মহামান্য থুল বাগানে তার চেয়ারটিতে বসেছিলেন। সূর্য ড়ুবে যাবার পর একটা শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে। তার একটা গরম কাপড় গায়ে দিয়ে বসা উচিত ছিল। দুই হাত বুকের কাছে এনে অনেকটা শিশুর মতো গুটিসুটি মেরে তিনি চেয়ারে বসে রইলেন।
পাশে তথ্যবিজ্ঞানী জুহু দাঁড়িয়েছিল। সে বলল, মহামান্য থুল, এখন আপনার ঘরের ভেতরে চলে যাওয়া উচিত।
মহামান্য থুল বললেন, ঠিকই বলেছ, কিন্তু উঠতে আলস্য লাগছে। বয়স হয়ে গেলে এটি হচ্ছে সমস্যা! সহজ কাজটিও তখন কঠিন।
তাহলে কি আপনার জন্যে একটা গরম কাপড় নিয়ে আসব?
না, না, না, কোনো প্রয়োজন নেই! মহামান্য থুল ব্যস্ত হয়ে বললেন, তুমি বরং চেয়ারটা টেনে বস। তোমার সাথে একটু কথা বলি।
জুহু একটা চেয়ার টেনে মহামান্য থুলের কাছে বসল। মহামান্য থুল দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, পৃথিবীতে খাবারের পরিবহনের কাজটা কী শেষ করা হয়েছে?
করা হয়েছে মহামান্য থুল। আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবে পৃথিবীর একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও খাদ্যশস্যকে পৌঁছে দেয়া হয়েছে।
শুকনো প্রোটিন?
সেটিও।
মৌলিক ওষুধপত্র।
যথেষ্ট পরিমাণে।
চমৎকার।
কেন সেটি করা হল সেটি আমরা কেউ বুঝতে পারছি না। মূল ভাণ্ডার থেকে প্রয়োজনের সময় খাবার পাঠানো অনেক বেশি কার্যকর পদ্ধতি। এখন অনেক জায়গায় নতুন করে শস্য সংরক্ষণের জন্যে ব্যবস্থা করতে হয়েছে। এতো অল্প সময়ে সেটা করা খুব সহজ হয় নি। তারপরেও করেছি–আপনার নির্দেশ সবাই খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছে।
ধন্যবাদ জুহু।
মহামান্য থুল কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, জুহু।
বলুন মহামান্য থুল।
আমরা যে মহাকাশযানটা পাঠিয়েছিলাম তার খবর কী জান?
জানি মহামান্য থুল। জুহু মাথা নেড়ে বলল, তাদের নিয়ে দুঃসংবাদ আছে।
কী দুঃসংবাদ।
সাতজন মহাকাশচারীর মাঝে দুইজন রবোমানব জানার পর মহাকাশযানের মূল কম্পিউটার সাতজন অভিযাত্রীকেই মহাকাশযান থেকে বের করে দিয়েছে।
বের করে দিয়েছে? কোথায়? মঙ্গল গ্রহে।
মহামান্য থুল শিস দেয়ার মতো শব্দ করলেন। মঙ্গল গ্রহ তো থাকার উপযোগী গ্রহ নয়। সেখানে গত শতাব্দীতে তেজস্ক্রিয় এক ধরনের প্রাণী তৈরি করা হয়েছিল। সেই প্রাণীগুলো তো এখনো শেষ হয় নি।
জুহু মাথা নাড়ল, বলল, খুবই ভয়ংকর পরিবেশ। মহাকাশচারীদের বেঁচে থাকার কথা না। সম্ভবত সবাই এর মাঝে মারা গেছে।
মহামান্য থুল মাথা নেড়ে বললেন, যদি সম্ভব হয় তুমি তাদের সাথে একটু যোগাযোগ করতে পারবে?
পারব মহামান্য থুল। যদি তারা বেঁচে থাকে তাহলে পারব।
চমৎকার।
মহামান্য থুল হঠাৎ করে একটা গভীর চিন্তায় ড়ুবে গেলেন। জুহু কী করবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ নিঃশব্দে বসে রইল। তারপর অত্যন্ত দ্বিধান্বিত ভাবে বলল, মহামান্য থুল, আমি কী এখন চলে যাব?
হ্যাঁ, হ্যাঁ নিশ্চয়ই। যাবার আগে শুধু তোমার কাছে একটা জিনিস জানতে চাই।
বলুন মহামান্য থুল।
প্রিসা নগরীর উত্তরে একটা বন আছে না?
আছে মহামান্য থুল।
সেই বনে কী একটা আগুন লাগানো সম্ভব?
জুহু অবাক হয়ে বলল, আগুন লাগনো?
হ্যাঁ।
আপনি আদেশ দিলে অবশ্যই সম্ভব!
কিন্তু কাজটি করতে হবে গোপনে। মহামান্য থুল দুর্বল ভঙ্গিতে হেসে বললেন, কেন এটা করতে চাইছি তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করো না!
আমার খুবই কৌতূহল হচ্ছে, কিন্তু আমি জিজ্ঞেস করব না।
ধন্যবাদ জুহু। তুমি আগামীকাল দুপুরে বনটিতে আগুন লাগিয়ে দিও। আর তার একটু আগে লিন্টাস শহরের নিউক্লিয়ার শক্তি কেন্দ্রের পানি সরবরাহ কেন্দ্রে পাঁচ লিটার তেজস্ক্রিয় আয়োডিন ফেলে আসতে হবে।
পাঁচ লিটার তেজস্ক্রিয় আয়োডিন?
হ্যাঁ।
কাজটি খুবই বিপজ্জনক, কিন্তু আপনি চাইলে অবশ্যই করা সম্ভব। জুহু। খুব কষ্ট করে তার বিস্ময়টুকু গোপন করে বলল, আর কিছু মহামান্য থুল?
হ্যাঁ। আরো কয়েকটা ছোট বড় কাজ। যদি আমার জন্য করে দাও তাহলে খুব ভালো হয়।
আপনি বলুন।
মহামান্য থুল তার পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে জুহুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এই যে এখানে আমি লিখে দিয়েছি! তুমি পড়ে হাসাহাসি করো না!
জুহু বলল, আপনার নির্দেশ শুনে আমি হাসাহাসি করব? কী বলছেন আপনি মহামান্য থুল!
নির্দেশগুলো হাস্যকর সেজন্যে বলছি!
জুহু কাগজের লেখাগুলো পড়ল। সেখানে বিচিত্র বিচিত্র অনেকগুলো নির্দেশ দেয়া আছে। মাজুরা ইলেকট্রিক কোম্পানির ফোরম্যানকে অগ্রিম বোনাস দেয়া, সবুজ পৃথিবী শিশু স্কুলের বাচ্চাদের সকাল দশটায় আর্ট মিউজিয়ামে নেয়া, মাহীরাহদের সুইস গেট খুলে নিচের শুষ্ক অঞ্চলকে প্লাবিত করে দেয়া, বিনোদনের জন্যে আলাদা করে রাখা দুটি উপগ্রহকে অচল করে দেয়া, এরকম অনেকগুলো বিচিত্র নির্দেশ দেয়া আছে। মহামান্য থুলের ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে জুহুর মনে কোনো সন্দেহ নেই বলে সে কাগজে লেখাগুলো পড়ে বিচলিত হল না। মহামান্য থুলের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি নিশ্চিত থাকুন মহামান্য থুল। আপনি যেভাবে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেভাবে প্রত্যেকটা কাজ করা হবে।
ধন্যবাদ জুহু। অনেক ধন্যবাদ।
জুহু মহামান্য থুলকে অভিবাদন জানিয়ে লম্বা পা ফেলে বের হয়ে এল। থুল একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন।