বৃহন্নলা চৌধুরী ও কিরীটীর মধ্যে কথাবার্তা হচ্ছিল।
গতরাত্রে রায়বাহাদুরের নিহত হবার সংবাদ পেয়েই আমি যখন রায়বাহাদুরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করি, সেখানে আপনার কাকা ও আপনাকে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। কিন্তু একটু পরে লক্ষ্য করে দেখি আপনি ঘরে নেই। হঠাৎ ঘর থেকে চলে গিয়েছিলেন কোথায় আর কেনই বা গিয়েছিলেন!
আমার ঘরে কাকা যখন আমার শোবার ঘরে গিয়ে বাবার নিহত হবার সংবাদটা দেন আমি একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর কাকার সঙ্গে সঙ্গেই বাবার ঘরে গিয়ে ঢুকি কিন্তু পরে ঐ ভীষণ দৃশ্য দেখেই সমস্ত মাথাটা যেন কেমন আমার বোঁ বোঁ করে হঠাৎ ঘুরে উঠল। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। তাড়াতাড়ি আবার ঘর থেকে বের হয়ে যাই, তারপর আবার দালাল সাহেব ডেকে পাঠাতে ফিরে আসি।
রাত্রি সাড়ে তিনটে থেকে আপনার কাকা আপনাকে ডাকতে যাওয়া পর্যন্ত আপনি কি করছিলেন?
গতকালই তো আমি বলেছি, শরীরটা আমার বিশেষ ভাল না থাকায় সন্ধ্যে থেকেই প্রায় আমি আমার ঘরেই ছিলাম। বিছানাতেই শুয়ে ছিলাম, তবে ঠিক ভাল ভাবে ঘুমোইনি। একটা আধো ঘুম আধো জাগা অবস্থা।
একটা কথা বৃহন্নলাবাবু, আপনি কি সত্যিই আপনার বাবার কোন উইল আছে বলে জানেন?
যতদূর জানি বাবার কোন উইল নেই। আর থাকলেও আমার সেটা জানা নেই মিঃ রায়।
আপনি বলতে পারেন, আপনার কাকা দুঃশাসন চৌধুরীর প্রতি আপনার বাবার ঠিক মনোগত ভাবটা কেমন ছিল?
কিরীটীর প্রশ্নে স্পষ্টই বোঝা গেল বৃহন্নলা চৌধুরী যেন একটু ইতস্ততই করছেন। জবাবটা দিতে কেমন যেন একটু সংকোচ ও দ্বিধা বোধ করছেন।
অবশ্য আপনি যতটুকু জানেন, ততটুকুই আমি জানতে চাই আপনার কাছ থেকে বৃহন্নলাবাবু!
কাকা তো মাত্র মাসখানেক হল ফিরে এসেছেন। এই সময়ের মধ্যে তেমন বিশেষ কিছু আমার চোখে পড়েছে বলে তো কই আমার মনে পড়ছে না। তবে ইতিমধ্যে কাকা এখানে আসবার পরই একদিন রাত্রে, জানি না কি কারণে বাবা ও কাকা দুজনের মধ্যে একটা বচসা ও কথা-কাটাকাটি হয়েছিল এবং পরদিন সকালেই এখান থেকে মাইল পনের দূরে একটা কোলিয়ারীতে কাকা চলে যান।
সে বচসার বিষয়বস্তুটা কি ছিল কিছুই জানেন না?
না।
সে ঘরে আর কেউ ছিল?
না।
আপনি সে কথা জানলেন কি করে?
কি একটা স্টেটের কাজেই এ সময় বাবার ঘরের দিকে যাচ্ছিলাম। দরজার কাছাকাছি যেতেই শুনলাম কাকা খুব যেন রাগত ভাবেই চেঁচিয়ে কথা বলছেন।
শুনতে পেয়েছিলেন তাঁর কোন কথা? মনে করে বলতে পারেন কিছু?
হ্যাঁ, একটা কথা কেবল শুনতে পেয়েছিলাম, কাকা বলছিলেন, এ তোমার অত্যন্ত অন্যায়। এভাবে বঞ্চিত করবার তোমার কোন আইনগত অধিকার নেই জানবে। তার পরই কাকা দেখলাম ঘর থেকে দ্রুত চঞ্চল পদেই যেন বের হয়ে গেলেন। বাবার ঘরে ঢুকে দেখি বাবাও যেন তখন বেশ উত্তেজিত, কিন্তু তাঁর সঙ্গে ঐ সম্পর্কে আমার কোন কথাই হয়নি সে-সময়ে।
হুঁ। আপনার প্রতি আপনার কাকার মনোগত ভাবটা তত ভাল বলেই মনে হল, তাই না?
হ্যাঁ, কাকা আমাকে চিরদিনই একটু বেশী স্নেহ করেন। বিদেশে থাকাকালীন একমাত্র আমার কাছেই তিনি যা চিঠিপত্র মধ্যে মধ্যে দিতেন।
মৌচীর মাইকার বিজনেস তুলে দিয়ে বাঙলাদেশে ফিরে আসবার জন্য আপনার কাকাকে শুনলাম আপনার বাবাই নাকি পীড়াপীড়ি করেছিলেন, কথাটা সত্যি।
হ্যাঁ। বাবা কাকাকে একমাত্র ভাই বলে চিরদিনই বিশেষ একটু স্নেহ করতেন। কাকার বিদেশ যাওয়াটা শুনেছিলাম বাবার অমতেই হয়েছিল।
বিদেশ যাওয়ার আপনার কাকার কোন কারণ ছিল বলে জানেন?
বিদেশ যাওয়ার আগে কাকা বাবার ব্যবসাতেই কাজ করতেন। তারপর সঠিক আমি জানি না আসল ব্যাপারটা কি, তবে মনে হয় ব্যবসা-সংক্রান্ত ব্যাপারেই বোধহয় কি একটা গোলমাল হয়। তারপরই কাকা বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে মৌচীতে তাঁর এক বন্ধু মাইকার বিজনেস করছিলেন সেই বিজনেসে গিয়ে যোগ দেন। এবং শুনেছি ব্যবসাতে নাকি তাঁর খুব উন্নতি হয় এবং যথেষ্ট অথগমও হতে থাকে।
একটা কথা, আশা করি কিছু মনে করবেন না বৃহন্নলাবাবু, আপনার কাকার বর্তমান আর্থিক অবস্থাটা কেমন বলতে পারেন?
সঠিক আমি জানি না, তবে নগদ টাকা বেশ কিছু তাঁর হাতে আছে বলেই আমার তো ধারণা।
কেন আপনার এ ধারণা—বলতে আপনার আপত্তি আছে কি কিছু?
এখানে এসে অবধিই তিনি আমাকে প্রায়ই বলেছেন কোডামতে আবার তিনি মাইকার বিজনেস বড় করেই শুরু করবেন। ইতিমধ্যে দুএকবার কোমায় গিয়ে ঘুরেও এসেছেন।
আচ্ছা আপনি আপনার পিতার হত্যার ব্যাপারে কাউকে সন্দেহ করেন কি?
না। ধীর সংহত কণ্ঠে জবাব দিলেন বৃহন্নলা চৌধুরী।
আপনি এবারে যেতে পারেন মিঃ চৌধুরী। আপনার দাদু অবিনাশবাবুকে যদি এ ঘরে একবার দেখা করতে আসতে বলি, আসবেন কি?
যদি মনে কিছু না করেন মিঃ রায়, আমার মনে হয় যদি তাঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চান তাহলে তাঁর ঘরে গেলেই বোধ হয় ভাল হয়, কারণ তাঁকে ডাকলে যে তিনি আসবেন আমার তো মনে হয় না।
ডাঃ সানিয়ালের ঘর থেকে বের হয়ে ডাঃ সমর সেন কতকটা অন্যমনস্ক ভাবেই সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু অন্যমনস্ক ভাবে—সিঁড়ি যেখানে বাঁক নিয়েছে, সেখানে এসে পৌঁছতেই যেন হঠাৎ চমকে ওঠেন।
ঠিক সামনেই তাঁর দাঁড়িয়ে রুচিরা। বোধ হয় নীচে গিয়েছিল। সেই সময় সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে আসছিল।
রুচিরা!
রুচিরা ডাঃ সেনের ডাকে মুখ তুলে তাঁর দিকে তাকায় একটু যেন চমকেই।
তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল রুচিরা।
নীচে বাইরের ঘরে এস।
চল।
রুচিরাকেই অতঃপর অনুসরণ করে ডাঃ সেন পূর্বরাত্রের সেই নীচেকার বিরাট খালি ঘরটার মধ্যে গিয়ে প্রবেশ করলেন।
কাল রাত্রে দেখা গিয়েছিল ঘরের জানলা-দরজাগুলো বন্ধ, কিন্তু আজ দেখা গেল জানলাগুলো খোলা। একটা খোলা জানালার সামনে দুজন এসে দাঁড়ায়।
রুচিরাই প্রথমে কথা বলে মৃদু হেসে, তোমাকে কাল রাত্রে বাড়িতে দেখেও কেন না চেনবার ভান করেছি তাই জিজ্ঞাসা করবে তো?
হ্যাঁ, তাছাড়া—
তাছাড়া আবার কি?
তাছাড়া সমীরবাবুর সঙ্গে যে অলরেডি তোমার বিয়ের সম্বন্ধ ঠিক হয়ে গেছে সেইটাই বা এতদিন জানাওনি কেন?
রুচিরা ডাঃ সেনের কথার জবাব দেয় না। চুপ করেই থাকে।
ডাঃ সেন আবার বলেন, এইজন্যই যে এতদিন বার বার তোমার কাছে প্রোপোজ করা সত্ত্বেও আমায় কোন জবাব দাওনি তাও বুঝলাম, কিন্তু এর তো কোন প্রয়োজন ছিল না। রুচিরা!
রুচিরা তথাপি চুপ।
কি, জবাব দিচ্ছ না যে?
যে জবাবই এখন দিই না কেন, তুমি তো বিশ্বাস করবে না সমর।
বিশ্বাস করব না!
না। তারপর একটু থেমে আবার বলে, কার কাছে তুমি কি শুনেছ তা জানি না, তবে আমি ভেবেছিলাম তুমি অন্ততঃ আমাকে এতদিনে বুঝতে পেরেছ।
হ্যাঁ, বুঝেছি বৈকি। বড়লোক স্বামীর লোভ তুমি ছাড়তে পারনি বলেই গরীব আমাকে নিয়ে তুমি এতদিন ধরে খেলা খেলছ!
সমর!
হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই। কিন্তু এর কি প্রয়োজন ছিল বলতে পার রুচিরা দেবী?
তোমার আর কোন কথা যদি না থাকে তো এবারে আমি যাব!
যাবে বৈকি। খেলাটা যখন জানতে পেরে গেছি–
সমর সেনের কথাটা শেষ হল না, ঘরের মধ্যে কিরীটীর গলা শোনা গেল, সমরবাবু!
দুজনেই চমকে অদূরে উপস্থিত কিরীটীর দিকে তাকায়। কিরীটী যে ইতিমধ্যে নিজের ঘর থেকে বেরুবার মুখে সিঁড়ির সামনে ওদের দূর থেকে দেখে একেবারে কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে ওদের কথাগুলো শুনেছে সেটা দুজনের একজনও টের পায়নি।
কিরীটী অতঃপর বলল, আপনারা দুজনেই একটু ভুল বুঝেছেন দুজনকে। ডাঃ সেন, আপনার এটা অন্ততঃ বোঝা উচিত ছিল যে রুচিরা দেবীর মা এখানে বর্তমান!
আমি জানি তা মিঃ রায়, ডাক্তার সেন বললেন।
কিরীটী আবার যেন কি বলতে যাচ্ছিল, এবার রুচিরা বাধা দিল, মিঃ রায়!
না রুচিরা দেবী, মিথ্যে মনগড়া মনোমালিন্যের বোঝ টেনে লাভ নেই। শুনুন ডাঃ সেন, ওঁর মা সমীরবাবুর সঙ্গে ওঁর বিয়ের সব কথাবাতা ঠিক করলেও ওঁর মত পাননি–বলেই হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলে, ঝগড়াটা তাহলে এবার মিটিয়ে ফেলুন, আমি চলি।
কিরীটী স্থানত্যাগ করে।