাতে। ঠিক তারা যেরকম কল্পনা করেছে সেরকম। শত্রু হিসেবে এসে সেই রোবট তাদের ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল।
কিহিতাও ভাবত মহাজাগতিক প্রাণী হচ্ছে ভয়ঙ্কর নৃশংস একটা প্রাণী। অতিকায় সরীসৃপের মতো ক্লেদাক্ত তার দেহ। নিষ্ঠুর তার আচরণ তাই তার সামনে সেই প্রাণী এসেছে ভয়ঙ্কররূপে। এসে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে গেছে। ঠিক যেরকম সে আশঙ্কা করত।
কিন্তু আমি তা ভাবি না। আমার সবচেয়ে যে প্রিয় মানুষটি তাকে তারা নিজেদের কাছে নিয়ে তাকে আবার আমার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে। বুদ্ধিমান এনরয়েডদের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করেছে। আমাকে রক্ষা করেছে। কিহিতার নির্বুদ্ধিতা থেকে রক্ষা করেছে। আমি সেই মহাজাগতিক প্রাণীকে কল্পনা করি ভালবাসার কোমল রূপে। আমার মা যেভাবে গভীর ভালবাসায় আমাকে বুকে চেপে বড় করেছে ঠিক সেভাবে। আমার সামনে যদি সেই মহাজাগতিক প্রাণী আসে আমি জানি সে আসবে ভালবাসার কোমল রূপে। আমি জানি।
রুখ অবাক হয়ে ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল। বলল, তুমি তাই বিশ্বাস কর?
হ্যাঁ। আমি তাই বিশ্বাস করি। তুমি দেখতে চাও সেটি কি সত্যি না মিথ্যা?
রুখ ঘুরে তাকাল। ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যা আমি দেখতে চাই।
তা হলে দেখ।
ক্রীনা তার পোশাকের ভেতর থেকে একটা ধারালো ছোরা বের করে আনে। রুখ কিছু বোঝার আগে হঠাৎ করে সেটা দিয়ে এক পোচ দিয়ে নিজের কবজির কাছে বড় ধমনিটি কেটে ফেলল। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে এল সাথে সাথে, আর্তচিৎকার করে রুখ ক্রীনার হাত ধরে ফেলল, বলল, কী করলে তুমি? ক্রীনা? কী করলে?
মহাজাগতিক প্রাণীকে আমি আনতে পারি না রুখ! মহাজাগতিক প্রাণীকে শুধু তুমিই আনতে পার। ক্রীনা হাত থেকে গলগল করে বের হতে থাকা রক্তের ধারার দিকে সম্মোহিতের মতো তাকিয়ে থেকে বলল, আমাকে যদি এখন যথাযথভাবে চিকিৎসা করা না হয় তা হলে আমি মারা যাব। মানববসতি থেকে আমরা এত দূরে যে সেখানে আমাকে সময়মতো নেওয়া যাবে না।
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। কিন্তু তুমি যদি আমাকে ভালবাস তুমি যদি খুব তীব্রভাবে চাও আমি বেঁচে থাকি তা হলে মহাজাগতিক প্রাণী তোমার ডাকে আমাকে বাঁচাতে আসবে।
রুখ ক্রীনাকে জাপটে ধরে আর্তকণ্ঠে বলল, আমি তোমাকে ভালবাসি। নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসি। ক্রীনা, দোহাই তোমার।
ক্রীনার মুখে ক্ষীণ একটা হাসি ফুটে ওঠে, তুমি চাইলে আসবে। আমি জানি।
রুখ ক্রীনার হাত ধরে রক্তের ধারাকে বন্ধ করার চেষ্টা করতে থাকে। ফিনকি দেওয়া রক্তে তার শরীর রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। সে ভয়ার্ত অসহায় গলায় চিৎকার করে বলল, কী করলে তুমি ক্রীনা? তুমি এ কী করলে? আমি তো চাই তুমি বেঁচে থাক, কিন্তু কেউ তো আসছে না! এখন কী হবে ক্রীনা?
ঠিক তখন কে রুখের কাঁধে হাত রাখল। রুখ চমকে পিছনে ঘুরে তাকাল, সাদা নিও পলিমারের কাপড়ে ঢাকা একজন অপূর্ব সুন্দরী মহিলা তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। রুখের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, দেখি বাছা, আমাকে একটু দেখতে দাও।
রুখ সাথে সাথে উঠে দাঁড়িয়ে জায়গা করে সরে দাঁড়াল। মহিলাটি ক্রীনার কাছে ঝুঁকে পড়ে, তার রক্তাক্ত হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে কোমল গলায় বলে, পাগলী মেয়ে আমার। এরকম করে কেউ কখনো নিজের হাত কাটে?
ক্রীনা অপলক চোখে এই অপূর্ব সুন্দরী মহিলার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মা! তুমি এসেছ?
এসেছি। কথা বলবি না এখন। চুপ করে শুয়ে থাক দেখি। ইস! কী খারাপভাবে কেটেছে!
ক্রীনা উঠে এসে হাত দিয়ে গভীর ভালবাসায় মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলল, মা, আমি জানি তুমি আমার কল্পনা। কিন্তু তাতে কিছু আসে–যায় না। আমার কাছে তুমিই আমার সত্যিকারের মা।
আহ! কী বকবক শুরু করলি–একটু স্থির হয়ে শুয়ে থাক দেখি। রক্তটা বন্ধ করা যায় কি না দেখি।
ক্রীনা আবার শুয়ে পড়ল, মহিলাটি তার হাতের উপর ঝুঁকে পড়লেন, নিও পলিমারের একটুকরা কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলেন, গভীর স্নেহে ক্ষতস্থানে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, ইস! যদি একটু দেরি হত তা হলে কী হত?
কেন দেরি হবে মা? তুমি তোমার মেয়েকে বাচাতে আসবে না?
আমার আর অন্য কাজ নেই ভেবেছিস?
আমি তোমাকে আগে কখনো দেখি নি। একসময়ে ভেবেছিলাম দেখেছি কিন্তু পরে জেনেছি সব আমাদের মস্তিষ্কে বসানো কাল্পনিক স্মৃতি। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা বসিয়েছে। তুমি চিন্তা করতে পার আমার কোনো মা নেই? কোনো মাতৃগর্ভে আমার জন্ম হয় নি!
ক্রীনার মা গভীর ভালবাসায় তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, কে বলেছে তোর মা নেই? এই যে আমি। আমি কি তোর মা নই?
হ্যাঁ, মা। তুমি আমার মা।
রূপবতী মহিলাটি এবারে ঘুরে রুখের দিকে তাকালেন, বললেন, বাছা! তোমার এ কী অবস্থা? গায়ে কোনো কাপড় নেই। কালিঝুলি মেখে আছে!
রুখ হতচকিতের মতো মহিলাটির দিকে তাকিয়ে রইল। মহাজাগতিক প্রাণী ক্রীনা কল্পনা থেকে এই অপূর্ব সুন্দরী মাতৃমূর্তিকে তৈরি করেছে। এটি সত্যি নয় কিন্তু তার খুব বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল যে এটি সত্যি। সে ইতস্তত করে বলল, একটা দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম, গোলাগুলির বিস্ফোরণে
ক্রীনার মা নিজের শরীর থেকে একটুকরা নিও পলিমারের চাদর খুলে রুখের গায়ে জড়িয়ে দিলেন, সাথে সাথে তার সারা শরীরে এক ধরনের আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ল। তিনি রুখের মাথায় হাত দিয়ে নরম গলায় বললেন, আমার এই পাগলী মেয়েটিকে তুমি দেখে রাখবে তো বাছা?
রাখব। রাখব মা।
ক্রীনা অপলক দৃষ্টিতে তার ক্ষণকালের মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে তার বুকের ভিতরে এক ধরনের গভীর বেদনা অনুভব করে। তার মা তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, কিছু ভাবিস না মা সব ঠিক হয়ে যাবে।
মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, আমি কি তোর সাথে মিছে কথা বলব?
কিন্তু কেমন করে সেটা সম্ভব? এই দেখ–রুখের দিকে তাকাও–তার ডি.এন.এ. পর্যন্ত পাল্টে দেওয়া আছে বেস পেয়ার বারোটি। মেতসিসের দিকে তাকাও–বুদ্ধিমান এনরয়েডরা। আমাদের ইচ্ছেমতো তৈরি করে! ইচ্ছেমতো ধ্বংস করে! তুমিই বল এটি কি মানুষের জীবন?
মা মুখ টিপে হাসলেন যেন সে ভারি একটা মজার কথা বলেছে! ক্রীনা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, কী হল? তুমি হাসছ কেন? তোমার কি মনে হচ্ছে এটা হাসির ব্যাপার?
না, পাগলী মেয়ে। এটা মোটেই হাসির ব্যাপার নয় কিন্তু তোরা যত ব্যস্ত হচ্ছিস সেরকম তো নয়।
কী বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি। আয় আমার সাথে।
কোথায়?
আয়, গেলেই বুঝতে পারবি।
মা ক্রীনাকে ধরে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দিলেন। কীনা এখনো খুব দুর্বল, অন্য পাশে এসে রুখ তাকে ধরল। দুজন দুপাশে ধরে সাবধানে হেঁটে যেতে থাকে। বড় পাথরটির অন্য পাশে এসেই ক্রীনা এবং রুখ দেখতে পেল পাথরের গায়ে হালকা নীল পরদার মতো স্বচ্ছ একটি মহাজাগতিক দরজা। ঠিক এরকম একটি দরজা দিয়ে রুখ মহাজাগতিক প্রাণীর জগতে প্রবেশ করেছিল। আয়নার মতো স্বচ্ছ পরদার কাছে দাঁড়িয়ে ক্রীনার মা বললেন, তোরা দুজন আয় আমার সাথে।
ক্রীনা বলল, ভয় করছে মা!
পাগলী মেয়ে! ভয়ের কী আছে? আমি আছি না সাথে?
ক্রীনা তার মাকে জড়িয়ে ধরে। সত্যিই তো তার ভয়ের কী আছে? নিজের কল্পনায় তৈরি মা থেকে আপন আর কী হতে পারে এই জগতে? ক্রীনা এক পা এগিয়ে স্বচ্ছ আয়নার মতো হালকা নীল রঙের মহাজাগতিক দরজা স্পর্শ করল। সাথে সাথে মনে হল কিছু একটা যেন প্রবল আকর্ষণে টেনে লি ভিতরে।
ক্রীনা ভয় পেয়ে ডাকল, মা, মা তুমি কোথায়?
এই যে পাগলী মেয়ে, আমি আছি তোর সাথে।
ক্রীনা হঠাৎ করে দেখতে পায় আদিগন্তবিস্তৃত সবুজ বনভূমি, নীল আকাশ, আকাশে সাদা মেঘের সারি। দূরে নীল পর্বতশ্রেণী, পর্বতের শৃঙ্গে সাদা তুষার। প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্যে হঠাৎ করে ক্রীনার চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে আসে।
পছন্দ হয় ক্রীনা?
হ্যাঁ। মা। কোথা থেকে এল এই জায়গা?
তোদের স্মৃতি থেকে তৈরি করেছি। নিশ্চয়ই পৃথিবীর স্মৃতি! তোদের অবচেতন মনে লুকিয়ে ছিল।
কী হবে এই জগৎ দিয়ে?
পৃথিবীর অনুকরণে নতুন প্রাণী সৃষ্টি হবে এখানে।
সত্যি?
হ্যাঁ। তোর আর রুখের ডি. এন. এ. দিয়ে প্রথম মানুষের জন্ম হবে এখানে।
সত্যি মা?
হ্যাঁ। তোদের ভালবাসায় নতুন মানুষের জন্ম হবে এখানে। নতুন পৃথিবীর জন্ম হবে আবার।
সত্যি, মা? সত্যি?
হা! কী হল পাগলী মেয়ে, কাদছিস কেন তুই?
জানি না মা। আমি সত্যিই জানি না।